অবেলায় ভালোবাসি পর্ব ১৯+২০

#অবেলায়_ভালোবাসি
#লেখনিতে_সাবরিন_জাহান
#পর্ব_১৯

সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে আয়ান,পাশেই বেলাল সাহেবের কাঁধে মাথা রেখে নাহার কান্না করছে। ইহরা বার বার তাও আয়ুশীর ফোন ট্রাই করে যাচ্ছে।যদি লেগে যায় এই ভেবে! ফাহিন পুলিশের থেকে আপডেট নিচ্ছে…হুট করেই দরজার বেল বাজলো। ইহরা দৌড়ে গিয়ে গেট খুললো!খুশিতে উত্তেজিত হয়ে মৃদু চিৎকারে বলে উঠলো,”আয়ু!”

সবাই চমকে উঠলো।নাহার এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে দৌড়ে গেলেন!বেলাল , আয়ান আর ফাহিনও এলো!নাহার আয়ুশীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন!

“ছোট আম্মু,কাঁদছো কেন?”

“তুই জানিস আমি কতটা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম!কোথায় ছিলি?”

“এটা কি আয়ু?এত লেট?সেই সাড়ে ছয়টায় আসার কথা ছিল,এসেছো রাত এগারোটায়!কোথায় ছিলে?”(ফাহিন)

আয়ুশী উত্তর না দিয়ে নাহারকে ধরে নিয়ে সোফায় বসলো!উনার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল।আয়ুশীর চুপ থাকা সহ্য হলো না আয়ানের!টেনে তুললো ওকে,বেশ চিৎকার করেই বললো,”কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”

আয়ুশী চুপ করে আছে!

“কি হলো বলছো না কেনো?”

“আহ, আয়ান আস্তে!”

“হোয়াট আস্তে, ইহরা?ওর কি কমন সেন্স বলতে কিছু নাই?একে তো আমাদের সবাইকে এমন টেনশনে ফেলেছে,আবার এখন কোনো উত্তর দিচ্ছে না!”

“আমি…”

“কি আমি?বলো ?”

“ওই একটু….একটু…”

“কি একটু?বলছো না কেনো?”

“আব…ওই আরকি বই লাগতো কিছু!তাই ধানমন্ডি গিয়েছিলাম!মানে টিউশনি থেকে বের হয়ে গিয়েছি! জ্যাম থাকায় আসতে দেরী হলো!”

“আর ইউ ক্রেজি?গেছো ঠিক আছে তাই বলে ফোন করে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলে না?”

আয়ুশী নিশ্চুপ!

“নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে চাও,বুঝলাম!তাই বলে বাড়িতে যে এত গুলো মানুষ হয়রান হলো তাদের প্রতি কি বিন্দু মাত্র মায়া নেই!”

“স্যার,কি বলছেন?”

“ভুল কি বললাম?তোমার কি আমাদের সব কিছুতে দয়া নজরেই আসে?এই যে মা যে কেঁদে কে’টে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে! ইহরা ক্রমাগত অস্থির হয়ে তোমার নাম্বারে ট্রাই করেছে,যদি ফোন লেগে যায়…আমি আর ফাহিন পাগলের মত তোমায় এত জায়গায় খুঁজলাম!এগুলো কি এখনও তোমার দয়া লাগে মিস আয়ুশী?আরে আর কারো কথা না ভাবো মায়ের কথা তো ভাবতে?বাবার কথা ভাবতে!”

“আয়ান,থামো প্লিজ!”(নাহার)

“কেনো থামবো মা?ফোন করে জানালে কি ওকে মানা করতাম?বরং ইহরাকে নিয়ে যেতে বলতাম!এত রাতে কোনো অঘটন ঘটলে কি হতো ভাবতে পারছো?”

আয়ুশী কিছু না বলে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে আয়ানের দিকে এগিয়ে দিল!গ্লাস ফেটে অবস্থা খারাপ।যেনো কেও এটাকে কিছুর উপর ফেলে দিয়েছে!

“ফোন করতে চেয়েছিলাম!কিন্তু বাসে উঠার পর ধাক্কা খেয়ে ফোন বাসের বাইরে পড়ে যায়!আর এই অবস্থা হয়!অনেক চেষ্টা করেছি!ওপেন হয়নি!”

