এই রাত তোমার আমার পর্ব ১৮

#এই_রাত_তোমার_আমার
#সানজিদা_ইসলাম
#১৮তম_পর্ব

—শরীরের দাম তো দিয়ে দিলেন। আমার অনুভূতির দাম কিভাবে দিবেন?

ফিমা শান্ত কন্ঠে মাহিয়াতের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো।সে সামান্য বিচলিত হলো না। এই কয়েকদিনে নিজেকে বেশ শক্ত করে নিয়েছে।যখন সে জানতে পারল গত সাতদিনে মাহিয়াত একবারও তার কোনো খোঁজখবর নেয় নি।আর না দেখতে এসেছে।তখনি সে বুঝে নিয়েছে।মাহিয়াতের জীবনে তার এখন প্রয়োজন শেষ তারা বাচ্চা পেয়ে গেছে তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে এখন আর শুধু শুধু অভিনয় করার দরকার নেই।এখন শুধু কাগজে কলমে বিচ্ছেদের পালা।

মাহিয়াত দীর্ঘশ্বাস ফেলল,স্যুটের পকেট থেকে চেক বই বের করে তাতে কিছু লিখলো তারপর তা ফিমার দিকে এগিয়ে দিলো।

ফিমা উঠে বসলো। পেটের কাটা জায়গায় ব্যাথা করছে। ঘা এখনো ভালো ভাবে শুকায়নি একটু নাড়াচাড়া করলেই চিনচিন ব্যাথা হয়। কিন্তু মনের ব্যাথা তো শরীরের ব্যাথা থেকে বেশি যন্ত্রণাদায়ক।এত টুকু ব্যাথা আর কি করতে পারবে?

মাহিয়াত বুঝতে পারছিলো ফিমা ব্যাথা পাচ্ছে, একবার বলতে ইচ্ছে করছিলো আপনার উঠে বসার প্রয়োজন নেই আপনি ‌শুয়ে থাকুন। কিন্তু সে বললো না।আর বলবেও না কোনোদিন।আজই শেষ এর পর আর কোন দিন মনেও রাখবে না ফিমা নামে তার জীবনে কেউ ছিলো।

ফিমা উঠে বসেই মাহিয়াতের হাত থেকে চেকটা নিলো সেখানে এক লক্ষ টাকার অংক লেখা আছে মাহিয়াত সই করে দিয়েছে। তার মানে মাহিয়াত বোঝাতে চাচ্ছে তার অনুভূতির দাম এক লক্ষ টাকা।ফিমা বাঁকা হাসলো, তাচ্ছিল্যে ভরা হাঁসি।

—আমার অনুভূতির দাম এতোই ঠুকনো আপনার কাছে?তাই বুঝি এভাবে আমাকে নিয়ে খেলেছেন? আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো এতো দিন যা‌ যা করেছেন সবাই কি নাটক ছিলো? সামান্য সত্যতাও কি ছিলো না?

মাহিয়াতের সোজা সাপ্টা উত্তর,
—নাহ।

মাহিয়াতের উত্তর শুনে ফিমা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
—‌আমাকে বুকে জরিয়ে, রাখা হাজার খানিক চুমু খাওয়া,রাতের পর রাত জেগে গল্প করা, ঘুরতে যাওয়া, বিনা বাক্যে আমার আবদার মানা আমার ছোট থেকে ছোট বিষয় খেয়াল রাখা এ সবই আপনার নাটক ছিলো?

—হ্যা,

—কেনো?

