আলোছায়া পর্ব -০২+৩

#আলোছায়া
পার্ট -২
কলমে ঃ- #ফারহানা_কবীর_মানাল

সবকাজ সেরে বিছানায় গিয়ে শরীরটা এলিয়ে দেয় মিরা। বড্ড ক্লান্ত লাগছে তার। মিরার ঘরের জানালাটা বাইরের দিকে, ছোট একটা গলিপথ দেখা যায় জানালা খুলে দিলে। সামান্য বাতাসের আশায় জানাটা খুলে দেয়। নিজের জীবন নিয়েই বড্ড হতাশ সে! সারাদিনের কাজ শেষে ক্লান্তিতে চোখ বুঁজে আসে। হাতের পোড়া জায়গায় বেশ জ্বালা করছে কিন্তু কোনো ধরনের ঔষধ মিরার কাছে নেই। কারো কাছে ঔষধ চাইতে গেলে আবার নতুন করে অপমানিত হতে হবে, কি দরকার কারো কথা শোনার! একটু কষ্ট করে যন্ত্রণা সহ্য করলে আর অপমানিত হতে হবে না। শরীরের কষ্টের থেকে যে মনের কষ্টটাই বেশি পোড়ায় মিরাকে।

–” নবাবজাদি সন্ধ্যাবেলা আমাদের নাস্তা না দিয়ে শুয়ে আছে। ফ্রী খাবার পেলে এরা মাথায় ওঠে। ”

শাশুড়ি মা’য়ের চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় মিরার। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। অনেক দেরি হয়ে গেছে, সকলের জন্য নাস্তা বানাতে হবে। কোনো রকম চোখে মুখে পানি দিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়। তাড়াতাড়ি করে নুডলস রান্না করে, সে-ই সাথে চা বানায়। এ-র থেকে বেশি কিছু করতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।

–” কি রে নবাবজাদি সন্ধ্যাবেলা কি আর নাস্তা জুটবে না? নাকি একবারে রাতের খাবার খেতে হবে?”

রাতের খাবারের নাম শুনে মনের মাঝে ভয় জড় হতে থাকে মিরার। সত্যি বলতে রাতের জন্য কিছুই রান্না করা হয়নি। তড়িঘড়ি করে টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে রাখে, রাতের জন্য রান্না বসাতে হবে। শাশুড়ি আর ননদকে নাস্তা দেওয়ার সময় আশরাফুল বাড়িতে আসে। মিরার দিকে এক পলক তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।

–” ছেলেটা কত কষ্ট করে এলো, এই যা তো ও-র ঘরে নাস্তা দিয়ে আয়। আর শোন একটা ডিম অমলেট করে নিয়ে যাবি। ”

মিরা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে চলে আসে। আশরাফুলের জন্য নাস্তা তৈরি করে ও-র ঘরের দিকে পা বাড়ায়। এই ঘরে যেতে গেলে মিরার কেমন একটা অদ্ভুত কষ্ট হয়, কত আশা করে এ বাড়িতে এসেছিল জীবনটা নতুন করে সাজাতে। ও-ই ঘরটাতে তো মিরার থাকা উচিত ছিলো। সব জিনিসে মিরার ভাগ পাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু ভাগ্যদোষে মিরা ঘরের কোনো জিনিসে হাত দেওয়ারও অনুমতি পায় না। নানান কথা ভাবতে ভাবতে আশরাফুলের ঘরের সামনে চলে আসে। কিন্তু বিনাঅনুমতিতে কি কারো ঘরে ঢোকা উচিত হবে?

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ে মিরা। আশরাফুলের বুঝতে বাকি থাকে দরজার বাইরে মিরা দাঁড়িয়ে আছে। এক মাত্র মিরা আসলেই এমন কড়া নাড়ে, অন্যকেউ তো আশরাফুলকে ডাকতে ডাকতে ঘরের ভিতর চলে আসে।

–” কিছু কি বলার ছিলো? ”

আশরাফুলের গলা শুনে মিরা শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর আস্তে করে বলে, ” আপনার নাস্তা। ”