“অন্য কারোর ফোন থেকে ফোন করতে!”(ইহরা)

“আমি তো আম্মু আব্বু ছাড়া আর কারোর নাম্বার মুখস্ত করিনি!”

“ওয়াও!কি লজিক!”,তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো আয়ান!

“আয়ান অনেক হয়েছে!অনেক দখল গেছে…যে যার রুমে যাও!আয়ুশী মা,পরের বার এমন করো না! বুঝইতো,চিন্তা হয়!”(বেলাল)

“সরি ছোট আব্বু!”

“রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেও!”

আয়ুশী কিছু না বলে উপরে গেলো।সোফায় বসে পড়লো আয়ান। ফাহিন যেতে চাইলে নাহার বললেন আজ এখানেই থাকতে!ওকে গেস্ট রুমে নিয়ে গেলো ইহরা!বেলাল আর নাহার নিজের রুমে চলে গেল।বেশ ভয় ঢুকে গিয়েছিল সবার মাঝে।

রুমে গিয়ে ব্যাগ রেখে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো আয়ুশী।বাইরে মৃদু বাতাস বইছে!বেসিনের আয়নায় নিজের দিকে তাকাতেই আতকে উঠলো। শালের মত পেঁচিয়ে রাখা ওড়না সরিয়ে দিতেই বেরিয়ে এলো গলার মাঝে নখের আঁচড়!শুধু গলায় না, হাতেও আছে।যা থেকে রক্ত বের হয়ে শুকিয়ে গেছে!হাঁটুর উপর থেকে জামাটা হালকা সরিয়ে দেখলো হোয়াইট লেগিংসে রক্ত লেগে আছে!বালতির সামনে বসে পড়লো ও।মগ থেকে পানি নিয়ে ইচ্ছা মত ঢালতে লাগলো ও!হাত দিয়ে ওই সব ক্ষততে জোড়ে জোড়ে ডলতে লাগলো। ক্ষত গুলো জ্বলছে।কিন্তু ও থামলো না।আরো জোড়ে ডলতে লাগলো।ক্ষত গুলো যেনো আবার জীবন্ত হলো!রক্ত বের হতে লাগলো।আয়ুশী পানি ঢালছে আর ডলছে!হুট করেই মেয়েলি হাত ওকে বাঁধা দিল এসব করতে। ছল ছল চোখে হাতের মালিকের দিকে তাকাতেই দেখলো ইহরা!ওয়াশরুমের দরজা আটকাতে ভুলেই গিয়েছিল!

“আমি জানতাম,নিচে যা যা বললে সব মিথ্যে!কি হয়েছে আয়ু?”

আয়ুশী মাথা নিচু করে নিলো। ইহরা ওকে শুকনো কাপড় দিয়ে পড়তে বললো।আয়ুশী চুপচাপ চেঞ্জ করে বেরিয়ে এলো। ইহরা ওকে নিয়ে বিছানায় বসালো!

“সব সময় তো বলো,আমাকে বোন ভাবো!সত্যিটা কি বলা যায় না? ইহরাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো আয়ুশী!

“আয়ু!আমি বুঝতে পারছি সিরিয়াস কিছু হয়েছে!প্লিজ চুপ করে থেকো না!”

__________________________________

স্টুডেন্টের পরীক্ষা বিধায় লেট করে বের হলো আয়ুশী!হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিল সাড়ে ছয়টা!এমনেই দেরি হয়ে গেছে,হেঁটে গেলে আরো দেরি হবে!রিকশা নিবে ভাবলো!কিন্তু এই এলাকায় সাধারণত খুব একটা রিকশা আসে না! দশ মিনিট হাঁটলেই মেইন রোড আসে!আর তার মোড়েই রিকশা পাওয়া যায়!তাই ভাবলো রাস্তার মোড়ে গিয়ে রিকশা নিবে।যেই ভাবা সেই কাজ!যেতে যেতেই ফোন বের করলো ও! ইহরাকে জানাতে যে ওর আরেকটু লেট হবে আসতে!ফোনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই কারো সাথে ধাক্কা খেলো ও!লোকটি ঘুরে তাকাতেই আত্মা শুকিয়ে গেলো ওর! ও ভুলতেই বসেছিল এই রাস্তায় বখাটের উৎপাত বেশি! সন্ধ্যার পরই এরা এখানে বসে মেয়েদের টিজ করে!এটা যদিও ওর সাথে হয়নি!কারণ ও সন্ধ্যার আগেই বেরিয়ে আসতো!স্টুডেন্টের মা ই ওকে আগে আগে যেতে বলতো!কারণ এই বখাটে!তাই ওকে সাবধান করে দিয়েছিল।আজকেও বলেছিল অন্য রাস্তা দিয়ে যেতে,যেহেতু দেরি হবে বের হতে!কিন্তু পড়াতে পড়াতে সেই কথা বেমালুম ভুলে গেছে!নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মা’রা হয়তো একেই বলে!সামনে সিগারেট হাতে কিছু বখাটে দাড়িয়ে!ওকে দেখে আকাশের চাঁদ পাওয়ার মত করে তাকালো ওরা!

