অবেলায় তোমার আকাশে পর্ব -০৮

#অবেলায়_তোমার_আকাশে
#পর্ব_৮
#লেখিকা_N_K_Orni

ছেলেটা লোকটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

— ভাইয়া তুমি এখনো ওই মেয়েটার ছবি দেখেই যাচ্ছ।

ছেলেটার কথা শুনে লোকটা পেছনে ফিরে তাকাল। তার দুই চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। লোকটা ছেলেটা ধমক দিয়ে বলে উঠল,

— এই মেয়ে আবার কেমন শব্দ? তোকে কত বার বলেছি ওকে ভাবি বলে ডাকবি। আর একবারও যেন তোর মুখে ভাবি ডাক না শুনি। আর শুনলে যে তোর কি হবে সেটা তুই ভালো করেই জানিস?

লোকটার কথা শুনে ছেলেটা একটা বড় ঢোক গিলে বলে উঠল,

— সরি ভাইয়া আর হবে না।

লোকটা গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,

— মনে থাকে যেন।

ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে বলল,

— হুম।

বলেই ছেলেটার লোকটার সামনে গিয়ে পাশ থেকে একটা চেয়ার টেনে বসল। লোকটা আবারও ছবি দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ছেলেটা বলে উঠল,

— ভাইয়া তুমি কেন এই নিয়ে পড়ে আছো? তুমি কি আদোও এই মেয়েটা…

ছেলেটা এটুকু বলতেই লোকটা তার দিকে চোখ গরম করে তাকাল। ছেলেটা ভয় পেয়ে বলে উঠল,

— না মানে ভাবি ভাবি। আমি তো ভাবিই বলতে যাচ্ছিলাম। আচ্ছা তুমি কি ভাবিকে খুঁজে পাবে?

— পাব পাব খুব তাড়াতাড়ি পাব। আমি ওখানে গেলেই ওর খোঁজ পাব যেখানে ওকে আমি দেখেছিলাম। ওখানেই ওর বাসা।

— ওহহ। পেলেই ভালো।

তখনই ওই লোকটার ফোন বেজে উঠল। লোকটা ফোন হাতে নিয়ে উঠে বারান্দায় চলে গেল। ছেলেটা এবার উঠে দাঁড়িয়ে বড় ছবিটার কাছে গেল। সে ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

— উফফ ভাবি তুমি কই বলো তো? আমার ভাইয়াকে তাড়াতাড়ি দেখা দেও। তোমাকে খুঁজে না পেয়ে পেয়ে আমার ভাইয়া তো বিরহ প্রেমিকের মতো হয়ে যাচ্ছে।

এবার সে বারান্দায় উঁকি মারল যে তার ভাইয়া তাকে দেখেছে নাকি। সে দেখল সে কথা বলছে। সে বিরবির করে বলে উঠল,

— যাক ভাইয়া শোনেনি। নাহলে আমাকে চিকেন তন্দুরি বানিয়ে দিত।

বলেই ছেলেটা হাসতে হাসতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

——————-

কলেজ থেকে এসে বৃষ্টি জামাকাপড় বদলে বিছানায় টান হয়ে শুয়ে পড়ল। তার মুখে লেগে আছে এক চিলতে হাসি। সে নিজেই নিজেকে বলে উঠল,

— উফফ সবকিছু আমার কাছে স্বপ্নের মতো লাগছে। আমার আসিফের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। আর আসিফ তো চেয়েছিল যে আমি ডাক্তারি না পড়ি। তাই এই স্বপ্নটা ওখানেই বাদ দিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এভাবে যে হঠাৎ করে আমার অপূর্ণ ইচ্ছা পূর্ণ হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি আমি। সত্যিই এসব খুবই অবিশ্বাস্য ব্যাপার। আচ্ছা আমি আবার কোনো স্বপ্ন দেখছি না তো। আর একটু পরেই যদি স্বপ্ন ভেঙে যায় তখন আমার কি হবে? দেখি একটা চিমটি কেটে দেখি।

বলেই সে নিজের হাতে একটা চিমটি দিল। সাথে সাথে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো,

— আউউ!

বলেই চিমটি দেওয়া জায়গায় হাত বুলাতে লাগল।

— তার মানে সত্যি।

ভাবতেই বৃষ্টির মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে বিছানায় উঠে ভালো করে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল।

মিসেস রায়ার ডাকে বৃষ্টি পিটপিট করে চোখ খুলে উঠে বসল। মিসেস রায়া বলে উঠলেন,

— কলেজ থেকে আসার পর তোর সাথে আর কথা হয়নি। এখন এখানে এসে দেখি তুই ঘুমিয়ে পড়ছিস।

বৃষ্টি ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে উঠল,

— শুয়ে থাকতে থাকতে যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিস সেটাই জানি না?

— ওহহ আচ্ছা। যাইহোক হোক পোনে দুটো বাজে। চল গিয়ে খেয়ে নিবি।

— কিইই এতো বেজে গেছে? আমি তো শাওয়ারও নেই নি। আচ্ছা আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে শাওয়ার নিয়ে আসছি। তারপর তুমি আর আমি একসাথে খাব।

বলেই বৃষ্টি একটা লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ল। মিসেস রায়া হালকা হেসে বলে উঠলেন,

— আচ্ছা।

বৃষ্টি তাড়াতাড়ি একটা ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল শাওয়ার নিতে। কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি শাওয়ার নিয়ে ফিরে এলো। চুল থেকে টাওয়েল খুলে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চুলগুলো হালকা মুছে পিঠের উপর ছেড়ে দিল। তারপর গায়ে ওড়না জড়িয়ে মিসেস রায়ার কাছে চলে গেল। মিসেস রায়া টেবিলে খাবার সাজাচ্ছিলেন। বৃষ্টিকে দেখে তিনি বলে উঠলেন,

— তোর হয়ে গেছে?

