অন্তহীন পর্ব -১৩+১৪

#অন্তহীন💜
#পর্ব_১৩
#স্নিগ্ধা_আফরিন

কানের পাশ দিয়ে শীতল বাতাস বয়ে গেলো। রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ খেলে গেল। পলকহীন চোখে প্রহনের দিকে তাকিয়ে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে চৈতি। প্রহনের দৃষ্টি আটকে আছে নবিনা কিশোরীর চোখে।
চৈতির কোমর ছেড়ে দিল প্রহন। গ্রিলের বাইরে দূর আকাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। চৈতি নড়েচড়ে উঠলো। প্রহন কে পাশ কাটিয়ে রুমে চলে গেল। চৈতির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো প্রহন।মনে মনে বললো,”বউ আমার লজ্জাময়ী। লজ্জা পেয়ে চলে গেল।”

সে দিন সন্ধ্যায় হঠাৎ বৃষ্টির আগমন। চারদিক তিমির রুপে সেজে উঠে।শো শো করে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। বাতাসের তোড়ে জানালার পর্দা গুলো উড়ে উড়ে এলোমেলো হচ্ছে নিজের মতো।লোড সেডিং হয়।বাড়ির ভেতর জুড়ে তমস্রীর আধিপত্য।অম্বর তখন কালো মেঘেদের দখলে।মাঝে মাঝে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ শোনা যাচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় প্রহনের রুম স্বল্প সময়ের জন্য আলোকিত হয়ে উঠে।
মোবাইল এর ফ্লাশ লাইটের আলোয় বেলকনির দরজা রুমের জানলা বন্ধ করে দেয় প্রহন। হঠাৎ আবহাওয়ার এমন পরিবর্তনে চরম বিরক্ত সে।
আগামীকাল ঢাকায় ফিরে যাবে। একটু শান্তি তে যাওয়া আর হবে বলে মনে হচ্ছে না। বাইরে যে ভাবে বাতাস বইছে দেখা যাবে রাস্তায় গাছ ভেঙ্গে পড়ে আছে। ছুটির দিন শেষ।চলে যেতে হবে প্রিয় পরিবার ছেড়ে।ব্যস্ত হতে হবে দেশের কাজে। দেশের জন্য নিজের স্বাধীনতা বিসর্জন দেওয়াই যে সেনাবাহিনীদের কাজ।
গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে প্রহন।
বিছানায় বসা চৈতির দিকে এগিয়ে যায় প্রহন। মেঘের গর্জনে থেমে থেমে কেঁপে উঠছে মেয়েটা। চোখ মুখ খিঁচে দুই হাত দিয়ে বিছানার চাদর খামচে ধরে। চৈতির ভীতু মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে প্রহন।
“সেনাবাহিনীর বউ হয়ে সামান্য মেঘের গর্জনে এত ভয় পেলে চলবে পিচ্চি?”

চোখ মেলে তাকায় চৈতি। মিনমিনে গলায় বলে,
“বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে। ছোট থেকেই ভীষণ ভয় পাই আমি।”

“তুমি আবার বড় হলে কখন?এখনো তো ছোটই আছো।”

প্রহনের কথা শুনে গাল ফুলিয়ে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয় অভিমানী কিশোরী।
বাইরে এখন আর বাতাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে না। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। ভিজিয়ে দিচ্ছে শহরের প্রতিটি অলিগলি।ন্ চৈতির পাশে গিয়ে বসলো প্রহন।ধীর কন্ঠে বললো,
“ওয়েদারটা রোমান্টিক আছে। এই ওয়েদার একটা বউ ডিজার্ভ করে।”

প্রহনের দিকে ভ্রু কুঁচকে চোখ ছোট ছোট করে তাকায় চৈতি।বড্ড অসভ্য মানুষ তো।বউ থাকতে বলে বউ ডিজার্ভ করে?
কন্ঠে রাগ রেখে চৈতি প্রহনের উদ্দেশ্য বললো,
“আমি আপনার কী হই?”

প্রহন ঠোঁট কামড়ে হাসে।
“তুমি? তুমি তো আমার পিচ্চি বউ।”

“তাহলে আবার বউ চাচ্ছেন কেন? কয়টা বিয়ে করতে চান আপনি?”

ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসির রেখা টেনে প্রহন তার পিচ্চি বউয়ের প্রশ্নের উত্তর দেয়,
“আরো তিন টা বিয়ে করবো।চারটা বিয়ে করার তো অনুমতি আছেই।”

প্রহনের কথা শুনে চৈতি রেগে গিয়ে বললো,
“আমি মেয়ে খুঁজে দিবো আপনি বিয়ে করিয়েন।”

প্রহন হাসলো। কোনো উত্তর দিলো না। চৈতির হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললো,
“আমার সাথে এই অবেলার বৃষ্টিতে ভিজবে পিচ্চি পেত্নী? হয়তো অনেক দিন আমাকে কাছ থেকে দেখার ও সুযোগ হয়ে উঠবে না।”

“চৈতি, চৈতি, চৈতি বুঝছেন?আমার নাম চৈতি। পিচ্চি পেত্নী এটা আবার কীসের নাম?”

“শুনো,শুনো,শুনো, তোমার যত সুন্দরই নাম থাকুক না কেন আমি তোমাকে পিচ্চি বলেই ডাকবো।বুঝছো পিচ্চি? এখন চলো অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজতে।”

চৈতি কিছু বলার আগেই প্রহন চৈতির হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো ছাদের দিকে।
বৃষ্টি যে তার ভীষণ পছন্দের।আর সেই বৃষ্টি বিলাস যদি হয় প্রিয় মানুষটার সাথে তাহলে আর কোনো কথাই নেই।অন্যরকম অনুভূতির ছোঁয়া দিয়ে যায় হৃদয়ে।
বৃষ্টির পানি শরীরে পড়তে এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে। চৈতি কে ছাদের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে তার সরাসরি দাঁড়ায় প্রহন। বৃষ্টির পানি অঝোর ধারায় ঝড়ছে। মেঘেরাও যেনো মন প্রাণ উজাড় করে বৃষ্টি নামিয়ে দিয়েছে শহর জুড়ে।ভিজে একাকার দুজন মানব,মানবি। অন্ধকারের মাঝে বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় ভিজে একাকার হয়ে যাওয়া কিশোরীর দিকে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিল প্রহন।
চৈতি এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। বৃষ্টিতে ভিজি বলেই সত্যি সত্যি ছাদের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে ভেজাতে লাগলো? অদ্ভুত তো!

বেশ অনেক দিন পর বৃষ্টিতে ভিজতে পেরে আনন্দিত কিশোরী। বৃষ্টির পানি দুই হাতের মধ্যে জমিয়ে রেখে তা প্রহনের মুখের দিকে ছুঁড়ে মেরে খিল খিল করে হেসে উঠলো চৈতি।ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকানো দেখে প্রহন আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে মনে মনে বললো,
“অন্ধকারই শ্রেয় এখন।আলো দিও না আল্লাহ। নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে।”

বৃষ্টির শব্দ, সাথে কিশোরীর হাসির খিল খিল শব্দে মুখরিত চার পাশ।জুনাইদা কখনোই বৃষ্টিতে ভিজতে দিতেন না। সামান্য ভিজলেও ভীষণ বকতেন, জ্বর উঠবে বলে।

পায়ে যে ব্যান্ডেজ করা আছে সেই কথা একদম মাথায় নেই দুজনের। লাফালাফি করতে গিয়ে হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যেতে নিলে আগলে নেয় প্রহন।কানের পিছে অবাধ্য চুল গুলো গুঁজে দিয়ে আদুরে গলায় বলে,
“সাবধানে পিচ্চি। বৃষ্টি ভালোবাসো বুঝতে পারছি।তাই বলে এই ভাবে লাফালাফি করো না অন্ধকারে।ব্যথা পাবে।”

