অস্তিত্বে চাই তোমার ছোঁয়া পর্ব -০১+২

১.

‘তুই আমার বউ হবি রাইট! আয় তোর বউ হওয়ার শখ মিটিয়ে দেই।’

কলেজ থেকে আংশিক দূরত্বে বটগাছের পাশে ইফদিয়ারকে বালির উপর ছুঁড়ে মারে ছেলেটি। তার থুতনী উচ্চ করে ধরে রাগান্বিত গলায় বলে,

‘তোর তেজ ইদানিং বেড়ে যাচ্ছে। সারাদিন পিছে পড়িস কেন রে? তোকে আমার ভালো লাগে না, অসহ্য লাগে বুঝিস না। নেক্সট টাইম সামনে পড়বি কসম পর্চা ডোবার পানিতে চুবাবো। মাই ফাস্ট এন্ড লাস্ট ওয়ার্নি টু ইউ।’

থুতনীর উপর থেকে হাত সরিয়ে নিল। কলেজের গেটে চোখ রেখে দ্রতবেগে নিঃশ্বাস ছাড়ছে। দম আঁটকে সজোরে ধাক্কা দিল রমণীকে। পুনরায় পড়ে বালির উপর। যার ফলপ্রসু হাতের কনুই এ আঁচড় কাটে। ছলছল চোখে সুদর্শন ছেলেটির মুখপানে চেয়ে আকুতিভরা কণ্ঠে বলে,

‘যাবিয়াজ ভাইয়া কেনো তুমি আমায় ভালোবাসো না? প্রতিবার বেহায়ার মত তোমার কাছে এই দিনটিতে চলে আসি। তাও তুমি আমায় তাড়িয়ে দাও!’

যাবিয়াজ নামক ছেলেটি নিজের দৃষ্টিকটু তীক্ষ্ম করে বাঁকা দাঁতে হেসে বলে,

‘ইউ নো হোয়াইট! ইউ সাজ এ ননসেন্স গার্ল। তোকে কখনো পছন্দ করে ছিলাম বলে বলতে পারবি।’

ইফদিয়ার টনক নড়ে উঠে। মনজুড়ে বলা কথাটি খুঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু উত্তর শূন্য পাওয়া গেল। নজর নামিয়ে বালির দিকে দৃষ্টি রাখে। যাবিয়াজ নিজের ওষ্ঠের উপর দাঁত চেপে হাত মুঠো করে চেঁচিয়ে বলে,

‘গেট লস্ট ফর্ম হেয়ার। যদি থাকিস তাহলে ছেলেদের কোমর দেখিয়ে ঘুরিস।’

ইফদিয়ার বেহায়ার মত মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে থাকে যাবিয়াজ এর দিকে। কিন্তু ছেলেটি জাস্ট পাত্তাহীন ভাব নিয়ে নিজের পথে চলে গেল।
কলেজের ভেতরে ঢুকে পড়ে।
ইফদিয়ার ক্রোধান্বিত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। হাতের কনুই ঝাড়তে ঝাড়তে এগিয়ে গেল। কিন্তু হাঁটার পথেও ঘটল আরেক বিপদ। শাড়ির কুচিজোড়া আলগা হয়ে যায়।
লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
পড়ে যায় ভীষণ লজ্জায়। বাঁ কাঁধে কলেজ ব্যাগ শক্তভাবে ঝুলিয়ে রেখে। ডান হাতে কুচিজোড়া চেপে হলরুমের দিকে হাঁটা শুরু করে।
হলরুমে এসে দরজা আঁটকে দিল। শাড়ির কুচিগুলো সেফটিপিন দিয়ে শুদ্ধভাবে বেঁধে নিল। আয়নার মধ্যে তার প্রতিবিম্বে অসহায়ত্ব ভাব ফুটে উঠেছে। এই অসহায়ত্বের মূল কারণটি হলো যাবিয়াজ মেশরাফ।

কিছুক্ষণ আগের কথা……

আজ স্কুল এন্ড কলেজ কেন্দ্রে প্রকৌশলী কেন্দ্র হতে ভার্সিটির স্টুডেন্টস ভিজিটে এসেছে। অনুষ্ঠান উপলক্ষে মূলত তাদের আসা। যাবিয়াজ কলেজে যেতে চাই নি। কিন্তু সিনিয়র আর স্টুডেন্টস লিডার হওয়ায় ভদ্রতার কাতিরে গেল। ইফদিয়ার তার অপেক্ষায় গেটে দাঁড়িয়ে ছিল। যখন ভিজিটর্স এল আগমন শুরু হলো। নিজেকে আড়াল করে ফেলে সে। সবাই ভেতরে চলে যায়। পরন্তু যাবিয়াজ ফোন টিপে এক মনে হেঁটে আসছিল। এর সুযোগ লুটে নিল ইফদিয়ার। চট করে যাবিয়াজ এর গলা আঁকড়ে ধরে লাজুক কণ্ঠে বলে,

‘যায়াজ সোনা বউ বানাও না।’

যাবিয়াজ শুনে মুখ তুলে তাকায়। সেই বেহায়া মেয়েকে দেখে বজ্রপাতের ন্যায় রাগ ঝাড়ে।

