আলোছায়া পর্ব -শেষ

#আলোছায়া
শেষ পার্ট
কলমে ঃ- ফারহানা কবীর মানাল

মিরার যতদূর মনে পড়ছে সকালে সবকিছু গুছিয়ে রেখেছিলো সে। কিছু বুঝতে না পেরে মিরা খাবার ঘরের দিকে পা বাড়ায়। লাবণি নুডলস বানাতে এসেছিলো হয়তো। কিন্তু কাবার ঘরের দৃশ্য একদম আলাদা। রেশমা বানু, আশরাফুল, লাবণি সকলে মিলে খাবার খাচ্ছে। সকলের মুখেই হাসি লেগে রয়েছে।

মিরাকে দেখে আশরাফুল মুচকি হেসে বললো, ” মিরা তুমিও আমাদের সাথে বসে পড়ো। ঠান্ডা হলে খেতে ভালো লাগবে না। ”

আশরাফুলের সাথে তাল মিলিয়ে লাবণিও বলে উঠলো,” হ্যাঁ হ্যাঁ তুমিও চলে আসো। ভাইয়ার হাতের রান্না এতো মজার হয়। কি বলবো তোমাকে! শেষ পর্যন্ত কেন ভাগেই পেলে না। ”

আশরাফুল রান্না করেছে, মিরা ঘুমিয়ে ছিলো তার জন্যই কি সে রান্না করেছে! মিরা ভাবতেও পারে না এমন কথা। কিন্তু নিজের চোখকে কি করে অবিশ্বাস করে সে। মিরা এগিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়ে। আশরাফুল নিজেই মিরার প্লেটে খাবার বেড়ে দেয়। এসব খাবার কখনো রান্না করেনি মিরা তাই নামও বলতে পারছে না। এই পৃথিবীতে কত প্রকারের খাবার আছে কে জানে! আশরাফুল সত্যিই অনেক সুন্দর রান্না করে। মিরা খুব তৃপ্তি করে খাবারটা শেষ করলো। ইচ্ছে করছিলো আরও একটু খেতে কিন্তু বলতে পারলো না। খাওয়া শেষ করে সকলে নিজের মতো চলে গেলো। মিরা থালাবাসনগুলো গুছিয়ে রাখছে। এমন সময় রেশমা বানু মিরার কাছে আসলেন।

মিরার হাত ধরে বললেন, ” মা তোমার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি । নিজের ছেলের জীবনের প্রতি উদাসীনতা নিয়ে আমি তোমাকেই দোষারোপ করতাম। তোমার সাথে বিয়ে হওয়ার পর থেকেই ছেলেটা কেমন পাল্টে গেলো। একদম আগের মতো। তুমি হয়তো জানো না আশরাফুল আগেও একটা মেয়েকে ভালোবাসত। মেয়েটা মারা যাওয়ার পর আশরাফুল আর নিজের মতো ছিলো না, সময়ের সাথে ছেলেটা যখন একটু একটু করে ঠিক হয়ে যাচ্ছিলো তখনই তোমাদের বিয়ে আর ছেলেটা আবারও বদলে গেলো। আমি মানুষ হিসাবে হয়তো খুব খারাপ৷ তবে মা হিসাবে নিজের ছেলে মেয়ে দুইটাকে খুব ভালোবাসি। এতোদিন পর আজ আবারও ছেলেটা খুব খুশি দেখছি আমি। তুমি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে ছিলে বলে ও নিজেই রান্না করছে আমাদের সকলের জন্য। আমি ও-কে রান্নাঘরে দেখে প্রশ্ন করলাম, কি করছো তুমি? উত্তরে বললো, মিরা অনেক ক্লান্ত তাই রাতের রান্না করছি। ছেলেটা তোমার বড্ড ভালোবেসে ফেলেছে হয়তো। ও-কে তুমি কষ্ট দিও না৷ পারলে আমাকে মাফ করে দিও। ”

কথাগুলো বলে আর এক মুহুর্ত সেখানে দাঁড়ালো না রেশমা বানু। চোখের কোণে জমে যাওয়া পানিগুলো মুছতে মুছতে স্থান ত্যাগ করলো। মিরা কিছু ভাবতে পারছে না। কিছু ভাবতেও চাইছে না। খুব খুশি লাগছে তার, এই খুশিকেই সে উপভোগ করতে চায়।

বাকি কাজগুলো শেষ করে মিরা নিজের ঘরে চলে এলো। অনেক রাত পর্যন্ত সে ঘুমাতে পারেনি, শুধু আশরাফুলের কথাই ভেবেছে, তাঁর সাথে কাটানো সময়গুলো মনে করছে, কখনো লজ্জা পেয়ে একাই হেসেছে।

