আলো আঁধার, পর্ব:২০+২১

#আলো_আধাঁর
লিখা- জেসিয়া জান্নাত রিম

২০.
পুরো রুমের জিনিস পত্র চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হাতে একটা ফল কাটার ছুরি নিয়ে ফ্লোরে বসে আছে হিয়া। চোখ মুখ লাল হয়ে ফুলে আছে। এই দৃশ্য দেখে দ্রুত হিয়ার কাছে যেতে গিয়ে একটা ভাঙা ফ্লাওয়ার ভাসের কাঁচে বেশ অনেক খানি পা কেটে গেল রাজিবের। তবে সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে ও হিয়ার পাশে বসে দ্রুত ওর হাত থেকে ছুড়ি টা নিয়ে নিল। হিয়া বেশ ঠান্ডা গলায় ওকে বলল,
ভয় পেয়ো না মরার হলে তোমার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করতাম না। এখন বুঝতে পারছি আমার বোনটা কেন এমন একটা কাজ করেছিল। বলোতো এই টুকু সময়ে তোমাকে এতো ভালোবেসে ফেললাম কেন?
আমাকে পুরো ব্যাপারটা এক্সপ্লেইন করতে দাও হিয়া।
কি বলবে তুমি? বাচ্চাটা তোমার সেটা তো বলেই দিয়েছো। এমনি এমনি তো আর একটা বাচ্চা হয়ে যায় না। তোমাদের মধ্যে সেই রকম সম্পর্ক ছিল বলেই তো বাচ্চাটা…… নিজের ওপর খুব ঘৃণা হচ্ছে জানো। যখনই মনে হয় তুমি ঐ মেয়েটাকে যেভাবে ছুঁয়েছো আমাকে ও তেমনি ভাবে ছুঁয়েছো তখন মরে যেতে ইচ্ছা করে। তোমাকে অন্য কারো সাথে কল্পনাও যেখানে আমি ভাবতে পারিনি সেখানে বাস্তবে এমন কিছু আমি কিভাবে মেনে নেব বলতে পারো?
প্লিজ হিয়া আমাকে এক্সপ্লেইন করতে দাও। সবটা শুনে তুমি যে সিদ্ধান্ত নেবে আমি তাই মেনে নেব। আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না।
ভালো তো ওকেও বাসতে তাইনা। তাহলে আজ তোমার মন কিভাবে বদলে গেল। কিছু দিন পর তো আবার ও তোমার মন বদলে যাবে তাইনা?
আমি শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছি। বিশ্বাস করো তুমিই আমার প্রথম এবং একমাত্র ভালোবাসা। সারা রাফিন ভাইয়ের বোন। সেই সূত্রেই ওর সাথে আমার পরিচয়। ও আর আমি শুধুই বন্ধু আর সবকিছু একটা এক্সিডেন্ট ছিল। তুমি বললে আমি তোমার সাথে থাকবো। কখনো অন্য কোথাও যাবো না। তুমি যে সিদ্ধান্ত নেবে আমি সেটাই মেনে নেব।
তোমার কিছুই বলার দরকার নেই। আমি ফিরে যাবো। এতক্ষণ ধরে অনেক ভেবেছি জানো। কোনোভাবেই তোমার সাথে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। বাচ্চাটার অধিকার সবার আগে। কেন সে বাবা থাকতে এতিমের মতো বড় হবে বলতে পারো। তোমাদের ভুলের শাস্তি তো আর বাচ্চাটাকে দেওয়া যায় না। তাই তুমি ঐ মেয়েটার কাছে ফিরে যাও।
আর তুমি?
ভেবে নেব সব আমার ভাগ্য। শেষ একটা উপকার করো আমাকে শুধু দেশে ফেরার ব্যাবস্থাটা করে দাও।
আমাকে ক্ষমা করে দাও হিয়া।
তোমার প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই। করেই বা কি হবে বলো?
