অশ্রুমালা পর্ব ৫+৬

#অশ্রুমালা
Part-5
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

আমার সোনার টুকরা ছেলের তুলনায় তুমি কিছুই না। ওর পায়ের নখের ও যোগ্যতা নেই তোমার রোদেলা। তুমি হচ্ছো পোড়া কপালি। এক ঘরে তো সংসার করতে পারো নাই এখন আসছো আমার ছেলের মাথা খেতে।

এক দন্ড থেমে ফের ফোড়ন কেটে বলে উঠে,

-আমার ছেলেটার জীবনটা শেষ করে দিয়ে এখন বসে বসে টিভি দেখছো?

উপরের কথাগুলো কর্কশ কন্ঠে বলে উঠে আবেগের মা জাবেদা খাতুন।

রোদেলা বিষ্ময় চোখে তার শ্বাশুড়ির দিকে একবার তাকালো। তারপর চোখজোড়া নিচে নামিউএ নিল সেই সাথে মাথায়। যদি জাবেদা খাতুন একটু ঠিক ভাবে রোদেলার দিকে তাকাতেন তাহলে দেখতে পেতেন রোদেলার চোখে পানি! কিন্তু রোদেলার চোখের পানি সে দেখতে পেলনা আর দেখলেও খুব একটা প্রভাব বিস্তার করত না তার মাঝে।

জাবেদা খাতুনের মনে যত আগুন আছে সব নিয়ে জ্বলে একাকার! তিনি সাপের মতো হিসহিস করছেন৷

রোদেলা দ্রুত টেবিলের উপর থেকে রিমোটটা নিয়ে দ্রুত টিভি অফ করে দিল। টিভিতে মনপুরা মুভিটা চলছিল। এই মুভিটা একসময় ভীষণ প্রিয় ছিল রোদেলার। যখন প্রথম রিলিজ হয় ওইসময় সে টিনএজার ছিল তাই তো সিনেমা হলে গিয়ে তিনবার দেখেছে বান্ধবীদের সাথে। আজকে হঠাৎ টিভিতে মুভিটা হচ্ছে দেখে ইভানাই জোড় করে তাকে বসিয়ে দিল টিভির পর্দার সামনে।

মাত্র নাস্তা সেরেছে রোদেলা। তাতেই ইভানা তাকে ডাক দিল। সেও ইভানার ডাকে সাড়া দিয়ে ড্রয়িং রুমে যায়। ইভানা তাকে জোড় করে বসিয়ে দেয়। বাবু তাদের বেডরুমে ঘুমাচ্ছে। তাই রোদেলা ইভানার জোড়াজুড়ি তে সোফায় বসে পড়ে। হুট করে ইভানার কল আসায় সে অন্য রুমে চলে যায়। এরই মধ্যে রোদেলার শ্বাশুড়ি বাইরে থেকে ফিরেই তাকে এতো এতো কথা শুনালেন।

জাবেদা খাতুন কিছু বলবেন তার আগেই রোদেলা তাড়াহুড়ো করে রিমোট রাখতে গিয়ে থাম করে ফেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে রিমোট ভেঙে ব্যাটারি দুইটা দুই দিকে ছড়িয়ে গেল।

হুট করে যে এমন কোন ভুল রোদেলার মাধ্যমে ঘটে যাবে তার জন্য বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলনা রোদেলা। তার মুখটা কালো হয়ে গেল।

রোদেলা মিনমিন সুরে বলে, আমি উঠাচ্ছিস মামী।

জাবেদা খাতুন কর্কশ কন্ঠে বলে উঠে, তার কোন দরকার নাই বাপু। এই সময় ঝুকলে যদি ব্যথা বাড়ে আবেগ এসে আমাকেই কথা শুনাবে।

রোদেলা মৃদ্যু হাসলো কিন্তু মুখে কিছু বলল না। তার মামীর স্বভাবটাই এমন। বাইরে যতোই চটাং-চটাং বলুক না কেন ভেতরের দিকটা নরম। এমন না যে উনি মানুষ টা খারাপ। আপাতত সে পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে না৷ না পারাই কথা৷ আবেগের সাথে রোদেলার বিয়ে হবে এটা তো রোদেলা নিজেই আবেগকে ভালোবাসার পর ও কোন দিন কল্পনাও করতে পারেনি৷

