আধখাওয়া অষ্টভুজ,পর্ব:২

উপন্যাসের নামঃ
#আধখাওয়া_অষ্টভুজ
লেখনীতে:
#উম্মে_নাদিয়া_তাবাসসুম
#পর্বঃ২

রামিসার চিৎকারে আঁতকে উঠল ইন্তিকা।ওপাশ ফিরে বা হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে নিল,তারপর একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো,বাব্বাহ!রামিসা বুড়ি তো দেখি আমাকেই হারিয়ে দিল।

-দেখেছো বুবু,ছোট বলে অবজ্ঞা করতে নেই।কেমন হারালাম তোমায় দেখলে,বলে একটা ভাব নিল।
-তাই নাকি রে?আচ্ছা আর অবজ্ঞা করবোনা আম্মাজান!আপনি এবার একটু পড়তে বসুন।
এই বুয়াদাদী আসেনি?
-না বুবু,মাগরিবের নামাজ শেষে আসবে বলেছে।
-দাদাীর জন্যও এনেছিলাম রে।কথায় কথায় একদম ভুলে গেছি রে।ধর,এগুলো দাদী আসলে দাদীকে দিবি।টক সহ খাইয়ে দিবি,খেতে না চাইলেও জোর করে খাইয়ে দিবি।দাদী আজকাল খুব অনিয়ম করছে।
আমি গেলাম ছাদে কাপড় আনতে।
-আচ্ছা।

দরজায় ঠেশ দিয়ে দাড়িয়ে আছে বুয়াদাদী, চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে।এই দুইটা নাতনী আমার যেনো নিজের চাইতেও বেশি।কই আমার দুইটা মাইয়া ও তো আছে,আর নাতনী রুমা,ঝুমা আর পায়েল ওরা তো কোনোদিন এমন করে নাই।জামাইয়ের মাইর খাইতে খাইতেই জীবন গেছে আর কে -ই বা কি সম্মান ভালোবাসা দিবো!
কিন্তু এই দুইটা নাতনী আমারে এত ভালোবাসে ক্যান?ঠিক যেন সত্যিকারের মায়ার বন্ধন।মা মরা মাইয়া বলে?কিন্তু ইন্তু তো সেই আশা মা থাকন থেকাই এমন পাগল আছে আমার জন্য,আর রামু তো কত ছোডো তখন।
সমস্তজীবনের সব দুঃখ যেন এদের দেখলেই জুড়ায় যায়।আমার এক একখান কলিজা!

ওমা দাদী!কখন এলে তুমি?আসসালামু আলাইকুম,এসো এসো…বলেই রামিসা জড়িয়ে ধরে বুয়াদাদীকে টেবিলের কাছে নিয়ে এলো। দাদী বুবু তোমার জন্য কি এনেছে দেখো।এই নাও হা করো তো!
-ওমা এডি কি?মজা লাগের তো!
ধর রামু তুই আ কর তো দেহি,একটা খা,খা একটা কিছু হইবো না।
-দাদী,এটা হলো ফুচকা বুঝলা?আচ্ছা, দাদী আজকে আমায় বিনুনি করে দেবে চুলে?

শুকনো কাপড়গুলো নিতে নিতে গুণগুণ করে গান ধরলো ইন্তিকা।গানের গলা খুব একটা ভালো না তার।ওর নিজেরই খুব অপছন্দের,খুব মোটা স্বর।কিন্তু সবাই যখন বলে, “মেয়েমানুষের ব্যাটাছেলেদের মতো এমন গলা কেন, ছ্যা!”
তখন ইন্তুর খুব কষ্ট হয়।তাই কারো সামনে ভুলেও কোনোদিন গান করেনি সে।নিরালায় বসে আপন মনে গাইতে থাকে।আকাশ ও কেমন গুমোট হয়ে অদ্ভুত রূপ নিয়েছে।
কিরে আজও কি তোর আমার মতোই মন খারাপ?
কোনো কারণে মন খারাপ হয়না ইন্তিকার।কিন্তু হুটহাট কিসব মনে পড়ে খুব মন খারাপ হয়ে যায়।
আকাশের পানে চেয়ে কাঁদতে লাগল।আজ যদি আম্মু থাকতো,আমায় কেউ এভাবে বলার সাহস পেতো?আম্মু কেন তুমি চলে গেলে?
প্লিজ আসোনা একটাবার,প্লিজ!আল্লাহ,একটুক্ষণের জন্য আমার আম্মুকে আমার কাছে পাঠালে কি এমন হবে?
প্লিজ আম্মু একটাবার আসো!

