অন্তহীন পর্ব -১১+১২

#অন্তহীন💜
#পর্ব_১১
#স্নিগ্ধা_আফরিন

বিষ্ময়ে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে প্রহনের দিকে তাকিয়ে আছে ছেলে টা। চৈতি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। কিছুই বলার নেই তার।যা বলার সব কিছুই তার আর্মি সাহেব বলে দিবে।

ছেলেটা এক নজর চৈতির দিকে তাকিয়ে প্রহনের দিকে তাকালো।কন্ঠে বিষ্ময় নিয়ে বললো,
“উনি বিবাহিত? বিশ্বাস হচ্ছে না আমার।”

প্রহন মুচকি হেসে ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে বললো,
“আমি ওর হাসব্যান্ড।”

প্রহনের কথা শুনে ছেলেটার মুখের ভাব বদলে গেল।কত আশা করে চৈতির সামনে এসে ওর প্রশংসা করলো সিঙ্গেল জীবনের ইতি টানবে বলে। কিন্তু কী একটা অবস্থা? মেয়েটার ও বিয়ে হয়ে গেছে?প্রেম করার আগেই ছোট খাটো একটা ছ্যাকা খেলো ছেলেটা।
মাথা নিচু করে “সরি” বলে প্রহন কে পাশ কাটিয়ে দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করে। ছেলেটার এহেন কান্ডে হাসে প্রহন।
চৈতির হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চৈতির উদ্দেশ্যে বললো,
“আম্মুর কাছে থাকতে পারো না? এত দূরে একা দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?”

মিসেস ইয়াসমিন প্রহনদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন,”আমারই খেয়াল ছিল না। অনেক দিন পর পুরোনো সখীকে দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে গেছিলাম।”

প্রহন চৈতির হাতটা শক্ত করে ধরলো। রেদোয়ান চৌধুরীর কাছে যেতে যেতে বললো,
“সুন্দরী পিচ্চি বউ আমার। একটু দেখে রাখবা না? বিয়ে বাড়ীতে কত ছেলেই আছে। পটানোর চেষ্টা করবে। শেষে বউ যদি আমার পটে যায় তখন এই আমার কী হবে ভেবে দেখেছো?”

প্রহনের কথা শুনে চৈতি ধীর গলায় উত্তর দিলো,
“আমি এমন না।”

“আচ্ছা। তাহলে আপনি কেমন ম্যাডাম? বলেন একটু শুনি।”

“জানি না।”

“আহ প্রহন! মেয়েটা কে আর কিছু বলিস না।”মিসেস ইয়াসমিনের কথার প্রতি উত্তরে প্রহন বলে,
“পিচ্চি কে না। আমি তোমাকে বলেছি কথা গুলো।”

“বাদ দে এই সব কথা।”
মিসেস ইয়াসমিন এর কন্ঠে বিরক্তি। প্রহন ও আর কথা বাড়ালো না।

হলুদের পর্ব শেষ হতে বেশ রাত হবে।রেদোয়ান চৌধুরীর শরীর টা খারাপ। বেশি দেরি না করে ১০টার দিকেই বাড়ি ফিরে আসে প্রহনরা।শাড়ি পড়ে থাকতে দম আটকে যাচ্ছিল চৈতির।শাড়ি বদলে সেলোয়ার কামিজ পরে বিছানায় বসে বড় বড় শ্বাস নিতে লাগলো। চৈতির এহেন কান্ডে প্রহন হেসে বললো,
“হিমালয় পর্বতের চূড়ায় উঠে ছিলে মনে হয়।এত হাঁপাচ্ছো কেন পিচ্চি?”

চৈতির সোজা সাপ্টা উত্তর,
“শাড়ি পড়তে অবস্ত না আমি।”

“তাহলে পড়েছো কেন?বলে ছিলাম না শাড়ি বদলে অন্য কিছু পড়ে যাওয়ার জন্য? তখন বড় মুখে কী বলেছো,’শাড়ি সামলাতে না পারলে আপনাকে সামলাবো কী করে?’আম্মু আব্বুর সামনে কথা টা বলে কতটা লজ্জায় ফেলেছিলে আমাকে বুঝতে পারছো তুমি?”

