আলোছায়া পর্ব -০৬+৭

#আলোছায়া
পার্ট -৬
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল

নিজের টাকা ছিলো না বলে স্বামী চলে গেছে মেয়ের বেলায় সে এই ভুল করবেন না। বড়লোক বাড়ি দেখেই বিয়ে দিবে। এরপর মিরার বিয়ে হয়ে যায় আশরাফুলের সাথে।

–” কি হলো মা? কি ভাবছো?”

মেয়ের কথায় হুঁশ ফিরে আসে রোজিনা রেণুর। নড়েচড়ে বসে বলেন, ” না কিছু না। এসব কি শুনেছিস তুই কে জানে! এসব সত্যি না। ”

মায়ের বিচলিত চেহারা বলে দিচ্ছে সে মিথ্যা বলছে। মিরা আর দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করে না। মা হয়তো তাকে সত্যিটা বলতে চাইছে না, কেউ যদি তোমাকে কোনো কথা বলতে না চায় তবে সে কথা না শোনাই সব থেকে ভালো।
রোজিনা রেণু মিরার চিবুক স্পর্শ করে বলে, ” মা তুই ভালো আছিস তো?”

মিরার মলিন হেসে বলে, ” এইতো মা আল্লাহ যেমন রেখেছে বেশ ভালোই। খাওয়ার চিন্তা নেই। এতো বড় বাড়িতে থাকতে পারছি। আর কি চাই বলো!”

রোজিনা রেণু মুচকি হেসে বলেন, “মা আমি যা করেছি তোর ভালোর কথা ভেবেই করেছি। তোর বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে দিনরাত পরিশ্রম করে তোকে বড় করে তুলেছি। বড়লোক পরিবার দেখে বিয়ে দিয়েছে যাতে তোর বাবার মতো লোভী হয়ে না যায়। তুই আমার উপর কোনো রাগ রাখিস না মা।”

মিরা কোনো উত্তর দিতে পারে না। জীবনের এমন বাঁকে দাঁড়িয়ে একজনকে পাশে পেতে বড্ড ইচ্ছে করে কিন্তু কে তার পাশে দাঁড়াবে? কে তাকে আগলে রাখবে? এমন কি কেউ নেই!

–” মা চলো, অনেক রাত হয়েছে খেয়ে নিবে। ”

রোজিনা রেণু মেয়ের কথা মতো খেতে চলে যায়। সকলে নিজের মতো খেয়ে নিয়েছে অনেকে বাড়িও চলে যাচ্ছে। রোজিনা রেণুও খেয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। মিরা অনেকবার থাকতে বলেছিলো কিন্তু সে রাজি হয় না। পাছে মেয়েকে যদি কোনো অপমান সহ্য করতে হয়।

মিরা মন খারাপ করে ঘরে বসে আছে। চোখ দিয়ে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। কতদিন হয়ে গেলো মা’য়ের পাশে ঘুমায় না। মা একদিন থেকে গেলে কি এমন হতো! বড্ড অভিমান হয় মা’য়ের উপর। পরক্ষণেই মনে হয় মা চলে গিয়ে ভালোই করেছে, থাকলে হয়তো মিরার কষ্টগুলো চোখ পড়তো তার। কি দরকার শুধু শুধু মা’য়ের কষ্ট বাড়িয়ে। তাছাড়া এ বাড়ির কেউ তো মা’কে থাকতে বলেনি। এতো রাতে মা কি করে যাবে সে চিন্তাও কারো মাথায় আসেনি। সকলে নিজের মতো খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ছে। মিরা বা রোজিনা রেণু খেয়েছে কিনা সে খবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে হয়নি কারো কাছে, এ বাড়িতে মা না থেকেই বেশ ভালো করেছে।

মিনিট দশেক পর বাইরে ঘরে রোজিনা রেণুর গলা শোনা যায়। মিরা মনের ভুল মনে করে তেমন গায়ে লাগায় না, একমনে কিছু একটা চিন্তা করতে থাকে।

–” মিরা মা জামাই আজ যেতে দিলো না। মাঝ পথ থেকে নিয়ে এসেছে, এতো রাতে কিছুতেই একা যেতে দিলো না। ছেলেটা ”

