আকাশী পর্ব ২২

“আকাশী”
পর্ব ২২.

মেঝেতে থালা-বাসন ছড়ানো। কিছু কিছু উলটে পড়ে আছে। ভেতরকার ঘরে বেহাল অবস্থা। আকাশী তড়িঘড়ি করে মায়ের ঘরে গিয়ে দেখল, তিনি বিছানার একপাশে গুঁজে বসে আছেন। আকাশী ঘাবড়ে গিয়ে তাঁর পাশে বসে পড়ে।
‘কী হয়েছে মা?’
রোকসানা নির্লিপ্ত ভাবে তার দিকে একবার তাকালেন। আকাশী তাঁর গলা-কপাল ছুঁয়ে দেখল। জ্বর আসেনি। সে কিছু বুঝতে না পেয়ে উঠতে গেলে তিনি বললেন,
‘কোনোখানে টাকা নেই।’
আকাশী হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। মাত্র দু’জন মানুষের জন্য আকাশীর টিউশানির টাকায় দিব্যি চলে যায়। তবে আজ মা এভাবে কথা কেন বলছেন। আকাশী চারিদিকে চেয়ে দেখল খাওয়ার মতো তেমন কিছু নেই। তার হাতের ব্যাগটা কাঁধেই রয়ে গেছে। নামিয়ে সে একটা চেইন খুলে দেড় হাজার টাকার দিকে চেয়ে থাকে, খুচরা টাকা দিয়ে সে জমিয়েছিল ভার্সিটিতে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। তার কাছে হঠাৎ ফারুকের কথা মনে পড়ে যায়। এইচএসসি পরীক্ষায় আকাশীর ভালো ফলাফলের খুশিতে সকলকে তিনি মিষ্টি খাইয়েছিলেন। এরপর একদিন তাঁর হাঁপানি তীব্রতর হয়। পরে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। একসময় একেবারের জন্যই শ্বাস নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এজন্য সে পরীক্ষার প্রস্তুতিও নিতে পারেনি। আজ যদি তিনি থাকতেন! হঠাৎই আকাশী হতাশায় পতিত হলো। এখন ওদিককার পরিস্থিতি সামলিয়ে এলে আরেক বিপত্তিকর পরিস্থিতিতে সে পড়েছে। আকাশী টাকাগুলো হাতের মুঠোয় চেপে মায়ের কাছে গিয়ে বলল, ‘টাকা কি একদমই নেই?’
‘আমি কি মিথ্যে বলছি? বিশ্বাস না হলে আলমারি খুলে দেখ।’
‘মা, এভাবে কেন বলছেন। আমি শুধু জিজ্ঞেস করেছি।’
‘কিছু কেনার মতো টাকা একদমই নেই। চালও ফুরিয়ে আসছে।’
‘মাস তো এখনও শেষ হয়নি। কোনোদিকে বেতন পাইনি।’
‘তা তো বলবিই।’
‘মা এতদিন তো আমরা চলতে পেরেছিলাম। আমার বেতন তো যথেষ্ট।’
‘বেতন? সামান্য বেতন দিয়ে স্রেফ পেটের ভরণ করতে পারলে তাও সারত। কিন্তু কিস্তি?’
কিস্তি? আকাশী বিড়বিড় করল। সে দিনের বেলায় বাসায় কমই থাকে। সকালে রান্না করে দিয়ে নিজেও টিফিন নিয়ে সে চলে যায়। সারাদিন এধারওধার ঘুরে-খেটে সে ফেরে। এরই মাঝে মায়ের কিস্তি দেওয়ার ব্যাপার তার না জানারই কথা। মাও তো কখনও বলেননি। মা তো তাকে কিছুই বলে না। হয়তো এতদিন ভালোভাবে কিস্তি দিতে পেরেছিলেন বিধায় আকাশীকে কিছু বলতে যাননি। আজ অভাব ঘাড়ে এসে চাপ দেওয়া অকপটে বলে দিচ্ছেন।
‘এতদিন ঘরখরচের পাশাপাশি কিস্তি কিভাবে সামলিয়েছেন? মামা টাকা দিতেন?’