“মামা!আজ পার্টি হইবো!পাখি আসছে এক!”

ওদের মধ্যে একজনের এমন কথা শুনতেই কাঁপতে লাগলো আয়ুশী।উল্টো ঘুরে দৌড়াতে যাবে তার আগেই একজন হাত ধরে ফেলে ওর!আয়ুশী হাত ছাড়াতে ধস্তাধস্তি করতে থাকে!এক পর্যায়ে ওর হাতের ফোন ছিটকে এক পাথরের উপর আছার খায়!আর সবাই মজা নিচ্ছে!আয়ুশী নিজের মনকে শক্ত করলো!নিজেকে ছাড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো।কিন্তু পারলো না!লোকটার হাতের নখ বড় থাকায় ধস্তাধস্তির মাঝে নখের আঁচড় পড়ে গেলো।আরেকজন ওর গলায় হাত দিতে গেলেই ছিটকে সরে গেলো।ফলস্বরূপ গলাতেও আঁচড় লেগে গেলো!কুল কিনারা না পেয়ে আয়ুশী পা দিয়ে জোড়ে লোকটার মেইন জায়গায় আঘাত করলো!লোকটির হাতের বাঁধন হালকা হতেই কোনমতে ফোনটা তুলে সাইড ব্যাগ শক্ত করে ধরে দৌড় দিল।লোক গুলোও পিছু পিছু আসতে লাগলো।আয়ুশী আশে পাশে কোনো লুকানোর জায়গা না পেয়ে একটা ট্রাক দেখতে পেলো!কিছু না ভেবেই ট্রাকের পিছনে জলদি উঠে গেলো।ট্রাকের পিছনে ধারালো কিছু ছিল।ফলস্বরূপ ওর হাঁটুতে তা লেগে হাঁটু কেঁ’টে গেলো…..ছেলে গুলো ওকে আশে পাশে খুঁজছে!আয়ুশী মুখ চেপে বসে আছে!হুট করেই ট্রাক ছেড়ে দিল।আয়ুশী চিল্লাবে ভেবেও চিল্লালো না!আপাতত এখান থেকে বের হতে হবে!ওদের হাতের বাইরে যেতেই আয়ুশী ট্রাক থামাতে বললো,কিন্তু গাড়ির ড্রাইভার তা শুনতে পেলো না।উপায় না পেয়ে আয়ুশী বসে ফোন অন করতে চেষ্টা করলো।কিন্তু লাভ হলো না!বেশ অনেকক্ষণ পর ট্রাক থামলে আয়ুশী নামে!জন বহুল এলাকা!এই জায়গা ও চিনে! এখান থেকে বাড়ি ফিরতে ঘণ্টা খানেক লাগবে!ভাবলো কাউকে বলে ফোন দিবে বাড়িতে!পরেই মনে হলো ওই বাড়ির কারোর নাম্বার মুখস্ত নেই ওর!জলদি বাড়ি যেতে রওনা হলো। ওড়না ভালো মত পেঁচিয়ে নিলো।যদিও ওরা তেমন ভাবে কিছুই করেনি!কিন্তু তাও ওর গা ঘিন ঘিন করছে!তাই এসেই পানি ছেড়ে স্পর্শ মুছতে চাইলো!বাড়ি ফিরে সবাইকে এমন চিন্তিত দেখে আর বললো না কিছু!উল্টো আরো ঘাবড়ে যাবে!তাই বানিয়ে মিথ্যে বললো!