ছাদের লাইট জ্বলে উঠে। রাস্তার পাশের ল্যামপোস্ট গুলো ও জ্বলে উঠলো। বৃষ্টির গতি কমেছে যে।মন খারাপ হলো চৈতির।আরো কিছুক্ষণ ঝুম বৃষ্টি হলে কী এমন ক্ষতি হতো?
প্রহনের দিকে নেত্র জোড়া নিবিদ্ধ হতেই শিউরে উঠলো চৈতি। সামনের চুল থেকে টুপ টুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। মুখের মধ্যে বিন্দু বিন্দু পানির কনা। ঘোর লাগা চাহনি।ঢোক গিললো চৈতি। প্রহন কে পাশ কাটিয়ে ছুটে চলে যেতে নিলে চৈতির কোমর জড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় নেশাক্ত প্রেমিক পুরুষ।
হৃদয় স্পন্দন প্রক্রিয়া পাল্টে গেল কিশোরীর।স্পন্দনের গতি বেড়ে গেল কয়েক গুণ। প্রহনের এই ধারালো চাহনির সাথে পরিচিত নয় চৈতি।দম আটকে আটকে আসছে।
আবারো বৃষ্টি নামলো। ঝুম বৃষ্টি!লোড সেডিং হলো।চার দিক আঁধারে ছেয়ে গেল। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় প্রহনের দৃষ্টি গেল তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানবীর গোলাপি অধরে।
অধর জোড়া ছুঁয়ে দেওয়ার মারাত্মক নেশায় আসক্ত হয়ে উঠেছে নেশাক্ত মানব।আনন খানি এগিয়ে নিয়ে যেতেই টনক নড়লো। মস্তিষ্ক ধিক্কার জানিয়ে বলছে,
“এমন করিস না প্রহন। সঠিক সময় আসেনি।অন্যায় হবে এতে। ভীষণ অন্যায়!”

মন বললো,
“ও তোর জন্য হালাল প্রহন।একটা চুম্বনে কিচ্ছু হবে না। কিচ্ছু না!”

মন ও মস্তিষ্কের দ্বিমতে মস্তিষ্ককে আজ আশকারা দিলো প্রহন। ছেড়ে দিল চৈতির কোমর।সরে গেল দূরে। কিছুক্ষণ আগেই যতটা না কাছে ছিল তার চেয়েও অধিক দূরত্বে নিজেকে আড়াল করতে চাইলো।

চৈতির দেহে যেনো প্রান ফিরে এলো।বড় করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে এক পলক প্রহনের দিকে তাকিয়ে ছুটে গেলো রুমে।

দুই হাত দিয়ে মাথার চুল খামচে ধরলো প্রহন।”কী করতে যাচ্ছিলাম আমি? সামান্য একটা ভুলে মেয়েটার জীবনে মারাত্মক প্রভাব পড়তো।”

রুমে এসে চৈতি ভেজা কাপড় বদলে নিলো। প্রহনের তখনকার কান্ডে শরীর হিম শীতল হয়ে আছে। বৃষ্টিতে ভিজে ও এত ঠান্ডা শরীর ছিল না যতটা না এখন আছে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে প্রহন ও রুমে ফিরে এলো। বিছানার ঠিক মাঝখানটায় বসে আছে চৈতি। বৃষ্টি থেমে গেছে। পরিবেশ এখন শান্ত শীতল।এত গরমের মধ্যে এই বৃষ্টিটা রহমতের ছিল।

তোয়ালে দিয়ে মাথার চুল মুছতে মুছতে ওয়াস রুম থেকে বেরিয়ে আসে প্রহন। বিছানায় বসে থাকা চৈতির উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
“কাভার্ড থেকে আমার গুছানো ড্রেস গুলো বের করে বিছানায় রাখো পিচ্চি।”

