অমানিশার চাঁদ পর্ব -০২+৩

#অমানিশার_চাঁদ
#মেঘলা_আহমেদ (লেখিকা)
২+৩
[ ২ ]

-” বিয়ে হয়ে গেলেও এ মেয়েকে আমি কিছুতেই ঘরে তুলবো না।

একটি কথায় যেনো বিয়ে বাড়ির সবার মাথাতেই বাজ পড়লো। যে বিয়ে দিয়ে দুই বংশের মধ্যে যুগ যুগের শ|ত্রুতা শেষ করতে চেয়েছিলো, সেই বিয়ের মাধ্যমেই আবারো নতুন করে শ|ত্রুতার সূচনা হবে না তো? ইব্রাহিম সিকদার নতমুখে এগিয়ে এলেন। ইতোমধ্যে বিয়ে বাড়িতে গুন গুন আওয়াজ শুরু হয়ে গেছে। ইব্রাহিম সিকদার নতমুখে থেকেই বললেন-

-” দেখুন বেয়াই বিয়েটা হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু শুধু ঝামেলা করে লাভ কি?

সৈয়দ তুরাগ ভীষণভাবে রেগে গেলেন। তেতে উঠে গলা উঁচিয়ে বললেন-

-“কেন এমনভাবে ওয়াদা ভঙ্গ করলেন? আপনি বড় মেয়ে বিয়ে দেয়ার কথা বলে এখন কেন মেজো মেয়েকে গছিয়ে দিলেন?

ইব্রাহিম সিকদার যেনো দিশেহারা হয়ে গেলো। কোন উপায় না পেয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে বললেন-

-” বড় মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

পুরো বিয়ে বাড়ি এই কথায় নিরব হয়ে গেলো। সৈয়দ তুরাগ শুধু অবাক হয়ে তাকিয়েই রইলেন। হতভম্ব কন্ঠে বললেন-

-” এ কি অবস্থা আপনার মেয়েদের? এদের শিক্ষার এই দশা। শিক্ষিত বলে আপনার মেয়েকে ঘরে তুলতে চেয়েছি। এই শিক্ষাতেই আপনার মেয়ে বিয়ের দিন বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে! আর তার বদৌলতে আপনি মেজো মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলেন? আপনার বড় মেয়ে যখন বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়েছে, আপনার মেজো মেয়ে যে আমার ছেলের সংসার ছেড়ে পালাবেনা তার কি নিশ্চয়তা আছে? বলি আপনার মেয়েরা শিক্ষিত তাই অনেক ভেবে চিন্তে পুরোনো শ|ত্রুতা শেষ করতে এই বিয়ে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু আপনি তো পুরোনো ঘা তে মলম না লাগিয়ে তা আরো দ|গদগে করে দিলেন।

ইব্রাহিম সিকদার বলার মতো কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। এখন ভালোয় ভালোয় মেয়ে বিদায় দিতে পারলেই বাঁচে যেনো। তাতে বরপক্ষের দু চারটে কথা শুনলে দোষ কি। যখন অপরাধ তার বড় মেয়ে করেছে, কথা তো শুনতেই হবে। এই মেয়েকে আর কখনোই এ বাড়িতে আসতে দেবেনা। মনে মনে সেই প্রতিজ্ঞা করলো ইব্রাহিম সিকদার।

-” আহা বাবা ছাড়ুন তো। হাতের পাঁচটা আঙুল কি সমান হয়? বড় মেয়ে এমন করেছে তাই বলে সব মেয়েরাই কি এমন করবে? আর শ|ত্রুতা কিসের। সব শ|ত্রুতার সমাপ্তি আজ থেকে। ভুলে যান ওসব। কাজ ছিলো বিয়ে করা, কনে বদল হলেও সমস্যা নেই।

সবার মধ্যে থেকে একটা ভরাট পুরুষালি কন্ঠস্বর ভেসে এলো। উপস্থিত সবাই চাতক পাখির মতো তার দিকে তাকালো। বিয়ের বর এই কথা বলেছে! বরের কথা কারো কাছে ভারী অদ্ভুত ঠেকলো। তবুও কেউ কেউ পুরোদমে সমালোচনা শুরু করলো আবারো। কেউ কেউ স্বান্তনার বাণী শোনাচ্ছে। কেউ কেউ সিকদার বাড়ির বড় মেয়ের সমালোচনায় ব্যস্ত। সৈয়দ তুরাগ ছেলের কথায় দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বললেন-

-” কিন্তু!

