অস্তিত্বে চাই তোমার ছোঁয়া পর্ব -০৩+৪

#অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০৩

ইফদিয়ার ভীতু নয়নে তাকিয়ে আছে। হৃদপিন্ড ধড়াম ধড়াম করে লাফাচ্ছে। আকস্মিক অদৃশ্য মুখোশধারী লোক সেজে কেমনে আসল যাবিয়াজ ভাই! তা ভেবে পাচ্ছে না সে। শুকনো এক ঢোক গিলে দৃষ্টি নত করে। ফাঁকা ক্লাস রুমে বেঞ্চে টেবিলের উপর বসে আছে যাবিয়াজ ভাই। তার সম্মুখে অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে আছে ইফদিয়ার। যেনো কোনো অপরাধ করে ফেলেছে সে। তার শাস্তি স্বরুপ যাবত দুঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পা ধরে এসেছে ইফদিয়ার। দাঁড়ানোর ক্ষমতা লোপ পাচ্ছে। অন্যদিকে, যাবিয়াজ আনমনে শয়তানি হেসে কুটিকুটি অবস্থা। যখন দেখে রমণীর অবস্থা কাহিল হচ্ছে তখন হাতে স্পর্শ করে টান দিল। ইফদিয়ার এতক্ষণ স্থীর থাকায় তার পা জমে গিয়ে ছিল। অতএব টান খাওয়ায় পায়ের স্থীরতা ভেঙ্গে হুমড়ে খেয়ে পড়ে যাবিয়াজের কোলে।
কানের কাছে মুখ নিয়ে যুবকটি ফিসফিসানো কণ্ঠে বলে,

‘ডোন্ট ডেয়ার টু লাভ এনি বয়েস। রাদার আই উইল ফিনিশ ইউ।’

ইফদিয়ার রাগ চওড়া হলো। পাইছি কি তাকে কোনো গরু যে রাখালের মত কাটাবে? মনের মেজাজ বিগড়ে চেঁচিয়ে উঠে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)

‘পাইছেন কি হে আমি কি আপনার বাসার পালিত গরু! যখন যা বলবেন তাই শুনব। আই লাভ ইউ ডেম। এই ছোট তিনটি শব্দ বুঝেন না। উল্টা আসছেন উপদেশ মারতে।’

যাবিয়াজ শান্ত দৃষ্টিতে রমণীকে পর্যবেক্ষণ করছে। রমণীর ঠোঁট নাড়ানো যুবকের অন্তরালে নেশা জাগিয়ে দিচ্ছে। শার্টের কলার ঠিক করে চোখ ঘুরিয়ে ভাব এনে বলে,

‘আমার কোলে থেকে আমাকেই চিল্লাচ্ছো! ইটস এ ব্যাড ম্যানার্স। চাইলে তুলে আছাড় মারতে পারি। কিন্তু পরে বোঝা আমারই উঠানো লাগবে। তাই ছাড় দিয়েছি।’

‘ধুর গিয়ে বাঁশ খা। এক ছোটি লারকি কি দিলকি বাত নাহি চামাচতা। আসলে বলদ কোথাকার।’

যাবিয়াজ শুনে গম্ভীর রক্তিম দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। ইফদিয়ার কে আর পায় কে। তৎক্ষণাৎ রুম থেকে ছু মন্তর হয়ে গেল। যাবিয়াজ না হেসে পারল না। আনমনে দরজার দিকে পরখ করে বলে,

‘যে ব্যক্তিত্বের ধনাঢ্যে নিজের সর্বনাশ পেয়েছি সেই ধনাঢ্যের মূল অংশ তুমিতে ভরপুর। তাহলে সেই নারী কি তুমি? যার মধ্যে দেখেছি নিজের সর্বনাশ। না কখনো নয়। তুমি তো রইলে আমার এক অসভ্যসম্ভাবী নারী। এক মিনিট আমি কি কবি হয়ে গেলাম।’

যাবিয়াজ নিজের কথায় বেক্কলের মত চেহারা করে নিল। হিসেব মেলানো দ্বায়। তার মন যা চাই এর বিপরীতে গিয়ে দাঁড়ায় কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের স্ফীত অংশ মস্তিষ্ক। আচ্ছা হৃদপিন্ডের ধুকপুক কি প্রিয় মানুষকে দেখে গভীরতার রুপে তীব্রভাবে ধুক পুক করে উঠে। নাকি এতে কোনো এক প্রকার অসুখ মিশ্রিত। যে অসুখে প্রেমিক পুরুষ সর্বগ্রাস্তিত হয়ে পড়ে। অসুখটা কি আদৌ মন্দ নাকি ভালো।
যাবিয়াজ নিজের মনে গড়া প্রশ্নের সমাধান চাই। যা পাওয়া ইতিমধ্যে দুষ্কর। মেয়েটা কোনো হৃদয়হরণী নয় বরং ইরিটেটিং। ভেবে যাবিয়াজ ফাঁকা রুম থেকে বেরিয়ে ক্লাসের উদ্দেশ্য রওনা হলো।

৬.