যাবিয়াজ মেশরাফ হলো প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিভাগের ছাত্র। দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষ হয়েছে কিছুদিন হলো। ২১ বছর বয়সী যুবক। ঈষৎ হলদেটে গড়নে আলতো সাদা রঙ মিশ্রিত, ঘন নীলাটে রঙের চোখের মণি, বোঁচা নাকের পাশে ছোট একটি ঘন কালো তিল স্থান পেয়েছে, স্পাইক করা চুল, তীক্ষ্ম ভ্রুযুগল দেখে বোঝা যায় রাগ নিয়ে থাকে সারাক্ষণ, বাঁকা হাসি ওষ্ঠজোড়ে বহমান। যার ফলে প্রিমোলার দাঁতের অংশভাগ দৃষ্টিনন্দন হয়। তার চালচলনে মেয়েদের অবস্থা কাহিল। কিন্তু তার স্বভাবে মেয়েরা বেশি কষ্ট পায়। যাবিয়াজ মেয়েদের ক্রাশ নামে এক প্রকার বাঁশ। সে বাঁশ দিতে পছন্দ করে। যদি মেয়েরা স্বেচ্ছায় কিছু করতে আসে। ব্যস মহাভারত অতিষ্ঠ করে ফেলবে। গম্ভীর, বদরাগী হওয়ায় মেয়েরা ভয়ে মিশে না। সে শুধু নিজের বন্ধুমহলের সঙ্গে হাসিতে মেঁতে থাকে।

ছেলেটির ভাবনায় ডুবে থাকায় বান্ধবীকে খেয়াল করে নি ইফদিয়ার। স্বয়ং তিয়ানা এসে জাপ্টে ধরে। তার জাপ্টে ধরার বদ অভ্যাসটা কখনো পরিবর্তন হবার নয়। এমনে জাপ্টে ধরায় ইফদিয়ার ভয়ে চিৎকার দিল। তিয়ানা ভ্রু কুঁচকে বিরক্তিসূচক কণ্ঠে বলে,

‘দোস্ত তোর ভাবা ছাড়া আর কোনো কাজ নাই। যখন তখন ভাবতে থাকিস কেন। কলেজের বার্ষিক জয়প্রতা অনুষ্ঠান শেষের পথে আর তুই এখানে হা করে ভাবতেই আছিস।’

ইফদিয়ার গাল ফুলিয়ে তিয়ানার হাত খিঁচে ধরে অভিমানী কণ্ঠে বলে,

‘আমি হা করে ভাবি তো তুই গু খাইয়া ভাবিস।’

‘ইয়ে লো আমি কি করলাম! এজন্য সবাই বলে, মানুষের ভালো করতে নেই, পরবর্তীতে খোঁটা নিজেকে খাইতে হয়।’

তিয়ানার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি ফেলায় সে বেচারী হকচক খেয়ে গেল। ইফদিয়ার হাত ধরে বাচ্চামো চেহারায় বলে,

‘সরি এবার চল মহারাণী না হলে আমাদের লাভার বাবু তোর লাভে অজ্ঞান হবে।’

‘ধ্যাঁত কিসের লাভার ঐ টাকলু বেটা আমার কিছু লাগে না যতসব।’

তিয়ানা হু হু করে হেসে ইফদিয়ার সঙ্গে অনুষ্ঠানে প্রবেশ করে। তারা মঞ্চের সামনে বসেছে। এখানে সবার বসার সিট বরাদ্দ করে রাখা হয়েছে। বিধায় তিয়ানা আর ইফদিয়ার সিট একে অপরের সঙ্গে পড়েছে।
তিয়ানা মজা নেওয়ার পাশাপাশি তাকিয়ে দেখে একটি ক্যাফ খুলা আছে। সেখানে খাবারের যাবতীয় জিনিস আয়োজন করে রাখা হয়েছে। ইফদিয়ার কে অপেক্ষা করতে বলে সেখানে গেল।

মঞ্চের খানিক সামনের দিকে দৃষ্টি দিল। তৎক্ষণাৎ চোখাচোখি হলো যাবিয়াজ এর সঙ্গে ইফদিয়ার। অসহায়ের মত লজ্জায় মাথা নত করে ফেলে। যা দেখে যাবিয়াজ বিরক্তিতে মনে ‘ব’ উচ্চারণ করে। মঞ্চে শুরু হয়েছে আঞ্চলিক নাটক।
দুজন স্বামী-বউ নাটকের সাজ নিয়ে বেশভূষায় প্রকাশ করছে আঞ্চলিকতা।
ইফদিয়ার বেশ বোরিং ফিল করছিল। তার উপর তিয়ানা কে না দেখে রাগে ভ্রু কুঁচকে এলো। বিরক্তির ন্যায় উঠে পড়ে।
বিড়বিড় করে তিয়ানাকে অকথ্য ভাষায় গালি দিয়ে বলে,

‘তিয়ুর ঘরে তিয়ানী যাবি তুই কিনতে, আসতে লাগাবি একবছর। একবার হাতে পায় এমন কেলানি দিবো। জীবনে কেনার তৃষ্ণা মিটিয়ে দেবো। বজ্জাত মহিলা।’

তিয়ানাকে ক্যাফে একটা ছেলের সঙ্গে ফটরফটর করতে দেখে রেগে গেল। তিয়ানা হেসে হেসে যখন পরখ করে ইফদিয়ার কে। তখন ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে ছেলেটাকে বলে,

‘আ…বাবু তুমি এখন যাও। রাতে কল দেবো। ঘূর্ণিঝড় আসতেছে।’

ছেলেটি বেক্কলের ন্যায় মুখ করে বলে,

‘ঘূর্ণিঝড় ভার্সিটির মধ্যে কেমনে আসবে?’