—আমি নিরুপায় ছিলাম অতিরিক্ত চিন্তায় আপনি ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন, খাওয়া-দাওয়া করছিলেন না ঠিক মত, মেডিসিন নিচ্ছিলেন না সারাদিন আপন ভাবনায় থাকতেন। ধীরে ধীরে মানসিক রোগী তে পরিণত হয়েছিলেন। রেগুলার চেকআপ করাচ্ছিলেন না। যা আপনার সাথে সাথে আমার বাচ্চারও ক্ষতি করছিলো।আর আমি তো সামান্য গাফিলতির জন্য নিজের সন্তানকে হারাতে পারি না।আর তা ছাড়া এমন হতে থাকলে আপনার ও প্রাণের ঝুঁকি ছিলো তাই এমনটা করতে বাধ্য হয়েছি।যেন আপনি ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠতে পারেন আর আপনার এবং আমার বাচ্চার দুজনেরি খয়াল রাখতে পারেন।

ফিমা মাহিয়াতের চোখের দিকে তাকিয়ে কোমল কন্ঠে বললো,
—বিশ্বাস করুন মাহিয়াত আপনার এই ছলনার সহ্য করার চেয়ে আমার মরণ হলেই বোধহয় ভালো হতো।আমি এগুলো ‌নিতে পারছি না। দুঃখ জনক হলেও সত্যি যে আমি আপনাকে সত্যিই মন থেকে ভালোবেসেছিলাম। আমার ভালোবাসায় কোনো ছলনা ছিলো না।তাহলে প্রত্যেকবার আমিই কেনো কষ্ট পাবো?

প্রথমে তো আমিই নিজেকে সামলাতে নিয়েছিলাম নিজের স্বপ্ন গুলোকে ইচ্ছে গুলো দমিয়ে দেখেছিলাম আপনার ব্যাবহার মেনে নিয়েছিলাম কিন্তু আপনি কি করলেন?নাটক করে আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে আমার আকাশ কুসুম স্বপ্ন গুলোতে পাখা গজিয়ে দিলেন অসীম অকাশের দীর্ঘতম উচ্চতায় আমাকে পৌঁছে দিয়ে এখন এক পলকের মধ্যে ডানা গুলো ক্ষত বিক্ষত করে কেটে দিলে আমি নিজেকে কি করে সামলাবো নিজেকে বলতে পারেন?

মাহিয়াত লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল,
—আমি সত্যিই দুঃখিত আমি বুঝতে পারিনি আপনি এতোটা কষ্ট পাবেন।

—দুঃখিত বললেন আর সব সমাধান হয়ে গেল?

—তাহলে আপনি কি চাচ্ছেন আপনাকে আমি বাড়িতে নিয়ে যাই? আপনার সাথে সংসার করি?দেখুন আপনাকে বিয়ের আগে আমি সব ক্লিয়ার করে দিয়েছি বাচ্চা হওয়ার সাথে সাথে আপনি আমাকে বিনা বাক্যে ডিভোর্স দিয়ে দিবেন তাহলে এখন এই সব কথা বলে কি লাভ?

—কিন্তু কোথাও এটা লিখা ছিলো না। আপনি আমার মন নিয়ে খেলা করতে পারবেন,

—আমি সত্যিই দুঃখিত এই ব্যাপারটি নিয়ে।এই ব্যাপারটি ইচ্ছাকৃতভাবে করা না। আমি এক প্রকার বাধ্য হয়েই এমনটা করেছি।আমি আপনার কাছে বারবার ক্ষমা চাচ্ছি ।আর তাছাড়া আপনাকে এর মূল্যও দেয়া হচ্ছে যদিও অতি তুচ্ছ কিন্তু এ ছাড়া আমি আর কোনো উপায়ে আপনার অনুভূতির দাম দিতে পারবো না।

—আচ্ছা সব মানলাম, কিন্তু দিন শেষে যখন আবেগী গন্ঠে বারবার ভালোবাসি বলতেন অস্বীকার করতে পারবেন সেগুলোও মিথ্যা ছিলো?

—না সেগুলো সত্যি ছিলো।

—তাহলে?

—সেগুলো তো আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়নি!আমি কি কখনো বলেছি?ফিমা আমি আপনাকে ভালোবাসি?

—নাহ,

–আমি সব সময় বলতাম আমার বাচ্চার মা কে ভালোবাসি,আর আমার বাচ্চার মা নুহা আপনি নন।আমি শুধু নুহাকেই ভালোবাসি।




—আমাকে কি আপনার বাড়িতে ঠাই দেয়া যায় না মাহিয়াত বাবু?আমি না হয় আপনাদের চোখের দেখা দেখেই সারাজীবন কাটিয়ে দিবো?

কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজের আত্নসম্মন বিসর্জন দিয়ে বড়ই নির্লজ্জতার সাথে ফিমা কথাটা বলে ফেললো,মাহিয়াতও সরাসরি তাকে নাকচ করে দিলো,

—না তা হয় না।নুহা কখনো এ সব পছন্দ করবে না।ও খুব কষ্ট পাবে। এমনিতেও ও আমার দ্বারা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভাবে অনেক কষ্ট পেয়েছে আমি আর ওকে কষ্ট পেতে দিবো না। আর আপনিইবা কেনো আমার এখানে পরে থাকতে চাচ্ছেন? সামনে আপনার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। নিজের জন্য যোগ্য একজন লাইফ পার্টনার খুঁজুন যে আপনাকে তার সর্বোচ্চ দিয়ে ভালবাসবে। যা আমার দ্বারা কখনোই সম্ভব না।

—আমার আপনার থেকে বেটার কাউকে চাই না।

—দেখুন আমি আর কথা বাড়াতে চাচ্ছি না তাড়াতাড়ি সইটা করে দিন আমার আরো কাজ আছে।

ফিমার মনে ক্ষিন আশা ছিলো তাও শেষ হয়ে গেলো।সে জানে অন্যায় করছে কিন্তু কি করবে তারও তো ইচ্ছে করে সংসার করার ভালো থাকার। কিন্তু তা আর হলো কই মাহিয়াতের মনে তো তার জন্য জায়গা ছিলই না এখন আর ঘরেও জায়গা হবে না। তার প্রয়োজন যে শেষ।সে এখন মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য ঘরে রাখলেই বিপদ।

ফিমা আর কিছু বললো না।মাহিয়াতের কাছ থেকে কাগজটা নিয়ে সই করে দিলো।না একটু কান্না করলো না হাত কাপলো। কি হবে কান্না করে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে সে তো আর তাকে গ্রহন করবে না। একবার বাচ্চাটাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিলো তার কার মত দেখতে হয়েছে? কেমন হয়েছে?কিন্তু পরক্ষনেই ভাবলো কি হবে এক পলক দেখে মায়া বাড়িয়ে।ছেড়েই তো আসতে হবে।

ফিমাকে নির্দ্বিধায় স্বাক্ষর করতে দেখে মাহিয়াতের কষ্ট হচ্ছিল একটা সই আর সব সম্পর্ক শেষ।নাহ কি ভাবছে সে? এখন ফিমাকে নিয়ে ভাবাও অন্যায়। আর তাছাড়া সে নুহাকে ভালোবাসে ফিমা শুধুই মোহ এক সাথে অনেক দিন থাকতে থাকতে মায়া হয়ে গেছে তাই কষ্ট হচ্ছে মায়া কেটে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।আর যত তাড়াতাড়ি তাদের সম্পর্ক ছিন্ন ভাবে ততই তার জন্য আর নুহার জন্য মঙ্গল এই অশান্তি আর ভালো লাগে না তার। এখান

মাহিয়াত ফিমার হাত থেকে ডিভোর্স লেটার টা নিয়ে ব্যাগে রেখে দিল তারপর হালকা হাসে বললো,

—ভালো থাকবেন সবসময়, আপনি আসলেই চমৎকার একজন মেয়ে,আল্লাহ নিশ্চয়ই আপনার জন্য আরো ভালো কিছু জমিয়ে রেখেছে।পারলে ক্ষমা করে দিবেন এই অধমকে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় যেভাবেই হোক আপনার সাথে অনেক অন্যায় করেছি। আল্লাহ হাফেজ আশা করি এটাই আমাদের শেষ দেখা।

বলে মাহিয়াত উঠে দাঁড়িলো তার ইচ্ছে করছে রোজকার মত আজকেও ফিমার কপালে একটা চুমু দিতে, কিন্তু কিছু করলো না সে যেতে নিলে ফিমাই তাকে ডাক দিলো,

—মাহিয়াত?

