আলোছায়া পর্ব -০৪+৫

#আলোছায়া
পার্ট -৪
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল

মহিলা দুইজন উৎসুক হয়ে একে অপরের সাথে কথা বলছে। মিরা পা যেন ঘরের ভেতরে
যেতে চায় না। বড্ড জানতে ইচ্ছে করে কেন তাকে এই বাড়ির বউ করে এনেছে। কি এমন দোষ চাপা দিতে তার জীবনে এতো কষ্ট নেমে এসেছে।

মিরা ঘরে প্রবেশ করে না, বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে। মহিলা দুইজন নিজেদের মতো কথা বলতে ব্যস্ত।

–” আমাদের স্যারের নাকি ওই আয়ার দিকে কুনজর ছিলো। একদিন ফাঁকা অফিসে স্যার ও-র সাথে খারাপ কিছু করতে যায়। কিন্তু আয়া রাজি হয় না, সবাইকে বলে দিতে চায়। পরে ওই আয়ার মুখ বন্ধ করতেই ওর মেয়েকে ছেলের বউ বানিয়ে এনেছে। যাতে ও-র মুখ বন্ধ থাকে। ”

–” কি রে এই ব্যাপার! আচ্ছা এতো বড় বাড়ি স্যারের এতো বড় পদে চাকরি কিন্তু একজন কাজের লোকও তো দেখলাম না রে। ”

–” পরের চাকরি করে, বেতন আমাদের থেকে বেশি হলেও কোম্পানির মালিক তো না। কোম্পানির মালিক বিদেশ থাকে। দেশের এই কোম্পানি উনি দেখাশোনা করে। ”

–” ওহ তাই বল। আমি তো ভাবলাম উনার নিজের কোম্পানি। ”

–” আরে না। এতো বড় কোম্পানির মালিক হলে তো রাজপ্রাসাদ বানাতো। দাসদাসী থাকতো। হা হা”

–” তবে যা-ই বলো, ভাব কিন্তু রাজাদের মতো। ”

মহিলা দুইজন হেসে গড়াগড়ি দিচ্ছে, কিন্তু মিরার চোখের পানি। মা’য়ের সম্পর্কে এমন কথা সে কখনো আশা করেনি। মা নিজের সম্মান বিক্রি করে তাকে বিয়ে দিয়েছে, ব্যাপারটা কিছুতে বিশ্বাস হচ্ছে না তার।
মিরা ঘরের ভিতর প্রবেশ করে। মুচকি হাসি দিয়ে উনাদের উদ্দেশ্যে বলে, ” আপনাদের জন্য নিয়ে এলাম। কিছু লাগলে বলবেন কিন্তু। আপনাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? ”

মহিলা দু’জন মুচকি মুচকি হাসছে, একজন অন্যজনকে চোখের ইশারায় কিছু বলছে। মিরাকে দেখতে বলছে। সেসব মিরার চোখ এড়ায়নি, তবে কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মায়ের কাছে আজ সবকিছু জানতে হবে। সারাজীবন এই নরক যন্ত্রণা সহ্য করা থাকা নেহাৎ বোকামি।

বাড়িতে সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। রেশমা বানু, লাবণি আশরাফুল সকলের সাথে কথা বলছে। এরা কত সুন্দর সকলের সাথে হেসে হেসে কথা বলে, অথচ মিরার সাথে কখনো একটু হেসে কথা বলে না। ৩৫ জন মানুষের রান্না মিরা একার হাতে করেছে, একটু খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। ৩৫ জন মানুষের রান্না কি কম কথা! অল্প অল্প করে বারবার রান্না করেছে পাছে রান্না খারাপ হয়ে যায় যদি। এ বাড়িতে সব রান্না মিরা একার হাতে করলেও কখনো এতজন লোকের খাবার একসাথে রান্না করেনি। আগে বাড়িতে একজন সাহয্যকারী মহিলা ছিলো, মিরা আসার পর তাকেও বাদ দিয়ে দিয়েছে, মিরার খাওয়ার খরচ আছে, মহিলাকে বেতন দিলে নাকি টাকা কম পড়ে যাবে। হাস্যকর! মিরাও বুঝছে সে এ বাড়ির বিনা পয়সার কাজের লোক। বারবার এ জীবন থেকে চলে যেতে চেয়েছে, কিন্তু কার কাছে যাবে সে! মা’কে যতবার বলেছে আমি থাকতে চাই না। মায়ের একটাই উত্তর মানিয়ে নেও, ঠিক হয়ে যাবে।

