আমার হৃদয়ে সে পর্ব -২৯+৩০

#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-২৯

বউ,আমার?মিস ইউ!”

বলেই মাথাটা তার এগিয়ে এনে আমার ঠোঁটজোড়ার উপর আলতো একটা চুম্বন এঁকে দেয়।আমি জোরে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিই।নাক ফুলিয়ে চাপা অভিমানটা এবার আমার মাথায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।ধড়াম বলে উঠি,

“মিথ্যাবাদী!”

আমার কথার পিঠে হৃদয় একদণ্ড হেসে ফেলে।হাসি থামিয়ে বলে,
“বউ রাগ করছে কেন?কি করেছে তার স্বামী?”
“ইউ স্টপ!ন্যাঁকা অভিনয় বন্ধ করুন।”

হৃদয় আবারো হেসে ফেলে।আমি নাকের পাটা ফুঁলিয়ে বলে উঠি,
“বেহায়া।”

হৃদয় এবার যেনো হাসিতে আরে লুটোপুটি খাবে এহেন অবস্থা হয়ে যায়।তা দেখে আমার পিত্তি জ্বলে উঠে।কপালে দীর্ঘ ভাঁজ ফেলে চলে আসতে উদ্ভুত হলে হৃদয় পেছন থেকে আমাকে টেনে ধরে।তার বাহুদ্বরে আবদ্ধ করে নিয়ে পেছনের চুলগুলো ঠিক করতে করতে বলে,

“রাগ করে না বউ।বাবা যে এতো তাড়াতাড়ি আসছে আমিও জানতাম না।আজ হঠাৎ ফোনে আমার সদ্য ঘুম ভাঙ্গিয়ে বলে এই সপ্তাহের ভেতরই নাকি তিনি আসছেন।সেই কথাটা দু’ঘন্টা পর তোমার আঙ্কেলকে কল করে জানাই। তোমাকে সরাসরি সারপ্রাইজ দিবো ভেবে জানাই নি।এই দ্যাখো,এখন আসলাম সেই সারপ্রাইজটা দিতে।আর এসে দেখি বউ যদি আমার তার স্বামীর উপর রাগ করে থাকে তাহলে স্বামীর কাছে কেমন টা লাগে?”

শেষ কথাগুলো শুনে আমার কপালের ভাঁজ মসৃণ হয়ে এলো।সাথে মুচকি হাসিও ফুটে উঠলো।পেছন ফিরি।বলি,
“হয়েছে বুঝলাম।এবার আমাকে ছাড়ুন।সোফায় যেয়ে বসুন।আমি আসছি।”
“পরে যাবো।আজ অনেকদিন পর বউকে কাছে পেয়েছি এতো তাড়াতাড়ি কি ছেড়ে দেওয়ার জন্যে?”

এই লোকটার উদ্দেশ্য সৎ ঠেকছে না।যেকোনো মুহূর্তে অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে।দরজাটাও ভিড়ানো।খালামণি বা আঙ্কেল যে কোনো মুহূর্তে এর দরজা ঠেলে যদি রুমে ঢুলে গেলো?ভেবেই দেরী করলাম না।পেছনের কাঁধ দিয়ে হৃদয়কে খুব জোরে ধাক্কা।ওমনি হৃদয়,

“আআআ পড়ে যাচ্ছি…! ”

আমি আতঙ্ক মাখা চোখে পেছনে ফিরি।আচমকা ঠোঁটের উপর হাত চলে আসে।একহাতে রেলিং চেপে ধরে অন্যহাত শূন্যে ছুঁড়ে আছে হৃদয়ের।রেলিং না ধরলে নিচে পড়ে যেত নির্ঘাত।অল্পের জন্যে বেঁচে গেছে।আমি দৌড়ে হৃদয়কে ধরতে নিলে হৃদয় আমাকে সময় না দিয়ে ছিটকে উঠে দাঁড়ায়।বুকে হাত রেখে জোরে বার কয়েক শ্বাস নেয়।তারপর বলে,
“বাব্বাহ এতে জোরে কেউ ধাক্কা মারে,বউ?অল্পের জন্যে বাঁচলাম।”