ইফদিয়ার কে পুরু স্কুলে খুজেঁ হয়রান হয়ে গেল তিয়ানা। গেটের বাহিরে একবার উঁকি মেরে দেখে লাভ হলো না। ইফদিয়ারের ছাঁয়ামূতিও নেই। কোথায় যে গেল মেয়েটা! চিন্তায় অসীমতা পেরিয়ে যাচ্ছে তার। ফোন বের করে কল দিল। রিসিভ হতেই গালির বর্ষণ শুরু করে তিয়ানা।

‘ঐ বা*লের শা*লী তুই আজ স্কুলের ভেতরে আয়। শু*টিয়ে যদি নোংরা*মি না বের করি আমার নাম তিয়ানা না।’

‘আচ্ছা তখন তোর নাম ফাটা বাঁশ রাখব কেমন সুন্দর না নাম?’

‘ঐ তুই আমার লগে ফাজলামী করছিস কখন থেকে খুঁজে যাচ্ছি। আত্তাপাত্তা কিছু আছে?’

‘ওবাবা তোকে আত্তাও কেন দেবো পাত্তাও কেন দেবো।’

‘তবে রে আয় সামনে হাতে নাতে একবার ধরি তারপর বুঝাব।’

‘তাহলে যা সামনেই আসমু না।’

তিয়ানা শান্ত হলো। এতোক্ষণ ডিপ্রেশনে কত কি বলে ফেলল। কলটা কানে রেখে স্বাভাবিক আহ্লাদী কণ্ঠে বলে,

‘কই এবার আয়।’

‘ভূউউউ।’

তিয়ানা এক চিৎকারে লাফিয়ে উঠে। সে স্কুলের মধ্যে থাকা বেঞ্চে বসে ছিল। পিছ থেকে ভূতের মত ভয় লাগিয়ে দিল ইফদিয়ার। তিয়ানা হা করে ভয়ার্ত চেহারা করে রেখেছে। যা দেখে পেট ফুলিয়ে হেসে চলেছে ইফদিয়ার। তিয়ানা ঠোঁট কামড়ে কাঁদো কাঁদো চেহারা করে বলে,

‘যা তোর সঙ্গে কথা নেই। আমার মত বাচ্চা মেয়েকে ভয় লাগিয়েছিস। জীবনেও তোর কের হইতো না। দেখিস বদরাগী জামাই পাইবি। একদম জ্বালাইয়া পুড়াইয়া তোকে ছাই কইরা খাবে। আমার মত বাচ্চারে কাঁদাস। কথা নাই আড়ি তোর লগে।’

ইফদিয়ার মুহুর্তেই সিরিয়াস চেহারা করে তিয়ানাকে জাপ্টে ধরে ‘সরি’ বলে। কিন্তু বেচারী সত্যি ভয় পেয়েছে। দু’তিন বার বুকে ফুঁ দিচ্ছে। ইফদিয়ার কান ধরে ‘সরি’ বলতেই তিয়ানা তার হাত নামিয়ে বলে,

‘হয়ছে হয়ছে আমি আবার সহানুভূতিশীল মানুষ। কারো সরি একসেপ্ট না করে থাকতে পারি না।’

ফিক করে হেসে দিল ইফদিয়ার। তিয়ানাও হেসে দুই বান্ধবী হাতে হাত রেখে ক্লাস রুমে প্রবেশ করে।

এদিকে,
যাবিয়াজ পড়ল মুসিবতে। বন্ধুগণ তাকে আঁটকে রেখেছে। তাদেরকে যুক্তিস্বরুপ বলতে হবে যে, ফাঁকা রুমে সে আর ইফদিয়ার কি করেছে? আর কেনোই বা ইফদিয়ার এমন ছুটে পালালো। এর উত্তর যেন তাদের চাই।
যাবিয়াজকে নিরব থাকতে দেখে শ্রেয়িতা হাতে থাকা কলম দিয়ে গুতা মারে এরফানকে। এরফান জানে যাবিয়াজের সামনে যখন সে হিংসাত্মক কথাটি বলেছিল। এর প্রতিফলেই সে ইফদিয়ারকে রুমে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। যা সকলের চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও। দ্যা গ্রেট এরফান দা ডিটেক্টিভ বয়কে দেওয়া সম্ভব না।

কিছুক্ষণ আগের ঘটনা…..