একজন মানুষের একা ঘুরে দাঁড়াতে হলে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যেতে হয়। নয়তো কারো পক্ষে একা ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব না। মচকে যাওয়া লতাকে যেমন ডালের সাহায্য সোজা করে দেওয়া যায়, মানুষের বেলায়ও একজন মানুষের প্রয়োজন হয়। যে তাকে বুঝতে পারে। ভেঙে যাওয়া গাছে তো নতুন করে পাতার জন্ম হয়। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ একাই ঘুরে দাঁড়াতে পারে।

–” মা আমার সাথে একটু ঘরে চলো না প্লিজ। কতদিন তোমার সাথে ভালো করে কথা বলি না। এদিকটা উনারা নিজেই দেখছে তোমার আমার প্রয়োজন হবে না। ”

রোজিনা রেণু মেয়ের কথা মতো মেয়ের সাথে যায়। মেয়ে ছাড়া যে কেউ নেই তার। আধা পুরনো চাদর বিছানো বিছানায় মা মেয়ে বসে আছে। মা’য়ের চোখে মুখে নিষ্প্রাণ, মলিনতার ছাপ! মেয়ের চোখে মুখে কৌতূহল, হাজার প্রশ্ন!

–” মা আমাকে এখানে বিয়ে কেন দিয়েছো?”

–” তোর ভালোর জন্য! আমার মেয়ে এতো বড় বাড়ির বউ হবে। সুখে সংসার করবে। কোন মা এমন চায় না বল?”

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে মিরা। তারপর বলে উঠে, ” নিজের সম্মান বিক্রি করে মেয়েকে বিয়ে দিতে হলো মা? তোমার মেয়েকে কি কেউ বিয়ে করতো না? ”

রোজিনা রেণুর চোখ ছোট হয়ে যায়।তাড়াতাড়ি করে উত্তর দেয়, ” এসব কি বলছিস তুই? কেউ কি তোকে কিছু বলেছে?”

–” না আমাকে কেউ কিছু বলেনি। তবে শুনেছি। আমি যা শুনেছি তাই কি সত্যি মা?”

রোজিনা রেণু কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। কোনো এক অজানা ভাবনায় ডুবে যায়। ছেলেবেলায় বাবা শখ করে নাম দিয়েছিল রেণু, জীবনটাও তার রেণুর মতো কেটেছে, এক ফুল থেকে অন্য ফুলের খোঁজে, তার স্পর্শে ফুল থেকে ফল হয়েছে বটে তবে তার কোনো মূল্য হয়নি। বিয়ের চার বছরের মাথায় তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে অন্য মেয়ের হাত ধরে। কারণটাও ছিলো বড্ড অদ্ভুত! বিয়ের চার বছর পর মিরার যখন বছর দুই বয়স তখন এক মহিলাকে বিয়ে করে তার স্বামী মানে মিরার বাবা। সুন্দরী মহিলার ছিলো অঢেল সম্পত্তি, তার স্বামী মারা যাওয়ার পর আর বিয়েও করেনি। একাই থেকেছে, কোনো সন্তানও ছিলো না তার। মিরার বাবা ওই মহিলার বাড়িতে দারোয়ানের চাকরি করতো, বেতন সামান্য হলেও ছোট সংসার বেশ ভালোই চলে যেতো তাদের। সুখের কোনো অভাব ছিলো না। কিন্তু লোভ লালসা মানুষের মনে বাসা বাঁধলে সুখ জিনিসটা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। সুঠাম গঠনের অধিকারী মিরার বাবাকে দেখে কখনো দাওয়ান মনে হতো না। পেশিবহুল চেহারা, ফর্সা দেহ। যে কোনো রমনী তার সৌন্দর্য ছুঁয়ে দেখতো চাইবে। ওই মহিলারও এমন শখ জেগেছিলো। মিরার বাবাকে নিজের করে পাওয়ার। সে বৈধ অবৈধ যে কোনো ভাবেই মিরার বাবাকে তার চাই। বারবার প্রস্তাব দিয়েছে, কিন্তু কখনো মিরার বাবার মন গলাতে পারেনি। অবশেষে সম্পত্তির লোভ দেখানো শুরু করে, তাকে বিয়ে করলে সবকিছু লিখে দেবে মিরার বাবাকে, মিরা বাবাও যেন লোভ সামলাতে পারে না শেষ পর্যন্ত। এমন অঢেল সম্পত্তির মালিকানা অর্জন করার সহজ উপায় আর কোথায় পাওয়া যায়, রোজিনা রেণুকে তালাক দিয়ে ও-ই মহিলাকে বিয়ে করে নেয়। সে-ই থেকেই জীবন তাকে স্রোতের সাথে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে!