বলে আবারো হাঁপাতে থাকে।আমার চোখের দৃষ্টি নত হয়ে আসে।দিলাম তো আস্তে। এতো জোরে পড়েছে!ভাবনার মাঝে খালামণি দৌড়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেন।বেলকনির দিকে এগিয়ে বলেন,
“কি হয়েছে পারিসা?এখান থেকে কিচেনে যে চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পেলাম?”

আমার ঠোঁট নড়ে উঠে।মুখ দিয়ে শব্দ বের করতে পারিনি।তবে হৃদয় চুপ করে থাকে নি।ছটাং বলে উঠে,

“আপনার মেয়ে তো আমাকে শেষ করে দিত আজ, খালামণি?”
“মানে?”
“নাহ মানে হলো ও রেলিং এর উপর একটা তেলাপোকা দেখে ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়েছিলো। ওর চিৎকারে আমিও ভয় পেয়েছিলাম।”

খালামণি হৃদয়ের কথায় চোখজোড়া ক্রমাগত ছোট্ট করতে থাকেন।এর মানে হৃদয়ের কথা খালামণির বোধগম্য হচ্ছে না।কারণ খালামণি জানেন আমি
তেলাপোকায় ভয় পাইনা। আমি অসংযতে পড়ে গেলাম।খালামণিকে শুধলাতে ফোঁড়ন কেঁটে বলে উঠলাম,
“নাহ মানে খালামণি তেলাপোকাটা রেলিং এর উপর থেকে আমার গাঁয়ের উপর ঝাঁপ দিতে চেয়েছিল।আচমকা কিছুর উপস্থিততে ভয় পেয়ে যাই আর কি।এই আপনিও না ভালোমতো গুছিয়ে বলতে পারেন না।”

শেষ কথাটা হৃদয়কে উদ্দেশ্য করে।হৃদয় চোখ ছোট্ট করে মৃদু হাসে ।তারপর মাথা নাড়ে।খালামণি এবার বুঝতে পারেন।হাই তোলে বলেন,
“দাঁড়িয়ে কত আর কথা বলবি?মেহমানকে খেতে দিতে হবে না?বাবা সোফা যেয়ে বসো।”

৪৬.
আজ আরো দুইদিন কেঁটে গেলো।শুনলাম আজ রাতেই নাকি হৃদয়ের বাবা বাড়িতে ফিরবেন। সন্ধের দিকে হৃদয় আমাকে কল করে সংবাদটা জানায়।সে সংবাদ শুনে আমি ভেতরে ভেতরে খুব পুলকিত।পুলকিত কেন অবশ্যি তার কারণ জানি না।তবে বেশ পুলকিত।রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে রুমে এসে শুলাম।এমন সময় ফোন বেজে। স্ক্রিনে তাকিয়ে আমার জামাইটা।রিসিভ করে বললাম,

“বলো?”

ওপাশ থেকে হৃদয়ের নৈঃশব্দতা।বললাম,
“চুপ কেন?আচ্ছা,এই শুনুন?বাবা কি পৌঁছেছেন?”

বার কয়েক দৃঢ় শ্বাস ছেড়ে ওপাশ থেকে এবার হৃদয়ের খুব স্বর ভেসে আসে।তবে খুব আস্তে,
“হ্যাঁ।”

আমি হেসে দিলাম।বললাম,
“এটাতো ভারী খুশি খবর।তো এই খুশির মুহূ্র্তে আমার স্বামীর লাগে মন খারাপ?”

হৃদয়ের আবারো নিরবতা।বললাম,
“এই বারবার চুপ হয়ে যান কেন?কথার জবাব দেন।এবার কিন্তু চুপ থাকলে এখুনি আপনার বাড়িতে যেয়ে আপনাকে কিস করবো।”
বলে নিজ মনে খিলখিল করে আবারো হেসে উঠলাম।
“পারিসা?বাবা যেন কেমন বিহেভ করছে!”