সে ঘুরে দাঁড়ালো,
–হুম?

—একটু আমার দিকে ঝুঁকে দাঁড়াবেন?

মাহিয়াত তাই করলো,ফিমা সাথে সাথে তার কপালে একটা চুমু দিয়ে দিল ফিমার প্রথম এবং শেষ স্পর্শ তারপর বলল,

—আপনিও ভালো থাকবেন। আর এই চেকটা আমার মায়ের হাতে দিয়ে দিবেন এই মূল‌বান কাগজটার জন্যই আজকে আমার এই অবস্থা।আর হ্যা দোয়া করবেন আপনার দেয়া আমার অনুভূতির দাম দিয়েই যেন কিছু করতে পারি।মরতে তো পারবো না বেঁচে থাকার সম্বল নাহয় এটাই হলো।

মাহিয়াত দ্রুত পায়ে বেরিয়ে পড়লো। বেশিক্ষণ সে ফিমার সামনে থাকতে পারবে না। কেমন জানি একটা টান চলে আসে কঠোর হয়ে কথা বলাই যায় না।

হাতের ব্যাগটা খুব ভারি মনে হচ্ছে।সে ভালো ভাবে ধরে রাখতে পারছে না। নিজের শরীরের ওজনও তার কাছে বেশি বেশি মনে হচ্ছে।শরীর একদম ছেড়ে দিয়েছে মনে হচ্ছে সে হাওয়ায় ভেসে ভেসে সামনে আগাচ্ছে।নিজেকে এতক্ষণ খুব কষ্টে সামলেছে।ফিমার সামনে যাওয়ার সাহজ যোগাতে তার তিন দিন লেগেছে। আসলেই তার দ্বারা একটা মারাত্মক ভুল হয়েছে।নুহার কথা শুনে যদি জেদের মাথায় বিয়েটা না করতো তাহলে তাদের জীবনটা হয়তো অন্যরকম হতো। হয়তো অপূর্ণ থাকতো কিন্তু প্রত্যেকেই কি তার জীবনে সব পূর্ণতা পায়?

অপরাধবোধ খুবই খারাপ একটা অনুভূতি।পৃথিবীতে এমন কোন মানুষ পাবেন না যে ভুল করেননি। জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে মানুষ ভুল করে। সে ভুল অন্যের অনুভূতিতে আঘাত করে বা অন্যের প্রতি অবিচার করে। অন্যায় বা ভুলের ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয় পাপবোধ বা অনুশোচনা। এই পাপবোধ বা অনুশোচনাকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে না পারলে মারাত্মক মনোদৈহিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
অপরাধবোধ আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে,মন বিষণ্নতায় ভরে যায়, আত্মসম্মানবোধকে ধ্বংস করে, জীবনের আনন্দকে মাটি করে দিতে পারে। এমন কি এই পাপবোধই সম্পর্ক নষ্টের কারণ হয়ে থাকে।



রাতে একটু দেরি করেই বাসায় ফিরেছে মাহিয়াত।ফিমার সাথে দেখা করে, কাগজপত্র গুলো উকিলের কাছে জমা দিয়েই ছেলের কাছে চলে গিয়েছিল সে। আজকে তাকে খুব গভীর ভাবে দেখেছে সে কি ছোট ছোট হাত পা! নাকে মুখে বুকে আবার নল লাগানো হয়তো বাচ্চার টার ওজন একেবারে কম তাই শরীরের সব হাড় মনে হয় দেখা যাচ্ছিলো।মাহিয়াতের কাছে মনে হচ্ছিলো এ যেন তারই বাচ্চা কালের প্রতিচ্ছবি। শুধু ঠোঁট আর নাক তার মত হয়নি একদম ফিমার মত আর হাসলে ফিমার মত চোখের নিচে একটা গর্ত হয়। ঠিক জেন ফিমাই হাসছে।

