অন্যরকম ভালোবাসা, পর্ব:৫

#অন্যরকম_ভালোবাসা

#আফসানানীতু

#পর্ব_৫

অন্তরার পরীক্ষা চলছে , প্রচুর ব্যস্ততা! তবে এত ব্যস্ততার মাঝেও প্রতি রাতে ও নিয়ম করে ল্যাপটপে ফেসবুক অন করে রাখে। পড়ার মাঝে প্রায়ই টুক করে একটু চোখ বুলিয়ে চেক দিয়ে দেখে স্পন্দনের চ্যাটবক্সে সবুজ বাতি জ্বলে কিনা। মনের ভেতর অভিমানেরা কালো মেঘ সেজে ভেসে বেড়ায়। না হয় বলেই ছিলো অন্তরা যোগাযোগ বন্ধ রাখতে, তাই বলে এম্নি করে নাই হয়ে যাবে ছেলেটা !! আবার কখনো কখনো ভাবনা হয়, মনে হয় …ওর সাথে যোগাযোগ না করলেও ফেসবুকে ওর এ্যাক্টিভিটি তো থাকার কথা , তাও নেই। একেবারে চুপ! কোনো বিপদ হলো নাতো স্পন্দনের ? ইস্! কেনো যে ওর মোবাইল নাম্বারটা নিলো না অন্তরা ! সেজন্য মনে মনে নিজেকে হাজার বার বকে অন্তরা।

কতদিন স্পন্দন কল করতে চেয়েছে! অন্তরাই ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে এড়িয়ে গেছে। এতো এতো ম্যাসেজ চালাচালি, অথচ সরাসরি কল করে কথা বলতে বললেই কেমন লজ্জা লজ্জা করতো ওর। ম্যাসেজে তো যা খুশি বলা যায় তাতে মনের ভাবনা প্রকাশের অবকাশ নেই ,কিন্তু ফোনে তো গলার স্বরের তারতম্যে অনেক সময় সুপ্ত বাসনাগুলো প্রকাশ পেয়ে যায় । অন্তরা তাই ধরা পড়তে চায়নি। কিন্তু এখন আফসোস হচ্ছে ওর, একটা দিন… শুধু যদি একটা দিনও স্পন্দন ওকে কল দিতো তবে আজ ওকে নিয়ে এত ভাবতে হত না অন্তরার।

***

কলেজ থেকে বেরিয়ে ফরিদকে দেখতে পেয়ে হাতের ইশারায় ডাকলো অন্তরা।

– কেমুন আছেন আপা , শোইলডা বালা ?

– হুমম ,তুই কেমন আছিস ?

ফরিদ হেসে মাথা কাত করে জানায় সেও ভালই আছে। তারপর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকে অন্তরার দিকে। অন্তরা একটু ইতস্তত করে শেষমেষ লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেলে,
– তোর ভাইয়ের কোনো খবর জানিস ফরিদ ?

– কোন ভাই?
চটপটে ফরিদের এলাকা জোড়া বড় ভাই, তাই সে প্রথমে ধরতে পারে না অন্তরা কার কথা বলছে ।

অন্তরা বাঁধো বাঁধো কণ্ঠে বলে,
– স্পন্দন ভাই ।

– ওহ আইচ্ছা! না আপা , ভাইরে তো কতদিন ধইরা এলাকাত দেহি না। মনে লয় ভাই বাড়িত নাই। কেন আপা ,কিসু হইসে ?

– না তেমন কিছু না , ইয়ে …. তুই আমার একটা কাজ করে দিতে পারবি ?

-জান হাজির! কী কাজ করতে হইবো কন ?
ফরিদ বুক ফুলিয়ে দাঁড়ায়।

– তোর ভাইয়ের মোবাইল নাম্বারটা আমাকে একটু জোগাড় করে দিতে পারবি?

কথাটা শোনার সাথে সাথে ফরিদের মুখ শত পাওয়ার বাল্বের মত উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে ওঠে। সে কেতাদুরস্ত হাতে প্যান্টের পকেট থেকে একটা শতচ্ছিন্ন মানিব্যাগ বের করে , তারপর খুঁজে পেতে তার এক কোণে রাখা একটা কাগজ বের করে অন্তরার দিকে বাড়িয়ে ধরে। দোমড়ানো মোচড়ানো একটা কাগজকে ভাঁজ করে সমান করার চেষ্টা হয়েছে । কাগজটা অন্তরার দিকে বাড়িয়ে ধরে সে সলজ্জ ভঙ্গিতে বলে,

– সেইদিন যে কাগুজটা ফেলায় দিসিলেন। পরে লাগতে পারে মনে কইরা রাইখা দিসিলাম।

অন্তরা কাগজটা খুলে দেখে তাতে বেশ গুছিয়ে একটা মোবাইল নাম্বার লেখা , নীচে লেখা ….