রোজিনা রেণুর গলা পেয়ে মিরা চোখ তুলে তাকায়, আশরাফুল আর রোজিনা রেণু পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। মিরা চোখের ভুল মনে করে চোখ কচলে আবার তাকিয়ে একই দৃশ্য দেখতে পায়। আবেগে চোখ দিয়ে পানি আসতে চায়, তবে অজানা আবরণে অশ্রুকণা আঁটকে যায়। বিছানা গুছিয়ে মা’কে নিজের ঘরে ঘুমাতে বলে ছাঁদে চলে যায় মিরা। মা’য়ের পাশে ঘুমাতে বড্ড ইচ্ছে করছে তবে নিজের দাম্পত্য জীবনের কষ্ট মা’কে দেখাতে ইচ্ছে করছে না। সারাজীবন মা অনেক কষ্ট পেয়েছে, এখন না হয় মেয়ের দুঃখে কষ্ট না-ই বা পেলো।
রোজিনা রেণু বিছানায় পিঠ এলিয়ে দেয়। কিছু সময় পর গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। মেয়ে হয়তো জামাইয়ের কাছে আছে, তাই আর খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে হয় না তার।

নিস্তব্ধ রাত, অন্ধকার আকাশে কয়েকটা তারা নিজের মতো জ্বলে চলেছে। কিন্তু তাদের আলোয় পৃথিবী আলোকিত হচ্ছে না, বরং অন্ধকার আরো গাঢ়ো হয়ে ফুটে উঠেছে। মিরার রাতের অন্ধকারে তারার আলো দেখছে ব্যস্ত হয়ে আছে, আকাশ-পাতাল কিসব ভেবে চলেছে। তার পাশে একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তা মিরার চোখে পড়েনি।

–” আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি এমনকি এখন দিয়ে চলেছি, তাই না মিরা?”

আশরাফুলের কন্ঠে মিরা চমকে ওঠে। ব্যস্ত হয়ে আশেপাশে তাকায়, পাশে তাকাতেই দেখতে পায় আশরাফুল দাঁড়িয়ে আছে। বুকের সাথে হাত বেঁধে, আকাশের দিকে তাকিয়ে মিরার মতো তারা দেখছে। মিরা কোনো উত্তর দেয় না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

–” নিরবতাকে কি আমি সম্মতি ধরে নিবো?”

মিরা তবুও জবাব দেয় না। কি জবাব দিবে সে। আশরাফুল তাকে মেনে নিলে হয়তো এতো কষ্ট সহ্য করতে হতো না মিরাকে, তবুও আশরাফুলকে সে দোষ দিতে পারে না। আশরাফুল তো তাকে নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেনি, আজমল সাহেবের কথা রাখতে বিয়ে করেছে, তবুও দোষ তার। সে কি পারতো না নিজের বাবাকে বোঝাতে বা বিয়েটা না করতে কিন্তু সে তা করেনি। এমনি বিয়ে পরে কখনো মিরার কি প্রয়োজন বা মিরা কেমন আছে তা দেখতে যায়নি। তাহলে কি দোষটা তার না?

মিরা কথা ঘুরিয়ে বলে ওঠে, ” একটা প্রশ্ন করবো আপনাকে?”

আশরাফুল খানিকটা চমকে যায়। এতোদিনে মিরা কখনো তার কাছে কিছু জানতে চায়নি। যতটুকু যা কথা হয়েছে সবটাই কাজের প্রয়োজনে। তবুও মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়, আস্তে আস্তে বলে ওঠে, ” হুম বলো। ”

মিরার মাঝে সংকোচ কাজ করে, এবার ভাবে, না কিছুই জানতে চাইবে না। কি দরকার কারো কাছে কিছু জানতে চেয়ে, বলার হলে তো নিজে থেকেই বলতো। তবুও কৌতুহল কমে না। নিজের সাথে দন্দ কাটিয়ে প্রশ্ন করে, ” আপনার মানিব্যাগে আমার ছবি কেন?”

আশরাফুল শান্ত গলায় জবাব দেয়, “ছবিটা তোমার মতো দেখতে হলেও মানুষটা তুমি না। ”

মিরা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। মিরার মতো দেখতে! তার মানে মিরার মতো দেখতে আরো কেউ পৃথিবীতে আছে। কলেজে স্যারের কাছে শুনেছিলো একজনের মতো দেখতে নাকি অনেক মানুষ পৃথিবীতে থাকে। তাহলে এই ছবির মেয়েটা কি তেমনই একজন।

–” সত্যি! আমার মতো দেখতে অন্য কেউ এই পৃথিবীতে আছে? আমাকে তার সাথে একবার দেখা করিয়ে দিবেন?”

