অন্তরালে ভালবাসা পর্ব ১১

#অন্তরালে_ভালবাসা
১১
#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা_হঠাৎ_বৃষ্টি

রাতের আধার কেটে দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে একটু একটু করে।কুয়াকাটাতে সূর্যোদয় দেখার জন্য গঙ্গামতির চরে ঝাউবনের উদ্দেশ্য অহিন আরিশাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছে সমুদ্রের পথ ধরে।
অহিন এখানে আসার পরই মোটরসাইকেল ভাড়া করে এসেছে তবে একটি নয় দুটি। কারণ এখানে মোটরসাইকেল ভাড়া দেয় যারা তারা নিজেই যাত্রীদের পৌঁছে দিয়ে আসে।তাই অহিন দুটো ভাড়া করেছে একটিতে বাইকের চালকরা যাবে।অন্যটিতে অহিন আরিশাকে নিয়ে যাবে।দুটো বাইকের ভাড়া দিবে বলেছে অহিন। বাইকের পেছনে বসায় আরিশার পরনে শাড়ির আঁচল বাতাসে উড়ছে।কিছুটা দূরত্বে বসেছে আরিশা।অহিন বলে আরু ধরে বস আমাকে নয়তো পড়ে যাবি।
এখানে রাস্তা তেমন ভালো না।
আরিশা তখন চারপাশের প্রকৃতি দেখতে ব্যাস্ত।অহিনের কথা তার কানে যাচ্ছে না।তাছাড়া বাতাসের শব্দ অনেক বেশী। অহিন বাইক দাড় করিয়ে বলে এই আরু ধরে বস আমাকে নয়তো পড়ে যাবি,আরু আমরা স্বামী স্ত্রী না, বন্ধু শুধু মনে এটা মনে রেখে ফ্রী ভাবে আগের মত চল প্লিজ।আরিশা মুখ ভেঙচি কেটে বলে ধুর! জানি তোরে কে স্বামী মানে আজাইরা!

অহিন মুচকি হাসে।স্নিগ্ধ হাসি সেই হাসি!
যেতে যেতে তারা দেখতে পায় বিশাল ঝাউবন সারি সারি ঝাউগাছ। দেখতে বেস লাগছে।চারপাশে আবছা আলো,আবছা অন্ধকার। যেহেতু এখনো সুর্য উঠেনি তাই ভোরের শুকতারারা আকাশে স্পষ্ট! এই এক অসম্ভব সুন্দর সময়। চারপাশে আরও অনেক পর্যটক ছুটে যাচ্ছে এই সাগর কন্যার সুর্যদয় দেখতে।কেউ ভ্যানে কেউ মোটরসাইকেলে।কেউ বা হেঁটে। অহিনের কাঁধে আরিশা হাত রেখেছে। নিজের অজান্তেই অহিনের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে।অহিনের এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে নাই বা পেলাম আরিশাকে, এই যে ছোট ছোট পাগলামি আর ছোট ছোট স্পর্শ এটাই বা কম কিসের।কিন্তু পরক্ষনেই রাফিনের কথা মনে হতেই বুক হাহাকার করে উঠে। এসবে শুধু তারই অধিকার।

এসব ভাবতে ভাবতেই তারা পৌঁছে যায় গঙ্গামতির চরের ঝাউবনে। সেখান থেকেই সূর্যাস্ত ভালো দেখা যায়।
আরিশা নেমে পড়ে বাইক থেকে অহিন তার পাশে দাঁড়ায়। অনেক উৎসুক জনতা অপেক্ষা করছে সমুদ্রের পেট চিড়ে কিভাবে সূর্য উঠে তা দেখার জন্য!
মুহুর্তের মাঝে সমুদ্রের গর্ভে থেকে সূর্যের মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এই দৃশ্য সত্যি মুগ্ধ করার মত!মনে হয় সুর্য আকাশে নয়।এই সমুদ্রের বুকেই ছিলো!