‘আরে ভাই ভাগ তো। নাহলে আমার সঙ্গে তুইও মরবি রে গাধা।’

ছেলেটি অবুঝের মত চেহারা করে চলে গেল। ইফদিয়ার হেসে বুকের উপর হাত গুঁজে সরু দৃষ্টি নিয়ে বলে,

‘তোর কি ফ্লাটিং করার শখ কখনো মিটবে না?’

‘দেখ দোস্ত এখন বয়সটাই ফ্লাটিং, সিটি বাজানোর, প্রেম করার। সেখানে তোর মত হ্যাবলা হলে আর জামাই বানানো লাগবে না।’

ইফদিয়ার দ্বিগুণ রেগে বলে,

‘তোর ফ্লাটিং এর চৌদ্দ গুষ্ঠি কিলাই। মানছি আমি ভদ্র মেয়ে। তাই বলে অপমান শুনাবি।’

‘শোকরিয়া আদায় কর আল্লাহর। যে শুধু শুনাচ্ছি দেখাচ্ছি না বলে মেহেরবাণী জানা বোন।’

‘তবে রে হারামজাদী।’

ইফদিয়ার তিয়ানাকে ক্যাফের বাহিরে গিয়ে ছুটাছুটি করতে থাকে। পাঁচতলার ছাদ থেকে খুব সূক্ষ্ম আবেগে চেয়ে আছে যাবিয়াজ। রমণীকে তার মনমাঝাড়ে দারুণ লাগে। কাছে আসতে লাগে বিরক্ত। এর বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তি কি হতে পারে কে জানে?
হয়ত কোনো পীড়ন দেওয়ালের মত চলে আসে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছাদের দেওয়ালে হেলান দিল।

২.

স্ত্রীর উপর তেঁতো মনভাব নিয়ে চড় লাগিয়ে দিল জনাব আহসান। মিসেস জাবিয়া খাতুন চোখ নামিয়ে চোখের জল ছেড়ে দিলেন। কিন্তু ভাবান্তর হলো না আহসানের মুখমন্ডলে। বিরক্তির কণ্ঠে বলে উঠেন।

‘ইউ আর মাই ওয়াইফ। তোর উচিৎ ছিল মদের বোতলগুলো রেখে দেওয়া। তুই শা*লী কু*ত্তী মহিলা কি করলি? সোজা নালার পানিতে ফেলে দিলি। তোর হাতে বাধেঁ নাই ব্যাপারটা?’

আহসান বলে মিসেস জাবিয়ার চুল টেনে ঝাড়ি দিতে লাগেন। কিন্তু পরক্ষণে দরজার বাহির থেকে টমটম এর ‘পিপ পিপ’ শব্দে সেরে দিলেন।
সোজা সোফায় গিয়ে বসে পড়েন। পত্রিকার হাতে নিয়ে সাধু সেজে অভিনয় শুরু করলেন। মিসেস জাবিয়া তখনো ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। এতে চোখ রাঙিয়ে তাকালেন আহসান। মিসেস জাবিয়া ভীতি মনে রান্নাঘরে চলে গেলেন। মেয়ে বাসায় প্রবেশ করার আগে মুখমন্ডল পরিষ্কার করে নিলেন।
রান্নাঘরে কাজের বুয়া হালিমা ওষ্ঠ চেপে নিজের মালকিনকে বলে,

‘জাবিয়া আফা হান্না থামান। মাইয়া দেহিলে বড় সাহেব আরো মারিবো।’

জাবিয়া চুপটি করে শুনে বলে,

‘মেয়ে আছে বলেই তো আমার অস্তিত্ব আছে। না হলে সেই কবে কাফন জড়িয়ে নিতাম।’

‘আফা এমন কইবেন না। দেখবেন একদিন সব ঠিক হইব।’

জাবিয়া উত্তরে তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। এই ‘একদিন’ আসতে আসতে যদি মরণ হয়ে যায়। দরজা ঠেলে হাসিমুখে ভেতরে প্রবেশ করে তাদের মেয়ে। আহসান শয়তানি হেসে মেয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। ইফদিয়ার বাবাকে দেখে মুখটা কাঙ্কালের ন্যায় করে নিল। হাসিটা যেন উবে গেল।
‘বাবা’ নামক মানুষটাকে সে ঘৃণার চোখে দেখে। আহসান হাসি বজায় রেখে বলেন,

‘মা আমার টাকা এনেছিস?’

