অন্তহীন পর্ব -২৩+২৪

#অন্তহীন💜
#পর্ব_২৩
#স্নিগ্ধা_আফরিন

প্রহনের গলার আওয়াজ পেয়ে সবাই ততক্ষণে গেস্ট রুমে এসে হাজির। মুহিতের শার্টের কলার চেপে ধরে প্রহন কে রেগে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো চৈতির। প্রহনের এত রাগ আজ প্রথম দেখছে সে।
মুহিত প্রহনের দিকে তাকিয়ে বললো,”সরি দোস্ত। আমি তো তোকে জেলাস করানোর জন্য ওমন করে বলেছি। কিন্তু তুই এতটা রেগে যাবি বুঝতে পারিনি।”

মিসেস ইয়াসমিন প্রহনের হাত থেকে মুহিতের শার্টের কলার ছাড়িয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললেন,”কী হয়েছে তোদের?”

প্রহন রাগে গজগজ করছে। রেদোয়ান চৌধুরী মুহিতের কাছে গিয়ে শার্ট ঠিক করে দিয়ে বললেন,”কী হয়েছে মুহিত? প্রহন এত রেগে আছে কেন?”

রেদোয়ান চৌধুরীর প্রশ্নের উত্তরে প্রহন বলে উঠে,”কারন ও চৈতি কে নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছে।”
প্রহনের কথা শুনে কেঁপে উঠলো চৈতি।বাজে মন্তব্য মানে?মনে মনে ভাবলো সে,”রিফাত যেমন বাজে কথা বলতো সে রকম কিছু কী?”
প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে প্রহনের দিকে তাকালো চৈতি। প্রহনের দৃষ্টি মুহিতের দিকে। তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে চৈতির দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে ধমক দিয়ে উঠলো প্রহন।”এখানে কী করছো তুমি? রুমে যাও বলছি।”
প্রহনের চিৎকারে ঘাবড়ে গেল চৈতি। দ্রুত পায়ে হেঁটে রুমে চলে গেল সে।
মিসেস ইয়াসমিন প্রহনের কাছে গিয়ে বললেন,”কী বলেছে মুহিত?”

“আন্টি আমি তো প্রহন কে জেলাস করানোর জন্য বলেছিলাম। কিন্তু ও যে এত রেগে যাবে বুঝিনি।বুঝলে এমন করে কখনোই বলতাম না।”

“আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি মুহিত। প্রহন কে জিজ্ঞেস করেছি।তাই আমি মনে করি আমার প্রশ্নের উত্তর প্রহনের দেওয়া উচিত।”

“কী বলেছে জানো, আমার বউ নাকি অনেক হট। নজর খারাপ হয়ে গেছে ওর।”

প্রহনের বলা কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন মিসেস ইয়াসমিন এবং রেদোয়ান চৌধুরী।

“ছিঃ মুহিত। তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি। চৈতি তোমার বন্ধুর বউ। মেয়েটা অনেক ছোট তোমাদের চেয়ে। ছোট বোন হয় তোমার। তাকে নিয়ে এমন কথা ছিঃ”

“আন্টি আমি তো শুধু জেলাস….”
মুহিতের পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে মিসেস ইয়াসমিন বলে উঠলেন,”এটা কোন ধরনের জেলাস করানোর উপায় বলো আমাকে? তোমার যদি প্রহন কে জেলাস করতেই হবে তাহলে অন্য ভাবে ও তো করতে পারতে। এমন কথা বলে শুধু শুধু সবার চোখে নিজেকে খারাপ প্রমান করার দরকার কি ছিল? আচ্ছা সব কিছু বাদ দিলাম।আজ যদি চৈতি তোমার বোন হতো তাহলে কি এমন করে বলতে পারতে?”

