একই সুতোয় বাঁধা পর্ব ১৭

#একই_সুতোয়_বাঁধা

পর্ব-১৭

সপ্ত শীখা

হুট করে বাড়িতে এসেছে সায়ন। লাইলি বেগম খুশিতে কি রেখে কি করবেন তাই ভেবে পাচ্ছেন না। ছেলের জন্য লোকজন ডাকিয়ে পিঠা, মাংস মাছ তরকারি রাঁধতে বসেছেন। সাদেকুর রহমান বেরিয়েছেন বাজারে। ছেলের পছন্দমত খাবার এনেছেন… আবারো যাচ্ছেন। আনন্দের একটা কোলাহল বাড়িজুড়ে।

সায়নের মন অস্থির। বাবার সাথে কথা বলার সাহস এখনো কম তার। আর মা কে কথাটা বলার ফুরসত হচ্ছে না। কালই ফিরতে হবে… আজকে না বললে বলবে কখন ?

💙💙💙💙💙

— গরুর মাংস আরেকটু দেই বাবা ? কি না কি খাইয়া থাকস… নে আরেকটু…

লাইলি বেগম পাশে বসে ছেলেকে তুলে খাওয়াচ্ছেন। সায়ন না না করেও পার পাচ্ছেনা। তার ধারণা সায়ন উপোসে থাকে শহরের বাসায়। সায়ন আজ কিছু বলছে না… এত শখ তো খাওয়াক !

সন্ধ্যেবেলা।

মাগরিবের নামাজ পড়ে লাইলি বেগম তসবি জপছেন। সায়ন আস্তে ঘরে ঢুকল। এখনি সবচে ভাল সময় বলার…

— আম্মা !

— হু

— শুনো না। জরুরি কথা আছে।

— দাঁড়া জায়নামাজ গুটায়া লই। হু বল।

— আম্মা… ইয়ে মানে হইছে কি…

— সায়ন তাত্তাড়ি বল তো বাবা…

— আম্মা… আমার বয়স সাতাশ চলে। বিয়েশাদি করব ভাবছি… ইয়ে মানে…

–😯😯😯

— আম্মা আমার একটা মেয়েকে খুব ভাল্লাগে। ও আমাদের অফিসেই কাজ করে। আমি ওর চেহারা দেখিনাই নিকাব পরে আসে কিন্তু আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।

চোখ বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলল সায়ন। চোখ এখনো খোলেনি। খুললে দেখতে পেত লাইলি বেগমের মুখে অদ্ভুত এক ভাব ফুটে উঠেছে। কি করে সামলাবেন আজ তিনি জোয়ান ছেলেকে ?

— এইটা সম্ভব না বাবা।

— কেন আম্মা ! আম্মা ও ভাল মেয়ে-

— হয়ত ভাল মেয়ে… কিন্তু তোর জইন্য না। তোর বিয়া অনেক আগেই হইয়া গেসে।

— কি বল এসব ? আমার বিয়ে হয়ে গেছে আর আমিই জানিনা ?

— ছোটকালে তোর আব্বা একবার জোর কইরা তোরে পাঞ্জাবি পরাছিল… মনে আছে ? হুজুর ও আইছিল ওইদিন। তোরে কবুল কইতে বলছিলাম। তোর আর পুষ্পর বিয়ে হইছিল ওইদিন।

— পুষ্প আর আমার ! পুষ্প… ও ও তো আমাকে কখনো কিছু বলেনাই !

— তুই ই বুঝস নাই ও বুঝব কেম্নে ? ও কত ছোট আছিল ভুইলা গেছস ?

— আম্মা !! আমি…

সায়ন মূর্তির মত বসে থাকে। ওর মাথায় কিছুই ধরছিল না। লাইলি বেগমের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। আজ প্রথম অনুশোচনা হচ্ছে তার… কেন সেদিন শ্বাশুড়ির কথা শুনলেন ! অচলা বৃদ্ধা… না শুনলেই বা কি হত ! অন্তত আজ ছেলেটার এমন কষ্ট ত হত না ! তিনি তো এমন চাননি। তিনি চেয়েছিলেন ছেলে আর ছেলেবউ কে একত্রে এনে কথাটা বলবেন… লজ্জায় তারা লাল হবে…

লাইলি বেগম সায়নের কাঁধে হাত রেখে ছেলেকে কাছে টানলেন। অনেক অনেক বছর পর বুকে জড়িয়ে নিলেন ছেলেকে। মায়ের বুকে মাথা রেখে সায়নের ও কি যেন হল… কেঁদে ফেলল ও।

— আমারে মাফ কইরা দিস আব্বা। তোর দাদির শেষ ইচ্ছা ছিল তোর আর পুষ্পির বিয়া। তিনিই তাড়াহুড়া কইরা এইডা করতে বাইধ্য করছিলেন আমাদেরে আর পুষ্পর মা বাবারে।

— আম্মা… আমি এখন কি করব ? পুষ্প আমার স্ত্রী অথচ আমি জানিনা… এদিকে ভালবাসি জান্নাতুল কে ! কাকে বেছে নেব আমি !

