ইতি আলাপী পর্ব -০৩ ও শেষ

🚫কঠোর ভাবে এলার্ট। নিজ দায়িত্বে পড়বেন❌

#ইতি_আলাপী
#মম_সাহা

অন্তিম পর্ব

১২.

‘সাজেদা হসপিটালের’ সামনে দাঁড়িয়ে আছে সালাম সাহেব ও দীপন। দীপনের চোখে মুখে সংশয়। তার স্যার হঠাৎ করে তাকে হসপিটালের সামনে নিয়ে এলো কেন সে এটাই বুঝতে পারছে না। সালাম সাহেবের ঠোঁটের বরাবরের মতন হাসি লেপ্টানো। সে রহস্য করে বললেন,
“দীপন, চলো আজ একটা দারুণ খবর জেনে আসি।”

“কী খবর, স্যার?”

“গেলেই জানতে পারবে, চলো।”

দীপন সালাম সাহেবের পেছন পেছন ডাক্তার মিঠুন দাসের চেম্বারে প্রবেশ করল। মিঠুন দাস সালাম সাহেবকে দেখেই দাঁড়িয়ে গেলেন। মুচকি হেসে বললেন,
“সালাম সাহেব আপনিই তো? তাই না?”

সালাম সাহেব হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করতে করতে বললেন,
“হ্যাঁ, আমিই। গতকাল আপনাকে কল দিয়েছিলাম। আসলে একটা কেইসের ব্যাপারে ইনভেস্টিগেশন করতেই আসা।”

“হ্যাঁ, বলুন, আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে?”

দীপন বোকার ন্যায় একবার নিজের সিনিয়র অফিসার আরেকবার ডাক্তারকে পরখ করছে৷ তার ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না স্যার কেন এখানে এসেছে। কেইসের সাথে ডাক্তার সম্পর্ক আদৌও কোথায় সেটা সে বুঝে পাচ্ছে না।

সালাম সাহেব তার সামনের ইজি চেয়ারটায় আরাম করে বসলেন। মিঠুন নামক ভদ্রলোকটার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“শাহাদ নামের একটি টিনএজার ছেলে আপনার নিয়মিত পেশেন্ট তাই না?”

দীপন বি স্ফো রিত নয়নে চাইল। শাহাদ একজন সায়ক্রেটিস্টের নিয়মিত পেশেন্ট! কীভাবে সম্ভব! ছেলেটাকে দেখে তো তেমন মনে হলো না। মিঠুন দাসও কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকালেন, মাথা নাড়িয়ে বললেন,
“হ্যাঁ। শাহাদ রহমান। উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র। তাই তো?”

“হ্যাঁ। ওর ব্যাপারেই জানতে এলাম।”

“শাহাদ অতিরিক্ত ঠান্ডা প্রকৃতির ছেলে। ও তেমন ঝামেলা পছন্দ করে না। আর খুব কৌতূহল প্রবণ ছেলেও সে। ওর আই-কিউ দারুণ। কিন্তু এত ভালোর মাঝে একটা খারাপ ব্যাপার হলো- ছেলেটা রেগে গেলে ওর হুঁশ থাকেনা। খুব সহজে সে রাগেনা কিন্তু রেগে গেলে যা-তা করার ক্ষমতা রাখে। আর হঠাৎ আকস্মিক ঘটনা সে মানতে পারে না। এতে সে অসুস্থ হয়ে যায়। তার নার্ভ দুর্বল হয়ে যায় যার কারনে বমি শুরু হয়। আর তাই সে এই হঠাৎ রেগে যাওয়া ব্যাপারটাকে কন্ট্রোল করতে পারেনা বলেই আমার কাউন্সিলে আছে। বিভিন্ন ভাবে ওর রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে।”