এরফানের কথায় যাবিয়াজ কোনোরুপ বনীতা করে না। বরঞ্চ শান্ত উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে,

‘ওয়ান্ডারফুল! নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবি। আমি না হয় তখন তোর লাভসানের মজা উড়াবো।’

এরফান ঠোঁট ফুলিয়ে শ্রেয়িতার কানে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘বলে কি,বোঝায় কি একেই বলে বলদ।’

‘হক কথার মার নেই। তাই তো বিজ্ঞ লোকে বলেছে, কারো ভালো করতে নেই।’

‘অর্কমার ঢেকি যে তুই।’

ফেরদৌস ঠাট্টা করে শ্রেয়িতাদের উদ্দেশ্যে বলে,

‘এই বলদের কথা বাদ দে তো। হের জীবনে লাবডাব হইতো না বুঝলি।’

যাবিয়াজের দলভুক্ত সব উঠে গেল পাটি থেকে। তারা উম্মুক্ত আকাশের নিচে ভার্সিটির পিছনের দিকে পাটি বিছিয়ে বসে ছিল। ফেরদৌস ক্লাসরুমে যেতে নিলে যাবিয়াজ ডাক দেয়। সে এলে তার হাতে নিজের একডজন বই ধরিয়ে বলে,

‘দোস্ত ওয়াশরুমে যাচ্ছি। আমার টেবিলে ব্যাগের উপর বইগুলো রেখে দেস।’

ফেরদৌস মাথা নেড়ে চলে গেল। যাবিয়াজ ওয়াশরুমে না গিয়ে সোজা ইফদিয়ার স্কুলের গেটে গেল। ইফদিয়ার স্কুল যাবিয়াজের ভার্সিটির খুব নিকটে। ০৫ মিনিট হেঁটে গেলেই গেটের সামনে আসা যায়। ইফদিয়ার ভাগ্যবশত গেটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল তিয়ানার জন্যে। আজ সকালে একবার উঁকি মেরেছিল যাবিয়াজ ভাইয়ার দিকে। কিন্তু নিজেই লজ্জায় পড়ে পালিয়ে গেল। কেননা যাবিয়াজের বন্ধুগণ তাকে দেখে যাবিয়াজ ভাইয়াকে নিয়ে মশকারী করছিল।
হঠাৎ হাতে টান পড়ায় খেয়াল করে যাবিয়াজ রক্তিম দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ভীতু মনে ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলে,

‘আ….যা..যাবিয়াজ ভা..ইয়া আ…পনি।’

পূর্ণবাক্য হওয়ার আগে হিঁচড়ে স্কুলের ফাঁকা রুমে নিয়ে গেল। সেখানে শাস্তি স্বরুপ দাঁড় করিয়ে শোধ লুটিয়ে নিল।
ইফদিয়ারকে লাজুকভাবে বের হতে দেখে ফেলে এরফান। সে ভার্সিটির দুতলায় ছিল। দুতলায় সে ক্যাটাগরি ল্যাবে একটি টবে মাটি কুড়ছিল। মাটি কুড়ে টবে ভরপুর করে। টবটা সযত্নে টেবিলের উপর রেখে দিল। নিজের শরীর থেকে এপ্রোন আর হাত থেকে গ্লাভস খুলে মুখ ধুয়ে নিল। দরজা খুলে বেরিয়ে গেল ল্যাব থেকে। দুতলার রেলিং এর কাছে এলো হালকা মৌসুমী শীতল বাতাস উপভোগ করতে। তাদের ভার্সিটি থেকে ইফদিয়ার স্কুল সরাসরি দেখা যায়। কে যায়,আসে সব। তৎক্ষণাৎ ইফদিয়ার পিছনে যাবিয়াজকে বের হতে দেখে নিজেই বোকা বনে গেল। প্রথমে মনে করল নিজের ভ্রম। পরেরবার চোখ কুঁচলে খেয়াল করতেই দৃষ্টিকোণে ধরা পড়ে গেল যাবিয়াজ।

বর্তমানে…

শ্রেয়িতা ঠোঁট কামড়ে লাজুক কণ্ঠে বলে,

‘ইশ! আমার মেহনাত স্যারও যদি এমনটা করতো। কতই না রোমান্টিক হতো।’

এরফান হা করে বলে,

‘মেহনাত স্যার হে হে হে। ঐ হিটলার দাদা আর তোর সঙ্গে রোমান্স। আরে ভাই কেউ আমারে থামা। হাসি থামে না কা?’

