অন্তহীন পর্ব -১৭+১৮

#অন্তহীন💜
#পর্ব_১৭
#স্নিগ্ধা_আফরিন

মৃদু দখিনা বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠছে গাছের পাতা।স্বচ্ছ কাঁচের ন্যায় অম্বর আজ চকচকে,ঝলমলে। নীলিমা নীলে সেজেছে।নীরদের দেখা নেই অন্তরীক্ষে। আদিত্যর রঙিলা প্রভা এসে লুটোপুটি খাচ্ছে ছাদ জুড়ে।
দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই যখন ভাত ঘুম দিতে ব্যস্ত চৈতি তখন ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রোদ গায়ে মাখতে ব্যস্ত। কপালে ঘাম জমেছে। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে। ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে নেত্র পল্লব বন্ধ করে ফেলল।ছাদটা তার পছন্দ হয়নি। একদমই পছন্দ হয়নি! সুনসান ছাদ,একটা গাছ তো দূরের কথা টবও তার চোখে পড়েনি।এত বড় একটা ছাদ অথচ একটা চারা গাছের ও কত অভাব। অদ্ভুত মানুষ তো এরা।ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে আর ইচ্ছে করছে না চৈতির।দ্রুত পা চালিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদ থেকে নেমে রুমে চলে গেল। বেলকনিতে এখন যেনো বসন্ত এসেছে। মিসেস ইয়াসমিন এর সাহায্যে বেশ সুন্দর করে গুছিয়ে টবের গাছ গুলো সাজিয়েছে চৈতি। মানুষ গুলো একদমই গাছ প্রেমি না।মনে মনে ভাবলো সে। রেদোয়ান চৌধুরী কে গাছ আনতে বললে তিনি অনেক গুলো নিয়ে আসেন এক সাথে। বেলকনিতে সব গুলোর জায়গা হলো না। বাইরের উঠোনে রেখেছেন রেদোয়ান চৌধুরী।বাকি থাকা গাছ গুলোর কথা মনে পড়তেই ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো চৈতির।বেলকনি থেকে রুমে এসে বিছানার দিকে চোখ পড়তেই থ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো সে। মিসেস ইয়াসমিন এর মোবাইলের স্ক্রিনে আলো জ্বলছে।কী মনে করে যেন চৈতি মোবাইল টা হাতে নিতেই দেখে প্রহনের কল। ফোন সাইলেন্ট করে রাখা।বিড় বিড় করে সে বলে উঠলো”ভাগ্যিস দেখেছিলাম”।
কল রিসিভ করার আগেই কেটে গেল। বিরক্ত হলো চৈতি। দাঁত কিড়মিড় করে বললো,”অদ্ভুত তো! আমি যত বারই কল রিসিভ করতে যাই তত বারই কল কেটে যায়। অসহ্য!”
মোবাইল হাতে বিছানায় বসে পড়লো।স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ভাবছে আবার কখন কল আসবে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না।কল আসলো,রিসিভ করলো।ভিডিও কলে প্রহনের হাসি মাখা বদন দেখে চৈতি প্রশ্ন ছুঁড়লো”আপনি সব সময় ভিডিও কল করেন কেন?”

ভ্রু কুঁচকে গেলো প্রহনের।”ভিডিও কল করলেও এত সমস্যা কেন মেয়েটার?”মনে মনে বললো সে।প্রহনের উত্তর না পেয়ে আবারও বললো,”কবিও কল করলেই তো পারেন।আমি তো এখন অনেকটাই সুস্থ আছি।”

