আলোছায়া পর্ব -১০+১১

#আলোছায়া
পার্ট -১০
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল

মিতালি প্রায় দিন এখানে ঘুরতে আসে বিকালে, যখন কথা হতো তখন মিতালিই বলেছিলো। ওদের পাড়াতে আমি আগে কখনো যাইনি, সেদিনই প্রথম গেছিলাম সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য, মনে মনে কত কিছু ভেবেছিলাম, মিতালি কতোটা খুশি হবে আমাকে দেখে, ভাবতেই মনটা আনন্দে ভরে উঠছিলো।
আনন্দগুলো বড্ড ক্ষীণ স্হায়ী হয় মিরা। সেদিন পার্কে মিতালিকে খুঁজতে খুঁজতে একটু নির্জন জায়গায় চলে গেছিলাম। পরে ভাবলাম এখন ফাঁকা জায়গায় মিতালি আসবে না, তাই ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই চোখে পড়লো একজন পুরুষ কোনো রমনীর কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, শাড়ি আঁচল দিয়ে হাত ঢেকে গেলেও গাছের পাশ দিয়ে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, প্রথমে মনে করেছিলাম হয়তো কেউ একান্ত সময় কাটাচ্ছে, আমার এসব দেখা উচিত না কিন্তু পরবর্তীতে দেখলাম ওইটা মিতালি। মিতালি আমাকে দেখে চমকে গেলেও নিজেকে সামলে প্রশ্ন করলো, ” আশরাফুল তুমি এখানে কেন?”

আমি শান্ত গলায় জবাব দিলাম, ” তোমার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। ”

মিতালি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। মিতালির সাথের ছেলেটা দৌড়ে আমাকে মারতে আসলো আমার শার্টের কলার চেপে ধরে বললো, ” তোর এতো সাহস যে আমার বউয়ের সাথে দেখা করতে আসিস?”

আমি মুচকি হেসে বললাম, ” আর যাই হোক মিতালি আপনার স্ত্রী নয়। কেউ স্ত্রীকে নিয়ে পার্কের নির্জন জায়গায় নোংরামি করে না। ”

কথাগুলো বলে লোকটার হাত শার্ট থেকে সরিয়ে নিলাম। আর মিতালিকে প্রশ্ন করলাম, ” কে এই ছেলেটা?”

মিতালি ভিতু গলায় বললো, ” এটা আমার কাজিন। ”

ছেলেটা মিতালির উপর চিৎকার করে বলে উঠলো, ” সময় করে হোটেলে যেতে পারো না নাগর সামনে এলে কাজিন। ”

আমার কিছু বুঝতে বাকি রইলো না। চুপচাপ চলে এলাম। শরীরটা কেমন যেন অবশ হয়ে আসছিলো। মিতালি এমন হতে পারে বা এমন করতে পারে আমি কখনো বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম মিতালি আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, নিজের ভুল বুঝতে পারবে। মিতালি একবার আমার কাছে ফিরে আসলে আমি সবকিছু ভুলে ও-কে নিজের করে নিতাম কিন্তু এমনটা হয়নি। ওই দিনের পর আরো সাতদিন কেটে গেলো। মিতালি আমাকে কোনো প্রকার কল বা এসএমএস দেয়নি। ওই সময়টাতে মিতালিকে ছাড়া আমি কোনো কিছুই ভাবতে পারতাম না। তাই নিজেই বেহায়ার মতো মিতালি কে কল দিলাম।

–” মিতালি কেমন আছো?”

–” অনেক বেশি ভালো আছি। শোনো আশরাফুল তুমি আমার সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি, তোমাকে নয়। ”

–” এতোদিন কি বলেছিলে আমাকে?”

–” তুমি কষ্ট পেতে একা একা তা-ই সহানুভূতি দেখিয়েছিলাম। ”

–” এখন কি আমি কষ্ট পাচ্ছি না?”

