অন্যরকম ভালোবাসা, পর্ব:৬

0
588

#অন্যরকম_ভালবাসা

#আফসানানীতু

#পর্ব_৬

অন্তরা ছাদে কফি হাতে দোলনায় বসে মৃদুমন্দ দোলায় দুলছে।পাশেই তার মোবাইলটা অবহেলায় পড়ে আছে চুপচাপ। সেদিন মায়ের বলার পর থেকে ও আর ল্যাপটপ ছুঁয়েও দেখেনি।ছেলেবেলা থেকেই অন্তরা ভারী জেদী আর অভিমানী। ওর আম্মার করা অভিযোগটা ওর কাছে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন মনে হয়, ও নাহয় অবসরে একটু ল্যাপটপ নিয়ে বসে তাই বলে ওর আম্মা এই বিষয়টা নিয়ে অযথাই ওর সঙ্গে খোঁচাখুঁচি করবে কেনো! অন্তরা আত্মকেন্দ্রিক স্বভাবের মেয়ে। ওর বয়সের আর সব মেয়েদের মত হইচই আড্ডা এসব এড়িয়ে চলে সে, তারপরও যদি কথা শুনতে হয় তবে একটু খারাপ লাগবে বৈকি।

এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতেই ওর মোবাইল বেজে উঠে। তাকিয়ে স্ক্রিনে অপরিচিত নাম্বার দেখে আর গা করে না অন্তরা। মোবাইল বাজতে বাজতে থেমে যায়। তবে মোবাইলের ঘ্যানঘ্যানানী থামেনা,একবার …দুইবার …তিনবারের বার একটু বিরক্ত হয়েই কলটা রিসিভ করে অন্তরা।
রুক্ষ সুরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে বহু আকাঙ্ক্ষিত কণ্ঠটি শোনা যায়।

– কিরে বিল্লু ফোন ধরো না কেন , কি সমস্যা ?

অন্তরা ফোনে স্পন্দনের গলা শুনতে পেয়ে এতটাই চমকে ওঠে যে আর একটু হলে মোবাইলটা ওর হাত থেকে পড়েই যেতো। নাম্বারটা যদিও অপরিচিত তবুও স্পন্দনের গলা আর ওর বলার ভঙ্গিটা অন্তরার অতিপরিচিত। আনন্দে ওর অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। বিশ্বাসই হতে চায় না যে স্পন্দন কল করেছে!
সে কাঁপা কন্ঠে জানতে চায়,

– কে ?

– কিরে , পরীক্ষা দিয়ে মাথা কি পুরাই গেছে নাকি?আরে আমি স্পন্দন!

– স্পন্দন !! আপনি এতদিন কই ছিলেন , ফোন বন্ধ কেন আপনার, ফেসবুকেও দেখলাম না! কোন বিপদে পড়েছিলেন? কোন সমস্যা?

-আল্লাহ্ ! থামো থামো, আগে দম নিয়ে নাও তারপরে কথা বলো। এত কেনোর উত্তর কীভাবে দেবো একসাথে !! আজব সুলতান !!! তুমিই না বল্লা যোগাযোগ করতে না? তাই ঘুরতে গিয়েছিলাম।

– ঘুরতে !?

– হুম ! তুমি বল্লা আমার জ্বালায় পড়তে পারো না। শুনে মায়া লাগলো…ভাবলাম তাইতো, শেষে ফেল করলে আমাকে দুষবা। তাই সেন্ট মার্টিন থেকে ঘুরে এলাম এক মাস।

– তাই বলে মোবাইল অফ থাকবে ?

– তাইতো থাকা উচিত! প্রকৃতির কাছে গেলে আমি সবসময় প্রযুক্তি বিসর্জন দেই। এক মাস যখন তোমার সাথে যোগাযোগই করতে পারবো না তবে ওইসব মোবাইল ফোবাইল সাথে রেখে লাভ ? তাই অফ ছিল। কেনরে ময়না, ডিড ইউ মিস মি!!?