প্রহনের সব কথা মাথার উপর দিয়ে গেলো চৈতির। কিছুই ঠিক মতো বুঝলো না। প্রহন বিছানায় শুয়ে পড়লো।বিড় বিড় করে বললো”আহ শান্তি।”

“পিচ্চি লাইট অফ করে ডিম লাইটটা অন করে শুয়ে পড়ো। অনেক রাত হয়ে গেছে।”

প্রহনের কথা মতো চৈতি লাইট অফ অন করে বিছানায় গিয়ে প্রহনের কাছ থেকে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো।পাশ ফিরে প্রহন এক নজর চৈতির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।আজ রাতেও ঘুমানো হবে তার।ঘুমালেই বিপত্তি।জেনে শুনে বিপত্তি ঘটালে এতে মহা পাপ হবে। ভীষণ পাপ!

বিছানার সাথে বন্ধুত্ব টা ছোট বেলা থেকেই খুব গাঢ় চৈতির। বিছানায় আয়েশ করে গা এলিয়ে দিলেই চোখ জুড়ে নিদ্রা এসে ভীড় জমায়।নেত্র জোড়া বন্ধ হয়ে আসে আপনাআপনি।দ্রুতই পাড়ি জমায় তন্দ্রার দেশে।

গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন নবিনা কিশোরীর ঘুমন্ত আনন জুড়ে ছেয়ে আছে এক রাশ মুগ্ধতা। সেই মুগ্ধতা দেখার সৌভাগ্য সবার হয় না। সত্যিকারের প্রেমিক পুরুষেরা তার প্রিয়তমার সব কিছুতেই মুগ্ধতা খুঁজে পায়। তাদের কথা বার্তা, ঘুমন্ত মুখোশ্রি, তাদের ছোট ছোট ভুল গুলো, তাদের হাঁটার ছন্দে ও যেনো থাকে এক আকাশ সমান ভালো লাগা।প্রেমিকের মন অলিন্দের সব টুকু জায়গা জুড়ে প্রেমিকার বসবাস থাকে।
আচ্ছা,স্বামী নামক প্রেমিকের চোখের ঘুম যে নবিনা কিশোরী কেড়ে নিয়েছে সে কথা কী কখনো জানা হবে তার?নাকি অজানায় হারিয়ে যাবে সেই সত্য গুলো? দূরে বহুদূর যেখান থেকে খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়বে।
প্রহন চৈতির দিকে তাকাতে চায় না। মস্তিষ্ক ঝংকার দিয়ে উঠলো,তাকাবি না প্রহন।এতে অন্যায় হবে।ঘোর অন্যায়!
অন্য দিকে বেপরোয়া মন বলে উঠে,
একটা বার একটা অন্যায় করলে কিচ্ছু হবে না প্রহন। কিচ্ছু না। মস্তিষ্কের বারনের উপর এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে মনের ডাকে সাড়া দিলো প্রহন।কাত হয়ে ঘুমন্ত মানবির আননের দিকে নেত্র জোড়া নিবিদ্ধ করে।
মন এক প্রশান্তি তে শান্ত হয়ে উঠে।আর মস্তিষ্কে ধপ করে আগুন জ্বলে উঠে। আঁখি জোড়া বন্ধ করতেই দম আটকে আসে প্রহনের।নেত্র জুড়ে নিদ্রার আনাগোনা ও নেই। শোয়া থেকে উঠে বসে প্রহন। ঘুম হবে না তার।
কী এক অনলে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে প্রহন? সেই উত্তর জানা নেই তার।আজ কাল নিজেকে বড্ড অচেনা মনে হয়। সেই গম্ভীর,রাগি প্রহন টা যেনো বিয়ের দিনই কোথায় হারিয়ে গেছে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে প্রহনের কাছ থেকে।এ কী অদ্ভুত পরিবর্তন।একদম নতুন এক প্রহন হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করছে সে।একদম নতুন!
চৈতির ঘুমন্ত মুখোশ্রীর দিকে তাকিয়ে প্রহন হতাশ কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমি শুধু তোমার মুখ পানে চেয়েই ঠের পাই কিশোরী, আমি আর আমার মাঝে সহস্র বছর যাবৎ নাই।মরেছি আমি! ভীষণ জ্বরে পুড়ে মরেছি।”
অজস্র শব্দের ভীড়ে, কয়েক টা শব্দ খুঁজে নিয়ে প্রহন একটি বাক্য সাজালো,”কেমন করে এমন হলো জানি না।”
নারী,যার কাছে পুরুষের কঠিন হৃদয় এক নিমিষেই গলিয়ে ফেলার অস্ত্র আছে।
সেদিন রাতে ও ঘুম হলো না প্রহনের। ঘুম না হওয়ার বিশেষ কোনো কারণ নেই।একটাই কারণ “চৈতি”।