সে কিছুক্ষণের জন্য তাকে ছুয়েছিলো। তার এতো টুকু শরীর যে মাহিয়াতের এক হাতেই তাকে অনায়াসে শুইয়ে রাখা যাবে। কিছু ক্ষণের জন্য মাহিয়াত সারা দুনিয়া ভুলে গিয়েছিলো।নিজেকে বাবা বাবা মনে হচ্ছিল। ইচ্ছে করছিলো তাকে বুকে জরিয়ে রাখতে কিন্তু কোলে নেয়ার অনুমতি নেই।দশদিনে বাচ্চার যথেষ্ট ইমপ্রুভ হয়েছে আরো ভালো ইমপ্রুভমেন্টের জন্য ডাক্তার আরো দুদিন রাখার পরামর্শ দিলো।

মাহিয়াত ঘরে ঢুকতেই নুহা তার কাছে চলে এলো তারা এখন তাদের আগের রুমে সিফ্ট হয়েছে,

—কই ছিলে সারদিন ফোন বন্ধ ছিলো কেনো?জানো কত টেনশনে ছিলাম?
বলতে বলতেই মাহিয়াতকে জরিয়ে ধরে বুকে মাথা রাখলো।মাহিয়াতও হাতের ব্যাগ রেখে নুহাকে জরিয়ে ধরলো দুজনেই কিছুকক্ষণ নিরব রইলো।মাহিয়াতের এখন কিছুটা ভালো লাগছে।আজ সব ঝামেলা থেকে মুক্ত পেয়েছে।তাই একটু হালকা হালকা লাগছে। আর তাছাড়া সে আবার নুহাকে ফিরে পেয়েছে তার সন্তান পেয়েছে আর কি চাই। কিন্তু তবুও কিছু একটা আছে যা কাঁটার মতো বিঁধে আছে কিন্তু কি তা সে খোঁজ করতে চায় না।

—কাজ হয়েছে?

—হুম।সব কাগজপত্র উকিলের কাছে দিয়ে এসেছি।আর ওর প্রাপ্যও বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি।

—সিন ক্রিয়েট করে নি?

—নাহ।

—ওহ।আমি তো মনে করেছি সহজে তোমাকে ছাড়বেনা।সিন ক্রিয়েট করবে।ডিভোর্স দিতে চাইবে না কান্নাকাটি করবে। তুমি বুঝি ঝামেলায় পরে গিয়েছো তাই বোধহয় আসতে দেরি হচ্ছে।

—হুম, কিছু করেনি।

—সারাদিন কই ছিলে বললে না তো?

—আ আব কাজ শেষ করে মাহিরের(তাদের ছেলের নাম দিয়েছি আন্দাজে ভালো নাম মনে পড়ছিলো না 😆) কাছে ছিলাম এতোক্ষণ। ফোন বোধহয় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাই খেয়াল করি নি। এবার ছাড়ো ফ্রেস হয়ে নেই।খেয়েছো?নুহা ছাড়লো না মাথা উঁচু করে জবাব দিলো,

—হ্যা।

মাহিয়াত তার মুখ থেকে চুল গুলো সরিয়ে তার মুখটা দুই হাতে আগলে ধরে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল,
—তাহলে অপেক্ষা করো আমি ফ্রেস হয়ে আসছি।

নুহা মুচকি হেসে জবাব দিল,
—হুম।

রাতে দুজনেই শুয়ে পড়ল।মাহিয়াতের গলা দিয়ে খাবার নামলো না।নুহা ঘুমিয়ে গেছে।অনেক দিন পর সে তার মাহিকে একান্ত ভাবে পেয়েছে।যার উপর শুধু তার অধিকার।আজ থেকে তাদের মাঝে তৃতীয় কেউ নেই।তাই সে পরম শান্তিতে মাহিয়াতের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে। কিন্তু মাহিয়াতের চোখে ঘুম নেই। তার মন বারবার বারান্দায় যাওয়ার জন্য উসখুস করছে।নুহা ঘুমিয়ে গেলে অনেক আগেই।মাহিয়াত খুব সাবধানেই নুহাকে রেখে বারান্দায় চলে গেলো।