মামীর তার সাথে এমন করাটা জায়েজ আছে।কোন মা ই মানতে পারবে না তার অবিবাহিত সুপুরুষ ছেলের সাথে কোন কোন বিবাহিত নারীর বিবাহ। তাও যদি ছেলে ডাক্তার হয়। বাংলাদেশে তো এমনি ডাক্তারের কদর হিমালয় ছুইছুই । পাত্র-পাত্রী বাজারে সবচেয়ে আর্দশ হলো ডাক্তার পাত্র। সেরকম একটা অবস্থায় আবেগ তাকে বিয়ে করেছে। তার ছেলের সৎ বাবাও হয়ে গেছে।

ভেতর থেকে বাবুর কান্নার শব্দ ভেসে আসল।

জাবেদা খাতুন বলে উঠে, যাও। বাচ্চা সামলাও।

রোদেলা কিছু না বলে৷ উঠে গেল। এবং রুমে ঢুকে বাবুকে কোলে তুলে নিল৷

তারপর বলে উঠে, কি হয়েছে বাবাই? কাদো কেন?

রোদেলা বাবুকে নিয়ে হাটতে লাগলো। বাবুকে কোলে নিয়ে হাটলে চুপ হয়ে যায় সে তাই রোদেলা আস্তে আস্তে হাটছে। হাটতে হাটতে সে বারান্দায় গেল। বারান্দায় যেতেই ইভানার মৃদ্যু আওয়াজ ভেসে আসল। এখনো ফোনে কথা বলছে ইভানা? কার সাথে এতোক্ষন ধরে কথা বলছে সে?

রোদেলা এ নিয়ে আর মাথা ঘামালো না। বাবু চুপ হয়ে গেছে। এখন বেলা একটা বাজে। বাবুকে গোসল করাতে হবে।

রোদেলা গরম পানি আনতে গেল।

★★★

আবেগ ডা. আফরোজার কেবিনে বসে আছে। উনি একটা ফর্ম আবেগের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, বাচ্চার নামের জায়গাটা ফাকা রাখলাম। তুমি লিখে দিও পরে।

–আচ্ছা ম্যাডাম।

ডাক্তার আফরোজা তার কেবিনের চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চশমাটা খুলে টেবিলে রেখে বলে, রোদেলাকে সাত দিন পর আমার কাছে আনবে। চেক আপ করতে হবে৷ ঔষধ ঠিক মতো খেতে বলবে।

–জি৷

–তুমি নিজেই তো ডাক্তার তাই আর কিছু বলব না।

–হুম।

আফরোজা বলে উঠলেন, তোমার কিন্তু বিশ হাজার টাকা ডিউ আছে।

–জি ম্যাডাম। আমি আগামী মাসের বেতন পেলেই দিয়ে দিব৷

–ইটস ওকে। আমি কি আর হাসপাতাল থেকে কোথাও যাচ্ছি নাকি? তোমার সুবিধা মতো দিয়ে দিও।

–থ্যাংকস ম্যাম।

–বাচ্চার নাম কি রাখবে ঠিক করেছো?

–উহু।

–ভালো দেখে সুন্দর একটা নাম রাখবে।

–আচ্ছা। আমি যাই তাহলে।

–ওকে।

আবেগ তার রুম থেকে বের হলো। রোদেলাকে পাক্কা সাত দিন হাসপাতালে রাখতে হয়েছিল। সব মিলিয়ে অনেক খরচ হয়ে গিয়েছিল যার সবটা আবেগ নিজে পে করেছে। কিন্তু তারপর ও বিশ হাজার টাকা এখনো দিতে পারেনি। এই হাসপাতালে চাকরি করে জন্য সে থার্টি পাসেন্ট ডিসকাউন্ট পেয়েছে। তারপর ও বিশ হাজার ডিউ আছে।