মিসেস ইয়াসমিন এর প্রশ্নের উত্তর নেই মুহিত এর কাছে।সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

“মা ওকে চলে যেতে বলো। আমার আগের ফ্রেন্ড মুহিত আর এই মুহিত এর মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। আগের মুহিত মেয়েদের সম্মান করতে জানতো। কিন্তু এই মুহিত জানে না।”

“দেখ দোস্ত আমি মজার ছলে বলেছি। তুই কেন এতো সিরিয়াসলি নিলি?”

“আজ যদি তোর পছন্দের মানুষটিকে আমি কিংবা অন্য কেউ এমন করে বলতো তোর কী রাগ হতো না?যাই হোক আমার মেজাজ আর খারাপ করিস না। তুই চলে যা।যে দিন আবার আগের সেই মুহিত হতে পারবি সেদিন আমার সামনে এসে দাঁড়াবি।এর আগে না।”
_______
প্রকৃতি তখন বৃষ্টিতে ভিজতে ব্যস্ত। চারদিকে ঝাপসা হয়ে গেছে।বেলকনির গ্রিলের উপর একটা চড়ুই পাখি আধ ভেজা হয়ে ঠোঁট দিয়ে পালক খুঁটছে। বৃষ্টি পড়ার শব্দ স্পষ্ঠ। বৃষ্টির ছিটকে পড়া পানিতে বেলকনির ফ্লোর ভিজে একাকার। একটা হাত বৃষ্টির পানিতে ভিজতে ব্যস্ত। রুম থেকে কেউ একজন ঘুমন্ত কন্ঠে বারবার করে বলে যাচ্ছে,”বৃষ্টিতে ভিজে যাবে। রুমে আসো চৈতি। বৃষ্টির পানি সয় না তোমাকে।আসো বলছি।”
কে শুনে কার কথা চৈতি তো আপন খেয়ালে বৃষ্টি উপভোগ করছে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। চোখে মুখে পানির ছিটা এসে পড়লেই চোখ কুঁচকে ফেলে সে।কী এক সুন্দর অনুভূতি।
শোয়া থেকে উঠে বসে প্রহন।নিজে গিয়ে নিয়ে না আসলে মেয়েটা আসবে না।বড্ড বেশি সাহস বেড়েছে। একদমই কথা শুনতে চায় না।
বেলকনি থেকে হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছে প্রহন। চৈতি হাসছে,একা একা নিজের সাথে।
“তুমি আমার একটা কথা ও শোনো না চৈতি। তোমাকে বলেছি না রুমে আসতে।”

প্রহন কে বেলকনির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে গেল চৈতি। প্রহনের হাত ধরে বললো,”চলুন না আজ আবার বৃষ্টিতে ভিজি।”

“মাইর চিনো?সে বার কেমন জ্বর উঠে ছিল মনে নাই? বৃষ্টিতে ভেজার দরকার নেই।”

প্রহনের কথা শুনলো না চৈতি।আবারো চলে গেল বৃষ্টির পানি ছুঁতে। সেখানে দুই মিনিট দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই তার মনে হলো সে শূন্যে ভাসছে।
হাত পা ছুড়তে ছুড়তে বললো,”আরেএএ আপনি আমাকে কোলে নিলেন কেন? ছাড়ুন বলছি।”
প্রহন চৈতির কথার উত্তরে বলে উঠলো,”সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বেকা করতে হয়। এতবার বললাম রুমের ভেতর এলে না তাই তো বাধ্য হয়ে আমাকেই কোলে নিয়ে যেতে হচ্ছে।”

রুমের ভেতর নিয়ে এসে চৈতি কে বিছানার উপর বসিয়ে দিল প্রহন। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিয়ে বললো,”একটা মানুষ এত চিকন হয়?৪০ কেজি ওজনের ও তো হবে না তুমি।”

চৈতি ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমানী কন্ঠে বললো,”আপনি আমায় শুধু শুধু নিয়ে আসলেন কেন?”

“ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবেই বা কেন?”

“আমার ভালো লাগে বৃষ্টি দেখতে। ভিজতে তো দিবেন না।তাই বলে কি দেখতে ও দিবেন না?”

