আলোছায়া পর্ব -১২+১৩

#আলোছায়া
পার্ট -১২
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
ওদিকে মিরার চিঠি পড়ে অচেনা লোকের চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে চিঠির উপর। কাগজের চিঠি আস্তে আস্তে পানিকণাগুলো শুষে নেয়। পরক্ষণেই লোকটার মুখে রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে। এই হাসি-ই কি মিরার জীবন উলোটপালোট করে দিবে?

রাতের খাওয়া শেষ করে মিরা নিজের ঘরে চলে যায়। দরজা চেপে দিয়ে খোপা খুলে দেয়। কোমর সমান লম্বা চুল পিঠের উপর ছড়িয়ে পড়ে। চুলগুলো বেঁধে ঘুমাতে যাবে মিরা, খোলা চুলে তার ঘুম আসে না। এমন সময় কেউ মিরার দরজায় কড়া নাড়ে। মিরা ভিষণ অবাক হয়। সচারাচর তার ঘরে কেউ আসে না, প্রয়োজন পড়লে তাকে ডাকে তবে এমন কখনো হয় নি। মিরা প্রশ্ন করে,

–” কে?”

ওপাশ থেকে পুরুষালী কন্ঠ বলে ওঠে, ” আমি আশরাফুল। ভিতরে আসবো?”

মিরা মাথার কাপড় টেনে দেয়। তারপর আস্তে করে বলে, ” হুম আসেন। ”

আশরাফুল মিরার ঘরে এই প্রথমবার এলো। বিয়ের এক বছর হয়ে গেলেও আশরাফুল মিরার ঘরে আসেনি। বাসর রাতে মিরাকে অপমান করে ছিলো। মিরাকে স্ত্রী বলে সম্মান দেয়নি। তারপরের দিন সকালে মিরা জন্য এই ঘরটা বন্দবস্ত করা হয়, আশরাফুল নিজেই তদারকি করে এই ঘরটা গুছিয়ে দিয়েছিলো। মিরাকে হয়তো স্ত্রী অধিকার দেয়নি, তবে কখনো কারণে অকারণে মিরার গায়ে হাত তোলেনি। মিরা হয়তো মনেও করতে পারে না আশরাফুল তাকে কখনো চড় পর্যন্ত মেরেছিলো কিনা! আশরাফুল হয়তো মিরার পক্ষ হয়ে লাবণি বা রেশমা বানুকে কোনো কথা বলেনি, তবে কখনোই মা বোনের কাজকে সমর্থন করেনি। আশরাফুল নামের মানুষটাকে ঘৃণা করা গেলেও অসম্মান করা যায় না।

–” শুধু ঘরে আসবে বলবে? বসতে দিবে না?”

আশরাফুলের প্রশ্নে মিরা বিব্রত হয়ে বলে, ” না না তা কেন বসুন। আপনি এখন এখানে কেন? মানে কিছু দরকার কিনা তাই জানতে চাইলাম। ”

–” না তেমন কিছু না, এমনিই আসলাম। তোমার অসুবিধা থাকলে বলো, চলে যাচ্ছি। ”

মিরার বড্ড ঘুম আসছে৷ কিন্তু আশরাফুলকে চলে যেতে বলতে পারছে না। কি না কি ভেবে বসে কে জানে! মিরা ঘুমে পড়ে যাচ্ছে,, আশরাফুল হয়তো বুঝতে পারে মিরার ঘুম আসছে তাই উঠে দাঁড়িয়ে বলে,” সারাদিন অনেক কাজ করো তুমি, এখন ঘুমাও। ”

মিরা খুব খুশি হয়৷ সত্যি অনেক ঘুম আসছে। আশরাফুল মুচকি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মিরা মাথার ওড়না খুলে বিছানার পাশে রেখে চুল বাঁধতে থাকে। আশরাফুল কি মনে করে আবার ফিরে আসে, পর্দায় ওপাশে কোনো এক রমণী খোলা চুলে দাঁড়িয়ে আছে, আশরাফুলের বড্ড লোভ হয় মিরাকে এক পলক দেখার কিন্তু ইচ্ছেটাকে দমন করে আবারও চলে যায়। ঘুমাতে যাওয়ার আগে মিরা জানালা লাগাতে গিয়ে আরো একটা চিঠি পায়। এই চিঠিগুলো মিরার খুব পছন্দের হলেও আজ ভয় হচ্ছে। মিরা কোনো প্রকার অশান্তি চায় না। চিঠিটা নিয়ে জানালা বন্ধ করে দেয়। চিঠিতে লেখা —