–” জানি না। তোমার এতো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় আমার নেই। ”

–” কেন এমন করলে? এটা শেষ প্রশ্ন। ”

–‘ কতদিন হয়ে গেছে তোমার কোনো চাকরি হয়নি। তুমি আমাকে সামান্য একটা মোবাইল কিনে দিতে পারো না, আর ওই ছেলে আমাকে আইফোন কিনে দিয়েছে। আমি ও-র সাথেই খুব সুখী। আমি ও-কে বিয়ে করবো। ”

–” যে ছেলে তোমাকে বিয়ের আগে হোটেলে নিয়ে যায় সে তোমাকে বিয়ে করবে বলে তোমার মনে হয়?”

–” তুমি কে এতো কথা বলার? আর কখনোই আমাকে বিরক্ত করবে না। ”

মিতালি সেদিন কল কেটে দেয়। এরপর হাজার বার ও-র সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। আমাদের বিয়ের সাতদিন আগে মিতালি আমাকে ডেকে পাঠায়৷ জানি না কেন তখন এতো পাগল ছিলাম। মিতালির ডাকে ছুটে গেছিলাম ওর কাছে। ভেবেছিলাম হয়তো মিতালি ও-র ভুল বুঝতে পেরে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, আমাকে আবার আগের মতো ভালোবাসবে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। মিতালি ওইদিন আমাকে ডেকে নিয়ে ও-র বয়ফ্রেন্ড আর কিছু ছেলেদের দিয়ে আমাকে মারে, একদম মেরেই ফেলতে চাইছিলো কিন্তু পরে কি মনে করে আর মারেনি৷ যাওয়ার আগে ওয়ার্নিং দিয়ে গেলো জানি মিতালিকে বিরক্ত না করি। তাহলে পরের বার আমাকে মেরে ফেলবে। মিতালিও আমাকে অপমান করতে ভোলেনি। সবার সামনে বললো, ” তোর মতো একটা ছোটলোক আমার পিছনে কি করে আসতে পারে। আমার রূপ দেখেছিস তুই? এই রূপের যোগ্য তুই না। একটা চাকরি খুঁজে পায় না আসে আমার সাথে লাইন মারতে। ফাউল পোলাপান। ”

মাটিতে শুয়ে ছিলাম কিছু সময়। উঠায় শক্তি ছিলো না। যে মিতালি ভেঙে যাওয়া আমিকে জোড়া লাগিয়েছে, আমি সামান্য ব্যাথা পেলে যে ব্যাকুল হয়ে যেতো আজ সে নিজে দাঁড়িয়ে আমাকে মার খাওয়ালো। কতোটা বদলে যায় মানুষ। এরপর কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। পরে রাস্তার লোকজন তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলো। বাড়িতে কল দিয়ে বলছিলাম আমি অফিসের কাজে বাইরে আসছি। ওদের টেনশনে রাখতে চাইনি। সাতদিন পর হাসপাতাল দিয়ে বাড়ি ফিরে জানতে পারি সেদিন নাকি আমার বিয়ে। অনেক ঝগড়া করেছি, কিন্তু আব্বু কিছু শুনতে চায়নি। পরে ভেবেছিলাম কার জন্য বসে থাকবো, বাড়ির লোকের মনে কষ্ট দিয়ে কি লাভ! তাই ওদের সাথে গেছিলাম। বিয়ের আগে তোমার সাথে অনেক দেখা করার চেষ্টা করেছি, কথা বলতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি।

মিরার মনে পড়ে সেদিন আশরাফুল অনেকবার বলেছিলো আমি একটু পাত্রীর সাথে কথা বলবো কিন্তু রোজিনা রেণু উত্তরে বলেছিলো বিয়ে হলে সারাজীবন কথা বলতে পারবে।

আশরাফুলের চোখের কোণ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে, এক হাত দিয়ে পানি মুছে আবারও বলতে শুরু করে,