আশরাফুল এগিয়ে এসে দরজা খুলে দেয়, মিরা নাস্তার প্লেটটা জায়গা মতো রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। অথচ এই ঘরেরই মিরার থাকার কথা ছিলো, এই মানুষটাকে একান্ত নিজের করে পাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু তা আর হলো কোথায়! দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। রাতের রান্না তখনও বাকি যে। মিরার এ বাড়িতে একটা সুবিধা আছে, তা হলো নিজের পছন্দ মতো রান্না করা। রেশমা বানু কখনো কি রান্না করতে হবে বলতে আসে না। তবে রান্নার ভুল ধরেন ঠিকই। প্রথম প্রথম মিরার বেশ অসুবিধা হতো। কখন কি রান্না করবে বুঝতে পারতো না। নানান কথাও শুনতে হতো। এখন অবশ্য মিরা কিছুটা বুঝতে পারে এদের কেমন রান্না পছন্দ।

তিন চার রকমের সবজি একসাথে ভাজি করে, সাথে কয়েকটা চিংড়িমাছ। লাউ দিয়ে ডাল, সাদা ভাত আর মাছ ভাজি। এর থেকে বেশি কিছু রান্না করতে গেলে অনেক রাত হয়ে যাবে।
রাতে খাওয়ার সময় মাছ দেখে মিরার ননদ রাগারাগি শুরু করে। সে মাছ খায় না। তবে ডাল আর ভাজি তার পছন্দের খাবার। তবুও-

–” আম্মু দেখো এই ছোট লোকটা কিসব রান্না করছে। আমি কি মাছ খাই বলো? এখন আমি কি দিয়ে ভাত খাবো? ”

রেশমা বানু মেয়ের সাথে তাল দিয়ে বলে উঠেন, ” ঠিকই তো। মেয়েটা এখন কি দিয়ে ভাত খাবো। তোকে কি আমরা বিনা পয়সায় চাকর রেখেছি যে ইচ্ছে মতো সব করবি?”

টেবিলের পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে মিরা। কি জবাব দিবে ভেবে পাচ্ছে না। বিনা পয়সায় চাকরই তো মিরা, জীবনটা কেমন হয়ে গেছে তার। রান্না আগে যদি প্রশ্ন করতো কি রান্না করবো তাহলেও তাঁকে কথা শুনতে হতো আর এখনও।

–” আচ্ছা থাক মা, বাদ দে। এই ছোটলোক এসব অখাদ্য খেয়ে বড় হয়েছে তাই ভালো কিছু রান্না করতে জানে না। আমি বরং তোমার বাবাকে বলি তোমার জন্য বিরিয়ানি নিয়ে আসতে। কি বলো মামনি?’

মায়ের কথায় খুশি নেচে উঠে লাবণি। লাবণি সম্পর্কে মিরার ননদ। তবে এসব সম্পর্ক যেন দূর থেকে মিরাকে উপহাস করে আর মিরার জায়গা যে কাজের লোকের মতো তা বুঝিয়ে দেয়।
এতো সময় আশরাফুল চুপ করে খাবার খাচ্ছিলো কিন্তু হঠাৎ কি ভেবে বলে উঠে, ” আচ্ছা মা তোমরা তো আগে দিয়ে বলে দিতে পারো কে কি খাবে, কি রান্না হবে বাড়িতে। শুধু শুধু রোজ এই অশান্তির মানে কি? আর এগুলোকে অখাদ্য বলছো কেন? খাবারকে সম্মান করতে শেখো নয়তো পরে খাবার না-ও জুটতে পারে। ”

ছেলের কথায় কপাল কুঁচকে আসে রেশমা বানুর। ছেলেটা কি বউ পাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি? পরক্ষণেই মনে পড়ে মিরাকে আশরাফুল কখনো মেনে নেয়নি। তাহলে কেন ও-র পক্ষ হয়ে কথা বললো। নানান চিন্তা মাথার ভিতর জট পাকিয়ে যেতে থাকে।

–” আম্মু আব্বুকে কল দিয়ে বলো বিরিয়ানি আনতে। ”

কোনো এক অজনা চিন্তায় ডুবে ছিলেন রেশমা বানু। মেয়ের কথা চমকে উঠলেন।

–” হুম মা বলে দিচ্ছি। এই মেয়ে এভাবে সং সেজে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা নিজের কাজে যা। ”

মিরা মাথা নিচু করে স্থান ত্যাগ করে। মাঝে মাঝে মনে হয় মাথাটা বড্ড নিচু করা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একার ভরসা হয় না মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে, রান্নাঘরে বসে কোনো রকমভাবে রাতের খাওয়া শেষ করে, থালাবাসন ধুয়ে সাজিয়ে রাখে। হাতের পোড়া জায়গাটা বেশ জ্বালা করছে। রাতের রান্না সময় আবারও একটু ছ্যাঁকা লেগেছে। ব্যাথা জায়গাতে হয়তো বেশি ব্যাথা পাওয়া যায়।