প্রেয়সী,

আমি তোমার বিপদের দিনে তোমার পাশে ছিলাম। আমি তোমার খেয়াল রেখেছি, তোমার স্বামী কখনো তোমার দিকে ফিরে তাকায়নি। তোমাকে প্রাপ্য সম্মান দেয়নি। তাকে তুমি ছেড়ে আসতে চাইছো না। এমনটা করো না মৃগ নয়নী, আমি তোমাকে ভালোবাসি।

ইতি,
আমি।

মিরার কিছু চিন্তা করতে পারছে না। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয়, বড্ড ঘুম আসছে তার। সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে নিয়মমাফিক গাছে পানি দিতে যায় মিরা। আজও সে-ই অচেনা ছেলেটা মিরাকে দেখছে। মিরার মনের মাঝে ভয় জন্মাতে থাকে। এ-ই আবার সেইটা নয় তো। মিরা কিছু ভেবে পায় না। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে ঘরে চলে আসে। সকালে রান্না শেষ করতে হবে।
আশরাফুল ঘুম থেকে উঠেছে অনেক আগে, কোথাও গেছে হয়তো। খাওয়ার টেবিলে আশরাফুলের সাথে দেখা হয় না মিরার। মিরা বাড়িতে কোথাও আশরাফুলকে দেখেনি। কোথায় চলে গেলো কে জানে! কাজ শেষ করে মিরা একটা চিঠি লিখতে বসে,

জনাব,

আপনি কে জানি না, কখনো দেখিনি। কয়েকটা চিঠি দিয়ে খেয়াল রাখা ভালোবাসা হতে পারে নিশ্চয়ই তবে আমি আপনাকে ভালোবাসি না। আমি বিবাহিত। আপনি আমার স্বামীর দোষটা দেখেছেন। হ্যাঁ আমার স্বামী হয়তো আমাকে স্ত্রী সম্মান দেয়নি, তবে কখনো শারীরিক চাহিদাকে ভালোবাসা মনে করেনি। সে চাইলেই আমার সাথে শারীরিক করতে পারতো আমার তাকে বাঁধা দেওয়ার উপায় ছিলো না। কিন্তু সে এমন করেনি, সে আমার গায়ে হাত তুলতে পারতো, আমাকে নানান ভাবে অত্যাচার করতে পারতো কিন্তু কখনো এমন করেনি। আপনি যে-ই হন না কেন, আমি আপনাকে ভালোবাসি না। কখনো আপনার কাছে যেতে চাই না।

ইতি
মিরা

চিঠিটা দেওয়ালের উপর ভাজ করে রেখে ছাঁদের দিকে পা বাড়ায় মিরা। সে অচেনা লোকটাকে এভাবে না বলে দিয়ে ভুল করছে না তো। লোকটা তার অনেক খেয়াল রেখেছে, পোড়া হাতের জন্য ঔষুধ কিনে দিয়েছে। হাজার প্রেমময় কথা শুনিয়েছে। তুবও কেন মিরা তাকে চাইতে পারছে না। মিরার তো উচিত তাঁকে মেনে নেওয়া। আশরাফুলকে ডিভোর্স দিয়ে ওই লোকটার কাছে চলে যাওয়া।

