অন্যরকম ভালোবাসা, পর্ব:৪

#অন্যরকম_ভালোবাসা

#আফসানানীতু

#পর্ব_৪

কিছুতেই পড়ায় মন বসছে না অন্তরার, অথচ ক’দিন বাদেই তার পরীক্ষা। ও অসহায়ভাবে বইয়ের পাতার দিকে শুধু চেয়ে থাকে। ওর মনে হয়, বইয়ের পাতার সমস্ত ম্যাডিকেল টার্মগুলো যেনো ওর অপারগতা দেখে চোখের সামনে একে বেকে নাচছে আর দাঁত কেলিয়ে হাসছে পরিহাসের হাসি! কিছুটা সময় এভাবে পড়ার টেবিলে বইয়ের সঙ্গে মনোযুদ্ধ চালিয়ে অন্তরা “ধ্যাত্তরিকা….খ্যাতা পুড়ি পড়াশোনার” বলে বই রেখে অপ্রসন্ন চিত্তে ল্যাপটপ নিয়ে বসে।

ওর ভাল্লাগেনা রোগ হবার পর থেকে ফেসবুক কিংবা ম্যাসেঞ্জার চেক দেয়া হয়নি একদিনও। অন্তরা তার মোবাইলে ম্যাসেঞ্জার কিংবা ফেসবুক কোনটাকেই স্থান দেয় না, কেননা এতে ওর পড়ায় মন বসে না। বিশেষ করে ম্যাসেঞ্জার ওপেন থাকার মানে তো সাড়ে সর্বনাশ! রাত নেই দিন নেই কেবল টিং টিং আর টিং টিং!

অন্তরা ম্যাসেঞ্জার চেক দিতে গিয়ে দেখে একটা ম্যাসেজ রিকোয়েস্ট এসেছে। নাম “অন্তরার স্পন্দন” !! অন্তরার হৃদকম্পন বেড়ে গেলো হঠাত্‍ । সে কাঁপা হাতে ম্যাসেজ ওপেন করে দেখে তাতে লেখা…

“তুমি বলেছো আমার সাহস নাই …কিন্তু তোমার এই কথাটা একদম ঠিক না মেয়ে। আমার সাহস আছে , বলতে পারো প্রয়োজনের চাইতে একটু বেশীই সাহস আমার । শুধুমাত্র ভূত দেখবো বলে একবার রংপুর রাজবাড়ীতে আমি একা এক রাত কাটিয়েছিলাম। কিন্তু সমস্যা হলো…তোমাকে দেখলেই আমার কি যে হয় !!! সব কেমন ওলটপালট লাগে! মুহূর্তেই আমার সব সাহস কর্পূরের মত উবে যায়!

যেদিন প্রথম তুমি আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছিলে, সেদিনই আমি ঠিক করে ফেলেছিলাম যে তুমিই আমার বৌ হবে। কেনো হবে , কীভাবে হবে ভেবে দেখি নাই… কিংবা বলতে পারো তোমাকে ভাবার পর আর ওসব নিয়ে ভাবার অবকাশ পাইনি।

এই ক’দিন আমি সব ফেলে শুধু তোমার আগে পিছে ঘুরেছি শুধু এই কথাগুলো বলবো বলে কিন্তু সাহসে কুলায় নাই এক্কেবারে। প্রতিদিন বন্ধুদের সামনে কত শতবার প্র্যাকটিস করেছি এই বলবো সেই বলবো বলে! এ ব্যাপারে আমার বন্ধুরা আমাকে সাহায্য যেমন করেছে তেমনি আমাকে নিয়া হাসাহাসিও কম করেনি।

ওরা বুদ্ধি দিয়েছিল তোমাকে যেনো ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাই, কিন্তু তুমি যদি সেটা এক্সেপ্ট না করো তখন আমার কি হবে এই ভেবে দেইনি । অনেক কষ্টে তোমার সেল নাম্বার জোগাড় করেছি কিন্তু তুমি কল ধরলেই আমি আর কথা বলতে পারি না এই ভয়ে ….যদি তুমি রেগে মেগে ফোন কেটে দাও!

তাই অনেক ভেবেচিন্তে এই আদিম পদ্ধতিটা বেছে নিলাম। ভাবলাম আমার সেল নাম্বার তোমাকে দেই , তুমি যদি কল দাও তবে তো পোয়া বারো আর না দিলেও আশা থেকে যায় কিন্তু!

