#রিপোস্ট
#অন্তরালের_কথা
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ২৯
.
.
” এই তুমি শুনতে পাচ্ছো না? অতল কি তোমায় ফোন দিয়েছিল? কোনো খবর পেয়েছ অতলের? ”
তানহা এ পর্যায়ে মুখ খুলে টলটলে চোখে ভাঙা গলায় বলল,
” অতল…অতল.. ”
” কি হয়েছে অতলের? ”
তানহা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” কিছুক্ষণ আগে এ…একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এসেছিল আ..আমার নাম্বারে। আর বলেছে প্রায় ৪০ মিনিট আগে আব্দুল্লাহপুর তুরাগ নদীর ব্রিজের উপর থেকে…”
” থেমে গেলে কেন, কি হয়েছে বলো? বলো তানহা। ”
তানহা চোখ দুটো বন্ধ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” ব্রিজের উপর থেকে একটি মাইক্রো বাসের ধাক্কায় অতল ছিটকে নদীতে পড়ে যায়। ”
কথাটি শোনামাত্র মরিয়ম বেগম এক চিৎকার দিয়ে মেঝেতে বসে ভেঙে পড়ে আর্তনাদে। তিহান মা’কে জড়িয়ে ধরে বুঝাতে বুঝাতে বলল,
” মা তুমি কাঁদছ কেন? তুমি কি ভুলে গিয়েছ ভাইয়া সাঁতারের দিক থেকে ওস্তাদ? তুমি দেখে নিও ভাইয়া ঠিক সাঁতরে পারে উঠে গিয়েছে কিন্তু কেউ জানে না। ”
” আমার মন যে মানছে না। আমার বুকের ধন, আমার অতল! আল্লাহ.. তুমি কি করে পারলে আমার জীবনে এ সর্বনাশ দিতে? আমি তোমার কি ক্ষতি করেছিলাম? আমার বুকের ধনকে তোমার এতো ভালো লাগল আমার কোল খালি করে নিয়ে যাচ্ছো? ”
” মা তুমি প্লিজ এভাবে কেঁদো না। ও বাবা বাবা! তুমি একটু মা’কে বুঝাও না এরকম করলে যে মা অসুস্থ হয়ে যাবে। আর ভাবি…ভাবিকে কে সামলাবে মা এরকম করলে? ”
অতলের বাবা যেন ঘোরে চলে গিয়েছে। মুখের সব ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। তিহান তাকে কিছু বললেও সে যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছে না কিংবা শোনার চেষ্টাও করছে না। শুধু তাকিয়ে আছে অতলের ঘরের চারিপাশে। এমনসময় তানহা মেঝে থেকে উঠে চোখের জল মুছে বাবার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
” বাবা, আমায় একটু নিয়ে যাবেন আপনার ছেলের কাছে? আর না’হয় স্বল্প সময়ের জন্য অনুমতি দিন আমি একা গিয়ে দেখে আসি। ওকে সাথে করে নিয়ে আসি। ও বাবা! কথা বলুন। যাবো আমি?”
তানহার চাপা আর্তনাদের গলার কথাগুলো শুনে আনিস খন্দকার তানহার মাথায় হাত রেখে চোখের জল ফেলে বললেন,,
” চলো মা। ”
তিহান পাশ থেকে বলল,
” দাঁড়াও বাবা আমরাও যাবো। ”
.