‘তোর মামার অবস্থার কথা কি জানিয়ে দিতে হবে? নিজের টাকা নেই। তার ওপর মায়ের জন্য ওষুধ খরচা পাঠাতে হয়। আমাকে দেখার ফুরসত আছে?’
‘তাহলে?’
রোকসানা মিনমিন করে বললেন, ‘এতমাস কিস্তির টাকা ফারুক ভাইয়ের কাছ থেকে পেতাম। এখন তিনি তো চলে গেলেন।’ তিনি চোখ মুছলেন, ‘অনিকের মা’কে তুই তো চিনিস। কাউকে কিছু দেওয়া পছন্দ করে না। অনিকও তোর ফরম ফিল আপের টাকা দেওয়ার কথা তার কাছ থেকে লুকিয়েছে। এখন আমরা চলব কী করে?’
আকাশীর চোখে পানি এলো না। কেন যেন সে মাঝে মাঝে বর্তমানকে দেখতে পারে না। বর্তমানের দুঃখটা তাকে ছুঁতে পারছে না। একসময় বর্তমানটা অতীত হয়ে গেলেই তার মনে হয়, সে অনেকবড় একটা দুঃখের সাগর থেকে সাঁতার কেটে ওঠেছে। সে কখনও আগামীর জন্য কিছু ফেলে রাখে না। পরীক্ষা দেওয়ার টাকা আবারও না হয় জমাবে। কিন্তু হাতে চাপানো টাকাটা আজ মায়ের হাতে না দিলে মনে অনেক গ্লানি জমবে। আকাশী কাঁপা হাতে মা’কে টাকাগুলো দিয়ে দেয়, ‘ভার্সিটিতে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য টাকাগুলো খুচরা থেকে জমিয়েছিলাম।’
‘কি! তুই ভর্তি পরীক্ষা দিবি?’
‘কেন মা? ফারুক চাচা মারা যাওয়ার আগে তো বলেছিলাম।’
‘আমি না তোকে বলেছি, তোকে দিয়ে পড়ালেখা আর করাতে পারব না?’
‘মা, ভবিষ্যতের সম্বন্ধে তো আমরা কেউই জানি না। তাই না? বাবা মারা যাওয়ার কয়েক মাস পর থেকে আমরা দুরবস্থায় পড়েছি। তখন কি নিশ্চিত ছিলাম, আমরা এতদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকব? এতদিন পর্যন্ত চলতে পারব? আমি পরে টিউশনি করে কি ঘরখরচ চালাতে পারিনি?’
‘কিন্তু তুই এই খরচ ছাড়া ইন্টারে ভর্তিরও খরচ জোগাতে পারিসনি। এখন তো এরচেয়ে ডাবল খরচ হবে।’
‘সে দেখা যাবে মা।’
‘কি দেখবি! কোথায় পাবি এতো টাকা? আমি তোকে আর পড়াব না। হাতে ভালো ভালো সম্বন্ধ আসছে। আমি কিছুতেই হাতছাড়া করতে পারব না।”
‘কী বলছেন? আমি…বিয়ে..’