তুরাগ কে চুপ করিয়ে দিয়ে তার ছেলে বলল-

-” বাবা আমি চাইনা আর কোন কথা হোক। এত ঝামেলা করলে আমাদের উভয় বংশের মানহানি হবে। যত শীঘ্রই বউ নিয়ে বাড়ি ফিরে চলুন। আমাদের সব কাজ তো হয়েই গেছে‌। আপনি খামোখা চিন্তা করছেন! আপনি যা চেয়েছেন আমি তো তা করেছি।

ছেলের কথায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো তুরাগ‌। তার ছেলে ঠিক থাকলেই সব ঠিক। আর তাদের যা চাই তা তারা পেয়ে গেছে। এখন ঝোপ বুঝে কো প মা রার অপেক্ষা। হতাশার মাঝেও তুরাগের ঠোঁটের কোনে মৃদু হাঁসি খেলে গেলো। সে হাঁসি বড্ড রহস্যময়। আড়াল থেকে তা একজনের চোখ এড়ালো না। ইব্রাহিম সিকদারের বুক থেকে যেনো পাথর নেমে গেলো। আর যাই হোক মেয়ের জামাই তার লাখে একজন। নাহলে কনে বদলেও রা|গারাগী করলো না। সৃষ্টিকর্তার কাছে শোকরিয়া আদায় করলেন মনে মনে। ফুরাত শক্ত হয়ে বসে আছে শুধু। এরা আরো কত নাটক করতে পারে তা সে দেখে ছাড়বে। শ|ত্রুতা মেটানোর এত শখ। আড়ালে কারো কপালে চিন্তার ভাঁজ। সে একমনে ভাবছে বরের বলা কথাগুলো – [ কাজ ছিলো বিয়ে করা কনে বদল হলেও সমস্যা নেই।। আমাদের সব কাজ তো হয়েই গেছে।। আপনি যা চেয়েছেন তা তো আমি করেছি। ] কি বুঝিয়েছে এই কথা দ্বারা। আগন্তুক কথাগুলোর হিসেব মিলাতে হিমশিম খাচ্ছে। তার মানে বিয়েতে ছেলের দিকে মতামত নেয়নি সৈয়দ সাহেব!

কনে বিদায় দেয়ার সময় হয়েছে। ইব্রাহিম সিকদার মেয়ের হাত তুলে দিলেন জামাইয়ের হাতে। ফুরাতের সর্বাঙ্গে যেনো বিদ্যুৎ খেলে গেলো। কখনো কেউ স্পর্শ করায় এমন হয়নি। ইব্রাহিম সিকদার অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন-

-” বাবা তোমার হাতে আমার কলিজার টু|করো কে তুলে দিলাম। তুমি ওকে দেখে রেখো। আমার বংশের রত্নের অমর্যাদা করোনা। ওকে সুখে রেখো।

মেয়ের জামাই ও সুন্দর করে শ্বশুরের কথার জবাবে বলল-

-” জ্বী ইনশাআল্লাহ।

-” লোক দেখানো চোখের জল ফেলানো হচ্ছে। বলে কি আবার কলিজার টু|করো। বংশের রত্ন। নিজের বংশের রত্নের অমর্যাদা নিজেই করেছে। অন্য‌ লোকে আর কি করবে। ( মনে মনে কক্ষাট করে কথাগুলো বলল ফুরাত) তার চোখে আজ পানি নেই। বিদায় বেলায় নাকি মেয়েরা না চাইতেও চোখে জল এসে যায়। তার একটুও আসছেনা কেন? আর কাদের জন্যই বা কাঁদবে? যারা নিজেদের বংশ মর্যাদার জন্য তাঁকে ব|লি দিয়েছে? তাচ্ছিল্য করে হাসলো ফুরাত। অনেক কিছু দেখা বাকি তার। ফুরাতের দু চোখ তার মা কে খুঁজছে। কিন্তু তার মা যে ঘরে বসে একা একা কাঁদছে। তাঁর নয়নের মনিকে সে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে রক্ষা করতে পারেনি। এই আক্ষেপে সে মেয়ের সামনেও আসছেনা। ফুরাত রাগান্বিত হলো‌। মায়ের কাছেও পর হয়ে গেলো তাহলে। তাকে নিয়ে পালকি তে বসানো হলো। মা কে দেখার জন্য তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো বুজে এলো। তার কোন মূল্যই নেই এই সিকদার বাড়িতে।

