আরশি পর্ব ২৪+২৫

#আরশি
#Part_24
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছি সামনের দিকে। কেমন জড়তা কাজ করছে আমার মধ্যে। অস্বস্তি লাগছে। বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে আমার সাথে করা ফাহাদের ব্যবহার গুলো। অহনার প্রতি তার নির্দয়তা। সবকিছু মনে পড়তেই গা আমার রি রি করে উঠে। মনের মাঝে এক তীব্র বাসনা জেগে উঠে, এখন এই প্রহরে এই মূহুর্তে ফাহাদের গালে কষিয়ে এক চড় মারার। তার কাছে প্রশ্ন করার, “ছেড়েই যখন দেওয়ার ছিল তাহলে কেন আমার জীবনের ১০ টা বছর কেড়ে নিল? কেন অহনাকে পিতৃহীন জীবন দিল? কেন? আমার কথা না হয় বাদই দিলাম কিন্তু অহনা? সে কি জানে না, একটি সন্তানের মায়ের ভালবাসা পাশাপাশি তার বাবার ভালবাসাও চাই। মা যতই চেষ্টা করুক সন্তানের বাবা হয়ে উঠার কিন্তু দিন শেষে তো সে মা এই থাকে৷ তাহলে কেন সে বঞ্চিত করলো অহনাকে তার ভালবাসা থেকে? মেয়েটা তো তারই রক্তের। নিজের রক্তকেই বা কিভাবে অবজ্ঞা করলো সে? কিভাবে?”

কিন্তু না! আমি আমার ইচ্ছাটিকে প্রশ্রয় দিলাম না। থাকুক না কিছু প্রশ্ন অজানা। দরকার কি পুরোনো জিনিসকে ঘাটার? আর মোট কথা, এই কথাগুলো যে ফাহদের নিকট অতি তুচ্ছ। বলেও কি আদৌ কোন লাভ আছে? যা হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে। বুক চিরে বেরিয়ে এলো এক গুচ্ছ দীর্ঘ নিঃশ্বাস। আমি পিছে ঘুরে দাঁড়ালাম। এই মানুষটি সামনে থাকতেও গা ঘিন ঘিন করছে। এই মানুষটা নিতান্তই আমার এক কালো অতীতের পৃষ্ঠা মাত্র। যা অতি তুচ্ছ। একে কেন্দ্রবিন্দু করে এত চিন্তা ভাবনার কোন মানেই হয় না। যে আমার জীবনের এক কালো অংশ তাকে নিয়ে মাথা ঘামানো নেহাৎ বোকামি। আমি সামনের দিকে পা বাড়াতে যাব তার আগেই পিছ থেকে ডাক পড়ে,

— এই তুমি আরশি না?

সাথে সাথে আমি চমকে উঠি। বিষ্ময়ে চোখ দুইটি বড় হয়ে আসে। কেন না এই কন্ঠের অধিকারী লোকটিকে যে আমি জানি। এতো সেই যাকে নিয়ে আমি এতক্ষণ জল্পনা-কল্পনায় স্থির ছিলাম। এ যে ফাহাদ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছো সে আমাকে চিনলোই বা কিভাবে? আমি তো উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ঢাকা। গায়ে বোরখা,মাথায় হিজাব আর নিকাব। আমাকে চিনবার তো কথা না। ফাহাদের তো একদমই না। আমার এই ভাবনার মাঝেই ফাহাদ সামনে এসে দাঁড়ায়। সৌজন্য মূলক হাসি দিয়ে বলে,

— হ্যাঁ আরশি এই তো।

আমি চকিতে চাই তার দিকে। বেশ হাস্যজ্বল তার মুখখানি। যা রীতিমতো আমার মধ্যে অস্বস্তি সৃষ্টি করছে৷ আমি বেশ জড়তা নিয়ে বলি,

— আসসালামু আলাইকুম!