আবেগ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আকিকা করতে কত টাকা লাগবে? কুরবানী দিতে হবে। ছোট করে হলেও আকিকা করতে হবে। আজ-কালের মধ্যে হাসপাতালের বিল মেটাতে হবে। আবেগ মনে মনে ঠিক করল, আজকেই ব্যাংকে যাবে। টাকা তুলবে। তার নিজের জমানো দশ লাখ টাকা আছে। সেখান থেকেই দুই লাখ তুলতে হবে৷ এই টাকা সে নেহাকে দেনমোহর দিবে বলে জমাচ্ছিল কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে তা আর সম্ভব না। রোদেলাকে সে মাত্র বিশ হাজার টাকা দেনমোহর দিয়ে বিয়ে করেছে৷ আবেগের বুকে ফেটে একটা নিশ্বাস বেরিয়ে এলো।

তার অর্থের অভাব জিনিসটা একদম অপছন্দ কিন্তু মধ্যবিত্ত প্রতিটা ঘরেই মনে হয় একবার না একবার অর্থের সংকট কাড়া নাড়বেই!

আবেগের মনে হচ্ছে তার যদি কোন টাকার গাছ থাকত তাইলে সেখান থেকে পাতা ছিড়ে ছিড়ে ব্যবহার করত সে!

আবেগ বেশ ক্লান্ত। চেয়ারে গা এলিয়ে দিতে না দিতেই ইর্মাজেন্সিতে ডাক পড়ল। অগত্যা সে উঠে পড়ল রোগী দেখতে যাওয়ার জন্য।

★★★
রোদেলা সবেমাত্র বাবুকে নিয়ে বারান্দায় বসেছে গোসল করাবে জন্য। হুট করে জাবেদা খাতুন এসে বাজখাঁই গলায় বললেন, এটা কোন সময় হলো বাচ্চা গোসল করানোর? বাচ্চাদের সকাল-সকাল গোসল দিতে হয়। বেলা পড়ে যাওয়ার পর না। এইসবের জ্ঞান যদি না থাকে তাহলে কেমনে হবে? এখন তো ঠান্ডা লেগে যাবে আর তোমাকে ডাক্তার নিচে হেলে বসতে মানা করেছে না? তাও কেন বসছো?

–বাবুকে গোসল করানোর জন্য। দুই দিন ধরে গোসল করানো হয়না।

জাবেদা খাতুন বললেন, উঠে দাড়াও৷ আমি ময়নার মাকে পাঠাচ্ছি৷

রোদেলা বাবুকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। জাবেদা খাতুন হনহন করে রুম থেকে বের হয়ে আসলেন।কিছুক্ষন পর ই আবেগের বাসার সাহায্যকর্মী ময়নার মা এলেন। উনি এসে বাবুকে গোসল করিয়ে দিলেন৷

বাবুকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রোদেলা নিজে গোসল করতে গেল।

আবেগ অফিস থেকে বের হলো। আজকে ব্যাংকে যাবে। কিছু কাগজ-পত্র লাগবে জন্য বাসায় এই অসময়ে ফিরে আসছে। একটা রিকশা ঠিক করে সেটায় বসতেই তার ফোন বাজতে লাগলো। সে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল নেহার ফোন। সাথে সাথে তার চেহারার রং পালটে গেল। আবেগ ঢোক গিলল। এতোক্ষনে তার বিয়ের খবর নেহার কান অব্দি যাওয়ার কথা!

সে ফোন ধরতেই নেহার কান্নার শব্দ পেল। ওপাশ থেকে কেবল নেহা কেদেই যাচ্ছে। ফুপিয়ে কেঁদে চলেছে সে৷ কোন কথা বলছে না। একবার অস্ফুট স্বরে আবেগ বলেছে শুধু।

আবেগ ফোন কেটে দিল। কি যে হচ্ছে আর কি হবে কিছুই জানে না সে৷ শুধু স্রোতের অনুকূলে ভেসে চলেছে সে! স্রোত যেদিকে যাচ্ছে সেও সেদিকে বয়ে চলছে! এছাড়া আর কি বা করার আছে তার?