বৃষ্টি একগাল হেসে বলে উঠল,

— হ্যাঁ।

— তা ভেজা চুল পিঠের উপর ছড়িয়ে রেখেছিস কেন? ঠান্ডা লেগে যাবে তো?

— আজকে চুল শুকাতে ইচ্ছা করছে না। তাই এভাবে রেখেছি। চিন্তা করো না। ঠান্ডা লাগবে না। হালকা মুছে এসেছি।

— ওহহ আচ্ছা। তুই বস।

— তুমিও আমার সাথে বসো। আর আয়নাই বা কই?

— তুই তো জানিই ওর সামনে পরীক্ষা। তুই যখন ঘুমিয়ে ছিলি তখন ও এসে খেয়ে বেরিয়ে গেছে। ওর পড়ার চাপ চলছে প্রচুর।

— ওহহ।

এরপর মিসেস রায়া আর বৃষ্টি একসাথে লান্স করে নিল। খাওয়ার পর মিসেস রায়া সবকিছু গুছিয়ে তার রুমে চলে গেলেন। তিনি রুমে গিয়ে বিছানায় বসতেই বৃষ্টি এসে তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। মিসেস রায়া সযত্নে বৃষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। মায়ের পরে এই একজন নারীকেই বৃষ্টি নিজের একমাত্র আপন মনে করে। মিসেস সানিয়া বৃষ্টির প্রথম থেকেই পছন্দ ছিল না। বৃষ্টি শুয়ে থাকা অবস্থাতেই বাচ্চাদের মতো করে বলে উঠল,

— ফুফি আমাকে গল্প বলবে?

বৃষ্টির কথায় মিসেস রায়া হালকা হেসে বলে উঠলেন,

— হুম বলব। তা কিসের গল্প শুনবি?

বৃষ্টি ঠোঁটের কোণে কিছুটা হাসি ফুটিয়ে বলে উঠল,

— মায়ের গল্প। তুমি বলবে তো?

বৃষ্টির কথা শুনে মিসেস কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর মাথা নাড়িয়ে বলে উঠলেন,

— হুম বলব।

মিসেস রায়া বলতে শুরু করলেন,,,

— তোর মা খুবই ভালো একজন মানুষ ছিলেন। খুবই সরল, সাদামনের। ভাইয়া যখন কলেজে পড়ত তখনই বাবা মা মারা যান। আমি তখন স্কুলে পড়তাম। ভাইয়া আর ভাবির প্রেমের বিয়ে ছিল। কলেজে থাকাকালীন তাদের সম্পর্ক শুরু হয়। তাদের সম্পর্ক একদম নিখুঁত ছিল। একে অপরকে অনেক বেশি ভালোবাসত। পড়ালেখা শেষ করে ভাইয়া তার বন্ধুর সাথে বাবার রেখে যাওয়া ব্যবসায় হাত দেয়। তারপর ভাবির বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায়।যেহেতু আমাদের বাবা ছিল না ভাবির বাবা বিয়ে দিবেন না বলে দেন। তখন তারা দুজন পালিয়ে বিয়ে করেন। যেহেতু ভাবি পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে ভাইয়াকে বিয়ে করেছিল তাই ভাবির বাড়ির কেউ বিয়েটা মেনে নেয় না। আর ভাবির সাথে সম্পর্ক ওখানেই শেষ করে দেয়। যদিও ভাবির ছোট বোন লুকিয়ে লুকিয়ে ভাবির সাথে যোগাযোগ রাখত। তবে সে একদিন বাড়ির লোকের কাছে ধরা পড়ে যায়। যার কারণে সেও যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তখন ভাবি খুবই ভেঙে পড়ে। তবে ভাইয়া ভাবিকে সামলায়। হঠাৎই একদিন তারা খবর পায় যে তুই আসছিস। তুই হওয়ার পর আমি যেতে পারিনি। কারণ আমরা তোর ফুপার কাজের জন্য দেশের বাইরে গিয়েছিলাম। তবে ওখান থেকে ফিরে তোকে দেখতে গিয়েছিলাম। তোকে পেয়ে ভাইয়া আর ভাবি অনেক খুশি ছিল। ভাবি তো তার পরিবার হারানোর দুঃখই ভুলে গিয়েছিল। সবই ঠিকঠাক ভাবে চলছিল। হঠাৎ…

বলেই মিসেস রায়া থেমে যান। বৃষ্টি মাথা তুলে বলে উঠে,

— হঠাৎ কি ফুফি?

— হঠাৎ একটা ঝড়ে সবটা শেষ হয়ে যায়।

বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

— তোর বয়স যখন সাড়ে চার বছর, তখন….

মিসেস রায়া আবার চুপ করে গেলেন। বৃষ্টি এবার উঠে বসল। বৃষ্টি মিসেস রায়াকে ঝাকাতে ঝাকাতে বলল,

— তখন কি ফুফি? বলনা প্লিজ বলনা?

মিসেস রায়ার দুই চোখ পানি গড়িয়ে পড়ল।

চলবে,,,

( ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here