রাত ১ টা ২১ মিনিট। আব্দুল্লাহপুর ব্রিজের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে তানহা। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে বর্ষাকালের ভরা তুরাগ নদীর পানে। অবশ্য নদী বললে ভুল হবে এ কেবল তুরাগ নদীর একটি শাখা মাত্র। তাইতো কোত্থাও কোনো ঢেউয়ের চিহ্নটুকুও নেই। শুধুমাত্র ডুবুরিদের সাঁতার দেয়া, বিভিন্ন জিনিসপত্র ওঠা নামায় যেটুকু ঢেউয়ের সৃষ্টি হচ্ছে সেটুকুই রয়েছে। প্রায় ঘন্টা পাঁচেকের মতো হতে চলেছে অতলের নিখোঁজ হবার সময় কিন্তু এখনো কোনো খবর পাওয়া যায়নি। সবাই ধরেই নিয়েছে, না শিউর.. একেবারে শিউর হয়ে গিয়েছে অতল আর বেঁচে নেই। এমনকি যেই জায়গায় পড়েছিল সেই জায়গা তেও নেই। হয়তো ভেসে ভেসে কোথাও চলে গিয়েছে কিংবা পানির তলদেশের কোনো একপ্রান্তে পড়ে আছে যেটা তাদের খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব! তারপরও ডুবুরিরা খুঁজে বেড়াচ্ছে তানহার অনুরোধ ও বুক ফাটা আর্তনাদ দেখে।
তানহা ফোলা ফোলা দুটো চোখ দিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে অতলকে নদীর চারপাশে। যদি একটিবারের জন্য দেখতে পায় সেই আশায়। ঠিক সেসময় একটি ২৫ কি ২৬ বছরের ছেলে এসে তানহাকে বলল,
” পানিতে যে ডুবেছে তার আপনি কি হোন? ”
দৃষ্টি না ফিরিয়ে চোখের জল মুছে ভাঙা গলায় তানহা বলল,
” স্ত্রী… তার স্ত্রী আমি। ”
” আপনার নাম-ই কি… তানহা? ”
তানহা চমকে গিয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল,
” আপনি জানলেন কি করে আমার নাম? কে বলেছে আপনাকে? ”
” আমাকে কেও বলেনি তবে মোবাইলে দেখেছি। ”
ছেলেটি একটি মোবাইল তানহার দিকে এগিয়ে ধরতেই তানহা মোবাইলটি লুফে নিয়ে গলার স্বর ছেড়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,
” এই মোবাইল তো অতলের! আপনি কোথায় পেলেন এই মোবাইল? আপনি কি জানেন অতল কোথায়? আমার অতল কি বেঁচে আছে? আমাকে একটিবার নিয়ে যাবেন ওর কাছে? আমি আপনার পায়ে ধরি প্লিজ আমাকে একটু নিয়ে যাবেন? ”
” দেখুন প্লিজ আপনি এভাবে বলবেন না। আমি আসলে জানি না আপনার হাজবেন্ড কোথায়। ”
” তাহলে মোবাইল… মোবাইল আপনার কাছে গেল কি করে? ”
” সেতো আমি ব্রিজের সাইড থেকে কুড়িয়ে পেয়েছি। আপনার হাজবেন্ড গাড়ির ধাক্কায় ছিটকে নদীতে পড়ার সময় হাত ফসকে মোবাইলটি ব্রিজের সাইডে পড়ে যায়। সেসময় আমি ফোনটি তুলে হাতে নেই আর তখনি দেখি তানহা নামের কেউ ফোন দিচ্ছে কিন্তু আমি রিসিভ করতে পারছিলাম না। তারপর আবার মোবাইলে ওই একই নাম্বার থেকে ফোন এসেছিল তখন এই মোবাইল থেকে আমার মোবাইলে নাম্বারটি তুলে আমি ফোন দিয়ে আর এখানে আসার কথা বলি। ”
” ওহ্! ”
” জ্বি। আচ্ছা, তাহলে আমি আসছি। ”
ছেলেটি চলে গেল। তানহা কিছু না বলে পুনঃরায় ঘুরে দাঁড়ালো নদীটির দিকে। অতলের মোবাইলটি নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ধরে এক চিৎকার দিয়ে বলল,
” অতল……..”
.