রাতে টর্চলাইটের আলো ফেলে ফেলে সবকিছু খুঁতিয়ে দেখা আরাদের পুরনো অভ্যাস।এক এক করে আলো ফেলতে ফেলতে ইন্তিকার উপরও আলো ফেলে দিলো।
ওহ নো!টর্চলাইটটা অফ করতে গিয়েই চোখ ধাঁধিয়ে গেলো আরাদের।
কি এত দুঃখ ওর মনে?এভাবে ফুঁপিয়ে কাঁদছে কেন?
কতবার তো দেখেছে রাস্তায়,অলি-গলিতে,একবারও তো মনে হয়নি ওর এত কষ্ট আছে।
কাঁদলে বুঝি কোনো মেয়েকে এত সুন্দর লাগে!
কতজনকে দেখেছে কাঁদলে তো মেয়েমানুষকে ভারি অদ্ভুত লাগে,কেমন চোখফোলা,নাকে সর্দিওয়ালা বুড়ির মতো লাগে!
এই পিচ্চিকে তো রাস্তায় কত শতবার দেখেছে।এত সুন্দর তো ওকে কখনো লাগেনি।এত না বলতে গেলে কোনোরকমই লাগেনি।কিন্তু আজ এত সুন্দর কেনো লাগছে তাকে?সুন্দর না ঠিক যেন মায়াবতীলতা!সুন্দর বললে এ রূপের অসম্মান করা হয়,এত মায়া আজ অবধি আর কারো চেহেরায় দেখেনি।কান্নারত নারী যে কতটা মায়াময়ী হতে পারে তা এ রূপ না দেখলে কারো বোঝার সাধ্যি নেই।
কি হয়েছে ওর?আমি এতক্ষণ ধরে আলো ফেলে আছি,ওর কোনো খবরই নেই।

-এই যে মিঃ এভাবে অন্যের ছাদে আলো ফেলছেন কেন?
আরাদ হা করে তাকিয়ে আছে,আ আ আ আমি…কিছু বলতে গিয়েও যেন থমকে গেছে।
আরাদের ইচ্ছে করছে একটা থাপ্পড় মেরে আবারো ওকে কান্না করিয়ে দিতে।
আরাদ হা করেই আছে।এমন অদ্ভুত কান্ড দেখে ইন্তিকা আর কিছু না বলে কাপড়গুলো নিয়ে নিচে চলে গেল।

সায়ান বাসায় এসেই টেক্সট করলো সারাকে।সাবধানে পৌঁছোলে তো?কোনো অসুবিধা হয়েছে?কেমন আছো এখন?
-হুম
-আচ্ছা ওয়েট,আমি ফ্রেশ হয়ে নক করছি।
-হুম

বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার নিয়ে চুল মুছতে মুছতে বেরোলো সায়ান।সারার কথা ভেবেই ফোনটা হাতে নিয়েই একটা কল দিল।ওর কি কিছু হয়েছে?কেমন অদ্ভুত লাগছে!
দুইবার মিসড হয়ে গেল কল।তৃতীয়বার করাতে রিং হতে হতে ধরল সারা।
-এই সারা!কল ধরছোনা কেন?তোমার এই ফোন সাইলেন্ট করে রাখার অভ্যাসটা কবে যাবে বলোতো!আচ্ছা ছাড়ো,এই পাখি কি হয়েছে তোমার?মুড সুইং হয়েছে?
-কিছু হয়নি আমার,তুমি ফোনটা রাখো তো!

সারা রাখতে বললেও সায়ান ফোন রাখল না,সে জানে সারা আসলে মন থেকে চায়না ফোন রাখতে ও খুব করে চায় সায়ান যেন ওর পাশে থাকে।
-সারা, তেঁতুলের চকলেট খাবে?
-না
-আমার পাখিটার যে কি হয়েছে!এমন থাকলে তো আমার একটুও ভালো লাগে না প্রিয়।

ভাতগুলো নাড়াচাড়া করেই উঠে গেল সায়ান,কোনোভাবেই মুখে তুলতে পারলো না।জানালা দিয়ে নদীতে ফেলে দিল এঁটো খাবার।প্রতিদিনের মতোই হুড়মুড় করে এসে জড়ো হলো মাছেরা। টপাটপ করে খাচ্ছে ওরা,এদের কয়েকবার ভিডিও কলেও দেখিয়েছিল সারাকে।সারা তো একটার নাম ও দিয়েছে,চিকু।এই চিকুটা রোজ আসে গায়ে একটা কাটা দাগ,চিনতে ভুল হয়না ওদের।