বিয়ের দিক সব থেকে বড় ধাক্কা খেয়েছিলাম তোমাকে দেখে, কারণ তোমাকে দেখতে একদম মিতালির মতো। একটা পার্থক্য আছে বটে কিন্তু সেদিন অতো খেয়াল করিনি। আমি জানি না আমার জীবনটা কেন এমন হলো। বাসরঘরে তোমাকেই মিতালি ভেবেছিলাম, পরে জানলাম তুমি অন্যকেউ। শেষ কথাগুলো বলতে কন্ঠ জড়িয়ে আসে। আশরাফুল উঠে দাঁড়ায়, মিরার কেন জানি বড্ড কষ্ট হচ্ছে আজ। যে মানুষটা এতোদিন দোষী ভেবে এসেছে আজ তার জীবন কাহিনী মিরাকে বড্ড আঘাত করছে। মিরা আর সহ্য করতে পারে না। আশরাফুলকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দেয়। আশরাফুল একটু অবাক কিন্তু কিছু বলে না। মিরার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে, প্রথম কোনো পুরুষের এতোটা কাছাকাছি এসেছে মিরা, আশরাফুলের উষ্ণতা অনুভব করছে তবে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। মিমিট পাঁচেক পর মিরা বুঝতে পারে এমনটা করা উচিত হচ্ছে না। তবুও আশরাফুলকে ছেড়ে দেয় না, জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। আশরাফুল নিজেই মিরার দুই বাহু ধরে মিরাকে মুক্ত করে নিজের বুকের উপর দিয়ে, তারপর দুইহাত দিয়ে মিরার দুই কপল মুছে দেয়। চোখের পানিতে গাল ভিজে একাকার হয়ে গেছে মেয়েটা।

শান্ত গলায় বলে, ” অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তাই না?”

মিরা মাথা নাড়িয়ে না বলে, তারপর কান্না জড়িত কন্ঠে প্রশ্ন করে, ” আপনি কেন কাঁদছেন? সেঁজুতি কথা বলার সময় তো কাঁদতে দেখিনি। ”
আশরাফুল হাসে, তারপর বলে, ” বেইমান দের জন্যই আমি বেশি কষ্ট পাই। চোখের পানি বেইমানরা বেশি ঝরায়। তাদের জন্য তেমন কষ্ট হয় না যারা আমাদের সত্যিকারের ভালোবাসে। আমিও ব্যতিক্রম নই রে। ”

মিরা কিছু বলতে পারে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আশরাফুল ছাঁদ থেকে নেমে নিচে চলে যায়। চারদিকে তখন অন্ধকারে ভরে গেছে, কখন সন্ধ্যা নেমেছে মিরা জানে না। ধীর পায়ে ঘরে চলে যায়। সবকিছু এলোমেলো লাগছে না, মিরা যাকে সব থেকে বেশি ঘৃণা করে সে-ই মানুষটার জন্যই কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। এতোটা কষ্ট পেয়েও ছেলেটা কত সুন্দর হাসে। মিরা কি পারতো এমন হলে ঘুরে দাঁড়াতে? আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় মিরা, মিতালিকে তার মতে দেখতে কেন? সে কি অন্য রকম হতে পারতে না। আশরাফুল মিরাকে দেখলে কেন ঘৃণা জন্ম নিবে, আকাশ পাতাল ভাবতে থাকে মিরা।

জানালায় উপর একটা সাদা কাগজ পড়ে আছে। হয়তো অচেনা লোকটা চিঠি দিয়েছে, আজ মিরা চিঠির প্রতি আর্কষণ অনুভব করে না, তবুও গিয়ে চিঠিটা হাতে তুলে নেয়। অন্য কেউ দেখলে আবার কি সমস্যা হয়!

