আমার অভিমান তোমাকে নিয়ে পর্ব -২৩

#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(23)

আজ দুইদিন হয়ে গেছে অরুনিকা রুম থেকে বেরোয়না। কারোর সাথে কথা বলা তো দূর খাওয়া দাওয়ায় করেনা। দুদিনেই কেমন যেনো মূর্ছা পড়েছে। উপায়ান্তর না পেয়ে সবচেয়ে বিশ্বস্ত আর ভরসার স্থান কাব্যকে ডাকেন অরুনিকার মা। মেয়ের চিন্তায় তিনি নিজেও দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছেন। না পারছেনা তাহসান সাহেবের বিরুদ্ধে গিয়ে মেয়ের সংসার ফিরিয়ে দিতে আর না পারছেন মেয়েটাকে একটু বোঝাতে। এই সবকিছুর মাঝে কেমন যেনো হাসফাঁস করছেন তিনি। একমাত্র কাব্যই পারবে অরুনিকাকে কিছু বলতে। ছোটো থেকে কাব্যের কোনো কথাই অমান্য করেনি অরুনিকা, কাব্যও ভীষণ আগলে রাখতো অরুনিকাকে।

“খালামণি তুমি চিন্তা করোনা, আমি দেখছি অরুকে। আমি কি তোমাদের কাছে এখন এতো পর হয়ে গেছি খালামণি? অরুরসাথে এতকিছু হয়ে গেলো অথচ কেউ আমাকে জানালেই না। খাবার দাও একটা প্লেটে, আমি খাইয়ে দিয়।”

“কাব্য আমাকে ভূল বুঝিসনা। সবকিছুই কেমন যেনো না ঘটা এক ঘটনার মতো ঘটে গেলো। অকল্পনীয় ঘটনার প্রেক্ষিতে আমাদের ঠিক কী করা উচিৎ ছিল কেউই বুঝে উঠতে পারিনি। একের পর এক কি থেকে কি হয়ে গেলো বুঝতেই এতটা সময় লেগে গেলো। অরুও দুইদিন ধরে নিজেকে ঘরবন্ধী করে রেখেছে। এতকিছু বলেও একটু কিছু মুখে দেওয়াতে পারিনি আমি। আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিনা, আমার মেয়েটার কষ্ট সহ্য হচ্ছেনা আমার।”

রুবিনা বেগমের কান্না ভেজা চোখ দুইহাতে মুছিয়ে দিয়ে বামহাতে আগলে ধরে তাকে কাব্য।

“খালামণি আমি থাকতে তোমার চিন্তা করতে হবেনা। অরুকে আমি ঠিক বুঝিয়ে দেবো চিন্তা করোনা। আমার অরু এখন আমার কাছে চলে এসেছে।”

শেষের কথাটা একদম আস্তে বলায় রুবিনা বেগমের কাঁ পর্যন্ত পৌঁছায়নি।

বেশ কয়েকবার দরজা ধাক্কা দেওয়ার পর অনিচ্ছা সত্বেও দরজা খুলে দেয় অরুনিকা। কাব্যকে কখনও অমান্য করার সাহস হয়নি তার। বড়ো ভাইয়ের মতো ভীষণ শ্রদ্ধা আর সম্মান করে কাব্যকে অরুনিকা। সবার সাথে রাগ করে একা বসে থাকলে কাব্যই একমাত্র মানুষ ছিলো যে হাজার উপায়ে রাগ ভাঙ্গাতো। পছন্দের সবকিছুর আবদার নির্দ্বিধায় কাব্যের কাছে করে ফেলতো। কখনও বড়ো ভাইয়ের অনুপস্থিতি অনুভব করতে দেয়নি কাব্য। কাব্যের বলা সব কথাই বরাবরই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতো অরুনিকা। তাই আজও সে কাজের অন্নথায় হলোনা। বাবা মায়ের ডাক উপেক্ষা করলেও কাব্যের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলোনা।

“অরু”

“হু”

“বিশ্বাস করিস আমাকে?”

“এমন কেনো বলছো কাব্য ভাইয়া? তুমি তো জানো আমি তোমাকে কতো বিশ্বাস করি।”

“তাহলে এতো কিছু লুকালি কেনো? বিশ্বাসের জায়গাটা কি কোথাও নড়বড়ে হয়ে গেছে? আমি কি তোর বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারিনি?”

“ছি ছি কাব্য ভাইয়া। এসব কি বলছো তুমি। তোমাকে তো আমি যে কোনো পরিস্থিতিতে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারি। প্লীজ আমাকে ভুল বুঝোনা। আসলে আমার জীবনের বেক্তিগত বিষয়গুলো নিয়ে আমি তোমাকে বিরক্ত করতে চাইনি। আমার কারণে তোমাকে বিব্রতবোধে ফেলতে চাইনি।”

“অরু! তোর কারণে আমি কখনো বিরক্ত হইনি, আর না কখনও হবো। তুই আমার জন্য কী তা নিজেও জানিসনা।”