ফাহাদ আমার কথা শুনে কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ পর ঠোঁটের কোনে সেই মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বলে,

— ওয়ালাইকুম আসসালাম।

অতঃপর দুইজনের মাঝে নীরবতা। আমার মধ্যকার অস্বস্তি ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে আসছে। গা রি রি করছে। ক্ষোভে দুঃখে আমি নিজের হেদায়েত-জ্ঞান সব হারাচ্ছি। বিগত ১০ বছর ৫ মাসেরও অধিক সময়ের পুষে রাখা জীদগুলো যেন বেড়িয়ে আসতে চাইছে। হয়তো কোন ফাঁকফুকুর পেলে ঠিকই বেড়িয়ে এসে সামনের মানুষটি ভস্ম করে দিবে। কিন্তু না! তা তো হওয়া দেওয়া যাবে না। এমনটা হলে সামনে থাকা ব্যক্তিটি আমার রাগকে আমার দূর্বলতা ধরে নিবে। এমনটাই ধারণা করে নিবে আমি তার ছাড়া একদম অচল। সে ছেড়ে দিয়েছে বিধায় আমি নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি। কিন্তু এইটা তো সত্য না। সবসময় সব জায়গায় রাগকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়। আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে সংযত করছি। যতটা সম্ভব মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করছি। ঠিক এমন সময় ফাহাদ নীরবতা পেড়িয়ে বলে উঠে,

— তা কেমন চলছে দিন কাল?

আমি যতটা সম্ভব শীতল কণ্ঠে বলি,

— আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

ফাহাদ এইবার একটু তাচ্ছিল্যের সুরেই বলে উঠলো,

— থাকছো কোথায়? কোথাও কি ঠাই হয়েছে? নাকি দ্বিতীয় বিয়ে করে নিয়েছ?

কথাটা কর্ণপাত হতেই রাগে আমার শরীর জ্বলে উঠে। হাত দুইটি মুষ্টি বদ্ধ হয়ে আসে। আমি রক্তিম চোখে তাকাই ফাহাদের দিকে। কিছু কড়া কথা মুখ দিয়ে বেড়িয়ে আসতে নিলে মামার একটি কথা টনক নাড়ে, “রেগে গেলে তো হেরে গেলে৷ রাগ বিষয়টা হচ্ছেই মূল্যহীন। তো সেটা কখনো নিজের উপর ভারী হতে দিবি না। মাথা ঠান্ডা রেখেও কিন্তু কড়া কথা শুনানো যায়। আর ঠান্ডা মাথায় বলা কথার ধার বেশি৷ এতে সহজেই প্রতিপক্ষকে বিপর্যস্ত করা যায়।” কথাটা মনে হতেই আমি চুপ বনে যায়। দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে শান্ত কন্ঠে বলি,

— সকলে আপনার মত হয় না মি. ফাহাদ হোসেন। তাই সকলকে নিজের মত ভাবা বন্ধ করুন।

— হুম তাও ঠিক। যার যার যে স্বভাব। যেমন তোমার! আগেও এমন ছিলে, এখনো তেমনই আছো। মিডেলক্লাস!

— তা এই মিডেলক্লাস মেয়েকে এক দেখায় চিনে গেলেন কিভাবে? আমার মতে আমি তো আপনার স্মৃতি ক্ষুদ্র অংশটুকুতে জায়গা পাওয়ার যোগ্য নয়। তাহলে?

ফাহাদ আমার কথা ভড়কে উঠে। কিছুক্ষণের জন্য তব্দা মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয় আমার দিকে। হয়তো সে এই প্রশ্নটা আশা করে নি অথবা প্রশ্নটা শুনে সেও হতভম্ব। আমি তা দেখে বলি,

— আপনার কি আর কিছু বলার আছে? আমার আবার একটু তাড়া আছে।

ফাহাদ এইবার ফুঁসে উঠে বলে,

— আমাকে দেমাগ দেখাচ্ছ?

আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলি,

— সে যোগ্যতা আমার নেই।

— কি বুঝাতে চাইছো?

— তার কৈফিয়ত আমি আপনাকে দিতে বাধ্য নই। এখন সরুন যেতে দিন। দেরি হচ্ছে আমার।

ফাহাদ হয়তো কিছু বলতে নিচ্ছিল কিন্তু তা তোয়াক্কা না করে পাশ কাটিয়ে চলে আসি। অসহ্য লাগছে লোকটাকে। খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে তাকালাম একবার৷ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সামনের দিকে পা বাড়ালাম। মনে মনে বললাম,

— আপনি সত্যি বাবা হওয়ার যোগ্য না। স্বামী তো হতে পারেনই নি, সেই সাথে না একজন বাবা হতে পেরেছেন। একবারের জন্যও জানতে চাইলেন না অহনা কেমন আছে। যতটুকু সময় ছিলাম ততটুকু সময় কম ছিল এই ছোট প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করার জন্য? ধিক্কার জানাতেও ইচ্ছা করে না আপনাকে। কেন না এতে ওই শব্দটিকেই অপমান করা হবে। আপনি তো আমার ঘৃণার ও যোগ্য না।

______________________

রাত প্রায় নেমে এসেছে। চারদিকে অন্ধকারে হাতছানি। শা শা করে তীব্র বাতাস বইছে। ফাহাদ বাসের সিটে গা এলিয়ে দিয়ে সেই বাতাসের স্বাদ গ্রহণ করছে। সেই বিকেল থেকেই মনের মাঝে ঘাপটি মেরে বসে আছে একটি তিক্ত প্রশ্ন। যার উত্তর সে কোন ভাবেই মিলাতে পারছে না। বার বার বিরবির করে উঠছে সে, ” আসলেই কিভাবে আমি এক দেখায় আরশিকে চিনলাম? ওকে তো চিনার কথা নয়। তাহলে? ” কিন্তু উত্তরটা যে তাকে ধরা দিতে নারাজ।

ব্যাংকের কাজে ঢাকা এসেছিল সে। দু’দিন যাবৎ ধরে এইখানেই আছে। আজ অবশেষে ফিরে যাচ্ছে। তা সে ফিরে যাওয়ার আগে ভাবলো ঢাকা থেকে জুঁই আর আগন্তুক বাচ্চাটির জন্য কিছু কেনা কাটা করা যাক। সেই চিন্তা ধারাই মাথায় স্থির রেখে ছুটেছিল মার্কেটের দিকে। মার্কেটিং করার এক পর্যায় বোরকা পরিহিত এক নারীকে দেখে হঠাৎ তার টনক নেড়ে উঠে যে, “এইটা আরশি।” কেন মনে হলো জানে না সে। তাই সে কনফার্ম করার জন্য এগিয়ে যায়। আর এর পরবর্তীর কাহিনী তো সকলেরই জানা।

ফাহাদ নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করেই চলেছে এই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের সামান্য উত্তর পাবার জন্য। কিন্তু সে যে প্রতিবার ব্যর্থ হচ্ছে। অবশেষে নিজের সাথে আর না পেরে সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে এই যুক্তি পেস করে,

— আরশির সাথে আমি ১০ বছর থেকেছি। এত কাছ থেকে দেখেছি ওকে, চেনাটাই তো স্বাভাবিক ব্যাপার। হুদাই ফাও একটা প্রশ্নের পিছে এতটা সময় ব্যয় করলাম আমি। ডিসগাস্টিং!

বলেই চোখ খুলে তাকালো সে। জানালার বাইরে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় সে। আনমনে কি যেন ভাবে। হঠাৎ মনের মাঝে ছোট একটি নাম উঁকি দিয়ে যায়। অহনা! নামটা মনের মাঝে আসতেই ফাহাদের ভ্রু কুটি কুঞ্চিত হয়ে আসে। সে বিরবির করে উঠে,

— অহনা! সে কেমন আছে?

