আলো আঁধার, পর্ব:২২

#আলো_আধাঁর
লিখা: জেসিয়া জান্নাত রিম

২২.
আজিজ সাহেব হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। দিয়াকে দরজা খুলে দাড়িয়ে থাকতে দেখে উনি বললেন,
আমাকে ভেতরে আসতে বলবে না মা।
দিয়া অবাক হলো। এতো ভালো ব্যবহার মানুষটার, দেখলেই শ্রদ্ধা জাগে। কিন্তু এনাকে নিয়ে ওদের এত ভয় কেন? দিয়া দরজা ছেড়ে দিয়ে দাঁড়ালে আজিজ সাহেব ভেতরে ঢুকে ড্রয়িং রুমে বসলেন। দিয়ার কানে তখনো হেডফোন গোঁজা। হিয়া ভিডিও কলে আজিজ সাহেব কে দেখতে পেয়েছে। ও দিয়াকে ফোন কাটতে নিষেধ করলো। উনি দিয়াকে কি বলতে এসেছেন কে জানে? দিয়া ফোন কাটলো না। কান থেকে হেডফোন খুলে দরজা লাগিয়ে আজিজ সাহেবের সামনে এসে বসলো। ঘরে আসা মেহমানদের সাথে কিভাবে কথা বলে জানেনা দিয়া। ওনি কি খাবেন জানতে চাইবে? ভাবতে ভাবতে ই আজিজ সাহেব বললেন,
যাও তো মা আমাকে এক কাপ কফি করে খাওয়াও। জার্নি করে এসেছি তো। যদিও বিমানে কিন্তু জার্নি তো। কফি না খেলে ফ্রেশ লাগবে না। ব্লাক কফি খাবো চিনি ছাড়া।
দিয়া উঠে দাঁড়ালো। কিচেনে গিয়ে চিন্তায় পরে গেল। ও তো কিছুই পারেনা। আগুন কিভাবে জালাতে হয় তা ও জানেনা এখন কি করবে? হঠাৎ হিয়ার কথা মনে পড়ায় হাতে থাকা ফোনটা তুলে ও বলল,
বড়াপু এখন কি করবো?
কফি কোথায় জানিস?
বোধহয় কেবিনেটের ভেতরে।
রিয়াদ কে কখনো কফি বানাতে দেখেছিস?
হুম।
কিসে বানায়?
দিয়া আশে পাশে তাকিয়ে কফি মেকারটা কোথায় সেটা দেখে নিল। সেটা হিয়া কে দেখাতেই হিয়া ওকে কিভাবে কি করতে হবে তা বুঝিয়ে দিল। কফি বানানো শেষ করে তা নিয়ে আবার ও ড্রয়িং রুমে ফিরে এলো ও। আজিজ সাহেব কফি হাতে নিলেন কিন্তু খেলেন না। এরপর দিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,
তুমি কি আমাকে চিনতে পেরেছো?
হুম।
বলোতো কে আমি?
রিয়াদের বাবা।
আমার কিন্তু আরো একটা পরিচয় আছে সেটা কি জানো?
না।
আমি তোমার বড় আপুর শ্বশুর ও। তোমার বড় আপু মানে হিয়া কে আমি রাজিবের জন্য পছন্দ করেছিলাম বলেই আজ ওদের বিয়ে হয়েছে এবং ওরা একসাথে সুখে আছে। কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম। তোমাকে আমি কিছুতেই ছেলের বউ হিসেবে মানতে পারিনা। কেন বলোতো?
দিয়া কোনো কথা বললো না। আজিজ সাহেব ও উত্তরের কোনো আশা করেনি তাই তিনি বললেন,
হিয়া কে পছন্দ করার কারণ ছিল সে ভালো মেয়ে। পরিবারের বড় মেয়ে, পড়ালেখায় ভালো, শিক্ষিত, সবথেকে বড় কথা তার স্বভাব চরিত্র ভালো। তার জীবনে ছেলে ঘটিত কোনো ব্যাপার নেই। তোমার মধ্যে এমন কোনো গুণ নেই‌। কি আছে?
এবার দিয়া মাথা দুলিয়ে না বলল।
তোমার মধ্যে যেটা আছে তার সবটাই নেগেটিভিটি। তোমরা একই পরিবারে বেড়ে উঠেছো। কিন্তু দুজনের মধ্যে পার্থক্য অনেক। এটা স্বাভাবিক। পরিবারের সব ছেলেমেয়ে একই রকম হয়না। কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। তোমার মধ্যে যদি পজেটিভ চেইন্জ হতো তাহলে আমি একটা সুযোগ তোমাকে দিতাম। তোমার মা মারা গেছেন তোমার সামনে তাই তোমার মানসিক অবস্থা ভালো না। এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু এরপরে যা ঘটেছে তারপর কোনো ভালো পরিবার তোমাকে তাদের ছেলের জন্য পছন্দ করবে না।
কিন্তু রিয়াদ আমাকে পছন্দ করে।
ইমরান ও তোমাকে পছন্দ করতো। কারণ কি জানো