সময় এখন খুব ভালোই কাটছে আশরাফুল মিরার। মিরার কয়েকদিন কলেজে যেতে হবে, সকালে দুইবেলার রান্না করে তারপর আশরাফুলের সাথেই কলেজে উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ে। যদিও আশরাফুলের অফিস উল্টো দিকে তবুও সে মিরাকে কলেজে নামিয়ে অফিসে যায়। ছুটির সময় মিরা একাই বাড়ি ফিরে আসে। তখন আশরাফুল অফিসে থাকে। যাওয়ার পথে মিরাকে কখনো ফুচকা কখনো আইসক্রিম কিনে দেয় আশরাফুল। তাদের সম্পর্কটা স্বামী স্ত্রী হয়ে না উঠলেও বন্ধুত্বটা খুব বেশি গভীর। চলার পথে রাস্তায় অনেক গাড়ি থাকলে মিরার হাতটা ধরতে দ্বিধা করে না আশরাফুল। বাইকে চলার পথে আশরাফুলের কাঁধে হাত রাখতেও দ্বিধা হয় না মিরার। দু’জন হয়তো দু’জনকে ভালোবাসে তবে কিছুতে বলতে পারে না। হয়তো ভয়, নয়তো দ্বিধা!

এমন সুখের মাঝেও একটা চিঠি সবটা এলোমেলো করার বার্তা দিয়ে যায়। সেদিন সন্ধ্যায় আশরাফুলের ঘরে চা দিতে গিয়েছিলো মিরা। আশরাফুল চা খেতে খেতে নিজের কাজে মন দিয়েছিলো। মিরাও পড়তে হবে বলে ঘরে চলে আসে। এতোদিন ওই চিঠি দেওয়া লোকের কোনো খবর না থাকলেও আজ একটা চিঠি পড়ে আছে জানালায় পাশে। মিরা চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করে,

প্রিয় মিরা,

তুমি হয়তো ভালোই আছো। আমি একদমই ভালো নেই তোমাকে ছাড়া। অনেক দাবী করেছি তোমার ভালোবাসা কিন্তু তুমি কখনো রাজি হওনি। এতোদিন অনেক খেয়াল রেখেছি তোমার, কাছ থেকে না পারি দূর থেকেই তোমার ভালো চেয়েছি, তোমাকে ভালোবেসেছি। সবকিছুর বিনিময়ে একদিন একটু দেখা করো আমার সাথে। একা না আসলেও কারো সাথে। তোমার সাথে একদিন কয়েকটা মিনিট হলেও সময় কাটাতে চাই। এটাই আমার শেষ দাবী। আর কখনোই তোমার সামনে আসতে চাইবো না। শুধু একবার… ….

ইতি,
তোমার অচেনা শুভাকাঙ্ক্ষী

চিঠিটা পড়ে দ্বিধায় পড়ে যায় মিরা। কি জবাব এই চিঠির। তবে এই অচেনা লোকটা মিরার পাশে থেকেছে। মিরার পাশে যখন কেউ ছিলো না তখনও তাঁকে সাহায্য করতে চেষ্টা করেছে। কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে হলেও একবার তার সাথে দেখা করা উচিত। মিরা সিদ্ধান্ত নেয় সত্যিই দেখা করবে লোকটার সাথে। কিন্তু এই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে গিয়ে আশরাফুলকে হারাতে রাজি নয় সে। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয়, আশরাফুলকে সাথে নিয়েই ও-ই অচেনা লোকের সাথে দেখা করতে যাবে। তাহলে নিশ্চয়ই আশরাফুল তাকে ভুল বুঝবে না।

মিরাও একটা চিঠি লিখে জানালার উপরে রেখে দেয়।

জনাব,

আমি কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে একদিন আপনার সাথে দেখা করবো। আমি কাল কলেজ ছুটির পর বকুলতলায় আপনার জন্য অপেক্ষা করবো। আপনি পারলে আসবেন, আর আমি আমার সাথে আমার সব থেকে কাছের বন্ধুকে নিয়ে আসবো।

ইতি,
মিরা

পরদিন কলেজে যাওয়ার সময় মিরা আশরাফুলকে বলে, ” আমি একজন অচেনা লোকের সাথে দেখা করবো, ও-ই পরিচিত আর কি, তবে কখনো দেখিনি। আপনি কি আমার সাথে যেতে পারবেন?”

আশরাফুল উত্তরে বলে, ” অফিসে কাজ না থাকলে নিশ্চই আসবো, তবে কথা দিতে পারছি না এখনই। ”

মিরা শুধু হাসে। কোনো কথা বলে না। আশরাফুলের সামনে কি ওই ছেলেকে মিরাকে উল্টোপাল্টা প্রস্তাব দিয়ে বসবে? কিছুই বুঝতে পারছে না। ছুটির পরে মিরা বকুলতলার দিকে হাঁটা শুরু করে। আশরাফুল আগেই সেখানে বসে আছে। মিরা সামান্য অবাক হয়, আশরাফুলকে তো সে জায়গার নাম বলেনি। পরক্ষণেই মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে গেলে। আশরাফুল কাছে গিয়ে বলে, ” আপনার কাজ নেই অফিসে? তা বেশ ভালোই হয়েছে। আমি ও-ই লোকটা চিনি না, আমাদের অপেক্ষা করতে হবে তার আসার জন্য। যেহেতু আমি তাঁকে চিনি না তাই সে এসে আমার সাথে কথা বললেই বুঝতে পারবো। ”