‘হ্যাঁ বিয়ে। তুই পড়াশোনা আর করবি না। এই আমার সিদ্ধান্ত।’
আকাশী কিছু বলতে গেলে রোকসানা তাকে ধমক দিয়ে টাকাগুলো তার হাতে দিয়ে বাজারে পাঠিয়ে দিলেন। সে টাকাগুলো হাতে চেপে বেরিয়ে গেল। কী হচ্ছে তার সাথে, কিছুই সে বুঝতে পারছে না। এতদিন মেয়ে হয়েও সে ছেলের অনুরূপ সব কাজ করেছে। কিন্তু হঠাৎ আজই প্রকৃতি তাকে মেয়ে সাব্যস্ত করে এ কেমন পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে? নিজের মেয়ে হওয়াতে আকাশীর মাথায় চিড়চিড়ে একটা রাগের উৎপত্তি হয়। আজ যদি ছেলে হতো, নিজের একটা ক্যারিয়ার গড়ার মতো পর্যাপ্ত পরিমাণ সময় পেত। আজ সে মেয়ে হওয়ায় মায়ের দুঃখকে মায়ের নির্দেশকে মোটেই উপেক্ষা করতে পারছে না। সে ভেবে দেখে, কিস্তি নয়তো ঘরখরচ যেকোনো একটাই সে চালাতে পারবে। বাবা বাড়িটা তৈরি করার শেষের দিকে অনেক টাকা লোন নিতে হয়েছিল। আজ তাই নিয়ে হচ্ছে দুর্দশা।
আকাশী এসে রান্নাবান্না করে একদিকে বসে রইল। তার রঙিন মনে হঠাৎই একটা কালো দাগ পড়ে যাওয়া যেন জীবনকে কলঙ্কিত করে ফেলার মতো। তার এখনও এমন অনেক কাজ আছে, যা সে করতে পারেনি কিংবা সুযোগ পেয়েও করেনি সময়ের অপব্যবহার না হওয়ার জন্য। অনেক সুখই সে একদিকে ফেলে রেখে কেবল জীবনের লক্ষ্যে মনোযোগ দিয়েছে। আজ লক্ষ্যের মাঝপথেই থেমে যেতে হচ্ছে। তার উপর সে অনেক উপেক্ষিত সুখের নাগাল পায়নি। আকাশীর কাছে মনে পড়ে যায়, জয়ের সাথে কাটানো দুটো নিশুতি রাতের কথা। লোকটির মনের কথা মুখে না এলেও আকাশী সবকিছু নীরব ভাষায় বুঝেছিল। জয় তার জন্য উদয় হওয়া ভাবনাটা তিনটা বছর রাখতে পেরেছে। আকাশী সুযোগ দিলে সম্ভবত সারাজীবন রাখতে পারত। কেন যে মনটা তার দিকে ধাবিত হয়নি! তার কাছে মনে পড়ে যায় এক চন্দ্রিমা রাতে অনিক তার সঙ্গ চেয়েছিল। আকাশী নিজের লক্ষ্যের জন্য এবং একদিন স্বপ্নের রাজকুমারের সাথে ঘর বাঁধার জন্য অনিককে ফিরিয়ে দিয়েছিল। সে পারত তার সাথে সম্পর্ক গড়তে। কেন যে মনটা অনিকের প্রেমে পড়ল না! পড়লে আজ অন্তত মনে একটা সুখ থাকত যে, এই জীবনে নিজের ইচ্ছায় পার্থিব কোনো সুখ পেয়েছে। প্রতিটি মেয়েই তার মনে এক অজানা অদেখা রাজকুমারকে ঠাঁই দেয়। সেও দিয়েছে। ভেবেছে, এতদিন যে ভালোবাসা থেকে সে দূরে ছিল, তার সবই তাকে দেবে। আর এই ভালোবাসার শুরুটা সে অন্যভাবে করতে চেয়েছে। সে চেয়েছিল, প্রকৃতিই যাতে তাকে অজ্ঞাত একটা লক্ষণে সামনে এনে দেয়। এভাবে বিয়ের পর জোরপূর্বক অন্য কারো জন্য নিজের মনের সমর্পণ করার কথা সে কখনই ভাবেনি। চায়নি তার প্রথম প্রেমটা এমন হোক। সে প্রেম করতে চায় সংগ্রামকে এবং সেই সংগ্রামের মাঝে পাওয়া রাজকুমারকে। আজ এমন কেন হলো?