ইফদিয়ার ক্রোধ বেড়ে যায়। ব্যাগ থেকে এক হাজার টাকা বের করে হাতে ধরিয়ে রুমে চলে গেল। আহসান টাকা নিয়ে সোজা বেরিয়ে পড়েন। এখন মদ কিনে গিলার পরই বাসায় ফিরবেন। ইফদিয়ার কান্না চেপে মেঝের উপর বসে পড়ে।
তার জীবনটা স্বাভাবিক নয়। নরক লাগে এই বাসায়। টিনের ছাদের নিচে পরিবার হয়ে থাকলেও ভেতরে নিযার্তন ছাড়া কিছু পায় না।

আহসান বুহিয়ান আর জাবিয়া খাতুন এর মেয়ে ইফদিয়ার বুহিয়ান। এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী । বয়স ১৬ হয়েছে। দুধে আলতা গায়ের রঙ, ঘন কালো রঙের চোখের মণি, উষ্ণ রেশমি চুল, মুচকি হাসি দিলে প্রাণবন্ত রুপসী মনে হয়, ভ্রুযুগলে তৃপ্ততা ফুটে উঠে। মেয়ের চঞ্চলতায় প্রতিবেশীরা বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু প্রতিবার নাকচ করে দেয় ইফদিয়ার। সে চাই প্রতিষ্ঠিত হতে। স্বপ্ন একটাই একজন সফল ডাক্তার হওয়া। তার মাকে এই নরক থেকে বের করে সুন্দর বাড়ি আর জীবন করে দেওয়াই যেন মূল লক্ষ্য। এর পরিবর্তে তার মনের কোণায় সুপ্ত অনুভূতি সবসময় টান হয়ে উঠে। সেটি হলো জীবনসঙ্গী হিসেবে যাবিয়াজ কে পাওয়া। সে জানে না আদৌ পাওয়া সম্ভব কিনা। তবুও তার প্রার্থনার ইতি নেই।

ইফদিয়ার ব্যাগটা সরিয়ে কাবার্ড থেকে একটি বক্স বের করে। বক্সটি খুলে সেখানে রাখা লকেটটি হাতে নিল। বুকের মাঝে চেপে ধরে কান্নামিশ্রিত গলায় বলে,

‘আই লাভ ইউ যায়াজ। আই রিয়েলী লাভ ইউ। আপনাকে পেতে যদি সাগরে ডুব দিতে হয়। তাহলে সেটাও দেবো। একনিষ্ঠতায় তুমি প্রিয়।’

ইফদিয়ার লকেটটা সযত্নে রেখে দিল কাবার্ডে। আকাশী রঙের থ্রি-পিচ বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। কিছুক্ষণ পরে তার টিউশনের স্যার আসবে।

দরজায় কটকট শব্দে ইফদিয়ার তোয়াল মাথায় পেঁচিয়ে কাপর ঠিক করে খুলে দিল। নিজের মাকে হরমড়িয়ে ঢুকতে দেখে খানিক চমকে উঠে। মায়ের গালে ফোলা ভাব দেখে বুঝতে বাকি রইল না যে ফোলা ভাবটা চড়ের কারণে। মাকে টেনে বসিয়ে ব্যথানাশক মলম বের করে। গালে যত্ন করে লাগিয়ে দিয়ে অনুরোধক কণ্ঠে বলে,

‘আম্মা কাল থেকে প্লিজ তুমি আব্বার মদের বোতল ফেলে দিও না। প্রতিবার ফেলে চড় খাওয়াটা কি খুব জরুরি। দেখো না ঐ নিষ্ঠুর আব্বা তোমাকে তব্দা বানিয়ে দেয়।’

মিসেস জাবিয়া ম্লান হেসে বলেন,

‘তোর আব্বারে ছাড় দিলে তো মৃত্যু ডেকে আনবে নিজের। তখন সংসারটা থেমে যাবে। তোর পড়াশুনা থেমে কাঙ্কাল হতে হবে।’

ইফদিয়ার কপাট রেগে কিছু বলে না। কারণ সত্য তার মায়ের কথাটা। কিন্তু তার অপছন্দ বিষয় হলো আহসানের মদ গিলাটা।
‘কুহ কুহ’ কাশির শব্দে চোখ গেল দরজায়। টিউশনী স্যার চলে এসেছেন। হাতে উচ্চতর গণিত আর ইংলিশ বই চেপে ধরেছেন। মিসেস জাবিয়াকে দেখে সৌজন্যমূলক কণ্ঠে সালাম দিলেন। মিসেস জাবিয়া পড়ার জন্যে বসতে বলে চলে গেলেন নাস্তার আয়োজন করতে। ইফদিয়ার সংকোচে মাথায় তাড়াতাড়ি ঘোমটা টেনে নিল। টিউশনী স্যারের হরবড়িয়ে রুমে প্রবেশ করাটা সে মুটেও সহ্য করে না। তবুও আহসান সাহেবের পূর্বপরিচিত হলেন জনাব নাহেম উল্লাহ স্যার। মানে তার টিউশন স্যার।
দাঁত কেলিয়ে হেসে তিনি ইফদিয়াকে বলেন,

‘আরে ইফু এমনে ঘোমটা টেনে নিজেকে ঢেকে রাখো কেনো? দেখতে একদম বুড়ি লাগে। এখন যেভাবে উড়না হালকাভাবে গায়ে পেঁচিয়ে ছিলে সেভাবে রাখবে। রাখলে ফকাফক সুন্দ্রী লাগে।’

স্যারের লাগামহীন কথাগুলি ইফদিয়ার মনে ভীতির সাথে ঘৃণা তৈরি করছে। উনার মুখের মধ্যে পারলে তো এস্টাপ্লার করে দিতো সে। মনের ইচ্ছা দমে রেখে পড়তে বসে।
#অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০২

‘তোমার কানের দুলটা আমার খুব পছন্দের।’