– হু ! না মানে অবাক হয়েছিলাম …
ঝোঁকের মাথায় হু বলে লজ্জা পেয়ে যায় অন্তরা ।

-অবাক হও আর যাই হও মিস্ তো করসো বি ….ল্লু!

স্পন্দনের কৌতুকপূর্ণ কণ্ঠ শুনে লজ্জায় অন্তরার গলা বুজে আসে। সে কোনমতে বলে,

– হু !

– তাইলে লাভ ইউ বলো।

-কিহ!

ওপাশ থেকে ভরাট গলার প্রাণখোলা হাসির শব্দ পায় অন্তরা। ওর পুরো শরীরে একটা ভাল লাগার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে , ওর সমস্ত ইন্দ্রিয় জুড়ে যেন বেজে ওঠে তানপুরার তান। ইস, যদি জন্ম জন্মান্তর ধরে স্পন্দন এভাবে ওর কানের কাছে হেসে যেত! সে নিজেও আনমনে মুখ টিপে প্রশ্রয়ের হাসি হাসে।

অন্তরা গুন গুন করে গান গাইছে দেখে ভালো লাগে সাবিনার। ক’দিন ধরে মেয়েটা ভীষণ মন মরা হয়ে ছিলো। হয়তো বেচারী পরীক্ষার চাপে একদম কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল, যাক্ তবু ভালো যে অন্তরা ধীরে ধীরে সেটা কাটিয়ে উঠছে। মনে মনে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন যেনো সাবিনা। সেদিন যখন মেয়েটা অমন হুট করে কেঁদে দিলো, তিনি খানিকটা দমে গিয়েছিলেন। মেয়ের এমন অদ্ভুত আচরণের জন্য তার নিজেকে ভারী অপরাধী মনে হচ্ছিলো। সত্যিই তো ! অন্তরা বরাবরই স্বপ্নকে এড়িয়ে যায়, তারপরও মা হয়ে ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে এসব করা ঠিক হয়নি উনার একদম! অন্তরার বাবা মুশফিক খন্দকার জানতে পারলে ভীষণ রাগ হবেন। অন্তরাকে কোন বিষয়ে জোরাজুরি করাটা তিনি একদম পছন্দ করেন না।

সাবিনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবেন “বাবা মেয়ে দু’জনই একরকম …রাগী আর একরোখা”। স্বপ্নের সাথে অন্তরার বিয়ে হলে কত ভালো হত! ছেলে নিজে ডাক্তার, ওর বাবার নিজস্ব ক্লিনিক আছে। আবার সাবিনার বান্ধবী হাসিনা শ্বাশুড়ী হিসেবেও মন্দ হত না। অন্তরাকে নিয়ে বিয়ের পর আর ভাবতেই হত না তার, কিন্তু হলো আর কই ! মেয়েরই তো মত নেই বিয়েতে। তবে এতসব ভাবনার মাঝেও অন্তরার দিকে তাকিয়ে মনটা ভালো হয়ে যায় তার, বসে বসে কি সুন্দর গান গাইছে আর ছোট ছোট দোল দিচ্ছে দোলনায় ! সাবিনা এগিয়ে গিয়ে মেয়ের মাথায় সস্নেহে হাত রাখেন। অন্তরা গান থামিয়ে ওর মায়ের মুখের দিকে তাকায় তারপর মায়ের হাতটা টেনে নিয়ে তাতে ছোট্ট করে চুমু খায়।

***
-অন্তু বিল্লু , কী করো ?

-কিছু না , গান শুনি । আপনি ?

– ধুর , কি খালি আপনি আপনি কর ! নিজেরে কেমন বুড়া বুড়া লাগে।

– তাইলে তুই করে বলি ? একদম বাচ্চা বাচ্চা ফীল আসবেনে।

– কোনো দরকার নাই , এমনেই তোমার মাস্টার টাইপ বিহেভে নিজেরে বেচারা বেচারা লাগে! তাছাড়া স্বামীরে তুই করে বল্লে আল্লাহ্ নারাজ হয়।

– ইস্, শখ !!

এমন টুকটাক ফোনালাপ , চ্যাটিং ওদের নিত্য রুটিন এখন।

– বিল্লু ,নীল রঙ্গের শাপলা দেখছো কখনো?