ছাঁদের একটা জায়গাতে মিরা বসে পড়ে। নানান চিন্তা তার মাথায় ঘুরতে থাকে, আশরাফুলের জীবনে যা-ই হোক মিরা কোনো দোষ করেনি। মিরাকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে হয় না। আবার আশরাফুলের কথা ভাবতে গেলে যে ও-কে সব থেকে বেশি কষ্ট দিয়ে চলে গেছে তার মতো দেখতে একটা মেয়েকে মেনে নেওয়া এতো সহজ নয়। তারপর আবার যেভাবে বিয়েটা হলো। আশরাফুলকে সব কিছু জন্য দোষী করতে পারে না মিরা, সে নিজেও তো এভাবে বিয়েটা মানতে পারেনি। স্বামী খারাপ ব্যবহার করলে তার সাথে ঝগড়া করা যায়, অভিমান করা যায়, প্রয়োজনে ঘৃণা করা যায় তবে তার থেকে বেশি গুরুত্ব অন্য কাউকে দেওয়া উচিত না।
দুপুর হয়ে আসে তখনও মিরা ছাঁদে একাকি বসে আছ। না জানি এই অচেনা লোকটা কে,
বিকালে মিরা ছাঁদ থেকে নেমে ঘরে যায়। আজ কাল কিছুই ভালো লাগছে না তাঁর।
রেশমা বানু হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মিরার দিকে। আজকাল মেয়েটা কেমন অদ্ভুত লাগে তার কাছে। রেশমা বানু কয়েকদিন মিরা তেমন একটা কাজের হুকুম করে না। সারাক্ষণ মন মরা হয়ে থাকেন রেশমা বানু। কারো সাথে তেমন কথা বলে না। লাবণি বাড়িতে নেই, কোনো এক আত্মীয় বাড়ি গেছে বলে শুনেছে সে। তেমন খোঁজ করার প্রয়োজন মনে করেনি। লাবণি মিরা সাথে ভালো ব্যবহার করলে হয়তো মিরা খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করতো কিন্তু এই মেয়ে তো সবসময় মিরার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে।

সন্ধ্যার দিকে মিরা আরো একটা চিঠি পায়। তাতে লেখা-

প্রিয়,

এতো দিন এতো খেয়াল রাখার কি কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে? আমি হয়তো আশরাফুলের মতো বড়লোক নই তবে সত্যি তোমার খেয়াল রাখবো। একটা কথা জানতে চাই তোমার কাছে, আমার প্রতি কি তোমার কোনো অনুভূতি নেই? কেন ভালো বাসতে পারো না তুমি আমাকে?”

ইতি,
আমি

মিরা চিঠিটা পড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর নিজেও লিখতে শুরু করে,

জনাব,

প্রথমেই আমি আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আপনার আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, হয়তো খুব ভালো বন্ধু। তবে আমার ভালোবাসা নয়। আমি বিবাহিত একজন নারী। আমার অন্য পুরুষের প্রতি আসক্তি থাকা অন্যায়। আমি যদি কখনো ডিভোর্সি হই তবেই ভেবে দেখবো আপনার ব্যাপারে৷

ইতি,
মিরা।

মিরার নিজের চিন্তাকে বড্ড সেকেলে লাগছে। তবুও সে বিবাহিত, কারো প্রতি আসক্ত হয়ে পড়া উচিত নয়। আশরাফুল তাকে মেনে নিবে কিনা মিরা জানে না। মিরার নিজেও আশরাফুলের প্রতি অঘাত ভালোবাসা নেই। যে সবকিছু ভুলে সে শুধু তা
র হয়ে থাকবে। মিরা আশরাফুলকে সম্মান করে, লোকটা চাইলে মিরার সতীত্ব নষ্ট করে মিরাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারতো, দিনের পর দিন মারধর করতে পারতো, লাথি মেরে বাড়ও থেকে বের করে দিলেও অস্বাভাবিক কিছু হতো না। কিন্তু সে এমনটা করেনি। নিজেই মিরার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে, এতটুকুই বা কম কিসে!

সন্ধ্যার পরে আশরাফুল মিরাকে নিজের ঘরে ডাকে। মিরা বুঝতে পারছে তাক কেন ডাকছে আশরাফুল । ঘরের সামনে গিয়ে বলে,

–” ভেতরে আসবো। ”

আশরাফুল উঠে এসে দরজা খুলে দেয়। তারপর মুচকি হেসে বলে, “হুম আসো। তোমার জন্যই বসে ছিলাম। ”

মিরা আশরাফুলের দিকে এক কাপ কফি এগিয়ে দিয়ে বলে, ” আপনি হয়তো এটা চাইতেন।”

আশরাফুল মুচকি হেসে বলে, ” না আজ মাথা ব্যাথা করছে না। তবে তুমি যখন নিয়ে এসেছো তখন খেয়ে নিচ্ছি। ”

মিরা একটু ইতস্তত হয়ে বলে, ” তাহলে কেন ডেকেছেন আমাকে?”