আশরাফুল মিরার কৌতুহল দেখে অবাক হয়। নিজের মতো দেখতে অন্য একজন আছে শুনে কারো মনে এতো কৌতুহল জাগতে পারে? একরাশ হতাশা নিয়ে আশরাফুল জবাবে বলে,

–” কি করে তোমার সাথে তার দেখা করাবো বলো, সে তো আমার জীবনেই নেই। হাসিখুশি ছেলেটাকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে চলে গেছে। ”

–” আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে? ”

–” শুধু আমাকে ছেড়ে চলে যায়নি। বরং মানুষের উপর আমার ভরসা বিশ্বাস এগুলোও নষ্ট করে দিয়ে গেছে। আমি চাইলেও নতুন করে কাউকে আমার জীবনে জড়াতে পারি না। বড্ড ভয় হয়। ”

–” সবাই তো সমান হয় না। একজন চলে গেছে মানে এমন তো না যে সবাই চলে যায়। ”

–” তোমার মতো আমিও এটাই ভাবতাম, তবে আমার বিশ্বাস একবার নয় দুইবার ভেঙে গেছে, ভেঙে যাওয়া গাছে নতুন পাতা গজাতে অনেকদিন সময় লাগে। আমি তো নিঃশেষ হয়ে যাওয়া মানুষ।”

মিরার কোনো কথা বলে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। নিজের জীবন-ই যখন এতো কিছু দেখিয়েছে তখন অন্যের জীবন নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করার প্রয়োজন মনে করছে না। তবুও বলে,

–” আমাদের জীবনে এমন একজন মানুষ অবশ্যই থাকে, যার কথা ভেবে আমরা শান্তি পাই। আমাদের তাঁকে নিয়ে ভাবতেও বড্ড ভালো লাগে। ”

–” তোমার জীবনে এমন কেউ আছে? যাকে নিয়ে ভাবতে তোমার ভালো লাগে?”

আশরাফুলের প্রশ্নের কি জবাব দিবে জানা নেই মিরার। তবে অচেনা কারো থেকে পাওয়া চিঠির কথাটা মনে পড়ে, কে চিঠিটা পাঠিয়েছে মিরা জানে না, তবে সে মিরাকে নিজের খেয়াল রাখতে বলেছে, এতটুকুই বা কে বলে ও-কে!

নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে মিরার। যা আশরাফুলের চোখ এড়ায়নি। আশরাফুল ব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে,

–” তোমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন করে ফেললাম। দুঃখিত। ‘

কথাটা বলে আশরাফুল ছাঁদ থেকে চলে যায়। মিরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। জীবন মানুষকে কত কিছুই না দেখায়! আজ আশরাফুল আর মিরার তো একটাই ব্যক্তিগত জীবন হওয়ার উচিত ছিলো। দুইজন একান্ত দু’জনের! তাঁরা যে স্বামী স্ত্রী। তবে এই সম্পর্কটা নেহাৎ কাগজে কলমে। বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব নেই।

রাত বাড়তে থাকে, মিরা ঠিক করে মা’য়ের কাছেই ঘুমাবে। মা জানতে চাইলে বলবে তার কাছে ঘুমাতে ইচ্ছে করছিলো খুব। তা-ই চলে এসেছে। তাছাড়া এখন রাতও অনেক হয়েছে, মা নিশ্চয়ই ঘুম। মিরা ঘরের দিকে পা বাড়ায়। হঠাৎ খেয়াল করে একটা কাগজের টুকরো পড়ে আছে। কৌতূহল বশত কাগজের টুকরো হাতে তুলে নেয়। তাতে লেখা-

“শুভ জন্মদিন প্রণয়ী। হে আমার প্রিয়তমা, তুমি আমার জীবনে না আসা পর্যন্ত আমি কখনই সুখ অনুভব করিনি। তুমি আমার জন্য এই পৃথিবীস্বরুপ। তোমার এই বিশেষ দিনে, আমি তোমার জীবনে ভালবাসা, আনন্দ, শান্তি এবং সুখের জন্য স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করি।”

আজ মিরার জন্মদিন! মিরার নিজেরই মনে ছিলো না। কিন্তু এখানে এই কাগজটা কে রাখলো? আশরাফুল?