এবার মুখের হাসিটা ঠোঁটের সাথে চেপে যায়।কপালের উপর উপচে পড়া চুলগুলো বামহাত দিয়ে কানের পেছনে গুঁজে নিই বলি,
“কেমন বিহেভ করে মানে?”
“পারিসা, আমি বুঝতেছি না বাবা কেন ডিভোর্সের বিষয়টা নিয়ে এতটা বিগড়াচ্ছেন।সামান্য একটা ডিভোর্সের ব্যাপারই তো।তুমিতো অভির সাথে সংসারও করোনি।তারপরও বাবাকে বুঝাতে পারছি না।মরে যেতে ইচ্ছে করতেছে পারিসা আমার।খুব মরে যেতে ইচ্ছে করতেছে।এই সময় বাবার এরকম বিহেভিয়ার সত্যিই আমি আশা করি নি।”

বলে হৃদয় কেমন ছন্নছাড়া পাখির মতন ছটফট আওয়াজ তুলতে থাকলো।আওয়াজগুলো বেদনার আওয়াজ।বললাম,
“আপনি আমাদের বিয়ের আগে বলেন নি আপনার বাবাকে আমার যে আগে একজায়গায় ডিভোর্স হয়েছিল?”
“বাবাকে এসব বলার সময় পাইনি।মাকে বলেছিলাম।ভাবলাম মা বাবাকে বলেছেন হয়তো।এখন শুনলাম মা বাবাকে কিছুই বলেননি।তবে যা হবার তো হয়েই গেছে তাই না?বাবা এখন আগের ইতিহাস ঘেঁটে কি লাভ পারিসা!কি লাভ!”
“উনার অনেক লাভ।কারণ আপনি উনার একমাত্র ছেলে।এক ছেলেকে নিয়ে বাবাদের কত স্বপ্ন থাকে।কত আশা থাকে।আপনি উনার সেই স্বপ্ন এবং আশায় গুড় বালি দিয়েছেন।ভুল করেছেন।খুব ভুল করেছেন।”
“নাহ,পারিসা,নাহ।কোনো ভুল করি নি।আমি তোমাকে ভালোবাসি।আর আমার ভালোবাসাই সত্যি।সত্য আমাদের বিয়ে।পারিসা তুমি শুধু আমাকে একটু আশ্বাস…..!”

কেঁটে দিলাম হৃদয়ের কল।শুনলাম না ওর আর কোনো কথা! আঘাতটা এবার ঠিক বুকের মাঝখানে এসে বিঁধলো।ভেতরে সব দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।চোখের পাতা ভার হয়ে এসেছে।গলা জড়িয়ে কান্নাগুলো বেরিয়ে আসতে চাইছে।মুখ চেপে গলার বেগতিক কান্না চাপাতে উঠে লাগলাম।
“আমি আর পারছি না আল্লাহ!আর নিতে পারছি না!আর না!

সেই রাতে ঘুম আসে নি আর।পুরো রাত জেগে থেকেছিলাম।শেষরাতে চোখবুঁজে এসেছিলো।পরক্ষণে আবার ধপ করে খুলে গেলো।পুরো রাতে হৃদয়ের অসংখ্যবার কল এসেছিলো।মেসেজ এসেছিলো।রিসিভ করি নি!মেসেজ গুলো দেখিনি।ওর কল,মেসেজ দেখবোই বা আর কেন আমি যে আবারো আরো একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি!এই ভুলের এবার মাশুল কিভাবে দেব?কিভাবে?