_____

আঁকাবাঁকা রাস্তায় ধীরে ধীরে পালকি চলছে। রাত হয়ে গেছে আগেই। একটু পর হয়তো এশারের আযান পড়বে। পালকির ভেতর বসে বসে নিজের জীবনের হিসাব মেলাচ্ছে ফুরাত। সবশেষে কিছুই পেলো না সব শূন্য। মেট্রিকের পর বাবা আর পড়তেও দিলেন না। ( পুনশ্চঃ প্রথম পর্বে আমার কিছুটা ভুল হয়েছে। ওরা দু বোন এসএসসি নয়‌ মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে। এই উপন্যাস টা এখনকার সময়ের না। এটা পুরোনো সময়কার কাহিনী নিয়ে হবে। তখন এসএসসি ছিলো না। আমি দুঃখিত ভূল তথ্য দেয়ার জন্য) জীবনে প্রাপ্তির খাতাটা একেবারে শূন্যতায় ভরা। ফুরাত মনে মনে আবারো আক্ষেপ করে বলল- সিকদার বাড়িতে যেনো কোন মেয়ের জন্ম না হয়। ও বাড়িতে মেয়ের‌ চেয়ে দাসিদের স্বাধীনতা বেশি। ও বাড়ির সম্মান রক্ষায় মেয়েরা যুগ যুগ ধরে ব|লি হয়ে আসছে। তার বোনটা চলে গেছে ভালোই হয়েছে। চারদিক নিরব, নিকষ কালো, এই রাতে কিছু মানুষের পদধ্বনি ভুতুড়ে ট তাকিয়ে থাকতে দেখলো। ফুরাত বিব্রত হয়ে গুটিসুটি মেরে বসলো। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে বেনারসি ঠিকঠাক করে নিলো। বড় বোনের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। যতই হোক ফাবিহা ওকে নিজের চেয়েও ভালোবাসতো। না জানি কার সাথে গিয়েছে! ফুরাতের এসব ভাবনার মাঝেই পালকি থামে। কেউ একজন হাত বাড়িয়ে দেয় তাকে নামানোর জন্য । হাতটা তার সদ্য বিবাহিত স্বামীর। সত্যিই স্বামী? সে কখনোই এ সম্পর্ক মানবে না। হাতের উপর হাত রাখতেই তখনকার মতো অচেনা অনুভূতি ঘিরে ধরলো। ফুরাত এসবে পাত্তা দিলো না। সে নেমে এলো পালকি থেকে। চারদিকে মানুষের কোলাহল শুনে কিছুটা বিব্রত হলো ফুরাত। তার মুখ ঘোমটার জন্য দেখা যাচ্ছে না। তাহলে মায়েদের ভাষ্যমতে এই সৈয়দ বাড়িই তার আপন নীড়। কিন্তু সেই তীক্ষ্ণ নজর ওয়ালা গম্ভীর লোকটা কে?

#চলবে

(আসসালামুয়ালাইকুম পাঠকমহল আমি দুঃখিত গত পর্বে ভুল তথ্য দেয়ার জন্যে। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। আপনাদের মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম।)

#অমানিশার_চাঁদ
#মেঘলা_আহমেদ (লেখিকা)

[ ৩ ]

এতদিন শুধু এই সৈয়দ বাড়ির নাম শুনেছে ফুরাত। আজ থেকে এটাই তার স্বামীর ভিটা‌। ফুরাত ঘোমটা টা চোখের উপরে ওঠায়। সাথে সাথে চোখে পড়ে নিপুণ কারুকার্য করা তিনটি বাড়ি। এত সুন্দর বাড়ি হয়তো তাদেরটাও নয়। শুনেছে এখানে তিনটি ভবনে মোট ২৩ টি কক্ষ রয়েছে। যেখানে তাদের দুই ভবনে মাত্র ১৩ টি কক্ষ। ফুরাত হাঁ করে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে কিছু মানুষ কানাঘুষা শুরু করে দিয়েছে। ইতোমধ্যে বিয়ের কন্যা বদল হয়েছে সে খবর ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসের গতিতে। তিনতলা ভবনের সামনে এসেই দাঁড়িয়ে যায় তাঁরা। ফুরাত মাথা নিচু করে আছে। আশেপাশের মানুষদের কথাগুলো তাকে কষ্ট দিচ্ছে। গ্রামের লোকজন তার বোনকে যাচ্ছে তাই বলছে। তার বোনের চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন তুলছে। বরণডালা নিয়ে মুখ আঁধার করে ফুরাতের সামনে এসে দাঁড়ায় করিমন্নেসা। ছেলের বউ পালিয়েছে সেই কথা শুনেই তাঁর মুখ আঁধার। তবুও তার স্বামী তুরাগ বলায় বাধ্য হয়ে এই মেয়েকে বরণ করতে এসেছে। পাশ থেকে জিনাত শিখিয়ে দেয় ফুরাত কে-

