আলোছায়া পর্ব -০৮+৯

#আলোছায়া
পার্ট -৮
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল

কথাগুলো বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না সেখানে, হনহন করে চলে যায়। মিতা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আশরাফুল ইদানীং অদ্ভুত ব্যবহার করছে মিরার সাথে!

সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না, সেদিন পর প্রায় দুই মাস কেটে গেছে, আশরাফুল মিরার সাথে বেশ ভালোই কথা বলে, খাওয়ার টেবিলে মিরা রান্নার প্রশংসা করতে ভোলে না। মিরার এখন আশরাফুলকে নিয়ে তেমন মাথা ব্যথা নেই। অচেনা সে-ই ছেলেটা প্রতিদিন মিরাকে নতুন চিঠি দেয়, ভরসা দেয়। আজও মিরা সকাল থেকে অপেক্ষা করছে চিঠির জন্য, বেশ কয়েকবার ঘরে গিয়ে দেখে এসেছে কিন্তু কোনো চিঠি নেই। অপেক্ষার সময় যেন পার হতেই চায় না।

দুপুরে সকলের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে, মিরা সবে মাত্র খেতে বসেছে এমন সময় আশরাফুল অফিস থেকে বাড়িতে আসে, আশরাফুল কখনো দুপুরবেলা বাড়িতে আসে না। আজ হঠাৎ চলে এসেছে, মিরা আশরাফুলের দিকে তাকিয়ে বলে, ” আপনি দুপুরে খাবেন?”

আশরাফুল মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়, তারপর নিজের ঘরের দিকে চলে যায়। মিনিট দশেক পর ফ্রেশ হয়ে খেতে আসে। মিরা বাড়তি খাবার রান্না করে না, কালে ভদ্রে খাবার বেশি থাকলেও আজ বাড়তি কিছুই নেই। মিরা নিজের খাবারটা রেখে বাকি ভাতগুলো পিছনের পুকুরে দিয়ে এসেছে, উপায় না পেয়ে নিজের প্লেটটা আশরাফুলের সামনে সাজিয়ে দিয়ে বলে, ” আপনি খেতে শুরু করেন। আমি ডিম ভেজে আনছি। ”

আশরাফুল আঁড়চোখে মিরার দিকে তাকায়, তারপর শান্ত গলায় বলে, ” তুমি খাবে না? আমার সাথেই বসে পড়ো। বেলা তো অনেক হলো। ”

মিরা কি জবাব দেবে ভেবে পায় না। হাতের আঙ্গুলে ওড়না পেঁচাতে থাকে।

আশরাফুল উত্তর না পেয়ে আবার প্রশ্ন করে, ” কি হলো তুমি খাবে না? আমি যখন আসলাম তখন তুমি খেতে বসছিলে তাহলে?”

–” আসলে আমার খাওয়া শেষ। আপনি খেয়ে নিন। আমি ঘরে যাই। ”

আশরাফুল মুচকি হেসে বলে, “জানো তো মিরা মিথ্যা কথা বলতে নেই। তুমি আমার সাথে একসাথে বসে খাবার খেতে চাও না, এটা বললেই তো পারো। অবশ্য তোমার আমার মুখ দেখাও উচিত না। ”

–” না মানে…”

মিরা কোনো জবাব খুঁজে পায় না। কি বলা উচিত বুঝতেও পারে না, শুধু দাঁড়িয়ে থাকে। আশরাফুলের মুখে তখনও একটা হাসি লেগে রয়েছে, হয়তো বিদ্রুপের হাসি।

–” আচ্ছা মিরা আমি কি অনেক বেশি খারাপ?”