লাফ দিয়ে বসা থেকে উঠে পড়ল সায়ান।কোনোমতে ব্লু কালার টি-শার্ট টা পড়ে বাইকে উঠল।এই টি-শার্ট টা ওর খুব পছন্দের সারা দিয়েছিল গত লাভ অ্যানিভারসারিতে।ওটা দেখলেই কেমন সারা সারা অস্তিত্ব অনুভব করে সায়ান।ফোনটা বের করে সিলভারের পাড় দেয়া নীলচে বেগুনী রঙের শাড়ি পড়া ছবিতে সারাকে দেখতে লাগল।এত সুন্দর ও কেউ হয়!
এই মেয়েটার চোখে, মুখে কোনো রূপ নেই..ওকে এক দেখাতে কেউ পছন্দ করতে পারবেনা।কিন্তু আমি কেন তার সমস্ত কিছুতে কি অপরূপ সৌন্দর্য্য অনুভব করি।রূপহীনা, গুণহীনা নারীর যেই সৌন্দর্য্য,যেই নিষ্পাপ মূর্তি থাকে,চাপা এক পাহাড় সমান কষ্ট জড়ানো যেই চাহুনি থাকে সেই সৌন্দর্য্যে আমি বিস্মিত হয়েছি।আমি তো তার রূপ কে ভালোবাসিনি,গুণকেও ভালোবাসিনি। ভালোবেসেছি তাকে শুধু তাকে,মানুষটাকে।
প্রথম দেখায় ভালোবাসার চেয়ে দেখতে দেখতে ভালোবাসা সত্যিই অদ্ভুত সুন্দর।

ফুল স্পিডে বাইক চালিয়ে মিনিট পনেরোর মাথায় পৌঁছে গেল।চাবি দিয়ে আস্তে করে দরজা খুললো সায়ান।পা টিপে টিপে সারার রুমের দিকে এগুলো।বাকিরা ঘুমোচ্ছে, সারার বাসার একটা চাবি সায়ানের কাছেই থাকে। হবু জামাই বলে কথা,তার উপর এমন হুটহাট এসে চমকে দেয়া ওর রোজকার অভ্যাস।বাড়ির সবাই ওকে খু্ব পছন্দ করে।

সারা উপুড় হয়ে বালিশ চাপা দিয়ে শুয়ে আছে।
সারার রুমে পা ফেলতেই সারা বললো, “এসো।এতো রাতে আসার দরকার ছিলনা।আমি জানতাম তুমিই হবে,তোমার এসব কবে থামাবে বলোতো!”

সায়ান জানে সারা কতটা কষ্ট থেকে বলছে এসব।
এমন মুড সুইং ওর প্রায়ই হয়।সব কিছু বিষাক্ত লাগে।কিছু সহ্য হয় না,যা ইচ্ছা বলে।এসব সায়ান বুঝে,তখন ওর খুব কষ্ট হয়,”আহারে কত কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা,এই কষ্টের একটুভাগও আমি নিতে পারিনা, প্রকৃতির কি লীলাখেলা!”

সারার কিছু হবার আগেই যেন সায়ান সব বুঝে যায়।এই মুড সুইং তো আসলে কেউ খুব একটা বোঝেনা।মানুষ শুনলেই বলে শহুরে মেয়ের নতুন নতুন শহুরে ঢং!আসলে তা কি কষ্টের সারাই বোধ করতে পারে।সব তছনছ করে দিতে মন চায়।তখন সবসময় পাশে থাকে সায়ান।কিন্তু সেই সায়ানের সাথেও ও এমন ব্যবহার করে।ও তো চায় না,তবুও হয়ে যায় এমন, কি করবে সারা?

-এই সারা,তেঁতুলের চকলেট খাবে?তুমি না মাঝরাতে লুকিয়ে লুকিয়ে এগুলো খেতে খুব পছন্দ করো,এই নাও।

সবকিছু উপেক্ষা করলেও এই চকলেট সে উপেক্ষা করতে পারবেনা।
এক খাবলা মেরে সব চকলেট নিতে গিয়েই কয়েকটা পড়ে গেল মেঝেতে।
সায়ান হাহা করে হেসে ফেললো।চকলেট গুলো তুলতে তুলতে বললো,”এই যে মহারানী ছাদে যাবেন?চলুন,একটু ছাদবিলাস করে আসি।”
সারা ঠোঁট বাকিয়ে বললো,”নাহ।”
সায়ান সারার ডান হাতটা শক্ত করে ধরে টানতে টানতে ছাদে নিয়ে গেলো।সারার মন খারাপ হলে সায়ান কখনো কারণ জিজ্ঞেস করেনা।ও জানে কারণ জিজ্ঞেস করলে তার মন আরও খারাপ হয়ে যাবে।মুড ঠিক হলে যে নিজেই বলবে।
কিছু কিছু মন খারাপের আবার কোনো কারণ হয়না।এমনিই থমকে যায় মন,অস্বস্তি কাজ করতে থাকে।এক বিষন্নতা যেন পুরো মনকে গ্রাস করে ফেলে।

-সায়ান!
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here