__________________________________

সব শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো ইহরা!আয়ুশী ইহরাকে এখনও জড়িয়ে আছে। ইহরা ওকে ছাড়িয়ে মলম আনতে গেলো।বাইরে বের হতেই দেখলো আয়ান হাত মুঠো করে দাড়িয়ে আছে!বুঝতে বাকি রইলো না, ও সব শুনেছে। ইহরা কিছু বলবে তার আগেই আয়ান শান্ত কণ্ঠে বললো,”ওষুধ লাগিয়ে কিছু খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিও!আর আজকে ওর সাথেই ঘুমিয়ে পড়!ভয় একটু কমবে!”

বলেই নিজের রুমে গেলো! ইহরা কিছু না বলে ওর কথামতো সব করলো!

পরেরদিন!
দুপুর বেলা সেই রাস্তাতেই বসে সিগারেট খাচ্ছিলো ওই বখাটে!দিনের বেলা ওরা তেমন কিছু না করে না।তখনই সেখানে একটা বাইক থামলেই ওরা তাকায়!কালো জিন্স আর টিশার্ট পরিহিত মানুষটি হেলমেট খুলে ওদের দিকে এগিয়ে এলো।মোবাইল থেকে একটা ছবি বের করে এগিয়ে দিয়ে বললো,”এই মেয়েকে চিনো?”

ছেলেগুলো ছবির তাকাতেই চোখ বড় বড় করে ফেললো।ওদের মধ্যেই এক ছেলে মুখ ফস্কে বলে ফেললো,”এতো কালকের পাখিটা,বাইচা গেছিলো গা!”

ছেলেটা মুচকি হাসলো!না ঠিক জায়গাতেই এসেছে।

বেশ ভয়ে ভয়ে টিউশনিতে এসেছে আয়ুশী,সাথে সীমা আর ইভাও আছে।হুট করেই ওরা ওদের সামনে আসলো।আয়ুশী শক্ত করে সীমার হাত ধরলো।

“আমাদের মাফ কইরেন আফা!”

চমকে উঠলো ওরা!ওদের হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ!কেউ যে উত্তম মধ্যম দিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।ওরা চলে যেতে নিলেই সীমা ডাক লাগায়!

“আরে ওদের ডাকছিস কেনো?”(ইভা)

“চুপ কর! হঠাৎ সরি কেন বললি রে তোরা?”

“উচিত শিক্ষা হইছে আমাগো!আর জীবনেও মাইয়া তো দূরে থাক মুরব্বিদের কাছেও ঘেসমু না!”

সীমা মুখ টিপে হাসলো!

“তো কে দিলো এই শিক্ষা?”

“এক ভাই এ!”

“কে সে?”

“মোরা তো চিনি না,হেয় আইসা এই আফার (আয়ুশীর) ছবি দেখাইলো…আর আমরা মুখ ফসকে কয়ে দিছি কালকের কথা!এরপর বাঁশ দিয়ে যেই মা’ইর দিলো,জন্মেও ভুলুম না!”

সীমা চট করে ফোন বের করে একটা ছবি দেখালো!

“ইনি কি সে?”

“এই বেটা কেডা!?”

আয়ুশী উকি মে’রে দেখলো ফাহিনের ছবি!লোকগুলো আর কিছু না বলেই চলে গেলো!

“তাহলে ছেলেটা কে ?”

“ইহরাপু কে সবটা বলেছিলাম!উনি হয়তো কাউকে পাঠিয়েছে!”

“ওহ!”

__________________________________

“তুমি কি লোক পাঠিয়ে ওই বখাটেদের মে’রেছো আপু?”

আয়ুশীর কথায় ইহরা খানিক বোঝার চেষ্টা করলো।

“কিসের লোক?আমি কেনো মা’রতে যাবো?”

আয়ুশী চিন্তিত হলো!

“কি হয়েছে?”

আয়ুশী সবটা বললো। ইহরা হেসে বললো,”আমি না পাঠালেও আমি জানি সে কে!”

আয়ুশী জিজ্ঞাশাসূচক দৃষ্টিতে তাকালো!