“স্পন্দন নাম আমার।
ভালো লাগলে কল দেবেন প্লীজ ”

অন্তরার আনন্দে নাচতে ইচ্ছা করে। সে ফ্ট্টাস করে ব্যাগ থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে ফরিদকে দিয়ে বলে,
– নে তোর ট্রিট ।

– এইডার মানে কি বখশিশ আপা ?
ফরিদ মাথা চুলকে জানতে চায় ।

-হুম ।
মুখ টিপে হাসে অন্তরা।

ফরিদ হাত বাড়িয়ে নোটটা নেয় তারপর স্যালুট দেয়ার মত ভঙ্গি করে লাফিয়ে লাফিয়ে ভিড়ে মিশে যায়।

– যাক্! পরান বন্ধুর নাম্বার পাইলা শেষমেষ !
প্রীতি উত্সুক হয়ে বকের মতো গলা বাড়িয়ে কাগজটা দেখার চেষ্টা করে। অন্তরা প্রীতির কাছে লুকায় না কিছুই, তাই বন্ধুর মনের অবস্থার খবর অজানা নেই তার। এতোদিনে অন্তরার উতলা থমথমে মুখে হাসি ফুটতে দেখে প্রীতিও যেনো স্বস্তি পায়।
– দেরী করে লাভ নাই,এখনই ফোন লাগা দোস্ত।

-আরে এত তাড়া কিসের ?

অন্তরা মুখে বলে ঠিকই তবে রিকশায় উঠেই স্পন্দনের নাম্বারে ডায়াল করে। কিন্তু তার পরপরই অন্তরার আনন্দিত মুখে আবারও কালো মেঘেরা দল পাকায় । সে থমথমে মুখে মোবাইল কানে চেপে ধরে বসে থাকে ।
এদিকে ওপাশ থেকে অপারেটর একঘেয়ে সুরেলা কণ্ঠে বলেই চলে,
” এই মুহূর্তে আপনার কাঙ্খিত নাম্বারে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না ”
কখনো ইংরেজিতে, কখনো বাংলায় …….

***

অন্তরার ঘুম ভেঙ্গেছে অনেক আগেই। তবে উঠতে ইচ্ছা করছে না। অবশ্য ওঠার তেমন কোনো তাড়াও নেই ওর। পরীক্ষা শেষ, তাই এখন বেশ খানিকটা অবসর। অন্তরা শুয়ে শুয়ে স্পন্দনের কথা ভাবছে। এক মাস হয়ে গেলো , অথচ স্পন্দনের কোনো খবর নেই! এলাকাতেও নাকি দেখেনি ওকে ফরিদ। ফোনটাও সুইচ অফ করা। গেলো কোথায় ছেলেটা ?

এমন সময় এক কাপ চা হাতে বানু ঘরে ঢোকে।

– বুঝসিলাম, আপনে উটসেন ঠিকই কিন্তুক বিছানা ছাড়েন নাই। লন আপনের চা।

অন্তরা অলস ভঙ্গিতে বিছানায় উঠে বসে হাত বাড়িয়ে কাপটা নেয়।

চায়ের কাপ দিয়ে বানুর চলে যাবার কথা, কিন্তু সে যায় না। গদগদ কণ্ঠে বলে,
– আপা দুইডা খবর আছে, একটা খুশীর আরেকটা দুঃখের। কোনডা আগে শুনবেন ?

ওদের এই কাজের মেয়েটা বাজে বকবক বেশি করে , এর জন্য হাজার বকা দিয়েও কোন লাভ হয়নি। সারাদিন সে পটপট করতেই থাকে।
অন্তরা বিরক্ত মুখে বলে,
– তোর যেইটা খুশী বল। তবে যা বলার খুব শর্টে বলে বিদায় হবি। আজাইরা ত্যানা প্যাচাবি না একদম!

– খুশীর খবর হইল আইজকা খালাম্মা আপনের পসন্দের নাশতা বানাইসে, গরুর মাংস আর চালের আটার রুটি।

– পছন্দের নাশতা কী কোন গুড নিউজের আওতায় পড়ে, গবেট!
অন্তরা চায়ে চুমুক দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে,
– গুড নিউজ শুনে আমি খুবই আনন্দিত! এইবার দুঃখের নিউজটা দিয়ে কেটে পড়।

অন্তরার অনীহায় বানুর অভিব্যক্তিতে তেমন কোন প্রভাব পড়ে না, সে উজ্জ্বল মুখে খারাপ খবরটা প্রচার করে।
– আর দুঃখের খবর হইতেসে, পাকনা কাঁডোল সকালেই আইসা বইসা আছে আপনের জন্য।

– পাকনা কাঁডোল !!? সেটা আবার কী?
অন্তরা বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চায়।

উত্তরে বানু ঠোঁট টিপে হেসে বলে ,
– স্বপন ভাই আসছে।

বানু স্বপ্নকে স্বপন বলে , মিনিং এক বলে এটা নিয়ে কারো তেমন কোন মাথা ব্যাথা নেই।

খবর শুনে এবার সত্যি সত্যি বিরক্তিতে অন্তরার মুখটা তেতো হয়ে যায়। সে চায়ের কাপ ফিরিয়ে দিতে দিতে বলে,
– বানু শোন….আমি আরেকটু ঘুমাবো , তুই দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে যা।

-নাশতা করবেন না ? খালাম্মা ডাকে তো!

