এক্সিডেন্টলি প্রেম পর্ব ২৬

#এক্সিডেন্টলি_প্রেম♥
#পার্ট-২৬♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥

দেখতে না দেখতেই কীভাবে যেনো পেড়িয়ে গেলো দু দুটো মাস। বর্ষার ঋতু বদলে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নেমেছে শরৎ! তবুও মাঝে মাঝেই মেঘের নিদারুণ কান্নায় মাতোয়ারা হয়ে উঠে শহর। গাছে-গাছে বৃষ্টির ফোটায় ভেজা পাতাগুলো ফিরে পায় নতুন করে সতেজতা। বুক ভরে এই হঠাৎ বৃষ্টির গন্ধ নিতেই বিষন্নতায় আজ আবারও খুব করে ভুগছে অন্বিতার মন। অনেক তো হলো, আর কতো অপেক্ষা? অপেক্ষার প্রহর বুঝি আর শেষ হবে না কখনোও?

অন্বিতা জানালার কোল ঘেঁষে দাঁড়ালো। তারিখ কতো হবে আজ? ছয় নাকি সাত? ঠিক মনে পড়ছে না তার। অতিরিক্ত চিন্তার ফলে আবার মেমোরি লস হলো না তো? অন্বিতা ঠোঁট উল্টালো। তপ্ত শ্বাস ফেলে দেয়ালের সাথে পেরেক ঠুকে টাঙানো ক্যালেন্ডারটার দিকে স্থির দৃষ্টি ফেললো। ৬ এ সেপ্টেম্বর! ওমা আজই তো নিশান্তদের পরীক্ষার শেষ দিন। এই দিনটার জন্যেই তো হাজারও ব্যাকুলতা ফেলে অপেক্ষায় কাটিয়েছে সে কতশত প্রহর। উদ্বীগ্ন চোখে চেয়েছিল গত হওয়া প্রতি সময়গুলোর। অন্বিতাদের সেমিস্টার ফাইনাল এক্সাম শেষ হয়েছে প্রায় ১ মাস হলো। এতোদিনে রেজাল্টও পাবলিশ হওয়া সাড়া তাদের। আশার তুলনায় অতিরিক্তই উন্নতি হয়েছে তার। ফেইল করে আদুভাই হবার মতো প্রিপারেশনও নিশান্তের ছায়ায় ঠাই পেয়ে সিজিপিএ ৩.৪৬ পাওয়া তো আর চারটিখানি কথা নয়। বাবলী-শিখাও খারাপ করে নি রেজাল্ট, যতোটা ভেবেছিল তার থেকে ঢেড় গুণ ভালো ফলাফল লাভে তারা দুজনও হয়েছিল হতবাক। সে কী দাপাদাপি তাদের! অন্বিতাকে পারলে যেনো কোলে উঠিয়ে ছুড়ে মেরে পুরো মহাকাশ ঘুরিতে আনতো তারা।

অন্বিতা ঝটপট চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। ঘড়িতে সময় দেখলো জলদি করে। এখন সময় ৪ টে বেজে ২৫ মিনিট। বিকেল গড়িয়ে এসেছে প্রায়। আকাশে হাল্কা হাল্কা মেঘের মেলা জমতে শুরু করেছে সবে। সূর্যের তেজ কমে ধূসর বর্ণ ধারণ করেছে প্রকৃতিটা। তবে কি আজ বর্ষণের ঝুম নেমে আসবে আবারও? প্রেমের জোয়ারে নিজের আর্দ্রতা ছড়িয়ে ভেজাবে কী তবে অন্বিতাকে?

______________________________

চকবাজার মোড়ের পাশে সেই চিরচেনা সরু গলিটায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে তিন বান্ধবী। যেখানে প্রথম দেখা হয়েছিলো নিশান্ত-অন্বিতার! সেদিন না কেউ কাউকে চিনত, আর না জানতো। উদ্ভট এক কারণের দরুন অনাকাঙ্ক্ষিত এক্সিডেন্টের সহিত মিলিত হতে হয়েছিল তাদের।

শিখা-বাবলীর চোখে-মুখে ছেয়ে আছে তাদের বিনিদ্র অস্থিরতা। এই পড়ন্ত বিকেলে এসেও শুনশান নীরবতায় দগ্ধ হয়ে চলেছে অন্বিতার মন। কখন ফিরবে নিশান্ত। সময় যে আসন্ন! এতোক্ষণে তো পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরে ঘুম দেওয়ার কথা নিশান্তের, অথচ এখনও ভার্সিটি থেকেই ফেরেনি সে। যার দরুন শিখা-বাবলীর মনে জমছে এক পশলা কালো মেঘ! অথচ অন্বিতার মনে ক্ষীণ আশাটা যেন সময়ের সাথে সাথে হয়ে চলেছে আরো তীব্রতর!