আশরাফুল কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বলে, ” তুমি আবার পড়াশোনা করবে? তুমি বললে আমি তোমাকে আবার কলেজে ভর্তি করে দিবো। ”

মিরা বিশ্বাস করতে পারে না সে আবার পড়াশোনা করবে। এ বাড়িতে প্রথম যখন পড়ার কথা বলেছিলো তখন রেশমা বানু মুখের উপর না বলে দিয়েছিলো। পরে আর কাউকে বলার প্রয়োজন মনে করেনি। সময় বুঝিয়ে দিয়েছিলো সে এ বাড়ির দলীল বিহীন কাজের লোক। মিরা মুখে কিছু বলতে পারে না। শুধু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়।

আশরাফুল হেসে বলে, ” তাহলে কাল আমার সাথে যাবে, তোমার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে, আমি তোমাকে ভর্তি করে দিবো ইনশাআল্লাহ। ”

মিরা খুব খুশি হয়। সে আবার পড়তে পারবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। হারিয়ে যাওয়া সব স্বপ্ন যেন আবারও মিরার চোখে ধরা দেয়। খুশিতে চোখের কোণে আনন্দ অশ্রু টলটল করে। আশরাফুল নিজে হাতে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে, ” খুশি হলে আলহামদুলিল্লাহ বলে আল্লাহর শোকর আদায় করতে হয়। কাঁদতে হয় না পাগলী। ”

মিরার ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে। খুশি মনে মিরা নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। দরজার কাছে আশরাফুল বলে ওঠে, “তুমি সেদিন বললে না মিতালির দেখতে হুবহু তোমার মতো কিনা। তোমরা হুবহু এক রকম দেখতে নও, তোমার গলার তিলটা ও-র ছিলো না। ”

মিরা পিছনে ফিরে মুচকি হাসি দেয়। তারপর নিজের ঘরের দিকে চলে যায়। মিরা আজ বড্ড খুশি। আবার পড়তে পারবে সে। ঘরে গিয়ে আয়নার নিজের গলার তিলটা দেখতে থাকে। মিরার এতো লজ্জা লাগছে কেন! তবে কি মিরা আশরাফুলের প্রেমে পড়লো?

চলবে#আলোছায়া
পার্ট -১৩
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
মিরা পিছনে ফিরে মুচকি হাসি দেয়। তারপর নিজের ঘরের দিকে চলে যায়। মিরা আজ বড্ড খুশি। আবার পড়তে পারবে সে। ঘরে গিয়ে আয়নার নিজের গলার তিলটা দেখতে থাকে। মিরার এতো লজ্জা লাগছে কেন! তবে কি মিরা আশরাফুলের প্রেমে পড়লো?
ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করে না মিরা, তাড়াতাড়ি করে শুয়ে পড়ে। কাল সকালে আবার কলেজে যেতে হবে। আশরাফুল কি সত্যি তাকে ভর্তি করে দিবে? নাকি মিরা কোনো স্বপ্ন দেখছে!
সকালে ঘুম থেকে উঠে মিরা তাড়াতাড়ি সব কাজ শেষ করে নেয় মিরা। সকাল থেকে মিরা আশরাফুলের জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু আশরাফুল দরজা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। মিরা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বেলা ১১টা বেজে গেছে। আশরাফুল তখনও ঘুম। আশরাফুলের কি মনে নেই তার আজকে মিরাকে নিয়ে কলেজে যাওয়ার কথা, মিরার মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। মন খারাপ করে ঘরে বসে থাকে, সকাল থেকে নিজের ঘরটা পর্যন্ত গোছায়নি মিরা, এখনও জানালা দরজা বন্ধ করে রেখেছে। কিছু সময় খাটের উপর বসে আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকে। তারপর উঠে গিয়ে জানালা খুলে দেয়। দম আটকে আসছে তার৷ জানালার উপরে একটা চিঠি পড়ে আছে। মিরা চিঠিটা উঠিয়ে নেয়, তাতে লেখা-

প্রেয়সী,

অযোগ্য মানুষকে এতোটা ভালোবাসতে নেয়। তবুও আমি তোমাকে জোর করবো না, একটা আবদার করবো তোমার কাছে। একদিন অন্তত দেখা করো আমার সাথে। তোমার সব স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব আমি নিবো। আমাকে ভালোবাসতে হবে না তোমাকে, শুধু একবার সামনাসামনি দেখা করো প্লিজ।