–” না তেমন কিছু না, আসলে আর খাবার নেই। আমি যে প্লেটে খেতে বসেছিলাম ওইটাই আপনাকে দিয়েছি। আমার প্লেট আপনাকে দিয়েছি শুনলে হয়তো রাগ করতেন তাই আর বলিনি। ”

আশরাফুল মুচকি হাসে, তারপর অন্য একটা প্লেটে নিয়ে তাতে সব খাবার অর্ধেক ভাগ করে। মিরার দিকে তাকিয়ে বলে, ” এবার এসো। এতো কাজ করে না খেয়ে থাকা উচিত নয়। ”

মিরা ভাবতেও পারেনি আশরাফুল এমন কিছু করবে, সে ভেবেছিলো হয়তো ও-র প্লেট আশরাফুলকে দিয়েছে জানলে আশরাফুল রাগ করবে, তাকে ছোটলোক বলে মারতে আসবে কিন্তু আশরাফুল খাবার ভাগভাগি করে খেতে চাইবে তা কখনো বুঝতে পারেনি। আশরাফুল দিন দিন অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছে। কত সাদামাটা একটা ছেলে, যে মেয়েকে বিয়ের রাতে অস্বীকার করেছে তার সাথে আজ খাবার ভাগ করে নিচ্ছে। দুনিয়ার মানুষগুলো কত অদ্ভুত।

–” তুমি কি আমার সাথে বসে খাবে? নাকি আমি উঠে যাবো। ”

মিরা চায় না আশরাফুল খাওয়া ছেড়ে উঠে যাক। এটা রেশমা বানু বা লাবণি শুনলে তাকে অনেক কথা শোনাবে, অশান্তি একদম ভালো লাগে না তার। তাই দেরি না করে একটা চেয়ার টেনে খেতে বসে পড়ে।

–” মিরা লাউ চিংড়ি রান্নাটা দারুণ হয়েছে। তুমি কিন্তু দারুণ রান্না করো। ”

মিরা মুচকি হাসে, তারপর প্লেটে হাত নাড়াচাড়া করে, খাবার মুখে তুলতে পারে না। হয়তো আগে কখনো আশরাফুলের সাথে এক টেবিলে খায়নি তার জন্য। আশরাফুলও ব্যাপারটা বুঝতে পারে, তাই মিরাকে জোর করে না, নিজের মতো খেয়ে চলে যায়। মিরাও খাওয়া শেষ করে ঘরে চলে যায়। এতোক্ষণে হয়তো লোকটা চিঠিটা রেখে গেছে, প্রতিদিন দুপুরে পরেই মিরা চিঠিটা হাতে পায়, জানালার পাশেই রাখা থাকে, এদিকে বাড়ির কেউ আসে না বলেই কেউ কখনো চিঠিটা হাতে পায়নি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো এখনও কেউ চিঠি রেখে যায়নি, মিরার মনটা বেশ খারাপ হয়। মন খারাপ করে ছাঁদে চলে যায় সে।

ছাঁদের উপর বেশ কয়েক রকমের ফুল ফলের গাছ। আশরাফুল নিজের হাতে লাগিয়েছে সবকিছু, মিরা ছাঁদে গিয়ে দেখতে পায় আশরাফুল কিছু পোড়াচ্ছে, আগুনের শিখার উপর দিয়ে কালো ধোঁয়া আকাশের ওঠে যাচ্ছে, আশরাফুল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে, চোখের কোণ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে কপল ভিজিয়ে দিয়েছে আশরাফুলের। মিরা অবাক হয়, এই ছেলেটাও কাঁদতে পারে। যে কিনা মিরাকে এতো কাঁদিয়েছে সে-ও আজ কাঁদছে। হয়তো ভাগ্যই এমন হয়। মিরা উপস্থিতি বুঝতে পেরে আশরাফুল চোখ মুছে ফেলে তারপর শান্ত গলায় বলে, ” কিছু বলবে তুমি?”

মিরা মাথা নাড়িয়ে বলে, ” না এমনি ছাঁদে এসেছিলাম, ঘরে ভালো লাগছিলো না বলে।”

–” মিরা জীবন সিনেমার থেকেও অদ্ভুত হয় তাই না বলো? সিনেমা তো আমরা তিন ঘন্টা দেখে শেষ করে ফেলি, তবে জীবনে প্রতি মুহূর্তে কষ্ট পেতে হয়।”

–” আপনি এমন কেন বলছেন? আপনার জীবনে তো কোনো কষ্ট নেই। কত সুন্দর আপনার জীবন, এতো বড় বাড়ি, সকলে আপনাকে কত ভালোবাসে। এমন জীবন তো সবাই পায় না”

আশরাফুল তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, ” তুমিও আমাকে ভালোবাসো নাকি?”