“তোমার মিস্টার খারুষ!”

চোখ বড় বড় করে তাকালো!

“উনি কিভাবে…”

“কালকে শুনে ফেলেছিল!আজকেই ব্যাবস্থা করে দিয়ে আসলো!বেশ হয়েছে!”

আয়ুশী আর কিছু বলল না।মনে মনে আবারও ভাবলো,”দায়িত্ব!”

__________________________________

পুরো ঘর লন্ড ভন্ড করে মানি রিসিট খুঁজছে আয়ুশী।মাসের শেষ তারিখ,আজকেই বেতন পেয়েছে আয়ুশী।খুশি মনে ভেবেছিলো দুল আর আংটি ফিরিয়ে আনবে!কিন্তু ঘরের কোথাও মানি রিসিটটা পেলো না!ওইটা ছাড়া যে ও ওগুলো ছাড়াতে পারবে না!তখনই বাসার কাজের মেয়ে আসলো।

“আপু,আপনার পার্সেল আইছে!”

“কিসের?”

“এইযে!”

বলেই বক্স আয়ুশীর হাতে দিয়ে বেরিয়ে গেলো। উদাস মনে পার্সেল খুলতেই চমকে উঠলো।ওর মায়ের দুল আর আংটি!সেই সাথে সাদা পাথরে ডিজাইন করা চিকন চেইনের ব্রেসলেট!ভিতরেই সেই মানি রিসিট যাতে লিখা পেমেন্ট কমপ্লিট!একটা চিরকুট দেখতে পেয়ে খুললো সেটা!গোটা অক্ষরে লিখা,

“আত্মসম্মান ভালো!তাই বলে প্রিয় জিনিসগুলো হারিয়ে ফেলো না বা দূরে সরিয়ে দিও না!জানি তোমার আত্মসম্মান তোমার কাছে বড়,সেই সাথে তোমার মা বাবাও!কিন্তু নিজের ইমোশন গুলোকে এতটাও কঠোর করে ফেলো না।আমি কে খুঁজতে যেও না!জিনিসগুলো ফিরিয়ে দিলাম!কখনো হারাবে না!আর সাথে তোমার জন্য একটা ছোট্ট উপহার!সবসময় সাথে রেখো!”

#চলবে#অবেলায়_ভালোবাসি
#লেখনিতে_সাবরিন_জাহান
#পর্ব_২০

“এটা কে দিয়েছে ?”

“আয়ুশীর প্রশ্নে ঘাবড়ে গেলো কাজের লোকটি।

“কি হলো? বলছো না কেনো ?”

“আপা, এক ভাই আইসা দিছে।”

” কে সে?”

“আমি তো চিনি না হেরে। দিয়াই চলে গেছে।আপনার নাম কইয়া !”

“আচ্ছা, তুমি যাও।”

কাজের লোকটি যেতেই ভাবনায় পড়ে গেলো ও।
__________________________________
“এটা আমাকে কোথায় নিয়ে এলি তোরা ?”

ইভার প্রশ্নে চওড়া হাসলো ওরা। প্ল্যান মোতাবেক ইভাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে আসলো আয়ুশী আর সীমা।

“ইউ ইঞ্জয় বেবি! আমরা গেলাম, চল আয়ু! (সীমা)

বলেই আয়ুশীকে টেনে নিয়ে গেলো সীমা।

“আরে তোরা…”

আর কিছু বলার আগেই জুনাইদের গলা শুনতে পেলো ও!

“হ্যালো মিস!”

পরিচিত কন্ঠ শুনে চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো ওর!

“ফাজিলের দল।”

” না মিষ্টি আছে। ”

ইভা আড়চোখে জুনাইদের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটলো।

“আমার সাথে একটু কথা তো বলো।”

“কেন আপনার লাভলী কোথায়?”

“আমার লাভলী আবার কই পাও, আমার তো ইভা।”

বত্রিশ দাঁত বের করে হাসলো জুনাইদ,

“এসব ফ্লার্ট অন্য কারো সাথে করেন। গেলাম আমি!”

“ইভা প্লিজ!”

“বাই !”