‘ঐ বেয়াদপ পোলা মেহনাত স্যারকে একদম হিটলার বলবি না। সেই হ্যান্ডসাম যদিও কথাবার্তায় আখরু ওয়ালা। তাও আমি বউ হিসেবে চালিয়ে নিবো।’

‘হই ঐ আখরুর জীবন ত্যানা ত্যানা করে দিবি আরকি।’

‘ধুর হাড্ডিসার।’

যাবিয়াজ এদের নানান কথোপকথন শুনে আনমনে হাসছে। তাদের বন্ধুগণের এই এক রসিকতা তার কাছে বেশ পছন্দনীয়। তারা কথায় এতটা পটু যে তাদের মাধ্যমে নিজের অজান্তে খারাপ হওয়া মনটাও বুঝি ভালো হয়ে যায়। ক্লাসরুমে ফারুক সাহেব প্রবেশ করলেন। তিনি যাবিয়াজদের প্রযুক্তিবিদ্যার স্যার। ফেরদৌস নিরব হয়ে গেল। কেননা উক্ত স্যার স্বয়ং তার বাবা। এরফান হে হে করে হেসে ফেরদৌসের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘তোর বাপরে জিগাই স্যার ফেরদৌস কইছে হের নাকি বিয়া!’

ফেরদৌস চোখজোড়া বড় করে তাকায়। সেই চোখের মধ্যে অগ্নিশর্মা ভেসে উঠেছে। সে শক্ত করে চাপড় মারে এরফানের পিঠে। সে মুখ চেপে ব্যথা প্রশমন করে বলে,

‘দেইখা নিমু হা*লা তোকে।’

স্কুল শেষে তিয়ানা রিক্সার জন্যে অপেক্ষা করছে। স্কুলের গেটের পাশ দিয়ে এরফান বাইক করে যাচ্ছিল। ইতিমধ্যে তিয়ানাকে দেখে থেমে যায়। সন্ধ্যা হতে চলেছে মেয়েটা এখনো বাসায় যায় নি। কোনো সাহায্যের প্রয়োজন নেই তো! নিজের মত ভেবে এরফান বাইক ঘুরিয়ে তিয়ানার সামনে আসে।
হঠাৎ হেলমেট পরিহিত এক যুবককে দেখে ভয়ে আত্মা কেঁপে উঠে তিয়ানার। চৌপাশে চোখ ঘুরিয়ে চিৎকার দেওয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিল। যদি কোনো অসভ্যতামি করে তাহলে হরতাল করে দেবে। হেলমেট মাথা থেকে খুলতেই তিয়ানার চোখজোড়া উজ্জ্বল হয়ে গেল। পলকও পড়ছে না। অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। এরফান মুচকি হেসে নিজের মাথার চুল নেড়ে বলে,

‘আই নো আইম চামিং। প্লিজ ক্লোজ ইউর মাউট। অন্যথায় মাছি ঢুকে যাবে।’

তিয়ানা লজ্জায় মুখ বন্ধ করে ফেলে। এরফান হালকা কেশে বলে,

‘নিড এনি হেল্প। আপনি অনেকক্ষণ যাবত অপেক্ষা করছেন দেখলাম।’

তিয়ানা খুশিতে ফটাফট মুখের বুলি শুরু করে দিল। এই আসবে,সেই হয়ছিল,ওই হয়ছিল। এরফান বিরক্ত হয়ে দিল এক ধমক। তিয়ানা চুপছে গেল। আমতা আমতা করে বলে,

‘স..সরি আসলে আমার বাসা নওরাপুরে। এই শহরে হোস্টেলে থাকি। স্কুলের বাস এখনো আসিনি। তাই অপেক্ষা করছিলাম।’

‘আর ইউ ম্যাড? এখন সন্ধ্যা হচ্ছে বাস চলে গিয়েছে সেই দুপুরে।’

তিয়ানা চমকে তাকাল। চোখজোড়া কান্নার মত করে অসহায় কণ্ঠে বলে,

‘এবার আমার কি হবে?’

‘বাইকে বসো। ঠিকানা বলো পাঠিয়ে দিব।’

তিয়ানার ভরসা করতে ইচ্ছে হচ্ছে ছেলেটার উপর। দেখতে সিনিয়র,গুড লুকিং লাগে তবে চরিত্র খারাপ হবে না ধারণা করে নিল। ঠিকানা দিয়ে বসে পড়ে।

৭.