সেখানে গিয়ে প্রথমেই তার চোখ পরলো বারান্দার শেষ প্রান্তে যেখানে ফিমা সবসময় বসে থাকতো। বিয়ের পরের দিন সকালেও এখানেই প্রথম তাকে দেখেছিলো। এখানেই প্রায়ই দেখতো উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকতো আকাশ পানে। তখন এতটা গুরুত্ব দিয়ে না দেখলেও মাঝে মাঝেই চোখ চলে যেতো ঘুমন্ত রমনীর দিকে।আর শেষ দুইটা মাস তো আরো ভালো করে গভীর ভাবে খেয়াল করেছে তাকে।

খুব বড় করে একটা শ্বাস নিলো মাহিয়াত সে যতই চেষ্টা করছে ফিমাকে মনে না করতে তার সাথে জরিত স্মৃতিগুলো মনে না করতে ততই যেন ফিমা তার মাথায় জেকে ধরছে। হঠাৎ পেছনে কারো অস্তিত্ব টের পেলো মাহিয়াত সে জানে কে এসেছে তাই পেছনে না ঘুরেই বললো,

—উঠে এলে কেনো?তুমি না ঘুমিয়ে ছিলে?

নুহা দেরি করলো না ঘুমে ঢুলুঢুলু পায়ে মাহিয়াতের পাশে গিয়ে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো।

—হুম হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো পাশে হাত দিয়ে দেখি তুমি নেই।তাই উঠে এলাম।কি হয়েছে তোমার? কয়েকদিন ধরেই দেখছি সবসময় এমন উদাস হয়ে থাকো ?

—কিছু হয়নি এমনি,

—ওই মেয়েটার কি খবর?

মাহিয়াত বুঝতে পারলো কোন মেয়েটা।তাই আর জিজ্ঞেস করলো না ‘কে সে’। সোজাসুজি উত্তর দিল,

—এখন মোটামুটি ভালো আছে। কিন্তু মনের দিক দিয়ে অনেক ভেঙে পরেছে।মাহিয়াত ফিমার ব্যাপারে সব কিছু খুলে বললো শুধু এখানে থেকে যেতে চাওয়ার ব্যাপারটা ছাড়া।সব শুনে নুহা বললো,

—আমি এতদিন ভাবতাম মেয়েটা বোধহয় সুবিধার না টাকার জন্য সব করতে পারে।গোল্ড ডিগার একটা। কিন্তু এখন এসব শুনে খারাপ লাগছে।

হঠাৎ মাহিয়াতের মন খারাপ হয়ে গেল। বিষন্ন ছেয়ে গেল চোখে, মুখে,
— আমার জন্য এত কিছু হলো! মেয়েটার জীবন টাই নষ্ট করে দিলাম। যতবার ভাবি ওতবার খারাপ লাগে।

— তোমাকে ভাবতে বলছে কে? শুধু শুধু কেন ভাবো?

— না ভেবে থাকা যায়? এই অপরাধবোধ থেকে কবে যে মুক্তি পাব!

নুহা মাহিয়াতের সামনে গিয়ে বললো,
— শোনো, তোমার ফল্ট নেই। তাই অপরাধবোধ ও নেই। এটা একটা এক্সিডেন্ট জাস্ট! ওর কপালে এটা হওয়ার ছিল তাই হইছে। এখানে তুমি আমি শুধু একটা উছিলা মাত্র।বুঝতে পারতেছো আমার কথা?