ইভা বের হতে নিলেই জুনাইদ বলে উঠলো,

“লাভলী আমার বড় আন্টির মেয়ে, যে বিবাহিত। একটা বাচ্চাও আছে। মাঝে মাঝে মজা করে আমাকে বাবু বলে খেপায়। আর সামনে বিয়ে । এক সপ্তাহের ছুটি নিতে হবে৷ তাই কাজ একটু বেশি। তাই সময় বের করতে পারিনি। কিন্তু রাতে দশ মিনিট বের করে খোজ তো নিতাম।”

ইভা থেমে গেলো। আমি বেশ কিছু সময় চুপ থেকে বললো,

“আগে বললেই হতো।”

“বলার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কে যেনো শুনেনি!”

ইভা জুনাইদের দিকে ঘুরে কোমড়ে হাত রেখে বললো,

“মোবাইলে এত সেজে পাঠান, সেই সব মেসেজে ইভা একটু কথা বলো না বলে এই সেম কথা সেই মেসেজেও তো বলা যেতো। তাই না? আমি রিপ্লাই না করলে কি হবে?দেখতাম তো এটা জানেন!তাহলে?”

জুনাইদ মাথা চুলকে বললো,

“আসলেই তো ভেবে দেখিনি!”

“ভাববেন কেনো ? ব্যাডা মানুষ তো।”

জুনাইদ ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকালো। তাই দেখে ইভা মুচকি হাসলো।
_________________________________
” তুমি এখানে?”

স্টুডেন্টের মায়ের কথা শুনে অবাক হলো আয়ুশী।

“কেনো ? আজকে পড়বে না ওরা?”

“না, কিন্তু আমি তো জানি তুমি আর পাড়াবে না ওদের!”

আয়ুশী এবার আরও অবাক হলো।

“কে বললো আপনায় ?”

“আয়ান নামে একজন। এটাও বললো তুমি আর আসবে না। এই জন্য নতুন টিচারও খুঁজে দিয়েছে।”

সাইড ব্যাগের বেল্ট শক্ত করে ধরলো আয়ুশী৷ রাগ হচ্ছে ওর। কিছু না বলেই দৌড়ে বের হয়ে গেলো।

__________________________________

“কেনো বার বার আপনি আমার সাথে এমন করেন, মিষ্টার আয়ান মাহতাব?”

হুট করে আয়ুশীকে নিজের রুমে এসে এভাবে রেগে কথা বলতে দেখে চমকে গেলো আয়ান।

” মানে ?”

“বুঝতে পারছেন না, নাকি বুঝতে চাইছেন না? আমার টিউশনিটা কেনো বন্ধ করলেন ?”

“কারণ চাই না আবার সেদিনের মতো ওই রকম পরিস্থিতিতে পড়!”

” ওহ! তো এইজন্য আমার টিউশনি অফ করে দিবেন?!”

“যা করেছি তোমার ভালোর জন্যই করেছি।”

“আমার এত ভালো করতে কে বলেছে আপনায় ?”

” আজব, তুমি এমন রিয়েক্ট করছো কেনো?”

“করবো না কেনো ? আপনি আমাকে একা থাকতে না দিয়ে এখানে নিয়ে এলেন। তার উপর আমার পড়াশোনার খরচবাবদ সব খরচ চালাচ্ছেন, এখন যখন টিউশনি করে নিজের টুকটাক খরচ চালাতে চাই সেটাতেও বাঁধা দিচ্ছেন।কেনো ?”

“তোমার যা লাগবে বলবে,এতে কি হবে এমন?”

“আপনি কেনো বুঝতে পারছেন না ,নিতে পারছি না আমি আপনাদের এত উপকার!প্রতি নিয়ত মনে হচ্ছে বোঝা হয়ে আছি এখানে!আপনারা যতই ভালোবাসা বলুন,আমার তো খারাপ লাগে!অন্তত এই টুকু করে নিজের জন্য কিছু করলে ভালো লাগবে!”

“যাই বলো না কেনো,তুমি আর বাড়তি কোনো কাজ করবে না!”

“কেনো!”

“হোয়াট কেনো?সেদিনের মত অমন ঘটনা আবার ঘটলে কি জবাব দিবো আমি সবাইকে?তোমার কিছু হলে আমার কি হবে বুঝতে পারছো?”

“আপনার কি হবে?”