পুকুরপাড়ে বরশি নিয়ে বসে আছে ইফদিয়ার। তার মন চাচ্ছে না আজ টিউশনী পড়তে। এর অবশ্য কারণ আছে। কারণটা যে নাহেম স্যার। তিনি কলে বলেছিলেন আজ যেন সে শাড়ি পরে পড়তে বসে। কোনো স্যারের মুখে এমন কথা শুনে কার না খারাপ লাগবে। যেখানে স্যারটা শুধু তার টিউশনী স্যার বটে। মনে মনে যাবিয়াজকে ভেবে বলে,

‘পুরান পাগলের ভাত নাই নতুন পাগলের আমদানী।’

নতুন পাগলটা যে নাহেম স্যার কে উদ্দেশ্য করা বলে দিল। স্কুল থেকে গোসল সেরে লং ফ্রক পরেছে। পানিতে ফ্রকের নিচের অংশ ভিজে টুইটুম্বর। মাছ ধরার সময় সে বেখেয়ালি হয়ে পড়ে। নানান সংলাপ নিয়ে ভাবান্তর হয়। তার এই অসাবধানতার ফলে যে বিপদ ঘটতে চলেছে এর বিন্দুমাত্র ধারণা নেই ইফদিয়ার।

যাবিয়াজ ওষুধ কিনতে ফার্মেসীতে এলো। তার বাবার জ্বর এসেছে দুপুর থেকে। ন্যাপা এক্সট্রা কিনে বের হয়ে গাড়িতে বসবে। এর পূর্বেই মেয়েলী চিৎকার শুনে থেমে যায়। চোখযুগল বিপরীত মোড়ে ঘুরিয়ে দেখে অবাক হয়ে গেল। নিজেকে দমে রাখতে না পেরে ছুটে যায়।
#অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০৪

পায়ের মধ্যে দড়ির ন্যায় কিছু পেঁচিয়ে যাওয়ায় পানির মধ্যে তুলিয়ে যেতে লাগে ইফদিয়ার। মুখের মধ্যে পানি ডুকেছে। যার ফলে কাশি দিয়ে অতীব কষ্টে চেঁচাচ্ছে। কিন্তু চৌপাশে হর্ন বাজনার ফলে তার চেঁচানো কারো কানে পৌঁছাচ্ছে না। পুকুরপাড়টা তাদের বাসা থেকে খানিক দূরত্বে অবস্থিত। যার ফলে বাসার কেউ জানে না ইফদিয়ার যে এখানে। সে কষ্ট করে নিজের হাত বরশির মধ্যে পেঁচিয়ে টান দিল। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। বরশির দড়িটা যে লোহার উপর পেঁচানো ছিল। সেটা ঢিলে হয়ে খুলে পড়ে যায়। যার কারণে ইফদিয়ার পুনরায় তলিয়ে যেতে লাগে।
পুকুরপাড়টা বেশ চওড়া আর গভীরতম। যার ফলে কোনো কিছুর সঙ্গে আঁটকে গেলে। সেটার অনুকরণে পানির গভীরতায় ডুবে যায় মানুষ।
ইফদিয়ার প্রাণের মধ্যে শীতল আভা ধরা বেঁধেছে। স্বয়ং আজরাইল বোধ হয় তার সন্নিকটে আসার আহ্বান দিচ্ছে। তবুও কেন যেন তার অক্ষিগোলকে তার মা আর যাবিয়াজের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে। হ্যা এরাই তো তার প্রিয় মানুষ।
এদের জন্যেই সে সব করছে। কিন্তু যাবিয়াজ! সে কি আদৌ তার প্রণয়ের অর্থ বুঝবে! বুঝবে কি প্রণয়ের দহনে পুড়ে ছাইখার হওয়া হৃদয়ের অনুভূতি। এই বিপদ সম্মুখীন মুহূর্তে লোকটার কথা ভীষণভাবে মনে নাড়া দিচ্ছে। বড্ড ভাবাচ্ছে তার কথা। লোকটি কি আসবে তাকে বাঁচাতে! নাকি শুধুই তার মনের ভ্রম রয়ে যাবে।
ধীরে ধীরে পানির নিচে ডুবে যায় ইফদিয়ার। গালের মধ্যে পানি প্রবেশ করছে ক্রমান্বয়ে।
চোখযুগল নিরবে নিশ্রান্ত হয়ে গেল। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অবশ হয়ে ডুবে যেতে লাগে।
লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)

৮.

