অপ্রত্যাশিত ভালোবাসা পর্ব -১৮

গল্প : #অপ্রত্যাশিত_ভালোবাসা
লেখক : #কাব্য_মেহেরাব

পর্ব: #১৮

সেদিন সারাদিন প্রবীশ বাবু বেঘোরে ঘুমিয়েছিলো। সারারাত জেগে ড্রাইভ করে সেই চিটাগাং থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। সচরাচর তিনি ড্রাইভ করেন না। তবে শখের বিষয় মাঝেমাঝে ড্রাইভ করেন।

রাতে খাবার টেবিলে বাঙালি জাতীয় কিছু খাবার রাখা হয়েছিল যা আমি নিজে রান্না করেছিলাম। অবশ্যই প্রবীশ বাবু খাবার গুলো দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন যে এগুলো আমি রান্না করেছি। টেবিলের পাশেই রামু চাচা মুখ গোমরা করে দাঁড়িয়ে ছিলো।আজ আবার এই খাবার গুলো দেখেই প্রবীশ বাবু রেগে না যায় সেই চিন্তায়।উপর থেকে তা আমি সব দেখেছি। তার পর রুমে এসে আমি এশার নামাজ আদায় করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।

প্রবীশ বাবু নীচে খাবার টেবিলে আমার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছিল, অমিত বাবুর ক্ষুধার্ত থাকায় করুন ভাবে প্রবীশ বাবুর দিকে তাকালে , প্রবীশ বাবু তাকে বলে _

প্রবীশ: এইভাবে না তাকিয়ে থেকে খেয়ে এখান থেকে যেয়ে আমাকে উদ্ধার করো…..

অমিত বাবু: ………(মুখটা গোমড়া করে খাবার খেতে শুরু করল।

রামু চাচা: বলছিলাম কি প্রবীশ বাবা? তুমি বসে না থেকে খেয়ে নাও । মামনি সন্ধ্যায় খাবার খেয়েছেন ।

প্রবীশ বাবু মনে মনে ভাবলেন পুরো দুইটা দিন মেয়েটার সাথে খেতে পারল না। কোথায় একসাথে বসে খাবে তা না। সকালে ঠান্ডা মাথায় অপমান করে ছে, আর এখন এই মেয়েটা একা একা খেয়ে দিব্বো উপরে উঠে বসে আছে ।প্রবীশের মেজাজটা বিগড়ে গেল। নাকের পাতা ফুলিয়ে অমিতের দিকে তাকাতেই দেখে, অমিত তৃপ্তি সহকারে খাবার খাচ্ছে। একটু বিরক্ত নিয়ে প্রবীশ নিজের প্লেটে খাবার একটু একটু করে সব খাবার তুলে নিল ।তারপর নিজেও খাবারটা শেষ করল। হাত মুছতে মুছতে টেবিল থেকে উঠে গেল ।অমিতা তখনও খেয়ে যাচ্ছে।

প্রবীশ বাবু আমার রুমের সামনে এসে হালকা শব্দে দরজা খুললেন। দরজা খুলে দেখতে পারলো আমি নামাজ পড়ছি। তার পর কোন বাক্য ব্যয় না করে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন।অনেকক্ষণ বাইরে দাড়িয়ে ছিলেন আমার সাথে হয়তো একটু কথা বলবে সেজন্য। কিন্তু আমি যে ভেতরে নামাজ পড়ছি।

আজ কাল নামাজে দাঁড়ালে আর উঠতে মন চায় না। এখানে আসার পর থেকে কম অত্যাচার সহ্য করেনি। যেমন শারীরিক তেমন মানসিক। কিন্তু যেই মানুষটা এতো অত্যাচার করতো, তার অতিত জানার পর তার প্রতি আমার নিজের সাথে হওয়া অত্যাচারের সেই রাগটা মিয়ে গেছে ।

অনেকদিন পর আজ যেন মন ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি। পরম করুনাময় আল্লাহ তাআলার কাছে দুহাত তুলে এই মানুষটার জন্য দোয়া করতে মন চাচ্ছে। যতটা খারাপ আমি ভেবেছিলাম ততটা খারাপ এই মানুষটা নয়। আমি তো তাও অনেক মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি , কিন্তু এই মানুষটা প্রতিটা পদে পদে পেয়েছে ধোকা, মায়ের কাছে ,বোনের কাছে, বউয়ের কাছে ,বন্ধুর কাছে তার জীবনে আসা প্রতিটি রুপ ই তাকে ধোঁকা দিয়েছে।

