এক বেরঙ চিলেকোঠায় পর্ব -২২+২৩+২৪

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-২২

-ডক্টর সুমন!

দোয়ার আস্তেধীরে করা শব্দদুটোর উচ্চারনে সুমন স্তব্ধ হয়ে রইলো। দোয়াকে এতোগুলো বছর পর দেখে ভুত দেখার মতো ঘটনা ঘটেছে যেনো ওর সাথে। আপাদমস্তক দেখে নিলো দোয়াকে ও। মলিন থ্রিপিস,বিনুনি,কাধে পাটের সাইডব্যাগ,পাতলা চপ্পল,তাকওয়াতুল দোয়ার এইরুপে যে সে অভ্যস্ত নয়। চরম অবিশ্বাসের স্বরে বলে উঠলো,

-দ্ দোয়া? তুমি?

তাজীন কপাল কুচকে তাকিয়ে রইলো দুজনের দিকে। কে ডক্টর সুমন? ওর সাথে দাড়ানো মানুষটা তো ডক্টর মুফতাহির। তবে দোয়া ওকে ডক্টর সুমন কেনো বললো? আর মুফতাহির দোয়ার নাম ধরে ডাকলো কেনো? তবে কি সে দোয়াকে চেনে? বিস্ময় বজায় রেখে তাজীন আগে সুমনকে বললো,

-তুমি চেনো দোয়াকে মুফতাহির?

সুমনের কপালের কার্নিশ বেয়ে ঘাম গরাচ্ছে। আর দোয়া শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে। যে অতীত থেকে গত চারবছর পালিয়ে বেরিয়েছে ও,তা আবারো এভাবে ওর জীবনে হানা দেবে,কল্পনাতেও ছিলো না ওর। তাজীন দোয়ার দিকে ফিরে বললো,

-দোয়া? তুই চিনিস মুফতাহিরকে? আর ওকে সুমন বলে ডাকছিস কেনো? ওর নাম মুফতাহির। ডক্টর সজল মুফতাহির।

তৌফিকা দ্বিতীয়বার নামটা বলায় দোয়ার হুশ ফিরলো। এই নামটা চেনা ওর। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না কোথায় শুনেছে ও নামটা। বললো,

-উ্ উনি…

সুমন দোয়ার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি স্থির রেখে বললো,

-আপনি তাকওয়াতুল দোয়া?

-হ্যাঁ। ও তাকওয়াতুল দোয়া। কেনো বলো তো মুফতাহির? তুমি আগে থেকেই চেনো ওকে?

-না! উনি চেনেন না আমাকে!

-কিন্তু…

-কোনো কিন্তু না তাজ! উনি আমাকে চেনেন না!

দোয়ার জবাবে সুমন কিছু বললো না। তাজীন ক্ষুদ্র একটা শ্বাস ছেড়ে বললো,

-ওকে ফাইন। চলো আগে বসি তিনজনে! তারপর কথা হবে না হয়? আমি…

তাজীনের কথা শেষ হবার আগেই সুমন বললো,

-তাজ? তোমার সাথে দরকার আছে আমার! ইটস্ আর্জেন্ট! চলো এখান থেকে! আমি…

তাজীন লাজুক লাজুকভাবে বিরবিরিয়ে বললো,

-এইযে মহাশয়,অতিকষ্টে আপনাকে এনেছি এখানে,দোয়ার সাথে দেখা করাবো বলে। নইলে আপনার সময় কোথায়? এখন এসেই যখন পরেছেন,এতো পালাই পালাই করছেন কেনো বলুনতো? তাছাড়া বিয়েটা এখনো হয়নি। এখনই এমন তাজ,তাজ করলে চলবে? দোয়া কি ভাববে?

তারপর গলা ঝেড়ে দোয়াকে বললো,

-দোয়া? চল বসি। এইযে? আপনিও আসুন!

সুমন দোয়াকে পাশ কাটিয়ে তাজীনের সাথে পা বাড়ালো। বিমুঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলো দোয়া। মা,ভাই বাদে ওর জীবনের গুরুত্বপুর্ন ব্যক্তিটা তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন মানুষ হিসেবে এ কাকে বেছেছে? তাজীন যে মনপ্রান দিয়ে সুমনকে ভালোবাসতে শুরু করেছে,তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই ওর। কিন্তু এই মানুষটা তো ওর ভালোবাসার যোগ্য নয়! এই মানুষটা তো একটা ঠকবাজ! একটা কার্লপ্রিট! এর সাথে তাজীনকে মানতে পারবে না ও।