অতঃপর আর কিছু ভাবনা মনের মাঝে বিচরণ করতে দিবে তার আগেই ফাহাদের মুঠোফোনটা বেজে উঠে। সে চকিতে চায়। মুঠোফোনটা বের করে দেখে জুঁই ফোন করেছে। ফাহাদ সকল চিন্তা-ভাবনা ফেলে ফোন তুলে। মুহূর্তেই তার মন-মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়েই যায় সেই দুটি নাম। অহনা আর আরশি। হারিয়ে যায় নিজের ফোনালাপের গহীনে।

___________________________

সময় যে কিভাবে কিভাবে গড়িয়ে যায় তা বুঝাই যায় না। নদীর স্রোতের ন্যায় সে অতিবাহিত হতেই থাকে। ফাহাদের সাথে আমার সাক্ষাৎ এর আজ দুই সপ্তাহ কেটে গেল। এতে যে আমার মধ্যে প্রভাব ফেলেছিল বা আমার মধ্যে কোন ছাঁপ ফেলেছিল তা কিন্তু নয়। বরং বেশ সাচ্ছন্দ্যেই ছিলাম আমি। নিজেকে সেইদিনের পর হালকা লাগছিল। হয়তো মনের কিছুটা ঝাঁজ মিটাতে পেরিছিলাম বলে। ফাহাদকে দেখাতে পেরেছিল যে আমি অসহায় নই। সকলের এই সময় আসে নিজেকে প্রুভ করার। হয়তো আমিও সেইদিন এই সুযোগটাই পেয়েছিলাম।

নিজের ব্যাগ গুছাচ্ছি আর টাইম দেখছি। রাত সাতটার বেশি বাজে। কাজের চাপ আজকে বেশি হওয়ায় লেট হয়ে গেল। ইতিমধ্যে মোহাম্মদপুর যাওয়ার শেষ বাসটি ছেড়ে দিয়েছে। এখন বাসায় যেতে হলে রিকশা ছাড়া গতি নেই। আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বের হতে যাব এমন সময় কানে কিছু শব্দ এসে বারি খায়। আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। সর্তক দৃষ্টিতে চারদিকে চোখ বুলাই। আমি যে ফ্লোরে কাজ করি সেই ফ্লোর এখন পুরো ফাঁকা। অফিস আওয়ার শেষ প্রায় দেড় ঘন্টা আগে। যে যার মত চলে গিয়েছে। আর যারা ওভারটাইম করার জন্য ছিল তারা গিয়েছে উপরের তালায়। কি যেন ঝামেলা হয়েছে। সেটাই দেখতে গিয়েছে। শব্দটা আবার এসে বারি খেল কানে। আমি এইবার একটু চমকে উঠে। আশেপাশে ভালো মত তাকাই। ভয় না করলেও মনের মাঝে জন্ম নিচ্ছে সংশয়। বেশ কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারি শব্দটা সাদের কেবিনের থেকে আসছে। কিন্তু সাদের তো এইসময় থাকার কথা না। সে তো দুপুরের লাঞ্চ টাইমের আগেই বেড়িয়ে পড়েছিল আর আসে নি। যার জন্য আমার কিছু কাজ পেন্ডিং এ পরে গিয়েছে। যেহেতু সাদ অফিসে নেই সেহেতু সাদের কেবিনে কে? আর যেই বা আছে তার কোন অনৈতিক উদ্দেশ্য নেই তো? আমি পা টিপে টিপে সাদের কেবিনের দিকে যাই। যাওয়ার পথে চোখে সাইডে ফ্লোর ক্লিনিং স্টিক দেখে দাঁড়িয়ে পড়ি। হয়তো পিওন দাদা ফ্লোর মুছার পর এইটা সরাতে ভুলে গিয়েছেন। আমি দ্রুত সেটা হাতে নিয়ে নেই আর সাদের কেবিনের দিকে এগিয়ে যায়। এইদিকটার লাইট ডিস্টার্ব করছে। বার বার অন অফ হচ্ছে। পুরাই ভুতুড়ে পরিবেশ লাগছে। যার ফলে ভয় নামক জিনিসটি বাসা বাঁধছে মনে। আমি দরজার সামনে যেতেই ক্যাঁচ করে দরজা খুলে কেউ বেড়িয়ে আসে৷ আমি তা দেখে ভয়ে হাতে থাকা স্টিকটা দিকে সামনের মানুষটির দিকে আঘাত করি। সাথে সাথে ভেসে আসে এক চিৎকার…