★★★
রোদেলা গোসল করে বের হতেই চমকে গেল। আবেগ একদম তার মুখ বরাবর দাড়িয়ে আছে।

এই অসময়ে কেন ঘরে ফিরেছে আবেগ? মনে মনে বলে রোদেলা। সে আবেগের দিকে তাকালো। সম্পূর্ণ ঘেমে-নেয়ে একাকার সে! শার্টটা ঘামের জন্য ভিজে গেছে৷

আবেগ রোদেলার দিকে তাকালো। মাত্র গোসল সেরে বেরিয়েছে রোদেলা হাতে গামছা পেচিয়ে রেখেছে। চুল গুলো ভেজা। টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে রোদেলার চুল থেকে৷

আবেগ রোদেলাকে দেখতে লাগলো। রোদেলার চুল গুলো কোমড় পর্যন্ত ছড়ানো। আবেগ হুট করে রোদেলার হাত থেকে ভেজা গামছাটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল।

রোদেলা হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে থেকে। আস্তে করে বলে উঠে, আমার চুল মোছা হয় নি তো!

আবেগ এই কথার জবাব দিল না।।

কিছুক্ষন পর,

দুপুরে খেতে বসেছে সবাই। আবেগ ও বসেছে। রোদেলাও আবেগের পাশে বসে আছে। খেতে খেতে আবেগ সবার উদ্দেশ্য বলে, আগামী শুক্রবার বাবুর আকিকা করব। আত্মীয়-স্বজন যাকে যাকে দাওয়াত দিতে চাও দিতে পারো।

জাবেদা খাতুন কিছু বলতে যাবেন তার আগেই আবেগের বাবা ইমতিয়াজ সাহেব বলে উঠে, আচ্ছা। ঠিক আছে।

স্বামীর কথার বিরোধিতা না করতে পেরে জাবেদা খাতুন খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলেন।

যা আবেগের চোখ এড়ালো না।

খাওয়ার পর রোদেলা-আবেগ রুমে আসল। আবেগ রোদেলাকে উদ্দেশ্য করে বলে, বাবু কে কি বলে ডাকো তুমি?

রোদেলা শান্ত গলায় বলে, বাবু বলেই ডাকি।

–কোন নাম ঠিক করেছো তুমি?

–নাহ।

–তাহলে কি নাম রাখতে চাও?

রোদেলা কিছুক্ষন ভেবে বলে, পলাশ।

আবেগ মুখ বাকিয়ে বলে, এটা কোন নাম? সেই পুরান আমলের।

–তাহলে প্রেম রাখি?

আবেগ আবারো বিরক্ত মাখা গলায় বলে, আমার ছেলে কি সালমান খানের মুভির চরিত্র যে প্রেম নাম রাখব?

রোদেলা আরো এক দফা বিষম খেল। তার ছেলেকে আবেগ নিজের সন্তান মানে? খুশিতে রোদেলার চোখ চিকচিক করতে লাগে। সে তা আবেগকে বুঝতে না দিয়ে বলে, তাহলে তুমিই ঠিক করো।

চলবে।
অশ্রুমালা
Part–6
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

আবেগ বিরক্তমাখা মুখ নিয়েই রোদেলাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। রোদেলা এখনো অবাক হয়ে চোখ কিছু টা বড় করে আবেগের দিকে তাকিয়ে আছে।

আবেগ তার ফোন রেখে বাথরুমে ঢুকে পড়ল।

সে বাথরুমে ঢুকতেই তার ফোন বাজতে লাগলো। ফোনের ভাইব্রেশন রোদেলার বুকে কম্পম সৃষ্টি করে।

আবেগ বাথরুম থেকেই বলে উঠে, ফোনটা ধরো রোদেলা।

একথাটা শোনার মিনিট এক পর রোদেলা ফোন ধরার জন্য টেবিলের কাছে গেল কিন্তু দুঃখজনক ভাবে ফোন কেটে গেল।