মিসেস জাবিয়া রুমে বসে চুপটি করে পা টিপছেন আহসান সাহেবের। ডান হাতে ধারালো প্যান্টের বেল্ট ধরে বাঁ হাতে মদ গিলছেন। মেয়ের জমানো টাকায় মদ কিনে আয়াশে উড়াচ্ছেন। এই অমানুষকে কি কখনো বাবা বলে সায় দেওয়া যায়!
কখনো নয় যে মানুষ বাবা নামে কলঙ্গ সে বাবা নয় একজন অমানুষের প্রতিচ্ছবি। তবুও এই অমানুষের সঙ্গে চুপ করে সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন মিসেস জাবিয়া। এখনো স্বামীর রাগান্বিত হওয়ার ভয়ে পা টিপছেন। আহসান সাহেবের বেড রুমের বাহির থেকে ড্রয়িং রুমে মেঝে পরিষ্কার করছেন হালিমা। আড়চোখে কয়েকবার আহসান সাহেবের রুম পরখ করছেন তিনি। তাও উনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে। হালিমা বেগম বয়সে ত্রিশ বছরের বেশি হবেন। তাও শরীরে বেশ জোর আছে উনার। শক্তপোক্ত হাতের বাহু হওয়ায় সহজে কাজ করে হাঁপিয়ে উঠেন না। অথচ মিসেস জাবিয়ার বয়স কমবেশি ৩১ হবে। একটু কাজ করতেই হাঁপিয়ে উঠেন। উনার শরীর বেশ দূর্বল। মেয়ে থাকলে শরীরে সুস্থতা ভোগ করেন। কারণ মেয়ে তার ভালোই সেবা করে। অথচ যখন মেয়ে বাসায় থাকে না। তখন শুরু হয় স্বামীর অমানবিক অত্যাচার। যা মানসিকভাবে খুব কষ্ট দেন উনাকে। মেয়েকে শুনাতেও পারবেন না। কারণ এ নিয়ে কড়া নিষেধ আছে স্বামী আহসানের। তাই তো মুখ বুজে নিরবে অশ্রুসিক্ত করা ছাড়া উপায় নেই উনার। যদি নিজেকে যত্নে রাখতেন তাহলে তিনিও হতেন হালিমার মত।

আহসান মদের বোতল খেয়াল করলেন শেষ কয়েকটা বোতল। এবার যেন উনার মাথায় নেশা ধরেছে। অমানবিক চাহিদা পূরণের ন্যায় দাঁড়িয়ে যান। মিসেস জাবিয়ার বাহু চেপে ধরেন। এতটা শক্ত করে ধরায় বেশ ব্যথা অনুভব করছেন তিনি। আমতা আমতা কণ্ঠে বলেন,

‘কি কি খুঁজছেন আপনি?’

‘তোর সোনার হার এখনি বের করে দে।’

চমকে তাকান তিনি। আশ্চর্য না হয়ে পারছেন না। যে সোনার হারটা স্বয়ং আহসান সাহেবের মা মানে উনার শ্বাশুড়ি মা দিয়েছেন। সেই হারটা কিনা তিনি ছিনিয়ে নিতে চান। কষ্টক্লেশ জমিয়ে মিহি কণ্ঠে বলেন,

‘ঐ সো সোনার হার দিয়ে কি কি করবেন?’

‘তোর কি শা*। তুই হারটা দে।’

‘ও ওইটা আম্মার।’

‘আম্মা মরছে বহুত আগে। তুই দে।’

‘না আপনি আগে বলুন কি করবেন!’

