উমা পর্ব -০১

১.
সিঁথি ভর্তি সিঁদুর নিয়ে প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে উমা। বিস্ময়ে সে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। তার সম্মুখে মাতাল রুদ্র ঢুলছে, মুখে পৈশাচিক হাসি। এতোদিনের মনোবাসনা পূরণের আত্নতৃপ্তি যেনো মুখশ্রীতে ছলকে উঠছে। কিছুক্ষণ পূর্বে গোপিনাথপুর গ্রামের সকল সনাতন ধর্মাবলম্বী নারীদের সিঁদুর খেলা উৎসবের মাঝে হুট করেই রুদ্রের উপস্থিতি। একরাশ সিঁদুর মুঠো করে রাঙ্গিয়ে দেয় উমার সিঁথি। উমা সহ উপস্থিত সবার আশ্চর্যের অন্ত নেই। চেয়ারম্যান অভিনব সিংহ রায় ছেলের এমন কার্যে খুব একটা খুশী হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে না। বরং চোখ গরম করে তাকিয়ে রইলেন রুদ্রের দিকে। এদিকে রুদ্রে মা শ্রীমতী লক্ষী দেবী স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। চেয়ারম্যান পত্নী হবার দরুন তার দাপট গ্রামে বেশ। আজ রুদ্রের এমন কাজে যেনো মুখে ঝামাঘষা পড়লো তার। রুদ্র এখনো হাসছে। পেটে সিদ্ধি পড়লে মাথাটা তার কাজ করা বন্ধ করে দেয়। মাতলামো সে হরহামেশাই করে, এটাই তার স্বভাব। রুদ্রের গুনের বর্ণনা সারা গ্রাম ই জানে। বাপের পয়সা উড়ায়, মাতলামী করে, মেয়েনেশা, যত খারাপ গুন একটা মানুষের মাঝে থাকা যায় সে তাই। তার কাছে কারোও অনুভূতির দু পয়সার দাম নেই। কিন্তু আজ সব স্পর্ধা যেনো মাত্রা ছাড়ালো। পুজো মন্ডবে রিরি লেগে গেলো। মানুষের কথার ঢল পড়লো। উমা এখনো হতবিহ্বল। মাথায় হাত পড়তেই বাস্তবকে যেনো আরোও ভালো করে বুঝতে পারলো সে। সব নারীদের কানাগোসা শুরু হলো। “উমার সিঁথি রাঙ্গালো চেয়ারম্যান পুত্র রুদ্র”– এটা হবে আগামীকাল ভোরের আলোচনার টপিক।

রতী দেবী ছুটে এলেন, রক্তচক্ষু প্রয়োগ করলেন উমার দিকে। যেনো দোষটা উমার, অবশ্য যে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা; এই প্রবাদের উল্লেখ্য উদাহরণ এই নারী। সৎ মেয়ে উমাকে তার কেনো যেনো সহ্য হয় না। একেবারেই না, তার মতে এই ষোড়শী তার সংসারের অন্ন ধ্বংস করছে। তাকে ঘাড় থেকে থামাতে পারলেই যেনো মঙ্গল। তাই তার সাথে অনর্থ ঘটলেও তার ই দোষ। তিনি পরিবেশের গাম্ভীর্য না বুঝেই উমার বাহু ঝাকিয়ে বললেন,
“মুখপুড়ি এ কি অলুক্ষনে কান্ড করলি? দিলি তো, দিলি সবার আনন্দে জল ফেলে! শুধু শুধু বলি তুই সর্বনাশী?”

তিনি রেডিও শুরু করলেন, উমার মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না। রুদ্র তার তাল রাখতে পারলো না। ধড়াম করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। ছেলেকে লুটিয়ে পড়তে দেখে লক্ষী দেবী ছুটে এলেন, সবাইকে আদেশ দিলেন,
“তোলো আমার বাছাকে কেউ তোলো।”

রুদ্রের বন্ধুমহল তাকে কোনো মতে ধরাধরি করে তুললো। তারপর রওনা দিলো চেয়ারম্যানের বাড়ি। লক্ষী দেবী পিছন পিছন গেলেন।