মাহিয়াত মাথা দোলালো,নুহা তাকে সামনে থেকে জরিয়ে ধরলো,

—মাহি কোনো ভাবেই কি তুমি ঐ মেয়েকে ভালবাসে ফেলছো?যদি এমনটা হয়ে থাকে আমাকে বলতে পারো আমি তোমার একমাত্র ভালোবাসা হয়ে থাকতে চাই করুণা নিয়ে না। তুমি যদি ফিমাকে ভালবেসে থাকো তাহলে আমি তোমার জীবন থেকে চলে যাবো কোনো ঝামেলা……

মাহিয়াত তাকে কিছু বলতে দিলো না তার ঠোঁট দিয়ে নুহার মুখ বন্ধ করে দিলো কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিয়ে তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,

—আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি নুহা আর কাউকে না। আজকে বলেছ বলেছ আর কোনদিন আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলবেনা।আমি উদাস থাকি কারণ আমার নিজেকে দোষী মনে হয়।আর তাছাড়া কথাটা তিক্ত হলেও সত্যি যে ফিমার প্রতি আমার সামান্য দুর্বলতা আছে মেয়েটাকে দেখলেই আমার মায়া হয়। একসাথে সংসার করেছি সময় কাটিয়েছি তার চলে যাওয়াতে একটু তো খারাপ লাগবেই। আমাকে কিছুদিন সময় দাও নিজেকে সামলে নেয়ার জন্য। বিশ্বাস রাখো আমার উপর। আমি তোমার ছিলাম আছি আর থাকবো।আই লাভ ইউ সো মাচ।আর কখনো আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলবে না।

নুহা হাসলো সামান্য …



পরের দিন মাহিয়াত ফিমার চেকটা কুরিয়ারের মাধ্যমে তার মায়ের নামে পাঠালো,ফাহিমা তা মেনে নিতে পারলো না ।টাকা নেয়া একটা বাহানা ছিলো মাত্র বিয়ে দেয়ার জন্য,সে ভেবেছে বাচ্চা হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। মেয়েটার একটা সংসার হবে তাকে সুখে দেখতে পারবে আর ফিমার শাশুড়িও তাই বলেছিলো।যদিও ফিমাকে হসপিটালে ভর্তি করানোর পর মাহিয়াতের আচরণ দেখেই সে কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে যে এমনটাই হবে তবুও মনকে এতো দিন বুঝিয়ে এসেছে এমন কিছুই হবে না। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণিত করে চেকও পাঠিয়ে দিলো?তাহলে কি ফিমার ডিভোর্স হয়ে গেছে?

ফিমার সাথে দেখা না করতে পেরে তার বাবা মার এমনিতেই পাগল প্রায় অবস্থা এর মধ্যে ছেলেটাও কথা বলছে না এখন আবার এত বড় ধাক্কা।তার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে আজকে মনে হচ্ছে সত্যিই সে নিজ হাতে মেয়ের জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে।ফাহামা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো ফিমার বাবা কিছু বললো না।সে সাবধান করেছিলো তাকে কিন্তু শোনেনি। অবশ্য নিজেরও দোষ আছে সে যদি একটু কঠোর হতো?

ফাহিমা চুপ চাপ বসলো না। কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে আজমীন কে ফোন করলো,সে সব জেনেছে মাহিয়াত তাকে পুরো বিষয়টা খোলাসা ভাবে বলেছে।আর তাদের ডিভোর্সের ব্যাপারেও।সে শুধু হতভম্ব হয়ে শুনে গেছে কিছু বলতে পারে নি।

কত হাসিখুশি আর প্রানবন্তর লাগছিলো মেয়েটাকে। কয়েকদিনেই তাকে কত আপন করে নিয়ছিলো তার সাথে সময় কাটাতো। গল্প করতো তার খোঁজ খবর নিতো আজমীনও নিজের মেয়ের মত আদর করতো তাকে।আর শেষ কয়েক দিনে মাহিয়াতের ব্যাবহার দেখে সে ধরেই নিয়েছিলো সে ফিমাকে ছাড়বে না। কিন্তু সে যে অভিনয় করছিলো তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি তিনি।তাহলে আগে থেকেই মেয়েটাকে সাবধান করে রাখত।

কি খুশিই না ছিলো এতোদিন সে। মেয়েটার তো দোষ ছিলো না।সব দোষ তার তাহলে সে কেনো এই প্রতারণার শিকার হলো?এত বড় ধাক্কা মেয়েটা সামলে উঠতে পারবে তো।এমনিতেই তার অতিত এখনো পিছু ছাড়েনি তার উপর আবার ধোকা।
ঠিক আছে তো মেয়েটা?