আহসান সাহেব অকথ্য ভাষায় গালি দিয়ে মিসেস জাবিয়াকে ধাক্কা দিলেন। অপ্রতিকূল ঘটনায় তিনি বিছানার ছিপায় কপালে আঘাত পেলেন। কপাল চেপে নিভু চোখে পরখ করলেন স্বামীর দিকে। আহসান আলমারী খুলে কাপড়চোপড় উজার করে ফেললেন। শেষমেষ আলমারীর ড্রয়ারে পেলেন সোনার হারটা। সেটা নিয়ে পৈশাচিক হাসি দিয়ে বেরিয়ে গেলেন বাসা থেকে। মিসেস জাবিয়া কষ্টে উঠে দাঁড়ালেন। উনার মন চাচ্ছে ছুটে যেতে স্বামীর যাওয়ার পথে। কিন্তু চোখে অন্ধকার নেমে আসছে। কপালে ক্ষত পাওয়ায় অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
হালিমা উচ্চ শব্দ শুনে রান্নাঘর হতে উঁকি দিলেন। তখন মালিককে বের হতে দেখে তিনি তড়িঘড়ি রুমে যান। কিছুক্ষণ আগেই তিনি ড্রয়িং রুম পরিষ্কার করে রান্নাঘরে গিয়ে ছিলেন।
এই কিছুক্ষণটায় বড় কিছু ঘটে যাবে বলে ভাবেননি তিনি।
রুমে এসে মালকিনকে ক্ষতপূর্ণ দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। আহত দৃষ্টি নিয়ে মালকিনের পাশে বসে ডাক দিলেন। কিন্তু চোখ না খুলায় বুঝতে পারলেন মালকিন অজ্ঞান হয়েছেন। সাবধানে মিসেস জাবিয়াকে বিছানায় শুয়িয়ে দিলেন। ঘরোয়া পদ্ধতিতে কপালের কেটে যাওয়া অংশ কাপড় দ্বারা বেঁধে দিলেন। অপেক্ষা করতে লাগলেন ইফদিয়ার মামুনির।

মাটির উপর শুয়ে আছে ইফদিয়ার। মুখ থেকে অনর্গল পানি বের করছে। বেশ পানি জমেছে রমণীর পেটে। পেটের উপর স্থীরভাবে হাত রেখে ক্রমান্বয়ে চাপ দিচ্ছে যাবিয়াজ। পরণের শার্ট প্যান্ট ভিজে একাকার। রমণীর শরীর প্রায় শীতল হয়ে পড়েছে। হাতজোড়া অবশ আর ঠান্ডা হয়ে আছে। যাবিয়াজের বুকটা অমার্জিতভাবে ধড়ফড় করছে। কোনো কিছু হারানোর আশঙ্কা মনে জেগেছে তার। চোখজোড়া রক্তিম লাল আভায় পরিণত হয়েছে। মুখ থেকে শুধু ‘প্লিজ প্লিজ’ শব্দটি বের হচ্ছে। ইফদিয়ার জ্ঞানশূন্যতায় যাবিয়াজের বুক শূন্যতা অনুভব করাচ্ছে। রমণীর হাতে গরম ভাব দিচ্ছে নিজের হাত দিয়ে চাপ দিয়ে।
মাটির উপর যাবিয়াজ নিজের ফোন রেখে পুকুরে ডুব দিয়ে ছিল। সেটি নিয়ে এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে।

‘কুইক কাম হেয়ার। আই উইল গিভ ইউ অনলি ফাইভ মিনিট।’

যাবিয়াজ এর কথায় ঘাবড়ে এম্বুলেন্স নিয়ে বের হলো নার্সগণ। রমণীকে নিজের কোর্ট পরিয়ে দিল। কোলে তুলে রাস্তার মোড়ে নিয়ে আছে। সেখানে এম্বুলেন্স এসে হাজির হয়ে যায়। ডক্টর ভেতরেই বসে ছিলেন। পেশেন্ট আসায় চটজলদি যাবিয়াজ তাকে স্ক্যাচারে রাখে। ডক্টর একজন মহিলা ছিলেন। বিধায় তিনি যথাসম্ভব জ্ঞান ফিরিয়ে আনেন ইফদিয়ার। এম্বুলেন্স করে হসপিটালে নিয়ে যেত। কিন্তু যাবিয়াজ এর কথায় এম্বুলেন্সে প্রাথমিক চিকিৎসার ফলে জ্ঞান চলে এলো ইফদিয়ার। ডক্টর ঠান্ডা না লাগার জন্যে দুটো ওষুধ প্রেসক্রিপশন করে দিলেন।
যাবিয়াজ এম্বুলেন্সের বাহিরে পায়চারী করছিল। এম্বুলেন্সের দরজা খুলার পর দেখে ইফদিয়ার কাঁপছে শীতে। ঠান্ডার কারণে অতিরিক্ত ফর্সা রক্তপিশাচী নারী লাগছে রমণীকে। ডক্টর প্রেসক্রিপশনটি যাবিয়াজকে দিল। আর সংক্ষেপে বলেন,

‘ওয়াইফের খেয়াল রাখবেন।’

দুজনে চমকে গেল। ইফদিয়ার লাজুক নয়নে মিটিমিটি হাসছে। যাবিয়াজ চোয়াল শক্ত করে তাকায়। ডক্টর এম্বুলেন্সের ড্রাইভারকে গাড়ি ঘুরিয়ে হসপিটাল পথে যেতে বলে।