মিরা নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আশরাফুলকে সে কখনো ভালোবাসতে পারে না। এই ছেলেটা মিরার জীবনটা শেষ করে দিয়েছে, সেদিন মিরাকে বিয়ে করে নরক যন্ত্রণা বরণ করতে হয়েছে মিরাকে, শশুর শাশুড়ি লাবণি কত অত্যাচার করেছে ওকে, কখনো প্রতিবাদ করেনি, পাশে এসে দাঁড়ায়নি, এমনি স্ত্রী’র মর্যাদা পর্যন্ত দেয়নি। এমন মানুষকে ভালোবাসা যায় না, শুধু ঘৃণাই করা যায়। মিরার নিরবতা আশরাফুলকে বিচলিত করে না, সকলেই নিরবতাকে সম্মতি হিসাবে ধরে নেয়, তবে আশরাফুল নিশ্চিত এখানে উত্তরটা না। তাকে মিরার ভালোবাসার কোনো প্রশ্নই আসে না। আশরাফুল মিরার ভালোবাসা আশাও করে না।

শান্ত গলায় বলে, ” জানো মিরা সব জিনিস যেমন দেখা যায় তেমন হয় না, সমুদ্র কে-ই দেখো, কত সুন্দর, কত বিশালতা তার, হাজার হাজার মানুষ সমুদ্র পাড়ে বেড়াতে যায়, পানিতে সাঁতার কাটে, তবে সে-ই মাঝিই এর নিষ্ঠুরতা জানে যে সাগরে পড়েছে, খুব কাছ থেকে একে উপভোগ করছে, সে-ই নাবিক এর নিষ্ঠুরতা জানে যার শেষ সম্বলটুকু সাগর জলে বিলীন হয়ে গেছে। আমার জীবনটাও অনেকটা তেমন, দূর থেকে অনেক বেশি সুন্দর তবে কাছ থেকে আমি এর নিষ্ঠুরতা জানি। ”

মিরা অবাক হয় না। বরং কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করে, ” কি এতো নিষ্ঠুরতা আপনার জীবনে?”

–” অনেক বিশাল কাহিনী। তুমি শুনবে নাকি?”

মিরা উত্তর দিতে দেরী করে না। চট করে বলে বসে, ” হ্যাঁ শুনবো। ”

আশরাফুল বলতে শুরু করে তার জীবন কাহিনী, মিরা উৎসুক শ্রোতার মতো আশরাফুলের দিকে চেয়ে থাকে। দূরের আকাশে সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ছে, তবুও সন্ধ্যা নামতে বেশ দেরী।

–” মিরা এই যে দেখো কিছু জিনিসকে আগুনে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে ফেলছে এগুলো আমার ভালোবাসার চিহ্ন। অনেক যত্ন করে রেখেছি এতোদিন, আজ কেন জানি আর রাখতে ইচ্ছে করলো না। ”

–” যাকে ভালোবাসা হয় তার জিনিস তো যত্ন করে রাখতে হয়, আমিও তার চিঠি যত্ন করে রেখেছি।”

তার চিঠি যত্ন করে রেখেছি কথাটা আস্তেই বলে মিরা তবুও আশরাফুল হয়তো শুনতে পেয়েছে তাই কপাল কুঁচকে তাকালো মিরার দিকে, কিন্তু কিছু বললো না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। মিরাও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। নিরবতা ভেঙে মিরা প্রশ্ন করে, ” আপনি যাকে ভালোবাসেন তাকে ছেড়ে দিলেন কেন?”

ম্যানিব্যাগ থেকে মিরার মতো দেখতে মেয়েটার ছবিটা বের করে কয়েক টুকরো করলো আশরাফুল তারপর আগুনে পুড়িয়ে দিতে দিতে বললো, ” বেইমানদের মনে রাখতে হয় না। ”

–” আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। ”

–” বুঝতে হলে তো তোমাকে সবটা শুনতে হবে। তাই না? ”

–” হুম। ”