নিস্তব্ধ রাত, শহরের অলিগলিতে কোথাও কোনো আওয়াজ শোনা যায় না। আকাশে চাঁদ নেই, তবে কয়েকটা তারা মিটমিট করে জ্বলছে। মিরার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে, কেন জীবনটা এমন হলো তার। সে কি মা বাবার সাথে সুন্দর একটা জীবন পেতে পারতো না? যেমনটা লাবণি পেয়েছে। হয়তো মা বাবা একসাথে থাকলে তার জীবনটাও এমন গোছানো হতো কিন্তু সেসব আর পাওয়া হলো কোথায়! মিরার চোখের পানি যেন থামতে চাইছে না। হাতে বড্ড জ্বালা করছে, মনের মাঝেও বড্ড পুড়ছে।
এমনভাবে সময় পার হতে হতে কখন যেন চোখের পাতায় ঘুম চলে আসে মিরার। সব কষ্ট থেকে একটু মুক্তি মেলে তার।

সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয় মিরার। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারেনি। তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে নেয়। চুলায় রান্না বসিয়ে বাড়ির সামনের দিকে ছুট লাগায়, কয়েকটা ফুলগাছ আছে বাড়ির সামনে, মিরা নিজেই লাগিয়েছে। ছাঁদের উপর বেশ বড় ফুলের বাগান আছে আশরাফুলের, সেখান থেকেই ফেলে দেওয়া গাছগুলো যত্ন করে বড় করে তুলেছে, এই বাড়িতে আপন বলতে এই গাছগুলোই। ঘরের পাশেই গাছগুলো লাগাতে চেয়েছিলো মিরা যাতে গাছগুলোকে নিয়ে একটু সময় কাটাতে পারে কিন্তু শাশুড়ি মা’য়ের ঘোর আপত্তি ছিলো বলে বাড়ির সামনেই লাগাতে হয়েছে। সারাদিন রাস্তায় লোকজন থাকে বলে খুব একটা যাওয়া হয় না সেখানে৷ শুধু সকাল-বিকাল গাছে পানি দিয়ে আসে।
গাছে পানি দিয়ে এসে সকালের সব কাজগুলো একে একে শেষ করতে থাকে৷ লাবণির জন্য পাস্তা রান্না করে, মেয়েটা সকালবেলা পাস্তা পেলে আর কোনো কথা বলে না।
রান্না শেষ করতে করতে প্রায় নয়টা বেজে আসে। টেবিলে খাবার সাজিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়৷ সকাল সকাল কারো কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না আজ। হাতটা বড্ড বেশি কষ্ট দিচ্ছে, পানি লেগে হয়তো বেশি জ্বালা করছে।

ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে পড়ে, কাজ করে ক্লান্ত লাগছে শরীরটা, ক্ষুধাও লেগেছে একটু একটু। হঠাৎ চোখ পড়ে জানালার দিকে, জানালার পাশে কিছু একটা রাখা মনে হচ্ছে, সকালবেলা জানালাটা খুলে রেখেছিলো মিরা, কে কি রেখে গেছে কে জানে। মিরা কাছে গিয়ে দেখতে পায় একটা মলম, এক পাতা নাপা টেবলেট আর একটা চিরকুট। তাতে সাজানো অক্ষরে লেখা রয়েছে, –” নিজের যত্ন নিতে শেখো। ”

বড্ড অবাক হয় মিরা, কে করতে পারে এমন কাজ। হঠাৎ মনে পড়ে সকালে গাছে পানি দেওয়ার সময় একটা ছেলেকে মিরাকে লক্ষ্য করছিলো বারবার, কয়েকবার মিরার হাতের দিকেও তাকিয়েছে, মিরা দেখতে পেয়ে ওড়না দিয়ে হাতটা ঢেকে ফেলেছিলো তখন। তাহলে কি সে-ই ছেলেটা এ কাজ করছে? ভাবতেই মিরার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে৷ কেমন অস্থির লাগছে যেন। তবুও হাতে ঔষধটা লাগিয়ে নেয়। যদি কিছুটা কষ্ট লাঘব হয় এই আশায়।

–” এই মিরা এদিকে শোন তো।”

রেশমা বানুর গলা পেয়ে খাবার ঘরের দিকে পা বাড়ায় মিরা। দূর থেকে একজোড়া চোখের মালিক মিরা কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করছিলো। সে কথা মিরার অজানাই থেকে যায়।