চৈতির কথা শুনে প্রহন প্রত্যত্তর করলো না। বিছানায় শুয়ে পড়লো। চৈতির হাত ধরে টান মেরে নিজের বুকের উপর ফেলে গায়ে কম্বল টেনে দিলো। চৈতির চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,”ঘুমাও।”

বাঁধ সাধলো চৈতি। ফিসফিস করে বললো,”আপনি ঘুমান। আপনি ঘুমিয়ে পড়লেই তো আমি বৃষ্টি ছুঁতে পারবো।”

চৈতির মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে শান্ত কন্ঠে ভয়ঙ্কর হুমকি দিলো প্রহন।”একবার শুধু বিছানা থেকে নেমে দেখো তোমার পা ভেঙ্গে বিছানায় শোয়াই রাখবো।”

গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো চৈতি। বিড়াল ছানার মতো শান্ত হয়ে প্রহনের বুকের ভেতর শুয়ে পড়লো। বৃষ্টি থামলে রাতের দিকে হয়তো নিজের বাবার বাড়িতে যাওয়া হবে।আর যদি বৃষ্টি পড়তেই থাকে আজ আর যাওয়া হবে বলে মনে হয় না চৈতির।
.
সময় টা তখন বিকেলের। তবে নিত্যদিনের মতো আজ আর অন্তরীক্ষে দিনমনির আধিপত্য নেই।অম্বর আজ অভ্ররের দখলদার।ভারি বর্ষণে ভিজছে পাহাড়, রাজপথ, কোলাহল পূর্ণ ব্যস্ত নগরীর অলি গলি।সতেজ হচ্ছে গাছের পাতা।বড় বড় গাছের মগডালে ভিজে একাকার হয়ে নষ্ট হচ্ছে বোবা পাখির বাসা।
প্রহনের রুমের বেলকনিতে একটা বিড়াল ডাকছে ম্যাউ ম্যাউ করে। অন্ধকার সুনসান নীরবতায় ভরপুর রুমের ভেতর নিদ্রায় আচ্ছন্ন দুই জন মানব মানবি।
বাহিরে বৃষ্টি থামার নাম নেই।মুষল ধারে বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টির সময় গরম গরম খেচুড়ি হলে মন্দ হয় না বলেই মিসেস ইয়াসমিন রান্না ঘরে চলে গেলেন খেচুড়ি রান্না করতে।রন্ধন প্রিয় মানুষের একটাই কাজ সঠিক একটা সময় আসলে সুন্দর একটা খাবার রান্না করে পরিবারের সবাই কে খাওয়ানো। রেদোয়ান চৌধুরী বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে বই পড়ছেন। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে আর তিনি রুমে বসে বই পড়ছেন। বৃষ্টির সময়টা বই পড়ার অন্যতম সুন্দর একটা সময়।
সাথে এক কাপ গরম চা বা কফি হলে জমে যাবে।
রেদোয়ান চৌধুরী হাঁক ছাড়লেন,”ইয়াসমিন,এক কাপ চা দিও তো।”
.
বুকের উপর ঘুমিয়ে থাকা ঘুমন্ত চৈতির চোখের সামনে এলোকেশ গুলো এসে জড়ো হয়েছে। প্রহন সেই চুল গুলো বারবার কানের পিছে গুঁজে দিয়ে ঘুমন্ত মুখটা দেখে মায়ায় আটকে পড়ার পথ খুঁজে চলেছে।
ঘুমাবে না বলে ও মেয়েটা ঘুমাচ্ছে। অথচ তার নিজের চোখে বিন্দু পরিমাণ ও ঘুম নেই। বালিশের পাশে মোবাইল টা বেজে চলেছে।হাত বাড়িয়ে মোবাইল টা নিলো প্রহন। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে আছে সিও স্যারের নাম্বার।
অবাক হলো প্রহন। সকালে ও স্যারের সাথে কথা বলেছে সে। হঠাৎ আবার কল দিল কেন বুঝলো না।বার কয়েক রিং হতেই কল রিসিভ করে সালাম দিলো।
সালামের জবাব শোনার পর স্পষ্ঠ শুনতে পেল,”আমি তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি প্রহন।”
#অন্তহীন💜
#পর্ব_২৪
#স্নিগ্ধা_আফরিন