–” কি এতো ভাবছো মা? আমার কথায় উত্তর দেও।”

মেয়ে কথায় নিজের অতীতের স্মৃতিচারণ বন্ধ করে সে। চোখ তুলে মিরার দিকে তাকায়। কৌতূহলী চোখে মিরা তার দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো উত্তর খুঁজে পায় না রোজিনা রেণু। চোখ বন্ধ করে রাখে। তবুও বন্ধ চোখের সামনে ভেসে ওঠে কুৎসিত কালো এক দিন।

” সেদিনটি ছিলো চারদিক কালো মেঘে ঢাকা, থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ছে। বিকাল চারটায় যেন সন্ধ্যা নেমে এসেছে ধরণীতে। অফিসের সবাই বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে শুধু রোজিনা রেণু, আজমল সাহেব, দাওয়ান নিরব মিয়া আর কুসুম বিবি বাদে। আজমল সাহেবের কিসব কাজ তখনও বাকি। অফিসের বস কাজ শেষ করে বাড়িতে না যাওয়ার পর্যন্ত কি নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের ছুটি মেলে নাকি! সে-ই জন্যই এরা তখনও অফিসে নিজের কাজ করছে।

এমন সময় আজমল সাহেব কুসুম বিবিকে ডাক দেয়।

–” আমাকে এক কাপ চা দিয়ে যা তো। মাথাটা বড্ড ধরেছে। ”

কুসুম বিবি তখন দুই বছরের ছোট বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে ব্যস্ত। বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে বলে বারো বছর বয়সি তামান্না ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে মা’য়ের কাছে এসেছে। কিছুতেই কান্না থামছে না ছেলেটার! ক্ষুধার জ্বালায় বড্ড কাঁদছে। ঘরে দুধ নেই বলে খাওয়াতেও পারেনি। অফিস থেকে ওদের বাড়ি দেখা যায় তাই তেমন সমস্যাও হয়নি। কুসুম বিবি ওই পাশে ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত তাই রোজিনা রেণুই চায়ের কাপ হাতে আজমল সাহেবের দরজার কড়া নাড়ে।

–” স্যার আসবো। ”

–” হ্যাঁ। ভেতরে আয়।

–” স্যার আপনার চা। ”

আজমল সাহেব চোখ তুলে তাকায়। রোজিনা টেবিলে চা রাখছে, গলার কাছে সামান্য খোলা, শরীর দেখা যাচ্ছে। কি সুন্দর ফর্সা গলা! কোমলতায় ভরা! মনের মাঝে হিংস্র সাপটা ফনা তুলে ওঠে আজমল সাহেবের। রোজিনা বেশ সুন্দরী। ফর্সা চেহারা, একদম মিরার মতো। দেখলেই কেমন লোভ জাগে। আজমল সাহেব খপ করে হাতটা ধরে ফেলে রোজিনা রেণুর।