চলবে#আলোছায়া
পার্ট -৩
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল

রেশমা বানুর গলা পেয়ে খাবার ঘরের দিকে পা বাড়ায় মিরা। দূর থেকে একজোড়া চোখের মালিক মিরা কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করছিলো। সে কথা মিরার অজানাই থেকে যায়।

খাবার টেবিলে মিরার শশুর, শাশুড়ি, লাবণি আর আশরাফুল বসে আছে। সকলে নিজেদের মতো খাবার খাচ্ছে, মিরা ওদের কার কি প্রয়োজন লক্ষ্য করছে, কেন যে এরা মিরাকে বাড়ির বউ করে নিয়ে এসেছিলো ভেবে পায় না সে। মাঝে মাঝে মা’য়ের কাছে জানতে ইচ্ছে করে, এদের সবাইকেও প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, অসহায় বলে কি যা খুশি করবে আমার সাথে কিন্তু কথাগুলো বারবার গলার কাছে এসে আঁটকে যায়।
নিজের মা’ই যখন মেয়ের কথা শুনতে চায় না, কষ্ট বুঝতে চায় না সেখানে অন্য মানুষ কেন-ই বা এসব করবে।

খাবার মুখে দিতে দিতে রেশমা বানু বলেন, ” সন্ধ্যায় ওদের বাবার অফিস থেকে কয়েকজন লোক আসবে, সবকিছু গুছিয়ে ভালো কিছু রান্না করে রাখবে। ওদের যেন কোনো অসম্মান বা অযত্ন না হয়। ”

আজমল সাহেবের অফিসের লোকজন আসবে শুনে মিরার চোখ আশায় জ্বলজ্বল করে ওঠে৷ আবেগের বশে বলে ফেলে, ” মা-ও কি আসবে? ”

মিরার কথাটা যেন এখানের কেউ আশা করেনি। লাবণি মুখে পাস্তা পুরতে পুরতে বলে, ” তোমার মা বাবার অফিসে কি চাকরি করে? ওহ হ্যাঁ আয়ার কাজ করে, তাকে কেন আমাদের বাড়িতে দাওয়াত করে আনতে যাবো? থার্ডক্লাশ লোকজন!”

–” তাহলে সেই থার্ডক্লাশ লোকের মেয়েকে কেন এ বাড়ির বউ করে এনেছো? ফ্রী-তে কাজের লোক হিসাবে? যখন নিজে এমন পরিস্থিতিতে যাবে তখন শুধু লোকের অফিস নয় লোকের পায়ের জুতোও মুছবে। ”

মিরার কথায় সকলে চমকে যায়। মিরা এমন জবাব দিতে পারে কেউ আশা করেনি। রেশমা বানু কর্কশ গলায় বলে ওঠে, ” এই মেয়ে তুই ভদ্রতা জানিস না? আমার মেয়েকে এভাবে অভিশাপ দিচ্ছিস। তোর মা তো তোকে কিছুই শেখায়নি দেখছি। ”

মা’য়ের নামে কোনো প্রকার বাজে কথা মিরার সহ্য হয় না। যে মা একা হাতে ও-কে মানুষ করেছেন তাকে নিয়ে কেউ বাজে কথা বললে কাউকে ছেড়ে কথা বলার মেয়ে মিরা নয়। অসহায় হতে পারে তবে বোবা তো নয়। ঝাঁঝালো কণ্ঠে কিছু বলতে যাবে এমন সময় আশরাফুল বলে ওঠে, ” মা অন্যের মেয়েকে শিক্ষা না দিয়ে নিজের মেয়েকে ভদ্রতা শেখাও, কাজে লাগবে। ”

মিরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আশরাফুলের দিকে, এই লোকটা কখনো কখনো বড্ড বেশি সাপোর্ট করে মিরাকে, কারণটা খুঁজে পায় না মিরা। তবে বেশ ভালো লাগে। মনে কোনো আশার আলো ফুটে ওঠে, কিন্তু পরে কোনো এক দমকা হওয়ার মাঝে আলোটাও হারিয়ে যায়।

আজমল সাহেব সচারাচর মিরার ব্যাপারে কথা হলে কিছু বলেন না। আজ কি মনে করে বললেন, ” ও-র মা-ও আসবে। সবাইকেই বলেছি। সবকিছু রেডি রেখো। ”

মিরার চোখে আজ খুশির অশ্রু, কতদিন বাদে মা’কে দেখতে পাবে। বিয়ের পরে মাত্র কয়েকবার মা’য়ের সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়েছে। বহুদিন পর মা’কে দেখতে পাবে। আজ মা আসলে তার কাছে প্রশ্ন করবে কেন বিয়ে দিয়েছিলো তাকে। কি জন্য এতো কষ্ট তার জীবনে!