বিভাবরী সবে তমস্রীর গাঢ় রেশ কাটিয়ে আদিত্যর রঙিলা প্রভায় মৃদু রাঙিন হয়ে উঠছে। দখিনা হাওয়ায় এলোমেলো হচ্ছে ঘুমন্ত মানবীর অবাধ্য চুল। ইচ্ছে করেই দখিনের জানালাটা মেলে দিয়েছে প্রহন। পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে।ভোর হয়েছে যে। প্রহন চৈতির দিকে এগিয়ে গেল। খুব যত্ন করে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুমন্ত চৈতিকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে।
প্রভাতের শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশের মতো কন্ঠে চৈতি কে ডাকদিল।
“পিচ্চি উঠো।ফজরের নামাজ আদায় করে নাও।উঠো পিচ্চি।”

প্রহনের ডাক চৈতির শ্রবণেন্দ্রিয়তে পৌঁছাতেই ঘুম ভেঙ্গে যায়।পিট পিট করে চক্ষু জোড়া মেলতেই প্রহনের মুখ খানি এত কাছ থেকে দেখে ঘাবড়ে গেল চৈতি। প্রহন তা বুঝতে পেরে সরে দাঁড়ালো। হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে চৈতির দিকে না তাকিয়েই রাশ ভারি গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“অযু করে ফজরের নামাজ আদায় করে নাও।”
চৈতি কে কথা টা বলা শেষ করেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল প্রহন।
তন্দ্রা ভাব কাটেনি চৈতির। দুই হাত দিয়ে চোখ কচলাতে লাগলো। ঘুম ছাড়ানোর চেষ্টা। ঘুমের ঘোরেই হেলেদুলে হেঁটে ওয়াস রুমে চলে গেল। চোখের মধ্যে পানির ঝাপটা দিতেই ঘুম চলে গেল।
.
নামাজ পড়ে শেষ করে বেলকনিতে যায়।চার দিকে এখনো আবছা আলোয় আলোকিত। সূর্য এখনো তেজ দেখায়নি তার।দেওয়াল ঘড়িটা হঠাৎ করেই টুং টুং আওয়াজ করতে থাকে। চৈতি রুমে আসে।সবে মাত্র সকাল ছয়টা বাজে।
বেলকনিতে আবারো চলে গেল চৈতি।অন্তরীক্ষ জুড়ে নীলের আধিপত্য।মেঘ নেই বললেই চলে। আকাশ একে বারে পরিস্কার। চৈতির হঠাৎ খেয়াল হলো,
প্রহন সেই কখন রুম থেকে বেরিয়ে গেল এখনো ফিরেনি। কোথায় গেল? নিজের সাথেই নিজে প্রশ্ন করলো চৈতি।
ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা টানলো। সরদার সাহেবের শেখানো শিক্ষা। মাথায় কাপড় দেওয়া।অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করে চৈতি। রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে পা রাখতে যাবে তখনই কেউ বলে উঠে,
“কোথায় যাচ্ছো এত সকালে?”

চকিতে পেছন ফিরে তাকায় চৈতি। কাউকে দেখতে পেল না।আবারো কানে ভেসে আসলো,
“তোমার ডান পাশের রুমের ভেতরেই আছি আমি।রুমে যাও পিচ্চি।”

প্রহনের কথা শুনলো না চৈতি। বরং একটা আবদার করে বসলো।
“আপনার সাথে হাঁটতে নিয়ে যাবেন? সকালের এই সময়টায় খালি পায়ে হাঁটতে আমার ভীষণ ভালো লাগে।”

চৈতির কথার উত্তরে প্রহনের বেপরোয়া মন বলে উঠে,
“মনে জমিনে খালি পায়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছো।সে খবর রাখো চঞ্চলা হরিণী?”#অন্তহীন💜
#পর্ব_১২
#স্নিগ্ধা_আফরিন