-” একি স্যার কি করছেন আপনি? ”

–” তুই বেশ সুন্দর রে! আজ সন্ধ্যাতে তুই আমার সাথে থাক। টাকা পাবি সেই সাথে মজাও পাবি। শুনেছি তোর বর নেই বহু বছর। ”

–” নাহ আমি এসব করতে পারবো না, আপনি আমার হাত ছেড়ে দেন। ”

–” আহ্! শোন তো। এদিকে আয়। ”

আজমল সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে, তার একহাত তখনও রোজিনা রেণুর হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। রোজিনা রেণু তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু আজমল সাহেব তাকে ছাড়তে চাইছে না। অপর হাত দিয়ে রোজিনা রেণুর আঁচল টান দেয়, শাড়ির আঁচল টান দিতেই রোজিনা চিৎকার দিয়ে উঠে, রোজিনার আঁচল ছেড়ে মুখ চেপে ধরে আজমল।

–” আমি তোরে অনেক টাকা দিবো। একটা সন্ধ্যাই তো মাত্র! না রাজি হলে তোর চাকরি খেয়ে নিবো কিন্তু! ”

–” না স্যার। চরিত্র বিক্রি করলে অনেক আগেই মেয়েকে নিয়ে ভালো থাকতো পারতাম। অফিসের বসদের শরীর দিলে বেশ সহজে চাকরি করতে পারতাম কিন্তু আমার কাছে চরিত্র আগে, আপনি আমাকে ছেড়ে দেয় আপনার চাকরি আমি করবো না। সবাইকে বলে দিবো আপনার অসভ্যতামির কথা। ”

আজমল সাহেবের মনের মাঝে জেগে ওঠা ফণা তোলা সাপ রোজিনা রেণুকে ছাড়তে চাইছে না। বিষাক্ত ছোবল বসিয়ে দিতে চাইছে। বহুদিন ধরে এ নারীকে দেখে চলেছে, অদ্ভুত সুন্দর তার শরীরের গঠন। দেখলেই বিষাক্ত মনে লালসা জেগে ওঠে। এমন সময় কুসুম বিবির গলা শোনা যায়।

–” স্যার ডেকেছিলেন আমাকে? ”

আজমল সাহেব রোজিনা রেণুর হাত ছেড়ে দিয়ে নিজের চেয়ারে বসে পড়ে। কপালে জমে থাকা ঘাম বিন্দু গুলো রুমাল দিয়ে মুছে নেয়। রোজিনা রেণু দৌড়ে বেরিয়ে যায়। কুসুম বিবি দরজার পাশে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে থাকে।

চলবে#আলোছায়া
পার্ট -৫
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল

আজমল সাহেব রোজিনা রেণুর হাত ছেড়ে দিয়ে নিজের চেয়ারে বসে পড়ে। কপালে জমে থাকা ঘাম বিন্দু গুলো রুমাল দিয়ে মুছে নেয়। রোজিনা রেণু দৌড়ে বেরিয়ে যায়। কুসুম বিবি দরজার পাশে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে থাকে।
তারপর রোজিনা রেণুর কাছে যায়। রোজিনা রেণুর হাতে আঁচড়ের দাগ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। লাল হয়ে আছে।

–” আপা আমাকে এক গ্লাস পানি দেন। ‘
হাঁপাতে হাঁপাতে কথাটা বলে রোজিনা। কুসুম বিবি একগ্লাস পানি তার সামনে ধরে। কুসুম বিবির হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে সবটুকু শেষ করে ফেলে। তারপর মন মরা হয়ে বলে উঠে, ” আমি আর এই অফিসে চাকরি করবো না আপা। আপনার জানা শোনা কোন কাজ আছে। বেতন অল্প হলেও হবে। ”

–” কেন চাকরি করবা না কেন? এইটাই তো বেশ ভালো চাকরি, বেতনও ভালোই।”

–” আমার চাকরি লাগবে না, নিজের মানসম্মান সবার আগে। ”

বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে রোজিনা রেণু। সে ভেবেছিলো কথাগুলো কুসুম বিবি শুনতে পায়নি। কিন্তু কথাগুলো ঠিকই কুসুম বিবির কর্ণগোচর হয়েছিল। পরের দিন আর অফিসে আসে না রোজিনা। বাড়িতে বসে থাকে। আজীবন নিজের সম্মান বাঁচিয়ে এসেছে, একা মেয়ে হওয়ার সবাই বারবার সুযোগ নিতে চেয়েছে। শকুনের নজর থেকে নিজেকে আগলে রেখেছে, সে-ই সাথে মেয়েকেও। জীবনে চলার পথে বারবার পড়ে গেছে, আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। এবার কেন পারবে না! এতোবার উঠে দাঁড়াতে পারলে এবারও নিশ্চয়ই পারবে।

ওদিকে অফিসে আজমল সাহেবের চিন্তার শেষ নেই। সারা অফিস জুড়ে কালকের গুঞ্জন! সত্যি কথার সাথে মিথ্যা কথা মিশিয়ে নানান গল্প। কেউ কেউ বলছে আজমল সাহেব নাকি রোজিনা রেণুকে ভোগ করে অনেক টাকা দিয়ে দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছে। কারো মতে রোজিনা রেণু লজ্জায় আর অফিসে আসে না। কুসুম বিবি নাকি নিজের চোখে সব দেখছে।
সময় যাওয়ার সাথে সাথে সমালোচনার মাত্রাও বাড়তে থাকে। আজমল সাহেবের সামনে কেউ কিছু না বললেও পিছন থেকে সব কথাই কানে আসে।

–” শিউলি আপা শোনো, আমি ভাবছি চাকরিটা ছেড়ে দিবো, যে স্যারের নজর আয়ার উপর পড়তে পারে তার নজরে আমি পড়বো না এটা কি করে হতে পারে! ”

–” আরে কিসব বলছো চাকরি কেন ছাড়বে, বরং তোমার রূপের সুধা দিয়ে প্রমোশন করিয়ে ফেলো। ”

আজমল সাহেবের অগোচরে দুইজন মহিলা কর্মচারী কথোপকথন।
আজমল সাহেবের আড়ালের বলেছে কথাগুলো তবুও আজমল সাহেবের কানে এসে পৌঁছায়, সেখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না আজমল সাহেব। ওদের চোখ এড়িয়ে নিজের কেবিনে গিয়ে বসে পড়ে। এমন চলতে থাকলে ওনার নিজের চাকরিও থাকবে না আর মানসম্মানের কথা না হয় না-ই বা বললাম। কোম্পানির মালিক বড্ড ভালো মানুষ। মেয়েদের অনেক বেশি সম্মান করে, কোনো ভাবে এ কথা তার কানে গেলে আজমল সাহেবকে চাকরি থেকে বের করে দিতে দ্বিধা বোধ করবেন না। অফিসে আজমল সাহেবের পদটা দখল করতে চায় এমন লোকেরও অভাব নেই। টেনশনে মাথা ফেটে যাওয়ার অবস্থা তার।

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে আজমল সাহেব। নিজের লালসাকে বশ করতে পারলে আজ এইদিন দেখতে হতো না। অনেক বেশি ভাবছে তো সে। কিন্তু ভাবনাটা অস্বাভাবিক কিছু না। সেবার একজন তার নিম্নপদস্থ কর্মচারীকে খারাপ প্রস্তাব দিয়েছিলো। সে ঘটনা মালিকের কানে গেলে তাকে সাথে সাথে চাকরি থেকে বের করে দেয়। কারো কোন কথা শোনেনি। সেই সাথে আজমল সাহেবকে কড়া হুকুম দেন, এসব কাজ দ্বিতীয়বার কেউ করলে যেন তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এখানে সবাই নিজের যোগ্যতা দিয়ে কাজ করে, কেউ কারো লালসা হাসিল করার বস্তু নয়। এখন এই মালিক যদি জানতে পারে আজমল সাহেব অফিসের আয়ার সাথে খারাপ কিছু করতে চেয়েছিলো তাহলে তার কি দশা করবে! ভাবতেই ভয়ে কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায় আজমল সাহেবর।
চোখ বন্ধ করে চিন্তা করতে থাকে, কি করে সব সামাল দেওয়া যায়। ব্যাপারটাকে এমনভাবে ধামাচাপা দিতে হবে যেন কারো কিছু বলার সাহস না থাকে। অনেক চিন্তা করে অফিসের দারোয়ানকে ডেকে পাঠায়।

–” স্যার ভিতরে আসবো?”