রোদেলা আবেগের ফোন হাতে নিয়ে ডায়াল লিস্টে গেল। সে দেখল হাসপাতাল থেকে কল এসেছিল এটার দেখার পর পর ই রোদেলার চোখ নিচে যেতেই রোদেলা আরেকটা দফা কেপে উঠে। তার মাথা ভোভো করতে লাগে৷ স্ক্রিনে ইংরেজি ওয়াডে লেখা “Neha”

রোদেলা অস্পষ্ট ভাবে নেহা বলে উঠে।

ঠিক সেই সময় আবেগ বাথরুম থেকে বের হয়ে
এভাবে রোদেলাকে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার কাছে যায় এবং ছো মেরে নিজের ফোনটা রোদেলার হাত থেকে কেড়ে নেয়।

তারপর আবেগ কড়া গলায় বলে, কারো ফোন তার পারমিশন ছাড়া ধরতে হয় না৷ ইটস ব্যাড ম্যানারস। নেক্সট টাইম থেকে আমার ফোন আর ধরবা না।

রোদেলার কানে আবেগের কোন কথাই যাচ্ছে না। তার মাথায় প্রচন্ড ব্যথা অনুভব হচ্ছে।বহু কষ্টে দাঁড়িয়ে আছে সে। মনে হচ্ছে এখুনি পা জোড়া গুরগুর করে ভেঙে যাবে। নেহার নাম আবেগের ফোনে দেখে রোদেলার বুকের ব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর হলো!

নেহা যদি তার কাছে জবাব চায়? কি জবাব দিবে সে ? ফ্রেন্ড হয়ে ফ্রেন্ডের সুখ কেড়ে নেওয়ার অপরাধ যে তার কাধে এসে জমবে৷

রোদেলার দুই চোখ বেয়ে দুই ফোটা অশ্রুমালা গড়িয়ে পড়ে৷

আবেগ এখনো ফোন হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে রোদেলার দিকে তাকিয়ে আছে। চুল গুলো এখনো শুকায় নি। ভেজাই আছে। আবেগ মূলত রোদেলা কে পর্যবেক্ষন করছে। মেয়েটাকে দেখে অন্যমনস্ক মনে হচ্ছে! কি এতো ভাবছে?

আবেগ আবারো রোদেলাকে পাশ কাটিয়ে বেডে গিয়ে বসল। সে ফোনের সেটিং এ গিয়ে পাসওয়ার্ড দিয়ে দিল। তারপর ফোন রেখে শুয়ে পড়ল। আধ ঘন্টা রেস্ট নিয়ে ব্যাংকে যেতে হবে তাকে। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতেই কানে বাবুর কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। সে চোখ খুলে দেখে রোদেলা রুমে নেই। কি আশ্চর্য!
মেয়েটার কি বুদ্ধি-সুদ্ধি নেই নাকি? বারবার বাচ্চা রেখে কই চলে যায়?

বাচ্চা সামলাতেই জানে না!—বিরবিরিয়ে বলে উঠে আবেগ। তারপর বাবুকে কোলে তুলে নেয় এবং কান্না থামানোর চেষ্টায় নেমে যায়।

★★★

নেহা বালিশে মুখ গুজে দিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে। এছাড়া তার আর কি করনীয় ই বা আছে? কাদা ছাড়া তার আর কোন অপশন নাই। কাদতে কাদতে হিচকি তুলে ফেলেছে সে। সেই সকাল থেকে একাধারে কেদেই যাচ্ছে নেহা। আজকে সকালে আবেগের বিয়ের খবরটা অথৈয়ের কাছ থেকে পেয়েছে সে। অথচ আবেগ নিজে থেকে তাকে জানায় নি৷ জানাবেই না কোন মুখে? চোর কি কোন দিন চুরি করে বলে আমি চোর ওমুক জায়গায় চুরি করেছি। ঠিক তেমন ই আবেগ ও ফোন দিয়ে কি বলত? নিজের প্রেমিকাকে তো আর নিজের বিয়ের কথা বলা যায় না?