থমকে গেলো আয়ান।রেগে যে কি বলতে যাচ্ছিল ভাবতেই ভয়ে গা শিউরে উঠলো ওর!
“কি হলো বলুন?কি হবে আপনার?”

“তোমায় আনার কথা যেহেতু বাবাকে আমি ই বলেছি,সেহেতু তুমি আমার দায়িত্ব!তোমার কিছু হলে তার দায় আমার!”

“গো টু হেল উইথ ইউর দায়িত্ব মিস্টার আয়ান!”

বলেই বেড সাইড টেবিলে থাকা ফুলদানি আছার দিয়ে ভেঙ্গে ফেললো!

“আয়ুশী!”

ধমকে বললো আয়ান!

“খবরদার আমায় ধমক দিবেন না!কি পেয়েছেন টা কি হুম?শুরু থেকে যা যা হয়েছে সব কিছু আপনি দায়িত্ব বলেছেন!এই দায়িত্ব,দায়িত্ব করে আপনি আমার লাইফ হেল করে দিয়েছেন!দায়িত্ব ,দায়িত্ব করে আমার মনটাকে আপনার প্রতি দূর্বল করতে বাধ্য করেছেন!আর এই দায়িত্ব ,দায়িত্ব করেই আজ আবারও আপনি আমাকে এটা ফিল করাচ্ছেন যে আপনার আমার প্রতি কিছু আছে!কিন্তু আসলে তো কিছুই নেই!আপনি শুধু দায়িত্ব নিভাচ্ছেন!”

চুপ হয়ে গেলো আয়ুশী।চোখের পানি বাঁধ মানছে না!আবার বলতে লাগলো,

“একটা কথা বলুন তো?আমার জন্য কেয়ার করা ,আমাকে সামলিয়ে রাখা, আমাকে যারা টিজ করেছে তাদের মা’রা,এমনকি আমার মায়ের গয়না গুলো ফিরিয়ে আনা,সব কি সত্যি শুধু দায়িত্বের মাঝে পড়ে?”

চমকে তাকালো আয়ান! তাই দেখে আয়ুশী তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,”আপনি কি ভাবলেন?আপনার হ্যান্ড রাইটিং আমি চিনবো না?”

আবারও থামলো ও।

“আর যদি এগুলো দায়িত্ব ধরেও নেই,তাহলে আজ এই মুহূর্ত থেকে আপনাকে সব দায়িত্ব থেকে মুক্ত করলাম আমি!প্লিজ আমার লাইফের কোনো দায়িত্ব আপনাকে পালন করতে হবে!প্লিজ…আমি বাঁচি বা ম’রি এতেও আপনি নাক গলাবেন না!”

“জাস্ট শাট আপ!কি যা তা বলছো?”

“কোনো যা তা বলছি না আমি!”

“দেখো আয়ুশী,তুমি তো জানো তোমার বাবাই চাইতেন যে…”

“সেটা আপনার কাছে না,আঙ্কেলের কাছে!আপনি আর দয়া করে কোনো দায়িত্ব পালন করতে আসবেন না!”

“তুমি না করলেও আমি সেই দায়িত্ব পালন করবো!”

“কেনো?কিসের এত অধিকার ফলাচ্ছেন আপনি?কেনো আপনার আমাকে নিয়ে এত চিন্তা?দায়িত্বের মাঝে শুধু পড়ে আমার খরচ,আর কিছুর না ।তাহলে?”

আয়ান আয়ুশীর বাহু চেপে বললো,

“বিকজ ইউ আর মাই…”

“আই এম ইউর?”

আয়ান নিশ্চুপ!

“কি হলো ?থেমে গেলেন কেনো?বলুন!”

“ইউ আর মাই রেসপনসিবিলিটি!”

নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকালো আয়ুশী।রাগে দুঃখে নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিলো আয়ানকে!ধাক্কা সামলাতে না পেরে বিছানায় পা বেজে বিছানায় বসে পড়লো ও!অবাক দৃষ্টিতে তাকালো ও। এ কোন আয়ুশীকে দেখছে ও?

“দায়িত্ব,মানবিকতার কথা বলে আপনি আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছেন আর এখনও দিচ্ছেন!একদম নিঃশেষ!”