আকাশীর মনকে আবারও একটা বিস্মৃতি ধাক্কাতে আসে। আজ হতে কয়েক মাস আগে নিস্তব্ধ একরাতে যখন চাঁদ তার সম্পূর্ণ আলো দিয়ে প্রকৃতিকে বেষ্টন করেছিল আর আকাশী সেই ভালোবাসা মাখা আলোতে নিজেকে এলিয়ে দিয়েছিল, তখন তার জীবনের সংগ্রাম তাকে অনিক আর জয়ের মতো আরেকটা প্রেমীর সাথে দেখা করিয়েছিল, যে কিনা পুরোপুরি তার রাজকুমার হওয়ার যোগ্য ছিল। সে কখনও তার রাজকুমারকে পুরোপুরি সৎ হিসেবে চায়নি। চেয়েছে, সে যেন কিছু ভালো কিছু খারাপের সংমিশ্রণে তৈরি হোক। যে রাগ করলে সহজে তা ভাঙে না, যার-তার সামনে আবেগ প্রকাশ করে না কিংবা যার মধ্যে কিছুটা হিংসা কিছুটা অভিমান ভরে থাকুক। যাতে আকাশী নিজ কায়দায় তাকে ঠিক করতে পারে। অনিক কিংবা জয়ের মতো সাদাসিধে কাউকে নয়। সব লক্ষণই সে সেরাতে দেখেছিল। তবে কেন আপন করে নেয়নি তাকে? কেন মনের রাজকুমারের জায়গায় তাকে বসানোর কথা মাথায় আসেনি! সেরাতে পাওয়া উপহারের গুঞ্জন এখনও তার কানে ঝুনঝুন করে বাজছে। মেলার পরদিন কলেজে রাজিবের সাথে ঝগড়া হওয়ায় তার মন খুব খারাপ ছিল। রাতে খামারের সামনের নিচু পুকুরের পাড়ে সে বিষণ্ণ মনে বসেছিল। এমন সময় বাইকের আওয়াজ শোনা যায়। অপূর্ব এসে বিনা নোটিশেই তার পাশে বসে পড়ে।
আকাশী মৃদু হেসে বলল, ‘আপনার ভাব দেখে লাগছে, আগে থেকেই জানতেন আমি এখানে আছি।’
‘আমি কী এই নির্বাক পরিবেশও জানে। তাছাড়া এখানে তোমাকে অনেকবার দেখেছি।’
তারা বেশ কিছুক্ষণ নীরব বসে রইল। আকাশীর কেন যেন ভালো লাগছে। অপূর্বের ফেলা নিঃশ্বাসের শব্দও কানে আসছে। সে নিশ্চিত ছিল অপূর্ব অন্য কোনো কারণে এসেছে। নইলে তার সবসময় চলে যাওয়ার একটা ছটফটে তাড়া থাকে। আজ তা নেই। এমনকি তার মুখে কেমন এক মুগ্ধতা বিরাজ করছে, যা তার মন সম্ভবত সহজেই বাহিরে প্রকাশ পেতে দিতে চাইছিল না। কিছুক্ষণ পর অপূর্ব নিজেকে বলার মতো করেই আকাশীকে বলল, ‘আমার সময় কাটছিল না। ভাবলাম এখানে চলে আসি। আই হোপ, কিছু মনে করোনি। আর এই জায়গাগুলোও আমার বাবার। আমি অধিকারেও আসতে পারি।’
আকাশী মৃদু হাসল, ‘সময় তো আপনার বাবার মূল জায়গার সামনে বারবার আড্ডা দেওয়া সালমার সাথেও কাটাতে পারতেন। বরং সে তো নিজ থেকেই আপনাকে সঙ্গ দিতে আসে।’
‘শোন, কারো দেওয়া আর অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে পাওয়ার মধ্যে তফাত আছে। তুমি বুঝবে না। বুঝলে?’
‘হুঁ।’
‘আচ্ছা, তুমি তো সবসময় বাইকে চড়ার জন্য পাগল হয়ে যাও, চলো এখন একটা রাইড দিয়ে আসি।’
‘আপনার কী হয়েছে বলুন তো?’
অপূর্ব কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলল, ‘আমারও যদি মন চায়, কোনো একটা আকাশ ছুঁতে চাওয়া আকাশীর সাথে বাইকে বসে রাইড দেই, তাতে কি অন্যায় কিছু আছে?’
‘আপনার কি মনে আছে, আপনি এই আকশীকেই কাদায় ফেলেছিলেন তাও একটা রাইড না দেওয়ার জন্যে?’