চিঠিটা পড়তে ইচ্ছে করছে না মিরার, বালিশের নিচে রেখে দেয়। কিছু সময় একা একা কাঁদতে থাকে। তারপর স্বাভাবিক হয়ে হাত মুখ ধূয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। বেশ রাত হয়ে গেছে সবাইকে খেতে দিতে হবে, সেদিন খাবার টেবিলে আশরাফুল আসে না। মিরা সাহস করে আশরাফুলের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। দুপুরে ওইটুকু ভাত খেয়েছে এখন রাতে না খেলে হয়তো শরীর খারাপ করবে। আশরাফুলের ঘরের দরজা খোলা, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মিরা কয়েকবার ভিতরে যাওয়ার অনুমতি চায়। কিন্তু কেউ সাড়া দেয় না। মিরা দরজার পর্দা সরিয়ে দেখে আশরাফ ঘুমিয়ে আছে। বালিশের সামান্য অংশ ভিজে গেছে। হয়তো কাঁদ ছিলো সে। মিরা সাহস করে ঘরের ভিতর গিয়ে আশরাফুলের গায়ে কম্বল টেনে দেয়। তারপর লাইট অফ করে বেরিয়ে আসে। মিরা এমন ব্যবহারের কারণ মিরা বুঝতে পারছে না। তবে এই মানুষটার জন্য বড্ড খারাপ লাগছে তার। কতটা কষ্ট নিয়ে ছেলেটা ঘুরে বেড়ায়, ছাড়া আড়ালে এতো কষ্ট লুকিয়ে রাখে মানুষ। আশরাফুল রাতে খায় না, মিরাও কেন জানি না রাতের খাবার না খেয়ে শুয়ে পড়ে। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে মিরা কিন্তু ঘুম আসছে না। আশরাফুলের বলা কথা মনে পড়ছে। কতটা কষ্ট পেয়েছে আশরাফুল তা অনুভব করার চেষ্টা করছে। হঠাৎ মিরার চিটির কথা মনে পড়ে, চিঠিটা বের করে দেখে, তাতে লেখা রয়েছে –

প্রিয়তমা মিরা,

তোমার ভাগ আমি কাউকে দিবো না প্রিয়তমা। তোমার স্বামী আশরাফুলকেও নয়। তুমি একান্তই আমার, নিজস্ব সম্পত্তি! তুমি কখনো আমার চিটির উত্তর দেও না। তবে আজ আমি চাই তুমি এটার উত্তর দেও। অপেক্ষায় রইবো।

তোমার অচেনা ভালোবাসা,

চলবে#আলোছায়া
পার্ট -১১
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল

মিরা চিঠিটা পড়ে হতভম্ব হয়ে বসে থাকে। সে তো কখনো ওই অচেনা লোককে ভালোবাসি বলেনি। কেমন অদ্ভুত একটা লোক রে বাবা! মিরা চিঠি নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না। চিঠির উত্তর লেখারও প্রয়োজন মনে করে না। শুধু ভাবতে থাকে সত্যিকারের ভালোবাসা বুঝি অবহেলিত হয়। যেমন আশরাফুল নিজের ম্যানিব্যাগে সেঁজুতির ছবি না রেখে মিতালির ছবি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এমন আকাশ পাতাল চিন্তা করতে করতে মিরা ঘুমিয়ে যায়। সকালবেলা ঘুম হতে উঠে নিয়মিত সে সকল কাজ করে সে-ই সকল কাজ শেষ করে রেশমা বানুর কাছে যায়। রেশমা বানু তখন খাবার টেবিলে বসে চা খাচ্ছে। একটু বেলা করেই ঘুম থেকে উঠেছে সে। মিরা তার কাছে গিয়ে কোনো প্রকার ভনিতা না করে প্রশ্ন করে,

–” আচ্ছা মা সেঁজুতি কে?”

সেঁজুতি নাম শুনে রেশমা বানু একটু নড়েচড়ে বসে। তারপর ব্যস্ত হয়ে বলে, ” তোমাকে এই নাম কে বলেছে?”

মিরা রেশমা বানুর বিচলিত হওয়ার কারণ বুঝতে পারে না। শান্ত গলায় বলে, ” আপনার ছেলে বলেছে। ”

রেশমা বানুর চোখ চকচক করে ওঠে। চা’য়ের কাপের উপর একটা ঢাকনা দিয়ে চা ঢেকে রাখে। তারপর বলে, ” পাঁচ মিনিটে রেডি হয়ে আসো তুমি৷ আমি আসছি। ”

মিরা বুঝতে পারে না তার শাশুড়ি কি করতে চাইছে, তবুও ঘরে গিয়ে বোরকা পরে নেয়। সাথে মাথায় একটা ওড়না পেঁচিয়ে নেয়। রেশমা বানু একটা চাদর নিয়েছে শুধু। মিরার কাছে এসে ছোট করে বললো, ” এসো আমার সাথে। ”