বলেই বেরিয়ে গেলো ও! দরজার পাশে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়ানো ইহরাকে দেখতে পেলো না ও!নিজের রুমে গিয়ে ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলে দিল।বিছানায় বসে কাঁদতে লাগলো ও।ওর সমস্যা টিউশনি বন্ধ হওয়া নয়!সমস্যা আয়ান !সমস্যা আয়ানের কেয়ার!সমস্যা আয়ানের ওকে নিয়ে টেনশন!কই দায়িত্ব ও আঙ্কেলের বেশি!তাও তো এমনটা করে না! ফাহিন বা অন্য কোনো ছেলের সাথে দেখলে রেগে যাওয়া,ব্যাথা পেলে মুখ ফুটে না বললেও বুঝে যাওয়া,ছেলেগুলোকে মা’রা,মায়ের স্মৃতি নিজ দায়িত্বে ফিরিয়ে দিয়ে ছোট্ট উপহার ও চিরকুট দেয়া,আর আজ ও যাতে সেদিনের মত কিছু ফেস না করে তাই টিউশনি বন্ধ করে দেয়া!এগুলো কি শুধু দায়িত্ব?মেয়েদের মন যে অনেক কিছুই বুঝে!কিন্তু এগুলো ও দায়িত্ব হিসেবে মেনে নিতে পারছে না।শুধু মাত্র এইসবের জন্য ওর মন আবারও আয়ানের প্রতি ব্যাকুল হচ্ছে।বাধ্য হচ্ছে ওকে নিয়ে ভাবতে!বাধ্য হচ্ছে ওর জন্য কষ্ট পেতে।সেটা কেনো বুঝছে না আয়ান!কেনো বার বার হঠাৎ আসা ঝড়ের মত ওর মনকে উলোট পালোট করে ফেলে!কেনো বার বার ওর মনকে বাধ্য করে বলতে,”অবেলায় ভালোবাসি!”

__________________________________

“আয়ান!”

আয়ানের পাশে বসে আয়ানের কাধে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলে উঠলো ইহরা! আয়ান কিছু না বলে জড়িয়ে ধরলো ইহরাকে!ছোট থেকে আর কাউকে পাশে পাক বা না পাক!এই মেয়েটাকে পেয়েছে!মেয়েটা ওর ছোট হলেও,ওর একজন ভালো বন্ধু হিসেবে সব সময় ব্যাবহার করেছে!কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে সোজা হয়ে বসলো ও! ইহরা আয়ানের ঘর থেকে আয়ুশীর চিৎকার শুনে এসেছিল!নাহারের আজকে শরীর ভালো না থাকায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাচ্ছেন!নাহলে হয়তো এসব দেখতে পেতেন!

“ইউ লাভ আয়ু?”

আয়ান চুপ থেকে উত্তর দিলো,”আমি দুঃখিত ইহরা!আমি পারিনি নিজেকে সংযত করতে!যেই অনুভূতি আমি তোমার প্রতি আনতে চেয়েছি,সেই অনুভূতি আমি আনতে পারিনি!সব পাল্টে গেলো আয়ুশীর সাথে দেখা হবার পর থেকে!সব!আমি কি করবো ইহরা,আমি যে নিরুপায়!মন মস্তিষ্কের যুদ্ধে মন জিতে গিয়েও হেরে গেছে!”

“ভালোবাসা বলে কয়ে হয় না আয়ান!আর কারো প্রতি জোর করে ফিলিং আনাও যায় না!”

আয়ান নিশ্চুপ!

“আন্টিকে বলবে?”

আয়ান মলিন চোখে তাকিয়ে বললো,”সব তো জানো তুমি!এটা হবার নয়!তাহলে কেনো জিজ্ঞেস করছো?”

ইহরা কিছু বললো না! ও বুঝতে পারছে আয়ানের অবস্থা!না পারবে ও বলতে আর না পারবে আয়ান!দুইজন যে একই পরিস্থিতির স্বীকার!

#চলবে

(প্রথমত দুঃখিত দেরির জন্য!দ্বিতীয়ত দুঃখিত ছোট পর্বের জন্য!কালকে থেকে বিকেল চারটা থেকে পাঁচটার মাঝেই গল্প পাবেন!আর ইনশাআল্লাহ বড় করে দিবো!আজকে একটু মানিয়ে নিবেন!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here