সালাম সাহেব এবার দীপনের দিকে তাকাল। দীপনের চোখ-মুখ যেন বেরিয়ে আসার উপক্রম। সালাম সাহেব মিঠুন দাসকে বিদায় দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসতেই দীপনের প্রশ্নের ঝুরি খুলল,
“স্যার, তার মানে শাহাদ এগুলো করছে? কিন্তু কিসের জন্য করবে? আর আপনি জানলেন কীভাবে শাহাদ এ হসপিটালে আসে? আর স্যার, আমরা তো সিসিটিভি ফুটেজে মেয়ে দেখলাম তবে আপনি সকল ছেলেদের কেন সন্দেহের তালিকায় রাখছেন? আর স্যার, আমরা সালেহাকে খুঁজছি না কেন? সালেহা তো এটা করতে পারে তাই না? প্রমাণ তো সেদিকে ইঙ্গিত করছে।”

“দীপ, এতদিন হলো চাকরিতে এসেছ অথচ ট্রিকস বুঝোনা এখনও! শুনো, যদি সালেহা মারতেই চাইতো তবে সে শহর ছেড়ে যেত না। আর এত লুকোচুরিও সে করতো না। কারণ সে জানতোই সন্দেহের তীর তার দিকে ছুটবে। এত বোকা কাজ এত শার্প খু নে হতে পারেনা।”

“তাহলে স্যার, আলাপী তো মেয়ের নাম। কিন্তু কোনো মেয়ে তেমন এই কেইসে দেখা যাচ্ছে না। যদিও মৃণী ছিল কিন্তু সেও গত দু’দিন যাবত গায়েব। তাহলে?”

“অন্যরকম করে ভাবতে হবে। অন্যভাবে ভাবতে হবে। এটা দ্বারা নিশ্চয় কারো নাম বুঝায়নি। কেউ কী নিজের নাম সরাসরি দিবে? নাহ্। তারমানে অন্যকিছু বুঝাতে এইটা লিখা হয়েছে।”

“আপনার কী মনেহয়, স্যার? কোনো পরিচিত মানুষ একাজ করেছে?”

“কি জানি! পরিচিতদের মাঝে সন্দেহজনক…….”

কথাটা বলতে বলতে থেমে গেলেন সালাম সাহেব। কেমন হুট করে চুপ করে গেলেন। তা দেখে উৎকণ্ঠা নিয়ে দীপন প্রশ্ন করল,
“কী হয়েছে, স্যার?”

“দীপন, আমাদের মৃণীর বাড়িতে যাওয়া উচিত একবার। তারপর ওদের চার বন্ধুকেও ডাকো। কথা আছে।”

১৩.

মৃণীর ঘরটা বিশাল বড়ো এবং সুন্দর। মেয়েটা যে খুব শৌখিন তা তার পুরো ঘরটা দেখলেই বুঝা যাবে। চারদিকে নানান ক্যানভাস টাঙানো। মেয়েটার আঁকার হাতও যে দারুণ তা তার এইসব রঙিন ক্যানভাস দেখেই বুঝা যায়। সালাম সাহেব বিচক্ষণ ভঙ্গিতে চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলেন। প্রায় কয়েকটা ক্যানভাসে কিছু মানুষের দেহের অংশবিশেষ আঁকা। একটা ঘড়ি পরিহিত হাত, কোথায় দু’টো চোখ আঁকা, কোথাও বা পায়ের ছবি আঁকা। সালাম সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন। মেয়েটা এই ছবিগুলো সম্পূর্ণ করেনি। একটু একটু করে এঁকে রেখেছে কেন? যেন কেউ চিনতে না পরে? সালাম সাহেবের বড্ড চেনা চেনা লাগল এই ছবি গুলো। সে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
”এক্ষুণি শাহাদ, রিবু, রিদান, কবিরদের সাথে কথা বলতে হবে। তাড়াতাড়ি চলো।”

কোচিং সেরে তিন বন্ধু এগিয়ে আসছে টং দোকানের সামনে। চারদিকে গাঢ় সন্ধ্যার প্রলেপ। রিবু আজ আসেনি। ছেলেটার শরীর ভালো নেই নাকি। বন্ধুর চিন্তায় তারাও যেন সকলে অসুস্থ অনুভব করছে। টং দোকানের সামনেই বসে আছে সালাম সাহেব ও দীপন। কোনো ফর্মাল পোশাক পড়ে না। নরমাল পোশাক পড়া। শাহাদদের দেখেই দীপন ডাকল। তিন বন্ধু উপস্থিত হলো সেই স্থানে। তারা উপস্থিত হতেই সালাম সাহেব দোকানদারকে উদ্দেশ্য করে আরএ তিন কাপ চায়ের অর্ডার দিল। অতঃপর তিন জনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল,
“কেমন চলছে তোমাদের পড়াশোনা?”