নেহা আবারো কেদে দিল। কি করবে সে এখন? আবেগ ছাড়া যে তার জীবন শুন্য! বুকের ভেতরের শুন্যতা নিয়ে সে কিভাবে বাকি জীবন পার করবে? কিভাবে? কিভাবে? —চিৎকার করে উঠে নেহা। তার এই আর্তনাদ সে কেবল নিজেই শুনতে পেল।

★★★
রোদেলা চা হাতে দাঁড়িয়ে আছে জাবেদা খাতুনের রুমের সামনে। মামা দুপুরের পর দোকানে যান। মামার ইলেকট্রনিক্সের দোকান আছে। সেখানেই বসেন মামা। দুপুরে খেতে আসেন বাসায়।

রোদেলা বিড়ালের মতো ধীর পায়ে রুমে ঢুকল। মামী এই সময় চা খান। তাই আজকে সে বানিয়ে দিল। আগে প্রায় ই এই সময়টায় ক্লাস করে মামার বাসায় আসত। দুপুরে খেয়ে রেস্ট নিয়ে বিকেলের দিকে আবেগ গিয়ে রেখে আসত তাকে। আবেগরা ফার্মগেট থাকে। ফার্মগেট থেকে ইডেন কলেজ অনেক কাছে হয় তাই রোদেলা মাঝে মাঝে আসত মামার বাসায়। তখন দেখত প্রায়ই মামী এই সময়টায় চা খেতেন। মামী রোদেলাকে তুই বলেই ডাকে কিন্তু কালকে থেকে তুমি করে ডাকছে। এতে বেশ হতাশ রোদেলা। কারন তার কাছে মনে হয় ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশের অন্যতম ভাষা হলো ‘তুই’। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো ইংরেজিতে তুই বলে কোন শব্দ নাই। সবাই হচ্ছে ইউ (You)।

এই কারনে যারা রোদেলাকে তুই বলে ডাকে তাদেরকে সে একটু অন্য নজরে দেখে।

রোদেলা মৃদ্যু সুরে মামী বলে ডেকে উঠে।

জাবেদা খাতুন শুয়ে ছিলেন। তাকে ডাকতে শুনে উঠে বসলেন বিছানার উপর৷ রোদেলা কে দেখে সে বুঝি একটু বেজার ই হলো। মুখটা কালো করে ভাবলেশহীন ভাবে বলে, কি চাই?

–মামী তোমার জন্য চা বানালাম৷

উনি মুখ টা বাকিয়ে বলে, যতোসব আদিখ্যেত! এসব করে আমাকে গলাতে চাচ্ছিস তুই? আমি বরফ না চেয়ে গরম পেলেই গলে যাব৷এই জাবেদা খাতুনের মনটা লোহার মতো শক্ত। তোর কোন কাজেই আমার মন গলবে না।যা আমার সামন থেকে। দূর হ।

রোদেলা হালকা হেসে মনে মনে বলে, লোহাও ১৫৩৮°C তাপমাত্রাতে গলে যায় মামী!

এইটুকু ভেবে সে মামীর রুমের বাইরে চলে আসে।

রোদেলা যাওয়ার পরপর জাবেদা খাতুন টেবিল থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে চা খেতে থাকেন। তার বড্ড চায়ের তৃষ্ণা পাচ্ছিল। কিন্তু উঠে গিয়ে চা বানানোর শক্তি পাচ্ছিল না সে।এই সময় চা খেতে পেরে বেশ ফ্রেস লাগছে তার!

রোদেলা রুমে যেয়েই দেখে আবেগ বাবুকে কোলে নিয়ে হাটাহাটি করছে৷ রোদেলাকে আসতে দেখে আবেগ তার কাছে গিয়ে বলে,

তোমার সমস্যা টা কি বল তো,? বাচ্চা রেখে কোথায় হাওয়া হয়ে যাও বল তো শুনি?

–আবেগ আমি রান্নাঘরে ছিলাম।

আবগ আর কিছু বলল না। তার এখন যেতে হবে বাইরে এটা যেমন একটা কারন তেমনি আরেকটা কারন হলো তার রোদেলার সাথে কথা বলতে মন সায় দেয় না। ভালো লাগে না। কোথায় যেন একটা বাধা কাজ করে। সে রোদেলার কোলে বাবুকে দিয়ে হনহন করে রুম ছেড়ে বের হতে লাগলো।

রোদেলা তড়িঘড়ি করে বলে, কোথায় যাচ্ছো এই সময়?

