একজোড়া পায়রা পর্ব -০৫

#একজোড়া_পায়রা
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
#পার্ট৫

গ্রামের বিয়েতে কিছু অদ্ভুত নিয়ম কানুনের জন্য আমার গ্রামের বিয়ে ভালো লাগে না। যেমন একটু আগে যখন অনুর বরকে একটা বড় প্লেটে খাবার সাজিয়ে দেওয়া হলো তখন অনুর মা বললো গিয়ে জামাইয়ের হাত ধুঁইয়ে দিতে।মানে কী?সে কী একা হাত ধুঁতে পারে না একা?হাত ধুঁইয়ে দিতে গেলেই স্পর্শ লাগবে!ইশ!ভাবতেই গা ঘিন ঘিন করে।বাবা আর ভাইয়া ছাড়া অন্য ছেলের স্পর্শ আমার কাছে খুব বাজে লাগে।কিন্তু কি আর করার।এটা বলে নিয়ম জামাইয়ের হাত শালী ধুঁইয়ে দেবে।যদিও আমি আর অনু সমবয়সী।জামাইয়ের হাত ধুঁইয়ে দেওয়ার পর কতবার যে নিজের হাতের দিকে খুতখুতানি দৃষ্টিতে তাকিয়েছি তার হিসাব নেই।বাঙালি সংস্কৃতির আরেকটা ঘৃণ্য নিয়ম হলো কনেকে দেবর কোলে তুলে বাসর ঘরে নিয়ে যাবে।লাইক সিরিয়াসলি?যেখানে পবিত্র হাদিসে বলা হয়েছে দেবর মৃত্যু সমতুল্য(সহীহ বুখারী)।
কনে বিদায় হয়ে গেলেই আমি রওনা দিই।থাকতে চাইছে না মন আর এই জেলখানায়।বাস ধরেই যাত্রা শুরু করি ঢাকার উদ্দেশ্যে।

তখন সন্ধ্যা ছয়টা হবে।সারাদিনের ক্লান্তিতে আমার চোখে রাজ্যের ঘুম চলে এসেছে।কফিকো ক্যান্ডি খেয়ে চেষ্টা করছি ঘুমটাকে আটকানোর।এমন সময় ফোনের রিংটোনে হকচকিয়ে উঠি।স্ক্রিনে একটা আননোওন নাম্বার ভেসে উঠেছে।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কেউ আদুরে কন্ঠে আমায় সালাম দেয়।আমিও সালামের জবাব দিই,,,

-ওয়ালাইকুম আস সালাম। কাকে চাই?
-আপনি মেঘ ম্যাম না?
-জ্বী।কেন?
-ম্যাম আমি শিশির।এটা ভাইয়ার নাম্বার।আপনি আসবেন কবে?
-রওনা দিয়েছি।আর যেহেতু ভাইয়ার নাম্বার থেকে কল করেছো তাহলে নিশ্চয়ই পাশে ভাইয়া আছে।সে আবার আমার ভাবি না ডাকলে বলে মারে তোমায়।

আমার কথা শেষ হতে না হতেই ফোনের ওপাশ থেকে শিশিরের চিৎকারের আওয়াজ আসে।আবছা আবছা বোঝা গেলো।কেউ মনে হয় শিশিরকে ঠাস করে থাপ্পড় মেরে বলছে,,,

-এই ভাবি ডাক।

নিশ্চয়ই ঐ তালগাছটা হবে।ইনি পারেনও।মিচকা শয়তান টাইপের এই লোকটা।তবে এনার শয়তানি গুলো মাঝে মাঝে খারাপ লাগে নাহ!অজান্তেই হেসে দেই আমি।এদিকে মার খেয়ে ফোনে ওপাশ থেকে শিশির চিৎকার করে বলে,,,

-ভাবি ভাইয়া মারে।

আমি হেসে বলি,,,

-আপনার ভাইয়াকে ফোনটা দিন ননদিনী
-ভাইয়া ভাবী চায় তোমায়।

ফোনের বিপরীত পাশে থাকা শিশির শুভ্রকে বলে।মোটা কন্ঠস্বর হওয়ায় আমি শুভ্রের কথা বুঝতে পারি কিছুটা হলেও।উনি তোতলাতে তোতলাতে বলেন,,,

-ত..ত..তুই বল।আমি গেলাম।

হাসি পাচ্ছে খুব শুভ্রের এমন কান্ডে।শিশির বিরক্ত কন্ঠে বলে,,,,

-ভাইয়া চলে গেছে ম্যাম।

আবার সেই ফোনের বিপরীত পাশ থেকে চিরচেনা মোটা কন্ঠস্বর শুনতে পাই,,,

-এই গাধী।বলছি না ভাবী ডাকতে?যেই একটু দূরে চলে গেছি ওমনিই ম্যাম ম্যাম। দিবো এক থাপ্পড়।
-আমার ভাবী হলে তোর তো বউ লাগে।তো বউয়ের সাথে কথা না বলে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিস কেন ফোন?
-এত বড় সাহস তোর?আমায় তুই বললি।
-একশোবার বলবো।তুই ক্রিমিনাল।আমায় অকারণে মেরে শিশু নির্যাতন করিস তুই।
-দেখ শিশির আমায় আইন শিখাতে আসিস না।
-একশোবার শেখাবো।শয়তান।