”এসবের মাঝে পড়াশোনাটা কী আর ভালো চলবে, স্যার!” কথাটা বলেই রিদান হতাশার শ্বাস ফেলল।

“সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করোনা। বলো তো, রিবু কোথায়?”

শাহাদ উত্তর দিল, “ও অসুস্থ নাকি কিছুটা। তাই আসেনি।”

“ও কী একা থাকে?”

“শুনেছিলাম আন্টি, আঙ্কেল নাকি এসেছিলেন।”

“এতকিছু হলো, অথচ ওর মা-বাবাকে এতকিছু হয়ে গেল, তবুও দেখলাম না যে!”

সালাম সাহেবের প্রশ্নে সকলের টনক নড়লো। সত্যিই তো! এমনটা তো হয়নি কখনো। সালাম সাহেব উঠে চায়ের বিল দিলেন। সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“চলো, আজ ওর বাড়িতে যাওয়া যাক।”

১৪.

শহরের বেশ নোংরা একটি বস্তির পেছনের দিকে একটি পরিত্যক্ত বিল্ডিংয়ের সকমনে এসে দাঁড়াল সালাম সাহেবদের গাড়ি। সকলেই নেমে দাঁড়াল। সালাম সাহেব ফোনে কিছু একটা করে তারপর বিল্ডিং এর ভেতর প্রবেশ করলেন। কেমন অপরিষ্কার, ধূলোময়লা জমা। সালাম সাহেব নাকে রুমাল চেপে শাহাদের জিজ্ঞেস করল,
“ও এমন একটা জায়গায় থাকে তোমরা কিছু বলোনা?”

কবির উত্তর দিলো,“কী বলবো স্যার? যার যার ব্যাক্তিগত ব্যাপার। তাছাড়া ও গম্ভীর প্রকৃতির। এসব শুনলে রাগ করবে।”

“আগে কখনো আসোনি ওদের বাসায়?”

“একবার এসেছিলাম। এরপর আর আসা হয়নি।”

যথারীতি কথা বলতে বলতে তারা দোতালা একটি ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। লোহার জং পড়া দরজায় কড়া নাড়লো শব্দ করে। কয়েকবার কড়া নাড়তেই দরজা খুলল রিবু। ঘর্মাক্ত দেহ, এলোমেলো চুল ছেলেটার। চোখের সামনে সবাইকে দেখে কিছুটা অবাকই হলো যেন। অবাক কণ্ঠে বলল,
“আপনারা?”

রিদান, কবির ওকে ঠেলতে ঠেলতে ভেতরে প্রবেশ করে বলল,
“আন্টির হাতে খাবার খেতে এলাম সাথে তোর শরীর কেমন দেখতে এলাম। কী করছিলি দোস্ত? এত ঘেমে আছিস?”

রিবু দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। শার্টের হাতে ঘাম মুছতে মুছতে বলল,
“শুয়ে ছিলাম, দোস্ত।”

সালাম সাহেব ঘরে ঢুকতেই সালাম দিল রিবু। সারাম সাহেব গাঢ় দৃষ্টিতে আশপাশ তাকালেন। ঘরটা পরিপাটি বলা যায়। তেমন কিছুই নেই অবশ্য। একটা আলমারি আছে যার দরজাটা কাচের। তার পাশেই খাট এবং পড়ার টেবিল। ঘরটার বা দিকে আরেকটা ছোট রুম যেখানে একটা রঙ ওঠা বিশার ফ্রীজ আছে। এবং একটা আলনা আছে। রিবু সবাইকে বিনীত ভঙ্গিতে বসতে বলল। সকলে বসলো রিবুর খাটে। দীপন বসল একটি টুলে এবং সালাম সাহেবকে একটি চেয়ারে বসতে দিল। সালাম সাহেব খেয়াল করে দেখলেন কাঁচের আলমারির ভেতরে পাঁচটা পুতুল আছে। সালাম সাহেব অবাক হলেন। ছেলেদের রুমে পুতুল! তিনি বিস্ময় ভাব না চাপিয়ে রেখে রিবুকেই প্রশ্ন করলেন,
“তুমি পুতুল দিয়ে কী করো?”