#চলবে#আরশি
#Part_25
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

দরজার সামনে আসতেই ক্যাঁচ করে দরজা খুলে কেউ বেড়িয়ে আসে৷ আমি তা দেখে ভয়ে হাতে থাকা স্টিকটা দিকে সামনের মানুষটির দিকে আঘাত করি। সাথে সাথে ভেসে এক চিৎকার,

— আরেহ ভাই! করছো টা কি?

আমি সাদের গলা শুনে চোখ খুলে তাকাই। আঘাত করার সময় আমি চোখ বন্ধ করে নিয়েছিলাম। লাইট বার বার অন অফ হচ্ছে। সেই লাইটের আলোয় আমি সামনে তাকিয়ে দেখি সাদ বা হাত দিয়ে স্টিকটা ধরে আছে আর আমার বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি সাদকে দেখে বুক ভরা নিঃশ্বাস নেই। হাতের স্টিকটা নিজের দিকে ফিরিয়ে এনে ইতস্তত সুরে বলি,

— তুমি এইখানে করছো?

সাদ সরু চোখে তাকিয়ে বলে,

— এই একই প্রশ্ন আমার তোমাকেও করতে ইচ্ছে করছে। তুমি এইখানে কি করছো?

— কাজ করছিলাম। কাজের চাপ বেশি থাকায় আজ লেট হয়ে যায়। এখন চলেই যাচ্ছিলাম, কিছু আওয়াজ শুনে দাঁড়িয়ে যাই। তোমার কেবিন থেকেই আওয়াজ আসছিল। তুমি তো সেই দুপুরে বেড়িয়েছিলে এরপর তো আসো নি। তাই ভাবলাম কে না কে।

সাদ আমার কথা শুনে হেসে বলে,

— তো তুমি ভেবেছ চোর ঢুকে পড়েছে আমার কেবিনে তাই তো? তা ওই চোর তাড়ানোর দায়িত্ব বুঝি তুমি নিয়েছিলে? নাইট শিফট করছ নাকি?

সাদের কথা শুনে আমি ফুঁসে উঠে বলি,

— মজা হচ্ছে?

— কি যে বলো না। মশকরা করিলে বুঝি আমার গর্দান যাইবে না? ইহা জানিবার পরও আমি কিভাবে এই দুঃসাহস দেখাই?

— ইউ আর টু মাচ।

— থ্যাংকস ফোর দ্যা কমপ্লিমেন্ট।

আমি কিছু না বলে আড় চোখে তাকাই। পাশে গিয়ে ফ্লোর ক্লিনিং স্টিকটা দেয়ালের সাথে কাত করিয়ে রেখে দেই। সাদের দিকে আসতেই বলি,