কথাটা বলেই রাজিবেকে একনজর দেখে নিল হিয়া। এই সেই মানুষটা যাকে বিয়ের প্রথম রাতে দেখেই নিজের ভেবেছিল হিয়া। যে হিয়ার জীবনের প্রথম ভালোবাসা। আর কোনদিনও কি কাউকে ভালোবাসতে পারবে ও? নাহ সেটা আর সম্ভব না। হুট করেই ওর নজরে এলো ফ্লোরে রক্ত। রক্তের উৎস খুঁজে পেতে ওর বেশি সময় লাগলো না। হিয়া দ্রুত উঠে ফাস্ট এইড বক্স খুঁজতে শুরু করলো। কিছু সময় পর খুঁজেও পাওয়া গেল। রাজিবের পায়ে ব্যান্ডেজ করতে করতে হিয়া বলল,
ভেবনা তোমাকে যেতে দিয়ে কোনো মহান কাজ করছি। বাচ্চাটা ইনভলভ্ না হলে আমি কখোনোই তোমাকে এভাবে যেতে দিতাম না। জানো তো প্রথমে আমি কিছুতেই এসব সহ্য করতে পারছিলাম না। পরে ভাবলাম যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। শুধু শুধু লোকজন জানিয়ে লাভ কি। আমি শিক্ষিত একটি মেয়ে, বাবার বাড়ির অবস্থা ও ভালো। তোমাকে ছাড়া থাকতে আমার তেমন অসুবিধা হওয়ার কথা না। কিন্তু ঐ বাচ্চাটা, ওর বাবা মা দুজনকেই প্রয়োজন। তুমি কি বুঝতে পারছ আমার কথা?
রাজিব কিছু বলতে পারলো না। ও বুঝতে পারল আজকে শুধু ও ওর ভালোবাসা কেই হারাচ্ছে না একজন অসাধারণ নারীকেও হারিয়ে ফেলছে। ভালোবাসার সামনে ও নিজেই তো ওর সন্তানকে উপেক্ষা করে এসেছিল। কিন্তু হিয়া….. ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রাজিব। তখন ই ওর ফোনটা বেজে উঠলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা হাতে নিল ও। চার্লা ফোন করেছে। ধরবে কি ধরবে না ভাবতে ভাবতেই হিয়া ওর হাত থেকে ফোন টা নিয়ে রিসিভ করে ওর কানে ঠেকিয়ে বলল,
কথা বলো।
ওপাশ থেকে চার্লা কি বললো সেটা বোঝা গেলো না। তবে ভয়াবহ কিছু তা রাজিবের মুখ দেখেই হিয়া বুঝতে পারলো। ফোন টা রাখতেই রাজিব বলল,
সারা পরে গেছে। ব্লিডিং হচ্ছে প্রচুর। আমাকে যেতে হবে।
চলো আমিও যাবো।
কথা বাড়ালো না রাজিব হিয়া কে নিয়ে তখন ই রওনা হলো।

গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে ডাক্তার সুজান। ওনার সামনে রাজিব এবং হিয়া দাঁড়ানো। পাশের বেডে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে সারা। ডাক্তার সুজান ই প্রথম কথা বললেন,
আমি বলেছিলাম শেষ মাসে একটু সাবধানতা অবলম্বন করতে। যাই হোক আমাদের এই মুহূর্তে অপারেশন শুরু করতে হবে। তবে প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে বাচ্চা কে বাঁচানো যাবে কিনা সেটা বলা এখনই সম্ভব না। মা কে বাঁচানো টাও কঠিন। আপনাকে কিছু সাইন করতে হবে।
রাজিব কথা না বাড়িয়ে দ্রুত সমস্ত ফর্মালিটিজ শেষ করল। সারাকে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার সময় হিয়া সারার কপালে হাত বুলিয়ে বলল,
টেনশন করো না সুস্থ হয়ে ফিরে এসো। বাচ্চাটার জন্য ও দুঃখ পেয়ো না। আল্লাহর রহমতে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
