একটি জটিল প্রেমের গল্প পর্ব -০১

প্রেমে পড়া ভালো, কিন্তু এমন প্রেম যে নিজের কাছেই ‘বাদরের গলায় মুক্তোর মালা’ মনে হতে থাকে তেমনটা কোনোভাবেই কাম্য নয়৷ তবে মানুষের স্বভাবই হলো সহজ জীবন ছেড়ে জটিল জীবনের দিকে আকর্ষিত হওয়া, আমিও তাই হলাম। প্রেমে পড়াটাও আকষ্মিক পানিতে পড়ার মতো করেই হলো।

একদিন ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনে খেতে গেছি। ক্লাসের মধ্যে স্যার কী একটা পড়াতে গিয়ে উদাহরণ টানলেন গরম সিঙাড়ার। ওমনি আমার মন চলে গেল সদ্য ভাজা লালচে গরম সিঙাড়ার দিকে। আমাদের ক্যান্টিনে আবার স্পেশাল সস হয়৷ ঝাল টমেটো সসের ওপড় হালকা গুড়ো মরিচ ছিটিয়ে দেয়। ঝালে চোখ দিয়ে পানি গড়ায়, সেই ঝালের মজাও আলাদা। ভাবতে ভাবতে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ নজর গেল সামনের মেয়েটার দিকে। হাতে বই, চোখে বড় ফ্রেমের চশমা, চুলগুলো পনিটেইল করে বাঁধা, আকাশি রঙের একটা টপস পরেছে, গলায় সাদা ওড়নাটা এলোমেলোভাবে পেঁচিয়ে রাখা, হাতে একটা কলম দিয়ে কপালে এসে থাকা চুলগুলো পেঁচিয়ে যাচ্ছে, দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে আনমনা হয়ে কী যেন ভাবছে। সেদিন প্রথমবার উপলব্ধি করলাম এমন কিছুও পৃথিবীতে থাকতে পারে যেটা আমাকে খাওয়ার কথা ভুলিয়ে রাখবে। সত্যি বলছি, সেদিন কী খেয়েছি নিজেও বুঝিনি। আস্ত কাঁচামরিচ খেয়েও ঝাল লাগেনি। কী ভয়ানকভাবেই না প্রেমে পড়েছিলাম!

এ তো ছিল শুরুর কথা। এর পরের ঘটনা আরও ভয়াবহ। তার বৃত্তান্তই এখন লিখব। আগে বলে নেই, আমি মাসুদ রানা। সেই দুর্ধর্ষ এজেন্ট মাসুদ রানা নই, নেহায়েতই সাদামাটা মানুষ। গায়ের রঙ মাঝারি, উচ্চতা গড়পড়তা, ছাত্র হিসেবেও মধ্যম পর্যায়ের। আমার বিশেষত্ব একটাই, আমার চোখের মণির রঙ হালকা বাদামি। সবসময় অবশ্য সেটা বোঝাও যায় না। ছোটবেলায় সবাই বিড়াল চোখা বলে ক্ষেপাত। এই চোখ নিয়ে তাই আক্ষেপের শেষ ছিল না। কলেজে ওঠার পর এক মেয়ে নিজে থেকে প্রপোজ করেছিল আমার চোখ দেখে, এরপর থেকেই মনে হয় চোখদুটো আসলে সুন্দর। সেই মেয়ের অবশ্য বিয়ে হয়ে গেছে। একটা ছেলে আছে। গোলগাল ভীষণ ফর্সা ছেলেটার ছবিতে এখনো আমি মন্তব্য করি, ‘মাশাআল্লাহ।’

তো এই নামের বিড়ম্বনা কিন্তু আমাকে ছাড়েনি। ইউনিভার্সিটিতে ওঠার পর সিনিয়রদের কাছ থেকে বেশিরভাগ র‌্যাগ খেয়েছি নামের জন্য। যত কঠিন কাজ তাদের মাথায় আসত সব আমাকে করতে হতো। একবার বলেছিল শীতের রাতে মাঝ পুকুর থেকে শাপলা তুলে আনতে। তাও পেরেছিলাম, কিন্তু একবার গায়ে ঢোঁরা সাপ ছেড়ে দেয়ায় আর নিতে পারিনি, পড়ে গিয়েছিলাম দাঁতকপাটি লেগে। এরপর র‌্যাগের হাত থেকে অবশ্য বেঁচে গিয়েছি, কিন্তু স্মৃতিটা এখনো তাড়া করে বেড়ায়।

ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে যাচ্ছে? না না, আমি নিজের বর্ননা দিলাম। নইলে বুঝবেন কেমন করে কেন আমার প্রিয় মানুষটিকে মুক্তোর মালা বানিয়ে নিজে বাদর হচ্ছি?

আমার কাঙ্ক্ষিত প্রেমিকাটি পড়ে ইংরেজি সাহিত্যে। আমি দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা না হতে পারলেও সে দুর্ধর্ষ ছাত্রী বটে! প্রথম চারটা সেমিস্টারেই ফার্স্ট হয়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। কী ভালো বক্তৃতা দেয়! যে কোনো অনুষ্ঠানে তাকে ডাকা হয় কোনো নতুন বিষয়ে বক্তব্য রাখতে। এদিকে আমার মাইক হাতে নিলে পা কাঁপতে শুরু করে। সে ইংরেজি বলে ভাত খাওয়ার মতো সহজে, আর আমার এক বাক্য বলতে গলায় তিনবার আটকে যায়৷ পাশও করি টেনেটুনে। পড়ছি আইন নিয়ে। ইংরেজিতে ‘ল’। এক অক্ষরের সাবজেক্ট পড়তে গিয়ে জীবনের করুণ দশা হয়েছে দেখবার মতো। তাই এখন তেমন পড়িটড়ি না। পরীক্ষার আগের রাতে কমন প্রশ্নগুলো ঝালিয়ে গিয়ে যা পারি উগড়ে দেই, পাশ চলে আসে। তবে সেসব আর বেশিদিন চলল না৷ প্রেয়সীর টান আমাকে সবার আগে যেটা বানিয়ে দিল সেটা হলো ভালো ছাত্র।

(ইহা একটি ছোটগল্প। পরের অংশ যে কোনো সময় আসতে পারে)

#একটি_জটিল_প্রেমের_গল্প

সুমাইয়া আমান নিতু

**

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here