পশ্চিমাকাশে সূর্য যখন অস্তপ্রায় এমন সময় বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো শিখা-বাবলীর। প্রায় দেড় ঘন্টা যাবৎ একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ঝিম ধরে উঠেছে তাদের পা। অথচ অন্বিতা এখনোও আগের মতাই উদ্বীগ্ন চোখে চেয়ে আছে নিশান্তের ফেরার অপেক্ষায়। শিখা জিহ্ব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো। দ্বিধাভরা গলায় অন্বিতার কাঁধে হাত রেখে বলল,

—– অন্বি, এবার আমাদের বাড়ি ফেরা উচিৎ রে। নিশান্ত ভাইয়ার আসার কথা হলে এতোক্ষণে ঠিক চলে আসতো। এতো সময় লাগার কথা ছিলো না মোটেই। তুই বরং বাড়ি ফিরে যা রে। এভাবে আর কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবি বল? হয়তো ভাইয়া অন্য রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরেছে। তুই নাহয় বাড়ি গিয়েই………..

শিখার কথার মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো অন্বিতার হাত। ডান হাতের পাঁচ আঙুল মেলে শিখাকে থামিয়ে দিয়ে সে বলল,

—- তোরা চলে যা শিখা! আমাকে নিয়ে এতো চিন্তা করিস না। বাসায় হয়তো আংকেল-আন্টি চিন্তা করছে, অনেক্ষণ তো হলো, এবার যা। আমার বাড়ি ফেরার সময় হলে আমি ঠিকই চলে যাবো।

শিখা চুপ করে রইলো। এই মেয়েটাকে যে শত চেষ্টার পরও কিছুতেই রাজি করানো যাবে না ভেবেই বুক ভারী হয়ে এলো তার। পাশ থেকে উঁচু কন্ঠে বাবলী মুখ নিসৃত ধ্বনি দ্বারা মন্তব্য পোষণ করে বলল,

—– কিন্তু অন্বি, তুই শুধু শুধু এরকম পাগলামি করছিস কেন? যেখানে নিজের ফ্ল্যাটেই নিজের আশিককে পেয়ে যাবি, সেখানে অহেতুক পাওয়া না পাওয়ার ধাঁধায় জিম্মি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কী আদৌ কোনো মানে আছে?

—– মানে আছে বাবলী! তোরা বুঝবি না। এই জায়গাটা দেখছিস না? ঠিক এই জায়গাটিতেই আমাদের প্রথম দেখা, প্রথম আলাপন, প্রথম কথোপকথন! এই জায়গাটা হয়তো খুবই সাধারণ হতে পারে সবার কাছে বাট আমার কাছে তার মূল্য অপরিসীম! তোরা যা বাবলী প্লিজ! আমি সময় হলে ঠিক চলে যাবো। মাত্র ৫ মিনিটের পথ। কিচ্ছু হবে না আমার।

অন্বিতার কথায় চোখ-মুখ কুঁচকে একে-অপরের দিকে তাকালো শিখা-বাবলী। তাদের নীরবতা ভেদ করে চলেছে মাঝে মাঝে একটা-দুটো বাইক। থেমে থেমে মেঘে-মেঘে ঘর্ষণে চমকে উঠছে বিদ্যুৎ! বজ্রপাতের আশংকায় থমকে রয়েছে আকাশ। এমন সময় বাবলীর ফোনে কল এলো, ভাইব্রেশন মুড অন থাকার পরও টের পেল সে। ভয়ার্ত চোখে ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই কেঁপে উঠলো আত্মা। আজ পাত্রপক্ষের দেখতে আসার কথা তাকে। এইরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ দিনেও মেয়ে বাহিরে বাহিরে ঘুরে বেরোবে তা কোনো বাবা-মা ই চাইবে না কোনোকালেই। তবু নিরুপায় ছিলো বাবলী। হাজার হোক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেখানে কোনো উৎসাহ কিংবা পাশে থাকার মতো কাউকে খুব করে প্রয়োজন ছিলো, সেখানে বলার আগেই আগ বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো অন্বিতা। সেই ঋণ কি এতো সহজে ভোলা যায়? অন্বিতা কপাল কুঁচকে তাকালো। হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় ব্যাকুল হয়ে উঠলো মন। বাবলীর হাত চেপে ধরে থমথমে গলায় সে বলল,

—- বাবলী আজ না তোকে দেখতে আসার কথা, তুই এখানে কি করছিস?

বাবলী অসহায়ত্বে ভরা চোখে তাকালো। চোখের ইশারায় স্পষ্ট সত্যটা ভেসে উঠলেও হাসিতে প্রসারিত করলো ঠোঁট। অন্বিতা নিঃশব্দেই বুঝলো উত্তরটা। ভারী গলায় তৎক্ষণাৎ শিখাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

—– শিখা, বাবলীকে বাড়ি নিয়ে যা। এক্ষুনি মানে এক্ষুনি! আর এক সেকেন্ডও দেরি নিয়। যাহ!