সারাকে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে চলে যাওয়ার পর ও হিয়া সেখানেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। এই মাত্র ও কাজটির কেন করল সেটা ও জানেনা। শুধু জানে হুট করে এই মায়ের প্রতি ওর ভীষণ মায়া হচ্ছে। হে করুনাময়, তার থেকে তার সন্তান কে কেড়ে নিয়ো না। বেশ অনেকটা সময় রাজিব আর হিয়ার মধ্যে কোনো কথাই হলো না। নিরবতা ভেঙ্গে হিয়াই বললো,
আজ যদি বাচ্চাটাকে বাঁচানো না যায় তবুও তুমি ওকে বিয়ে করো। স্বাভাবিক হতে ওর কাউকে প্রয়োজন পরবে। ওর আর তোমার মধ্যে কি হয়েছে আমি জানি না। ভালোবাসা ছিল কিনা তাও জানিনা। তবে তোমার চোখে আমি সবসময় আমার জন্য প্রচুর ভালোবাসা দেখেছি। যেকোনো মূল্যে তুমি এখন আমার সাথেই থাকতে চাও। আমি চাইনা ভালোবাসার কাছে মনুষ্যত্ব হেরে যাক। বিশ্বাস হচ্ছে না আমি এমন কথা বলছি। কিন্তু জানো কেন জানিনা এ মেয়েটার জন্য প্রচুর মায়া হচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে আমাকে সামলানোর জন্য আমার পুরো পরিবার আছে কিন্তু ওর তো কেউ নেই।
হিয়া…..
আমার কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে?
উঁহু, তবে অবাক হচ্ছি।
আবার ও চুপ করে গেল দুজনে। বাকি সময়টুকু দুজনের মধ্যে বিশেষ কথা হলো না। অপারেশন শেষ হতে সাধারণ সময় থেকে কিছুটা বেশি সময় লাগলো। ডাক্তার সুজান বেরিয়ে এলো। তাকে কিছুটা বিষন্ন দেখাচ্ছে। তার পিছু পিছু একটি নার্স টাওয়ালে পেঁচানো সদ্য জন্ম নেয়া এক নবজাতক কোলে বেরিয়ে এল। ডাক্তার সুজান রাজিব কে ডেকে বলল,
মেয়ে হয়েছে। পেশেন্ট কে এখনই আর বেডে দেওয়া হচ্ছে। দেখা করে নিন। তার হাতে বেশি সময় নেই। বাচ্চাটা কে বাঁচানোর জন্য সে এমনভাবে অনুরোধ করলো সেটা আর আমরা ফেলতে পারলাম না। তাকে বলেছিলাম এতে তোমার জীবনের রিস্ক আছে। আমি আমার পুরো চেষ্টা করেছি তবে ব্যর্থ হয়েছি।
ততক্ষণে সারা কে কেবিনে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওর জ্ঞান তখনও ফেরেনি। বাচ্চাটা কে বেবিদের রুমে রাখা হয়েছে। এভাবেই অনেকটা সময় চলে গেল। নার্স এসে খবর দিল সারার জ্ঞান ফিরেছে এবং সে শুধু মাত্র হিয়ার সাথে দেখা করতে চায়।

চলবে………’

#আলো_আধাঁর
লিখা- জেসিয়া জান্নাত রিম

২১.
হিয়া সারার বেডের সাইডে বসল। সারা চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। ওর খুব খারাপ আর দুর্বল লাগছে। হিয়ার উপস্থিতি টের পেয়ে ও চোখ খুললো না ও। দুর্বল গলায় ধীরে ধীরে বলল,
আপনি আমার থেকে অনেক সুন্দরী হিয়া। তাই আপনার দিকে তাকাতে ইচ্ছা করছে না। শেষ সময়ে নিজের কোনো ক্ষুত ধরতে চাই না।
আপনার বাবুকে দেখবেন না?
নাহ। মারা যাচ্ছি তো কোনো প্রকার আফসোস আর নিজের মধ্যে রাখতে চাই না। বাবু বা রাজিব কে দেখে যদি বাঁচার ইচ্ছা জাগে। তাই ওদের কাউকেই দেখতে চাই না।
আমাকে কেন ডাকলেন?