বাধ্য মেয়ের মত বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো চৈতি। পায়ের ব্যান্ডেজ ভিজে যাওয়ায় ফেলে দিয়েছে।কাঁটা জায়গায় পানি ও লেগেছে ইচ্ছে মতো।পা বাড়াতেই শব্দ করে উঠলো চৈতি।
কাঁটা জায়গায় চাপ পড়তেই রক্ত ঝরা শুরু হয়েছে।
পা ধরে বিছানায় বসে পড়লো চৈতি।
প্রহন দ্রুত এগিয়ে এসে চৈতির পা ধরে রক্ত মুছে দিতে বললো,
“ইশশশ আমার ভুলেই পায়ের ব্যথা বেড়ে গেলো। সরি পিচ্চি। আমার মাথায় ছিল না যে তোমার পা কেটে গেছে।”
প্রহনের কন্ঠে অপরাধ।
__________
সেদিন রাতে গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে চৈতির। ঘুমের মধ্যে জ্বরের ঘোরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে প্রহন কে। চৈতির গায়ের তাপমাত্রায় প্রহনের মনে হচ্ছিলো সে নিজেই পুড়ে যাচ্ছে।
সেই প্রথম,মা বাবা ছাড়া অন্য কারো জন্য বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করতে পারে সে।কারন চৈতি যে তার প্রিয় মানুষের একজন হয়ে উঠছে। শুধু প্রিয় বললে ভুল হবে।অতিপ্রিয় একজন!
প্রহন রাত জেগে চৈতির মাথায় জল পট্টি দিতে ব্যস্ত। মধ্যে রাতে জ্বরের ঘোরে প্রহনের দিকে চোখ মেলে তাকায় চৈতি।
চৈতির সেই চাহনি দেখে স্বামী নামক প্রেমিক পুরুষের অবাধ্য মন বলে উঠে,
“তোমার এই জ্বরের ঘোরের চাহনিতে যে কত মায়া তুমি তা জানো না মেয়ে। তোমার এই মায়ার চাহনিতে যে লেখা আছে আমার মৃত্যু।”
#অন্তহীন💜
#পর্ব_১৪
#স্নিগ্ধা_আফরিন

বেলকনির গ্রিলের ফাঁকে এক ফালি সোনারাঙা সোনালী রোদ্দুর এসে পড়েছে নবিনা কিশোরীর চোখে মুখে। কোমর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া অগোছালো চুল গুলো বিকেলের মৃদু বাতাসে উড়ছে।গালে হাত দিয়ে ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে।অন্তরীক্ষ জুড়ে কাদম্বিনীর মেলা বসেছে।অম্বর আজ তাদের দখলে। স্নিগ্ধ,শান্ত, মনোরম পরিবেশ।মন ভালো করে দেওয়ার মতো আবহাওয়া।তবে এই সুন্দর পরিবেশে ও মন খারাপ কিশোরীর।যখন থেকেই ঘুম ভেঙ্গেছে,জ্বর কমেছে তখন থেকেই মন খারাপি হাওয়া এসে ছুঁয়ে গেছে তাকে।রোদের তেজ কমে এসেছে। পড়ন্ত বিকেল!চিত্ত জুড়ে গাঢ় অভিমানের অনল জ্বলছে অভিমানী কিশোরীর।নেত্রপল্লব ক্লান্ত,শান্ত।
দু’টো চড়ুই পাখির মান অভিমান চলছে সেই কখন থেকেই।মেয়ে পাখিটা উড়ে গিয়ে অন্য জায়গায় বসছে।ছেলে পাখিটা গেলে মেয়ে পাখিটা ঘাড় ঘুরিয়ে ফেলছে। পাশের বাড়ির বেলকনির গ্রিলের উপর বসে থাকা চড়ুই পাখির অভিমান চুপ করে দেখছে অন্য এক অভিমানী মানবী।সেও তো ভীষণ অভিমান করেছে একজনের প্রতি।সে খবর কে রাখে?কেউ না!
মিসেস ইয়াসমিন হাতে করে এক কাপ চা নিয়ে আসলেন চৈতির কাছে।
চৈতি এক পলক মিসেস ইয়াসমিন এর দিকে তাকিয়ে আবারো সেই পাখি দুটোর দিকে নজর রাখলো।

মিসেস ইয়াসমিন চৈতির পাশে মোড়া টেনে বসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে গলায় হাত দিয়ে তাপমাত্রা অনুভব করার চেষ্টা করলেন।জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।কমেনি এখনো।

মিসেস ইয়াসমিন চায়ের কাপ টা এগিয়ে দিয়ে মলিন কন্ঠে বললেন,
“চা টা খেয়ে নে মা।ভালো লাগবে।”

ডানে বামে মাথা নেড়ে বাঁধ সাধলো চৈতি।জ্বরের কারণে বিষাদ মুখ।সব কিছু তেতো লাগছে। ভালো লাগছে না কিছুই।শরীরের সাথে সাথে মনের ও অসুখ দেখা দিয়েছে যে!