–‘ হুম আসো। আচ্ছা আমাদের অফিসের আয়া, কি যেন নাম ও-র? ”

বিদ্রুপে মুখ বেঁকে আসে নিরব মিয়ার। কাল বিকালে যার হাত ধরে টানাটানি করছিলো আজ তার নাম ভুলে গেছে। কত নাটক করতে পারে মানুষ! ইচ্ছে করে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে তবুও চাকরির ভয়ে চুপ করে থাকে। মিনমিনে গলায় বলে, ” আয়ার নাম তো রোজিনা রেণু। কিন্তু সে তো আজ অফিসে আসে নাই স্যার। ”

–” ওহ, তাহলে ও-কে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে এসো। আর হ্যাঁ এই না-ও। কিছু খেয়ে নিও। আর ও-কে সাথে করে নিয়ে আসবে। কেমন? ”

নিরব মিয়ার দিকে এক হাজার টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দেয় আজমল সাহেব। নিরব মিয়া হাত বাড়িয়ে টাকা নিয়ে রোজিনা রেণুর বাড়ির পথ ধরে। নানান প্রশ্ন মনের মাঝে জেগে ওঠে তবুও নিজেকে শান্ত রাখে। কি দরকার এসব ঝামেলায় জড়িয়ে।

–” রোজিনা আপা, এদিকে শোনো তো। ”

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁক ছাড়ে নিরব। রোজিনা তখন উনুনে ভাত চাপিয়েছে, মেয়েটা সকালে না খেয়ে কলেজে গেছে। এসে জানি গরম ভাত খেতে পারে। নিরব মিয়ার গলা শুনে বাইরে বেরিয়ে আসে।

–” কিছু বলবে নিরব ভাই?”

-” বড় সাহেব তোমাকে ডেকেছে। এখনই চলো। আমাকে তোমাকে সাথে নিয়ে যেতে বলেছে। ”

চোখমুখে ভয়ের ছায়া এসে ভীড় করে রোজিনা রেণুর। তবুও মুখে কিছু বলে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর মাথা নেড়ে ঘরের ভিতর চলে যায়। মিনিট দশেক পরে বেরিয়ে এসে বলে, ” চলো নিরব ভাই। ”

নিরব মিয়া রোজিনা রেণুর পাশে হেঁটে চলেছে। বারবার আড়চোখে এই মহিলাকে দেখছে। মাঝে মাঝে তাকে বড্ড অসহায় মাঝে মাঝে বড্ড ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। কিন্তু কারণগুলো নিবর মিয়া নিজেও ধরতে পারছে না।

–” স্যার রোজিনা আপাকে নিয়ে এসেছি। ‘

–” আচ্ছা তুই যা এখন।”
নিরব মাথা নেড়ে চলে যায়। রোজিনা রেণু মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। হাতের আঙ্গুলে কাপড় পেঁচিয়ে যাচ্ছে। কি জন্য তাকে ডেকে নিয়ে এসেছে বুঝতে পারছে না। এখন মনে হচ্ছে না আসলেই ভালো হতো।

–” রোজিনা তোর মেয়ে আছে না একটা?”

–” হ্যাঁ, একটাই মেয়ে আমার। ”

–” কি করে তোর মেয়ে?”

–” এই তো কলেজে পড়ে। অনার্স ভর্তি হয়েছে এবার। ”

–” বিয়ে দিবি তোর মেয়েকে আমার ছেলের সাথে?”