চৈতির এহেন কথায় রাগ হলো প্রহনের। সাথে বিরক্ত ও। কিছু না বলেই কল কেটে দিলো।আজ আবারো বাবা মায়ের প্রতি রাগ হচ্ছে। সেই প্রথম দিনের মতন। এই মেয়ের সাথে বিয়ে না দিলে ও পারতেন।গাল ফুলিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো প্রহন।”ধেত মুডটাই নষ্ট করে দিলো।”বিরক্ত মাখা কন্ঠে কথা টা বলেই নেত্র জোড়া বন্ধ করে বালিশে মাথা এলিয়ে দিলো।
অথচ সে বুঝলো না,ভিডিও কলে কথা বলতে কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে কোনো একজনের।তাইতো এই কথা বলেছে সে। মুখের সামনে মোবাইল টা ধরে রাখতে হয়, অস্বস্তি জেঁকে বসে তখন।
সেই কথা প্রহন জানে না।বিষ্মিত নয়নে হাতের মুঠোয় ধরে রাখা মোবাইল টার দিকে তাকিয়ে আছে চৈতি।
হঠাৎ করে কল কেটে দেওয়ার মানেটা বোধগম্য হলো না তার।মৌন মুখে বিছানায় বসে রইলো।কল ব্যাক করার সাহস পেলো না।সে যে ভীষণ ভীতু শুধু প্রহনের কাছে।রুম থেকে আর বের হলো না চৈতি।মৌন মুখে বিছানায় শুয়ে পড়লো।

ক্যান্টিনে বসে দাঁত কিড়মিড় করে যাচ্ছে প্রহন। মেজাজটাই বিগড়ে আছে।
“কফি খাবেন স্যার?”

পাশের এক ওয়েটার এর কথা শুনে তার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললো,”কড়া লিকারের চা দাও।কফি খাবো না।”

চায়ের কাপে চুমুক দিতেই মোবাইল বেজে উঠলো।স্ক্রিনে ভেসে আছে মায়ের নাম টা। প্রহন কল রিসিভ করে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,”বলো কি বলবা।”
ওপাশ থেকে কোনো সাড়া পেল না। প্রহন আবারো বললো,”আম্মু চুপ করে থাকা আমার একদম পছন্দ না।”
তবু রেসপন্স না পেয়ে প্রহন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,”চৈতি কী হয়েছে? কথা বলছো না কেন? সমস্যা কি?”

প্রহনের মুখ থেকে এই প্রথম নিজের নাম শুনলো চৈতি। পিচ্চি ডাকটাকে কেন জানি মিস করছে সে। প্রহনের মুখ থেকে পিচ্চি ডাক টা শুনতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল।মলিন কন্ঠে বললো,”আপনি কি আমার কথায় রেগে আছেন?”

হাতের মধ্যে কপাল ঠুকলো প্রহন।রাগিয়ে দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করছে রেগে আছে কী না।আজব তো!

“আপনি তো আমার চোখের সামনে নাই।তাই বুঝতে পারছি না। রেগে আছেন কী না। আমার কথায় রাগ করে থাকলে দুঃখিত আমি। আসলে আমি ভিডিও কলে কথা বলতে স্বস্তি বোধ করি না।”

চৈতির শেষের কথাটা শুনে প্রহনের রাগ উড়ে গেল।”আচ্ছা। কিন্তু এখন থেকে অভ্যাস করে ফেলো বুঝছো পিচ্চি।”

চৈতি ছোট্ট করে উত্তর দিলো”হুম।”
সে বার প্রথম ভীতু মেয়েটা সব ভয় ভীতি এক পাশে সরিয়ে রেখে প্রহন কে নিজ থেকে ফোন করে ছিল। শান্ত কন্ঠে খুব সহজেই নিজের অসুবিধার কারণ তুলে ধরে ছিল।