কাব্যর কথা আজ খুব মনে পড়ছে। জানিনা কোথায় আছে , কিভাবে আছে। আমাকে কি ভুলে গেছে। আচ্ছা কাব্য যদি জানতে পারে আমার এখনকার পরিচয়, ও ফিরে এসে কি আমাকে মেনে নিবে? আমাকে ভুল বুঝবে না তো? যাইহোক কাব্য ফিরে এলে তাকে আমাকে আমার সব সত্য কথা বলতেই হবে! তবে আমি সব সময় চাই কাব্য যেখানেই থাকুক সুস্থ থাকুক।

দোয়া করলাম আমার স্বার্থপর ভাইটার জন্য ও। ভালো থাকুক আমার ভাবী। বাবাকে কেন বাদ দিব, সে ও ভালো থাকুক। সুখে থাকুক সবাই ।সবার মত করে সুখে থাকুক। আমি না হয় সবার সুখ দেখে নিজের সুখ খুঁজে নিব।

কতটা সময় পার হয়েছে আমি জানিনা। প্রবীশ বাবু অপেক্ষা করতে করতে একসময় চলে গেছেন হয়তো ঘুমানোর জন্য। একবার মনে হয়েছিল আমার যে প্রবীশ বাবু এসেছেন কিন্তু নামাজ ছেড়ে উঠতে মন চাইল না। নামাজ শেষ করে আমি উঠে লাইট অফ করে শুয়ে পড়লাম। মনটা অনেক ফুর ফুরা লাগছিল অনেকদিন পর হয়তো একটু শান্তির ঘুম ঘুমোতে পারব। ঘুমিয়ে গেলাম।

প্রবী্শ এতক্ষণ ধরে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল মেঘার জন্য।আর মনে মনে বলছে, বসে বসে এতক্ষণ কি পড়ে এই মেয়েটা, বোঝে না প্রবীশ। এতক্ষণ লাগে নামাজ পড়তে….? পিছনে ঘুরে দেখে মেঘার রুমের লাইট অফ। তারমানে প্রবীশ এসেছে সেটা টের পেয়েও এই মেয়েটা লাইট অফ করে ঘুমিয়ে পড়েছে, যাকে বলে অপমান করা। সকালে এত অপমান করে স্বাদ মিটেনি, এখন আবার ইগনোর করছে? প্রবীশের মেজাজটা আরও গরম হয়ে গেল। হন হন করে লম্বা লম্বা পা ফেলে মেঘার রুমে এসে লাইট অন করে দিল।

এই মাত্র ঘুমটা চোখে ভর করেছে। ওমনি লাইটের আলো পড়াতে মনে হলো কেউ আমাকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে।হঠাৎ করে চোখ মেলে তাকালাম। লাল লাল চোখ করে নাকের পাতা ফুলিয়ে রাগে ফুসফুস করছে প্রবীশ বাবু আমার সামনে। আমি উঠে দ্রুত বসে পড়লাম। এই হঠাৎ করে রেগে যাওয়ার কারণটা বুঝতে পারলাম না। আবার আমার গায়ে হাত তুলবে না তো। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল। পরক্ষনেই মনে পড়ল আজ সকালে তার সাথে আমি কি গেম টাই না খেলেছি। মনের ভিতরে ভয় থাকলেও কিছুটা সাহস দেখিয়ে বললাম_

মেঘা : কি সমস্যা আপনার?(বেশ জোরে কথাটা বললাম আমি)

প্রবীশ : এই প্রবীশের সাথে এইভাবে কথা বলার সাহস তুমি কোথা থেকে পেলে…?(খুব জোরে চিল্লিয়ে বলল) তুমি জানো তুমি কার সাথে কথা বলছ ?এইভাবে কথা বলার পরিণাম কি হতে পারে তার ধারণা আছে তোমার….?

মেঘা : (বুঝতে পারলাম এখন আমি ভয় পেলে, এই প্রবীশ বাবু আমাকে আরও ভয় দেখাবে ।তাই অনেক সাহস নিয়ে আবারো বলে ফেললাম) কেন চিনবো না আমি আপনাকে? ভুয়া কাড নিয়ে ঘুরে বেড়ান, আর ভাব দেখান কোটিপতির।

প্রবীশ বাবু: তুমি আবা………(প্রবীশ বাবুর চোখ যায় দরজার পাশে রাখা আমার কাপড় গোছানো সেই ব্যাগটির উপর। তিনি আরো বেশি রেগে যান। আমার দুই হাতের কব্জি শক্ত করে ধরে তার আরো কাছে নিয়ে এসে আমার চোখে চোখ রেখে বললেন) তারমানে তুমি সত্যিই চলে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছিলে……?