মিসেস ইয়াসমিন জোর করলেন না। চৈতির দৃষ্টি অনুসরণ করে সেই চড়ুই পাখি গুলোর দিকে তাকালেন। হাসলেন তিনি। চৈতির মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় শুধালেন,
“অভিমান জমেছে?”

অধীর আগ্রহ নিয়ে এই কথা শোনার জন্যই যেনো বসে ছিল চৈতি।কন্ঠে চাপা অভিমান নিয়ে বললো,
“আমাকে একটু জানিয়ে গেলে কী এমন ক্ষতি হতো?”

মিসেস ইয়াসমিন মুচকি হেসে জবাব দিলেন,
“তুই ঘুমিয়ে ছিলি।জ্বরের জন্য তাকাতেও পারছিলি না।১০৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা ছিল।”

“তাই বলে একটু বলে যেতে পারলেন না?একটু ডেকে দিলেন না কেন আমায়?”
অভিমানে গাল ফুলালো চৈতি। মিসেস ইয়াসমিন দেখলেন,স্পষ্ঠই দেখলেন,নেত্রপল্লব থেকে দু ফোঁটা পানি ঝরে পড়তে। গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
“আমি ডাকতে চেয়ে ছিলাম। কিন্তু প্রহন বাঁধ সাধে।
কথা বাড়ালো না চৈতি। মিসেস ইয়াসমিন এর মুঠোফোন টা সেই কখন থেকে বেজে বেজে ক্লান্ত হচ্ছে। মোবাইলের রিং টোন এর শব্দে চরম বিরক্ত হলেন রেদোয়ান চৌধুরী।বিছানার উপর আধশোয়া হয়ে হুমায়ূন আহমেদ এর লেখা উপন্যাস”চোখে আমার তৃষ্ণা” বইটি খুব মনোযোগ দিয়েই পড়ছিলেন।অবসর সময় কাটানোর জন্য বই পড়া একটি সুন্দর উপায়। বাস্তবতা ছেড়ে কল্পনায় ডুবে যাওয়া এক অন্যরকম অনুভুতি। রেদোয়ান চৌধুরী হাঁক ছাড়লেন।
“ইয়াসমিন, তোমার কল আসছে।”

রেদোয়ান চৌধুরীর কন্ঠ শুনে মিসেস ইয়াসমিন উঠে দাঁড়ালেন। চায়ের কাপ টা হাতে নিয়েই চলে গেলেন রুমে। বিছানার উপর থেকে মোবাইল টা হাতে নিতে নিতে কড়া গলায় রেদোয়ান চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“পাশেই তো ছিল মোবাইল টা।হাতে নিয়ে কলটা রিসিভ করলে কী এমন ক্ষতি হতো শুনি?বইয়ের ভেতরে ঢুকে গেছে একে বারে।বুড়ো বয়সে এসেও এত কীসের উপন্যাস পড়তে হয় বুঝিনা আমি।”

বাজতে বাজতে নিভৃত হয়ে গেল চারপাশ। কোনো প্রকার শব্দ নেই। রেদোয়ান চৌধুরীর কোনো টু শব্দটি ও নেই। তিনি তার মতো ব্যস্ত। কল্পনার জগতে!
মিসেস ইয়াসমিন রেদোয়ান চৌধুরীর দিকে চোখ ছোট করে তাকিয়ে বিড় বিড় করে বললেন,
“কাকে কী বলছি? উনি তো এখন এই বাস্তবেই নেই।”

মিসেস ইয়াসমিন ফের চলে গেলেন চৈতির কাছে।হাতের মুঠোয় ধরে রাখা যন্ত্রটা ঝংকার দিয়ে বেজে উঠলো।সময় অপচয় না করেই একবার রিং হতেই কল রিসিভ করলেন মিসেস ইয়াসমিন।
ফোনের ওপাশ থেকে কেউ বিচিলিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“পিচ্চির শরীর কেমন আছে আম্মু?”

“জ্বর পুরোপুরি কমেনি এখনো।”

“ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও।কী করছে এখন?”