চলবে#আলোছায়া
পার্ট -৭
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল

আশরাফুল মিরার জন্য এমন প্রেমময় চিঠি লিখেছে! মিরার যেন কথাটা বিশ্বাস হতে চায় না। আচ্ছা সেই অচেনা ছেলেটি এ চিঠি লেখেননি তো? মিরা নিজের হাতের দিকে তাকায়। পোড়া জায়গাটা বেশ শুকিয়ে এসেছে। এখন তেমন ব্যাথাও নেই। সামান্য যত্ন মানুষের মনের উপর কতটা প্রভাব ফেলে! মিরার অচেনা ছেলেটার কথা ভাবতে বড্ড ভালো লাগে। কে হতে পারে লোকটা। মিরার হাতের চিঠিটা উল্টে পাল্টে দেখে, চিঠির পিছনে এক বছর আগের তারিখ লেখা রয়েছে । নিমেষেই মিরার মনের আকাশে কালো মেঘ জমা হতে থাকে। এই বুঝি চোখ দুটি থেকে বৃষ্টি গড়িয়ে পড়বে।

কপলের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানির চিহ্নগুলো হাত দিয়ে মুছে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। অতিরিক্ত আশা করতে নেই। মিনিট পাঁচেক পর আশরাফুল ফিরে আসে।

–” মিরা একটা চিঠি দেখেছো তুমি? এখানেই হয়তো ফেলে গেছি। ”

মিরা কেন জানি কথা বলতে পারে না। গলা আঁটকে আসে। তবুও মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়। তারপর চিঠিটা আশরাফুলের দিকে বাড়িয়ে দেয়।

আশরাফুল মিরার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে। তারপর তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, ” যে নেই তার স্মৃতি রেখে কি লাভ! ভুলে যাওয়াই সব থেকে ভালো, তবুও কেন ভুলতে পারি না। ”

মিরার মনে নানান প্রশ্ন জমা হতে থাকে। তবে জানতে চাওয়ার ইচ্ছে হয় না। চুপচাপ পাশ কাটিয়ে চলে যেতে থাকে। কয়েক পা সিঁড়ি দিয়ে নামলে আশরাফুল মিরার নাম ধরে ডাক দেয়। মিরা সামান্য অবাক হয়, সে-ই সাথে অদ্ভুত এক অনুভূতির সাক্ষী হয়। নিজের অনুভূতিকে নিজের ধিক্কার জানায় মিরা। তারপর পিছন ফিরে বলে,

–” কিছু বলবেন?”

–” আজ কি তোমার জন্মদিন? ”

মিরা বুঝতে পারে না কি জবাব দেওয়া উচিত। এমন সহজ একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েও যেন বারবার থমকে যাচ্ছে। আজ কেন সবকিছু এমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে মিরার।

–” বলবে না আমাকে?”

–” হ্যাঁ, আজ আমার জন্মদিন। ”

আশরাফুলের চোখেমুখে বিস্ময় ফুটে ওঠে। কি করে দুইটা মানুষের এতোটা মিল থাকতে পারে?

–” তোমার কি যমজ বোন আছে মিরা? ”

–” না আমার কোনো বোন নেই। আমি একা। ”

হতাশার ছাপ ফুটে ওঠে আশরাফুলের মুখে। সে কি কখনো তার প্রেয়সীকে খুঁজে পাবে না? হয়তো বা না। যে নিজের ইচ্ছার হারিয়ে যায় তাকে কি আর খুঁজে পাওয়া যায়? তাকে হয়তো খুঁজে বেড়ানোও অনুচিত। তবুও কেন তাকে খুঁজতেই মন ব্যাকুল হয়ে থাকে?

মিরা আর দাঁড়াতে পারছে না। শরীরটা বড্ড ক্লান্ত লাগছে। সারাদিন অনেক কাজ করেছে সে। এখন চাইলেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করা সম্ভব না।

–” আপনি কি কিছু বলবেন? আসলে শরীরটা ভালো লাগছে না, বড্ড ক্লান্ত লাগছে। ”

–” ওহ! আমি দুঃখিত। তুমি যাও।”

মিরা দ্রুত পায়ে ছাঁদ থেকে নেমে যায়। তারপর মা’য়ের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে, রোজিনা রেণু দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ভালোই হয়েছে মিরার জন্য, না হলে রান্নাঘরের ঠান্ডা মেঝেতে ঘুমাতে হতো। বিছানায় শুয়ে নানান কথা ভাবতে থাকে মিরা। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে যায় খেয়ালই করে না।