____________

প্রতিদিনকার নিয়মে পূর্ব দিগন্তে সূর্য উদয় হচ্ছে আবার পশ্চিম দিগন্তে অস্ত যাচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা ঘুরে ঘুরে সময় পার করছে। নদীর স্রোত ও বহমান। থেমে নেই কেউ কারো জন্য। নিজেদের নিয়মে যে যার মতো ব্যস্ত। চৌধুরী বাড়ির অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। বাড়ির ছাদ এখন বিভিন্ন প্রজাতির গাছে সেজে উঠেছে। বেলকনিতে ও শান্তির বসন্ত এসেছে যেন। ফুলের সুবাসে ভরে থাকে চারপাশ।এই সব কিছুর পরিবর্তন হয়েছে শুধু চৈতির জন্য। নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছে আজ দুই মাস চলছে। চোখের পলকেই পেরিয়ে গেল দুই- দুটো মাস।
অন্তরীক্ষের পূর্ব দিগন্ত যখন আদিত্যর লালাভ আভায় আচ্ছাদিত চৈতি তখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৫টা বেজে ৪৫ মিনিট। মিসেস ইয়াসমিন সেই কখন থেকে ডেকে যাচ্ছেন।অথচ মেয়ের ঘুম ভাঙ্গার কথাই নেই।
এত সকালে চৈতি কে ঘুম থেকে ডেকে তোলার একটাই কারণ রাতে সে পড়া ফাকি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কোনো পড়াই শেষ করেনি। মিসেস ইয়াসমিন জানলার পর্দা সরিয়ে দিলেন। অন্ধকার ঘর আলোয় ভরে গেল এক নিমেষেই।চোখে মুখে আলো পড়তেই ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেললো চৈতি।

“বলি কী এত ঘুমালে হবে?রাতে ও তো কোনো পড়া শেষ করিস নি। এখন জলদি করে উঠে পড়তো দেখি।ফ্রেশ হয়ে পড়তে বস। আমি নাস্তা বানাতে যাচ্ছি।”

মিসেস ইয়াসমিন এর কথা শুনে চোখ পিটপিট করে তাকালো চৈতি।এই পড়ালেখা শান্তির ঘুম নষ্ট করে দেওয়ার যুদ্ধে নামে যেন।
ঘুম ঘুম কন্ঠে মৃদু স্বরে বললো,”আরেকটু ঘুমাই না ভালো মা প্লিজ।”

মিসেস ইয়াসমিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চৈতির দিকে তাকিয়ে বললেন,”তুই ঘুমা। আমি প্রহন কে ফোন করে বলছি সব।”

প্রহনের নাম শুনতেই শোয়া থেকে হকচকিয়ে উঠলো চৈতি। দুই হাত দিয়ে এলোকেশ গুলোকে খোঁপা করে ভীতু কন্ঠে বললো,”না না।তার দরকার নাই। আমি উঠে গেছি তো।”

মিসেস ইয়াসমিন হাসলেন। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মেয়েটা প্রহনকে প্রচন্ড ভয় পায়।এই তো সেদিন কার কথা,স্কুলে ক্লাস টেস্ট পরীক্ষা হবে কিন্তু চৈতি পড়তেই রাজি না।তার ঝোঁক পড়েছিল ঘুমের উপর। ঘুম থেকে না উঠার জন্য দুই দিন স্কুলে যায় নি সে।সুযোগ পেলেই ঘুমিয়ে পড়তো। তেমনি পড়ার টেবিলে মাথা রেখে যখন ঘুমিয়ে ছিল তখন মিসেস ইয়াসমিন প্রহন কে ভিডিও কল দিলেন। চৈতির এই সব কান্ড দেখে হাসতে হাসতে শেষ প্রহন। মায়ের কড়া আদেশ চৈতি কে যেনো আচ্ছা মতো বকে দেয়। মেয়েটা তাকে একদম ভয় পান না। প্রহন কে যেহেতু একটু ভয় পায় সেহেতু ওর বকা খেলে আর এমন ঘুমিয়ে পড়বে না।সে বার প্রহনের ধমক খেয়েই সোজা হয়ে যায় চৈতি। তার পর থেকেই প্রহনকে বলে দেওয়ার কথা বললেই চৈতি ঘুম থেকে উঠে পরে। প্রহন তাকে একটা কথা বলেছিল যা মনে পড়লেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে।”পিচ্চি তুমি যখন ঘুমিয়ে থাকবা তখন আমি তোমার সামনে হাজির হয়ে যাবো।কানের নিচে ঠাসসস করে এটা চুমু দিয়ে বলবো আমাকে ছাড়া এত ঘুম আসে কোথা থেকে?”
মিসেস ইয়াসমিন রুম থেকে বের হয়ে যেতে যেতে বললেন,”আমি নাস্তা বানাতে যাচ্ছি। তুই ফ্রেশ হয়ে পড়তে বস।”