তোমার মত মেয়েদের ইয়াং ছেলেরা বেশ পছন্দ করে। সোসাইটিতে তোমার মতো মেয়েদের একটা নাম আছে। নামটা অত্যান্ত বাজে বলে আমি সেটাকে ব্যবহার করছি না। আমি তোমাকে দোষ দেব না। কারণ তুমি একটা ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে। যদিও আত্মহত্যা আমি সমর্থন করি না। কিন্তু তোমার মতো মেয়েদের জন্য এটা ঠিক আছে। তোমাদের মরে যাওয়াই উচিত। তোমার ফ্যামিলির মধ্যে সবাই ভালো একমাত্র তুমিই ঐ পরিবারের কলঙ্ক। আমার তো মনে হয় তোমার মা তোমার মতই ছিল। নিজের সম্মান বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছিল। শোনো আমি বেশি কথা বাড়াতে চাই না। তুমি আমার ছেলের জীবন থেকে চলে যাও।
আমি ওকে বিয়ে করেছি। আমি ওকে ভালবাসি। আমি ওকে ছাড়তে পারবো না।
রিয়াদ আর তোমার কোনো ম্যাচ নেই। তুমি জাস্ট ওর ওপর বোঝা। তোমার কারণে ও ওর পরিবার ছাড়া থাকছে। তোমার সাথে থাকলে ওকে আমি আমার সমস্ত সম্পদ থেকে বঞ্চিত করবো। তুমি সবার জন্যই সমস্যা সেটা কি তুমি কখনো বুঝতে পেরেছো?
আমি সবার জন্য সমস্যা?
সমস্যা না। তোমার পরিবারের লোকেরা তোমাকে কিভাবে দূরে রাখবে সেই চিন্তা করে। কোনো ফ্যামিলি ফাংশানে তোমাকে নিয়ে যায়না। কারণ তুমি তাদের জন্য সমস্যা। তুমি নিজেই চিন্তা করো তোমাকে কি মানুষের সামনে আনা যায়। এখন রিয়াদের লাইফে এসেছো ওর লাইফে সমস্যা শুরু হয়েছে। প্রথমে বাড়ি ছাড়তে হলো তারপর ঢাকা ছেড়ে আসলো। এখন সমস্ত সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত হবে। আর হিয়া ও তোমার কারণে সমস্যায় পড়বে। এতদিন সুখে সংসার করছে আমার কারণে। এখন তোমার কারণে ওর সংসার ভাঙতে আমার দু সেকেন্ড ও লাগবে না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলো দিয়া। যে মানুষ টা কে দেখে প্রথমে মনের মধ্যে শ্রদ্ধা জেগেছিল এখন তাকে ভিষণ ভয় করছে। মানুষটা ভয়ংকর খারাপ। ওর কারণে এতগুলো মানুষের ক্ষতি হবে। বিশেষ করে বড়াপুর এটা দিয়া কিছুতেই মানতে পারবে না। কিন্তু ও কি করবে? কিভাবে লোকটাকে আটকাবে? বেশ কিছুক্ষণ পর দিয়া বলল,
এখন আমি কি করলে আপনি এসবের কিছুই করবেন না?
সেটা তোমাকেই বের করতে হবে। শুধু বলবো এমন কিছু যাতে করো যাতে রিয়াদ তোমাকে কোনদিন খুঁজে না পায়। কোনোভাবেই যেন তোমার আর রিয়াদের দেখা না হয়। আমি এখন উঠি একটা জরুরী মিটিং আছে। তুমি ভাবো কি করবে।
একটা কার্ড টেবিলের উপর রেখে যাওয়ার সময় আজিজ সাহেব বললেন,
আমার নাম্বার রইলো। কি ঠিক করলে আমাকে জানিও।
কি করবে দিয়া এখন? যাতে করে রিয়াদ ওকে খুঁজে না পায়। মনে পড়লো ওর মা মারা যাওয়ার আগে ফাঁকা রুমে বার বার একটা কথাই বলেছিল,”তোমরা আর কোনদিন আমাকে খুঁজে পাবে না তোমাদের কষ্টের কারণ ও আর হবো না আমি। আজ আমি তোমাদের মুক্তি দিলাম। নিজেও সবকিছু থেকে মুক্তি নিলাম।”
তাহলে ওর ও কি সেটাই করা উচিত? হিয়া তখন ও ভিডিও কলে আছে। ও দিয়াকে ডেকে যাচ্ছে। কিন্তু হেডফোনের প্লাগ লাগানো থাকায় দিয়া কিছুই শুনতে পেল না। হিয়া কল কেটে আবারো কল দিলো। কিন্তু দিয়া রিসিভ করলো না। হুট করেই রায়া চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করলো। চারতলার কোলে ওকে দিয়ে হিয়া এবার রিয়াদের নাম্বারে কল দিলো। কিন্তু চার পাচঁবার
কল করার পর ও ফোন রিসিভ করলো না রিয়াদ। রায়ার কান্না এখনো থামেনি। হিয়া দ্রুত রাজিব কে ফোন দিলো। আজকে রাজিবের অফিস থেকে ফিরতে এত সময় কেন লাগছে।