–” মিরা আমি তখন সবে মাত্র এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি, পড়াশোনা নেই, রেজাল্টও বের হয়নি। কোনো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সারাদিন ঘুরে বেড়ানো আর দিন শেষ বই পড়া, আড্ডা দেওয়া, সকলের সাথে গল্প করা। সেঁজুতি নামের একটা মেয়ে আমার ক্লাসমেট ছিলো। একসাথে পড়তাম স্কুলে, কলেজে। কলেজে যাওয়া হতো না বলে ও-র সাথে তেমন যোগাযোগ হতো না। আমরা বন্ধুও ছিলাম না। একদিন হঠাৎ রাস্তায় ও-র সাথে দেখা হলো। হাতে ছোট বাচ্চাদের বই নিয়ে কোথাও যাচ্ছে। আমাকে দেখে ডাক দিলো, আমি তখন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে প্রথমবারের মতো সিগারেট ঠোঁটে লাগিয়েছি্। সুখটান দেওয়ার আর সুযোগ পেলাম না।

–” আশরাফুল এদিকে শোন। ”

ও-র ডাক শুনে সিগারেটটা ফেলে দিয়ে ও-র কাছে গেলাম। সেঁজুতি হয়তো আমাকে সিগারেট ফেলতে দেখে ফেলেছিলো। ও-র কাছে যাওয়ার সাথে সাথে বলে উঠলো, ” দেখ তুই রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খেলে কিন্তু আমি কাকি মা-কে বলে দিবো। ”

ও-র কথায় বড্ড মেজাজ খারাপ হয়েছিলো। কে কোথা থেকে আসছে আমার মা’কে নালিশ করতে, রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বললাম, ” তুই কে রে যে আমার মা’কে বলতে যাবি। তুই কি আমার মা’য়ের দাসীবাঁদী নাকি রে?”

সেঁজুতি মুচকি হেসে বললো, ” না রে পাগল, আমি তো তোর বড় ভাবি। তোর ভাইয়া আমাকে অনেক পছন্দ করে, কত্ত চিঠি দিয়েছে আমাকে জানিস তুই?”

সেঁজুতি কথায় আমি শক খেলাম বড়সড় রকমের কারণ আমার কোনো ভাই নেই। লাবণি তখনও বেশ ছোট। মুখ বেঁকিয়ে বললাম, ” দেখ আমার কোনো বড় ভাই নেই। বাজে কথা বলিস না তো। নিজের কাজে যা। ”

–” দেখো ছেলের রাগ, কতোদিন বয়স তোর যে এখন সিগারেট টানছিস? আমার মতো ভালো কাজ কর পারলে। ”

–” কি এমন মহান কাজ করিস তুই শুনি? আর তাছাড়া তুই তো মহান কাজ করবি কারণ কয়েকদিন পর তোর বিয়ে হবে, তুই তো বুড়ি হয়ে যাবি তখন। ”

সেঁজুতি আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে নিজের কাজে চলে গেলো। আমিও ও-কে মনে মনে গালাগালি দিতে দিতে বাড়িতে আসলাম। কত শখ করে সিগারেট খেতে গেছিলাম, মাটি করে দিলো একদম। পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সেঁজুতি সোফায় বসে আছে আর মা’য়ের সাথে কথা বলছে, ও-কে এখানে দেখে আমার হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। এই মেয়ে এতো ডেঞ্জারাস তা তো আগে জানা ছিলো না। আমি ওঁদের কাছে যাওয়ার আগেই সেঁজুতি কাঁধে ব্যাগ তুলে বেরিয়ে গেলো। এদিকে আমি তখন মহা টেনশনে আছি।

চলবে#আলোছায়া
পার্ট -৯
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল

পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সেঁজুতি সোফায় বসে আছে আর মা’য়ের সাথে কথা বলছে, ও-কে এখানে দেখে আমার হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। এই মেয়ে এতো ডেঞ্জারাস তা তো আগে জানা ছিলো না। আমি ওঁদের কাছে যাওয়ার আগেই সেঁজুতি কাঁধে ব্যাগ তুলে বেরিয়ে গেলো। এদিকে আমি তখন মহা টেনশনে আছি।

মা’য়ের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলাম, ” মা ওই মেয়ে তোমাকে কি বলে গেলো?”