আবেগ পেছনে না ফিরেই বলে, নান অফ ইউর বিজনেস।

রোদেলা আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। সে বাবুকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রোদেলা একবার ঘড়িতে দেখে নিল। সময় জানান দিচ্ছে সাড়ে চারটা বাজে। এই অবেলায় কই যাচ্ছে আবেগ? রোদেলার মনে প্রশ্ন জাগে। কিন্তু উত্তর মেলাতে পারল না সে৷

আবেগ ব্যাংকের কাজ শেষ করে বের হতেই আবারো নেহার ফোন আসল। আবেগ বুকে সাহস সঞ্চার করে ফোন রিসিভ করে।

ওপাশ থেকে নেহার কান্না ভেসে আসছে৷ নেহার কান্নার শব্দ শুনে আবেগের বুকটা ছ্যাত করে উঠে। সে নরম স্বরে বলে, কান্না থামাও নেহা। স্টপ ক্রায়িং।

এরপর পাক্কা দশ মিনিট উভয় পাশের ব্যক্তিরা নিরব। যার বেনিফিট কল সেন্টার পাচ্ছে।

নেহা কাপা স্বরে বলে, আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই।

আবেগ ছোট বাক্যে জবাব দেয়, সম্ভব না।

নেহা আবারো করুন সুরে বলে উঠে, প্লিজ!

আবেগ নেহার অনুরোধ ফেলতে পারল না তাই তো নেহার বলা রেস্টুরেন্টে না চাওয়া সত্ত্বেও গেল।

কখনো কখনো আমরা মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু কাজ করে থাকি। আবেগের মনে হয়, মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আমরা যেসব কাজ করে বসি সেই সময় টা হচ্ছে সবচেয়ে শ্বাসরুদ্ধকর! ওই সময়টায় নিশ্বাস নিতেও যন্ত্রনা লাগে!

আবেগ বসে আছে৷ ধানমন্ডির এক রেস্টুরেন্টে। তার সামনে নেহা বসে আছে। নেহাকে দেখার পর থেকে তার বারবার মনে হচ্ছে কেন এলো সে? না আসাই হাজার গুন বেটার ছিল। নেহার ফোলা ফোলা লাল টকটকে একদম রক্তজবার মতো চোখ দুটি দেখে যে তার বুকটা কেপে উঠল। এই সময় আবেগের বুকে কেউ স্টেথিস্কোপ ধরলে নিশ্চয়ই রেটিং অনেক পেত!

সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হালকা হেসে বলে, কিছু ওর্ডার দিব?

নেহা তার দিকে তাকালো একথা শুনে৷

নেহার সাথে চোখাচোখি হতেই আবেগের বুক হুহু করে উঠে তাও নিজেকে শক্ত করে বলে, তোমার ফেভারিট থাই স্যুপ আর অন্থন ওর্ডার দিই?

নেহা কিছুটা উচু আওয়াজে বলে উঠে, আর ইউ জোকিং উইথ মি?

— অভবিয়াসলি নো।

নেহা থমথমে গলায় বলে উঠে, তুমি কি রোদেলাকে নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করেছো?

আবেগ একথার উত্তর না দিয়ে নেহার চোখের দিকে তাকালো। নেহার লাল চোখ দেখে যা যা বলতে চাচ্ছিল সব গুলিয়ে ফেলে সে।

নেহা কঠিন গলায় বলে, কি হলো চুপ করে আছো কেন? উত্তর দাও।

–হু।(ছোট করে)

–হু কি? ঠিক মতন জবাব দাও। চুপ থেকো না প্লিজ। তোমার নিরবতা আমার বুকে নতুন আশা জাগিয়ে তুলছে।

আবেগ যান্ত্রিক গতিতে বলে উঠে, হুম। নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করেছি৷

একথা শুনে হতাশ হয় নেহা। মনের মধ্যে একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে আবেগ নিজ ইচ্ছাতে বিয়ে করে নি কিন্তু আবেগের মুখে কথাটা শুনে মনে পুষে রাখা আশাটা কাচ ভাঙ্গার মতো টুকরো টুকরো হয়ে গেল।

সে হতাশ হয়ে গেল এবং করুন গলায় বলে, আমার কথা ভাবলে না একবারো? আমি যে তোমাকে ছাড়া কিছুই বুঝি না! তাও আমাকে ফেলে দিলে? কি দোষ ছিল আমার আবেগ?