‘একটা সময়ের কথা আরেকটা সময়ে না তোলাই ভালো। যাবে কি যাবে না?’
‘যাব কোথায়?’
‘এইতো, রাস্তা যতদূর নির্জন থাকে, ঘুরিয়ে আনব। শুনো, তোমার তো এই ধরনের পরিবেশ অনেক পছন্দের। ওদিকের মাদ্রাসার পেছনের বাড়িতে এমন একটা নির্জন জায়গা আছে। ওখানে পুকুর নয়, বরং খাল আছে। খালটার ওপরের পাড়ে ছোট একটা বাঁশের তৈরি ভাঙা দোকান আছে। ঝড়বৃষ্টি বেশি হয় বিধায় এখন ওটা পরিত্যক্ত। ওখান থেকে চাঁদকে আর তার মোহনীয় মায়াকে খুব ভালোভাবে উপভোগ করা যায়। ওখানে যাবে একবার?’ বলে অপূর্ব আকাশীর দিকে ফিরতেই দেখে, সে মুগ্ধের মতো তার দিকে চেয়ে আছে।
‘আপনি কি সত্যিই এমন?’
‘মানে?’
‘আমি জানতামও না, প্রকৃতির ছোট ছোট এই মায়াগুলোকে আপনি চেনেন। বরং আমি অবাক হচ্ছি।’
‘কিছু জিনিস অনেকেরই প্রকাশ পায় না। তবে তাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। বলো যাবে?’
আকাশীর মন যদিও বিষণ্ণ ছিল, খালের ওই জায়গাটা দেখার জন্য তার মন ব্যকুল হয়ে উঠেছে। সে জানে খালটির সম্বন্ধে। কিন্তু ওই জায়গায় সে কখনও যায়নি আর সে অপূর্বকে একবার পরীক্ষাও করে দেখতে চায়। তাই আকাশী অপূর্বের বাইকে উঠে পড়ল। তার ভাগ্যকে মন্দ বলা চলে। যেদিনই বাইকে উঠার সুযোগ পায়, সেদিনই সে শাড়ি কিংবা লং ফ্রক পরে থাকে। ছেলেদের মতো করে বসার অবকাশ সে সম্ভবত কখনও পাবে না। অপূর্ব বাইক চালাচ্ছে। আকাশী যেন স্বপ্নে প্রবেশ করেছে। চারিদিকে জোছনার খেলা এবং নিস্তব্ধ পরিবেশ আকাশীকে মাতাল করে ছাড়ছে। সে আজীবনই এতে হারিয়ে থাকতে চায়। আজীবন। আকাশী বুঝতেই পারল না, কবে তারা মাদ্রাসা পেরিয়ে গাছের ঘনস্তূপের মাঝখানের রাস্তা এবং কয়েকটা দোকান বাড়ি পেরিয়ে খালের পাশে পৌঁছাল।
আকাশী খালের পাড়ে পৌঁছাতেই তার হৃদপিণ্ড দ্বিগুণে কম্পিত হতে শুরু করল। এমন মনোরম পরিবেশের জায়গার সম্বন্ধে সে আগে কেন জানেনি? আগে কেন আসেনি এখানে। এমন একটি জায়গার সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য সে এতদূর নির্দ্বিধায় হেঁটেই চলে আসতে পারত। অপূর্বের দিকে তাকিয়ে সে তাকে মনে মনে অজস্র ধন্যবাদ জানায়। মনে হলো, এই জায়গাতে নিয়ে আসার জন্যই অপূর্ব তার জীবনে এসেছে। আকাশী যখন দুই হাত মুক্ত করে এলিয়ে চোখ বন্ধ করে চাঁদকে তার মনোমুগ্ধকর বন্ধু পরিবেশের সাথে তার বন্ধুত্ব গ্রহণ করার আবেদন করছিল, তখন অপূর্ব ভাঙা দোকানটায় গেল। আকাশী ফিরে দেখল ওখানে একটা ভাঙা বেঞ্চ আছে। বেড়ার একদিকে একটা হারিকেন ঝুলানো। অপূর্ব তা নিয়ে বেঞ্চে বসেছে। আকাশী গিয়ে অন্যপাশে বসল। বেঞ্চের মাঝখান বরাবর তার বসতে হয়েছে। তার একটু পিছে ভাঙা। অপূর্ব লাইটার বের করলে আকাশী বলল, ‘লাইটার সবসময় সাথে রাখেন?’