বিলিভ মি! তুমি যে ওই ছোট্ট গোবেচারা সাইজের কাগজটা পেয়ে এত ক্ষেপে যাবা সেটা স্বপ্নেও ভাবি নাই আমি!! তবে রাগলে কিন্তু তোমাকে মোটেও ভালো দেখায় না। অমন আদুরে তুলতুলে চেহারাটা কেমন মিষ্টি আলুর মত লাল হয়ে যায়!

জাস্ট জোকিং…..রাগ করো না আবার!”

ম্যাসেজ এই পর্যন্তই…

করবে না করবে না করেও অন্তরা স্পন্দনের ম্যাসেজটা এক্সেপ্ট করে ফেললো। তারপর গুট গুট করে টাইপ করলো…

– ইটস ওকে! তবে আপনার সাহস আসলেই বেশী! কী ভেবে আপনি আমাকে মিষ্টি আলু বলেন! আমার চেহারা কি মিষ্টি আলুর মতো আঁকাবাঁকা?

ম্যাসেজ সেন্ড করে অন্তরা স্পন্দনের প্রোফাইল ওপেন করে। ছেলেটার সাহস আছে বটে! ওর নাম নিজের নামের সঙ্গে জুড়ে কেমন আই ডি খুলে বসে আছে!!! “অন্তরার স্পন্দন “?

তবে ওর প্রোফাইলে দেয়া ছবিটা দেখে ভীষণ অবাক হয় অন্তরা। অমন এলোমেলো ছেলেটা ছবিতে কি সুন্দর ব্লু জিন্স আর টকটকে লাল টিশার্ট পড়ে বেশ গুছিয়ে দাঁড়িয়ে! এই প্রথম সে খেয়াল করে ছেলেটা দেখতে শুধু ভালো না…. বেশ ভালো!অন্তরা স্পন্দনের ছবিটাকে জিভ দেখিয়ে ভেংচি কাটে একটা। এমন সময় স্পন্দনের ম্যাসেজ আসে। বোধহয় অনলাইনই ছিলো ।

– আহা! মিষ্টি আলু যেমন বলসি আবার সুন্দরও তো বলসি তাই না?

অন্তরা অপ্রসন্ন মুখে টাইপ করে…
– কখন সুন্দর বললেন!

– ওপসস!! বলি নাই ? যাও এখন বলছি …তুমি অনেক তুলতুলে আর আদুরে রকমের সুন্দর,একদম বিড়ালের মত….!

– কি ?!!!

– রাগ করলে নাকি ? সুন্দর বললাম তোহ !

অন্তরা স্পন্দনের কথার ঢঙে আপনমনে হাসে।
– সরি, সেদিন আসলে একটু বেশী বেশী করে ফেলেছি! এতটা রাগ করা উচিত হয় নাই ।

– যাক বুঝতে পেরেছো তাহলে? তবে এতো সহজে তো সরি গ্রহণযোগ্যতা পাবে না , ক্ষমা করতে পারি এক শর্তে…

– কী???

– আমি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালে এক্সেপ্ট করতে হবে।

– কীহ!!! মতলববাজ !!!

– আহ! গালিটা একেবারে গুলির মতো বুকের বা’পাশে এসে বিধলো!

অন্তরা হেসে টাইপ করে,
– আচ্ছা করবো।

অন্তরার ম্যাসেজ পাঠাতেই যা দেরী, সাথে সাথেই স্পন্দনের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট চলে আসে। অন্তরা রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করে নিয়ে লিখলো…

-আপনার সাহস আসলেই বেশি! আমার নামের সঙ্গে নিজের নাম খুলেআম জুড়ে দিয়ে আই ডি খুলে বসে আছেন !

-আগে আমার নামেই ছিল , যেদিন থেকে ভাবছি তোমাকেই বৌ বানাবো নগদেই নাম পরিবর্তন করেছি ।

– ওই শুরু !!

– আচ্ছা সরি! ব্লক মাইরো না আবার।

***

অন্তরাদের ফাইনাল পরীক্ষা খড়গের মতো এক্কেবারে মাথার উপর ঝুলছে । অনেক ব্যস্ততা ! কিন্তু শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রতি রাতে ওর আর স্পন্দনের এমন টুকটাক আলাপ হতেই থাকে…

-আছো ?

-আপনি রাতে ঘুমান না ?