ঠোঁট ফুলিয়ে মিসেস ইয়াসমিন এর চলে যাওয়ার দিকে
তাকিয়ে বিড় বিড় করে বললো,”সব সময় উনার ভয় দেখাবে।সব্বাই পঁচা হয়ে গেছে।”

পড়ার টেবিলে বসে ঝিমুচ্ছে চৈতি। মিসেস ইয়াসমিন হাতে করে নাস্তার প্লেট নিয়ে চৈতির পাশে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে চৈতির দিকে তাকিয়ে আছে।
“প্রহন কে ফোন দিব?”

হকচকিয়ে গেল চৈতি। দুই হাত দিয়ে চোখ কচলিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে মিসেস ইয়াসমিন এর দিকে তাকিয়ে বললো,”ঘুমাচ্ছি না তো। চোখ বন্ধ করে পড়ছি তো।মনে মনে।”

মিসেস ইয়াসমিনের খুব হাসি পাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই তিনি চৈতির পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।আর তাকে বলছে সে ঘুমাচ্ছে না।
নাস্তার প্লেট টেবিলের উপর রেখে চৈতির উদ্দেশ্যে বললেন,”আমার চুল কী হাওয়ায় পাকছে?”

চৈতি চট করে বলে উঠলো,”এখনো সব পাকেনি তো।মাত্র কয়েক টা।”

“আমি ঐ গুলোর কথাই বলেছি।”

“ইয়াসমিন তুমি মেয়েটাকে এমন গোয়েন্দাদের মতো জেরা করছো কেন?”
কথা টা বলতে বলতে চৈতির পড়ার রুমের ভেতর প্রবেশ করেন রেদোয়ান চৌধুরী।
শ্বশুড় কে দেখেই উঠে দাঁড়ালো চৈতি। মাথায় কাপড় দিয়ে উনার কাছে গিয়ে অভীযোগি কন্ঠে বলে,”দেখেছেন আব্বু ভালো আম্মু শুধু উনার ভয় দেখিন আমাকে।”

রেদোয়ান চৌধুরী চৈতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তার কথা বুঝতে না পেরে বলেন,”কার ভয় মা?”

চৈতি নিচু স্বরে উত্তর দেয়,”আপনার ছেলের।”

চৈতির উত্তর শুনে হা হা করে হেসে উঠেন রেদোয়ান চৌধুরী।”বোকা মেয়ে। প্রহন তো এখন অনেক দূরে আছে।ওর ভয় দেখালে কী হবে?আর ওরে বললেও কী হবে?ও তো আর এসে তোকে বকতে পারবে না। দূর থেকে বকলে ঐ সব গায়ে মাখতে নেই।”

“দিলা তো,ভয় ভাঙ্গিয়ে দিলা।ওরে এখন কী করে পড়াতে বসাবে তা শুধু তুমি জানো। আমি আর নেই এই সব এর মধ্যে।”
কথা গুলো বলে মিসেস ইয়াসমিন রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। রেদোয়ান চৌধুরী মিসেস ইয়াসমিন এর কথার অর্থ বুঝতে পেরে দাঁত দিয়ে জিহ্ব কাটলেন।কী যে ভুল করেছেন এখন বুঝতে পারছেন তিনি।
চৈতির দিকে তাকিয়ে দেখলেন চৈতি ঠোঁটে শয়তানি হাসির রেখা টেনে উনার দিকে তাকিয়ে আছে।
রেদোয়ান চৌধুরী আবার বললেন,”প্রহন দূর থেকে বকলে হয় তো তোর সমস্যা নেই। কিন্তু ও কী একবার ও বাড়িতে আসবে না নাকি। তখন কিন্তু সামনে থেকে বকা দিবে।মারতেও পারে।”