কিছু কথা বলার জন্য। জানেন তো আপনার প্রতি আমার কোনো নেগেটিভ ফিলিংস্ জন্মাচ্ছে না। ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত শোনাতে পারে কিন্তু অপারেশনের আগে যখন আপনি আমাকে ঐ কথা গুলো বললেন আমার চিন্তা ভাবনা পুরোটাই পাল্টে গেল। আগের আমি হলে নিজেকে বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করতাম। বাচ্চাটার কথা ভাবতাম ও না। কিন্তু সেই আমি নিজের সন্তান কে বাঁচাতে নির্দ্বিধায় নিজের জীবন দিয়ে দিচ্ছি। আজ বলতে বাঁধা নেই বাচ্চাটা কে আমি এতদিন নিজের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করেছি। কখনো নিজেকে মা হিসেবে নয়। রাজিবের বউ হিসেবে প্রেজেন্ট করতে চেয়েছি। রাজিব আমাকে কখনোই ভালোবাসেননি তা সত্য কিন্তু ওর ভালো বন্ধু হওয়ার সুবাদে ওর সবটা জানা ছিল আমার। রাজিবের মতোন মানুষ হয়না। তাই কখন যে ওকে ভালোবেসে ফেলেছি বলতে পারবো না। ও কখনো আমাকে ভালোবাসবে না আমি জানতাম। ওর বাবার ভয় হোক বা অন্য কিছু ও সবসময় বলতো যাকে বিয়ে করবে তাকেই ভালোবাসবে। আমিও কখনো নিজেকে ছোট করে ভালোবাসা ভিক্ষা করার পক্ষে ছিলাম না। কিন্তু ওকেও ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলনা। তাই সবসময় ভাবতাম কি করে রাজিব কে নিজের করা যায়। একদিন সুযোগ পেয়েও গেলাম। রাজিব কে দেখতাম ও কখনো ড্রিংক করত না। তাই আমিও কখনো ইচ্ছা থাকা সত্বেও ওসব খেতাম না। বন্ধুরা এটা নিয়ে খুব মজা করতো। একদিন এক বন্ধুর পার্টিতে ওরা মজা করার জন্য না জানিয়ে আমাদের ড্রিংকে এ্যালকোহল মিশিয়ে দেয়। প্রথমবার বলে আমরা ব্যাপারটা সামলাতে পারলাম না। রাজিবের তো আরও অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। সে রাতেই একটা দুর্ঘটনা ঘটনা ঘটলো। যদিও এটা শুধু রাজিব ই মনে করে। আমি চাইলে পারতাম কন্ট্রাসেপটিভ কিছু নিয়ে ব্যাপারটা ওখানেই শেষ করে দিতে। কিন্তু আমি সুযোগ টা কাজে লাগলাম। আমি জানতাম ও কখনো ওর দায়িত্ব অস্বীকার করবে না। আর ও বাচ্চা নষ্ট করে দেওয়ার মতো মানসিকতা ও রাখে না। যেটা চাইলাম সেটাই হলো। দুজনে মিলে ঠিক করলাম বেবির জন্মের পর বিয়ে করে এখানেই সেটেল্ড হয়ে তারপর ওর বাড়িতে জানানো হবে। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু মাঝখান থেকে………
আমি চলে এলাম।
নাহ। নিজেকে ব্লেম করবেন না। দোষ যদি কারো থেকে থাকে তা আমার এবং রাজিবের বাবার। আমি চেয়েছিলাম যেকোনো মূল্যে রাজিব কে পেতে সেটা ওর ইচ্ছা থাকুক বা না থাকুক। আর ওর বাবা ওর কোনো মতামত না নিয়ে, ছেলে কোন পরিস্থিতিতে আছে না জেনে ওর বিয়ে ঠিক করে দিল। তবে ওর বাবার দোষটা এখানে কম। কারণ রাজিব আপনাকে ভালোবাসে ও আপনার সাথে সুখী। আপনাকে আজ একটা অনুরোধ করবো। আজকে আমি মায়ের মহত্ত্ব বুঝতে পেরেছি। আমার মা ছিল না কিন্তু বাবা ভাইয়ের ভালোবাসায় মায়ের অভাব টা কখনো সেভাবে অনুভব করিনি। আমার বাচ্চটা তো আর