চওড়া বক্ষের উষ্ণতা পেয়ে পাখির ছানার মতো গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে চৈতি। দুই হাতের আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে রেখেছে প্রহন। বাইরের পরিবেশ বৃষ্টিময়। ঠান্ডা ও বটে। জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে প্রহন।সিইও স্যারের বলা কথা গুলো মনে পড়তেই বড় একটা শ্বাস ফেললো সে।
একটু আগে যখন সিইও স্যারের মুখে ওমন কথা শুনে ছিলো তখন মনে হচ্ছিল চাকরিটা বোধহয় গেল।
কিয়ৎক্ষন পূর্বের ঘটনা,
সিইও স্যারের কথা শুনে প্রহন বলে উঠে,
“সরি স্যার। আমি আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারিনি।”
“বুঝতে পারবে না তো।আমার কাছ থেকে লুকোনোর কি খুব প্রয়োজন?একটা বার জানালে কি ক্ষতি হতো?”
“আসলে স্যার আমার কিছু করার ছিল না।”
“প্রহন, তোমার মায়ের যে শরীর এতটা খারাপ তা আমাকে বলতে তো পারতে। তোমাকে বলেছি না আমাকে আপডেট জানাতে। তাহলে তুমি বললে না কেন তোমার মায়ের ক্রিটিক্যাল অবস্থা। ভাগ্যিস রিমন আমাকে জানিয়েছে তোমার কিছু টাকার দরকার এবং ছুটির দিন বাড়িয়ে দিতে না হলে তো আমি জানতেই পারতাম না।”
সিইও স্যারের কথা শুনে থ হয়ে গেল প্রহন।কী ভেবেছিল সে আর কী হলো? তবে রিমন কে অনেক ধন্যবাদ দিতে মন চাইছে প্রহনের।টাকার দরকার না থাকলে ও আরো কয়েক দিন ছুটি প্রয়োজন ছিল প্রহনের।
“আসলে স্যার,,”
“কী আসল নকল করছো বলো তো? তোমার কত টাকা লাগবে বলো। মায়ের চিকিৎসা তো করাতে হবে তাই না?এত লজ্জা করার কিছু নাই।”
“না না স্যার।টাকার দরকার নাই। আপনি বরং আমাকে আরো কয়েক দিনের ছুটি বাড়িয়ে দিন।”
“আচ্ছা। তোমার মা হসপিটাল থেকে রিলিজ হয়ে বাড়িতে গেলে আমাকে জানিও।”
“আচ্ছা ঠিক আছে স্যার।”

নড়েচড়ে উঠলো চৈতি। ঘুমের ঘোরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে প্রহন কে। ঘুমন্ত চৈতির মুখের উপর থেকে চুল সরিয়ে দিয়ে গালে আলতো করে অধর ছোঁয়ায় প্রহন।নিদ্রায় শায়িত প্রেয়সীর অজান্তে দুই বার তার গালে অধর ছুঁয়েছে রিক্ত প্রেমিক। শুনেছি, বিয়ের পর নাকি প্রেমিকরা স্বামী হয় আর স্বামীরা নাকি কখনো প্রেমিক হতে পারে না। অথচ বিয়ের পরেই তো সম্পর্কটা হারাম থেকে হালাল হয়।আর হালাল সম্পর্কে মহান সৃষ্টিকর্তা এমনিতেই ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দেন।
বউয়ের জন্য সবটুকু ভালোবাসা খুব যত্ন করে রেখেছে প্রহন। জন্ম একবার, জীবন ও একটাই,মন একটা সেই মনের অধিকারী তো একজনই হবে। ভালোবাসা টা তো সবার মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার জিনিস না।যে যাকে ইচ্ছা তাকেই ভালোবাসায় ভরিয়ে দেওয়া যাবে।
চৈতির মাথা হাতের উপর থেকে সরিয়ে বালিশের উপর রাখলো প্রহন। ধীরে সুস্থে চৈতির কাছ থেকে সরে বিছানা থেকে নেমে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