— তুমি কি অফিসেই ছিলে নাকি? কিন্তু তোমার দেখা তো সেই দুপুর থেকেই নেই।

সাদ নিজের কাঁধের ব্যাগ ঠিক কর‍তে করতে বলে,

— আরেহ জানোই তো অফিসের উপরের ফ্লোরে কিছু ঝামেলা হয়েছে। কিছু হিসাবে আর ফাইলে গড়মিল ছিল বিধায় এই ঝামেলাটা ক্রিয়েট হয়েছিল। তো এমডি স্যার এইটা সমাধানের জন্য মিটিং ডেকেছিল। সব সেকশনের মেনেজারদের নিয়ে। দুপুর থেকে সেখানেই ছিলাম। আমাদের মধ্যকার প্রবলেম সলভ হলেও কলিগদের মধ্যে একটা ঝামেলা রয়েই যাই। যা এখনো চলছে।
আমাদের মিটিং কিছুক্ষণ আগেই শেষ হলো। তো নিচে এসেছিলাম নিজের ব্যাগ নিতে। ব্যাগ নিয়ে যেই না বের হতে যাব তখনই এক বুনো বিড়াল ঝাঁপিয়ে পড়লো।

শেষের কথাটা বলেই সাদ ঠোঁট টিপে হাসে। আমি শুধু আড়চোখে তাকাই। এই ছেলে জীবনেও শুধরাবে না। সারাজীবন আমাকে পিঞ্চ করেই যাবে৷ আমি কিছু না বলে সামনের হাঁটা দেই। সাদ তা দেখে দৌড়ে আমার পাশে এসে হাটতে শুরু করি। অতঃপর সন্দিহান সুরে বলে,

— মাননীয় দর্পণ বুঝি আমার প্রতি রুষ্ট হয়িয়াছে? যদি তাহি হইয়া থাকে তাহলে এই অধম খুবই লজ্জিত তাহার কাজে। কিন্তু কৃপা করিয়া শাস্তিস্বরূপ এই অধমের গর্দান চাহিবেন না। ইহা আমার বিনীত অনুরোধ।

সাদের কথা শুনে আমি ফিক করে হেসে দেই। সাদ আমার হাসির শব্দ শুনে বলে,

— হেসেছে তো ফেসেছে।

আমি কিছু না বলে মুচকি হাসি। লিফটের সামনে এসে আমি বলি,

— বাসায় এসো একবার। অহনা বেশ কয়েকদিন ধরে তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল।

— তাহলে আজকেই চলি। শুভ কাজে দেরি করতে নেই।

বলে একগাল হাসলো। আমি মাথা নেড়ে বলি,

— আচ্ছা চলো।

— তা একসাথেই যাই?

আমি কিছু একটা ভেবে বলি,

— আচ্ছা চল।

_________________________

বাইক চলছে আপন গতিতে। আমি পিছনের দিকে চেপে বসে আছি। শক্ত করে সিটটা ধরে বসে আছি। বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পর আমি আনমনে সাদকে জিজ্ঞেস করে বসি,

— তুমি বাইক কবে থেকে চালাও?

— ৪ বছর হবে আরকি। জয়নিং এর ১ বছর পর কিনেছিলাম আরকি।

— অহহ আচ্ছা।

— আমি ইচ্ছা ছিল একবারে গাড়ি কিনবো কিন্তু কেনা হলো না। অবশ্য এখন ইচ্ছাও নেই আর।

— কেন কিনতেই তো পারো। স্যালারি তো ভালোই পাও।

— টাকার বিষয় না আসলে। বাইকটার সাথে অনেক ছোট খাটো স্মৃতি মিশ্রিত আছে। একজনের শেষ স্মৃতিও এইটা। তিন্নির স্মৃতি। মেয়েটার বাইকে চড়ার অনেক শখ ছিল। আমার সাথে রাতের আঁধারে বাতাসের গতিতে ছুটে চলার তীব্র বাসনা ছিল তার। তার ইচ্ছা পূরণ করার জন্যই বাইকটা কেনা।

তিন্নির কথা শুনে আমি চট করে প্রশ্ন করে বসি,

— তিন্নি কোথায় সাদ? এতদিনের পরিচয়ে আমি কখনো ওকে সামনাসামনি দেখি নি। আর না তুমি কখনো ওর বিষয়ে তেমন কথা বলেছ, আর না আমি বলেছি। তাই ওর সম্পর্কে জানাই হয় নি। কোথায় ও?