স্নিগ্ধ সকালের নরম ঘাসের উপর চরণ ফেলে হাঁটতে ব্যস্ত কিশোরী। তার থেকে কিছু টা দূরে এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে সেই চরণের দিকে তাকিয়ে আছে প্রহন। বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে। ভীষণ ভালো লাগছে!
ঘাসের উপর হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বসে পড়ে চৈতি। প্রহন দ্রুত এগিয়ে আসে।ডান পায়ের তালু কেটে গেছে ধারালো কিছুতে।গল গল করে রক্ত ঝরতে শুরু করে।
চৈতি অসহায় দৃষ্টিতে প্রহনের দিকে তাকায়। প্রহন ঘাসের উপর হাঁটু গেড়ে বসে দূর্বা ঘাস হাতের তালুতে ডলে নিয়ে চৈতির পায়ের কাটা অংশে চেপে ধরে। কিছুক্ষণ পর রক্ত পড়া বন্ধ হয়। প্রহন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।
চৈতির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো মুখটা চুপসে গেছে।চোখে এখনো ভয়। প্রহন চৈতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
“কিচ্ছু হয়নি পিচ্চি। সামান্য কেটে গিয়েছে। ভালো হয়ে যাবে।ভয় পেয়ে ও না।”

প্রহনের আনন থেকে নেত্র জোড়া সরিয়ে নেয় চৈতি। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই কাটা জায়গায় টান খায়।তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নিলে প্রহন খম করে চৈতির হাত ধরে সোজা দাঁড় করিয়ে দেয়। গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“এত দূর্বল হলে চলবে না।স্ট্রং হতে হবে।”

চৈতি অবাক হয়ে প্রহনের দিকে তাকিয়ে আছে।”কতো পাষান মনের মানুষ উনি।পা কেটে যাওয়ার পর ও এইভাবে দাড় করিয়ে দিল?”

প্রহন চৈতির অনেকটা কাছে গিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে,
“পিচ্চি তোমার আর্মি ক্যাপ্টেন সাহেব কিন্তু অনেক স্ট্রং। তোমাকে ও তার মতো হতে হবে।এত সামান্য বিষয় নিয়ে ভয় পেয়ে দূর্বল হলে কিন্তু চলবে না।”

চৈতি কিছু বলে না। চৈতির উত্তরের অপেক্ষা করে না প্রহন। সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। হঠাৎ করে চৈতির কী হলো বুঝতে পারছে না সে। শুধু এইটুকুই বুঝলো,
“জীবনের পথ চলায় এমন হাজারো বিপদ আসবে। শরীর থেকে রক্ত ঝরবে। কিন্তু কোনো পরিস্থিতিতে দূর্বল হওয়া যাবে না। এতে ক্ষতি হবে। মারাত্মক ক্ষতি!”
দাঁতে দাঁত চেপে কাঁটা পায়ের উপর ভর করেই হাঁটতে থাকে চৈতি। হোক কষ্ট তাতে কি? কষ্টের ফল মিষ্টি হয়। পেছনে ফিরে তাকায় প্রহন। চৈতির উদ্বেগ দেখে খুশি হয়।
চৈতির দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করেই মনে মনে নিজেকে নিজেই কথা দেয় প্রহন,
“হও তুমি ইমম্যাচিউর তাতে কিচ্ছু যায় আসে না।তোমাকে আমার মনের মতো করেই ম্যাচিউর করে তোলার দায়িত্ব আমি নিলাম পিচ্চি।”
কঠিন হৃদয়ের করা প্রতিজ্ঞার কথা কখনো জনা হবে কী নরম হৃদয়ের অধিকারীনির?হয় তো হবে। আবার নয় তো না।

চৈতি প্রহনের দিকে তাকিয়ে ব্যথাতু্র কন্ঠে বলে উঠে,
“হাঁটতে পারছি না আর।পায়ে ব্যথা করছে।”

“পারছি না বললে হবে না পিচ্চি।পারছি না,পারি না, পারবো না,হবে না, সম্ভব না, এমন শব্দ গুলো তোমার জীবনের ডিকশোনারি থেকে মুছে দাও।একে বারে মুছে দাও। এখন থেকে,এই মুহুর্ত থেকেই।”

বিষ্ময় নিয়ে তাকায় চৈতি।”কি বলছেন কী উনি এ সব? মাথা ঠিক আছে তো?”
মনে মনে বললো চৈতি। মুখে প্রকাশ করলো না। প্রহন চৈতি কে রেখেই বাড়ির ভেতরে চলে গেল। প্রহনের এহেন কান্ডে হতভম্ব চৈতি। ছোট্ট হৃদয়ে এক আকাশ অভিমান এসে ভীড় জমালো।স্বামী নামক মানুষটির জন্য।”আপনি একবারে বাজে আর্মি সাহেব।একে বারেই খারাপ। ভীষণ খারাপ!”