হঠাৎ বলে নাহেম স্পর্শ করে ইফদিয়ার কানে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যায় সে। শরীরে ঘৃণ্য পুরুষের স্পর্শ পাওয়ায় নজর সরিয়ে নিল। নাহেম বোকার মত চেহারা বসতে ইশারা করলেন। বাধ্য মেয়ের মত বসে পড়ে ইফদিয়ার। এ ছাড়া তার উপায় নেই। টিউশনীর জন্যে অন্য স্যার রাখতে বললেও মানবে না তার বাবা আহসান সাহেব। নাহেম খুব দৃঢ়স্থ কণ্ঠে পড়া বুঝাচ্ছেন। পড়া বুঝানো শেষ হলে তিনি ঘোরলাগা দৃষ্টিতে পরখ করেন ইফদিয়ারকে।
ইংরেজি খাতায় প্রশ্নের উত্তর লিখছে সে। হাতের লেখা অপরিচ্ছন্ন হচ্ছে। কারণ তার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় জানান দিচ্ছে, এই স্যার তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
কাঁপা হাতে লিখে যাচ্ছে। লেখার গতি কমাচ্ছে না।

মিসেস জাবিয়া হালিমাকে ট্রের মধ্যে জুস, চা আর বিস্কুট সাজিয়ে দিতে বলে। মালকিনের আদেশ মত সে সাজিয়ে দিল।
নাস্তা নিয়ে যেই রুমে প্রবেশ করলেন তখনই নাহেম উল্লাহ কে হকচক খেতে দেখলেন।
নাহেমের এহেন কান্ডে সন্দেহ জাগে মিসেস জাবিয়ার মনে। তবুও পাত্তা না দিয়ে নাস্তা দেখিয়ে টেবিলে রাখলেন। নাহেম নিজেকে স্বাভাবিক করে পড়া চালিয়ে গেলেন। মিসেস জাবিয়া কে দেখে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলেন,

‘আন্টি এগুলো করার কোনো প্রয়োজন ছিল না।’

‘তা কেমনে বাবা তুমি খালি পেটে এসেছো শুনেছি। তাই না দিয়ে পারলাম না।’

‘ওই তেমন কিছু না। আপনাকে মা মনে হয় ভুল বলছেন।’

‘না আমি তোমার মা থেকে জানি নি। জেনেছি তোমার আঙ্কেল থেকে। তোমার খুব প্রশংসা করেন তিনি। খুব ভালো পড়াতে পারো দেখে মেয়ের জন্যে রেখেছেন।’

বিনিময়ে নাহেম লাজুক হাসি দিল। অন্যথায় ইফদিয়ার মন বিরক্তিতে ফুলে উঠে। মিসেস জাবিয়া কুটিনাটি কথা সেরে চলে গেলেন। এরই মাঝে চটজলদি নিজের খাতা এগিয়ে দিল ইফদিয়ার। নাহেম দেখে কোনো ভুলত্রুটি নেই। এতে তিনি খানিক ইতস্তত বোধ করেন। কারণ উনার এই মুহুর্তে বাসায় যেতে মন চাচ্ছে না। মেয়েটার সঙ্গে উম্মাদনায় ব্যস্ত হতে চাচ্ছে। তবে এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে ইফদিয়ার। সে দাঁত কেলিয়ে বলে,

‘স্যার আজ আপনার ছুটি ওকে বাই।’

কারো পরোয়া না করে ব্যাগ নিয়ে ছুটে পালায়। নাহেম রেগে জোরালো ভাবে টেবিলে বারি দিলেন। দম আঁটকে শ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। বাসার পথে রওনা দিলেন। ইফদিয়ার তার পুকুরপাড়ে এসে বসে পড়ে। কান্না পাচ্ছে তার। উচ্চ গলায় চিৎকার করে গালি দিতে মন চাচ্ছে নাহেম নামক ঐ টিউশনী স্যারকে। যে কিনা পূর্ব পরিচিত হওয়ায় স্পর্শ করার স্পর্ধা দেখিয়েছেন।
পুকুরপাড়ের পানিগুলো খানিক লালচে-হলদেটে রঙের। নাক ছিটানো ভাব চলে আসে। সে সঙ্গে পচাঁ দুর্গন্ধও ভেসে আসছে পুকুরের মধ্য দিয়ে। চৌপাশে চোখ বুলিয়ে একটি টিউবওয়েল দৃষ্টি গেল। সেখানে গিয়ে টিউবওয়েল চেপে ধরে পানি নিয়ে দু’তিন বার কান পরিষ্কার করে। কানের যে অংশে স্পর্শ করেছিল নাহেম। সে অংশ পরিষ্কার করে করে লাল করে ফেলে।

চোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রুসিক্ত হচ্ছে। একটি ছোট বাচ্চা বেলুন আর চকলেট বিক্রি করছে। সে পুকুরপাড়ের পাশে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। কোনো কিছুর সঙ্গে পা লেগে যায় তার। হালকা আর্তনাদে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। ইফদিয়ার মায়া হলো। সে নিজের বুকে চাপা কষ্ট দমে নিয়ে এগিয়ে গেল। বাচ্চাটি কে পরখ করে দেখে ছেঁড়া একটি ফ্রক পরিহিত মেয়ে। যার বয়স কমবেশি ৭ বা ৮ হবে। উচ্চতায় ওতোটা লম্বা নয়। খাটো মেয়ে কালো বর্ণী শরীরের রঙ। ইফদিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত্বনা দিতে লাগে। নিজের ব্যাগ থেকে রুমাল আর কিছু টাকা বের করে মেয়েটিকে সহায়তা করে। মেয়েটি মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে।

‘এই আপু তোমার নাম কি?’