রেদোয়ান চৌধুরীর কথা শুনে বেলুনের মতো চুপসে গেল চৈতি। মুখের ভাবভঙ্গি বদলে গেল নিমিষেই। চুপচাপ হেটে গিয়ে পড়ার টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে গিয়ে বসলো।গ্লাসে রাখা পানি গুলো এক ঢোকে খেয়ে বইয়ের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো।সব পড়াই যেনো নতুন নতুন লাগছে।অথচ এই পড়া গুলো আজ তিন দিন ধরে পড়ে যাচ্ছে।
রেদোয়ান চৌধুরী সামাল দিতে পারার খুশিতে গদগদ করতে করতে মিসেস ইয়াসমিন এর কাছে চলে গেলেন। সেখানে গিয়ে বললেন,”ইয়াসমিন চৈতিকে পড়ার টেবিলে বসিয়ে রেখে এসেছি আমি।কত শান্ত হয়ে পড়ছে এখন।”
মিসেস ইয়াসমিন এক পলক রেদোয়ান চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের কাজে ব্যাস্ত হলেন।

স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময়। স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে চৈতি। রেদোয়ান চৌধুরী নিতে আসবেন। প্রতিদিন আসেন। রৌদ্র উজ্জ্বল ঝলমলে দিন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে কৃষ্ণবর্ণের নীরদের তলে। ঊর্ধ্ব দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকালো চৈতি।মেঘ জমেছে। বৃষ্টি আসবে হয় তো! বর্ষার মৌসুম ঘনিয়ে আসছে।
চোখের পলকে চার দিক অন্ধকার হয়ে উঠলো। চৈতি সেই জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্কুল ছুটি হয়েছে মিনিট ২০ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখনো রেদোয়ান চৌধুরীর দেখা নেই।এত দেরী কখনো হয়নি কখনো।
বাতাস বইছে। ঝিরঝির বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পড়তেই তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে উঠলো কিশোরীর অবচেতন চিত্ত।
হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। মনের ভেতর থেকে অনবরত এক চৈতি যেনো নিষিদ্ধের দাবিতে ঝংকার করে বলে উঠছে”আমার গায়ে পড়ো না বৃষ্টি। আমি তাকে ছাড়া ভিজবো না।”
#অন্তহীন💜
#পর্ব_১৮
#স্নিগ্ধা_আফরিন

কৃষ্ণবর্ণ নীরদের ঘন বর্ষনের ঝুম ঝুম শব্দ স্পষ্ঠ। বৃষ্টির পানিতে টুইটম্বুর পিচ ঢালা পথ। পরিবেশ ঝাপসা, টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দে মুখরিত চার পাশ। নিষেধাজ্ঞা ভেঙ্গে বৃষ্টির এক ফোঁটা পানি ও কিশোরীর শরীর স্পর্শ করতে পারেনি। বৃষ্টির পানি গায়ে পড়ার আগেই মাথার উপর ছাতা ধরে না দেখা আগুন্তক।হাত ধরে টেনে দৌড়ে নিয়ে গিয়ে দোকানের ছাউনীর নিচে দাঁড় করিয়ে দেয়। বৃষ্টির পানি ছিটকে পড়বে বলে পায়ের সামনে ছাতা বসিয়ে দেয় লোকটা।আনন খানি চোখে পড়তেই বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায় চৈতি।কিয়ৎক্ষন মানুষটার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ টা ভ্রু নাচিয়ে মুচকি হেসে চৈতির দিকে এগিয়ে এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিস ফিস করে বলে,”আমাকে ছাড়া একা তোমাকে কখনো বৃষ্টিতে ভিজতে দিতাম না আমি।তাই তো বৃষ্টি শুরু হবার খানিক পূর্বেই চলে এসেছি।ম্যাজিক দেখেছো পিচ্চি?”বলেই হাসলো প্রহন।
কন্ঠনালিতে কথা আটকে গেল চৈতির। আরো এক দফা অবাক হলো সে। মনে মনে ভাবলো,”মনের কথা বুঝলো কী করে উনি?”
কিন্তু মুখ ফুটে একটা শব্দ ও বের হলো না। এই মানুষ টা কে কাছ থেকে দেখার তীব্র তৃষ্ণার্ত নেত্র পল্লব যেন প্রশান্তিতে শুধু চেয়েই রইলো।
চৈতি কে এমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেললো প্রহন। তার কাছ থেকে কিছু টা সরে এসে বললো,”আমি আসায় খুশি নও তুমি?”

