আমার ধারণা ছিল মেয়েরা অতি নরম মনের হয়। এদের একটু প্রশংসা করলেই গলে পানি হয়ে যায়। আমার ধারণা যে ভুল ছিল সেটাই দ্রুতই প্রমাণ হয়ে গেল। আপনাদের আমার প্রেয়সীর নাম বলা হয়নি তাই না? ওর নামটা কিঞ্চিৎ অদ্ভূত। আফ্রিতা অর্থিতা। এরকম নাম ফেসবুকে হয় জানতাম, বাস্তবে প্রথমবার দেখেছি। এই ভয়ানক নামের মানবীর সাথে প্রথমবার কথা বলতে গিয়েই নারীদের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে অল্পবিস্তর ধারণা আমার হয়ে গেছে। সে গল্পটাই এখন বলতে যাচ্ছি।
তখন বর্ষাকাল। অহরহ বৃষ্টি হচ্ছে। সেদিন মাঝরাত থেকে তুমুল বৃষ্টি। ঢাকার রাস্তাঘাট সকালের আগেই জলের তলার ডুবোপথ হয়ে গেছে। গাড়িঘোড়া তেমন চলছে না৷ এদিকে ক্লাসটেস্ট পড়েছে সেদিনই। না গিয়ে উপায় নেই৷ আমি জিন্স গুটিয়ে, কাঁধে ব্যাগ ফেলে তার ওপর রেইনকোট জড়িয়ে বহু ঝক্কি পোহানোর পর কোনোমতে একটা লোকাল বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলতে ঝুলতে ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছালাম। গিয়ে দেখি পরীক্ষা পিছিয়েছে। স্যার নিজেই নাকি আসতে পারেননি। খবরটাও সবাইকে সকালেই দেয়া হয়েছে, আমিই দেখিনি। এসেছি জলকাদা মেখে, ওদিকে বাকিরা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। নিজের চুল ছিঁড়তে মন চাইল। ভেজা শরীর কেমন কুটকুট করছে। খিদে লেগেছে প্রচন্ড। মা ডুবো তেলে পরোটা ভাজছিল, বলেছিল খেয়ে আসতে। দেরি হবে বলে খাইনি। আফসোসের সীমা পরিসীমা রইল না আমার। এখন ফিরতে হলে আরেক দফা ভিজতে হবে। আজ ঠান্ডা না লেগেই যায় না।
ক্যান্টিনে গেলাম খেতে। গিয়েই মনের সব দুঃখ একেবারে বাষ্পের মতো নাই হয়ে গেল। দেখি আফ্রিতা বসে আছে। এই মেয়ে কেমন করে এই দুর্যোগের দিনে এলো? অবশ্য ভালো ছাত্রীদের কামাই করলে চলে না৷ ওর হাতে যথারীতি একটা মোটা ইংরেজি উপন্যাসের বই। গভীর মনোযোগ দিয়ে সেটা পড়ছে, মাঝে মাঝে কফির কাপে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে। অপূর্ব দৃশ্য। আমি কিছুক্ষণ হা হয়ে দেখলাম। তারপর চারটে গরম সিঙাড়া আর দুটো ভেজিটেবল রোল নিয়ে ওর টেবিলে গিয়েই বসলাম৷ একগাল হেসে পরিচিত হতে গেলাম, “হ্যালো। আমি মাসুদ রানা।”
আফ্রিতা প্রথমবার চোখ তুলে আমার দিকে চাইল। আমি তার টেবিলে বসেছি দেখে খানিকটা বিব্রত এবং বিরক্তও হলো। তারপর চশমাটা ওপরে তুলে বলল, “আমি আফ্রিতা।”
“তোমাকে চিনি। ফার্স্ট গার্ল।”
“কিন্তু আমি আপনাকে চিনতে পারছি না।”
“আরে আপনি করে বলছ কেন? আমরা সেইম ব্যাচ।”
আফ্রিতা ভুরু তুলে বলল, “আমি ভেবেছিলাম সিনিয়র। তো তুই নিশ্চয়ই এখন খাবি? আমি আবার কেউ খেতে থাকলে সামনে বসে পড়তে পারি না। আসছি।”
আমি ভ্যাবলার মতো বসে রইলাম। সে উঠে চলে গেল। ও আমাকে তুই করে বলবে সেটা ভাবতেও পারিনি। অবশ্য ধাক্কাটা সামলে নিলাম দ্রুত। সেইম ব্যাচের ছেলেমেয়েরা তুই তোকারি করবে এটাই স্বাভাবিক। কত তুই চোখের সামনে জানপাখি হয়ে যাচ্ছে! আমারটাও হবে।
আমি ধীরেসুস্থে খেয়ে নিলাম। খাওয়ার ফাঁকে আঁড়চোখে আফ্রিতাকে দেখছি। ও আবার বইয়ের ভেতর ডুবে গেছে। খাওয়া শেষে এক কাপ কফি নিয়ে আবার ওর সামনে গিয়ে বসলাম। এবার আমিও তুই তে নেমে এসে বললাম, “তুই খুব ভালো বক্তৃতা দিস। আমার দারুণ লাগে শুনতে।”
ও মুখ তুলে সামান্য হেসে আবার মুখ নামাল। বললাম, “তোর প্রিয় কয়েকটা বইয়ের নাম বল তো? বইটই পড়াই হচ্ছে না। ভাবছি পড়ব। তুই তো ভালো জানিস এসব বিষয়ে। এত ভালো স্টুডেন্ট তুই।”
এবার স্পষ্টত বিরক্ত দেখাল আফ্রিতাকে। সে সোজা হয়ে বসে বলল, “কী বই পড়বি? বাংলা না ইংরেজি?”
ওর রুদ্রমূর্তির সামনে খানিক ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, “দুটোই।”
“পাঁচটা বাংলাদেশী লেখকের নাম বল।”
মন হলো ভাইভা দিতে বসেছি। ভাইভার সময় যেমন সহজ জিনিসও ভুলে যাই এখনো তাই হচ্ছে। আমতা আমতা করে বললাম, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, আর……হুমায়ূন আহমেদ…আর…..”
আর কিচ্ছু মনে নেই। আফ্রিতা বলল, “লাইব্রেরিতে যাবি আজ। গিয়ে বিশটা লেখকের নাম মুখস্থ করে আসবি। মুখস্থ পড়া দিবি আমার কাছে, তারপর বইয়ের নাম বলব।”
বলে গটগট করে হেঁটে চলে গেল। আমি মুখ পানসে করে বসে রইলাম। এ তো একেবারেই হেডমাস্টার টাইপ মেয়ে৷ এই মেয়ের সাথে প্রেম করা কি আদৌ সম্ভব? ভাবতে ভাবতে আনমনা আমি পৌঁছে গেলাম লাইব্রেরি রুমে। নিজের অজান্তেই শেলফ ঘুরে লেখকের নাম খুঁজতে শুরু করলাম।
(এখন ভাবছি ছোট ছোট করে কয়েকটা পর্ব লিখব)
#একটি_জটিল_প্রেমের_গল্প
ভাগ-২
সুমাইয়া আমান নিতু