ফোনের বিপরীত পাশে ভাই বোন ঝগড়া করছে।আর আমি বাসে বসে অডিও এন্টাটেইনমেন্ট নিচ্ছি।ভাই বোনের সম্পর্কটা খুব মিষ্টি।একসময় আমি আর ভাইয়াও এভাবে মারামারি ঝগড়া করতাম।ভাইয়া আর্মিতে চলে যাওয়ার পর আর আমার বাইরে পড়তে আসার পর আমাদের খুব একটা দেখা হয় না।মিস করি বড্ড ভাইয়াকে।

-আম্মু শিশির কামড় দেয়।

ফোনের ওপাশ থেকে শুভ্রর চিৎকারে আমি ফিক করে হেসে দেই।আন্টি এসে ইতিমধ্যে বকাবকি শুরু করে দিয়েছেন,,,

-দুইটা গাধার বাচ্চা জন্ম দিছি।একটা দামড়া বুড়ো হয়ে গেছে।কয়েকদিন পরে বিয়ে করে বউ নিয়ে আসবে ঘরে।আরেকটা তো বিচ্ছু।দুনিয়ার যত দুষ্টামি আছে সব করবে।তোরা কি কোনো দিন মানুষ হবি না?শিশির তো তোকে এমনি এমনি কামড় দেয় নি।নিশ্চয়ই তুই কিছু করেছিস!
-আম্মু ভাইয়া না ভা…..

কথা শেষ করতে পায় না শিশির।শুভ্র বোধহয় মুখ চেপে ধরেছে।

-আম্মু কিছু না তুমি যাও।

-হ্যা..হ্যা..হ্যালো মেঘ।সরি ডিস্টার্ব করার জন্য।
-আরেহ ডিস্টার্ব কিসের।আমি মজাই পেয়েছি।অডিও বিনোদন।আন্টি যেভাবে আপনাকে বকা দিলো আমি তো হাসতে হাসতে শেষ।

আমি হাসতে হাসতে বলি।ওপাশ থেকে উনি ফিসফিসিয়ে বলে,,

-রিপ মাই ইজ্জত।

মোটা কন্ঠস্বর হওয়ায় সেই আবার আমি শুনে ফেললাম।উনি কী বললেন!

হলে ফিরতে রাত হয়ে গেছে।ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে দশটা ছুঁই ছুঁই।হলে ফিরে দেখি এশা জেগে আছে।আমার জন্য নাকি নাবিল ভাইয়ার জন্য বুঝলাম না।আমাকে দেখেই সে উঠে দাঁড়ায়,,

-দোস্ত শোন কালকে না নাবিলের জন্মদিন।ওকে সারপ্রাইজ দিবো।

উত্তেজনা নিয়ে বলে এশা।আমি গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলি,,,

-তো আমি কি করবো?
-পুরোটা শোন তো!
-বল।
-আমি আর তুই দুইজন মিলে ওকে সারপ্রাইজ দিবো।
-কি সারপ্রাইজ।
-এক বালতি ভালোবাসা সরি পানি।
-কালকে সব দেখতে পারবি।তুই শুধু হেল্প করিস।খাবার আমি গরম করে রেখেছি। খেয়ে ঘুমা।
-মন চাইছে না রে খেতে!
-কষ্ট করে গরম করেছি।তুই খাবি না তোর জামাই খাবে বলে দিলাম!
-বফই নেই আর জামাই!

কোনো রকমে ফ্রেশ হয়ে কিছু মুখে তুলে শুয়ে পড়ি।জার্নি করে আসায় বড্ড ক্লান্ত লাগছে।বিছানায় শুতেই রাজ্যের ঘুম এসে ভর করে আমার চোখে।আমি চোখ বুজি।


এক বালতি পানি নিয়ে দোতলায় দাঁড়িয়ে আছি।এশা ফোনে প্রেমালাপে ব্যস্ত।পরিকল্পনা এশা ভুলিয়েভালিয়ে নাবিল ভাইয়াকে নিচে নিয়ে আসবে,সে ইশারা দেবে আর আমি বালতি ভরা পানি তার ওপর ফেলে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবো।কিছুক্ষণ পরই এশা হাতের ইশারায় জানিয়ে দেয় যে আমার সময় এসে গেছে।আমিও এক বালতি পানি ঢেলে দিই নাবিল ভাইয়ার ওপর।দুজনে ওপর থেকে চিৎকার করে বলি,,,