অপূর্ব সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট নিয়ে নীরবে জবাব দিলো।
আকাশী বলল, ‘ধূমপান ভালো না। শারীরিক দিক থেকেও শরীয়তের দিক থেকেও।’
অপূর্ব সবে একটা সিগারেট মুখে ঠুকেছে। আকাশীর কথা শোনে সে তা নিয়ে কুটির থেকে বেরিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা খালের পানিতে ফেলে দিলো। সে ফিরে এসে হারিকেন ধরানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
‘তেল অনেক কমই আছে। বেশিক্ষণ বসতে পারব না।’
‘কিন্তু চাঁদের আলো তো আছে। আর এই কুটিরের একপাশ খোলা থাকায় চাঁদ আমাদের কাছে তার নিঃস্বার্থ আলো পাঠাচ্ছে। আচ্ছা, সিগারেট ফেলে দিলেন কেন বলুন তো।’
‘মাঝে মাঝে কারো আদেশ পালন করে আর কারো আদেশ পালন না করে আমি একধরনের স্বস্তি পাই।’
‘তা আদেশটা কি আজীবন পালন করবেন?’
‘আজীবন মাই ফুট। আমি জীবনেই বিশ্বাস রাখি না। তাই নির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না। তবে এটা বলতে পারি, আমার মন যতদিন আদেশটাকে আগলে রাখবে ততদিন আমি আদেশটা পালন করব।’
পরক্ষণে চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল। হারিকেনের হলদে আর চাঁদের দুধেল আলো মিশে এক স্বর্গীয় পরিবেশ তৈরি করেছে। আকাশী কিছুক্ষণ মাতালের মতো বসে রইল।
অপূর্ব বলল, ‘তুমি সবসময় ঢালা শাড়ি পরো কেন? কুঁচি শাড়ি ভালো লাগে না?’
আকাশী শুনতে পায়নি। তবে বলল, ‘আপনি এই পরিবেশের ভাষাকে কীভাবে শিখলেন বলুন তো।’
অপূর্ব খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। তাহলে সে আকাশীর মতো প্রকৃতির সাথে কথা বলতে পেরেছে।
‘আসলে আমি মাদ্রাসাটায় ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছি। তখন বন্ধুদের সাথে এদিক দিয়ে মাদ্রাসায় যেতাম। এখান থেকে বাড়ির রাস্তা অনেকটা কাছে। বাইক চালানোর মতো অবস্থা না থাকায় তোমাকে মেইন রোড দিয়ে এনেছি । তো মাঝে মাঝে শহর থেকে এলে মাদ্রাসা স্কুল এগুলোর স্মৃতি আমাকে টানলে গন্তব্যে চলে যাই। তখন এই জায়গাগুলো ঘুরে যাই। গতবার দেখলাম, এখানে বসা চায়ের দোকানটা তুলে ফেলা হয়েছে। খালের পাড়ে একটা বোকা লোক রেখেছিল। এখানে এসে বসে সিগারেট খাওয়ার সময় বুঝেছিলাম, পরিবেশটা বেশ সুন্দর।’
অপূর্ব খালের অন্যপাড়ের নিস্তব্ধ পরিবেশটা দেখে কথা বলছিল। আকাশীর দিকে ফিরে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। আকাশীকে অপরূপ সুন্দর দেখাচ্ছে। চাঁদের আলো তার মুখে পড়ায় তাকে আরও মায়াবী দেখাচ্ছে। সে তার দিকে তাকাতেই অপূর্ব দুইপা বেঞ্চের দু’পাশে দিয়ে হারিকেনের দিকে ঝুঁকে নিশ্চুপ হয়ে হারিকেনের আলো চেয়ে রইল। আকাশী লক্ষ করল, সে হারিকেনের দিকে নয়, তার পাশে রাখা ওর হাতের দিকে চেয়ে রয়েছে। ধরতে চাইছে নাকি?