আকস্মিক প্রশ্নে রিবু থতমত খেলো। আমতাআমতা করে বলল,
“স্যার, মা কিনে রাখেন। আমি আর কী করব!”

“কোথায় তোমার মা? সে নাকি তোমার বাসায়?”

রিবু তরতর করে ঘামছে। কণ্ঠেও তার কাঁপছে। কম্পনরত কণ্ঠেই সে বলল,
“উনারা আজ সকালে চলে গিয়েছে।”

“তুমি নাকি অসুস্থ! এ অবস্থায় রেখে চলে গেল?”

রিবুর চোখমুখে ভীত ভাব। সে ক্ষীণ স্বরে বলল,
“বাড়িতে কিছু সমস্যা হয়েছে তো, তাই চলে গিয়েছে।”

সালাম সাহেবে অভিজ্ঞ চোখে খটকা লাগল। তিনি এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বললেন,
“রিবু, চা বানাতে পারো? ”

” হ্যাঁ স্যার। পারি। ”

“ তাহলে আমাদের চা খাওয়াও। ”

রিবু ঘাড় কাঁত করে রান্নাঘরে চলে গেল। কবির ঘামে প্রায় চুপচুপে অবস্থা। ফ্যানটা খুব ধীর গতিতে চলছে। কবির ওঠে দাঁড়াল। শিস শিস বাজাতে বাজাতে ফ্রীজের দিকে গেল ঠান্ডা জলের আশায়। কিন্তু তার পর পরই ভেসে এলো ভয়ঙ্কর এক চিৎকার। রান্নাঘর থেকে থালাবাসন পড়ার বিশৃঙ্খল শব্দ শোনা গেল। রিবুর হাত থেকে পরে গেল বোধহয়। সালাম সাহেব পাশের রুমে না এগিয়ে ছুটে গেলেন রান্নাঘরে। রিবুর হাতে ধারালো ছুরিটা মাত্রই ওঠেছে কিন্তু তার আগেই সালাম সাহেবের শক্ত হাত বেঁধে ফেলল তাকে। রিবুর দৃষ্টি পাংশুটে। সালাম সাহেব টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল পাশের রুমে। সে রুমে অবস্থারত সকলে স্তব্ধ। খোলা ফ্রীজ। ফ্রীজের মাঝে একটি মৃত দেহের কয়েকটা খন্ড পড়ে আছে। কী বিভৎসতা সেখানে!

সকলের স্তব্ধ চোখ এবার রিবুর দিকে এলো। রিবু নিশ্চুপ। সালাম সাহেব গিয়ে দরজা খুলতেই অনেক গুলো পুলিশের পোশাক পরিহিত লোক ঘরে উপস্থিত হলো। সকলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সকলে সালাম সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। দীপনও বোধহয় কিছুই বুঝতে পারছে না।

সালাম সাহেব আয়েশ করে চেয়ারটাতে বসলেন। পা দুলাতে দুলাতে বললেন,
“মৃণী কী বেঁচে আছে এখনও?”

রিবু নিশ্চুপ। সালাম সাহেব দীপনের দিকে চাইল, রাশভারি কণ্ঠে বলল,
“দীপ, ওর সব বই গুলো এখানে নিয়ে আসো আর ছিঁড়ে ফেলো।”

সালাম সাহেবের এমন কথায় সকলে বিস্মিত। দীপন বিস্মিত ভঙ্গিতে বলল, “কী!”