নবিনা কিশোরীর সলাজ অভিমান গাঢ় হবার আগেই কী সেই অভিমান ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে পারবে প্রহন? অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উপলব্ধি করতে পারবে তার চঞ্চলা হরিণীর হৃদয় জুড়ে বয়ে যাওয়া অভিমান নামক ঝড়ের?
এক পা দু’পা করে এগিয়ে যায় চৈতি।খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে দেখে মিসেস ইয়াসমিন তরিঘরি করে ছুটে আসতেই বাঁধ সাধলো প্রহন।কাঠ কাঠ কন্ঠে বললো,
“ওর লড়াইটা ওকেই লড়তে হবে আম্মু।”

মিসেস ইয়াসমিন প্রহনের কথা বুঝতে না পেরে ভ্রু জোড়া কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কীসের লড়াই? এইটুকু মেয়ের আবার কার সাথে লড়াই লাগলো?”

“জীবনের লড়াই আম্মু।”

“মানে কি প্রহন? ক্লিয়ার করে বলো। এমন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা আমার পছন্দ না।”

মায়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রহন।
“এই পৃথিবীর বুকে টিকে থাকা এত সহজ না।পতি পদে পদে বিপদ উৎ পেতে থাকে।হাজারো বাঁধা কাটিয়ে পথ চলতে হয়।আর সেই বাঁধা কাটানোর জন্য দরকার আত্মবিশ্বাস এর। চৈতির পা কিছুটা কেটে গেছে। চাইলে আমি ওকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে আসতে পারতাম। কিন্তু এতে করে পরবর্তীতে ওর নিজের ক্ষতি হবে। এমন করলে ধীরে ধীরে আমার, তোমার কিংবা অন্য কারো প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে ও।যা আমি চাই না।ওর সকল প্রকার নির্ভরশীলতা ওর নিজের কাছে।অন্যের কাছে না। সবাই অনেক জ্ঞান দিবে। কিন্তু কেউ সাহায্য করতে আসবে না।আসে না কেউ।‌”

প্রহনের কথায় মিসেস ইয়াসমিন মুচকি হাসেন। তার ছোট্ট সেই প্রহন আজ কত বড় হয়ে গিয়েছে।কত কিছু কতো সহজেই বুঝতে পেরে গেছে। ভেতরে এসেই সোফার উপর বসে পড়লো চৈতি।একটা বারের জন্য ও প্রহনের দিকে তাকালো না। মিসেস ইয়াসমিন এগিয়ে গেলেন তার দিকে।
চৈতি ধীর কন্ঠে বললো,
“ভালো মা পানি খাবো।”

মিসেস ইয়াসমিন ডাইনিং টেবিলের উপর রাখা জগ থেকে এক গ্লাস পানি এনে চৈতির হাতে দিলো।
থেমে থেমে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করে সোফায় শরীরের ভার ছেড়ে দিলো। প্রহন রুমে গিয়ে ফাস্টএইড বক্সটা নিয়ে এসে চৈতির পাশে গিয়ে বসলো।
চোখ বন্ধ চৈতির।মনে হচ্ছে ২০০ মিটার পথ দৌড়ে এসেছে। চোখ বন্ধ করে বড় বড় শ্বাস ফেলছে।

প্রহন সোফা থেকে উঠে চৈতির পায়ের কাছে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে চৈতির কেটে যাওয়া পা হাঁটুর উপর রেখে ডেটলে ভেজানো তুলো দিয়ে পরিষ্কার করে সেভলন লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়। চৈতির কোনো সাড়া শব্দ নেই।সে চুপ করে চোখ বন্ধ করে আছে।

প্রহন উঠে দাঁড়ালো। চৈতির উদ্দেশ্যে বললো,
“নাস্তা করে প্যারাসি টেমল খেয়ে নিবা পিচ্চি। তাহলে আর ব্যথা করবে না।”

প্রহনের কথা শুনে খুব রাগ হলো চৈতির।মনে মনে প্রহন কে ইচ্ছে মতো বকলো।”কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হতো একটু ধরে নিয়ে আসলে?এত কষ্ট তো হতো না আমার।”