–” কেন তুই চিনিস নাকি ও-কে? মেয়েটা বড্ড ভালো রে৷ ”

–” আমাদের কলেজেই পড়তো। তোমাকে কিছু বলছে নাকি? ”

মা মুচকি হেসে বললো, ” না রে বাবা। আমি এতোগুলো বাজারের ব্যাগ তুলে আনতে পারছিলাম না, আবার শাড়ি পায়ে জড়িয়ে পড়ে গেছিলাম, মেয়েটা দূর থেকে দেখে দৌড়ে এসে আমাকে উঠালো, তারপর ব্যাগগুলো বাড়ি পর্যন্ত দিয়ে গেলো। এমন ভালো মেয়ে এখন পাওয়া যায় না। ”

আমি মুচকি হেসে চলে এলাম। যাক শয়তানি আমার নামে কিছু বলেনি। কিন্তু এদিকে ও কোথায় যাচ্ছে? ও-র বাড়ি তো এদিকে নয়। কি জানি, থাকবে কোনো কাজ। টোটোকোম্পানির চাকরিটা বাঁচাতে রেডি হয়ে বের হলাম। দরজার কাছে আবারও মা’য়ের সাথে দেখা।

–” সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াস? মেয়েটার মতো ভালো কিছু তো করতে পারিস নাকি?”

–” কোন মেয়েটা?”

–” আরে ও-ই মেয়েটা, সকালে যাকে দেখলি। তাড়াহুড়ায় নামটা জানতেই ভুলে গেছি। ”

–” কি ভালো কাজ করে শুনি?”

–” ওইতো সামনের পার্কে ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়ায়, আমার ছেলেটা যে কেন এমন ভালো হলো না কে জানে!”

–” তো আমি কি খারাপ নাকি?”

–” না না বাবা। ”

মা’য়ের উপর রাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। সব হয়েছে ওই সেঁজুতিটার জন্য। কি এমন ভালো কাজ করে আমি দেখতে যাবো এখন। হয়তো প্রেম করছে পার্কে বসে আর এদিকে ভালো সেজে বেড়ানো হচ্ছে। পার্কে গিয়ে দেখলাম সেঁজুতি কতগুলো বাচ্চাকে নিয়ে কিসব করছে, বাচ্চাগুলো গোল করে ঘিরে রেখেছে ও-কে। আমি ও-র কাছে গিয়ে বললাম,
” কি রে তুই সকাল সকাল আমার মা’য়ের কাছে এমন ভালো সাজতে গেলি কেন? দেখ আমার তোকে পছন্দ না। আর আমার মা’য়ের আর কোনো ছেলেও নেই। তা-ই আমার মা’কে তেল দিয়ে লাভ নেই। ও বাড়িতে তোর বিয়ে হবে না। ”

সেঁজুতি কয়েক মিনিট ভেবে বললো, ” সকালের মহিলাটা তোর মা ছিলেন? ”

–” হ্যাঁ। ”

–” আমি যদি জানতাম ওইটা তোর মা তাহলে আরো বেশি করে পটিয়ে আসতাম। ভাবি নয় তোর বউ হতে… হা হা হা! ”

সেঁজুতি হয়তো কথাগুলো মজা করে বলেছিলো তবে আমি সিরিয়াসভাবে নিয়েছিলাম। এরপর রোজ পার্কে গিয়ে ও-র সাথে দেখা করা, অনেক সময় বসে গল্প করতাম। মাস খানেক পর একদিন সেঁজুতিকে প্রশ্ন করলাম, ” একটা কথা বলবি?”

–” হুম, বল কি কথা।”

–” তুই কি সেদিন কি ওই কথাগুলো সত্যি বলেছিলি? ”

–” কোন দিন? কি কথা?”

–” যেদিন আমি প্রথম এই পার্কে এসেছিলাম, ”

–” তুই কবে প্রথম এসেছিস আমি কি জানি? তোর বাড়ি তো এখানে। ”

–” যেদিন এখানে তোর সাথে দেখা হয়েছিলো, ওই আমার মা’কে শাশুড়ি, ওই কথাটা। ”

–” ওইটা তো কথায় কথায় মজা করে বলেছিলাম। ”

–” ওহ্, সরি। ”

খুব খারাপ লেগেছিলো সেদিন, সরি বলেন সেখান দিয়ে চলে আসছিলাম এমন সময় সেঁজুতি আমাকে পিছন দিয়ে ডাক দিলো। তারপর

–” কেন তুই কি আমাকে পছন্দ করিস?”