-” এইডা হইলো তোমার শ্বাশুড়ি আম্মা। ওনারে পায়ে ধরে সালাম করো। ছোড ভাই বউয়ের লগে তুমি ও সালাম করো।

জিনাত হচ্ছে এ বাড়ির আরেক ছেলের বউ। ফুরাতের কাছে জিনাতের কথাটা মনপূত হলো না। বরাবরই পায়ে ধরে সালাম করা ব্যাপার টা ফুরাত অপছন্দ করে। আল্লাহ ছাড়া কেন অন্যের সামনে মাথা নত করবে? কিন্তু তাদের সমাজে এটা করতেই হবে। এতে নাকি বড়দের সম্মান দেয়া হয়। এটাই নাকি নিয়ম। একদম অনিচ্ছুক ভাবেই ফুরাত আর তার স্বামী পা ছুঁয়ে সালাম করে। করিমন্নেচ্ছার চেহারায় কোন ভাবাবেগ দেখা গেলো না‌। তিনি কিছুটা সরে দাঁড়ালেন। এরপর গমগমে গলায় বললেন-

-” হইছে পা ধইরা আর ঢং করা লাগতো না। তোমার বইনডায় যেমনে ভাইগা (পালিয়ে) গেছে ওমনে আমার সংসার রাইখা চইলা যাবার চিন্তা মাথাত আইনো না। আমার পোলা ভালো মানুষ। তোমার বাপের উপরে করুনা কইরা, তোমারে বিয়া করছে। তাই যেমনে কইমু তেমনে থাকবা। আমার কথার উপরে কথা কইবা না। তোমার বইনডা তো সুন্দর আছিলো মেলা (অনেক)। তুমিও ফর্সা আছো তবে সাবধান বইনের মতো কইরো না যেন। তোমারে আমি কখনোই মাইনা নিতাম না।

তখনি পাশ থেকে তুরাগ বিরক্ত হয়ে বলে-

-” থামবে তুমি! কতবার বলেছি বরণ করে নিজের কক্ষে চলে যাবে। এখানে এত কথা কেউ তোমাকে বলতে বলেছে!

করিমন্নেসা হয়তো আরো কিছু বলতো। কিন্তু স্বামীর কথা শুনে রাগে গা রি রি করে ওঠে। তাঁর চোখে পানি এসে যায়। এমনিতেই বিয়েতে তার মত ছিলো না। মেয়ে সুন্দর তাই সে রাজি হয়েছিল। কিন্তু এখনে তো সেই মেয়ে নাই। তাই রাগ করে বলেছে। সে বরন ডালা টা বড় জায়ের হাতে দিয়ে বলে-

-” আমার পোলার বউ আনছো। আমার কোন মতামত নেও নাই। এহন আমি দুই চারডা কথা কইতে পারুম না। নাই, কোন দাম নাই আমার।

চোখ মুছতে মুছতে উপরতলায় চলে যায়। রাগে ফুরাতের সমস্ত শরীর জ্বলে যাচ্ছে। তার ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গেছে। এইসবের জবাব একদিন সে কড়ায় গন্ডায় মিটিয়ে দিবে। ফুরাত পাশে তার স্বামীর দিকে তাকায়। পাশে যেনো একটা কলের পুতুল দাঁড়িয়ে আছে। না আছে কোন অনুভূতি না আছে কোন আবেগ। ফুরাত নামটা মনে করার চেষ্টা করে। কিন্তু মনে আসছে না। সে ঘোরের মধ্যেই কবুল বলেছে তাই নামটা শুনতে পায়নি। জহুরা অসহায় চোখে ছোট দেবরের দিকে তাকান। সৈয়দ তুরাগ তাকে বরণ করার অনুমতি দিয়ে প্রস্থান করেন। দুজন কে বরণ করে ফুরাত কে ধরে ঘরে তোলেন জহুরা আর মরিয়ম। মরিয়ম হচ্ছে সৈয়দ বাড়ির মেজো বউ। সে সবসময় পর্দা করে চলেন। তার ভারি পছন্দ হয়েছে ফুরাত কে। তাঁরা ফুরাত কে নানারকম পরামর্শ দিচ্ছেন। ফুরাত কে ঘরে তোলার সাথে সাথেই তার স্বামী কোথায় যেনো চলে গিয়েছে। এতে অবশ্য তার মাথাব্যথা নেই। যতক্ষন পাশে ছিলো দমবন্ধ লাগছিল। তখন মরিয়ম বলে-