– ধুর , নীল আবার শাপলা হয় !

– খুব হয়! সেইজন্যই তো জিজ্ঞেস করলাম দেখছো নাকি। যাবা আমার সাথে শাপলা দেখতে ?

– হুম , বুঝলাম!

– কি বুঝলা?

– নতুন ফন্দি আটা হচ্ছে।

– কথা দিসিলা, এখন বেদের মেয়ে জ্যোত্স্নার মত ফাঁকি দিতে চাইতেছ কিন্তু!

– কার মত ?

– হে হে…পরীক্ষার পর দেখা করবা বলছিলা কিনা বল?

– আচ্ছা ঠিক আছে, কবে?
অন্তরা হেসে আত্মসমর্পণ করে।

– আজকে বৃষ্টি আসতে পারে, আজকেই ভালো হবে। যাবা?

– আজকে ? আর কখন! দশটা তো অলরেডী বাজে !

-তো কি হইসে! বাইক নিয়ে টান দিলে ব্যাপার না। খালি চটজলদি রেডী হয়ে মতিঝিল শাপলা চত্তরে চলে আসো, বাদ বাকী আমার চিন্তা।

অন্তরা ঠোঁট টিপে একটু ভাবে, তারপর বলে
– ওকে , ঠিক এগারোটায় আসতেসি। আমি পৌঁছে তোমাকে কল দিবো নে।

***

অন্তরা খুব যত্ন করে চোখে কাজল পড়ে। এমনিতেই ওর চোখগুলো ভীষণ মায়া মায়া তার উপর কাজল পড়লে ওকে আরো বেশি মায়াবতী লাগে। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক আর দুহাত ভর্তি কাঁচের চুরি পরে অন্তরা আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বর দিকে সন্তুষ্ট চিত্তে তাকায়, নাহ্, চলে! অন্তরা নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হাসে।

মতিঝিলে পৌঁছে স্পন্দনকে কল করে অন্তরা। আজকে ওদের প্রথম একসাথে বের হওয়া , অন্তরা তাই বেশ পুলক অনুভব করে মনে মনে। দেখা হলে কি বলবে, কি করবে …এমন ভাবনার সুখ স্বপ্ন গুলো মনের ভিতর হাজারটা ডালপালা ছড়ায় নানান রঙে। কিন্তু বাস্তবে স্পন্দন যখন বাইক নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় ওর মন খারাপ হয়ে যায়। অন্তরা ওর জন্য কত যত্ন করে সেজে এসেছে অথচ ছেলেটা সেই আগের মত এলোমেলো বেশেই আছে।

স্পন্দন ওকে দেখে ঝলমলে কন্ঠে বলে,
– ওরেহ ! তুমি তো মাঞ্জা দিয়া একদম বিউটি কুইন বিল্লো রানী সেজে আসছো !! এবার তাড়াতাড়ি পিছনে উঠে বসো দেখি, দেরী হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।

অন্তরা আর কথা না বাড়িয়ে স্পন্দনের থেকে নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে বাইকের পেছনে উঠে বসে।

– আমাকে ভালোমত জাপটে ধরো, নইলে পড়ে যাবা কিন্তু।

বলেই লাফ দিয়ে বাইকে স্টার্ট দেয় স্পন্দন। হঠাৎ এমন কাণ্ডে অন্তরা তাল সামলাতে না পেরে স্পন্দনের গায়ের ওপর এসে পড়ে।

স্পন্দন হাসতে হাসতে বলে,
– মাম্মা, এইজন্যই তো বাইক আমার প্রিয় রাইড! এর ফুল গিয়ারই লাভ গিয়ার।

লজ্জায় অন্তরার তুলতুলে গাল দুটো ঈষৎ লাল হয়ে ওঠে। তবে স্পন্দন সেটা দেখতে পায় না, সে তখন তুমুল বেগে ছুটে চলেছে সোনারগাঁয়ের দিকে।

***

ওরা যখন সোনারগাঁও গিয়ে পৌঁছায় তখন বেলা বাজে দুইটা। স্পন্দন একটা ভাতের হোটেলের সামনে দাঁড়ায়। তাই দেখে অন্তরা জানতে চায়,

-আমরা এখানে থামলাম কেনো ?