মিরা বাধ্য মেয়ের মতো রেশমা বানুর সাথে চলে যায়। বাড়ির সামনে দিয়ে একটা রিকশা নিয়ে তাতে উঠে বসে। মিরা ভাবতে পারেনি রেশমা বানুর মতো মহিলা তার পাশে বসে কোথাও যাবে। এই মহিলা তাকে কতটা অপমান করেছে, কত কথা শুনিয়েছে। রিকশা ছুটে চলেছে এক অজানা গন্তব্যের দিকে। দুইজন রমণী দুই দিকে মুখ করে বসে আছে। হালকা বাতাস মুখে লাগছে, এক অদ্ভুত শীতল অনুভূতি! রিকশা একটা জায়গায় থেমে যায়। রেশমা বানু ভাড়া মিটিয়ে মিরাকে নিয়ে একটা খোলা মাঠে নিয়ে যায়। খোলা মাঠ বলতে সামান্য ফাঁকা জায়গা উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা, তার চারপাশের জমি গুলো খালি পড়ে আছে।
রেশমা বানু একটা কবরের দিকে ইশারা দিয়ে বলে, ” এই যে সেঁজুতি ঘুমিয়ে আছে।”

মিরা অবাক হয়ে শাশুড়ির দিকে তাকায়। এই মহিলার চোখের কোণেও পানি জমে আছে। কি অদ্ভুত পৃথিবী। যারা মানুষকে কাঁদায় তাদেরকেও একদিন কাঁদতে হয়। চাইলেও সে সুখী হতে পারে না, মিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কবরের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে, ” তোমাকে তো কেউ ভালোবেসে ছিলো। আমার দিকে দেখো! ”

কবর জিয়ারত করে রেশমা বানু আর মিরা হাঁটতে থাকে। কিছু সময় পর একটা রিকশা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। মিরার বড্ড কষ্ট হচ্ছে, অদ্ভুত কষ্ট। যার কোনো কারণ সে খুঁজে পায় না। বাড়িতে ফিরে রেশমা বানু মিরার হাত ধরে বলে, ” মা তোর সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। পারলে আমাকে মাফ করে দিস। একটা অনুরোধ করি, আমার ছেলেটাকে আগের মতো হাসি খুশি বানাতে পারবি। ছেলেটা বড্ড শান্ত হয়ে গেছে। ”

রেশমা বানুর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মিরার চোখ পানিতে টলমল করছে, এই বুঝি গড়িয়ে পড়বে। মিরা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়, রেশমা বানু চোখ মুছে চলে যায়। দুনিয়া কত বিচিত্রময়! যাদের আমরা সবসময় কষ্ট দিয়ে থাকি, প্রয়োজনে তাদের কাছে হাত জোড় করতেও দ্বিধা করি না।

সকালের খাওয়ার সময় মিরা এক দৃষ্টিতে আশরাফুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। তখন শুধু আশরাফুল একাই খাবার খাচ্ছে। মিরা পাশেই টেবিলের উপর হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যদি আশরাফুলের কিছু প্রয়োজন হয়। এই মানুষটা কি করে এতো কষ্ট সহ্য করেছে! একদম পাথর হয়ে গেছে হয়তো। আশরাফুল হয়তো মিরার তাকিয়ে থাকার অর্থ বুঝতে পারে। মিরার হাতের উপর হাত রেখে শান্ত গলায় বলে, ” যে তোমাকে কষ্ট দেয় তার কষ্ট দেখে তোমার কষ্ট পাওয়া উচিত নয়৷ এতে এরা মনে করবে তুমি দূর্বল। খুব সহজে তোমাকে আঘাত করা যাবে।”

মিরা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। আশরাফুল মিরা হাত শক্ত করে চেপে ধরে পরক্ষণেই ছেড়ে দেয়। তারপর নিজের কাজে চলে যায়। অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। মিরা চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কেন জানি আজ কাল শুধু কষ্ট হয় মিরার, বড্ড কান্না পায়।

দুপুরের রান্না করতে করতে প্রায় বারোটা বেজে যায়। মিরা সবকিছু গুছিয়ে নিজের ঘরে যায়। গোসল সেরে ফেলতে পারলে মন্দ হয় না। জানালার উপর একটা সাদা কাগজ পড়ে রয়েছে। হয়তো লোকটা চিঠি দিয়েছে। মিরা গিয়ে কাগজটা উঠিয়ে নেয়। তাতে লেখা রয়েছে–

প্রিয়তমা,

তুমি কিন্তু আমার মনে ইচ্ছে পূরণ করলে না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। একটা চিঠি তো পেতে পারি, তাই না? তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না? কেন এতো দ্বিধা তোমার?”