গ্রামে রুদ্রের এমন আচারণ নতুন না। সে মাতাল হয়ে যেখানে সেখানে লুটিয়ে পড়ে। তার বন্ধুরা তাকে তুলে। তারপর চেয়ারম্যানের বাড়ি দিয়ে আসে। চেয়ারম্যানরা এই গ্রামের আদি জমিদার। জমিদারি চলে গেলেও দাপট যায় নি। স্বাধীন বাংলায় অভিনব সিংহের বাবা এই গ্রামের চেয়ারম্যান হন। সেখান থেকে এখনো চলে আসছে এই চেয়ারম্যানের অধিপত্য। গত শীতে রকিব মাস্টার দাঁড়িয়েছিলো। কিন্তু ভোট সেই পড়লো অভিনব সিংহের ভাগেই। কেনোই বা দিবে না, গ্রামের বিত্তবান মানুষের একজন অভিনব সিংহ। পুলিশ ও তাকে ভয় করে। গ্রামের যেকোনো সমস্যা তিনিই দূর করেন। রকীবুল মাস্টার লোক ভালো কিন্তু তার কাছে কোনো ক্ষমতা নেই। তাহলে কেনো হবে না অভিনব সিংহ চেয়ারম্যান!

এদিকে, ভাসানে যাবে প্রতিমা। দশ দিনে দুর্গোৎসবের আজ সমাপ্তি। আজ প্রতীমা ভাসিয়ে দিবে তারা। ফলে আসছে বছর যেনো আবার ফিরে প্রতীমা। অভিনব সিংহ গলা খাকারি দিলেন, রুঢ় স্বরে বললেন,
“মা কে তোলো, ভাসানে যাবো”

সনাতন পুরুষেরা একত্রিত হলেন, প্রতিমাকে যেভাবে আনা হয়েছিলো সেভাবেই নিয়ে যাচ্ছে নৌকার কাছে। গ্রামে বেশ ঠান্ডা পড়েছে। নিখিল বাবু নতমস্তকে মন্দিরের এক কোনে দাঁড়িয়ে আছেন। মঙ্গলের তিথিতে অমঙ্গল ঘটলো। অভিনব সিংহ যাবার পূর্বে হিসহিসিয়ে বললেন,
“এখানে যা ঘটেছে তা নিয়ে কাল সকালে আলোচনা বসবে৷ পুজোর রাত, সক্কলে ক্লান্ত।”
“জ্বে আচ্ছা”

নিখিল বাবু মাথা কাত করে কথাটা বলেন। নিখিল বাবু ছা পোষা মানুষ। গ্রামের বাজারে মুদি দোকান তার। কিছু কিছু মানুষের স্বভাব শুধু অপর মানুষের নির্দেশ পালন করা। নিখিল বাবু তেমন ই একজন। কখনো কাউকে উচ্চস্বরে কিছুই বলতে পারেন না। তাই তো মেয়ের সাথে এতো বড় কান্ড হবার পর ও তিনি শুধু ঘাড় কাত করে “জ্বে আচ্ছা” টুকুই বলেছেন।

রাত দশটা,
প্রতিমা ভাসানো হয়ে গিয়েছে৷ মাথা ভর্তি সিঁদুর নিয়ে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আছে উমা। নিখিল বাবু বাড়ি ফিরতেই রাজশ্বী পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। এক নিঃশ্বাসে পানিটুকু শেষ করলেন তিনি। রতী দেবীর বচন এখনো শেষ হয় নি। তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার করছেন। আর একটু পর পর এসে উমার মাথায় গাট্টা দিচ্ছেন।
“বলেছিলুম, বাড়ি থাক। যাস নে মন্দিরে। শুনলো তোমার মেয়ে? না যেতেই হবে তার। মানুষকে ধিঙ্গিপনা না দেখালে যে নয়। হলো তো, শান্তি। এখন আর কি, কাল আসছে উনারা। সিঁদুরদান হয়ে গিয়েছে এবার বাপু রীতি মেনে বিয়ে হবে ব্যাস।”
“মা আমি বিয়ে করবো না।”

এতোক্ষণে মুখ খুললো উমা। টানা টানা আঁখি জলে ভেসে যাচ্ছে। রুদ্রকে তার ইহজীবনে পছন্দ নয়। এমন মাতাল, চালচুলোহীন, আওয়াড়াকে কোনো মেয়েই পছন্দ করবে না। আর বহু দিন হলো তার নজর উমার দিকে। স্কুলে যেতেই তার সাথে দেখা হয়। ছলেবলে ডাকে এটা সেটা দিতে, উমা ভীত চোখে তাকায় তারপর পালিয়ে যায়। উমার চেয়ে বেশ বড় সে। উমার কথাটা যেনো কানে বাজছে রতী দেবীর। চুলের মুঠি ধরে হিনহিনে স্বরে বলে,
“তোর ভাগ্য ভালো সে শুধু সিঁথি রাঙ্গিয়েছে। তুলে নিয়ে গেলে কি করতাম? ভেবেছিস একবার ও?”