আশরাফুল উত্তরে কিছু বলে না। কেমন অদ্ভুত চোখে মিরার দিকে তাকিয়ে থাকে। কয়েক মুহুর্ত পরে একটা কাগজ এগিয়ে দেয় মিরার দিকে। মিরা অবাক হয়ে কাগজটা খুলে দেখে। অচেনা লোকের হাতের লেখার মতো হুবহু সে-ই হাতের লেখা।

প্রেয়সী,

আমি তোমাকে ভালোবাসি কিনা জানি না। তবে বাকি জীবনটা তোমার হাত ধরেই কাটাতে চাই। তোমায় কতটা সুখ দিতে পারবো বলতে পারি না তবে তোমার হাসিতে সুখ খুঁজতে চাই। তোমার কখনো কাঁদাবো না এমনটা বলবো না। শুধু বলবো যখন তোমায় কাঁদাবো তখন শক্ত করে তোমাকে জড়িয়ে ধরে রাখবো, যাতে অভিমান করে হারিয়ে যেতে না পারো। এইবার কি আমাকে ভালোবাসা যায়?”

ইতি,
তোমার আশরাফুল

মিরা চিঠিটা পড়ে হতবাক হয়ে যায়। তার মানে আশরাফুল এতোদিন মিরাকে চিঠি লিখতো। মিরার সবকিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। আশরাফুল মিরার মুখের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে, ” উত্তর দেও না। এইবার কি আমাকে ভালোবাসা যায়?”

মিরা কি উত্তর দিবে ভেবে পায় না। সে যে আশরাফুলকে ভালোবাসে না এমনটা নয়৷ তবে এমন সুখের মুহুর্ত তার জীবনে আসবে সে কখনো ভাবতে পারেনি। সত্যি সে আশরাফুলকে হারাতে চায় না।

মিরা অস্পষ্ট গলায় হ্যাঁ সূচক উত্তর দেয়। আশরাফুলের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ভালোবাসার মানুষের মুখে ভালোবাসি শোনা সত্যিই সুখকর বিষয়।

মিরা আশরাফুলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, ” আপনি আমাকে চিঠি লিখতেন কেন শুনি?”

–” ভালোলাগা থেকে।”

আশরাফুল একটা বেঞ্চে বসে পড়ে। মিরাও ইশারায় বসতে বলে। মিরা আশরাফুলের পাশে গিয়ে বসে। আশরাফুল মিরার হাত ধরে বলতে শুরু করে,” আসলে তুমি তো আমার আগের জীবন নিয়ে প্রায় সবকিছুই জানো। আমাদের বিয়ে সাতদিন আগেই কি হয়ে ছিলো আমার সাথে, নিজেকে গুছিয়ে নিতে অনেকটা সময় লেগেছে আমার। যখনই স্বাভাবিক হয়েছি তখন থেকে বুঝতে পেরেছি তোমার সাথে অন্যায় করেছি। আমার জীবনে ঘটে যাওয়ার ঘটনার তোমার তো কোনো দোষ নেই। তোমাকে না জানি কতটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছি আমি। খুব ইচ্ছে করতো তোমার কাছে সবকিছু জন্য মাফ চাইতে, কিন্তু কোন মুখ নিয়ে তোমার সামনে দাঁড়াতাম বলো? তার জন্যই এই পথ বেছে নিলাম। এরপর আস্তে আস্তে তোমার প্রেম পড়েছি। কবে থেকে যে ভালোবাসি তা ঠিক বলতে পারবো না। ”

মিরা কোনো উত্তর দেয় না। হয়তো আশরাফুল মিরার জীবনে কষ্টের কারণ ছিলো। হয়তো আশরাফুল পাশে দাঁড়ালে একটা বছর এতো কষ্ট হতো না। তবে একটা মানুষের একটাই তো মন। চাইলেি সবসময় সঠিক কাজটা করা হয়ে ওঠে না। মিরা আশরাফুলকে সবকিছুর জন্য মাফ করে দিতে চায়। সব দোষগুলোকে ভালোবাসার আড়ালে চাপা দিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চায়। মিরা এইবার আর চুপ করে থাকে না।

আশরাফুলের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে। তারপর ভাঙা গলায় বলে, ” আমি আমার বাকি জীবনটা আপনার সাথেই কাটাতে চাই। ভালোবাসি। ”

চারিদিকের লোকজনকে উপেক্ষা করে আশরাফুল মিরাকে জড়িয়ে ধরে। এখন থেকেই শুরু হবে মিরা আশরাফুলের নতুন জীবন। হয়তো অনেক ঝড়-তুফান আসবে, তবুও দু’জন দু’জনের হাতটা শক্ত করে ধরে থাকলে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যাবে।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here