অন্তরা জবাব না দিয়ে শুয়ে কাঁথাটা মুখের ওপর টেনে তুলে দেয়। তবে তার এই ভানে তেমন কোন লাভ হয় না। একটু বাদেই সাবিনা ঘরে ঢুকে উচ্চকণ্ঠে মেয়েকে ডাকাডাকি শুরু করে।

– কিরে অন্তু, উঠবি না ? নাশতা ঠান্ডা হয়ে গেলো তো !!

– প্লীজ আম্মা! এত সকালে আমি কিছুতেই উঠবো না । তোমরা খেয়ে নাও।

– আরে উঠ তো! আজকে তোর ফেভারিট নাশতা বানাইছি , গরম গরম না খেলে মজা পাবি না। তাছাড়া সেই কখন থেকে স্বপ্ন এসে বসে আছে তোর সাথে নাশতা করবে বলে। তোরা নাশতা করে নে, তারপর তোকে ও আজকে ওদের বাসায় নিয়ে যাবে।
সাবিনা আনন্দিত কণ্ঠে বলেন ।

– মানে কী!? আমি এখন ওই বাসায় কোন কাজে যাব !!

– কি আশ্চর্য,কাজে কেন যাবি! ঘুরতে যাবি। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর থেকে তো ঘরেই বসে বসে ঝিমাচ্ছিস। সারাটা দিন শুয়ে শুয়ে খালি ল্যাপটপ টেপাটেপি করিস! কি যে মধু আছে ওই জাদুর বাক্সে তা তুই’ই জানিস !! হাসিনা ফোন দিয়ে বললো তুই যেনো একটু ওদের বাসা থেকে ঘুরে আসিস , তাইতো তোকে নিয়ে যাবার জন্য স্বপ্ন এসে বসে আছে।

স্বপ্নের মা হাসিনা খানম সাবিনা জাহানের ছেলেবেলার বন্ধু। দুইজনের খুব খাতির, যাকে বলে একেবারে গলায় গলায় বন্ধুত্ব। তাই তারা দু’জন মিলে ঠিক করেছেন তাদের ছেলে মেয়েতে বিয়ে দিয়ে সম্পর্কটাকে আরো গভীর করবেন। অন্তরা যে স্বপ্নকে তেমন পছন্দ করে না এটা তারা বেশ বোঝে। তাই তারা প্রতিদিন নতুন নতুন ফন্দি আঁটেন ওকে বশ মানানোর জন্য। এটা সেই প্ল্যানেরই একটা অংশ, বেশ বুঝতে পারে অন্তরা। অন্তরার হঠাত্‍ অকারণেই ভীষণ অভিমান হয় মায়ের ওপর….স্পন্দনের ওপর। ওকে কেউ বোঝে না !!

অন্তরা অভিমানী কণ্ঠে বলে,
– আম্মা শোন , আমি ওই বাসায় যাব না…মারলেও না! আর তুমি যে এত ঢং করে বলতেসো আমার জন্য আমার প্রিয় খাবার করেছ সেটাও ঠিক না। তুমি এগুলো রাঁধসো স্বপ্নের জন্য। কারণ এইটা তারও ফেভারিট খাবার। তোমারে একবার না দুইবার না… বরং হাজার হাজার বার বলসি যে আমি ওই লাল বান্দরটাকে বিয়ে করবো না। তারপরও তুমি যেমনেই হোক ওর গলায় আমাকে ঝুলায় দিতে চাও। আমি কি এতই বেশী হয়ে গেছি তোমাদের কাছে!!! তোমরা আসলে খালি মুখেই বলো যে আমারে তোমরা অন্ধের মতো ভালোবাসো । রিয়েলিটি হইলো, আসলে তোমরা কেউ আমারে ভালোও বাসো না , বুঝতেও চাও না!

কথা শেষ করে অন্তরা ছেলেমানুষের মত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। সাবিনা মেয়ের কান্ড দেখে অবাক না হয়ে পারেন না । অন্তরা খুব শক্ত মেয়ে! ও এত তুচ্ছ বিষয়ে কাঁদার মতো মেয়ে না । অথচ আজ এই সামান্য কথায় মেয়েকে এভাবে হাপুস নয়নে কাঁদতে দেখে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন সাবিনা।

চলবে ….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here