– এইখানে ফ্রীতে ক্যেবারে ডান্স দেখায় তাই দেখতে থামলাম। কি আজব! ভাতের হোটেলে তো মানুষ ভাত খেতেই আসে তাই না ? দুপুর দুইটা বাজে, ভাত খাবা না ? আমার অনেক খুদা লেগেছে , তোমার লাগে নাই ?

– না , খুব একটা লাগেনি। তবে দুইটা যখন বাজে তখন খেয়ে নেয়াই ভাল।

ভাত খেতে বসে অন্তরা অবাক হয়ে দেখে স্পন্দন বাচ্চাদের মত এদিক সেদিক ফেলে হুড়োহুড়ি করে খাচ্ছে।

-আহ্, এভাবে খাইতেছো কেন? আস্তে আস্তে সুন্দর করে খাও!!

– সম্ভব না, অনেক খুদা লেগেছে।

স্পন্দন মুখভরা খাবার নিয়ে উত্তর দেয়। অন্তরা ওর কথা শুনে হেসে ফেলে।

-আর কত দূর স্পন্দন ?

– চলেই এসেছি , বড়জোর আর হাফ এন আওয়ার। আমার বন্ধু সাহিলের মামার ফার্ম হাউসেই তো।

ফার্ম হাউস শুনেই অন্তরার বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। অন্তরা স্পন্দন সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানে না, তাদের যা আলাপ পরিচয় সব ফোনের কথোপকথন আর চ্যাটিংএই সীমাবদ্ধ ছিল এতদিন। এই কদিনের এত অল্প পরিচয়ে হুট করে ছেলেটার সাথে কোন চিন্তা ভাবনা ছাড়াই এতদূর চলে আসা কি উচিত হলো …মনে মনে একটু কুঁকড়ে যায় অন্তরা।

এদিকে অন্তরার মুখের ভাব দেখে স্পন্দন ব্যপারটা ধরে ফেলে। সে খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে অন্তরাকে বলে,
– শোন বিল্লু, তুমি যা ভাবতেসো তেমন কিছুই না বুঝলে ? ওখানে গেলেই বুঝবা, ওটা আসলে কোন শুনশান আলিশান রেস্ট হাউস না। আর তাছাড়া স্পন্দন আর যাই করুক নিজের বৌকে কখনো রেপ করবে না, বুঝলে ?

স্পন্দনের বলার ভঙ্গিতে অন্তরা হেসে দেয়। বলে ,
– বৌ বলো কোন সাহসে ? আব্বা মরে গেলেও আমাকে ডাক্তার ছেলে ছাড়া বিয়ে দেবে না।

– কেনো দিবেনা শুনি? ডাক্তার না হই ,ইঞ্জিনিয়র পোলা তো! আমার রেস্টিং পিরিয়ড শেষ হলেই বাপের ব্যবসায় লেগে যাবো আদাজল খেয়ে। আমি তো আর ফকিরনীর পোলা না, বউ চালানোর মত টাকা পয়সা আলহামদুলিল্লাহ আছে। আবার হাত পা মাথাও ঠিক জায়গামতই আছে। তাইলে শুধু ডাক্তার না, মানুষের পেট কাটতে পারিনা …এই অপরাধে আমাকে রিজেক্ট করা কি তোমার বাপের ঠিক হবে বলো !!?

অন্তরা এবার স্পন্দনের কথায় চারপাশ ভুলে গিয়ে গা দুলিয়ে জোরে জোরে হাসতে থাকে, মাঝে মাঝে স্পন্দন এত মজা করে কথা বলে যে হাসতে হাসতে ওর পেটে খিল ধরে যায়। হাসতে হাসতেই অন্তরা খেয়াল করে স্পন্দন খাওয়া রেখে ওর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। অন্তরা লজ্জা পেয়ে যায়।

চলবে …..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here