“খুশি না মানে, আমার তো লাফাতে ইচ্ছে করছে।”
মনের কথা মনেই রইলো। মুখ ফুটে বলা হলো না। প্রহনের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল চৈতি। ধীর কন্ঠে বললো,”আপনি যে আজ আসবেন বলেননি তো!”

কোমরে দুই হাত রেখে বাইরের বৃষ্টির পানির দিকে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো প্রহন। রাস্তায় জমে থাকা পানির দিকে তাকিয়ে বললো,”আমি নিজেই জানতাম না যে আজ আসবো।”

প্রহনের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো চৈতি। বুঝতে না পেরে বললো,”মানে?”

ঘাড় ঘুরিয়ে চৈতির মুখের দিকে তাকিয়ে প্রহন জবাব দিলো,”মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায়। বাড়িতে আসার জন্য ইচ্ছে করছিল খুব। ছুটি তো সহজে পাওয়া যাবে না। তখন একটা শয়তানি বুদ্ধি উদয় হয়।ওটাই প্রয়োগ করে বাড়িতে চলে এসেছি।”

“সেটা আবার কেমন বুদ্ধি?”

“রাত তখন প্রায় ২টা।সিও স্যার কে ফোন করে বললাম,স্যার আমার আম্মু খুব অসুস্থ। আইসিইউতে এডমিট করা হয়েছে। আমি তার এক মাত্র ছেলে তাই আমাকে দেখতে চাচ্ছেন খুব।”

প্রহনের কথা শুনে থ হয়ে যায় চৈতি।”কী মারাত্মক মিথ্যা বললেন উনি।”
“আপনার এমন টা বলা উচিত হয়নি।”

“হুম জানি। কিন্তু মাঝে মাঝে বলতে হয়। তুমি দ্রুত বড় হয়ে যাও তাহলে আর বলতে হবে না।”
প্রহনের অধর জুড়ে শয়তানি হাসি।
চৈতি বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।”এই জন্যই আব্বু আমাকে নিতে আসেন নি।”

“আমার পিচ্চি বউ কে আমি নিয়ে যাবো। আব্বুর এসে কাজ নেই। আমি বারন করে দিয়ে ছিলাম।”

প্রত্যত্তরে চৈতি আর কিছু বললো না।চুপ করে বৃষ্টি পড়া দেখতে লাগলো।
দুজনেই চুপচাপ। যেন নীরবতা পালন করছে। প্রহন কী বলবে বুঝতে পারছে না।অথচ সারা রাস্তায় বাসে বসে বসে শত শত কথা জমিয়ে রেখেছিল প্রেয়সীকে উৎসর্গ করবে বলে।
বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় আছে পথচারীরা। হুটহাট এমন অসময়ের বৃষ্টিতে অনেক সমস্যাই ঘটে যায়।ছাতা থাকে না সাথে। গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজেও যাওয়া যায় না বৃষ্টির জন্য। প্রহনের মতো সব প্রেমিকরা কিন্তু বৃষ্টি প্রেমি না। অনেক এর অপছন্দের তালিকায় নাম লেখা আছে বৃষ্টির।
বেশ কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি পড়া কমে আসে।গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মাঝেই অনেকে রাস্তায় নেমে পড়লো।
সিএনজি ডেকে নিলো প্রহন। চৈতি কে ভেতরে বসিয়ে দিয়ে সে নিজেও চৈতির পাশে গিয়ে বসলো।
“আপনি কত দিন থাকবেন?”

“আম্মু যত দিন হসপিটাল থেকে বাড়িতে না আসে তত দিন।”

“তার মানে আপনি আরো মিথ্যা বলবেন?”