মিটিং শেষ করে সরাসরি বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে গাড়িতে বসল রিয়াদ। দিয়াকে একটা ফোন দেয়া উচিত। অনেকক্ষণ কথা বলে না। নিশ্চয়ই অনেক বার ফোন দিয়েছে দিয়া। মিটিং এর কারণে ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিল ও। ফোনটা হাতে নিতেই রিয়াদ দেখল অনেক গুলো মিসকল। ভাইয়া ভাবী আর ফাহিমের পরপর কতগুলো কল। ওরা এত কল করছে কেন? ভাবতে ভাবতেই আবারও ফাহিমের কল এল। রিয়াদ তাড়াতাড়ি রিসিভ করে বলল,
কি হয়েছে এত গুলো কল।
তুই জলদি বাসায় যা আমি আসছি।
কেন?
এত এক্সপ্লেইন করার সময় নেই। তোর বাবা আজ ওখানে গিয়ে ছিলো। দিয়াকে কিছু কথা শুনিয়েছে। তোর ভাবী আমাকে ফোন করে জানালো। তোকে আমরা অনেকক্ষণ ধরে ট্রাই করছি না পেয়ে আমি শেষ মেশ আমাকে আসতে হচ্ছে। আমি প্রায় পৌঁছে গেছি।
কি বলিস। আচ্ছা আমি রাখছি।
মাথা ঠান্ডা রেখে সাবধানে গাড়ি চালাস।
ঠিক আছে।
কতক্ষণ সময় পার হলো রিয়াদের জানা নেই। বাসার বাইরে কোনোমতে গাড়ি পার্ক করে দৌড়ে উপরে উঠে এল ও। এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে দিয়াকে ডাকলো ও। কিন্তু দিয়ার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। বেডরুমের দরজা বন্ধ। রিয়াদ কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করেও দিয়ার কোনো সাড়াশব্দ পেলনা। পকেট থেকে চাবির গোছা বের করে বেডরুমের চাবি খুঁজতে শুরু করলো ও। দরজা খুলতেই থমকে গেল রিয়াদ। ধপ করে সেখানেই বসে পড়লো। সময়টা যেন থমকে গেছে। সামনের সব অন্ধকার। এর বেশ কিছুক্ষণ পর ফাহিম এলো। মেইনডোর খোলাই ছিল। রিয়াদ কে চুপচাপ ওদের বেডরুমের সামন বসে থাকতে দেখে দ্রুত এগিয়ে গেল ও। রিয়াদের গায়ে ধাক্কা দিয়ে ওকে ডাকলো কিন্তু রিয়াদ জবাব দিলো না। ফাহিম পিছন ঘুরে রিয়াদের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতেই চিৎকার দিয়ে উঠলো। সামনে দিয়ার ঝুলন্ত লাশ।

পরিশীষ্ট: ছয়মাস পরের কথা। আজিজ সাহেব নিজের রুমে চুপচাপ বসে আছেন। তাকে বয়সের ভারে নুয়ে পড়া বৃদ্ধের মতো লাগছে। তিনি চেয়েছিলেন দিয়াকে কোনো এসাইলামে পাঠাবেন। ব্যাবস্থাও করে ফেলেছিলেন। যাওয়ার সময় দিয়া যাতে কোনো আপত্তি না করে তাই সেদিন ওকে কথাগুলো শুনিয়ে ছিলেন তিনি। কিন্তু দিয়া এমন একটা কাজ করতে পারে সেটা ভাবেন নি তিনি। সেই ঘটনার পর থেকে সবকিছু বদলে গেছে। তার দুটি ছেলেই তার থেকে দূরে। তাকে ছেড়ে চলে গেছে। পরিবারের বাকি লোকের মনেও তার জন্য এখন কোনো শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা তিনি খুঁজে পান না। দিয়ার পরিবার কেস করেছিলেন তার নামে। এখনো মামলা লড়ছেন তিনি। সব মিলিয়ে ভিষণ ভেঙে পড়েছেন তিনি।

রাজিব আর হিয়া রায়াকে নিয়ে সুখে আছে। কিন্তু দিয়ার শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি কেউই। রিয়াদ এখনো চুপচাপ। কারো সাথে একটা কথাও বলে না ও। ওই ঘটনার পর প্রথম বার আজিজ সাহেব কে দেখে ভিষণ চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেছিল ও। তারপর রাজিব আর হিয়া ওকে নিজেদের সাথে নিয়ে আসে। এখানেই চিকিৎসা চলছে ওর। হিয়া রিয়াদের মধ্যে দিয়ার ছায়া দেখে। কবে না রিয়াদ ও দিয়ার মতো কিছু ঘটিয়ে বসে এই চিন্তায় সবসময় ওকে চোখে চোখে রাখে। ওদের জীবনটা এখন অন্যরকম। একদিকে সুখের উজ্জ্বল আলো অন্যদিকে শোকের কালো আঁধার। এ আঁধার কাঁটার সম্ভবনা কি আদৌ আছে?

সমাপ্ত।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here