-Happy birthday Mr.Nabil Ahmed…

আমাদের কথা শুনে নাবিল ভাইয়া ওপরে তাকায়।তা দেখে এশা স্তব্ধ হয়ে যায়।শুকনো গলায় বলে,,,

-মেঘরে এটা নাবিল না।অন্য কেউ।

এশার কথায় আমায় গলা শুকিয়ে যায়।কাকে ভেজাতে গিয়ে কাকে ভেজালাম!এমনিতেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাগিংয়ের জন্য বিখ্যাত।যদি কোনো বড় ভাই থেকে থাকে তাহলে তো হচ্ছে!এশাকে নাহয় নাবিল ভাইয়া বাঁচাবে কিন্তু আমায়?আর যার সাথে ঘটনাটা ঘটেছে সে যদি রাগে ক্ষোপে আমার বড় ধরণের ক্ষতি করে দেয়!ভাবতেই আমার গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।বালতিটা ওখানে রেখেই দুজনে ভো দৌড় দিয়ে ক্লাসে চলে যাই।

ক্লাসে এমনিতে আমি প্রচুর বকবক করি।কিন্তু আজকে ঘটনার জন্য ভয়ে অনেকটা চুপষে গেছি।ফুল আমার ক্লাস। এই কয়েকটা দিনে ওর সাথে আমার বেশ ভালোই সম্পর্ক হয়েছে।আমায় এমন চুপচাপ থাকতে দেখে ও বলে,,,

-মেঘ তুই চুপচাপ!কিছু হয়েছে।

আমি মাথা নাড়িয়ে বলি যে কিছু হয়নি।এরই মধ্যে এক বড় ভাই ক্লাসে এসে আমার খোঁজ লাগান।আমি ভয়ে মাথা নীচু করে ব্রেঞ্চে শুয়ে পড়ি।

-এই তোমাদের ক্লাসে লাল কুর্তা পরা লম্বা চুলের বেণুনী করা কোনো মেয়ে আছে?

ভাইয়াটা বলে।ফুলের নজর তখন আমার দিকে।হা করে তাকিয়ে আছে মেয়েটা।ক্লাসের একটা ছেলে প্রশ্ন করে ভাইয়াটাকে,,,

-কেন কী হয়েছে ভাইয়া?
-দরকার মেয়েটাকে।
-ভাইয়া এই মেয়েটা?আমার পেছন বসে আছে।আপনার বর্ণনার সাথে মিলে যাচ্ছে।

বুশরা বলে ওঠে।আমি আস্তে করে সোজা হয়ে বসি।ভাইয়াটা আমার কাছে এসে আমায় দেখে।তেজি গলায় বলে,,,

-এইটাই হবে হয়তো।ওঠো।
-ক…ক..কেন ভাইয়া?
-উঠতে বলছি উঠো।

হুংকার দিয়ে বলে ভাইয়াটা।ধমক খেয়ে আমি উঠে দাঁড়াই।ভাইয়াটা শান্ত গলায় বলে,,,

-আসো আমার সাথে।

আমি আর কথা বাড়াই না।ভাইয়াটার পেছন পেছন যাই।ভাইয়াটা আমায় ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের রুম নাম্বার ১১১য় নিয়ে যায়।সব মনে রাখছি।আল্লাহ না করুক কোনো ক্ষতি করে দিলে এইগুলোই আমায় সাহায্য করবে।অনেক দিন ধরে বোঁধ হয় দরজা জানালা সব বন্ধ ছিলো।গ্যাস জমে কেমন একটা গন্ধ হয়েছে।হাত পা আমার ঠান্ডা হয়ে আসছে।ভাইয়াটা লাইট ফ্যান অন করে।ফ্যানের বাতাসে গ্যাস বাইরে বের হয়ে যায়।কিছুক্ষণ পর কয়েকটা ছেলে আসে।তাদের মধ্যে একজন কালো শার্ট পরা।শার্টটা ভেজা। টাওয়েল দিয়ে ভেজা চুল গুলো মুছছে।এটাই মেইবি আমাদের রঙ টার্গেট। আল্লাহ!এখন কি হবে।সে নিশ্চয়ই আমায় ছেড়ে কথা বলবে না।ছেলেটা এসে আমার সামনে রাখা একটা চেয়ারে বসে।আমি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছি।ছেলেটা শান্ত গলায় বলে,,

-এই মেয়ে আমার দিকে তাকাও।

আমি তাকাই না।সেই মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েই আছি।ছেলেটা এবার হুংকার দিয়ে ওঠে,,,

-এই মেয়ে তোমায় তাকাতে বলেছি না?

আমি কেঁপে উঠি।আসতে আসতে মাথা তুলে ছেলেটার দিকে তাকাই।তবে যাকে দেখতে পাই তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।

চলবে,,,ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here