-” এই দাসি গুলা কই। গয়না আর শাড়ি নিয়া আইতে কও। ওদের ঘরডাও ভালো কইরা সাজাও ফুল দিয়া। ফুলশয্যার রাইত তো আজকে।

তখনি কোথা থেকে এক স্বাস্থ্যবান সুন্দরী মহিলা এসে বলে-

-” কি কইতাছেন এইসব ভাবী? আইজকা হইলো গিয়া কাল রাইত। আইজকা কিয়ের ফুলশয্যা?

মরিয়ম অনেক ধার্মিক মানুষ। ধর্মীয় নিয়ম মেনে চলার চেষ্টা করেন সবসময়। তিনি প্রতিবাদ করে বলে-

-” তুমি চুপ করো মারওয়া। আমগোর ইসলাম ধর্মে কাল রাইত বলতে কোন নিয়ম নাই‌। এইসব মানাও পাপ।

মারওয়া চুপ করে গেলেন মেজো ভাইয়ের বউয়ের কথায়। তিনি কখনো মরিয়মের কথার উপর কথা বলেন না। ফুরাত শুধু অবাক হয়ে এদের যুক্তিত|র্ক দেখছে। এরা পারেও বটে। আশেপাশের সবাই মরিয়ম কে সমর্থন করে। এরপর জিনাত আর তার শ্বাশুড়ি মরিয়ম মিলে একটি কক্ষে নিয়ে ফুরাত কে সাজানো শুরু করে। গায়ের বেনারশি পাল্টে লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ানো হয় ফুরাত কে। মরিয়ম মুগ্ধ চোখে দেখে। তিনি ফুরাতের রূপেই মুগ্ধ। তার বড় বোন না জানি কত সুন্দর! তখনি জানালার কাছে একটা শব্দ হয়। জিনাত চেঁচিয়ে বলে ওঠে –

-” কেডা? কেডা ওইহানে?

কেউ একজন দ্রুতবেগে সরে যায় ওখান থেকে। ফুরাত ভয়ে মরিয়ম এর হাত খা|মচে ধরে। মরিয়ম জানালার দিকে তাকিয়ে বলে-

-” হইবো হয়তো কোন জন্তু। ভয় পাইস না‌ তোরা। আর হুনো নতুন বউ তোমারে আমি তুই কইরাই কমু। আমার বউরেও আমি তুই কইরাই কই। বুঝছো। আমার কোন মাইয়া নাই। তোমারা হইছো আমার মাইয়া। আমারে মেঝ আম্মা কইবা।

ফুরাত এক টুকরো মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বলে-

-” আচ্ছা মেঝ আম্মা।

মরিয়ম সন্তুষ্ট হয় ফুরাতের কথায়। এরপর গয়নার ডালার ওপর থেকে লাল কাপড়ের অংশ টা সরান তিনি। ঝকঝক করে ওঠে স্বর্ণ। মরিয়ম আর জিনাত মিলে সব গহনাগুলো ফুরাত কে পড়িয়ে দেয়। সৌন্দর্য যেন উপছে পড়ছে ফুরাতের। মরিয়ম ফুরাতের কপালে চুমু দিয়ে বলে-

-” মাশাআল্লাহ চাঁন্দের টুকরা আইজ আমগোর মহলে আইছে! তাঁর রূপের জ্যৈতি সবাইর মন জয় কইরা লইবো।

ফুরাতের মুখ লজ্জায় রক্তিম হয়ে ওঠে। মরিয়ম মুচকি হেসে আবারো বলে-

-” হুন সবসময় পর্দা কইরা চলবি। স্বামীরে দেখানো ছাড়া কখনো সাজবিনা। মনে রাখবি তোর যত রূপ যৌবন সব তোর স্বামীর হক। আর তোর শ্বাশুড়ি মেলা ভালা মানুষ রে। রাইগা আছে তার পোলার বিয়া নিয়া। তার মনের মইধ্যে ঢোকার চেষ্টা করিস। আর হুনো যহন তহন চুল ছাইড়া থাকবা না। তুমি সুন্দর বউ গায়ে খারাপ বাতাস লাগবো। তোরা বয় (বসো) আমি দেইখা আসি সাজানো কতদূর!