কিশোরী চৈতির মনে অন্য ভাবনা আসলেও এই ভাবনা আসলো না, যে কিছু কিছু মুহূর্তের ছোট খাটো কষ্ট জীবনের চলার পথে আরো বড় কষ্ট কেউ তুচ্ছ করে তোলে।

আজ আবার বিয়ে বাড়ীতে যেতে হবে। কিন্তু রেদোয়ান চৌধুরীর শরীর টা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে। বুকের ব্যথাটা হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। এই মাসে চেকআপ করানোর কথা ছিল। কিন্তু চার দিকের এত ঝামেলার মধ্যে ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয়নি। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ১০টা। রেদোয়ান চৌধুরী কে নিয়ে হসপিটালে যায় প্রহন। মিসেস ইয়াসমিনের মনটা ভালো নাই। অবশ্য ভালো থাকার কথা ও না।যেখানে তার জীবন সঙ্গী সুস্থ নেই সেখানে তাঁর ভালো থাকার প্রশ্নই উঠে না। বছরের পর বছর কোনো পশুর সাথে থাকলেও মায়া হয়। সেখানে রেদোয়ান চৌধুরী একজন মানুষ।২৯ বছরের বিবাহিত জীবনে এই মানুষটি কে বড্ড বেশি ভালোবাসে ফেলেছেন তিনি।।বড্ড বেশি!

চৈতি রুমে বসে ছিল। ভালো লাগছে না। হঠাৎ কী মনে করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। মাথায় কাপড় দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে ভাবলো বাড়িটা ঘুরে দেখা যাক। পায়ের মধ্যে ব্যান্ডেজ করে দেওয়ার জন্য ব্যথা নেই।তবে হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে। তবু ও বাড়িটা ঘুরে দেখার লোভ সামলাতে পারলো না চৈতি।খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে লাগলো। এই রুম থেকে ঐ রুমে।
বাড়ি ঘুরে দেখতে দেখতে চৈতির একটাই কথা মাথায় এলো।
“এত বড় বাড়ি অথচ মানুষই নেই। এতো বড় বাড়ি বানানোর কী দরকার ছিল? অদ্ভুত!”

___________
রৌদ্রতপ্ত অন্তরীক্ষ তখন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।দিনমনি অস্ত যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে।এই অপারহ্ন কে অনেকে গোধূলি কয়।সাঁঝবেলা আসার সময় হচ্ছে।দিনমনি ডুবে গেলেই সে তার আধিপত্য বিস্তার করার জন্য উঠে পড়ে লাগবে।অম্বর জুড়ে তুলোরাশিদের ছড়াছড়ি। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সেই অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করছে চৈতি।
হাতে এক কাপ চা নিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ায় প্রহন।
তার উপস্থিতি টের পেয়ে ও কোনো রকম প্রক্রিয়া করে না কিশোরী।
প্রহন চায়ের কাপে আয়েশ করে চুমুক দেয়।
কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে নিজ থেকেই কথা বলে,
“কী হয়েছে পিচ্চির?মন খারাপ কেন?”

উত্তর দিলো না চৈতি। আগের নেয় আকাশ পানে চেয়ে রইলো। ইচ্ছে করেই গরম চা মুখের ভেতর নিয়ে নেয় প্রহন। অতিরিক্ত গরমে জিহ্বা পুড়ে যায়।সহ্য করতে না পেরে ফেলে দেয় প্রহন। কিছুটা চা গিয়ে পড়ে চৈতির হাতে। ঘাবড়ে উঠে সে।
কন্ঠে চাপা ক্ষোভ রেখেই প্রহনের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“পাগল আপনি?এত গরম চা কেউ এক গালে খায়? জিহ্বা পুড়ে যায় নি তো?”

চৈতির কোমর জড়িয়ে ধরে এক টান মেরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় প্রহন।
প্রহনের এহেন কান্ডে বুকের মাঝে ধক করে উঠলো চৈতির। হৃদয় জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়।
প্রহন চৈতির কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের নেয় কন্ঠে বলে উঠে,
“তোমার সলাজ গাঢ় অভিমান আমার বুকের ভেতরে এর চেয়েও বেশি অনলে জ্বলে পুড়ে ছারখার করে দেয়। বুঝতে পারো না তুমি?”

#চলবে,,,,,,

চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here