–” ভালোবাসি! ”

কথাটা আস্তে বলেছিলাম, তবে সেঁজুতি শুনে ফেলেছিলো। মুখ কালো করে বললো, ” একটু ওদিকে চল তো। ”

ভেবেছিলাম হয়তো থাপ্পড় দিবে, কিন্তু আমার ভাবনা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ও আমার দুই কাঁধে হাত রাখলো, তারপর চোখ বন্ধ করে আমার ঠোঁটের কাছে ঠোঁট নিয়ে একটা চুমু এঁকে দিলো আমার ঠোঁটে, তারপর দুইহাত দিয়ে ও-র মুখ ঢেকে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। কতটা ভালো লেগে ছিলো বলে বোঝাতে পারবো না। তারপর থেকে দু’জনের পথ চলা শুরু, রোজ কথা বলা, দেখা করা, একদিন ও ও-র মা’য়ের কাছে ধরা পড়ে গেলো। ও-র বাড়ি দিয়ে ওর বিয়ে ঠিক করলো। তখন সবে মাত্র অনার্স ২য় বর্ষে পড়ি আমরা দুইজন। ঠিক করলাম দুইজন পালিয়ে যাবো। দূরে কোথাও গিয়ে টিউশনি করে সংসার চালাবো, অভাব থাকলেও কষ্ট থাকবে না। কোথায় যাবো, কিভাবে যাবো কিছুই জানতাম না। এইসব নিয়ে কথা বলতেই সেদিন সেঁজুতিকে পার্কে আসতে বলেছিলাম।

সেঁজুতি এসেছিলো, আমিও গেছিলাম। কিন্তু সব শেষ তো সুখের হয় না। একটা মোটরসাইকেল সেঁজুতিকে ধাক্কা দিলো, সেঁজুতি মাটিতে পড়ে গেলো। আমি এ পাশ দিয়ে দৌড়ে যেতে গিয়ে পা জড়িয়ে পড়ে গেলাম। একটা বাস সেঁজুতিকে চাপা দিয়ে ও-র পর দিয়ে চলে গেলো। আমি দৌড়ে গিয়ে ও-কে জড়িয়ে ধরলাম। ও ততোক্ষণে অজ্ঞান হয়ে গেছে। একটা বন্ধুকে কল দিয়ে আসতে বললাম, তারপর ও-কে নিয়ে জেলা হাসপাতালে চলে এলাম। ডাক্তাররা বললেন যে অবস্থা ভালো না বিভাগীয় হাসপাতালে নিয়ে যাও। আমাদের কিছু করার নেই। দেরী না করে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ও-কে নিয়ে গেলাম। বেডে নিবে এমন সময় ও-র জ্ঞান আসলো। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ” একটা কিস করবে আমাকে?”

আমি ও-কে জড়িয়ে ধরলাম। ততো সময় ও-কে নিতে চলে এসেছে, ও চোখ মেলে কিছু সময় চারদিকে দেখলো তারপর চিরতরে চোখ বন্ধ করে নিলো। এরপর থেকে আমার আর কোনো জ্ঞান ছিলো না, যতো সময় অজ্ঞান থাকতাম ততো সময় ভালো থাকতাম, জেগে উঠলে শুধু কাঁদতাম। ছয়দিন পর একটু স্বািহলাম। ও-র কবরে মাটি দিয়ে আসলাম। সেঁজুতির বাড়ি দিয়ে আমার নামে কেস করলো, খুনের! পরবর্তীতে ওঁরা কেস তুলেও নিয়েছিলো, কারণটা আমি জানি না। তারপর আর কি বড্ড এলোমেলো হয়ে গেলাম। খেতাম না, রাতে ঘুম আসতো না। চোখ বন্ধ করলে ও-র মরার দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠত। এভাবেই দিন চলে যেতে লাগলো।

মিরা এতো সময় নিরবে সবকিছু শুনলেও এবার বলে উঠলো, ” তার তো কোনো দোষ ছিলো না। আপনি কেন নিজেকে কষ্ট দিবেন? ”