৪৭.
বেলা দশটা/এগারোটার দিকে দরজায় প্রবল করাঘাতে চোখ থেকে তন্দ্রাঘুম ছুটে যায়।এলোপাতাড়ী চোখে উঠে বসি।মাথাটা ভার খুব।সাথে মাথাব্যথাও ।চারদিকে চোখ বুলাই।সবকিছু ঝাপসা ঝাপসা লাগছে।মাথার চুলগুলো আলতো টেনে ধরি।আবারো দরজায় করাঘাত।

” পারিসা?পারিসা?পারিসা?”

ওপাশে হৃদয়ের আওয়াজ!হৃদয়ের কন্ঠস্বর শুনতে চোখজোড়া আবারো পানিতে ভরে গেলো।তরতর করে কয়েক ফোঁটা ঝরে পড়লো।বুকে হাত রেখে শান্ত করার চেষ্টা করলাম।লাভ তেমন হলো না।কান্না যেন আরো বেরিয়ে আসতে চাইছে।
“পারিসা?দরজা খোলো প্লিজ?কিছু হবে না।আমি আছি না?দরজা খোলো?”

হৃদয়ের সাথে তাল মিলিয়ে খালামণিও ডাকতে থাকলেন।কান চেপে ধরলাম। কারো গলার স্বর শুনবো না।কান চেপেও ধরে রাখতে বিরক্ত লাগছে এখন।সবকিছুই বিরক্ত লাগছে।সবকিছু।
“দ্যাখো পারিসা?পাগলামো করো না।দরজাটা খোলো প্লিজ।তোমার সাথে আমার কথা আছে।আগে আমার কথাগুলো শুনো প্লিজ?তারপর নাহয় দরজাটা বন্ধ করে ফেলে আর খুলো না?”

খালামণিও তাল মিলিয়ে তাই বলতে থাকলেন।এবার কিছুটা নিজেকে ধাতস্থ করলাম। বিছানা থেকে নামলাম।টলমল পায়ে পড়ে যেতে নিলে আবার খাটের চৌকাঠ ধরে ফেললাম।তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে দরজার দিকে ঘুরলাম।দরজা খুললাম।ওমনি হৃদয় আমাকে জড়িয়ে ধরলো।খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। কাতর জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো,

” কেন এরকম পাগলামো করো তুমি?তুমি আমার স্ত্রী।আমার সাথে তোমার বন্ধন হয়েছে আল্লাহকে সাক্ষী রেখে।পৃথিবীর কোনো শক্তিই আমাদের বন্ধনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।বিশ্বাস রাখো বউ এই হৃদয়ের উপর।এই হৃদয় তোমার স্বামী।তোমার ভবিষ্যতে একই পথের পায়তারার সাথী।”

বলে আমাকে আলতো ছাড়িয়ে নেয় হৃদয়।চোখের কোণের পানি মুছে নেয়।তারপর খালামণির দিকে তাকায়,

“খালামণি?আমাদের বিয়ে তো হয়েছে,না?আর কোনো অনুষ্ঠান লাগবে না।আমি আল্লাহর উপর ভরসা রেখে আজই পারিসাকে আমার বাসায় নিয়ে যাচ্ছি।আর এক মুহূর্তও দেরী করতে চাচ্ছি না।”

খালামণি চুপ করে থাকলেন।নিরবতা সম্মতির শামিল।
#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-৩০