উমা দমে গেলো। এমনিতেই তার কথা এখানে শোনার কেউ নেই। নিখিল বাবু মেয়ের চুল ছাড়ালেন। ধীর স্বরে বললেন,
“নিজের ঘরে যা, তোর মার সাথে কথা আছে।”

উমা মাথা কাত করেই নিজের ঘরে চলে গেলো। দরজা আটকে দিলো। বুকটা যেনো ভারী হয়ে গিয়েছে। উথাল পাথাল করে কান্না পাচ্ছে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। তার কি দোষ ছিলো। সখীদের সাথে সিঁদুর ই তো খেলেছে। তা কি খুব অন্যায়! হাটু আকড়ে বিষাদ জোয়ার ছেড়ে দিলো সে। চাপা স্বরে বললো,
“মা, তুমি কেনো ছেড়ে গেলে আমায়”

উমার মা, শিবানি দেবী নবজাতক উমাকে রেখে পাড়ি দিয়েছেন পরলোক। জীর্ণ শরীরটা প্রসবের ধকল নিতে পারে নি। সেদিন উমার ঠাম্মা খুব কেঁদেছিলেন। শিবানি নাকি অন্নপূর্ণার রুপ ছিলো। তাই তিনি নাতনীর নাম রাখেন উমা। শিশু উমা মা ব্যাতীত থাকতে পারবে না বলেই নতুন মা আনেন নিখিল বাবু। কিন্তু রতী দেবীর চক্ষুশূল হলো উমা। ছোট উমার প্রতি দরদ ছিলো প্রথমে, কিন্তু উনার প্রথম সন্তান রাজশ্বীর যখন মৃতপ্রায় দশা হলো এই উমার জন্য তখন থেকে তার দুচোখের বিষ হলো চার বছরের উমা। অবশ্য রাজশ্বী বেঁচে গিয়েছিলো। এখন তার বয়স পনেরো হবে। একটা ছোট ছেলে ও হয়েছে নিখিল বাবু এবং রতী দেবীর। তার নাম গোপাল, তার বয়স এখন ছয়। ঠাম্মার গত হবার পর থেকে যেনো মাথা হাত বুলানোর কেউ ই নেই উমার। বাবা থেকেও নেই। তবে ভাইবোন দুজনের সাথে বেশ খাতির। রাজশ্বী তো উমা ভক্ত। তার দিদি ই যেনো তার সব কিছু। মন খারাপ উঁকি দিলেই ভাই বোনের কাছে ছোটে উমা। কিন্তু এই মন খারাপ যে সে মন খারাপ নয়। এতো কঠিন পরীক্ষা এসে ভিড়েছে তার সামনে। কিভাবে মোকাবিলা করবে উমা! সে যে পড়তে চায়, নিজের পায়ে দাঁড় হতে চায়; বিয়ে নামক বন্ধনে আটকে থাকতে চায় না উমা_________

সকাল ১০টা,
সূর্যের তীর্যক কিরণ পর্দা ভেজ করে আছড়ে পড়ছে। ঠান্ডা ঘরটি উষ্ণতার আবেশে পরিপূর্ণ। অবশেষে ঘুম ভাঙ্গলো রুদ্রের। গতকাল একটু বেশি নেশা করেছিলো সে। এখন গা গুলোচ্ছে। নেশাটা কাটে নি। মাথা ঝিমঝিম করছে। এর মাঝে ফুলির মা কটাশ করে শব্দ করে লেবুজলটা রাখলো। বিরক্তির স্বরে বললো,
“বাবাজী উঠে পড়ো, বরদের এতো বেলা করি শুতে হয় না। উঠে যাও”

ফুলির মার কথায় হতবাক দৃষ্টিতে তাকায় রুদ্র। হুংকার ছেড়ে বলে,
“কিসের বর, কার বর?”
“এ বাবা মনে নেই নাকি? কাল যে উমার সিঁথি রাঙ্গিয়ে দিলে! কর্তা গেছে নিখিলদার বাড়ি। পুরোহিত ও গেলো সাথে।”