সাদ স্মিত হেসে বলে,

— সে তো এখন দূর আকাশের শুকতারা। সাথেই আমার ছোট পরীটাও।

আমি বিষ্ময়কর কন্ঠে জিজ্ঞেস করি উঠি,

— মানে?

— ২ বছর আগে একটা রোড এক্সিডেন্টে তিন্নি মারা যায়। সাথেই মারা যায় আমার সাত মাসের অনাগত সন্তানও।

কথাটা কর্ণপাত হতেই আমার বুক মোচড় দিয়ে উঠে। মস্তিষ্ক নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি সাদের পিছনের দিকে। সাদের মুখমন্ডল আমার দৃষ্টির অগোচর হলেও বুঝতে পারছি যে, তার চেহেরায় ভেসে উঠেছে এক রাশ বিষন্নতা। মনের মধ্যে সাদ আর তিন্নির কাহিনী জানার তীব্র ইচ্ছা জাগ্রত হলেও তা প্রকাশ করার সাহস হলো না। কিছুক্ষণ পর সাদ নিজ থেকেই বিষাদ ভরা কন্ঠে বলতে শুরু করে,

— আমার বাবা নেই জানোই তো। ছোট থেকে মা এই আমার সব। তো মা একদিন এসে বললেন তার একটা মেয়েকে খুব পছন্দ। নাম তিন্নি। সে চায় আমি যাতে তিন্নিকে বিয়ে করি। তখন সবে মাত্র আমি জবে ঢুকেছি। আমার কোন পছন্দ না থাকায় মায়ের প্রস্তাবে রাজী হয়ে যাই। তার কিছুদিন পরেই খুব সাদামাটা ভাবে আমাদের বিয়ে হয়। বলা বাহুল্য, তিন্নি এতিম ছিল। তার আপন বলতে কেউ ছিল না। সেই সাথে আমারও তেমন কোন আত্নীয়স্বজন ছিল না। বলতে গেলে থেকেও নেই। তাই বিয়েটা আমরা জাঁকজমকপূর্ণ করার তেমন ইচ্ছেও জাগে নি। বিয়ের পর তিন্নি সবাইকে একদম আপন করে নেয়। তিন্নি মেয়েটাই এমন ছিল যে মুহূর্তেই সকলকের সাথে একদম মিশে যেত। সাথে খুব সহজ মনের মেয়ে ছিল। ভিতরে যা বাইরেও তা। কিন্তু অভিমানিনী ছিল খুব। মুখ ফুটে কিছু না বললেও ভিতরে ঠিকই অভিমানের পাহাড় জমিয়ে ফেলতো। আর এই অভিমানিনীর ভালবাসায় মগ্ন ছিলাম আমি। সময়ের সাথে ওকে এতটা ভালবেসে ফেলেছিলাম যে ওকে ছাড়া নিজেকে কল্পনাও করা দুষ্কর ছিল আমার জন্য। আমাদের বিয়ের ২ বছরের মাথায় যখন জানতে পারি আমি বাবা হতে চলেছি তখন নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি মনে হয়েছিল। খুশির আবেশে আমি প্রায় কেঁদেই দিয়েছিলাম। এরপর পুরো মহল্লায় মিষ্টি বিলিয়ে ছিলাম।
এই ঘটনার এক মাসের মাথায় আমার প্রোমোশন হয়। কাজের চাপ বাড়ে। তিন্নিকে ঠিক মত সময় দিতে পারতাম না। তাও যথাসাধ্য চেষ্টা করতাম যতটা সময় অবসর পাই তাকে দেওয়ার। দেখতে দেখতে কেটে যায় সাত মাস। আসে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দিন সেইদিন ও ডাক্তারের কাছ থেকে চেকাপ করে আসছিল। আমার কাজের চাপ ছিল বিধায় আমি ওর সাথে যেতে পারি নি। মাও তখন অসুস্থ ছিলেন। তাই সেও যেতে পারে নি। তিন্নি যখন রাস্তা পার হতে যাবে তখন কোথ থেকে যেন দ্রুত গতিতে একটি কার আসে। আর মূহুর্তেই তিন্নিকে ধাক্কা মেরে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। তিন্নি অন দ্যা স্পট মারা যায়। রাস্তায় পড়ে থাকে তার লাশ। সেই সাথে আমার অনাগত বাচ্চাটিরও।