‘ইফদিয়ার।’

‘তুমি খুব কিউট ইদিপ্পি।’

প্রত্যত্তুরে চওড়া হাসি উপহার দিল ইফদিয়ার। মেয়েটি চলে যায় দৃষ্টির অগোচরে। মাথা ঘুরিয়ে যেই পিছে ফিরবে। হঠাৎ বড়জোড় দামড়ার মত কিছু একটার সঙ্গে ধাক্কা খায়। তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নিল। এর পূর্বে কোমর আকঁড়ে ধরে বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী এক যুবক। চোখ বন্ধ রেখে ইফদিয়ার বুঝার চেষ্টা করছে। কোনো ভাবে কোমর ভেঙ্গে গেল কিনা। কিন্তু চোখ খুলার পর এমন একজন কে দেখে নিদ্বিধায় মনে ভয় জড়ে বসে।

৩.

‘এগেইন ইউ কাম ইন মাই ওয়ে। ডু ইউ এভার ফরগেট হোয়াইট আই সে ইন দ্যা মনিং?’

যাবিয়াজ ভাইয়ের কথায় ভেজি বিড়াল বনে গেল ইফদিয়ার। তবুও কোথায় যেন সাহস জোড়ো হলো তার। কেননা পুকুরপাড়টা রাস্তার পাশেই। যেহেতু তারা রাস্তার আশপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেহেতু যাবিয়াজ ভাইয়া চাইলেও পারবেন না কোনো ভুল কিছু করতে।
এই কথা ভেবে বাঁকা হাসি দিল ইফদিয়ার। যাবিয়াজ চমকে গেল হাসিটা দেখে। সরু চোখে ঘাড় ঝুঁকিয়ে কাছে এলো ইফদিয়ার। এতে শক্ত করে কাপড় চেপে ধরে সে। এই লোকটার হুটহাট কাছে আসাটা ভীষণ অস্বস্তি দেয়। যাবিয়াজ কণ্ঠটা তীক্ষ্ম করে সন্দেহের ন্যায় করে বলে,

‘কি চলছে রে তোর মাথায়? এমনে বাঁকা হাসি দেখালি কেন?’

‘চুমু খাবো বলে।’

‘হোয়াইট?’

যাবিয়াজ তৎক্ষণাৎ সটান হয়ে গেল। এই মেয়েটার উপর বিশ্বাস নেই। যখন তখন অসভ্যতামি করে ফেলতে পারে। তাও আবার পাবলিক প্লেস হওয়ায় কোনো প্রকার রাগ দেখাতে পারছে না। মেয়েটার সঙ্গে সহজে পেড়েও উঠে না। নিজের কাজের কথা ভেবে পা ফিরিয়ে নিল। সোজা পথে হাঁটা ধরে। যা দেখে ইফদিয়ার তার সামনে এসে কোমরে হাত রেখে অভিমানী নজরে তাকায়। এই নজরটা যেন যাবিয়াজের মন আর হৃদপিন্ডকে ঘায়েল করার জন্যে যথেষ্ঠ। মেয়েটার অভিমানী রুপ দেখলে হৃদপিন্ড লাফাতে শুরু করে। মন চাই সেই অভিমানী গালে ওষ্ঠ মিলিয়ে দিতে। নিজের মনের কথা ভেবে নিজেই বোকা বনে গেল। এক রাশ গালি মন আর মস্তিষ্কের মাঝে আদান প্রদান করে হালকা ধমকের সুরে বলে,

‘ভেবো না রাস্তা দেখে ছাড় দিয়েছি। একা পেলে সত্যি পর্চা নর্দমায় ডুবাবো। মাইন্ড ইট!’

ইফদিয়ার কানে নেই নি কথাটা। ফট করে যাবিয়াজের গালে গভীররাঙা চুম্বন দিয়ে ভৌ-দৌড় দিল। যাবিয়াজ স্তদ্ধ হয়ে যায়। তার শরীরের লোমহর্ষক হয়ে উঠে। কোন মেয়ের এতোটা সাহস হয় নি আজ অব্দি। সেখানে এই মেয়ের সাহস দেখে অবাক না হয়ে পারছে না। যে গালে চুম্বন পেল সেই গাল মুছতে চেয়েও মুছে না। কাজের ব্যাপারে ভেবে যথারীতি প্রস্থান করে।

৪.

ইফদিয়ার বাসার দরজায় হাত রেখে হাঁপাচ্ছে। এই মুহূর্তে জান যাওয়ার মত অবস্থা। নিজের বুকের উপর হাত রেখে জোরে শ্বাস টেনে বিড়বিড় করে বলে,

‘আজ তো কামাল হো গেয়া,লাজ ভুলকার বেশারাম হো গেয়া।’

লজ্জায় নিজের মুখ ঢেকে হেসে দিল ইফদিয়ার। তার হাসির শব্দে খেয়াল হলো তার মা ভ্রু বাঁকিয়ে সরু দৃষ্টিতে পরখ করছেন। শুকনো এক ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলে,

‘আ…আম্মা আস…লে তিয়ু এসে ছিল। ওর সাথে খেলে আসছি।’

‘মগের মল্লুক পাইছিস। তুই বলবি আর আমি মেনে নিলাম। জানিস মেয়েরা কখন এতো লাফাই, মুচকি হাসে। যখন তারা প্রেমে জল খায়। তুই কার জল খাইলি?’