ইতি,
আমি।

মিরা মনে হয় এইবার লোকটাকে একটা উত্তর দেওয়া প্রয়োজন। কেন জানি এই চোর পুলিশ খেলা আর ভালো লাগছে না। মিরা চিঠিটা বালিশের নিচে রেখে গোসল করতে যায়। গোসল শেষ করে সবার খাবার গুছিয়ে রাখে। হাতের নাগালে সবকিছু রেখে দেয় যাতে কারো মিরাকে ডাকার প্রয়োজন না হয়৷ সব কাজ শেষ করে মিরা নিজের খাওয়া শেষ করে, তারপর ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। চিঠির উত্তর লিখবে বলে। তার ঘরে একটা খাতা পড়ে আছে। পড়বে বাড়ি থেকে একটা বই আর খাতা কলম নিয়ে এসে ছিলো কিন্তু পড়াশোনা আর হয়নি। মিরা একটা সাদা কাগজে লিখতে শুরু করে–

জনাব,

আপনাকে আমি চিনি না। তাই প্রিয় বলে সম্মোধন করতে পারছি না। আমি একজন বিবাহিত নারী। আমার স্বামী আছে। আমি চাইলেও অন্য পুরুষের দিকে আকৃষ্ট হতে পারি না। আপনাকে বড় জোড় বন্ধু ভাবতে পারি। এর থেকে বেশি কিছুই নয়। আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন। এতোদিন খেয়াল রাখার জন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। ধন্যবাদ দিয়ে আপনাকে ছোট করবে না৷

ইতি,
মিরা

লেখা শেষ করে কাগজটা ভাজ করে জানালায় উপর রেখে দেয়। একটা ছোট ইটের টুকরো কাগজের উপর দিয়ে রাখে, পাছে যদি বাতাসে উঠে যায়।

মিরার কিছু ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে কোনো দমকা হাওয়া তার জীবনটা এলোমেলো করে দিবে। এতো দিন আশরাফুলকে ঘৃণা করার কারণ ছিলো মিরার কাছে কিন্তু আজ-কাল আশরাফুলকে দেখতে একদম রাগ হয় না। সহানুভূতি জেগে ওঠে। কতটা কষ্ট ছেলেটার জীবনে, তাও কি সুন্দর সবকিছু মানিয়ে চলেছে। কোনো অচেনা লোককে বিশ্বাস করে ঘর ছাড়তে রাজি নয় মিরা। বাইরের দুনিয়ায় ভয়ংকর রূপ সে দেখেছে। মা’য়ের লড়াই দেখেছে। এই বাড়ির ভিতর তবুও তার সতীত্ব অক্ষত আছে, কিন্তু বাইরে হাজারও হিংস্র কুকুর ওত পেতে আছে একটা নরম শরীর ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য। শিক্ষিত ডিগ্রীধারী লোক হতে বাসের ড্রাইভার। সত্যিকারের মানুষ পাওয়া যেন বড্ড দায়। অনেক ভাবে মিরা, শেষ মেষ সিদ্ধান্ত নেয় পরকীয়া নামক মরণ ফাঁদে সে পা দিবে না। আশরাফুলের সাথে যদি তার ডিভোর্স হয় তবেই কাউকে নিয়ে কিছু ভেবে দেখবে। সাগর দূর থেকেই সুন্দর। এর ভয়ংকর রূপ তো সাগরে ডুবে মারা যাওয়া লোকগুলো জানে। মুখে বলা যতটা সহজ বাস্তবে সেগুলো করে দেখানো বড্ড কঠিন। একজন বিবাহিত মেয়ের সাথে হাজার ছেলে প্রেম করতে আসে, হাজার রকমের ভালোবাসা দেখায় কিন্তু বাস্তবে কেউ বিয়ে করতে চায় না। যদিও কেউ বিয়ে করে সে-ই সংসারে সুখের নিশানা থাকে না। যদি এমন কেউ সুখী হয়ে থাকে তবে সে অতিরিক্ত ভাগ্যবতী। তার কথা আলাদা। প্রেমিকদের স্বামীর মতো দায়িত্ব থাকে না। স্বামী হয়ে ওঠা বড্ড কঠিন!