চোখ কোণে জমে থাকা পানিটা মুছে নিজের কাজে মন দেয় সে। হাতে সামান্য ব্যাথা করছে তবুও রেশমা বানুর কাছে কি কি রান্না হবে জিজ্ঞেস করতে যায়। লাবণি আর রেশমা বানু তখন সন্ধ্যায় কে কি পরবে তাই নিয়ে আলোচনা করতে ব্যস্ত হয়ে আছে। দরজার কড়া লাড়ে মিরা।

–” কি কি রান্না করবো? আর কতজন লোক আসবে যদি একটু বলতেন গুছিয়ে রাখতাম।”

–“দেখেছো মা নিজের মা আসবে বলে কাজের কত তাড়া এই মেয়ের!”

–” তোর মা তোর কাছে আসলে কি তুই কিছু করতি না?”

আশরাফুলের কথায় সবাই বেশ চমকে যায়। বেশ কয়েকদিন ধরে ছেলের মাঝে পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছে রেশমা বানু। ছেলে কথায় কথায় এই মেয়েকে সাপোর্ট করছে। ব্যাপারটা খুব বেশি ভালো লাগছে না তার। পুরুষ মানুষের মন সুন্দরী মেয়ে দেখলে তো গলেই যাবে। বলা বাহুল্য মিরা যথেষ্ট সুন্দরী। সুন্দরী না হলে আশরাফুলের সাথে বিয়ের প্রস্তাব কখনোই পেতো না। আজকাল লোকজন সাদা চামড়ার কাছে বড্ড দূর্বল। মুখে যা-ই বলুক বা নিজে দেখতে যেমনই হোক না কেন, তাদের পছন্দ লম্বা ফর্সা মেয়ে। আমি নিজেও এর ব্যতিক্রম নয়।

–” আশরাফুল! তুমি আজ-কাল এই মেয়ের হয়ে কথা বলছো যে? তোমার থেকে আমি এসব আশা করি না। ”

রেশমা বানুর কথা আশরাফুলের দিকে চোখ তুলে তাকায় মিরা। আশরাফুল শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে কোনো হিংস্রতা নেই। সে শান্ত গলায় বললো, ” তাহলে কি আশা করো তুমি মা? আমি ও-কে কথায় কথায় অত্যাচার করি? ওর গায়ে হাত তুলি?”

রেশমা বানু কোনো জবাব দিতে পারে না। মিরা মিনমিনে গলায় বলে, ” আমার জন্য আপনার কিছু বলতে হবে না। আমি… ”

কথা শেষ করতে পারে না মিরা তার আগেই আশরাফুল বলে ওঠে, ” আমি কিন্তু তোমাকে কিছু বলিনি। তোমার বিষয়েও কোনো কথা বলনি প্রথমে। আমি শুধু লাবণির কাছে জানতে চাইলাম মা গেলে ও কিছু করতো কিনা। যাইহোক বাজার করতে হবে তাই লিস্ট নিতে এসেছি। ”

লাবণি হয়তো ভাইকে কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু আশরাফুল সে সুযোগ না দিয়ে চলে গেলো। চোখমুখ কুঁচকে মিরার দিয়ে চেয়ে রইলো সে। রেশমা বানু নিজের হাতে লিস্ট বানিয়ে মিরা দিয়ে দিলো। যাওয়ার আগে কড়া গলায় বললো, ” রান্না জানি ভালো হয়, লোকের সামনে জানি মানসম্মান থাকে আমাদের। আর হ্যাঁ তোর ভালো কাপড় আছে তো?”