ইতি,
ব্যাথিত হৃদয়।

মিরা চিঠিটা পড়ে একটু চিন্তায় পড়ে যায়। কি উত্তর দিবে সে? যদিও একটুও ভালো লাগছে না মিরার। আশরাফুল তাকে আজ কলেজে ভর্তি করে দিবে বলেছে কিন্তু বেলা বারোটা বেজে গেলো এখনও ঘুম দিয়ে উঠছে না। কাল আশরাফুলের একটা কথা মিরার হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলো আবার জোড়া লাগিছে, আজ আবারও সে-ই স্বপ্ন ভেঙে যাবে না তো? আশরাফুল কি মিরার সাথে কাল মজা করেছে? কিছু বুঝতে পারছে না মিরা। আচ্ছা আশরাফুলের কিছু হলো না তো আবার! কথাটা ভাবতেই মিরার মুখ শুঁকিয়ে যায়। আশরাফুল তো কখনো এমনটা করে না, মিরা কখনো আশরাফুলকে এতো বেলা করে ঘুম দিয়ে উঠতে দেখেনি। একবার আশরাফুলকে ডেকে দেখা উচিত, কি হলো না হলো। চিঠিটা বালিশের নিচে রেখে মিরা আশরাফুলের ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

দরজার কাছে আসতেই আশরাফুল মিরাকে ডাক দেয়। মিরা দৌড়ে খাবার টেবিলের কাছে যায়, আশরাফুল ওই দিক দিয়ে কথা বললো বলে মনে হয়। আশরাফুল খাবার টেবিলে বসে আছে। হয়তো খেতে এসেছে। মিরাকে দেখে প্রশ্ন করে, ” দুইটা প্লেটে খাবার বেড়ে রেখেছ যে? কে খায়নি সকালে?”

মিরা আশরাফুলকে সুস্থ দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, পরক্ষণেই হতাশ হয়ে যায়। আশরাফুল যখন ঠিক আছে তাহলে কেন মিরাকে নিয়ে কলেজে গেলো না? মিরা এসব ভাবতে থাকে, কোনো কথা বলে না।

আশরাফুল জবাব না পেয়ে বলে আবারও বলে উঠে, ” কোনো সমস্যা তোমার? নাকি তুমি সকালে খাওনি? মুখ শুঁকিয়ে গেছে তোমার। ”

আশরাফুলের কথায় মিরার হুশ ফিরে আসে। মন মরা হয়ে বলে, ” হ্যাঁ আমি খাইনি সকালে। আপনি বলেছিলেন আজ কলেজে নিয়ে যাবেন আমাকে। আমি আবার পড়তে পারবো। তাই ভেবেছিলাম আপনার সাথে বসে খাবো। কিন্তু আপনি তো ঘুম দিয়ে উঠলেন এখন। আমাকে কি কলেজে নিয়ে যাবেন না? যদি ভর্তি করে না-ই দিবেন তাহলে বললেন কেন? এভাবে আশা দেখিয়ে নিরাশ না করলেও পারতেন।”

মিরার কথায় আশরাফুল মুচকি হেসে বলে, ” এতো গুলো প্রশ্ন একসাথে করলে আমি কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দিবো শুনি? একটা একটা করে প্রশ্ন করো। ”

আশরাফুলের উত্তর মিরার খুব একটা পছন্দ হয় না। তা-ই চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কেউ একটা তার হাত ধরে ফেলে। মিরা আশরাফুলের হাতের নাগালে দাঁড়িয়ে ছিলো, বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয় না যে আশরাফুলই মিরার হাত ধরেছে, হয়তে মিরাকে আটকানোর জন্য!

–” কোথায় যাচ্ছো? ”

মিরার কিছু ভালো লাগছে না। চারদিকের নানান চিন্তার ভিতর এসব মজা তার একটুও ভালো লাগছে না। তবুও শান্ত গলায় বলে, ” ঘরে যাবো, শরীরটা একটু খারাপ লাগছে। ”

–” না খেয়ে থাকলে শরীর আরো খারাপ হবে। আগে খেয়ে নাও। তারপর ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিও। ”

–” আমার কলেজে যাওয়া?”