‘এ্যাঁ।’

‘এ্যাঁ না হ্যা বল কার লগে প্রেম করে বেড়াস।’

‘ও আম্মা এমন কিছু হইনি এখনো। আর তুমি কি গ্রাম্য ভাষা ইউজ করছো। একদম এমন করে বলবে না।’

‘ওহো কেন আমি বুঝি তোর বান্ধবীর মতন না।’

‘তুমি আমার প্রিয় আম্মা আর প্রিয় বান্ধবী ঠিক তিয়ানার মত।’

মিসেস জাবিয়াকে পিছন থেকে জড়িয়ে গালে চুম্বন দিয়ে আদুরী গলায় বলে ইফদিয়ার। তিনিও মৃদু হেসে মেয়ের মাথার ডান পাশে চুম্বন এঁকে দিলেন। তাকে ফ্রেশ হয়ে খেতে আসতে বললেন।
লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
ঘড়িতে রাত ১টা ছুঁই ছুঁই করে বেজে চলেছে।
বাসার প্রতিটা কোণায় পিনপন নিরবতা বিরাজমান। শুধু ঘুম নেই যাবিয়াজের চোখে। চোখ নিমীলিত করলেই ইফদিয়ার ওষ্ঠের মিলন দেখতে পায়। তৎক্ষণাৎ চট করে চোখ উম্মুক্ত করে ফেলে। বিছানায় শুয়া অবস্থায় এপাশ ওপাশ ফিরছে। যেন একধারে পায়চারী করছে। মনটা যেন উম্মাদের মত চাইছে কিছু। তবুও নিজের ভ্রম ভেবে পাত্তা দিল না।
ঘুমের রাজ্যে যেতে না পেরে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। বেলকনিতে গিয়ে বসে। দূর আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। একদম উজ্জ্বলতায় চকচক করছে চাঁদটি। এই চাঁদের সাথে সাদৃশ্য পেয়েছে ‘ইফদিয়ার’ নামক মেয়েটির মুখশ্রী। চাঁদ যতটা নিষ্পাপ,পবিত্র আর অমায়িক লাগছে। ইফদিয়ার চাল-স্বভাব-হাসিতেও সেগুলো ফুটে উঠে। তবে মস্তিষ্ক এ কথা মানতে নারাজ।
হঠাৎ কিছু ভাঙ্গার শব্দে চমকে উঠে। দরজা খুলে বের হলো রুম থেকে।

৫.

ড্রয়িং রুমে এসে দেখে জনাব রবিউল মেশরাফ কিছু খুঁজছেন। বাবাকে এলোথেরাপি খুঁজতে দেখে ঘাবড়ে গেল। তড়িঘড়ি গিয়ে বাবাকে আকঁড়ে ধরে। রবিউল সাহেব ছেলের স্পর্শ পেয়ে উঠে দাঁড়ান। যাবিয়াজ খুব শক্ত কণ্ঠে বলে,

‘ড্যাড তুমি কোন জ্ঞানে ভাঙ্গা গ্লাস তুলার চেষ্টা করছিলে হুম? আজ যদি কোনো ভাবে কাঁচ তোমার শরীরে ঢুকে পড়তো? ভেবেছ কি হতে পারতো?’

রবিউল সাহেব ছেলের অভিমান বুঝে মৃদু হেসে বলেন,

‘বাবা এতো ভাবিস কেন। কাঁচ ভেঙ্গেছি সেই সাধে তুলার চেষ্টা করাটা কোনো অপরাধ নয়।’

‘হুম রাইট অপরাধ নয় বরং ঘোরতর অপরাধ।’

‘তোর মুন্ড রে বাবা। অন্ধ বুড়া বলে এমন করবি। আর এইগুলো সামান্য কাঁচ তুলতে গেলে কিছু হবে না আমার।’

রবিউল সাহেবের কথায় চোখ ভিজে এলো যাবিয়াজের। তৎক্ষণাৎ জড়িয়ে ধরে। চোখের পানি পড়তে দিল না। কিভাবে দেবে ছেলেরা তো কঠোর হৃদয়ের হয়ে থাকে। কান্না,অশ্রু,জল এই বিপরীত শব্দগুলি যেন তাদের চোখে বেমানান। রবিউল সাহেবের খেয়াল হলো কথার ছলে কি বলে ফেলেছেন! ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরী কণ্ঠে বলেন,

‘বাবা মাফ করিস। কখনো কখনো ভুল কথা বলে ফেলি। এর অর্থ তোকে কষ্ট দেওয়া নয়। বরং রাগ করে মুখ ফুসকে আসাটাকে বোঝায়। তোর প্রতিটা কথা সঠিক। যা আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু বাবা ইচ্ছে করে সবকিছু ছুঁয়ে বুঝতে পারার ক্ষমতা কেমন তা জানার।’

‘ড্যাড তুমি চিন্তে করো না। তোমার চোখের অপারেশন করাতে যত বড় বড় ফর্মালিটিস পূরণ করতে হয় করব আমি। তাও তোমার চোখের উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে আনব।’