হালকা বাসন্তী রঙের সেলওয়ার কামিজ পড়ে বাগানের এক কোণে হাঁটু ভাজ করে ঘাসের উপর বসে আছে তানহা। ভাজ করা হাঁটুর উপর দু’হাত রেখে ঘাড় কাত করে তাকিয়ে আছে সন্ধ্যের মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে। পেছন থেকে একটি হাত তানহার কাঁধে লাগতেই তানহা ঘাবড়ে গেল। চোখেমুখে আতংকের ছাপ ফুটিয়ে পেছনে ফিরে বলল,
” কে? ”
” আমি,তোমার মা। ”
” ও মা আপনি! আমিতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ”
মরিয়ম বেগম ঘাসের উপর বসতে বসতে বললেন,
” ভয় পাওয়ার কি আছে পাগলী মেয়ে? আমরা ছাড়া এ বাড়িতে কারো সাহস আছে ঢুকবার! ”
” না, মা কিন্তু আপনি এখানে কষ্ট করে আসলেন কেন? আমাকে ডাক দিলেই তো আমি চলে আসতাম। ”
” জানি, তাও আসলাম আর কি… ”
” ওহ্! ”
তানহার উদাসীন মন দেখে মরিয়ম বেগম বললেন,
” দেখতে দেখতে বেলা কম গড়ায়নি তানহা। অতল আমাদের ছেড়ে গিয়েছে দেড় বছর হতে চলেছে। কিন্তু তুমি…তুমি তো সেই আগের মতোই রয়ে গিয়েছ! এভাবে কি জীবন চলে মা? ”
” আমার ইচ্ছানুযায়ী জীবন না চললে তাহলে কীভাবে জীবন চলবে আপনারাই বলে দিন।”
” অতল যেরকম তোমার স্বামী তেমনি আমারও ছেলে। জন্ম দিয়েছিলাম ওকে। প্রথম মায়ের অনুভূতি, প্রথম মা ডাক শুনেছি ওর কাছ থেকে কিন্তু সেই আমি মা হয়ে ওকে ছাড়া দিব্যি আছি। আমার কি কষ্ট হয় না? তোমার থেকে হাজার গুন বেশি কষ্ট হয় আমার যে নাড়ী ছেড়া ধন। সেই নাড়ী ছেড়া ধনকে ভরা নদীর মাঝে ছেড়ে এসেও তোমাদের জন্য ভালো আছি। সেই তোমরাই যদি বিষন্নতা আর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে দিনের পর দিন পার করো আমার বুকের ভেতর কেমন করে তোমরা কি জানো? ”
” কিন্তু মা, এই বিষন্নতাই যে আমার সুখ। সুখ ছাড়া কি মানুষ বাঁচতে পারে?তাহলে আমি কি করে বাঁচবো বলুন? এই বিষন্নতার মাঝে যে আমি আপনার ছেলেকে খুঁজে পাই। তাহলে কি করে এর থেকে নিজেকে সংযত রাখি? ”
” কিন্তু এভাবে যে জীবন চলে না। ”
” তাহলে কি করতে বলছেন আমায়? আপনার ছোট ছেলেকে আপন করে জীবন পার করতে বলছেন? এ দেড় বছরে কমতো বলেননি কিন্তু আমার দেয়া প্রতি বারের উত্তর কি আপনাদের কাছে গ্রহণ যোগ্য হয় না? ”
” ভুল কিছুতো বলিনি। এরকম তো না যে তুমি সারাজীবন একা থাকবে। আমার তিহানকে না করো কিন্তু কোথাও না কোথাও তো তোমায় বিয়ে করতে হবে। নাহলে যে মানুষ আমাদের কথা শুনাবে, ‘মেয়ের বাবা-মা নেই বলে এই অল্পবয়সী মেয়ের কোনো গতি হয়নি।” তাই বলছি কি মা তোমায় তো মেয়ের থেকে কোনো অংশে কম দেখিনি তাই আমি চাইছি তোমায় অন্য কোথাও না দিতে। চিরজীবনের জন্য আমাদের কাছে রেখে দিতে। এক সন্তানকে হারিয়েছি আরেকটি সন্তানকে হারালে আমি যে নিঃস্ব হয়ে যাবো। আমার যে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। ”
“আমাকে দুমুঠো ভাত দিতে কি আপনাদের বেশি খরচ হবে মা? ”
” এসব কি বলছ তুমি তানহা? তোমার মাথা ঠিক আছে? তোমাকে খাবার খাওয়াতে আমাদের খরচ হবে সেকথা আমরা ভাববো তুমি এটা ভাবলে কি করে? ”
” এটা আমি কখনো ভাবিনি মা আর না ভাবার চেষ্টা করেছি। তবে এখন আমি বাধ্য হচ্ছি এ বিষয়টি ভাবতে আপনাদের কথানুযায়ী। ”
” আমাদের কথানুযায়ী মানে? ”
” আচ্ছা মা, আমি কি কোনোদিন আপনাকে বলেছি আমি পুনঃরায় বিয়ে করব? আমার কথাবার্তায় কিংবা আমার চালচলনে কি আপনারা কেউ বুঝতে পেরেছেন যে,আমার ইচ্ছে আছে নিজেকে নতুন সম্পর্কে জড়াবার? ”