— পুষ্পরে।

— আম্মা ! জান্নাতুল কে আমি কথা দিয়ে এসেছি যে !

— বাবা… আল্লাহর উপরে কারো কথা টিকে না। বিয়া ছাড়া নারী পুরুষের সকল সম্পর্কই অবৈধ। পুষ্প তোর বিয়া করা স্ত্রী… কারো জন্য তুই অরে কষ্ট দিলে এর ক্ষমা নাই বাবা। তুই জান্নাতুল রে সব বুঝাইয়া ক… ভালা মেয়ে যেহেতু মাইনা যাইব। আল্লাহর বিধান মানব ইনশাল্লাহ !

— আম্মা… আমি কালকে ভোরে ঢাকা যাব। ঠিক করনি তোমরা এতবড় কথাটা লুকিয়ে… তখন না বললেও পরে তো বলতে পারতে !

লাইলি বেগম কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ছেলেটা এরপর পুষ্পকে মেনে না নেয় যদি…

💚💚💚💚💚

পুষ্প নিজেও বাড়িতে। সাথে নীরা। দুজনেই এখন বসে আছে পুষ্পের দাদির কাছে। তিনি ফোকলা মুখে হিহি করে হেসেই যাচ্ছেন।

— অ পুষ্প রে… তোর নিজের জামাই তোরে বিয়ার পেস্তাব দিছে ? ওরে… পোলাডায় যখন জানব নিজের বউরেই বিয়া করতে জিগাইছে কি হাসির কাহিনি যে হইব !

পুষ্প কি বলবে ! বলার শক্তিই তার নেই। হা করে বসে আছে। একটু আগে যখন দাদি বললেন সায়নের সাথে ওর প্রায় বারো বছর আগে বিয়ে হয়ে গেছে… এতটা অবাক হয়েছিল ও ! এখন দাদির হাসির শব্দের সাথে নীরার হাসি মিলে যেতেই চটকা ভাংল ওর। এমন লজ্জা লেগে উঠেছে যে না পারতে দাদির কোলে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়েছে ও।

সায়ন আজ ওকে ভালবাসে। ছোটবেলার ভালবাসার মানুষ টা আজ নিজে এসে ধরা দিয়েছে। সে কতটা খুশি হবে যখন জানবে যে পুষ্প ওরই বিয়ে করা স্ত্রী ! ইশশশ… এতদিন ধরে মনে মনেই ভালবেসে গেছে পুষ্প ওকে। কত কষ্ট পেয়েছে ! বিয়ের বারো বছর হল, কেন একসাথে সংসার করতে পারল না ওরা ! বাবা মায়েরা আগেই বলে দিলে কি এমন ক্ষতি হত !

— এই ছেমরি ! জামাইর কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমাইয়া গেছস নি ? হইছে উঠ আর নখতা করতে হইব না। অই নীরা.. তোর খালাম্মারে ডাক।

শ্বাশুড়ির তলবে আছিয়া দ্রুত এলেন। ভেজা হাত মুছছেন আচঁলে।

— কি আম্মা ?

— বউ… তোমার কইন্যারে সাজাইয়া দিও গো। হ্যারে আমরার জামাই বিবাহের পেস্তাব দিছে।

— কি ! আম্মা কি কন বুঝিনা-

— আমরা তো এদিকে কিছু কইনাই এগোরে পোলাপাইন ভাইব্বা… এদিকে নিজে নিজে কান্ড ঘটাইছে। বস কই…

দুই মিনিট পর। আছিয়া এবং দাদির হাসিতে সারা ঘর ফেটে যাচ্ছে। একটু পর আছিয়া উঠে নিজের রুম থেকে একটা ব্যাগ নিয়ে এলেন।

— মা… কাল্কে ঢাকা যাইয়া হোস্টেলে ঢুইকাই এই শাড়িটা পরবা। সুন্দর কইরা সাজবা। তারপর সায়নের বাসায় চইলা যাবা। স্বামী হিসাবে ওর সাথে প্রথম দেখা করবা… তাই এই শাড়িটা আম্মার দোয়া হিসাবে পরবা। আচ্ছা ?

— 🙈🙈🙈

দাদি বললেন…

— দাদুমনি শুনো। তোমাদেরকে এম্নে জানানর কোন মতলব আমাদের ছিল না। তাই এখন যা কিছু হইতে পারে। সায়ন রাগ হইতে পারে তুমার উপর। পুরুষ লোক তো সে। তুমি দাঁতে কামড়াইয়া পইড়া থাইক।তারে নিজের কইরা নিবা। সে তোমার স্বামী। ঠিক আছে ?

— আম্মা…দাদু… তোমরা আমাকে তুমি করে বলছ কেন ? আমি কি এখনি পর হয়ে গেছি ?

বলতে বলতে কেঁদে ফেলল পুষ্প। অনেকক্ষন কান্না চেপে রেখেছিল ও। আর পারল না। ওর সাথে সাথে চোখ ভরে এল মা ও দাদির ও। কিন্তু দুজনেই একে অপরের দিকে চেয়ে নীরবে চোখ মুছে সামলে নিলেন। মেয়েটাকে সামলাতে হবে তো !

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here