–” আজকে শুক্রবার। যেদিন কলেজ খোলা থাকবে সেদিন তোমাকে নিশ্চয়ই নিয়ে যাবো। তোমাকে মিথ্যা আশা দেওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই, আমি জানি মিথ্যা আশা মানুষকে কতটা কষ্ট দিতে পারে। নাও এখন খেতে বসো। বললে তো আমার সাথে বসে খাবে। ”

মিরা ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে দেখে আজ সত্যি শুক্রবার। আজকে তো কলেজ বন্ধ। আজ কলেজে গেলে তো কোনো লাভ হতো না। ধূর! সবকিছু খেয়াল না করে আশরাফুলকে এতোকিছু বলা উচিত হয়নি। এখন নিজেকেই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে।

–” সাত পাঁচ কি এতো চিন্তা করছো? খেতে বসো। ”

মিরা আশরাফুলের পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ে। আশরাফুল মিরার হাত ছেড়ে দিয়ে নিজের খাওয়ার মন দেয়। মিরা লজ্জায় কিছু খেতে পারছে না, প্লেটের খাবারগুলো নাড়াচাড়া করছে। আশরাফুল হয়তো বুঝতে পেরেছে মিরার সমস্যা হচ্ছে। তাই সে বলে ওঠে, ” আরে রিলাক্স! এমন ভুল আমাদের সবার কম বেশি হয়ে থাকে। এতো লজ্জা না পেয়ে খাওয়া শেষ করো। ”

মিরা মুচকি হেসে খাওয়ার চেষ্টা করে। দূরে দাঁড়িয়ে রেশমা বানু সবকিছু লক্ষ্য করে। বহুকাল পুরনো শাশুড়ি বউমা সম্পর্কের সাথে তাল মিলিয়ে মিরাকে সে তেমন পছন্দ না করলেও চায় আশরাফুল সুখে থাকুক। সেঁজুতির ব্যাপারটা তিনি জানেন। ছেলের কষ্টে মা’য়েরও কষ্ট হয়। রেশমা বানুও তার ব্যতিক্রম নয়। তিনিও চান আশরাফুল সবকিছু ভুলে মিরার সাথে সুখে থাকুক।

খাওয়া শেষ করে আশরাফুল নিজের কাজে চলে যায়। জুমার নামাজ পড়তে গেছে হয়তো। মিরা সকালেই দুপুরে রান্না করে রেখেছে। তাই মিরাও গিয়ে বিছাবায় শরীরটা এলিয়ে দেয়। এই কলেজ যাওয়ার চক্করে আজ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে হয়েছে, তারপর সারাদিনের সব কাজ করেছে, এখন খুব ক্লান্ত লাগছে তার। মিরা চিঠির উত্তর লেখার প্রয়োজনবোধ করে না। বিছানায় শুয়ে পড়ে। বড্ড বেশি ক্লান্ত লাগছে তাঁর। কখন যে চোখটা লেগে আসে মিরা বুঝতেও পারে না।


” সময় কারো জন্য বসে থাকে না। মিরা এখন নিয়মিত কলেজে যায়। সে-ই অচেনা ছেলেটা এখন আর অচেনা নেই মিরার কাছে। মিরার সাথে প্রতিদিন কলেজ শেষ দেখা করতে আসে। চিঠিপত্র, গোলাপ, চকলেট এসব এখন নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে গেছে। একদিন ছেলেটা মিরার সাথে পালিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। মিরার কাছে সম্পূর্ণ তার হয়ে যাওয়ার বায়না করে। মিরাও তাতে রাজি হয়ে যায়। সেদিন কলেজে যাওয়ার আগে মিরা আশরাফুলের জন্য একটা চিঠি লেখে-

প্রিয় স্বামী,

আপনি আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন। আমি আপনাকে সম্মান করি, আপনাকে কখনো আশরাফুল বলেও ডাকতে চাই না। আপনি আমার অনেক উপকার করছেন, তবে বাসর রাতে যে পুরুষ আমাকে অস্বীকার করে, তাকে আমি কখনো মেনে নিতে চাই না। আমার ভালোবাসার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকবেন।
আপনিই বলতেন বেইমানদের মনে রাখতে নেই। আশা করি আমাকে ভুলে যাবেন৷ আমি চললাম অচেনা এক গন্তব্যের পথে, আমার অচেনা ভালোবাসার হাত ধরে।