রোজিনা রেণু অবাক দৃষ্টিতে আজমল সাহেবের দিকে তাকায়। কি করতে চায় এই লোকটা। কিছুই বুঝে উঠতে পারে না।

–” আমার ছেলে একটা বড় কোম্পানিতে চাকরি করে। তুই তো ও-কে দেখেছিস। ”

রোজিনা রেণুর কাছে আশরাফুল ছেলেটা অপরিচিত নয়। কয়েকবার বাবার অফিসে এসেছে। সে-ই সুবাদেই দেখা। আজমল সাহেব এই অফিসে চাকরি দিতে চেয়েছিলো ছেলেকে তবে ছেলে নাকি নিজের যোগ্যতায় চাকরি করবে, বাবার নাম ভাঙিয়ে চলবে না। তাই রাজি হয়নি। ছেলেটার কথা বলার ধরণ বেশ ভালো। ছোট বড় সবাইকে সালাম দিয়ে কথা বলে। আগেরবার রোজিনা রেণু আশরাফুলকে চা দিতে গেলে তাকেও সালাম দিয়েছে। দেখতেও সুন্দর!

–” কি রে কি ভাবিস? এতো ভাবনা ছেড়ে দে। তোর মেয়েকে দেখতে বেশ সুন্দর। আমার বেশ পছন্দ। আমার ছেলের সাথে বেশ সুখেই থাকবে। ”

রোজিনা রেণু ভেবে পায় না৷ ছেলে ভালো চাকরি করে, স্বভাব চরিত্র ভালো এমনই শুনছে। ছেলের বাপের চরিত্র যেমন ছেলে আবার তেমন না তো। ভয় হয় রোজিনা রেণুর তবুও মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে দেয়।

–” আজ বিকালে তোর মেয়েকে দেখতে যাবো। বিয়ের ঝামেলা শেষ হলে আবার অফিসে আসবি কেমন?”

–” আচ্ছা ঠিক আছে। ”

সারাপথ চিন্তা করেও কোনো কূল পায় না রোজিনা। নিজের স্বামীর টাকার লোভে তাকে ছেড়ে চলে গেছে। সল্প বেতনে চাকরি করে এমন ছেলের কাছে মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি নয় সে। এই প্রস্তাবটা বেশ ভালো। না করার দরকার হয় না। পুরুষ মানুষের একটু সমস্যা থাকতেই পারে, আর বাপের দোষ আছে বলে কি ছেলেরও দোষ থাকবে নাকি। তাছাড়া আজমল সাহেব এতো বছর বউকে নিয়ে সংসার করছে, কই তাকে ছেড়ে অন্য কাউকে তো আর বিয়ে করেনি। মেয়ের বিয়ে সে এখানেই দিবে।

ছেলে ভালো চাকরি করে, দেখতে সুন্দর, বড় ঘর হলেই মেয়ে সুখে থাকবে। এমন চিন্তা ধারা আজকালকার ৯০% মানুষের ভিতর দেখা যায়। রোজিনা রেণুও তাদের ব্যতিক্রম নয়। হয়তো টাকাই সুখ দিতে পারে, না হলে তার স্বামী কেন তাকে ছেড়ে চলে যাবে! স্বামী চলে যাওয়ার পর থেকে রোজিনা রেণুর মনে গেঁথে গিয়েছে টাকাই জীবনে সুখ আনতে পারে, টাকা জীবনের সব। তা না হলে অমন সুখের সংসার ছেড়ে কি কেউ চলে যায় নাকি? নিজের টাকা ছিলো না বলে স্বামী চলে গেছে মেয়ের বেলায় সে এই ভুল করবেন না। বড়লোক বাড়ি দেখেই বিয়ে দিবে। এরপর মিরার বিয়ে হয়ে যায় আশরাফুলের সাথে।

–” কি হলো মা? কি ভাবছো?”

মেয়ের কথায় হুঁশ ফিরে আসে রোজিনা রেণুর। নড়েচড়ে বসে বলেন, ” না কিছু না। এসব কি শুনেছিস তুই কে জানে! এসব সত্যি না। ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here