অমানিশার চাঁদ পর্ব -০৫

#অমানিশার_চাঁদ
#মেঘলা_আহমেদ

[ ৫ ]

অনুভুতি সবই বোঝো, বলো না কেন ভালোবাসি?
আচ্ছা অনুভূতিদের কবর দিতে, তুমি কি জানো রূপসী?

কানের কাছে ফিসফিস কথা গুলো শুনে নড়েচড়ে ওঠে নীলা। ঘুমের মধ্যে কথাগুলো বুঝতে কিছু সময় পার হয়। কথা গুলো যখন বুঝতে পারলো, ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ মেলে তাকায়। কিন্তু আজব ব্যাপার কক্ষে সে ছাড়া কেউ নেই। ভয় পেয়ে উঠে বসে নীলা। সারা কক্ষে চোখ বুলিয়েও কাউকে দেখতে পায়না। ভয়ে ঘাম ছুটে গেছে। আবারো সেই কথা। সিকদার বাড়িতে থাকতেও কেউ তার কানের কাছে এই কথাটা বলতো। কিন্তু এ বাড়িতে কে? কোন খারাপ জ্বীন নয়তো। মুহূর্তেই কপাল কুঁচকে যায় নীলার। ধ্যাত এসব কি ভাবছে। ফাবিহান ঘরে ঢুকে নীলাকে কপাল কুঁচকে বসে থাকতে দেখে। সে নিজের উপস্থিতি বোঝানোর জন্য গলা খাঁকারি দেয়। নীলা চমকে ফাবিহানের দিকে তাকায়। ফাবিহান ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে –

-” কি ব্যাপার? এভাবে চমকে গেলে কেন?

নীলা নিজের শাড়ি ঠিক করে মাথায় কাপড় টেনে নেয়। তার ইচ্ছা করছে ফাবিহান কে কথাটা বলতে। কিন্তু ভেতরের আরেক সত্ত্বা বলে ওঠে – বলিস না ওকে। তোকে খারাপ ভাববে। মন মস্তিষ্কের দ্বিধাদ্বন্দ্বে শেষে মিনমিন করে বলে-

-” ঘুম থেকে উঠেছি তো তাই।

ফাবিহান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়া। নীলার আগামাথা নিরীক্ষণ করে বলে-

-” ভীতু মেয়ে। শেষমেষ এই আমার কপালে কি না এই ভিতু মেয়ে জুটলো। সিকদার বাড়ির মেয়েরা এত ভিতু জানতাম না তো। সবাই ভিতু নয় তার মানে। কারন রাতের আঁধারে যে মেয়ে পালিয়ে যেতে পারে তার বংশ ভিতু হতেই পারেনা। তুমি একাই ভিতু।

নীলা ভেবেছিলো কিছু বলবেনা। কিন্তু বড় বোন কে নিয়ে একটা কথাও ও শুনবে না। ফাবিহানের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো। সে দৃষ্টি ভষ্ম করে দিতে পারে ফাবিহান কে। গলায় তেজ নিয়ে বলল-

-” নতুন বউ বলে যা ইচ্ছা তাই বলবেন। আর আমি চুপচাপ শুনবো, ভেবেছেন? ভুল ভেবেছেন তাহলে, আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখেছি। আমাকে যা বলুন, কিন্তু আমার পরিবার কে নিয়ে কিছু বললে এক চুলও ছাড় পাবেন না।

ফাবিহান মুচকি হাসে। এই মেয়ের তেজ কমেনা‌। সে কথার উত্তর না দিয়ে বারান্দার দিকে চলে যায়। নীলা বিছানা থেকে নামে। একটু পরে আজান পড়বে। নামাজ পড়া হচ্ছে না এই কদিনের ঝামেলায়। সে শাড়ি ঠিক করে মাথায় ঘোমটা টেনে নেয়। তারপর গুটি গুটি পায়ে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। নিচে নামতেই নিজের শ্বাশুড়ি কে চোখে পড়ে নীলার। করিমন বসে বসে ঢুলছে। জিকির করছে হয়তো। নীলা একটা শুকনো ঢোক গিলে শ্বাশুড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ভয়ে ভয়ে সালাম দেয়-

-” আসসালামুয়ালাইকুম আম্মীজান।

নীলা ভয়ে ভয়ে শ্বাশুড়ির দিকে তাকায়। হঠাৎ রিনরিনে কন্ঠে সালাম শুনে চোখ খুলে তাকায় করিমন। সামনে নীলা কে দেখে বিরক্ত হলেন। কিন্তু রাগ করতে পারলেন না কেন যেন। মেয়েটার গায়ে নীল শাড়ি আর গয়না গুলোতে যেন জ্বলজ্বল করছে। আজকে সুন্দর লাগছে খুব। করিমন চোখ ফিরিয়ে নিলেন অভিমানে। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন-

-” ওয়ালাইকুম সালাম। এখন এই সন্ধ্যায় কোন দিয়া আইছো? কি চাই এইহানে?

নীলা কি বলবে খুঁজে পেলো না। একটু ভেবে বলল-

-” আসলে আম্মীজান, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুম থেকে উঠে নিচে এসেছি। আপনাকে একা বসে থাকতে দেখে..