মিরা মাথা নাড়িয়ে না বলে, সত্যি বলতে তার ভালো কোনো কাপড় নেই। বিয়েতে যেসব কাপড় পেয়েছে তাই এতোদিন ধরে পরে আসছে সে। অভাব অনটনে বড় হওয়া মিরা খুব ভালো করে জানে কি করে একটা কাপড় বহুদিন ধরে ব্যবহার করতে হয়।

আশরাফুল বাজার থেকে ফিরে আসে। সাথে একজন লোকও আছে। এতো পরিমাণ রান্না মিরা একা কখন শেষ করবে মিরা জানে না। আজকের মেনুতে ইলিশ মাছ ভাজা, পোলাও, রোস্ট, গরুর গোশত, ডিম আর সালাত। সাথে অন্য কিছু আছে কিনা দেখতে হবে। ছয়টা বড় বড় ব্যাগ ভর্তি বাজার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ১১টা ৩০ বাজে। সন্ধ্যার আগে সব রান্না শেষ করতে হবে। শাশুড়ি মায়ের কড়া নির্দেশ লোকজনের সামনে কাজ করা যাবে না। একটা শাড়ি পরে ঘুরঘুর করতে হবে। লোক দেখানো সংসার কিনা! মিরা ভেবেছিলো মাছ কুটে ধূয়ে রেখে দিবে, আর মশলা পিঁসে রাখবে। তারপর গোসল সেরে বাকিসব রান্না করবে। কিন্তু দেখলো আশরাফুল মাছগুলো বাজার থেকে কেটে এনেছে। ৩৫জন মানুষের রান্না একা করা সহজ ব্যাপার না।

আস্তে আস্তে একা হাতে সব কাজ করতে থাকে মিরা। রান্না শেষ করতে করতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসে। কাজের চাপে গোসল করার সুযোগটুকু পায়নি সে। রেশমা বানু আর লাবণি ঘরের সবকিছু গুছিয়ে রেখেছে, প্লেট ধূয়ে সাজিয়েছে। তবে রান্নার কোনো কাজে হাত লাগায়নি।
সব রান্না শেষ করতে করতে মাগরিবের আজান দিয়ে দেয়। মিরা তড়িঘড়ি করে গোসলে করতে চলে যায়। রেশমা বানু মিরার খাটের উপর একটা শাড়ি রেখে গেছে সাথে কিছু গহনা। লোকের সামনে ভালো সাজতে মানুষ কিনা করে! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাথরুমে চলে যায় মিরা। গোসল শেষ করে শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে নেয়। গহনাগুলো পরে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যেন নিজেই চিনতে পারে না সে, এতো সুন্দর লাগে মানুষকে সাজলে! হয়তো বা! মিরা মাথায় হিজাবটা জড়িয়ে নেয়। কত্ত লোক আসবে তাদের সামনে খোলা চুলে থাকতে চায় না সে। এতো সুন্দর করে সাজায় পরেও নিজেকে দেখে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মিরার।

সব আয়োজন শেষ, বাড়িতে লোকজন আসতে শুরু করেছে। মিরা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মা’য়ের অপেক্ষায়। সবার পেছনে মিরার মা হেঁটে আসছে, পা যেন চলতে চায় না তার। মেয়ের সামনে দাঁড়াতে চায় না মোটেই।

মা’কে দেখতে পেয়েই মিরা তাকে জড়িয়ে ধরে। অবাধ্য চোখের পানি যেন বাঁধ মানতে চায় না। রেশমা বানু কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। দাওয়াতে আসা লোকজন সব জানলেও নতুন করে অবাক চোখে তাকায়। মিরা সব দেখতে পেয়েও চোখ বন্ধ করে থাকে। সকলে নিজের কাজে ব্যস্ত, মিরা মা’য়ের সাথে গল্প করছে, এমন সাজে মেয়েকে দেখে মা’য়ের চোখ জুড়িয়ে যায়।
হঠাৎ রেশমা বানু মিরাকে ডেকে নিয়ে যায়। দুইজন মহিলাকে কিছু খাবার দিয়ে আসতে বলে। তারা পাশের ঘরে বসে গল্প করছে। মিরা খাবারের থালা সাজিয়ে উনাদের দিকে যায়।

–” আচ্ছা এতো বড়লোক পরিবার এরা। বস কেন আমাদের অফিসের আায়ার মেয়েকে বিয়ে করলো বলো তো? এরা তো ধনী পরিবারের ভালো মেয়েকে ছেলের বউ করতে পারতো।”

–” আরে তুমি তো নতুন তাই জানো না। আমাদের অফিসে একটা কথা গুজব আছে। বস নিজের দোষ চাপা দিতে নাকি আয়ার মেয়েকে বউ করছে। ”

মহিলা দুইজন উৎসুক হয়ে একে অপরের সাথে কথা বলছে। মিরা পা যেন ঘরের ভেতরে
যেতে চায় না। বড্ড জানতে ইচ্ছে করে কেন তাকে এই বাড়ির বউ করে এনেছে। কি দোষ চাপা দিতে তার জীবনে এতো কষ্ট নেমে এসেছে!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here