“অভিমান করে বসে আছে।”

মায়ের কাথা শুনে নিঃশব্দে হাসলো প্রহন।এটা ভেবে চিত্ত জুড়ে ভালো লাগায় ছেয়ে গেল যে,
‘অভীমান করেছে।’
অভিমান তো মানুষ সেই মানুষটির প্রতিই করে যাকে মানুষ আপন ভাবে।অল্প সময়ের মধ্যেই যে কারো আপন হতে পেরেছে এটা ভেবেই শান্তি লাগছে প্রহনের।

“চৈতি কে মোবাইল দিচ্ছি। কথা বলে অভিমান ভাঙ্গা।”

“এক মিনিট। আমি ভিডিও কল দিচ্ছি।”

মিসেস ইয়াসমিন মুচকি হেসে বললেন “আচ্ছা।”

কয়েক এক সেকেন্ড পরেই ভিডিও কল দেয় প্রহন। মিসেস ইয়াসমিন ব্যাক ক্যামেরা দিয়ে চৈতি কে দেখালেন।আনন জুড়ে অসুস্থতার ছাপ স্পষ্ট।গালে হাত দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।লাউড স্পিকার অন করে দিলেন মিসেস ইয়াসমিন।
চৈতি কে দেখে মোবাইলের ওপাশ থেকে দুষ্টুমি কন্ঠে প্রহন বলে উঠলো,
“কীরে পিচ্চি, কেমন আছো?”

হঠাৎ প্রহনের কন্ঠস্বর শুনে চকিতে চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো চৈতি। মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে থাকা প্রহনের হাসি মুখ দেখেই বুকের বা পাশে চিন চিনে ব্যাথা অনুভব হলো।
চোখ ফিরিয়ে নিলো চৈতি। মিসেস ইয়াসমিন চৈতির মুখ বরাবর দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে মোবাইল টা রেখে চলে যেতে যেতে বললেন,
“ঐযে দূরের চড়ুই পাখি গুলোর মতো এখন বউয়ের অভিমান ভাঙ্গাও। আমি গেলাম।”

অবাক দৃষ্টিতে মিসেস ইয়াসমিন এর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে চৈতি। মোবাইল টা না রেখে গেলেও হতো। অদ্ভুত!
ভুলেও মোবাইলের স্ক্রিনে সরাসরি তাকালো না চৈতি। অভিমান জমেছে। ভীষণ অভিমান!

কানে হাত দিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে চৈতির দিকে তাকিয়ে সরি বললো প্রহন।
“পিচ্চি সরি। তুমি অসুস্থ তার উপর সারা রাত ছটফট করে সকালের দিকে ঘুমিয়ে ছিলে তাই আর ডাকিনি তোমায়।”
আড় চোখে প্রহনের দিকে এক বার তাকালো চৈতি। মুখের হাবভাব পরিবর্তন হলো না। আগের নেয় উদাসীন।

“পিচ্চি,জ্বর কমেছে? শরীর কেমন আছে?খেয়ে ছিলে দুপুরে? ঔষধ খেয়েছো?”

প্রত্যত্তর করে না চৈতি।
“ও পিচ্চি এত অভিমান কোথা থেকে আসে বলো তো? পিচ্চি একটা মেয়ের এত অভিমান?”

“আপনার সাথে কথা নেই আমার।”
কন্ঠে রাগ।

“এত অভিমান করতে নেই মেয়ে। অভিমানের পাল্লা ভারী হতে দিলে যে দূরত্ব তৈরি হয়।সেকি তুমি জানো না পিচ্চি?”