আমাকে পাবে না। আপনাকে অনুরোধ করছি ওকে নিজের সন্তান না ভাবতে পারেন,মায়ের ভালোবাসা না দিতে পারেন তবুও ওকে নিজের কাছে রাখবেন। ও যেন আপনাকে ওর মা হিসেবে জানে। মা হারা বাচ্চা ভেবে না হয় করুনা করলেন। আমি চাই বাবার ছায়ায় ও বেড়ে উঠুক। ও যেন কখনো না জানে ওর মা ওকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে। আপনি প্লিজ এসবের জন্য রাজিব কে ব্লেম করবেন না। ওর বা আমার কারণে আপনি যদি রাজিব কে ছেড়ে চলে যান আমি মরেও শান্তি পাবো না। আর আজকের কথা গুলো আপনি প্লিজ রাজিব কে বলবেন না। আমি ওর স্মৃতিতে একজন ভালো বন্ধু হিসেবে থাকতে চাই। সবশেষে আপনার কাছে আমি ক্ষমা চাইছি।
না বোন আমাকে ক্ষমা করে দিন। আপনাদের মাঝে তো আমি এসেছি।
আপনার প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই। আমার খুব খারাপ লাগছে। এতগুলো কথা বলে….একটু কষ্ট… হচ্ছে.. আপনি আমার….
কথাটা শেষ করতে পারলো না সারা। খুব ক্লান্ত লাগছে ওর। এতক্ষণ কথা বলতে ওর ভিষণ কষ্ট হলেও ওর মনে হয়েছে হিয়া কে কথা গুলো বলতেই হবে। তাই করুণাময়ের কাছে বারবার কথা গুলো বলার সময় এবং শক্তি চেয়েছে। এখন আর কোনোটিই অবশিষ্ট নেই ও সেটা ভালোই বুঝতে পারছে। আজ আর কোনো আফসোস রইলো না ওর।

তিনমাস হয়ে গেছে দিয়া আর রিয়াদের বিয়ের। আসলে ভালো সময়টা খুব দ্রুত কাটে। যেমনটা হয়েছে রিয়াদ আর দিয়ার ক্ষেত্রে। সিলেটে আসার পর সুন্দর একটা সংসার গুছিয়ে নিয়েছে ওরা। যদিও সংসার জিনিসটায় ওরা কেউ ই পারদর্শী নয়। তবুও ওরা ভীষণ সুখী। দিয়া আজকাল মন থেকে ভালো থাকতে চায়। রিয়াদকে ভালো রাখার চেষ্টা করে। সাংসারিক কোনো কাজ যদিও দিয়া জানেনা। তাতে রিয়াদের কোনো সমস্যাই হয়না। ও নিজে যতটা পারে করে নেয়। তাছাড়া একটা কাজের লোক ও রেখেছে। দুপুরে এসে কাজ করে দিয়ে যায়। আর দিয়া তো অনেক কিছুই জানেনা। তাই রিয়াদ কে না জানিয়ে ও কিছুই করে না। শুধু দুজনেই বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন। দিয়ার এতে কিছুই যায় আসে না। তবে রিয়াদের মাঝে মাঝে মা বোনদের কথা মনে পড়ে। রিয়াদের মা প্রায়ই ফোন দেন। তবে সেটা আজিজ সাহেব বলেন বলেই। ছেলের জন্য মায়ের মন কাঁদলে ও স্বামীর ওপর কথা বলার সাধ্য তার নেই। তাই ফোন দিয়ে সবসময় তারা কোথায় আছে এবং বউয়ের ছবি পাঠা এ ধরনের কথাই বেশি বলে। তবে ইদানিং আর তেমন ফোন করেন না তিনি। রিয়াদ ও এই নতুন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ওর মনে হয় দিয়া ছাড়া এক মূহূর্তের জন্য ও বাঁচা সম্ভব না। একজন সাইকায়ট্রিস্ট এর এমন চিন্তা ভাবনা শুনে ফাহিম খুব হেসেছিল। ভালোবাসা টা বোধহয় এমনই হয়। রিয়াদ হসপিটালে যাবে বলে রেডি হচ্ছে। দিয়া বিছানায় বসে রিয়াদ কে দেখছে। হুট করে করে রিয়াদ কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো দিয়া। তারপর আদুরে গলায় বলল,
আজকে না গেলে হয় না?