“কিছুই করার নেই।”

“অদ্ভুত তো! মিথ্যা বলা পাপ। আপনি জানেন না?”

“জানি।”

“তাহলে?”

“এত প্রশ্ন করো কেন?চুপ করে বসে থাকতে পারো না?সব কিছু তোমার বুঝতে হবে না।”

প্রহনের কথায় খারাপ লাগলো চৈতির।সাথে রাগ, অভিমান ও হলো।”বললাম না কথা। করলাম না প্রশ্ন।কী হবে? কিচ্ছু না! আমার সাথে কথা বলতে আসুক শুধু। একদম কথা বলবো না।”

গাল ফুলিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো চৈতি। প্রহন চৈতির দিকে তাকিয়ে আফসোসের সরে বললো,”ধুর শুধু শুধু বকলাম মেয়েটাকে।”

____________
ভেজা চুল তোয়ালে দিয়ে মুছতে ব্যস্ত চৈতি। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে টাটকা একটা গোসল না করলে শরীরটা কেমন মেজমেজ করে চৈতির। মেঘের বর্ষনের পর অন্তরীক্ষ পরিষ্কার।শহর জুড়ে আবারও আদিত্যর প্রখর তেজ পড়েছে। কমলা রঙের এক চিলতে রোদ এসে লুটোপুটি খাচ্ছে বেলকনির দেয়ালে। প্রহন বেলকনিতে এসে অবাক হলো।
“বাহ পিচ্চি দেখছি গাছ প্রেমি।”

চৈতি কোনো আগ্রহ দেখালো না প্রহনের কথায়।সে নিজের কাজে ব্যাস্ত। প্রহন আবারো বললো,”যাক আমার বউটা ও আমার মতো।গাছ, ফুল ভালোবাসে।জানো পিচ্চি, আমি যখন বাড়িতে থাকতাম তখন বেলকনি ছাদ গাছে আর ফুলে ভর পুর থাকতো।”

প্রহনের কথা কে পাত্তা না দিয়ে বেলকনি থেকে রুমে চলে আসে চৈতি।ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করে মাথায় কাপড় দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।এত দিন দূরে থেকে অভিমান করা হয়েছে।আজ না হয় কাছে থেকে অভিমান হোক। প্রেমিক পুরুষ কি করে সেই সলাজ অভিমান ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে প্রনয়ের চাদরে জড়িয়ে নিবে সেটাই দেখা হোক।

মিসেস ইয়াসমিন চৈতি কে দেখে মুচকি হাসলেন।ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখতে রাখতে বললেন,”কীরে মুখটাকে এমন বাংলার পাঁচ এর মতো করে রাখলি কেন?”

চৈতি ডাইনিং টেবিলের উপর রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে চেয়ারে বসলো। তিন ঢোক পানি খেয়ে বললো,”মাথা ব্যথা করছে একটু।তাই আর কি…”

মিসেস ইয়াসমিন আর কিছু বললেন না।প্লেটে খাবার বেড়ে চৈতির দিকে এগিয়ে দিলেন। কন্ঠ স্বর উঁচু করে প্রহন কে ডাক দিলেন।”প্রহন খেতে আয়। সেই যে আসলি কিছুই খাস নি।”

প্রহন খায়নি কথা টা শোনার পর চৈতির ও খাবার মুখে দিতে ইচ্ছে করলো না।মন সায় দিলো না। কেন দিলো না তা সে জানে না।
চৈতির ইগনোরে প্রহনের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তখন এর কথায় মেয়েটার রাগ হয়েছে।”সামান্য একটা কথায় একেবারে কথা বলাই বন্ধ করে দিলো। ইশশশ কী ঝাল মরিচ রে বাবা।”
_____________
ছাদের গাছ গুলো প্রাণ ভরে বৃষ্টির পানি খেয়েছে। বৃষ্টি টা একপ্রকার উপকার করলো চৈতির। কষ্ট করে আজ আর পানি দিতে হবে না। মাথা টা ধরেছে। বিছানার এক কোণে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে চৈতি। তার পাশেই গালে হাত দিয়ে বসে আছে প্রহন।
“ঐ পিচ্চি সরি।”