আকাশীর তাকিয়ে থাকা বুঝতেই অপূর্ব অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
আকাশী বলল, ‘কেন আমাকে এনেছেন বলুন তো।’
অপূর্ব স্বস্তি বোধ করল, ‘আসলে আমি কখনও কোনো মেয়েকে কিছু দেইনি। দিলেও নূপুর টাইপের কিছু দেইনি।’ বলতে বলতে সে পকেট থেকে নূপুরগুলো বের করিয়ে আনে।
আকাশী তখনও নূপুরের দিকে তাকায়নি, ‘নূপুর টাইপের মানে?’
‘মানে.. মানে’, অপূর্ব অন্যদিকে চেয়ে বলল, ‘ফিল্মে দেখি এগুলো প্রেমিকাকে উপহার দেওয়ার জিনিস।’
আকাশী নিঃশব্দে হাসল। এখন মন বলছে, সে যদি পা এগিয়ে দেয় অপূর্ব তা পরিয়েও দেবে। কোন সঙ্কোচে সে শুধু হাতই বাড়াল। অপূর্ব হাতে হাতে দিয়েই একপ্রকার বেঁচে গেছে। আকাশী মুগ্ধ হয়ে নূপুরের দিকে চেয়ে রইল। হারিকেনের সম্পূর্ণ আলো আকাশীর মুখে পড়ায় অপূর্ব তার ওপর থেকে নজরই সরাতে পারছে না। আকাশীর মাথার আঁচল পড়ে যায়। নূপুর খুলে পরতে যাওয়ায় খোলা চুলও বেরিয়ে এসেছে। অপূর্ব তার হাত ধরে ফেলে নূপুর নিয়ে নিজেই পরিয়ে দিতে নেয়। আকাশী কী করবে বুঝতে পারছে না। তার মনে কেমন এক ভয় করছে। ভয়টাকে এক অদ্ভুত মুগ্ধতা সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আকাশী ভয়টাকে সরাতে দিচ্ছে না। সরালে সে বেসামাল হয়ে পড়বে। কাঁপতে শুরু করবে। সে আগে বহুবার ছেলেদের হাত ধরেছে। কিন্তু কখনও কোনো ছেলে পরম ভালোবাসায় তার পা ধরেনি। অপূর্ব নূপুর পরিয়ে আকাশীর হাত ধরল। সে শিউরে উঠল। সে চাইছে ওঠে যেতে। কোন একটা জড়তা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরায় সম্ভবপর হচ্ছে না। অপূর্ব কাছে আসছে দেখেও সে উঠতে পারছে না। সে আকাশীর নাকের কাছে এসে গেল। ক্রমে তার নাক আকাশীর নাক ছুঁলো। আকাশীর হাত কাঁপছে। তার ঠোঁটে অপূর্বের ঘন নিঃশ্বাস পড়তেই আকাশী কী করবে ভেবে না পেয়ে তার হাতে থাকা অপূর্বের হাত হারিকেনে লাগিয়ে দেয়। অপূর্বের বুক ছ্যাঁত করে উঠায় সে এক ঝটকায় হাত সরিয়ে বেঞ্চ থেকে উঠে পড়ল। আকাশী নির্লিপ্তভাবে বলল, ‘স্যরি।’
অপূর্ব পুড়ে যাওয়া হাত ঝাড়তে ঝাড়তে তার দিকে তাকিয়ে রইল। আকাশী আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে যায়। অপূর্ব হাতের পোড়া স্থানে ফুঁ দেওয়া বাদ দিয়ে আকাশের চাঁদটার দিকে তাকায়। সে বুঝেছে, আকাশী ইচ্ছাকৃতভাবেই তার হাত উত্তপ্ত হারিকেনের কাচে লাগিয়েছে। তাকে কেন শাস্তি দিয়েছে? আকাশী নিজেই অপূর্বকে কাছে না যেতে দিতে পারত। আকাশীকে দোষ দেবে নাকি এই পরিবেশকে দেবে সে বুঝে উঠতে পারছে না। সকল দোষ এই পরিবেশের। এতক্ষণের মোহনীয় আকাশটা এখন তার দু’চোখের বিষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাঁদ যদি এভাবে মাতাল করা আভা না ঢালত, পরিবেশ যদি এভাবে নিস্তব্ধ না হয়ে থাকত, খালের পানি যদি শান্তিময় কলকল ধ্বনি না করত, হারিকেনও যদি হলদে আভা দিয়ে আকাশীর মুখকে না রাঙাত তবে তার মনের আকাশীর মনের সাথে লাগার প্রশ্নই উঠত না। অপূর্ব ছোটে নিচে গিয়ে বয়ে যাওয়া পানির স্রোতে হাতিয়ে সিগারেটের প্যাকেট খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগল। আকাশী দৌড়াতে দৌড়াতে রাস্তা যতটুকু মনে আছে তদানুসারে মাদ্রাসার সামনে এসে পৌঁছায়। একপ্রকার দৌড়ে আসায় সে হাঁপিয়ে উঠল।
স্মৃতিটুকু মনে পড়লে সে একটি বাক্স খুলে নূপুরগুলো নিয়ে বসল। এগুলো আর পরেনি। এগুলো ওই সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেদিন সে যেকোনো দুটো কাজ করতে পারত। হয়তো নিজেকে সংযত করা নয়তো অপূর্বকে প্রত্যাখ্যান করা। কেউ একজন সত্যিই বলেছিল, একটি ছেলে আর একটি মেয়ে একসাথে একা থাকলে তাদের মাঝে শয়তান বিরাজ করে। সেদিন আকাশী তার সামনের অপূর্বের দূরত্ব কমে আসতে দেখেও সেই শয়তানের বিরুদ্ধে পেরে ওঠেনি। অপূর্ব যতই কাছে আসছিল, ততই তাকে প্রত্যাখ্যান করা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। এমন সময় সংযত কিংবা প্রত্যাখ্যানের কাজ না করে অপূর্বকে একদম কাছে এসে যেতে দেখে সে তৎক্ষণাৎ অপূর্বের হাত পুড়ে দিয়ে পরিবেশ পাল্টে দিয়েছে। দুটো কাজই সে একসাথে করে পালিয়ে এসেছে। দোষ তারও ছিল। কিন্তু শাস্তি দিয়েছে অপূর্বকে। আজ হয়তো ওই অপূর্বেরই অভিশাপ তার লেগেছে। কী হতো, যদি সে অপূর্বকে মেনে নিত! অন্তত তার প্রতি মনের ধোঁয়া উঠা কয়লায় ফুঁ দিয়ে আগুন ধরাতে পারত। এতে করে অপূর্ব তার সেই রাজকুমার হতে পারত। তার লেখাপড়া এখন শেষ। একপ্রকার স্যাটল আছেই। তবু নিজ দমে চাকরি করতে চাওয়া লোকটির সাথে সে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হতে পারত। অন্তত এইদিন থেকে সে দূরে থাকত। এখন তো মনের কয়লাগুলো ঠান্ডা হয়ে গেছে। অপূর্ব দূরে চলে যাওয়ায় জায়গাটা একদমই নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। তার মনকে সে মানাতে পারে, কিন্তু অপূর্বকে কীভাবে? সেই রাতের কথা সে কখনই ভুলতে পারবে না। তার মন তার ওই পাপটাকে কোনোভাবেই মুছতে দিচ্ছে না। সে জীবনে অনেক পাপ করেছে। তারচেয়ে বড় পাপ করেছে সে ওই অভিশপ্ত রাতটা কাটিয়ে। এরপর থেকে সে আর প্রকৃতির সাথে কথা বলেনি। নিজেকে টিউশনি আর একাজ-ওকাজে ব্যস্ত রেখেছে। কিন্তু কে জানে, আজ বিয়ের কথা উঠায় সে এতোটা আহত হবে, সেই রাতের কথা তার মনে পড়ে যাবে।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here