“যা বলেছি, তা করো।”

দীপন আগাতে নিলেই থামিয়ে দিল রিবু, কেমন উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
“না না, বই ধরবেন না। আমি এমনেতেই সব বলব।”

সালাম সাহেব দীপনকে চোখের ইশারায় থামালেন এরপর রিবুর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“কোথায় মৃণী?”

“রান্নাঘরে, বিশাল তক্তাটার উপরে। জ্ঞান নেই।”

রিদান থমকে গেল, অস্ফুটে জিজ্ঞেস করল, “তুই এসব করেছিস?”

“হ্যাঁ।”

“কিন্তু কেন?”

কবির এবার প্রশ্ন ছুঁড়লো। সালাম সাহেব ওঠে দাঁড়ালেন। কয়েকজনে নির্দেশ দিলেন মৃণীকে নামানোর জন্য। শাহাদই প্রথম ছুটে গেল। রিবুকে নিশ্চুপ দেখে সালাম সাহেবই বলতে লাগলেন,
“আমি যদি ভুল নাহই, তাহলে তোমার বাবা-মা এই পৃথিবীতে বেঁচে নেই। তাই তো?”

রিবু কাঠ কাঠ কণ্ঠে জবাব দিল, ”হ্যাঁ।”

“কিন্তু স্যার, আপনি কীভাবে জানলেন রিবু এটা করেছে?”

দীপনের প্রশ্নে হাসলেন সালাম সাহেব। আয়েশ করে বলতে লাগলেন,
“সন্দেহ তো অনেকদিন যাবত হচ্ছে। প্রথম সন্দেহ হয়েছে সেদিন, যেদিন সবাইকে আমি বলছিলাম কে খু ন করেছে সেদিন রিবু কেমন করে যেন উত্তর দিল। যেখানে সবার চোখে ভয় সেখানে সে কেমন যেন অতিরিক্ত শীতল দেখাচ্ছিল। মৃণীর বাড়িতে সেদিন গিয়ে দেখলাম সে কারো চোখ আঁকছে। খুব পরিচিত লাগল চোখ দু’টো। তারপর তার রুম ঘেটে দেখলাম প্রায় অনেক চিত্রে পরিচিত মানুষের অবয়ব বুঝা যাচ্ছে। তারপর সিসিটিভি ক্যামেরায় খেয়াল করলাম বোরখা পড়া মেয়ে পার্সেল দিয়ে যাচ্ছে অথচ তার পায়ে জেন্টস্ জুতা। সেইম জুতাসহ পা আঁকা মৃণীর রুমে। শাহাদকে দেখালাম আর জানতে পারলাম এটা রিবুর জুতা এবং এটাও জানলাম শাহাদের সাথে মৃণী বেশিরভাগ সময় রিবুর কথা বলতো। এরপর মিত্রের লাস্ট ফোন কলে রিবুর নাম্বার পাই আমরা। আর লোকেশন ছিল ঢাকা। সব মিলিয়ে আন্দাজ করেই এসেছিলাম রিবুর কাছে, যেন ওর মুখ থেকে বের করতে পারি। কিন্তু এর আগেই এত ভয়ানক জিনিস নিজে নিজেই বের হয়ে গেল। তা রিবু এবার সবটা তুমি নিজেই বলো। নিজের বন্ধুর সাথে কেন করেছ এসব? নিজের বাবা-মায়ের সাথে এসব করেছ কেন? মৃণীর সাথে?”