৪৮.
স্বপ্ন ছিল অন্যরকম।বিয়েতে ঢাকঢোল বাজবে।মেহমান আসবে।বড় আয়োজন করে খাবারদাবার হবে।আমি বধূ সেজে সবাইকে বিদেয় জানিয়ে স্বামীর ঘরে পদার্পণ করবো।সেই বাড়ির সবাই আমাকে “বউমা” বলে সম্বোধন করে সাদরে গ্রহণ করবে।কিন্তু আজকের পরিস্থিতিতে স্বপ্নটা আমার ভাটা পড়া নদীর মতন হয়ে গেল।হৃদয়ের বাবার অসম্মতিতেও এখন ছুটে চলছি সেই বাড়িতে।মানে হৃদয়ের বাড়িতে।হৃদয় আমার পাশে বসা।উদাসীন মনে সি.এন.জির বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে আমাকে অন্যহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখে।আমার মনে ওকে নিয়ে প্রচন্ড রকমের অভিমান!তার বাবা যেহেতু আমাকে বউ করতে রাজি নেই তাহলে কেন আমাকে সে জোর করে নিয়ে যাচ্ছে সেখানে?তার ভালোবাসার মান রাখতে কেন বাবার চোখে খারাপ হবে সে?সে কি বুঝে না ডিভোর্সিদের দয়া দেখাতে যেয়ে সমাজে বাপ-মায়ের মুখ ছোট্ট হয়ে আসে।এতটা দয়ালু কেন সাজতে গেলো এই ছেলে?আবারো আরেক দফা কেঁপে উঠলাম।এই মুহূর্তে কান্না করে দিতে ইচ্ছে করছে খুব।ভীষণ রকম কান্না।হৃদয় হালকা নড়ে উঠে।তার হাতের বাঁধন হালকা হয়ে আসে।আমি ওমনি ওড়না টেনে চোখের কোণের জলে মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করি।হৃদয় আমার দিকে তাকিয়ে,

“পারিসা?আর কিছুক্ষণ পর আমরা পৌঁছে যাবো।”

বলে হাতের বাঁধন আবার শক্ত করে নেয়।আমি চুপ করে রইল।মিনিট সাতেশ পর সি.এন.জি একটা দো’তালা বাড়ির সামনে এসে থামে।

“পারিসা?চলে এসেছি।নামো।”

আমি কেনজানি বসে থাকলাম।নামার মতন পায়ে শক্তি পেলাম না।হৃদয় ড্রাইভারের দিকে এগিয়ে,
“মামা?ধরুন আপনার বিল?”

ড্রাইভার টাকাটা হাতে নেওয়ার পর হৃদয় আবার আমার দিকে ফিরে।দেখে এখনো বসে।সে আর না দাঁড়িয়ে আমার সিটের দিকে এগিয়ে আসে।কিছু না বলে ধপ করে তার দুইহাতে আমাকে তুলে নেয়।এ দৃশ্য দেখে আমিও যতটা না অবাক,ততটা ড্রাইভারও।তবে আমি লজ্জায় পেয়ে যাই।পরক্ষণে ড্রাইভার অবাক চোখে দুষ্ট চাহনি এঁটে উল্টো দিকে তাকিয়ে মুচকি মুঁচকি হাসে।তারপর বলে,

“যাই মা-আব্বা।তোমাদের জন্যে দোয়া রইলো।”
হৃদয় বলে,
“হ্যাঁ মামা।তারসাথে দোয়া করবেন আমার এই বউটার মনেও যেনো কোনো কষ্ট না থাকে।”

কথার পিঠে ড্রাইভার মৃদু হাসে।তারপর গাড়ি স্টার্ট করে চলে যায়।হৃদয় আমাকে তার দু’হাতের মধ্যে রেখেই সামনে হাঁটা ধরে।গন্তব্য সদর দরজা।সদর দরজার সামনে আসতে হৃদয় এবার আমাকে নিচে নামায়।আমি হৃদয়ের দিকে তাকাই।হৃদয় বলে উঠে,
“সরি বউ!তোমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি।এছাড়া আর উপায় ছিল না।”