আবেগ নেহার দিকে না তাকিয়ে বলে, তোমার বাবা আমাকে পছন্দ করেন না।

–তো? আমি তো তোমাকে ভালোবাসি। প্লিজ তুমি ফিরে আসো। আমার তুমি ব্যতিত আর কিছু লাগবে না। কেবল এবং কেবলমাত্র তোমাকে চাই আমি!

–ভুল সুত্র প্রয়োগ করেছো। ভুলে যাও আমাকে। (ক্লান্ত গলায়)

নেহা কেদে দিয়ে বলে, আমার সবটা জুড়ে যে তুমি! কিভাবে ভুলি তোমায়?

আবেগ এতোক্ষন ধরে মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। নেহাকে যা যা বলবে সেসব কথা গুছিয়ে নিয়ে নেহার কথা শেষ হতেই বলে উঠে,

যখন আমরা কোন অংক করতে যেয়ে দেখি ভুল সুত্র প্রয়োগ করেছি তখন কি করি? ভুল সুত্রের মাধ্যমে আগাই? (নেহাকে প্রশ্ন করল)

নেহা কিছু বলল না।

আবেগ নিজ থেকে বলে দিল, নিশ্চয়ই না। পুরো অংকটা কেটে দিয়ে নতুন করে শুরু করি। সঠিক ল এপ্লাই করি। ঠিক তেমনি আমি হয়তোবা তোমার জীবনে একটা ভুল সুত্র ছিলাম তাই তোমার হিসাব মিলছে না। আমাকে কেটে ফেলে নতুন সুত্র দিয়ে অংক করো। দেখো! মিলে যাবে। মুভ অন নেহা।

নেহা বাজখাঁই গলায় বললো, খুব তো বললা মুভ অন করতে? কিন্তু কিভাবে? আমার তো একটা সুত্রই জানা আছে সেটা হলো তুমি। আর কিছু জানি না আমি আর না জানতে চাই।

–উঠলাম।

–আবেগ?

আবেগ উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলে, একটা গনিত বইয়ে কিন্তু সব অংক থাকে না। পরীক্ষার হলে যা শিখেছি সেখান থেকে লিখি। হুবহু সব কিছু না পরীক্ষায় কমন পাওয়া যায় আর না জীবনে! খুজে নিতে হয়,বুঝে নিতে হয় আর শিখে যেতে হয়! আসি তাহলে। (শান্ত গলায়)

নেহা আবেগের যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল আর বলল, প্লিজ আমাকে একা রেখে যেও না। আমি পারব না তোমাকে ছাড়া থাকতে। খুব ভালোবাসে ফেলেছি তোমাকে।

আবেগের কান অব্দি একথা গেল কিন্তু সে কিছু বললো না। কারন এই কঠিন কথাটার পাল্টা জবাব তার শব্দ ভান্ডারে নেই৷

আবেগ রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলো ।

রাস্তার সাইড দিয়ে বড় বড় পায়ে হাটছে।আগামীকাল শুক্রবার। কুরবানির জন্য গরু আজকেই কিনবে। আবেগ ঠিক করেছে তার ছেলের নাম সাদবিন রহমান সমুদ্র রাখবে।

জগৎ টা বড্ড অদ্ভুত! ক্লাস লাইনে রসায়ন পড়তে গিয়ে শিখেছিল কিছু বন্ধন ভেঙে তবেই নতুন বন্ধন সৃষ্টি হয়! আজকে এই শিক্ষাটা তার জীবনে ঘটে গেল।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here