করিমন মাঝপথে হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললেন-

-” হইছে থামো। আর ঢং কইরা আম্মীজান ডাহন লাগতো না। সারাদিন হুইয়া (শুয়ে) থাইকা, এখন নিচে নামার কথা মনে আইছে। আমি কইছিনা তোমারে আমার পছন্দ না। আমার কাছে কেন আইছো? আর কোন কাম থাকলে কইয়া বিদেয় হও। তোমার এই চাঁন্দের লাহান মুখ আমার দেখতে মনচায় চায় না।

নীলা ব্যথিত হলো। শ্বাশুড়ির থেকে এই ব্যবহার পাবে আশা করেনি হয়ত। মা কে এখন খুব মনে পড়ছে। মায়ের অভাব টা এখন হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছে নীলা। এই বুঝি পার্থক্য। বিয়ের পরে সবাই আরেকটা মা পায় না, সব শ্বাশুড়ি মা হয়ে উঠতে পারেনা। আহত চোখে শ্বাশুড়ির দিকে তাকালো‌। সে এখনো মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। নীলার খুব করে বলতে ইচ্ছে করলো, আম্মীজান আমি কি দেখতে এতই খারাপ। যে আমার দিকে তাকিয়ে একটু কথাও বলা যায় না। কিন্তু মুখ ফুটে শব্দ বের হচ্ছে না। অপমানে চোখে অশ্রু টলমল করছে। টুপ করে বুঝি গড়িয়ে পড়বে। নীলা নিজেকে ঠিক রেখে প্রশ্ন করলো-

-” আম্মীজান আমি ঘাট পাড়ে ওযু করতে গেলাম।

করিমন ছাড়া ছাড়া গলায় বলে-

-” যাইবা তবে সন্ধ্যার আগে ঘরে আইবা। আমগো বাড়ির নতুন বউয়েরা সন্ধ্যার পরে বাইরে থাহেনা।

নীলা আর কিছু না বলে ঘাট পাড়ের দিকে এগিয়ে গেলো। ফাবিহান সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সব কিছুই দেখলো। মায়ের ব্যবহার টা তার হজম হয়নি। সে গটগট করে সিঁড়ি দিয়ে নামলো। ক্ষুদ্ধ গলায় তার মা কে বলল-

-” আম্মীজান আপনি নীলার সাথে এমনটা না করলেও পারতেন। মেয়েটা সহজ হতে চাইছে, আপনি মানিয়ে নিন।

করিমন ছেলের দিকে অবাক চোখে তাকালো। তার ছেলে বউয়ের হয়ে কথা বলছে। করিমন কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলল-

-” হায় আল্লাহ, ও বড় ভাবি, মেঝ ভাবি দেইখা যাও। পোলা বিয়া করাইয়া আমি কোন সর্বনাশ করছি। এই মাইয়া একটা ডাইনি, আমার পোলারে বশ কইরা ফেলছে।

ফাবিহান বিরক্ত হলো মায়ের কথায়। তার মায়ের এই বেশি বোঝা স্বভাব তার পছন্দ না‌। মায়ের সাথে কথা বলাই বৃথা। ফাবিহান রেগে ফুল বাগানের দিকে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে যায়। বাগানে গিয়ে রুহুল কে দেখতে পায় সে। বিরক্তিকর ভাবটা মুখ থেকে উবে যায়। দ্রুতপায়ে রুহুলের কাছে এগিয়ে যায় সে। মনটা একদম ভালো হয়ে যায় ফাবিহানের। রুহুল ফাবিহান কে দেখে হেসে বলে-

-” তোর কথামতো ওদের আম্মারে বলছি‌। ছেলে দুইডা আর আপনে আমাগো বাড়িতে থাইক্কা কাজ করে খাইলে আপনার কি সমস্যা আছে? হেয় খুশি হইছে অনেক। স্বামী নাই এহন খাইবো কি পোলা গো নিয়া। তাই তারা তিনজনেই রাজি হইছে। ওদের আম্মার নাম সালেহা বানু, আর ওগোর দুই ভাইয়ের নাম করিম, রহিম। বড়ডা রহিম, ছোটডা করিম।

ফাবিহান হেসে মাথা দুলিয়ে বলে-

-” সালেহা বানু কে নীলার দাসী নিযুক্ত করে দেবো। মেয়েটা সারাদিন একা একা থাকে, তুমি তো জানোই আম্মা ওর সাথে কথা বলেনা‌। তাই ওর সাথে কেউ থাকলে ভালো লাগবে।

রুহুল সব কয়টা দাঁত বের করে হেসে বলে-

-” আচ্ছা তাইলে ওগো দুই ভাইরে কি কাম দিবি?

ফাবিহান রহস্যময় হেসে বলে-

-” ওরা দুই ভাই আমার ব্যক্তিগত কাজ করবে। ওটা তোমার না জানলেও চলবে।

রুহুল আর প্রশ্ন করেনা। এত দিয়ে তার কাজ কি। ফাবিহান অনেকদিন পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। লাঠি এখন তার কাছে। লাঠি দিয়ে এমন ভাবে সাপ কে বাড়ি দিতে হবে যাতে, সাপ ও ম রে, লাঠিও না ভাঙে। লাঠিটা যে বহু কষ্টের পাওয়া। লাঠিটার প্রতি তার বড্ড মায়া। লাঠিটা ভাঙলে চলবেনা, সেটা তো বড্ড আদুরে।

___

নীলা ঘাট পাড়ে বসে আছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। চোখের পানি ঘাটের পানির সাথে মিশে যাচ্ছে। চারদিকে আযান পড়তে শুরু করেছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে অথচ নীলা এখানো বসে আছে।ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে তার। তাকে সন্ধ্যার পরে বাহিরে থাকতে নিষেধ করেছে। নীলা পানিতে হাত ডুবিয়ে ওযু করতে শুরু করে। হঠাৎ পানির মধ্যে একটা পাথর ছুঁড়ে মা রে কে যেনো। নিলা চমকে চারপাশে তাকায়। খেজুর গাছটার পাশ থেকে কে যেনো দ্রুতপায়ে সরে যায়। পড়নে কালো পোশাক। সেই ব্যক্তির উদ্দেশ্যে জোড়ে বলে- কে? কে?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here