মেঘা : …….(প্রবীশ বাবুর নিশ্বাস আমার মুখের উপর পড়ছে। প্রবীশে থুতনি রাগে কাঁপছে। এতক্ষণ রেগে যাওয়ার চোখের চাহুনি আর এই চাহুনি একেবারেই আলাদা। বুঝতে পারলাম , সে আগের থেকে আরো অনেক বেশি রেগে গেছেন আমার ব্যাগটা দেখে।তার চোখের দিকে আমি তাকাতে পারছিলাম না। চোখ নিচে নামিয়ে আমি বললাম_) আমার ঘুম পাচ্ছে, প্লিজ আমাকে একটু ঘুমাতে দিন…

প্রবীশ বাবু : ………(তার দুই ভ্রু কুঁচ করে আমার দিকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য রাগী চাউনি দিয়ে তাকিয়ে থেকে তারপর আমাকে এক হাত দিয়ে ঝারা মেরে বেডের উপর ফেলে দিলেন। কয়েক সেকেন্ড আবারো তাকিয়ে সোজা রুম থেকে বেরোনোর জন্য পা বাড়ালেন)

মেঘা :……….(এভাবে ধাক্কা মারায় আমি অনেকটা নুয়ে পরি বিছানার উপর। মাথাটা একটু উঁচু করে প্রবীশ বাবুকে বলি_) দাঁড়ান………

প্রবীশ বাবু: ‌………(আমি ঘুমিয়ে পড়বো বলে তাকে যেতে বলেছি। আবার হঠাৎ তাকে কেন দাড়াতে বলছি এটা ভেবে তিনি থমকে গেলেন)

মেঘা : আই এম এক্সট্রিমলি সরি…..!

প্রবীশ বাবু : (সামনের দিকে ফিরে পিছনের দিকে হালকা তাকিয়ে ভুরু ভাঁজ করে চোখের ভাষায় জানতে চাইল কিসের জন্য সরি)

মেঘা : ……….(একটু চুপ করে থেকে আমি আবার বললাম) যাওয়ার সময় দরজাটা লক করে যাবেন।

প্রবীশ বাবু: ……..(আমার এমন কথায় প্রবীশ বাবু রেগে আমার দিকে পুরো ঘুরে তাকালেন। দরজার কাছ থেকে আমার ব্যাগটা নিয়ে তুলে আছার মেরে ফেলে দিলেন, ছিটকে ব্যাগ টা ৭-৮ হাত দূরে পড়লো ।)

মেঘা :……. (আমি ভয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম)

প্রবীশ বাবু : সুখে থাকলে ভূতে কিলায় তাই না? নেক্সট টাইম এমন কিছু করলে এই ব্যাগটার জায়গায় তুমি থাকবে। কথাটা যেন মনে থাকে….

কথাটা বলেই তিনি ঘট ঘট করে লম্বা পা ফেলে রুম থেকে বাইরে চলে গেলেন। আমি টেবিলের উপর রাখা জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে তা এক নিঃশ্বাসে শেষ করলাম।

এই মানুষটার জন্য আমি আল্লার কাছে দুহাত তুলে কত ভালো ভালো দোয়া চাইলাম। আর এই মানুষটা আমার জান পাখিটা ফুরুৎ করে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে গেলেন! ডেভিল একটা।

দরজা লক করে এসে আবার শুয়ে পড়লাম। কোথায় ভেবেছিলাম একটু শান্তিতে ঘুমাবো ।কিন্তু এই মানুষটা থাকতে শান্তির ঘুম আমি কোন দিন ই মনে হয় ঘুমোতে পারব না ।

প্রবীশ বাবু রুমে গিয়ে কি করছে কে জানে? আমি তো কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। আর লাইট অফ করব না। নাহলে আবার কখন এসে আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দেবে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ আদায় করে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা রেডি করে টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখছিলাম ।বেশ কিছু দিন ধরে রান্না করতে, এও কি এখন বেশ ভালই লাগে আমার। আর অমিত বাবু যেভাবে খাবারগুলো খেয়ে নিজের আঙুল চেটেপুটে খায়, মনে হয় সে আঙ্গুর নয় আঙূকে খাবার মনে করে খেয়ে ফেলছে। ভাবতেই হাসি লাগে আমার। আর প্রবীশ বাবুর কথা কি বলব , খাবারের প্রশংসা করতে গেলেও যেন তার প্রচুর কাঠ খড় পোড়াতে হয় ।ডেভিল একটা….! হঠাৎ করেই ড্রোরেবেল বেজে উঠলো। রামু চাচা হাত মুছতে মুছতে গিয়ে দরজা খুলে দিল।

দরজা খুলতেই একজন মহিলা এবং একজন পুরুষ ভিতরে প্রবেশ করলো। মহিলাকে দেখে আমার কলিজা যেন শুকিয়ে আসলো। অমিত বাবু খাবারের জন্য হাত মুছতে মুছতে টেবিলের দিকে আসতেই দরজার কাছে দুজন মানুষকে দেখিয়ে তিনি ও থমকে ………

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here