লাল টিপের মত সূর্য সমুদ্রের বুক থেকে এক অপূর্ব রূপ নিয়ে উদিত হয়। আর এই সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়ে গঙ্গামতির বেলাভূমিতে। সাগরের জল ছেড়ে ধীরে ধীরে যেন জেগে উঠেছে ভেজা বালির এই সৈকত, এখানকার বালি এতোই নরম যে খালি পায়ে আলতো করে হাঁটলেও পায়ের স্থায়ী ছাপ পড়ে থাকে পরবর্তী জোয়ার না আসা পর্যন্ত। তার উপরে জমে থাকা পানিতে সোনালী
১৮ কিলোমিটার সুবৃস্তিত সৈকতের বুকে দাড়িয়ে ভোরের রক্তিম সূর্যদয় দেখতে দেখতে যে কেউ হারিয়ে যাবে অন্য এক দুনিয়ায়।যেখানে প্রকৃতির সাথে কথা বলা যায়।প্রকৃতির প্রেমে পড়া যায়!

আরিশা বলে প্রকৃতি এতোটা সুন্দর যেনো বুকের মাঝে কাঁপন ধরায় অহিন!
অহিন বলে,আসলেই আরু আমরা সারাক্ষণ জীবনে কি পাইনি কি পেয়েছি তার হিসেব করে সময় কাটিয়ে দেই।কিন্তু এসবের বাইরে যে পৃথিবীকে জানার আছে তা আমরা ভুলে যাই।একটাইতো জীবন এই জীবনে দুঃখ থাকবে এটাতো পূর্ব নির্ধারিত। তারপরও আমরা আমাদের সাথে ঘটে যাওয়া কষ্টগুলোকে কেনো যেনো মনে মাঝে পুষে রাখতেই ভালবাসি। কি হয় যদি মনের কষ্টগুলোকে এক পাশে রেখে কয়েকটা দিন এমনভাবে প্রকৃতিতে মিশে যাই।যদি নিজেকে কিছুটা সময় ভালো রাখতে পারি তাতে ক্ষতি কি!
এই যে আমাদের জীবনে রাফিন নেই এই কষ্টটা কি এই কয়েকটা দিন ভুলে এই প্রকৃতিতে মিশে যেতে পারিনা আমরা আরু?
রাফিন তো একটা সময় ঠিক ফিরে আসবে।এটা আমি বিশ্বাস করি।
আরিশা বলে,হুম ঠিক বলেছিস দোস্ত। এভাবে তো কখনও ভেবে দেখিনি।আসলে ছোট থেকে আমাদের শিখিয়ে দেয়া হয়েছে কিভাবে ভালবাসার মানুষদের অনুপস্থিতিতে শুধু কষ্ট পেতে হয়, সেটা হোক পরিবার কিংবা নাটক, সিনেমায়।কখনও এটা শিখায়নি যেকোন পরিস্থিতিতে একটু ভালো থাকার চেষ্টা করাই যায় এতে দোষের কিছু না।
সুর্যদয় দেখে দুই বন্ধুর সুন্দর দিনটি শুরু হয়। আরিশা বলে রাফিন থাকলে এটা আমাদের হানিমুন হতো তাই না অহিন?

মুহুর্তেই অহিনের মনের আকাশে যে সুর্যদয় হয় তা আরিশার কথা শুনে অন্ধকার হয়ে যায়।অহিন সব জেনেও এই একটা জায়গায় নিজেকে বুঝাতে পারে না।আরিশাকে মনের কষ্ট বুঝতে না দিয়ে বলে,আরে আরু তোর হানিমুন হয়নি এখনতো কি হয়েছে! বন্ধুর সাথে ফানিমুন তো করাই যায়!
আরিশা বলে ফানিমুন?
অহিন বলে, হুম!চলো বন্ধু সমস্ত কষ্ট ভুলে দুজনে উপভোগ করি বর্তমানকে।এখানে না থাকবে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক, না থাকবে অন্য কোন দায়বদ্ধতা।
আরিশা অহিনের সাথে সুর মিলিয়ে বলে চলো বন্ধু!
এভাবেই শুরু হয় দুই বন্ধুর নতুন একটি দিনের।যেদিন গুলোতে তারা অতীতকে ভুলে যেতে চায় কিছুটা মুহুর্তের জন্য। কিন্তু ভাগ্য সেটা কি হতে দিবে এই প্রশ্ন রয়েই যায়?