বলে হৃদয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।আমি হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম সে আমাকে এখানে এভাবে নিয়ে এসে বেশ খুশি নয়।আমার মতন তারও মনে চাপা ব্যথা।সেও হয়তো চেয়েছিল তার পরিবারের প্রতিটি মানুষ আমাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করুক।কিন্তু ভাগ্য তা আমার সহায় না।দরজা খুললেই কিছু মানুষের দেখা যাবে হাসি মাখা মুখ।আবার কিছু মানুষের রক্তলাল চোখ।হৃদয় কলিংবেল চাপে।কয়েক মিনিট বাদে কেউ ভেতর থেকে দরজা খুলে দেয়।আমি মাথা তুলে তাকিয়ে দেখি হৃদয়ের মা দাঁড়িয়ে। মানে আমার শাশুড়ী মা।আমি দেরী না করে উনাকে সালাম করে উঠি।উনি আমাকে দেখে যেন ভারী খুশি হলেন।চোখমুখ আনন্দে ঝলকে উঠলো।উত্তেজনায় পেছনে তাকিয়ে মুখ ফসকে কিছু বলতে যেয়ে চুপসে যান।আমাদের দিকে ফিরে গলার স্বর নিচু করে,

“বউমা কে নিয়ে ভেতরে যা।তোর বাবা তার রুমের ভেতর আছেন।”

উনার কথায় বুঝতে পারলাম হৃদয় যে আমাকে এখানে নিয়ে আসবে উনি তা আগে থেকেই জানেন।হৃদয় বললো,
“তো কি হয়েছে,মা?বিয়েটা কি আমি লুকিয়ে করেছি যে বাবার ভয়ে বউকে নিয়ে লুকিয়ে থাকবো?আর পারিসা তো খারাপ মেয়ে না।আমি সৎ,নৈতিকতা সম্পূর্ণ একজনকে আমার জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পেয়েছি এটা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।”

হৃদয়ের মার মুখটা আরে উজ্জ্বল হয়ে গেল।তিনি দরজাটা আরো মেলে দেন।হৃদয় আমার ডান হাত ধরে আমাকে ভেতরে নিয়ে যায়।আমি চারপাশে একবার চোখ বুলাই।নিচে তেমন কাউকে চোখে পড়লো না।তবে হ্যাঁ,কিচেনের দরজা বরাবর অল্প বয়সী একটা মেয়েকে দেখলাম।মেয়েটা কি যেন রান্না করছে।দেখেই বুঝা সহজ সে এই বাড়িতে কাজ করে।সে আমাদের দিকে তাকিয়ে চোখমুখ হাতে করে ফেলে।লাফ মেরে বলে উঠে,

“ভাবী আইছে।ভাবী আইছে।”

ওর গলার ধ্বনি খুব উঁচু ছিল,পুরো বাড়িটা যেন বেজে উঠলো।হৃদয়ের মা মেয়েটিকে থামাতে কিচেনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন।কিন্তু উনার চলার গতি হঠাৎ থমকে গেলো বামপাশে তাকাতে।আমি এবং হৃদয় উনার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে সেদিকে তাকাই।তাকিয়ে একজন বুড়া মতন লোক।অবশ্যি বেশি বুড়া না।এই বয়স ৫৬/৫৭ এর মতন হবে।উনি আমাদের দেখে চোখে থাকা চশমা চোখজোড়া থেকে তরতর করে খুলে ফেলেন। কপালের চামড়া ঘন করে চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে আনেন।হৃদয় তা উপেক্ষা করে আমাকে বলে উঠে,

“আমার বাবা।সালাম করো।”

আমি সালাম করে উঠলাম।উনি আমার সালামের জবাব দেননি।সরাসরি হৃদয়ের দিকে তাকান।বলেন,

“এ তোমার বউ?”
“হ্যাঁ,বাবা।”
“অতঃপর আমাদের না জানিয়ে নিয়েই আসলে।”
“উপায় ছিল না।”
“এক্সকিউজ শুনছি না।এনেছো ভালো করেছো।এবার সংসার করো।”

বলে চশমাটা আবারো চোখে এঁটে শক্ত চোখমুখে যে রুম থেকে বেরিয়েছেন সেই রুমে আবার পা বাড়ান।সেকেন্ডের ভেতর রুমে ঢুকে যান।আমাদের সবার চোখের সামনে দরজা ভিড়িয়ে দেন।হৃদয় আমাকে শুধায়,

“রুমে চলো পারিসা।”