শিখা অন্বিতার ধমকে কেঁপে উঠলো। বুকে হাত রেখে বাবলীর হাত টেনে ধরে বলল,

—– মোটু চল, সন্ধ্যে হয়ে আসছে প্রায়! ছেলেপক্ষের এতোক্ষণে চলে আসাই সাড়া হয়তো!

বাবলী ঠোঁট উল্টালো৷ অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাড়ি ফিরতে রওনা হতে হলো তাদের। শিখা-বাবলী চোখের আড়াল হয়েছে তার পাঁচ মিনিটের মাথায়ই আকাশে মেঘ ডেকে উঠলো অগত্যাই! সাথেসাথেই একফোঁটা-দুফোঁটা থেকে শুরু হলো ভারী বর্ষণ। মেঘের তীব্র কান্নায় কাকভেজা হলো শহর। পথচারীরা যে যার স্থান থেকে সরে দাঁড়ালো ভেজার ভয়ে। কেউ কেউ অটো কি’বা রিক্সা নিয়েই নিজেদের যথাসম্ভব ঢেকে রেখে রওনা হলো নিজ নিজ গন্তব্যে। শুধু সরে দাঁড়ালো না অন্বিতা। বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজে চুইয়ে চুইয়ে স্বচ্ছ জল গড়াতে লাগলো গা বেয়ে। পড়নের হাল্কা নীল পাড়ের শাড়িটা গায়ের সাথে লেপ্টে রইলো তার। লম্বা এলো চুলের বিনুনি বেয়ে অঝোরে ঝরতে লাগলো জলধারা।

আশাভরা উদ্বিগ্ন চোখের ছলছল চাহনিতে সেই চিরচেনা মুখশ্রীর ধরা মিলতেই ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো অন্বিতার। নিশান্তের পড়নে ভেজা সাদা শার্ট, চোখে স্বচ্ছ সাদা গ্লাসের সেই পাতলা ফ্রেমের চশমা, গালে লেপ্টে থাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মাথার সিল্কি ব্রাউন সেইডের চুলগুলো ভিজে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টির জোয়ার। ভ্রু কুঁচকানো স্নিগ্ধ সুষমায় ঘেরা চাহনি স্থির হয়ে আছে তার অন্বিতাতে। তাকে চোখের কোটরে আবদ্ধ করতেই থমকে এলো পা। অন্বিতা ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বৃষ্টির পানিতে ভেজা রাস্তায় ছমছমে শব্দের ধ্বনি তুলে নিশান্তের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নিশান্ত বৃষ্টির দরুন ঝাপসা হয়ে যাওয়া কাচের চশমাটা চোখ থেকে খুলে হাতে নিলো। প্রশ্নোক্ত গলায় অন্বিতাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করবে তার আগেই থেমে গেলো শ্বাস! অন্বিতার হঠাৎ ছোঁয়ায় বক্ষ জুড়ে বেয়ে গেলো শিহরণ। এভাবে হুট করে জড়িয়ে ধরায় হতভম্ব হয়ে বাকরুদ্ধই হতে হলো তাকে।

অন্বিতা শক্ত করে নিশান্তকে জড়িয়ে ধরে রইলো কিছুক্ষণ। দুজনের মাঝেই পিনপতন নীরবতা। কেউ প্রশান্তি অনুভবে মত্ত তো কেউ হতভম্বতায় ব্যস্ত! নিশান্তের উষ্ণ বুকে মাথা রেখেই চোখ বেয়ে দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো অন্বিতার। অঝোরে বৃষ্টি ঝরায় সেই দু-ফোঁটা নোনাজলের অস্তিত্ব ঠাওর করে ওঠা হলো না নিশান্তের। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে নিশান্তকে ছেড়ে দাঁড়ালো অন্বিতা। বৃষ্টিতে ভিজে চিপচিপে হয়ে গিয়েছে দুজনেই! শুনশান গলির নীরবতা ভেদ করে থেকে থেকে আর্তনাদ করে উঠছে মেঘ। সেই নীরবতার পর্দায় মোড়ানো অন্বিতার বুক চিরে বেড়িয়ে এলো তীক্ষ্ণ শ্বাস। নিশান্তের চোখেমুখে জমে আছে একরাশ প্রশ্নের ছড়াছড়ি, তবে সেই প্রশ্নগুলো বাকরুদ্ধতায় স্তব্ধ হয়েই রয়েছে আপাতত। অন্বিতা জিহ্ব দিয়ে ভেজা ঠোঁট টাকেই আবারও ভিজিয়ে নিলো। চোখের পলক ঝাপটে কাঁপাকাঁপা গলায় বলে উঠলো,

—– আ…আমি আপনাকে ভা..ভা..ভালোবাসি নিশান!

#চলবে_________💕

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here