– ঘুমাই না আবার ! আমিতো সারাদিনই ঘুমাই ।

– হোয়াট!

জবাবে স্পন্দন একটা মাসুম গোছের ইমোজি সেন্ড করে ।

– সারাদিন ঘুমান , আপনি কেমন পুরুষ !!

– সুপুরুষ কিংবা বলতে পারো স্বপ্নপুরুষ । আসলে আমি ছুটিতে আছি ।

– কেমন ?

– সেই বাচ্চাকাল থেকে দীর্ঘদিনের ছাত্রজীবন কাটিয়ে আমি ক্লান্ত! তাই বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর ভাবলাম কয়টা দিন একটু রেস্ট নেই ।

– আপনি বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়েছেন তাহলে!

– আলবত পড়েছি! আমি বুয়েটের ছাত্র ছিলাম।

– বাব্বাহ!

– কি….শুনে ভাল্লাগছে?

– উমমম , হুম !

– তাইলে লাভ ইউ বল।

– কিহ!!!

আরেকদিন ….

– কী করো অন্তু বিল্লু ?

– পড়ার চেষ্টা করি ।

– একটা কল করি ? খুব শুনতে ইচ্ছা করছে!

– কী?

– তোমার ভয়েস …তোমার নিঃশ্বাসের শব্দ ….

– ঢং কম।

– বৌ তো , বৌ না ?

– আশা এই জীবনে পূরণ হবে না জনাব। আব্বা আমাকে ডাক্তার ছাড়া বিয়ে দেবে না ।

– কেনো, ইঞ্জিনিয়াররা কি পুরুষ না?

– হুম !

– তাছাড়া বাবা মায়ের শর্ত স্বপ্নের কথা পরে শুনলেও চলবে।তারা তো আর বিয়ে করবেন না , বিয়ে করবা তুমি। তুমি বল… আমার মধ্যে এক তোমার পিছে ঘুরা ছাড়া আর কোনো খারাবি আছে ?

-নাহ্ , কত্ত ভালা পোলা আপনি !
অন্তরা খোচা মারতে ছাড়ে না ।

কিন্তু স্পন্দনও কম যায় না!
– তাই না? তাইলে লাভ ইউ বলো…

– ওই আবার!

***

দু’দিন বাদে পরীক্ষা তারপরও অন্তরা স্পন্দনের সঙ্গে ম্যাসেজ চালাচালির এডিকশন থেকে বের হতে পারছে না।

-আছেন ?

-আছি অলওয়েজ….শুধু তোমার জন্য! আমি তো তোমার অন্তরের রিদোমিক লাব ডাব …..স্পন্দন !

– ওরে বাবা !! ঢং কম করতে বলসি না?

– অন্তরা, আসো না একদিন দেখা করি?

-জ্বী না , এখন তো কোনো ভাবেই না…নো ওয়ে! দুইদিন পর আমার এক্সাম । এমনিতেই আপনার জন্য আমার অনেক পড়া নষ্ট হয়েছে! আমি তো ভাবছি কাল থেকে একাউন্ট ডিএ্যাক্টিভেট করে দেবো। ইসস্!পাশ করতে না পারলে কি হবে বলুনতো ? আমার এতদিনের কষ্ট সব মাটি !

– তাও ঠিক । আসলে ওভাবে ভেবে দেখি নাই তো। সরি! তোমার এক্সাম কতদিন চলবে? মানে, কতদিন অফ থাকতে চাও?

– এই ধরেন এক মাস!

– ওকে, নো সমস্যা!এতদিন যখন অপেক্ষা করতে পেরেছি তখন এক মাস ব্যাপার না!

– থ্যাঙ্ক ইউ! আমার প্রবলেমটা এতো সহজে বুঝতে পারার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ!

– তাইলে থ্যাঙ্ক ইউ কেনো ? লাভ ইউ বলো!

– আবার সেই একই ঘ্যান ঘ্যান !!!

– ওকে বিল্লু টা টা , ভালো থেকো।

পরদিন কিন্তু অন্তরা একাউন্ট ডিএ্যাক্টিভেট করলো না। যথারীতি পড়ার ফাঁকে অনলাইনে গেলো। কিন্তু স্পন্দনকে অফলাইন পেলো। সারারাতে একবারও সবুজ বাতি শো করলো না স্পন্দনের একাউন্ট , একবারের জন্যও না!

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here