সকলের দৃষ্টি স্থির। হলুদ বাল্ব উত্তাপ ছড়াচ্ছে যেন। রিবু বলতে শুরু করল,

“খুব ছোটোবেলা, বয়স অনেক কম। পড়াশোনা করতে ভালো লাগতো না। খেলাধূলাও করতাম না। চুপচাপ থাকতে ভালো লাগতো। কিন্তু এটা আমার বাবা-মা পছন্দ করতেন না। মা সবসময় আমাকে ভয় দেখাতেন পড়ার জন্য। একবার তো রান্না করার সময় রেগে লোহার চামচ গরম করে দিয়ে আমার হাতে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। একদিন সারাদিন ভাত দেননি। কখনো অন্ধকার রুমে আটকে রাখতেন। একবার কী হলো জানেন? ছোটো ছিলাম, পড়তে চাইনি বলে মা অন্ধকার রুমে আটকে রাখলেন। ভয়ে আমি এত পাথর হলাম যে এরপর থেকে আর কখনো ভয় পেলাম না কিছু। সেই থেকে কি যেন হলো, বই ছাড়া কিছু বুঝতাম না। সারাদিন বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতাম। বাবা-মাকে সহ্য হতো না। তখন থেকেই আমার ভালোবাসা হলো বই। বাবা-মাকে আমার এত অসহ্য লাগতো যে তাদের উপর ঘৃণা চলে এসেছিল। আর তারা আমার ছোটো বোনকে বোধহয় আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন যা আমার পছন্দ ছিল না। তারপর একদিন, মিনু পুকুরে গেল মাকে লুকিয়ে। আমাকে বলে গেলো ‘ভাই, মাকে বলোনা, আমি গোসল করতে যাবো’ আমিই মাথা নাড়ালাম। মিনু গেল গোসলে। শুনশান চারপাশ। মিনু সাতার জানতো না। গোসল করতে সে যে নামল, আর উঠে এলো না। কীভাবে ওঠে আসবে বলেন? যাকে ইচ্ছে করে মে রে ফেলা হয় সেকি ফিরতে পারে? আমার প্রথম রাগ কমানোর পন্থা। বাবা-মা তখন মিনুর শোকে হাহাকার করতো, আমার ভালো লাগতো। কিন্তু মিনু মা রা যাওয়ার পরও তারা নরম হয়নি। আমার প্রতি সবসময়ের মতন রূঢ়। তারপর এলাম শহরে। কতগুলো বন্ধু পেলাম। মনে হলো জীবনে এই বুঝি অনেক আপন মানুষ পেলাম। ওদের ঘিরেই আমার দ্বিতীয় বদল শুরু। আমাদের মাঝে রিয়াদ আর কবির ছিল প্রচুর প র্ন আসক্ত। আর ওদের পাল্লায় পড়ে আমি আর শাহাদও ধীরে ধীরে ডুবে গেলাম সেই দুনিয়ায়। আলাদা টান, আলাদা একটা মোহ কাজ করতো। কিন্তু বুঝতে দিতাম না কাউকে। কিন্তু ততদিনে আমি ভেতর ভেতর কেমন হয়ে যাচ্ছিলাম। তখন কোনো নারীকে আর সাধারন চোখে দেখতে পারতাম না। সবাইকে দেখতাম কামুক চোখে। যৌ ন তা খুঁজে পেতাম সবার মাঝে। মেয়েদের আমি আর মানুষ বলেই গন্য করতাম না। তার যেন কেবল কাম মেটানোর হাতিয়ার হয়ে ওঠল আমার কাছে। আমি রিদানকে মানা করতাম আমাদের গ্রুপে দিতে না, কিন্তু ও ভাবতো আমি মজা করতাম। কিন্তু ওকে তো আর বুঝাতে পারিনি যে আমি ধীরে ধীরে অমানুষে পরিণত হচ্ছি। আমি দ্রুত একজন সাইক্রেটিস দেখানো শুরু করলাম যিনি ছবলো একজন নারী। তার কাছে আমি পরামর্শ নিতে গেলেও তাকে আমি কামুক চোখে দেখতে শুরু করলাম। তার উপর রিদানের সেসব ভিডিও আমাকে আরও উত্তেজনা সৃষ্টি করে দিতো। যার জন্য মেডামকে একদিন আমি নিজের কাম মেটানোর কাজে লাগালাম জোর করেই। তিনি কিছু বলতে পারেনি কারণ আমাদের মুহূর্ত আমি ক্যামেরা বন্দি করে রাখি। কয়েকদিন পর তিনি আত্ম হ ত্যা করে। আমি তখন আরও উন্মাদ হয়ে গেলাম। তারপর মিত্রের পালানোর দিন সাথে ছিলাম। কিন্তু মিত্ররা সেদিন রাজশাহী না গিয়ে ফিরে আসে। মিত্র বলে তার বাবা নাকি তাকে খুঁজে বের করে ফেলবে যেখানেই থাকুক তাই আমার এখানে থাকবে। কেউ আর বুঝতেই পারবে না। আমিও রাজি হলাম। কিন্তু সেটাই আমার জীবনের বড়ো ভুল। সালেহাকে দেখে আমি আর নিজেকে সংযত রাখতে পারছিলাম না, অতঃপর যা হওয়ার হলো। মিত্রকে বেঁধে রাখতাম। মুখ আটকে রাখতাম আর সালেহার সাথে খারাপ আচরণ করলাম। এরপর তাকে মে রে পুড়িয়ে ফেললাম। ঐ যে আলমারিতে পুতুল আছে না? সালেহা সেখানে তার প্রিয় রঙের পুতুল হয়ে আছে। মিত্রকে মারতে চাইনি। ওকে বলেছিলাম ছেড়ে দিব যদি সে সব ভুলে যায় কিন্তু মিত্র রাজি হয়নি তাই বাধ্য হয়ে ওকে মারলাম। টুকরো টুকরো করলাম। তারপর মনে হলো আমার এই বিকৃত মস্তিষ্কটা বেরিয়ে আসা উচিত না-হয় আরও খারাপ কিছু হতে পারে। তাই পার্সেল করে সবার বাসার সামনে রেখে এলাম। ইচ্ছেকৃত নিজের জুতো পরে গেলাম যেন আমাকে ধরতে পারেন কিন্তু আপনারা অনেক দেরী করে ফেললেন। এর মাঝে বাবা-মাও এসেছিলেন। আমার মস্তিষ্ক এত বিকৃত হলো যে আমি সেদিন নিজের মায়ের মাঝে যৌ ন তা খুঁজতে লাগলাম। নিজেকে চেয়েও কন্ট্রোল করতে পারলাম না। মায়ের সাথে খারাপ কিছু তো করা যায় না তাি বলেছিলাম তাদের গ্রামে যেতে কিন্তু তারা রাজি হলেন না। আমি না পেরে নিজের মা’কে মেরে ফেললাম। মেরে তার দেহ পুড়িয়ে সেটাও তার প্রিয় লাল রঙের পুতুলের মাঝে রেখে দিলাম। বাবা আমার সাথে হাতাহাতি করলেন কিন্তু পারলেন না। বাবাকেও অনেকক্ষণ লাগিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে ফ্রীজে রেখে দিলাম। কিন্তু মৃণী আমার অনিচ্ছাকৃত শিকার ছিল। ওর সাথে তো মিশতে চাইনি কিন্তু ও নিজে নিজে সেদিন আমার পেছনে চলে এসেছিল আমার বাড়ি। তার মাঝেই রিদানের আরও একটা বাজে ভিডিও আমাকে আরও নিচে নামিয়ে ফেলল। আমি সব ভুলে মৃণীকে ধরলাম। ওর পরিণতিও এটা হতো কিন্তু আপনাদের জন্য বেঁচে গেল।”

সকলে বিমূঢ় নয়নে তাকিয়ে রইলো রিবুর দিকে। সালাম সাহেব হতাশ কণ্ঠে রিদানদের উদ্দেশ্যে বললেন,
“দেখেছ তোমরা? এত সুন্দর জীবনটা তোমরা কী করেছ? নিষিদ্ধ জিনিসে আসক্ত হয়ে একটা ব্রিলিয়ান্ট ছেলের মস্তিষ্ক নষ্ট করে ফেলেছ। তোমাদের জন্য কত গুলো প্রান শেষ। অতি ঝোঁক ভালো না। বুঝেছ তার ফল?”

“কিন্তু স্যার, ও ইতি আলাপী কেন লিখেছে চিঠিতে?”

দীপনের প্রশ্নে সালাম সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আলাপী মানে পরিচিত। ও আমাদেরকে সংকেত দেওয়ার জন্য নিজের হাতের লিখার চিরকটু দিয়েছিল। আমি শাহাদের খাতায় ওর হাতের লেখা দেখেই পরে বুঝতে পারি এটা ও।”

[সমাপ্ত]

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here