মুঠোফোনের স্ক্রিনে নেত্র জোড়া আবদ্ধ করলো চৈতি। সেখানে ভেসে আছে সেই পরিচিত বদন খানি।অধর জুড়ে লেপ্টে আছে নজর কাড়া হাসি। হাওয়া মিঠাইয়ের মতো নীরবে নিভৃতে গলে গেল অভিমানের পাহাড়।
জ্বরের প্রকোপ বেড়েছে। পিঠের মেরুদন্ড সোজা করে বসে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে দুর্বল শরীরে।অসুখ যেনো জেঁকে বসেছে। শরীরে অসুখ, মনের অসুখ,একটা মানুষকে কাছ থেকে দেখতে চাওয়ার তীব্র অসুখ।

চৈতির দৃষ্টি এলোমেলো হতে দেখে ঘাবড়ে গেল প্রহন।
“পিচ্চি,মাকে ডাক দাও।”

কথা বের হবার আগেই কন্ঠ নালিতে তা আটকে গেল।বসা অবস্থায় দুর্বল শরীরটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেল মেঝেতে।অপর প্রান্তে বসে থাকা মানব থমকে গেল।চাইলেও ধরতে পারলো না অবচেতন কিশোরীর শরীর খানি। নিজের বাহু ডরে আগলে নিতে পারলো না।

কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ পেয়ে ছুটে আসেন মিসেস ইয়াসমিন।
জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা চৈতি কে দেখে কিছুক্ষণ এর জন্য থমকে যান মিসেস ইয়াসমিন।
মোবাইল এর ওপাশ থেকে প্রহন চিৎকার করে বলছে,
“আম্মু পিচ্চির চোখে মুখে পানির ঝাপটা দাও।”

মিসেস ইয়াসমিন রুমের ভেতরে রাখা জগ থেকে পানি নিয়ে দ্রুত চৈতির কাছে চলে গেলেন। চৈতির মাথা নিজের কোলের উপর রেখে চৈতির চোখে মুখে পানি দিলেন।
দুই হাত দিয়ে মাথার চুল টেনে ধরলো প্রহন।উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে। অপরাধী কন্ঠে বিড় বিড় করছে,
“সব দোষ আমার। অবেলার বৃষ্টিতে মেয়েটাকে না ভেজালেও পারতাম। আজ আমার জন্য এত অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”

চৈতির গায়ে হাত দিতে পারছেন না মিসেস ইয়াসমিন। ঝলসে যাচ্ছে যেনো।এত তাপমাত্রা বেড়েছে শরীরের। পানির জগ থেকে হাতের মধ্যে পানি নিয়ে চৈতির চোখে মুখে ঝাপটা দিলেন।
এক বার, দুই বার, কয়েক বার দেওয়ার পর জ্ঞান ফিরলো চৈতির।দেহে প্রান ফিরে আসে মিসেস ইয়াসমিন এর।ধরে ধরে চৈতি কে রুমে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুয়ে দিলেন।
বেলকনি থেকে মোবাইল টা নিয়ে প্রহন কে বললেন,
“সব ঠিক আছে। চিন্তা করতে হবে না। দুপুরে না খাওয়ার জন্য শরীর বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে।”

ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রহন।”আমার সব দোষ। মেয়েটা যে এতো অভিমানী বুঝতেই পারিনি। বোঝা উচিত ছিল আমার।ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও এখনি।আর যদি ওর যেতে বেশি কষ্ট হয় তাহলে ডাক্তার আঙ্কেল কে ফোন করে বলে দাও।চলে আসতে।ওরে কিছু খাইয়ে দাও।ডাক পড়েছে আমার।সি ও স্যার ডাকছেন।পরে কল করবো।”
কথা গুলো বলার দেরি হলেও লাইন কাটতে এক সেকেন্ড ও দেরী হয়নি প্রহনের।

মিসেস ইয়াসমিন মোবাইল টা চৈতির বালিশের পাশে রেখে চৈতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“খাবার আনছি, অল্প হলেও খেতে হবে। একদিনের জ্বরেই শরীর কেমন দুর্বল হয়ে পড়েছে দেখেছিস?এত অভিমান করলে হবে?”

ক্লান্ত দৃষ্টিতে মিসেস ইয়াসমিন এর দিকে চেয়ে আছে চৈতি। এই ভীষণ জ্বরে সব পুড়ছে। শরীর,মন,আত্মা সব পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। কেন এমন অস্থির লাগছে বুঝতে পারছে না কিশোরীর অবচেতন চিত্ত।
“বিরহ অনলে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে গোটা মানুষটাই।সে কথা বুঝবে কখন নবীনা কিশোরীর নরম কোমল হৃদয় খানি?”

চলবে,,,,,

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here