সকালের সূর্য তখন পূর্ব আকাশে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। চারদিক সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়ে গেছে। মিরার বেশ দেরিতে ঘুম ভাঙে। সারাদিন কাজ করার পর অতো রাত জেগে থাকলে কি সকাল সকাল ঘুম ভাঙে নাকি! মিরারও তো রক্ত মাংসে গড়া শরীর। রোবট তো নয়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে আটটা বেজে গেছে। তড়িঘড়ি বিছানা থেকে নেমে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়। না জানি আজ তাকে কোন অপমান সহ্য করতে হয়৷ আবার মা-ও আছে এখানে। নিজের উপরই রাগ হচ্ছে মিরার। কে কাল ছাঁদে দাঁড়িয়ে কথা বলতে গেলো আশরাফুলের সাথে।

রান্নাঘরে গিয়ে দেখতে পায় রেশমা বানু প্লেট ধূয়ে সাজিয়ে রাখছেন। কাঁপা গলায় বলে, ” সকালে কি রান্না করবো? আমার উঠতে অনেক দেরী হয়ে গেছে, দুঃখিত। ”

রেশমা বানু কোনো উত্তর দেয় না। পিছন থেকে লাবণির কন্ঠ শোনা যায়। সে মিরার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে, ” তুমি ঘুম ছিলে বলেই ভাইয়া এতো সুন্দর একটা খাবার কিনে আনলো সবার জন্য। তুমি জেগে থাকলে তো রোজকার মতো ওইসব শাকপাতা খেতে হতো। ”

লাবণির কথায় মিরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, ততো সময়ে রেশমা রেনুর থালাবাসন ধূয়ে রান্নাঘর থেকে চলে যায়। রোজিনা রেণু রেডি হয়ে বসে আছে। মিরার সাক্ষাৎ পেলে বাসার দিকে রওনা দিবে। মিরা বাচ্চাদের মতো গিয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরে তারপর আহ্লাদী কন্ঠে বলে, ” আমাকে তোমার কাছে থাকতে খুব ভালো লাগে মা। আমাকে নিয়ে যাবে তুমি?”

রোজিনা রেণু মেয়ের ভালোবাসা দেখে একটু অবাক হয় না। ছোট থেকেই রোজিনা রেণুর সাথে এমন ব্যবহার করে মিরা।

–” মা তোমাকে সকালে কে খেতে ডেকেছিলো? ”

–” জামাই বাবা। বড্ড ভালো ছেলেটা। তুই ঘুম ছিলে বলে নিজে বাইরে গিয়ে খাবার নিয়ে এসেছে। আবার সবাইকে বলে গেছে আজ বাড়িতে রান্না করতে হবে না, বাইরে থেকে খাবার কিনে আনবে। ”

মিরা ব্যাপারটা নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখায় না। হয়তো বাইরে খাবার খেতে ইচ্ছে করেছে তাই কিনে এনেছে। সবকিছু নিজের মতো সাজিয়ে রঙিন করা উচিত নয়। পরে অনেক বেশি কষ্ট পেতে হয়। মিরা এ কষ্ট পেতে চায় না৷ রোজিনা রেণু তাড়াতাড়ি করে চলে যায়, বাড়ি গিয়ে তার অফিসে যেতে হবে। মিরা রাস্তায় পাশে দাঁড়িয়ে মা’য়ের যাওয়ার দৃশ্য দেখে, চোখ কোণ থেকে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে মিরার। শুষ্ক মাটি নিমেষেই তা শুষে নেয়। মিরার নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। কিছুই ভালো লাগছে না তার।

ঘরে গিয়ে জানালার আশেপাশে কিছু একটা দেখতে থাকে মিরা, মনে হচ্ছে কিছু খুঁজে চলেছে, কাঙ্ক্ষিত দুইটা কাগজের টুকরো দেখে ঠোটের কোনায় হাসি ফুটে ওঠে। তাড়াতাড়ি করে কাগজ দুইটা হাতে তুলে নেয়।

তার একটাতে লেখা-

” নিজের যত্ন নিতে শেখো, শুধু রাত দুপুর বেলা ছাঁদে দাঁড়িয়ে তারা দেখলে হবে? সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে, গাছে পানি দিতে হবে। এতো এলোমেলো হলে কি করে হবে শুনি?”