সময় টা তখন বিকেল সাড়ে ৫টা।আজ গোধূলি নেই।অন্তরীক্ষ জুড়ে লাল নীল হলুদ কমলা রঙের সুন্দর সংমিশ্রণ নেই। ধূসর রঙের নীরদ বাহনে ভরে আছে অম্বর। বৃষ্টি থামার নাম নেই। ঝিরঝির করে পড়ছে তো পড়ছেই। চারদিকে ঝাপসা আঁধার।
মিসেস ইয়াসমিন চুলায় খেচুরি বসিয়েছেন। রেদোয়ান চৌধুরী গরম চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন আর মনোযোগ সহকারে বইয়ের অবাস্তব কাহিনী পড়ছেন।
বই পড়ুয়া বাবাকে এক পলক দেখে মায়ের কাছে চলে গেল প্রহন। রান্না ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে মায়ের দিকে তাকালো প্রহন।
বেশ অনেক দিন পর মাকে আজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। চোখের চশমাটার পাওয়ার বাড়াতে হবে। শরীরের চামড়ায় ভাঁজ পড়ছে। চোখের দৃষ্টি শক্তি ও কমে গেছে আগের চেয়ে। মাথার চুল পাকা ধরেছে।
তবু ও কি সুন্দর, স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে মাকে। কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে মন দিয়ে রান্না করছেন।মা বাবা কে ছেড়ে থাকার চিন্তা ও করতে পারে না সে। অথচ সময় যত যাচ্ছে বাবা মা কে হারিয়ে ফেলার ভয় ও তত বাড়ছে।তারা যে বৃদ্ধ হচ্ছে।
মিসেস ইয়াসমিন এর চোখ পড়লো তার দিকে তাকিয়ে থাকা প্রহনের দিকে।
বড্ড আদরের ছেলে তার। প্রহন তার বাবা মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। প্রহনের আগে মিসেস ইয়াসমিন আর রেদোয়ান চৌধুরীর ঘর আলো করে তাদের রাজকন্যা জন্ম নেয়। মিসেস ইয়াসমিন খুব শখ করে মেয়ের নাম রেখেছিলেন ইতি।ইতির বয়স যখন দুই মাস তখন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল ছোট মেয়েটা। জীবনের গল্পের ইতি টেনে মা বাবার কোল খালি করে পরপারে পাড়ি জমায়।তাই হয়তো মিসেস ইয়াসমিন এবং রেদোয়ান চৌধুরী চৈতির মূল্যটা বুঝতে পারেন। চৈতি কে ও নিজেদের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন।
প্রহন মায়ের দিকে এগিয়ে গেল। মুচকি হেসে বললো,”কী রান্না করছো আম্মু?”
মিসেস ইয়াসমিন তরকারি নাড়তে নাড়তে বললেন,”খেচুরি আর গরুর মাংস ভুনা।”
দীর্ঘ শ্বাস নিলো প্রহন।”আহ্ কী সুন্দর ঘ্রান আসছে। রান্নার জন্য তুমি কিন্তু বেস্ট আম্মু।”
মিসেস ইয়াসমিন প্রহনের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রত্যত্তরে বললেন,”চৈতির রান্না ও কিন্তু অনেক মজার। একবার খেলে আরেক বার খেতে চাইবি না।”
মায়ের কথা শুনে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকালো প্রহন।
“মজার আবার একবারের বেশি খাওয়া যাবে না এর মানে কি আম্মু? তার চেয়ে ও বড় কথা চৈতি রান্না পারে নাকি?”
মিসেস ইয়াসমিন এর সোজা সাপ্টা উত্তর,”পারে না। আমার মতন রান্না শিখেয়ে দিবো চৈতি কে।যেনো কখনো আমার অনুপস্থিতিতে ও আমার রান্নার মতন রান্নার স্বাদ পাস।”