” আমরাতো সেটা একবারও বলছি না…”
” তাহলে? তাহলে কেন বলছেন মা? মানুষের কথা শুনতে হবে সেজন্য বলছেন? আচ্ছা মা, মানুষের কথা শোনাটা আপনাদের কাছে বড় নাকি আমার সুখ? আপনারা না আমাকে মেয়ের চোখে দেখেন, মেয়ের মতো ভালোবাসেন তাহলে আমার সুখের কি কোনো মূল্য নেই আপনাদের কাছে? ”
” দেখো মা আমরা কিন্তু তোমার সুখের জন্যই বলছি। আজ না’হয় শরীরে বল আছে বলে নিজের কাজ নিজে করে জীবন পার করলে কিন্তু কাল..কাল যখন আমি, তোমার বাবা কেউই বেঁচে থাকব না তুমিও বার্ধক্যজনিত রোগে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকবে তখন তোমায় কে দেখবে ভেবেছ? ”
” কিন্তু মা…”
” আমার কথা শেষ হয়নি তানহা। আমি আগে বলি তারপর না-হয় তুমি বলো।আমার অতলের একটি স্বপ্ন ছিল তার ব্যবসাটিকে ঘিরে। আর আমার যতটুকু মনে হয় সেই স্বপ্নের কথা তুমিও জানো। কিন্তু আজ সেই স্বপ্ন কেবল স্বপ্নের স্থানেই জায়গা পেল বাস্তবে নয়।”
” আপনারা চাইলে কিন্তু মা সেই স্বপ্নটিকে পূরণ করতে পারতেন। ”
” কি করে করব বলো? তোমার বাবা একজন বয়স্ক মানুষ সে’কি পারবে চট্টগ্রামে একা থেকে ব্যবসাবাণিজ্য করতে? যে ব্যবসার সে কিছুই বুঝে না তাও আবার সেই ব্যবসা। আর তিহান সেতো কখনোই করবে না। তিহান চায় না তার একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে তার ভাইয়ের স্বপ্নে কোনো প্রকারের আঁঁচ লাগুক। তিহান চায় তার ভাই যাকে বিশ্বাস করতো অর্থাৎ ম্যানেজার যে ছিল সেই ব্যবসাটি সামনে এগিয়ে নিয়ে যাক। তিহানের ধারণা সেই পারবে অতলের স্বপ্নকে বাস্তবরূপ দিতে। যতো বিশ্বস্তই হোক না কেন আমার অতলের স্বপ্ন,অতলের ব্যবসা আজ অন্যের হাতে। এটা কি আমার ভালো লাগে? ”
” এখানে আমার কি করনীয়? আমি কি মেয়ে হয়ে যাবো ব্যবসা সামলাতে? ”
” তোমাকে তো সেই কথা বলিনি। ”
” তাহলে? ”
” এখন না’হয় তিহান ব্যবসার দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না কিন্তু ভবিষ্যতেও যে নিবে না এমনতো কোনো কথা নেই তাই না? দেখো মা, আমরা যা বলছি কিংবা করতে চাচ্ছি শুধুমাত্র তোমার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই করতে চাচ্ছি। যেটা তোমার বাবা-মা বেঁচে থাকতে করতো কেবল সেটাই করতে চাচ্ছি। ”
” আমি বুঝতে পেরেছি আপনি কি বলতে চাচ্ছেন। কিন্তু মা আমিও একটি কথা ক্লিয়ার করে বলে দিচ্ছি আমি বিয়ে করবো না। আগেও বলেছি করবো না, এখনো বলছি করবো না আর ভবিষতেও বলবো করবো না। তাই প্লিজ এ বিষয়ে আর কেউ আমার সাথে কোনো কথা বলবেন না। ”
হঠাৎ করে পেছন থেকে তিহান গম্ভীর গলায় বলল,
” মা! ”
” তিহান তুই? কখন এসেছিস? আর এই সন্ধ্যেবেলা বাগানেই বা কেন? ”
” এসব কথার উত্তর না’হয় পড়ে দেয়া যাবে। এখন তুমি ঘরে যাও আমার উনার সাথে কিছু কথা আছে। ”
” কিন্তু…”
” প্লিজ মা। ”
” আচ্ছা। ”
তানহা তাকিয়ে আছে তার শাশুড়ির যাওয়ার পথে। চোখের আড়াল হতেই তানহা ক্ষিপ্র গলায় তিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” খেলা শুরু করে দিয়েছ তাই না? ভেবেছিলাম তুমি অন্য আর পাঁচটা ছেলের মতো নও কিন্তু তুমি আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে দেখিয়েই দিলে তুমিও সবার মতো। একজন লোভী প্রকৃতির মানুষ। যার কাছে নিজের সুখই সুখ অন্যের সুখ কিসে তা পরোয়া করার ইচ্ছেটুকু নেই। ”
” কি বলছ এসব তানহা? ”
.
.
চলবে…..