মিরা বুঝতে পারে না লোকটা কে! কি করে তাকে দেখতে পায়! তবে কেন জানি বড্ড ভলো লাগে মিরার। কেউ একজন আছে যাকে মিরা নিজের ভালো লাগা বলতে পারে। লোকটাকে অবশ্য মিরা দেখেনি, তবুও তার থেকে চিঠি পেতে বেশ ভালো লাগছে। দ্বিতীয় চিঠিতে লেখা –

” তোমার চোখের পানি, আর তোমার পাশে দ্বিতীয় কোনো পুরুষ আমায় বড্ড পোড়ায়। কেন এতো হিংসে হয় বলতে পারো?”

মিরা চিঠিগুলো পড়ে লজ্জা লাল হয়ে যায়, সারা মুখে লজ্জা মিশ্রিত হাসির রেখা ছড়িয়ে পড়ে। দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ ডাকে মিরা, এমন মনে হচ্ছে যেন কেউ তাকে সারাক্ষণ দেখেই চলেছে। কয়েক মুহুর্ত পরে নিজের কাজেই বিরক্ত হয় সে, চেনা নেই জানে নেই, অচেনা একটা লোকের এই তিনটা চিঠিতে এতো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। চিঠি দুইটা একটা খাতার ভাঁজে রেখে দুপুরের রান্না করতে চলে যায়।

মিরার সারাদিন কেটেছে চিঠি আর আশরাফুলের কথা মনে করে। আশরাফুলের অতীত জীবনের প্রেম কাহিনী বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে, সব থেকে বেশি অবাক হচ্ছে ওই মেয়েটাকে নিয়ে, কি করে এতো মিল থাকতে পারে ও-র চেহারার সাথে। আছে মা’য়ের কাছে শুনে দেখলে তো মন্দ হয় না। মোবাইল বের করে মা’কে কল দেয়। দুই বার রিং হওয়ার পর রোজিনা রেণু কল রিসিভ করে।

–” আসসালামু আলাইকুম মা, কেমন আছো? ”

–” ওয়ালাইকুম আসসালাম। এইতো মা আছি। তুমি কেমন আছো?”

–” আমি যেমন থাকি। দুপুরে খেয়েছিস মা?”

–” হুম মা। তুমি খেয়েছো?”

রোজিনা রেণু দুপুরে খায়নি। মেয়ের বাড়ি থেকে এসে আর রান্না করা হয়নি, তাই দুপুরে খাওয়া হয়নি। তবুও মুখে বলে, ” হুম। “.

–” মা একটা কথা জানতে চাইবো?”

–” হ্যাঁ মা বল, কি বলবি?”

–” আমার কি কোনো যমজ বোন আছে?”

–” না রে, আমার কাছে আছে। রাতে কথা বলি। ”

মিরা কল কেটে দেয়। মা তো বললো তার যমজ বোন নেই, তাহলে কি করে ওই মেয়েটার সাথে এতো মিল মিরার!

রাতের আকাশে তারা ফুটে উঠেছে। মিরা আজও ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে। রহস্যময় মানুষটা এখন তাকে দেখছে নিশ্চয়ই। আশেপাশে উঁকি দিতে থাকে, কিন্তু তেমন কাউকে দেখতে পায় না। তবুও দাঁড়িয়ে থাকে, তার চোখজোড়া যেন কাউকে খুঁজে চলেছে, অচেনা অজানা এমন কেউ, যাকে মিরা বড্ড বেশি চিনতে চায়। একবারের মতো এক পলক দেখতে চায়। দূরে তাকিয়ে দেখে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কিছু করছে, ছেলেটার মুখে মোবাইলের আলো পড়ে শুধু মুখটা দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারের ভিতর একটা ছায়া! এই কি তবে সে? মিরার কৌতূহল বেড়েই চলেছে। কিন্তু ছেলেটা অনেক দূরে, চাইলেও ডাক দেওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া মিরা তো তার নামও জানে না। এমনও নয় যে মিরা আর ছেলেটা পরিচিত। এ যদি অন্যকেউ হয় তবে অনেক ঝামেলা হয়ে যাবে। মিরার চোখে মুখে হতাশার ছাপ ফুটে ওঠে।

নিচ থেকে কেউ মিরার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ছাদে আসতে থাকে। কন্ঠ শুনে এটা স্পষ্ট বোঝা যায় এটা আশরাফুল। আশরাফুল ছাঁদে এসে মিরার হাতে একটা ফুলের তোড়া ধরিয়ে দেয়। তারপর শান্ত গলায় বলে,” I am sorry for everything. ”

কথাগুলো বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না সেখানে, হনহন করে চলে যায়। মিতা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আশরাফুল ইদানীং অদ্ভুত ব্যবহার করছে মিরার সাথে!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here