রবিউল সাহেব প্রত্যত্তুরে ছেলের অগোচরে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলেন। যাবিয়াজ পানি গ্লাসে ঢেলে নিজের বাবাকে দিল। উনাকে সযত্নে রুমে ছেড়ে নিজের রুমে চলে আসে সে। রবিউল সাহেব ছেলের যাওয়ার শব্দ শুনে কাঁথা হাতড়িয়ে বুক বরাবর টেনে নিলেন। চোখ খুলা রইলেও যেন নেই কোনো রশ্নি সেই চোখ কোটরে। নিভে গিয়েছে সেই চোখের রশ্নি প্রায় তিনবছর আগে। পুরোনো কথা ভাবতেই উনার চোখের পাতা বেয়ে গড়িয়ে পড়ে স্বচ্ছ অশ্রু।
বাঁ হাতে চোখের কোণা মুছে ঘুমানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ঘুম হানা দেওয়ার আগে ফোনের তীব্র ভাইব্রেশনে নড়ে উঠলেন। বালিশের পাশে ফোন হাতড়িয়ে বের করে কানে ধরলেন। কল রিসিভ হতেই কারো প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পান।
আনমনে মৃদু হেসে জিজ্ঞাসা করেন।

‘কেমন আছেন?’

উত্তরে অপরপাশের জন কিছু বললেন না। ভাবলেশনহীন রয়ে যায়। রবিউল সাহেব হতাশায় কল কেটে দিলেন। এমন হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তিনি জানেন কলদাতা উনার গভীর সম্পর্কের কেউ। তাই প্রতিবার কলে তিনি জিজ্ঞাসা করেন। ফলাফল শূন্য পেলে কল রেখে দেন। পুনরায় কল আসে না। তবে রাতের এ সময়ে উক্ত ব্যক্তির কলের অপেক্ষায় থাকেন। হোক না কণ্ঠ শুনতে পেলেন না; তবে নিঃশ্বাসের শব্দটা তো শুনতে পেরেছেন। প্রাণটা স্বাচ্ছন্দ্যে ভরে যায় তখন।

বিছানায় গা হেলিয়ে ভাবনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে যাবিয়াজ। আনমনে ঠোঁটের কোণায় বিড়বিড় করে বলে,

‘কাল পরশু কনট্রাক্ট করতে হবে অস্ট্রেলিয়ায়। ডা. আজাদ আঙ্কেলের পরামর্শে ফর্মালিটিস পূর্ণ করে ড্যাডকে নিয়ে যেতে হবে। তার আগে অস্ট্রেলিয়ার কনডাক্টর থেকে নোটিশ রুলস কালেক্ট করতে হবে।’

পরেরদিন ভার্সিটিতে…

যাবিয়াজ সিটে বসে আছে। তার পাশে বন্ধুগণ মেতে আছে নানান সংলাপে। কিন্তু সে ব্যস্ত জীব প্রযুক্তির গবেষণায়। অথাৎ, (biogenetic) বায়োজেনেটিক প্রকৌশল নিয়ে কাজ করছে। অবশ্যই সে প্রকৌশল আর প্রযুক্তি বিষয়ক টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ছে। তবুও বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়টিকে দৃঢ়ভাবে প্রদর্শন করতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি নিয়েও চর্চা করছে।
বন্ধুদের মধ্যে যাবিয়াজের বান্ধবী শ্রেয়িতা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘দোস্ত নিরামিষের রসিকতা কবে জম্মাবে রে? এখনো দেখ কেমনে বই নিয়ে পড়ে আছে।’

‘দোস্ত হেই বলদ বিদ্যাসাগরের বলদ।’

যাবিয়াজ বিনা বাক্যে শুধু গম্ভীর দৃষ্টি ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে তার দ্বিতীয় বন্ধু ফেরদৌস ঠাট্টার সুরে বলে,

‘কি মিয়া রসিকতা খাওয়াবেন এমন লুক দিতাচ্ছেন কেন?’

‘শা*লা মশকারী করস! আয় তোকে রসিকতার মুলার রস খাওয়ায় হারা*মীর দল।’

‘ছিঃ ছিঃ আমি গে নয় বুঝলি।’

‘কারেক্ট তুই গে কেন হবি তুই যে গন্ডাল।’

হে হে করে সকলে হেসে উঠে। ফেরদৌস মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে নজর ফেলে এক জায়গায় তার চোখ আঁটকে যায়। শয়তানি হেসে বলে,

‘যাবু বাবুর এখনই রস কস মুরগীর মাংস খাওয়ার মুড চলে আসবে ঐ মাইয়ারে দেইখা।’

শ্রেয়িতা দোস্তের কথায় অনুসরণ করে দেখে সেও তাল মিলিয়ে বলে,

‘পুচকি ভাবি চলে এসেছে রে। দেখ দেখ কেমনে উঁকি মারতাছে যাবুরাজার উপর।’

যাবিয়াজের মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে না। যে সে খুশি নাকি বিরক্ত হলো। শান্ত নজরে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে তাকায়। তৎক্ষণাৎ পালিয়ে গেল ইফদিয়ার। এরফান যাবিয়াজের হিংসা হয় কিনা পরীক্ষা করতে বলে উঠে।

‘আই ওয়ান্ট টু লাভ হার।’

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here