আরিশা বলে গঙ্গামতি নামটি যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি আরো আকর্ষণীয় এই চরের নৈসর্গিক সৌন্দর্য। স্বচ্ছ জলের নীল ধারা আর প্রকৃতির কারুকাজ খচিত প্রশস্ত বেলাভূমি এই চরকে দিয়েছে এক মোহনীয় রূপ।
কল্পনার সৌন্দর্যকেও হার মানায় সবুজে ঘেরা শান্ত নির্জন স্নিগ্ধ সৈকতের গঙ্গামতির চর। প্রকৃতি যেন তার সকল সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে এই চরের বুকে।
গঙ্গামতির সর্বত্রই যেন সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি।

অহিন বলে এখানে আরও অনেক কিছু আছে দেখার মত।তোকে আজ সব দেখাবো।হাটতে পারবি তো?

আরিশা বলে হুম পারবো। তুই জানিস না আমি কতটা এডভেঞ্চার প্রিয়?
অহিন বলে হুম জানি।

অহিন বলে,এখানে রয়েছে কয়েকটি স্বচ্ছ নীল জলের লেক আর প্রকৃতির শোভায় মন্ডিত বিশাল বেলাভূমি।
আরিশা সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে নীল জল হাতে নিয়ে দুগালে লাগিয়ে কিছু একটা অনুভব করলো। অহিন সেদিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হলো। ভালবাসার মানুষের মুখে ক্ষনিকের জন্য হলেও হাসি দেখলে তা পৃথিবীর সব সুখকে হার মানিয়ে দেয়।
তারপর বনের দিকে তাকিয়ে আরিশা জিজ্ঞেস করে এগুলো কি গাছ?
অহিন বলে,কেওড়া, ছইলা, গেওয়া, বাইনসহ কয়েক’শ প্রজাতির বৃক্ষ সবগুলোর নাম জানিনা।আরিশা মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে বলে,এ যেন চারদিকে সবুজের বিপ্লব । এই সবুজের কারখানায় বিশাল বিশাল গাছের গায়ে ঝুলে থাকা পরগাছার সৌন্দর্য দেখেও মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।

অহিন বলে আরু ধর এখন রাফিন তোর সামনে এসে দাড়ালো কি করবি তুই?

আরিশা অন্যমনস্ক হয়ে বলে,দেখবো দুচোখ ভরে।এই এতোটা সময়ের তৃষ্ণা মেটাবোরে অহিন।রাফিনকে খুব মিস করছি খুব!

অহিন বলে,তুই এতোটা ভালবাসিস রাফিনকে নিশ্চয়ই রাফিন তোর কাছে চলে আসবে খুব তাড়াতাড়ি। আর তাছাড়া আমি সিহাবকে বলে দিয়েছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাফিনকে খুজে নিয়ে আসতে।
আরিশা বলে হুম তাই যেনো হয়।এখন চল ওদিকে যাই।

অহিন আরিশা সুর্যদয়ের পরে গঙ্গামতির চর ঘুরে দেখে নির্জন কোলাহলশূন্য জায়গায় পাখির কিচিরমিচির ডাক যেন সুন্দর সকালটাকে আরও মোহনীয় করে তুলছে।
গঙ্গামতির সর্বত্রই যেন সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি।