রিয়াদ ওকে সামনে এনে আবারো জড়িয়ে ধরে বলল,
আমার ও তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু আজকে না গেলেও হবেনা।
ও। ঠিক আছে যাও।
মন খারাপ করে না। রোজ ই তো যাই। চলে আসবো।
আজকে মনটা খুব খারাপ লাগছে আমার।
কেন? কিছু হয়েছে?
জানিনা কেন যেন খুব মন খারাপ লাগছে।
মন খারাপ করো না দিয়া। আমি আছি তো। জলদি চলে আসবো।
জানো, মা যেদিন মারা যায় সেদিন ও আমার মনটা এমন খারাপ হয়ে ছিল। মা কেন কাজটা করেছিল জানো?
কেন?
আমি যে কারণে কাজটা করে ছিলাম।
মানে?
সেদিন শিলা আন্টির সাথে মা কথা বলছিল আমি বারান্দায় দাড়িয়ে সব শুনেছি। শিলা আন্টির সাথে বাবার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাবা মাকে বিয়ে করে নেয়। তারপর শিলা আন্টি আবারো আমাদের বাড়িতে আসে। বাবা আর শিলা আন্টির মধ্যে নাকি কোনো সম্পর্ক ছিল। এটা নিয়েই তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছিলো। শিলা আন্টি বললো যে সে এ বাড়ি থেকে চলে যাবে। বলেই বেড়িয়ে গেল। তার কিছুক্ষণ পর মা ফ্যানের সঙ্গে শাড়ি ঝুলিয়ে নিজেও……
আর বলতে পারলো না দিয়া। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রিয়াদ কে। বেশ কিছুক্ষণ পর রিয়াদ বললো,
এ কথা তুমি কাউকে বলোনি কেন দিয়া?
বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু সবাই তো শিলা আন্টির দলে। এমনকি বাবাও। আর বড়াপু শিলা আন্টি কে খুব পছন্দ করে তাই ওকেও বলিনি। আজ তোমাকে বললাম।
কেন বললে জানো?
হুম।
বলোতো কেন?
তুমি তো আমার হাসব্যান্ড। বড়াপু বলেছে তোমাকে সব বলতে হয়।
তাহলে বলো তো ইমরান কে আর ভালোবাসো?
উঁহু।
তাহলে কাকে ভালোবাসো?
তোমাকে।
আমিও তোমাকে ভালোবাসি। এখন মনটা ভালো হয়েছে?
হুম।
ঠিক আছে। এখন তাহলে আমাকে একটু যেতে দাও। কাজ শেষ করেই আবার তোমার কাছে চলে আসবো।
এবার দিয়া আর আটকালো না ওকে। রিয়াদ দিয়ার কপালে চুমু দিয়ে বেরিয়ে গেল। দিয়া দরজা বন্ধ করে রুমে আসতেই ফোনটা বেজে উঠলো ওর। হিয়া ফোন করেছে। ফোন টা রিসিভ করতেই হিয়া বলল,
নেট অন কর ভিডিও কল দেই। রায়া কে দেখবি না। এইটুকু বাচ্চা কিন্তু প্রতিদিন তার নতুন নতুন কান্ড।
আচ্ছা। আমি কল দিচ্ছি।
বলেই ফোনটা কেটে নেট ওয়ান করে ভিডিও কল দিলো দিয়া। কানে হেডফোন লাগিয়ে রায়া কে নিয়ে কথা বলছিল ওরা। এমন সময় বাসার কলিং বেল বেজে উঠলো। কাজের লোক ভেবে ফোন হাতেই দরজা খুললো ও। তবে বাইরে বুয়ার পরিবর্তে অপ্রত্যাশিত একজন কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলো দিয়া। এ সময় এই লোকটিকে এখানে একদমই আশা করেনি ও।

চলবে………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here