রুমে আসতে হৃদয়কে ফ্রেশ হবার কথা বলে বাথরুমে ঢুকি।দরজা চাপিয়ে ফ্লোরের উপর জবুথবু বসে পড়ি।চেপে রাখা চোখের বাঁধ এবার উন্মুক্ত হয়ে যায়।ঝরঝর করে পড়তে থাকে দুই চোখের অশ্রু!বুকের মাঝখানটা ভেঙ্গেচুরে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।আর যে আমি পারছি না,হবে আল্লাহ!কেমন অগ্নি পরিক্ষায় ফেললে তুমি!কি পাপ করেছি!কি পাপ!জীবনটা আমার এতটা সাদা খাতার মতন কেন কিছু লিখতে গেলেই কলমের কালি ফুরিয়ে যায়!ঠায় এভাবে কিছুটা সময় বসে থাকি।হঠাৎ মনে পড়ে হৃদয়কে আমি ফ্রেশ হয়ে আসার কথা বলেছি। এতটা সময় পার হলো হৃদয় ডাকে নি ত?এমন সময় ওপাশ থেকে হৃদয়ের গলার স্বর,

“পারিসা?পারিসা?”

কথার রেশে বুঝা যাচ্ছে আগেও অনেকবার ডেকেছে।আমি নিজেকে ধাতস্ত করার চেষ্টা করি।সর্বশক্তি দিয়ে উঠে দাঁড়াই।মাথার এলোমেলো চুলগুলো কানের দুই পাশে গুঁজে কল ওপেন করি।
মুখে কয়েক কোষ পানি দিয়ে বাথরুম থেকে বের হই।বের হতেই হৃদয় সামনে পড়ে।আমার দুই হাত ধরে ফেলে।

“এতক্ষণ লেগেছে কেন বউ তোমার?কাঁদছিলে তুমি?”
“আরেক নাহ।কাঁদবো কেন!?যান ফ্রেশ হয়ে আসুন।”

বলে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হৃদয়কে পাশ কেঁটে বিছানার দিকে আসি।হৃদয় আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।আমি ফের আবার পেছন ফিরি।বলি,

“এখনো দাঁড়িয়ে আছেন?”

ভাবলাম হৃদয় এবার বাথরুমে ঢুকে পড়বে।তা না করে সে আমার দিকে এগিয়ে আসে।নিষ্পাপ চোখে তাকায় ছোট বাচ্চাদের মতন।
“এই হৃদয়কে তোমার ভরসা হয়না?একটুও ভরসা হয়না?”

ওর ওমন প্রশ্নে ওর চোখের দিকে তাকাই।বলে,
“পারিসা?বাবার ওমন ব্যবহারে আমিও দুঃখিত।বাবার হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।তবে,বাবা আমাদের নিয়ে এই বিয়ের মনোমালিন্যটা দেখো একদিন ঠিকই চুকে যাবে।তোমাকে তার বউমা না শুধু,নিজের মেয়ে বলে কাছে টেনে নেবে।কারণ তুমি লক্ষী মেয়ে।লক্ষী মেয়েদের থেকে কেউ কখনো মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে না।”

বলে হৃদয় আমার গালে আলতো ছুঁয়ে।আবার বলে,
“কেঁদেছিলে এতক্ষণে, না?তুমি বলো নি।কিন্তু দেখো তোমার চোখের ভাষা আমাকে তাই বলে দিচ্ছে।কেনো কাঁদো তুমি?কেনো?কান্নাটা যে হৃদয়ের বুকের মাঝখানটা জ্বলেপুড়ে ছারখার করে দিচ্ছে?শুনো আমার মনোকান্না?কেনো আমাকে কষ্ট দাও!কেনো বউ?কেনো?!”

চোখের অশ্রু চেপে রাখতে পারলাম না।অবাধ্য পানি গড়গড়িয়ে আবারো বেয়ে পড়লো!

চলবে……
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here