আরিশা হাটতে হাটতে খেয়াল করলো সমস্ত বেলাভূমি জুড়ে লাল কাঁকড়ার ছোটাছুটি করছে।
অহিন আরিশার মন হয়ে উঠে আরো প্রফুল্ল। অহিন বলে ওয়াও দেখছিস,এই কাঁকড়াগুলো ঠিক যেন নিপুণ হাতে পুরো সৈকত জুড়ে আলপনা এঁকে রেখেছে। যা এই চরের সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
আরিশা বলে হুম ঠিক বলেছিস। আরিশা একটু অন্যমনস্ক হতেই বুঝতে পারলো তার পায়ে চিনচিনে ব্যাথা করছে।অহিন পায়ের দিকে তাকাতেই দেখলো একটা লাল কাকড়া আরিশার পায় জড়িয়ে আছে।আরিশার পায়ে কাকড়ার ডানার আঘাতে ক্ষত হয়ে গেছে।রক্ত বের হচ্ছে অহিন মুহুর্তেই বালিতে বসে পড়ে আরিশার পা নিজের কোলের উপর রেখে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করে। কাকড়াটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে ফেলে দেয়।আরিশার খুব ব্যাথা করলেও সে তা বুঝতে দিচ্ছে না অহিনকে।
অহিনের পকেটে রুমাল ছিলো সেটা বের করে অহিন আরিশার পায়ে বেধে দেয়।আর আরিশাকে অসাবধানতার জন্য হাজারটা কথা শোনায় বরাবরের মত।অবশ্যই আরিশা কোন কালেই অহিনের কোন কথা পাত্তা দেয়নি।তাই আজ দিবে এটা আশাও করা যায় না।কিন্তু বিপত্তি হলো আরিশা হাটতে পারছে না।
অহিন আরিশাকে কোলে তুলে নেয়।আরিশা বলে করে কোলে নিচ্ছিস ক্যান?
চুপ করে থাক আরু,অহিন জবাব দেয়।
আরিশা চুপ করে যায়।

আরিশা ব্যাথায় চোখ বুজে আছে। অহিন আরিশাকে দেখছে আর ভাবছে তোকে দেখার স্বাদ আমার কোনদিন মিটবে না।মনে আজীবন এভাবেই তোকে দেখে যাই।কিন্তু তুই তো রাফিনের শুধু রাফিনের।
এমন সময় আরিশা চোখ মেলে।অহিন অন্যদিক তাকিয়ে যায়।আরিশা বলে, বাই দা রাস্তা, তুই কি আমাকে দেখতেছিলি?
অহিন বলে,তোর মত পেত্নীরে আমার দেখার শখ নাই মামা।এমনিতেই কি ওজন আবার মুখে পটর পটর শুরু হইছে।

এই তুইই,,, সবটা শেষ করার আগে আরিশার মনে হলো তাদের পেছন থেকে কেউ একজন সরে গেলো।
পেছনে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলো না।আরিশা বলে,অহিন আমার মনে হচ্ছে কেউ আমাদের ফলো করতেছে।প্লিজ অহিন আমার ভয় করতেছে।
কাল রিসোর্টে তুই যখন বাইরে গেছিলি।তখন আমার মনে হলো তখনও কেউ আমাদের ফলো করছে।

অহিন হেসে বলে,তুই অযথা ভয় পাচ্ছিস আরু।কে আমাদের ফলো করবে তাও আবার এখানে?
তোর মাথায় সব আজেবাজে চিন্তা।আরিশাকে বুঝ দিলেও অহিনের মনে এই নিয়ে কাল থেকেই ভয় হচ্ছে। কারণ এমনটা যে শুধু আরিশার মনে হয়েছে তা নয় অহিনেরও মনে হয়েছে।

তবে কি ঘটতে চলেছে এই ত্রিভুজ প্রেমের সম্পর্কে?

চলবে,,,

এটা কোন ছোট গল্প না।এটা বড় গল্প।আশাকরি ধৈর্য নিয়ে পাশে থাকবেন।
ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here