সন্ধ্যার দিকে আশরাফুল আসে। ঘরে যাওয়ার আগে মিরাকে বলে, ” মিরা এক কাপ কফি দেবে আমাকে? মাথাটা বড্ড ধরছে। ”

মিরা মাথা নেড়ে রান্নাঘরে চলে যায়। কি সুন্দর করে আবদার করে আশরাফুল! ফিরিয়ে দেওয়া যে বড্ড কঠিন। আচ্ছা আশরাফুল যদি কখনো মিরাকে আবদার করে বসে, কি করবে মিরা? অতিতের কষ্ট আঁকড়ে আশরাফুলকে ফিরিয়ে দিবে নাকি সবকিছু ভুলে নতুন করে পথ চলতে চাইবে?

মিরা কফির মগটা হাতে নিয়ে আশরাফুলের ঘরের দিকে যায়। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে বলে,” ভিতরে আসবো?”

–” হুম আসো। ”

মিরা মগটা আশরাফুলের হাতে দেয়। আশরাফুল মুচকি হেসে বলে, ” Thank you. ”

প্রতি উত্তরে মিরা মুচকি হাসে। আশরাফুল মিরার দিকে মগটা এগিয়ে দিয়ে বলে, ” তুমি তো নিজের জন্য আনোনি। যেখানে দুইজন মানুষ থাকে সেখানে একা কোনো খাবার খাওয়া উচিত নয়। তুমি বরং এখান থেকেই একটু খাও। ”

মিরা আশরাফুলের কথায় হতভম্ব হয়ে যায়। এ ছেলে বলে কি! সত্যি কি মিরার এঁটো খাবার আশরাফুল খাবে নাকি? মিরার মনে প্রশ্ন জেগে ওঠে কিন্তু বলে, ” আসলে আমি কফি খাই না। আপনি খান। ”

আশরাফুল নিজের মতো কফি খেতে থাকে। মিরা তখনও দাঁড়িয়ে আছে। আশরাফুল ব্যপারটা লক্ষ্য করে বলে, ” একি! তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো। ”

মিরা খাটের উপর বসে পড়ে। আশরাফুলের খাটের এক কোণে বসে কফি খাচ্ছে। আর মিরা দু-হাত দূরে বসে কিসব ভাবছে।

–” আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”

আশরাফুল কফির মগে চুমুক দিতে দিতে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। মিরা বলে উঠে, ” আপনি ম্যানিব্যাগে মিতালির ছবি কেন রাখতেন? সেঁজুতি তো আপনাকে সত্যি ভালোবাসতো। ”

–” আসলে মিরা আমরা তাদেরকে বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেরি যারা আমাদের খারাপ সময় একটু সান্ত্বনা দেয়। একটু সাপোর্ট করে। আমিও মিতালিকে এমনই ভালোবাসতাম। ”

কথাগুলো বলে আশরাফুল মিরার দিকে ম্যানিব্যাগ এগিয়ে দেয়।

–” সেঁজুতি ছবি তো এখনো আমার কাছে আছে। ”

মিরা মুচকি হাসে। কোনো এক অজানা কারণে বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার। ধীর পায়ে আশরাফুলের ঘরে থেকে বেরিয়ে আসে। রাতের খাবার গোছাতে হবে।

ওদিকে মিরার চিঠি পড়ে অচেনা লোকির চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে চিঠির উপর। কাগজের চিঠি আস্তে আস্তে পানিকণাগুলো শুষে নেয়। পরক্ষণেই লোকটার মুখে রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে। এই হাসি-ই কি মিরার জীবন উলোটপালোট করে দিবে?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here