মরিয়ম মাথায় ঘোমটা টেনে ঘর‌ থেকে ব্যস্ত পায়ে বেড়িয়ে গেলেন। জিনাত হেসে ফুরাতের পাশে বসে বলল-

-” তুমি আমার সই আইজ থেইক্কা‌। জানো আমার শ্বাশুড়ি অনেক ভালা মানুষ। এমনেই সবসময় ভালোবাসে। তোমারেও সবাই অনেক ভালোবাসবো দেখবা। তুমি ও অনেক সুন্দর। তোমার বইন হয়তো আরো সুন্দর আছিলো তাই এরা একটু রাইগা আছে। সব ঠিক হইয়া যাইবো‌।

ফুরাত দীর্ঘশ্বাস গোপন করে। এই কথা যে কদিন শুনতে হয় আল্লাহ মালুম।

__

চারদিকে প্রদীপের টিমটিমে আলো জ্বলছে। ফুলে ফুলে ভরা বিছানায় মাঝখানে বসে আছে সে। এত এত ভারী গহনা আর শাড়িতে অতিষ্ট হয়ে গেছে গরমে। জানালা থেকে ক্ষীন চাঁদের আলো মিলেমিশে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে ঘরটাকে। ফুলের রাজ্যে যেনো বসে আছে কোন রানী‌। গায়ে তার রাজকীয় সাজ। হিন্দুদের ভাষায় সাক্ষাত দেবী। তখনি দরজা খোলার আওয়াজ হয়। ফুরাত দু হাতে শাড়ি আঁকড়ে ধরে। বুক ধুকপুক করছে খুব। এই লোকটার সাথে এক ঘরে থাকতে হবে ভাবলেই মাথা ঘুরছে। তাকে এই ঘরে রেখে গেছে কিছু মেয়েরা। কি কি বিশ্রী মজাই না করছিলো। ভাবতেই গাল দুটো লাল হয়ে ওঠে ফুরাতের। ফুরাত উঠে এসে সালাম করে তার স্বামীর পায়ে। সে উঠে দাড়াতেই সামনে থাকা মানুষটার চোখ আটকে যায় তার উপর। এ যেনো কোন পরীকন্যা দাঁড়িয়ে আছে। গাঁয়ের গয়নাগুলো কারণে মনে হচ্ছে রূপ গলে গলে পড়ছে। চাঁদ, আর প্রদীপের আলোয় ঠোঁটের নিচের তিলগুলো দেখে ঘোর লেগে যায় চোখে। মুহূর্তেই সম্বিৎ ফিরে পায়। মুখের মুগ্ধভাব কাটিয়ে কা|টকাট গলায় বলে-

-” বিয়ে করেছি দেখে যে বউয়ের অধিকার দেবো এটা ভেবো না। আমার তোমার প্রতি কোন আগ্রহ নেই। যার নিজের মান সম্মান নেই সেই মেয়ের প্রতি আমার করুনা ছাড়া কিছুই নেই‌। সরো সামনে থেকে। খুলে ফেলো এসব সাজ। এসবে আমাকে ভোলাতে পারবেনা।

ফুরাত বিষ্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেলো। ঠোঁটজোড়া নিজ শক্তিতে আলাদা হয়ে গেলো‌। সে কিছু বলার আগেই ওপাশের ব্যাক্তি বলল-

-” নাম কি মেয়ে তোমার?

ফুরাতের উত্তর দিতে ইচ্ছে হলোনা‌। তবুও চোখ নামিয়ে বলল-

-” ফুরাত নাওয়ার নীলা।

নামটা ভারী লাগলো অপর ব্যাক্তির। এত বড় নাম।‌ সে গলার স্বর স্বাভাবিক করে বলল-

-” আমি সৈয়দ কায়েস ফাবিহান। তবে তোমার এতবড় নাম আমার পছন্দ নয়। আজ থেকে তুমি সৈয়দ নীলা ফাবিহান।

ফাবিহানের মুখে সৈয়দ নীলা ফাবিহান, নামটা শোনা মাত্রই শুদ্ধতম ভালোলাগায় ছেয়ে গেলো হৃদয়। তবে এখানেই কি খেলা শুরু!

#চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here