ইতি,
মিরা।

তারপর চিঠিটা আশরাফুলের বালিশের নিচে রেখে বেরিয়ে পড়ে নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু সব যাত্রা তো সুখের হয় না। রাস্তায় একটা গাড়ির সাথে এক্সিডেন্ট করে মিরা। বাসের সাথে ধাক্কা খেয়ে কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়ে। রক্তে সারা শরীর একাকার হয়ে যায় মিরার। মৃত্যু যেন তার দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে। মিরার দম আটকে আসছে, মনে হচ্ছে তার জীবন এখানে শেষ। ”


ভয়ে লাফিয়ে উঠলো মিরা, সারা শরীর ঘেমে গেছে তার। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হয় দম আটকে যাবে। মিরা নিজেকে খাটের উপর আবিষ্কার করে, হ্যাঁ সে তো নিজের ঘরে রয়েছে, নিজের খাটের উপর। মিরা কিছু মনে করতে পারছে না, মনে হচ্ছে শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে।

এমন সময় আশরাফুল মিরার ঘরে আসে। মিরা তখন খাটের উপর বিছানার চাদর খামছে বসে আছে। বারবার নিঃশ্বাস নিচ্ছে, হয়তো এখনো স্বাভাবিক হতে পারছে না। আশরাফুল মিরার কাছে গিয়ে কয়েকবার মিরার নাম ধরে ডাকে। কিন্তু মিরা কোনো সাড়া দেয় না। আশরাফুল মিরার দুই বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বলে, ” কি হয়েছে তোমার? ঠিক আছো তুমি?”

মিরা আশরাফুলের দিকে তাকিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। আশরাফুল বেশ অবাক হয়। কিন্তু মিরাকে কিছু বলে না। মিরা ভীত কন্ঠে বলে, ” আমি কোথায়?”

আশরাফুল হয়তো বুঝতে পারে মিরার কিছু সমস্যা হয়েছে। তাই শান্ত গলায় বলে, ” তুমি তোমার ঘরে মিরা। একদম ঠিক আছো। ভয় নেই, কোনো সমস্যা নেই এখানে। শান্ত হও।”

মিনিট পাঁচেক পরে মিরা নিজে থেকে আশরাফুলকে ছেড়ে দেয়। হয়তো স্বাভাবিক হয়ে গেছে। মিরার মনে পড়ে সে আশরাফুল সাথে বসে সকালের খাবার খেয়েছে তারপর আশরাফুল মসজিদে চলে গেছিলো আর মিরা ঘুমিয়ে পড়ে ছিলো। ওহ্! তার মানে মিরা এতো সময় স্বপ্নে দেখছিলো। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মিরা। তারপর আশরাফুলকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” কিছু বলবেন আপনি?”

আশরাফুল মিরার হাতে কয়েকটা জিলাপি দিয়ে বলে, ” আজ মসজিদে মিলাদ দিয়েছে তাই তোমার জন্য নিয়ে এলাম। তুমি জিলাপি খাও?”

সত্যি বলতে মিরা খুব পছন্দ জিলাপি। ছোট বেলায় মিরার বাবা একবার মিরাকে জিলাপি এনে দিয়েছিলো মিরা তখন খুব ছোট তবুও যেন ওই একটা স্মৃতি স্পষ্ট মনে আছে। বয়সের সাথে মিরা বুঝেছে তার বাবা কোথায় চলে গিয়েছে, কেন তার মা’য়ের জীবনটা এমন কষ্টে ভরে আছে। মিরা চাইলেও তার বাবাকে মাফ করতে পারে না।

–” কি হলো মিরা কেনো সমস্যা? ”

–” না কোনো সমস্যা নেই। মা তো বাড়িতে উনাকে দিবেন না?”

আশরাফুল প্রথমে বুঝতে পারে না মিরার মা কোথা থেকে এলো, তারপর খেয়াল হয় মিরা তার মা’কে মা বলে ডাকছে। মেয়েটা কেমন অদ্ভুত। যে তাকে এতো কষ্ট দেয় তার কথাই জানতে চাইছে।

–” হুম মা’য়ের জন্য রেখেছি। তুমি খেয়ে নেও। আমি বরং মা’কে এগুলো দিয়ে আসি। ”

আশরাফুল নিজের কাজে চলে যায়। মিরার সাত-পাঁচ না ভেবে জিলাপিতে কামড় বসায়। কতদিন হয়ে গেলো তার পছন্দের মিষ্টি খায়নি।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here