মায়ের কথা শুনে বুকের ভেতর কেপে উঠলো প্রহনের। পেছন থেকে মাকে জড়িয়ে ধরে নরম গলায় বললো,”তোমার আর বাবার অনুপস্থিতির সময়টা কখনো না আসুক। আমি তোমাদের ছেড়ে থাকতে পারবো না।”
প্রহনের কথা শুনে হাসেন মিসেস ইয়াসমিন। ছেলেটা ছোট থেকেই মা বাবার জন্য পাগল। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,”অনেক সময় তো হলো। চৈতি কে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুল। মেয়েটা দুপুরে ও ঠিক মতো খায়নি।”
প্রহন ছোট্ট করে উত্তর দিলো,”হুম।”
রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে গেল প্রহন। শীত শীত অনুভব হতেই ঘুম ভেঙ্গে যায় চৈতির। আঁখি পল্লব মেলে তাকিয়ে রুমের ভেতর শুধু নিজেকেই আবিষ্কার করলো সে। দুই হাত দিয়ে চোখ কচলিয়ে দৃষ্টি পরিষ্কার করলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে প্রহন কে খুঁজলে। কিন্তু পেলো না। দুপুরে কেন জানি খুব রাগ হয়েছিল প্রহনের উপর। সামান্য কাঁধ ধরতেই কী রাগটাই না করেছিল। সেই সব কথা মনে পড়তেই আনমনে হাসলো চৈতি। কেন জানি মাঝে মধ্যে মনে হয় এই মানুষটি কে ছাড়া তার চলবেই না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই মানুষ টা কেই চাই তার। রুমের ভেতর এসে চৈতি কে বিছানায় বসে বসে এমন মুচকি মুচকি হাসতে দেখে শয়তানি হাসে প্রহন। চৈতির কাছে গিয়ে বলে উঠে,”কী বউ, ঘুমের মধ্যে কী রোমান্টিক স্বপ্ন দেখেছো যে এমন করে মিটিমিটি হাসছো?”
প্রহনের এহেন কথায় হাসি মিলিয়ে যায় চৈতির। বিরক্ত হয়ে বলে উঠে,”আপনার কী এই সব কথা ছাড়া অন্য কোনো কথা জানা নাই?”
চৈতি কে রাগিয়ে দিতে সক্ষম হয় প্রহন। আরেক টু রাগিয়ে দেওয়ার জন্য বলে উঠে,”একটু এই দিকে আসো তো, কপালে একটা আদর দিই।”
এহেন কথায় বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে দাঁড়ায় চৈতি। কাভার্ডের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বলে,”দূরে থাকুন। একদম কাছে আসবেন না।”
কাউকে জ্বালানোর সুযোগ পেলে তা হাত ছাড়া করতে নেই।সুযোগ কাজে লাগাতে হয়। সেই কাজটাই এখন করছে প্রহন।এক পা এক পা করে চৈতির দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,”একটু কাছে যাই না।কী হবে? কিচ্ছু হবে না তো।”
চৈতি আমতা আমতা করে বললো,”ভালো লাগে না আমার। দূরে থাকুন প্লিজ।দম আটকে আসে।”
চৈতির কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়লো না প্রহন। বরং একদম চৈতির কাছে এগিয়ে গেল। চৈতি সরে যেতে নিলে চৈতির হাত ধরে টেনে নেয় প্রহন। দুই হাতের আলিঙ্গনে জড়িয়ে নেয় কিশোরী বউ কে।অন্য এক নেশায় আসক্ত কন্ঠে বলে উঠে,”তুমি মরে যাও চৈতি। আমার ভালোবাসায় দম আটকে একেবারে মরে যাও।”

#চলবে,,,
#চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here