ফিমার জ্ঞান ফিরেছে সে শুনেছে। কিন্ত তাকে দেখতে যাওয়ার সাহস হয়নি। কিভাবে যাবে? কোন মুখে? সে তো অপরাধী নিজের স্বার্থের জন্য মেয়েটাকে ব্যবহার করেছে জীবনটাকে বিষিয়ে তুলেছে কোন মুখে তার সামনে যাবে?

আশ্চর্য হলেও সত্যি এই যে সে এখন পর্যন্ত তার নাতির মুখ দেখেনি। তার দেখতে ইচ্ছে করছে না। সেই সব থেকে বেশি উচ্ছ্বাসিত ছিল তার বংশের প্রদীপ আসার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু এখন আর এই সব তার ভালো লাগছে না।নুহা এসে বাচ্চার ব্যাপারে তাকে অনেক কিছু বলেছে কিন্তু সে উৎসাহ পায় নি।সে শুধু শুনে গেছে নির্বাক হয়ে।

ফিমার মা অনেক কথা বলেছে তাকে কান্নাকাটি ‌করেছে।কিন্তু সে কিছু বলতে পারেনি কিছু না একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারে নি।সেও ভিতরে ভিতরে অনেক ভেঙে পরেছে শুধু একটা কথাই তার মাথায় ঘুরপাক খায় তার একটা জেদের কারণে সব শেষ‌ সব….



বিশ দিন পর ফিমাকে রিলিজ দিয়ে দেয়।ফাহিম আর ফাহি পুরোটা সময় তার সাথে ছিলো।বড় বড় অফিসারের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকায় সে এতবড় ছুটি ম্যানেজ করতে পেরেছে।কিন্তু খুব দ্রুত ফিরবে ফিমাকে নিয়ে।তাকে দু দন্ডও একা ছাড়েনি তারা। ছোট কালের বিভিন্ন দুষ্টুমির কথা মনে করিয়ে হাঁসিয়েছে খুব।

ফিমাও মন খারাপ করার অবকাশ পায়নি যার এমন দুজন ভাই বোন আছে সে কি বিষন্ন মনে থাকতে পারে। তার বিষন্নতার সাক্ষী শুধু তার মাথার বালিশ আর নিস্তব্ধ রাত। একা থাকলেই মাহিয়াতের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোর কথা বারবার মনে পড়ে।এত সহজে কি সবকিছু ভুলে যাওয়া যায়?



ফিমা একটা সাদা রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছে চুল গুলো বেনি করেছে।বড় নাকফুল খুলে ছোট সাদা পাথরের একটা নাকফুল পরেছে।আর মাহিয়াতের মায়ের দেয়া চেন খুলে ফেলেছে। সে যাওয়ার জন্য তৈরী।

ফাহিম জিজ্ঞেস করলো,
—তুই শিউর ফিমা তুই ঐ বাড়িতে যাবি?

—হ্যা।

—আমি কি আসবো তোর সাথে?

—না দা ভাই আমি যেতে পারব তুমি টেনশন করো না।

—কিছু হলে আমাকে জানাবি।আমি কিন্তু কাউকে আর ছেরে কথা বলবো না।

—কিছু হবে না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।

—আমি পৌঁছে দেই।

—না দরকার নেই আমি যেতে পারব।

—ঠিক আছে সাবধানে যাস।


ফিমা দাঁড়িয়ে আছে মাহিয়াতের বাড়ির সামনে।এক সময় তার খুব পরিচিত একটা জায়গা ছিলো। বুকের ভেতর যে হাড়ে ধুক ধুক করছে এই মনে হয় বেরিয়ে আসবে।সাত পাঁচ না ভেবে ফিমা কলিং বেল চাপলো,

দরজা খুলে মাহিয়াত ফিমাকে দেখে ভুত দেখার মত চমকে গেলো………

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here