এতটুকু বলে সাদ থামে। ওর কন্ঠ স্বর ভেজা ভেজা লাগছিল। মনে হচ্ছিল যেন সে আর কথা বলতে পারছে না। আটকে আসছে তার কথা। আমি চুপটি মেরে বসে রই। নিজের মধ্যেও চাপা এক কষ্ট বিরাজমান করছিল। আমার শুনেই কষ্ট লাগছে না জানি সাদের অনুভূতি ঠিক কেমন। একটু পর সাদ বলে উঠে,

— তিন্নির লাশের পাশে পড়েছিল একটা রিপোর্টে। আল্ট্রাসোনোগ্রাফির রিপোর্ট। রিপোর্টে ছিল যে, আমার অনাগত সন্তানটি ছিল এক পরী। যে নাকি আমার ঘর উজ্জ্বল করতে এসেছিল। যখন রিপোর্টটা দেখি তখন আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কি বলে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করবো তাও ভুলেও গিয়েছিলাম। শুধু এক ধ্যানে তাকিয়ে ছিলাম সেই রক্তমাখা রিপোর্টটির দিকে। জানল আমি সর্বদাই মেয়ে চেয়েছিলাম। প্রত্যেক নামাজের মোনাজাতে আল্লাহ এর নিকট এক পরী চেয়েছিলাম। তাই হয়তো আল্লাহ আমায় এক পরী দিয়েও ছিল কিন্তু তাকে আমায় আগলে রাখার তৌফিক দেননি৷ তাকে ধরে ক্ষমতা দেন নি।

বলে সাদ চুপ হয়ে যায়। নিরব হয়ে যাই আমিও। কিছুই যে নেই বলার আমার। নিজের অজান্তেই হয়তো কষ্ট দিয়ে ফেলেছি ছেলেটাকে। পুরনো জখম খুঁড়ে তাজা করে দিয়েছি। অনুতাপের আগুনে জ্বলছি আমি। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছি না। ক্ষণিকের মাঝেই আমরা আমার বাসার সামনে এসে পড়ি। আমি চুপচাপ নেমে পড়ি। সাদ আমার দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলে,

— তুমি যাও। আমি অন্য কোন একদিন আসবো নে।

কথাটা বলেই সাদ বাইক স্টার্ট দেয়। আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে সে শা শব্দ করে টান দিয়ে বাইক নিয়ে চলে যায় সে। আর আমি নিষ্পলকভাবে তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রই। ক্ষণেকের মাঝে বুক চিরে বেড়িয়ে আসে এক মুঠো দীর্ঘ নিঃশ্বাস।

#চলবে

ছোট পর্ব দেওয়ার জন্য দুঃখিত। কিন্তু লিখার মত আর সময় নেই আমার কাছে। পড়া বাদ দিয়ে গল্প লিখতে বসেছি😑 অনেক পড়া বাকি এখনও। তাই চেয়েও পর্ব বড় করতে পারলাম না।

কালকে গল্প দেওয়া হবে। তাই আজকে ছোট হয়েছে বলে চেঁচাতে হবে না। তারপরও চেঁচালে কিন্তু কালকে গল্প দেওয়ার প্ল্যান ক্যান্সাল।😑😑

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here