রুদ্রের মাথায় যেনো বাজ পড়লো। এ কি শুনছে সে, তবে উমার সিঁথিতে সিঁদুরদান স্বপ্ন ছিলো না। তবে এই বিস্ময়ে ভয়ংকর হাসির রুপ নিলো, যে পাখিকে এতোদিন বশ করতে পারছিলো না এখন সে হাতের মুঠোতে। একটাই আফসোস, বিয়েটা তাকে করতে হবে।

নিখিল বাবুর বাড়িতে আসর বসেছে। রতী দেবী আক্রোশের স্বরে বললেন,
“সিঁদুর দান কি ছেলেখেলা! একবার সিঁদুরদান হয়েছে এবার রুদ্রকে বিয়েটা করতেই হবে। নয়তো আমার মেয়েকে কে বিয়ে করবে!”
“হ্যা, ঠিক ঠিক। গ্রামের মান সম্মানের ব্যাপার।”

রতী দেবী চোখে জল এলে বললেন,
“মেয়ে আমার লাখে একটা, এমন মেয়েকে নিয়ে এভাবে না খেললেই তো পারতো রুদ্র।”

অভিনব সিংহের কপালে চিন্তার রেখা ভেসে উঠে। ছেলের কীর্তিতে সে উচ্চবাচ্য করতে পারছে না। চেয়ারম্যান সে, একটা ভুল সিদ্ধান্ত আর পদ চলে যাবে অন্যত্র। টাকা দিয়ে আর যাই হোক সকলের মুখ একসাথে বন্ধ করা যায় না। রুদ্রের উপর যে বেজায় ক্ষেপে আছেন। আরে বাবা, মেয়েকে ভোগ করবি কর না, রাতের অন্ধকারে কর। তাই বলে সকলের সামনে সিঁদুর পড়াতে গেলি কেনো! সবার সামনে নিজের মুখখানা তো রাখতেই হবে, তাই উচ্চস্বরে বললেন,
“তুমি চিন্তা করো না নিখিল বউ, উমাই হবে আমার পুত্রবধু। লক্ষী পুজোর দিন হবে উমা এবং রুদ্রের বিয়ে”

কথাটা শুনেই অন্দরমহলে থাকা উমার বুক ধক করে উঠলো। ষোড়শীর স্বপ্নগুলো একত্রে কাঁচের মতো ভাঙ্গতে লাগলো অচিরেই। ভেতরে থাকা স্বপ্নগুলোকে কেউ গলা চেপে হত্যা করতে লাগলো যেনো_______

২.
লক্ষীপুজোর দিন,
নিখিল বাবুর আঙ্গিনাতে মন্ডব সেজেছে। রঙ্গিন কাগজ দিয়ে ঘর সাজানো হয়েছে। হিন্দু মুসলমান সকলের দাওয়াত পড়েছে। চেয়ারম্যানের ছেলের বিয়ে, আড়ম্বরতার কমতি নেই। লাল বেনারসিতে উমাকে দেবীর ন্যায় লাগছে। টানা টানা চোখে সুন্দর করে কাজল দিয়েছে, ফর্সা গায়ে লাল রঙটি যেনো মিশে আছে। কোমড় অবধি কোকড়ানো চুল খোঁপা করেছে, তার উপর শিউলির মালা। সাদা পা জোড়ায় আলতা পড়ানো হয়েছে। শুধু ঠোঁটের কোনে কেউ হাসি একে দিয়ে পাড়ে নি, পারে নি চোখের কোনের জল মুছে দিতে। গোপাল তার বন্ধুর বাড়ি থেকে একটা সাউন্ডবক্স জোগাড় করে এসেছে। সেখানে বাজছে,
“লীলাবালি লীলাবালি
বড় যুবতী সই গো
বড় যুবতী সই গো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে”

এরই মাঝে হট্টগোল শোনা গেলো। বাহিরে গোল লেগেছে। রতী দেবী ছুটে গেলেম বাহিরে। এর মাঝেই উমার কানে এলো,
“পুলিশ এসেছে, বিয়ে এবার বন্ধ”………….

চলবে

[আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন সবাই! আবারো ফিরে আসা নতুন গল্প নিয়ে। কেমন লেগেছে জানাবেন? ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আগামীকাল রাতে দিবো। কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না]

#উমা
#সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here