কথার মাঝে পুরো খাবারটা অরুকে খাইয়ে দিয়ে ওয়াশরুম থেকে হাত ধুয়ে এলো কাব্য। অরু কিছুতেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারছেনা। বারবার চেষ্টা করেও পারছেনা নিজের চোখের জল লুকাতে। আদাভানের হটাত পরিবর্তন ভীষণ পীড়া দান করছে তাকে। নিঃসংগতার বেড়াজালে জড়িয়ে পড়েছে পুরোপুরিভাবে। কোনকিছুতেই শান্তি খুঁজে পাচ্ছেনা। হুট করে একজন মানুষের এমন পরিবর্তন হয়ে যাবে! এসব ভাবলেই মাথার ভিতর ঝিমঝিম করে ওঠে। সবকিছুই যেনো অসহ্য লাগে। ভাবনার মাঝে কাব্যের ডাক কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই চমকে ওঠে অরুনিকা।

“অরু নিজের প্রতি অনিয়ম করিসনা প্লীজ। আঙ্কেল কখনও তোকে এত দুর্বল হতে শেখায়নি। বরং শিখিয়েছে দূর্বল করা জিনিসকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে।”

হতবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে শুধু অরুনিকা। এই কথার প্রেক্ষিতে বলার মত কোনো শব্দই তার কাছে নেই।

বেলকনিতে বসে একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আদাভান। কিছুই ভালো লাগছেনা তার। দুইদিন আগে শেষবারের মতো অরুনিকার দেখা পেয়েছিলো। তারপর এই দুই দিন অনেক খুঁজেছে আদাভান। অতৃপ্ত দুইচোখের তৃপ্তির আশায় উৎকণ্ঠা হয়ে খুঁজেছে বারংবার। কিন্ত খালি হাতে ফিরে এসেছে বারবার। কলেজ থেকে ফেরার সময় প্রতিদিন অরুনিকার বাড়ীর বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেছে। একপলকের জন্যও চোখ সরায়নি অরুনিকার বেলকনি থেকে। দিনশেষে নিরাশ হয়েছে। ব্যালকনির দরজা পর্যন্ত খোলেনি সে।

“আর নয় নিস্ফল ক্রন্দন
শুধু নিজের স্বার্থের বন্ধন
খুলে দাও জানালা,
আসুক সারা বিশ্বের বেদনার স্পন্দন।”

“পুরো রুম জুড়ে বিরাজ করছে এক নিঃসঙ্গ হাহাকার। তুমিহীনা এই রুম আমার কাছে মরুভূমি মনে হচ্ছে প্রাণপাখি। তোমাকে ছাড়া আমি নিঃস্ব। ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দিওনা আমাকে। আমি চাইলেও পারছিনা তোমার কাছাকছি যেতে, দূর থেকে দেখার সমস্ত রাস্তাও এক এক করে নিজের হাতে বন্ধ করে দিচ্ছ। জীবনের এই পরীক্ষায় আমি জয়ী হবো, হয়েই হবে আমাকে জয়ী। কোনো মূল্যেই আমি হারাতে পারবোনা প্রাণপাখি।”

“সময় তুমি সত্য ,সময় তুমি নিত্য, সময় তুমি একলা রাজা, আমরা সবাই ভৃত্য ।”

আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লো আদাভান। অরুনিকা চলে যাওয়ার পর থেকে একদিনও রুমে ঘুমায়নি। রুমে গেলেই অরুনিকার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো এক এক করে স্মৃতিপটে উঁকি দিতে থাকে। মাথার মধ্যে শুরু হয়ে অসহ্য যন্ত্রনা।

______________

“নূর তুমি জানো আমি কখনোই এমন নীরব মেয়েকে পছন্দ করতাম না। আমার পছন্দের তালিকায় ছিলো প্রতিবাদী, সাহসী কেউ। যে কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করবেনা, হবেনা মাথা গুঁজে কটুকথার শিকার। যে জানবে আমার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে। কখনও নিজেকে কারোর থেকে কম মনে করবেনা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস থাকবে যার। আমি এমন কাউকে চাইতাম।”

আদিলের মুখে তার পছন্দের বর্ণনা শুনে কেমন যেনো কেঁপে উঠলো নূর। আদিলের পছন্দভুক্ত সবকিছুর বিপরীতে একটা মানুষ সে। নিজের স্বামীর মূখে প্রশংসা সব মেয়েরই কাম্য। সে বিষয়ের অন্যথায় নূরও নয়। বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে এক অসীম ক্ষমতা আছে, যা দুটো অচেনা অজানা মানুষকে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, ভরসা করতে শেখায়। দুজনকে দুজনের পরিপূরক হয়ে জীবনের পথচলা শেখায়। অবাক করার বিষয় হলো নূরের মনে খানিকটা হলেও আদিল জায়গা দখল করে ফেলেছে।

“ওহ! তাহলে তো আমি আপনার পছন্দের মানুষটির মধ্যে পড়িনা।”

“তুমি কি তা হতে চাও?”

আদিলের এমন জবাবে হকচকিয়ে যায় নূর। সত্যি তো, সে তো চায়না আদিলের পছন্দের মানুষ হতে।

“নূর!”

এমন মায়াভরা কণ্ঠে ডাকে যেনো শ্বাস রোধ হয়ে আসে নূরের। বহু কষ্টে কিছু বলার প্রয়াস চালালে আদিল আবারো বলে ওঠে,

“তুমি আমার পছন্দ বদলে ফেলেছো নূর।”

আদিলের কথায় থমকে গেলো নূর। তবে কি আদিল নূরকে ভালোবাসে? প্রসঙ্গ এড়াতে নূর বললো,

“মাঝে মাঝে আমি মুখ বন্ধ রাখি আর মাথা নত করে নি। এর মানে আমি ‘পরাজিত নই’; ‘আমি পরিণত’।”

“এটা মাঝে মাঝের জন্যই রেখো নূর। আমরা যে সমাজে বাস করি তা মানুষরূপী কিছু অমানুষে ভরা। এদের মনের মতো কখনোই হতে পারবেনা তুমি। জীবনে কেউ পারফেক্ট হয়না। আর যারা হয় তাদের পরিপূরক কাউকে প্রয়োজন পড়েনা। আমি অপূর্ণতার মাঝেই বাঁচতে চাই নূর। যে অপূর্ণতাকে পরিপূর্ণতা দান করার জন্য লাগবে পরিপূরক কাউকে। আমাদের দোষ গুলো যে নির্দ্বিধায় মেনে নিয়ে উপহার দেবে এক স্বর্ণালী সন্ধ্যা। জোৎস্নাস্নাত রাতগুলো আমি হাঁসি মূখে সেই অপরিপূর্ণ মানুষটাকে নিয়ে কাটাবো।”

নূর নিস্পলক তাকিয়েই থাকলো আদিলের দিকে। কখনও ভাবেনি আদিত্যের পরেও জীবনেও কেউ আসবে। সেদিন যখন মায়ের কাছে গিয়ে প্রকাশ করেছিলো নিজের ভালোবাসা দেখেছিলো এক অন্য মাকে। সেদিন থেকে মাকে ভীষণ ভয় পায় নূর। থাপ্পড়ের উপর থাপ্পর মেরেছিলেন তিনি। চুলের মুঠি ধরে টান দিয়ে বলেছিলেন, আমার সোনার ডিম পাড়া মুরগিকে ছেড়ে তুই ওই ছেলের কথা মুখেও অনবিনা। আর কাউকে যদি এই কথা জানাস তো তোর বাপের লা*শ*টাও খুঁজে পাবিনা। বিয়ের পর একবারই গেছিলো ও বাড়িতে তাও আদিলের সাথেই। সেদিনই মনে মনে কল্পনা করেছিলো আদিলকে এক জঘন্য মানুষরূপে। ভেবেই নিয়েছিলো শুধু টাকার জন্য তার মা এক কুরুচিসম্পন্য, খারাপ লোকের সাথে তার বিয়ে দিচ্ছে। বিধাতার লেখা ভাগ্যকে বারবার দোষারোপ করেছে। নিজেকে মেরে ফেলার কথা ভাবতে গিয়েও ভাবতে পারেনি বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে। বাবা নামক মানুষটা মধ্যবিত্ত সত্বেও সাধ্যের বাইরে গিয়ে ভালোবাসে নূরকে। ভীষন বিলাসবহুল জীবন না কাটালেও বেশ আদুরে জীবন কাটিয়েছে বাবার সান্নিধ্যে। মা তাকে খুব একটা যে সহ্য করতো তেমনটা নয়, তবে দুর্ব্যবহার করেনি কখনও। তবে সেই ভয়ংকর রূপ আজও মনে পড়ে নূরের। মনে মনে সেটাকে দুঃস্বপ্ন আখ্যায়িত করতে চাইলেও বাস্তবতা তা হতে দেয়না। বারবার মনে করিয়ে দেয় এটা সত্য এক ঘটনা, তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা। আসলেই মানুষরূপী এক নোংরা মানষিকতার অধিকারি তিনি।

“কবে যেন বড় হলাম , পেরিয়ে এলাম ছেলেবেলার কড়িকাঠ,চিলে কোঠা ঘর আজও ডাকে,আজ ও কাঁদে সহজপাঠ।”

আদিলের ব্যাপারে ভাবনাগুলো নিতান্তই ঠুনকো ছিলো। আদিলের মতো মানুষের সাথে এ জিবনে তার আর পরিচয় হয়নি। বাবার পরে যদি কাউকে ভরসার স্থান বলা যায় তবে সেটা চোঁখ বন্ধ করে আদিলকেই করা যাবে। সংসার জীবনের এই অল্প কিছু সময়ে বেশ ঝড় ঝাপটা সামলাতে হয়েছে নূরকে। সব ঝাপটায় তার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে আদিলকে। কোনো কুটুক্তির তীর তার পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই দুমড়ে মুচড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে আদিল। সাথে কুটুক্তিকারিকেও কোনোভাবে ছাড় দেয়নি। হোক সেটা নিজের কেউ।

চলবে?
#Fiza_Siddique

1500 শব্দের দিলাম। আপনাদের সুন্দর মন্তব্যের আশায় রইলাম।🥰

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here