প্রহনের সরি শুনে চোখ বন্ধ করে ফেলল চৈতি।নিজেই বকবে আবার নিজেই সরি বলবে যত্তসব ঢং।

“আরে পিচ্চি টিয়া পাখি এমন রাগ করতে নেই।”
চৈতি শুনেও না শোনার ভান করে শুয়ে আছে।আজ যত যাই বলুক না কেন সে টু শব্দটি ও করবে না।

“দেখো পিচ্চি, আমি সেই কত দূর থেকে কত মিথ্যে কথা বলে বাড়িতে আসলাম আর তুমি এমন রাগ করে শুয়ে থাকলে কিন্তু হবে না।”

চৈতির কোনো সাড়া শব্দ নেই। প্রহন কিয়ৎক্ষন চৈতির মুখের দিকে তাকিয়ে বসা থেকে উঠে রুম থেকেই চলে গেল। নিজের চেয়ে বেশি কম বয়সী মেয়ে কে বিয়ে করলে এই এক সমস্যা। কিছুই বলা যাবে না। অভিমানে গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে।

মিসেস ইয়াসমিন এর রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মাকে কয়েক বার ডাকদিলো প্রহন। কিন্তু মিসেস ইয়াসমিন এর কোনো সাড়া পেলেন না।খুশিই হলো সে। রেদোয়ান চৌধুরী বিকেলের সময়টাতে বইয়ের ভেতরে ডুবে থাকেন।তাই আর তাকে ডাকলো না প্রহন।চট জলদি রুমে এসে বিছানার উপর থেকে চৈতি কে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে ছাদে উঠে গেল।সব কিছু এত দ্রুত ঘটলো যে চৈতি কিছু বুঝেই উঠতে পারলো না।
চৈতি কে নামিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলো। প্রহনের এহেন কান্ডে হতভম্ব চৈতি।আজব মানুষ তো!
“কী হয়েছে সামান্য কথায় এত রাগ করতে হয়?”

মুখ ফিরিয়ে নেয় চৈতি।সে রাগ করেছে। ভীষণ রাগ! কেন এমন করে বলবে?একটাই অভিযোগ তার। আসলে প্রিয় মানুষ গুলোর সামান্য কড়া কথায় ও অভিমান জমে যায় আমাদের মনে। খারাপ লাগে, কষ্ট হয়।

“আমার সাথে কথা বলবে না তো? ঠিক আছে বলো না। আমি আজ রাতেই আবার ফিরে যাবো। আর বছরে ও আসবো না।”

প্রহনের কথা শুনে বুকের বা পাশে চিন চিন করে উঠলো চৈতির। মুখ ফুটে বলেই ফেলল,”আপনি নিজ থেকেই বকবেন,নিজ থেকেই রাগ ভাঙাতে চাইবেন কেন?”

চৈতির কথা শুনে প্রহন চৈতির কোমর জড়িয়ে ধরে এক টানে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো। কেঁপে উঠলো চৈতি। আলতো করে চোখের সামনে আসা চুল গুলো কানের পিছে গুঁজে দিল। প্রহনের স্পর্শ পেতেই নেত্র পল্লব কুঁচকে ফেললো চৈতি।
চৈতির লাজুক আননের পানে চেয়ে প্রহন জোর গলায় বললো,
“তোমাকে যখন ইচ্ছে বকবো,যখন ইচ্ছে রাগিয়ে দিবো।যখনই মন চাইবে রাগ ভাঙাবো। ইচ্ছে হলে অনেক টা কাছে যাবো আবার ইচ্ছে হলে অনেক বেশি দূরে সরে যাবো। ইচ্ছে হলে ভালোবাসবো, ইচ্ছে হলে আদর করবো।মন চাইলে কষিয়ে একটা চড় দিবো।যখনই মন চাইবে তখনই কপালে গাঢ় করে চুমু দিবো।কারন তুমি শুধু আমার। একান্তই আমার।বুঝছো বউ?”

#চলবে,,,,,,
#চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here