‘ইউ সাউট ইউর স্মাইল। আই কান্ট টলারেট।’

‘হু বললেই হলো। আজ দেখলাম তো কেমনে টলারেট করলে।’

‘এক্সকিউজ মি মিস যেমন ভাবছ তেমন নয়। মনুষ্যত্বের কাতিরে ডুব দিয়েছিলাম।’

‘ভাঙ্গবে তাও মুচকাবে না। জানি ফিলিং আমার জন্যে আছে। শুধু মুখ থেকে বের করা বাকি।’

মনের মাঝে কথাটি ভেবে আনমনে লাজুক হেসে উঠে ইফদিয়ার।

‘চলো।’

যাবিয়াজের ধমকির সুরে বলায় ইফদিয়ার হুশ ফিরে। সেও যাবিয়াজের অনুসরণ করে গাড়ির কাছে গেল। গাড়িতে উঠিয়ে নিলে যাবিয়াজ শান্ত কণ্ঠে বলে,

‘বাসার ঠিকানা দাও। গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে ফেলবে। নাও এগুলো ওষুধ।’

ইফদিয়ারকে বসিয়ে সে ফার্মেসী থেকে ওষুধ কিনে এনেছিল। রমণী মুচকি হেসে বলে,

‘জামাই হবার আগে থেকে কেয়ারিং শুরু করে দিলে নট ব্যাড।’

‘ইউ।’

বেশ রাগমিশ্রিত কণ্ঠে বলেও লাভ হলো না। ইফদিয়ার পূর্বের ন্যায় মিটমিটিয়ে হেসে যাচ্ছে।

বাসায় এসে দেখে হালিমা মায়ের পাশে বসে আছে। ইফদিয়ার ভয় হলো মায়ের কিছু হলো না তো। রুমে গিয়ে দেখে মায়ের কপালে ব্যান্ডেজ করা। হালিমা ইফদিয়ারকে দেখে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে,

‘মামুনি।’

‘কি হয়েছিল?’

হালিমা শুরু থেকে শেষ অব্দি কথাগুলো জানায়। শুনে যেন ক্রোধ হলো ভীষণ। ইফদিয়ার ফোন হাতে নিয়ে আহসান সাহেবের ফোনে কল দিলেন। রিং হচ্ছে তবে তিনি উঠাচ্ছেন না। পর পর তিনবার চেষ্টা করেও পাওয়া গেল না আহসান সাহেবকে। ইফদিয়ার হালিমাকে কড়া গলায় আদেশ দিল।

‘আজ ঘরের দরজা খুলবেন না। ভুলেও যেন ঘরের চৌকাঠে আহসান বুহিয়ানের ছায়ামূতি না দেখি।’

হালিমা খুশিমনে রাজি হয়ে গেলেন। তিনি রুম থেকে বেরিয়ে গেলে ইফদিয়ার ফ্রেশ হয়ে গরম পোশাক পরে মিসেস জাবিয়ার পাশে শুয়ে পড়ে।

যাবিয়াজ বাসায় এসে দেখে ড্রয়িং রুমে মেহমান ভর্তি। হঠাৎ এত মেহমান দেখে সন্দেহ জাগে তার মনে। বাবাকে একজন ছোটখাটো পোশাক পরিহিত রমণীর পাশে বসা দেখে সন্দেহ নিয়ে এগিয়ে গেল। রবিউল সাহেব ছেলের পায়ের শব্দ অনুভব করে মুচকি হাসেন। তিনি দাঁড়িয়ে যান। যাবিয়াজ কাছে গিয়ে রবিউল সাহেবকে জড়িয়ে ধরে বলে,

‘ড্যাড এসব কি? এত মানুষ কেনো বাসায়? আজ কি কোনো অনুষ্ঠান ছিল?’

রবিউল সাহেব মনের মধ্যে সংকোচবোধ করছেন। তিনি এখন যে বাক্য মুখের উপর আনবেন। সেটি শুনে ছেলে কেমন রিয়েক্ট করবে। তা চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে। তিনি ছেলেকে ধরে একটি ফাঁকা রুমের ভেতর এলেন। দরজা হালকা ভিজিয়ে ছেলেকে নিয়ে পরিপাটি বিছানার উপর বসেন। ছেলের হাত নিজের হাতে আবদ্ধ করে আদুরী কণ্ঠে বলেন,

‘বাবা আমি তোর বিয়ে ঠিক করেছি।’

চলবে…..
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here