আশরাফুল মুচকি হেসে মিরার দিকে তাকালো। মিরার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। কপল দুইটা পানিতে ভিজে গেছে একদম। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে আছে। আশরাফুল হাত বাড়িয়ে মিরার চোখ মুছে দিলো। মিরা ইতস্তত হয়ে নড়েচড়ে বসলো।

–” আপনার জীবন তো একদম সিনেমার মতো। ”

–” তোমার কাছে হয়তো নাটক সিনেমার মতো কিন্তু এটাই আমার জীবন। ”

মিরার কেমন যেন খারাপ লাগছে, বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না, কিছু জড়িয়ে ধরে কাঁদলে হয়তো একটু ভালো লাগবে। তাই ঘরে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই আশরাফুল বলে উঠলো, ” চলে যাচ্ছো? আমার জীবন কাহিনী শুনবে না?”

মিরা আবারও বসে পড়লো। তারপর নিরাশ হয়ে বললো, ” এখনো শেষ হয়নি?”

–” না রে! কষ্টের জীবনের শুরুই তো এখান থেকে। ”

–” ওহ্!”

এভাবে দিন কাটতে থাকে, ঘুমের ঔষধ খেলে হয়তো কখনো কখনো ঘুম আসতো। সবকিছুর ভিতর একটা জিনিস আমার খেয়াল ছিলো যে আমি বড় ছেলের বাপের, পড়াশোনা আগের মতোই চালিয়ে যেতে লাগলাম, কিন্তু পড়তে পারতাম না, চোখের পানিতে বই ভিজে যেতো, পরীক্ষার খাতায় কি লিখবো খুঁজে পেতাম না, এভাবে সময় চলে যেতে লাগলো, এক দিন দুই দিন, এক বছর দুই বছর, এভাবে তিন বছর পার হয়ে গেলো। পড়াশোনা খুব বেশি ভালো হচ্ছিল না, তখনই আমার জীবনে আসে মিতালি। যাকে একদম তোমার মতো দেখতে, মেয়েটা অদ্ভুত ভাবে আমার সবকিছু বুঝে যেতো, আমার ছোট ছোট কষ্ট গুলো খুব সহজেই উপলব্ধি করতে পারতো, প্রথমে বন্ধুত্ব, তারপর আস্তে আস্তে প্রেম, সেখান দিয়ে কবে জানি ভালোবেসে ফেললাম। মিতালির বয়স তোমার মতো, আমাদের বয়সের পার্থক্য থাকলেও সম্পর্কে তেমন কোনো সমস্যা হতো না। ও-কে নিজের করে পাওয়ার জন্য আবারও মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। বেকার বলে সেঁজুতিকে ও-র বাড়ি থেকে আমার সাথে বিয়ে দিতে চায়নি। মিতালি যেন সেভাবে হারাতে না হয় তাই দিন-রাত কষ্ট করতাম। জীবনটা আবারও নতুন রঙে ভরে গেলো।

আমি যেদিন চাকরি পেয়েছিলাম, কতটা খুশি হয়েছিলাম তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না, এবার মিতালির বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দিবো, আগের ভুলটা আর হবে না। বেশ কয়েকদিন ধরে মিতালির মোবাইলটা নষ্ট হয়ে গেছিলো। আমাদের তেমন যোগাযোগ হতো না। কথা বলতে না পারলে আমার দম আটকে যেতো মনে হয়। তাই সেদিন বাবার কাছ দিয়ে টাকা নিয়ে ও-র জন্য একটা মোবাইল কিনলাম, কথা না বলতে পারলে আমার কিছুই ভালো লাগতো না। ও-র জন্য কেনা মোবাইল নিয়ে পার্কে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মিতালি প্রায় দিন এখানে ঘুরতে আসে বিকালে, যখন কথা হতো তখন মিতালিই বলেছিলো। ওদের পাড়াতে আমি আগে কখনো যাইনি, সেদিনই প্রথম গেছিলাম সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য, মনে মনে কত কিছু ভেবেছিলাম, মিতালি কতোটা খুশি হবে আমাকে দেখে, ভাবতেই মনটা আনন্দে ভরে উঠছিলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here