কিন্তু ওরই বা করার কি আছে? সুমনের বিরুদ্ধে কোনো প্রমান নেই ওর কাছে। ও এখন কিছু বলতে গেলে,ওর পরিচয় নিয়েও কথা হবে এখানে। যেটা একদমই চায় না ও। সুমনের আসল রুপটা যখন তাজীন জানবে,ওর সমস্ত স্বপ্ন,আশা,আকাঙ্ক্ষা সব ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। কিন্তু তা বলে চুপ থাকতে পারে না ও। কোনোভাবেই তাজীনকে এর সাথে জরাতে দেওয়া যাবে না। তাতে ওর যতোবড় ক্ষতিই হোক না কেনো! একটা দীর্ঘশ্বাসে নিজেকে বোঝালো দোয়া। তাজীনরা বসে গেছে। দোয়াকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,

-কিরে দোয়া? আয়?

দোয়া ধ্যান ছেড়ে এগোলো। আজকে এই পরিস্থিতিকে পাশ কাটানোর সর্বদিক বন্ধ। সুমনের মুখোমুখি মাথা নিচু করে বসে গেলো ও। সুমন চুপচাপ তাকিয়ে ওর দিকে। তাজীন আস্তে করে বললো,

-মুফতাহির? কথা বলো ওর সাথে? শি ইজ ভেরি শাই। তুমি কথা না বলা শুরু করলে ও কথা বাড়াবে না কিন্তু!

সুমন তাজীনের দিকে তাকালো। দোয়া লাজুক,আগবাড়িয়ে কথা বলবে না,কথাগুলো শুনে আটকে রইলো। বারবার মনে হচ্ছে,একই নামের অন্য একটা মানুষের সামনে বসে ও। কিন্তু দোয়ার ব্যবহার,চোখ নামানো ইতস্ততবোধ,ওকে চিনতে পারা,সবটাই ওকে মনে করিয়ে দিচ্ছে,এই সেই তাকওয়াতুল দোয়া। সুমন বললো,

-আপনার পুরোনাম তাকওয়াতুল দোয়া?

দোয়া নিচদিক তাকিয়েই শান্ত গলায় বললো,

-সন্দেহ কেনো রাখছেন মিস্টার মুফতাহির? আপনার পুরোনাম কি ডক্টর সজল মুফতাহির নয়?

সুমন শক্ত চোখে তাকালো এবার দোয়ার দিকে। ওই সেই দোয়া,কোনো সন্দেহ নেই আর তাতে। ভেবেছিলো রওশন পরিবারের ঝামেলা চিরতরে মিটে গেছে। ওদের মুখোমুখি আর হতে হবে না ওকে। কিন্তু আজ এতোগুলো বছর পর সেই দোয়ার সামনেই নিজেকে লুকোনোর চেষ্টা করতে হবে ভাবতেই নিজের উপর চরম রাগ হচ্ছে ওর। জোরপুর্বক হেসে বললো,

-কে বলেছে আপনি লাজুক? লজ্জা পাচ্ছেন! দেখো তাজ,তোমার বান্ধবী কতো সুন্দর কথার জবাবে কথা ফেরত দিতে পারে। মনে হচ্ছে না? এক অন্য দোয়াকেই দেখছো তুমি?

তাজীন হেসে বললো,

-হ্যাঁ তাইতো? আজকে কিন্তু কিছু রেয়ার জিনিস দেখা মিললো আপনার জন্য। জেনারেলি দোয়া এভাবে কথা বলে না!

-অনেকসময় আমাদের চারপাশে এমন অনেক অনাকাক্ষিত ঘটনা ঘটে,যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। রাইট মিস তাকওয়াতুল দোয়া? আপনি কি কল্পনা করেছিলেন,আমার সাথে আপনার দেখা হবে?

দাতে দাত চেপে সুমনের দিকে তাকিয়ে রইলো দোয়া। সুমন আবারো বললো,

-আই থিংক সেটা কল্পনা না করলেও,এর ফলাফলটা ঠিক কল্পনা করতে পারছেন রাইট?

দোয়ার ভেতরটা ধক করে উঠলো। বিস্ফোরিত চোখে তাকালো ও সুমনের দিকে। কোনোভাবে সুমন ওদের বিষয়ে সবটা জেনে যায়নি তো?তাজীন কিঞ্চিত অবাক হয়ে বললো,

-মানে?

-মানে,এর ফল হিসেবে,তোমার আমার বিয়েতে ওনার উপস্থিতি কনফার্ম হলো তাইনা?

সুমনের কথায় তাজীন হাসলো। কিন্তু দোয়া নির্বাক। রাগে চোখ জলে ভরে উঠেছে ওর। বাকা হাসলো সুমন। মেনুকার্ডটা দোয়ার এগিয়ে দিয়ে বললো,

-অর্ডার প্লিজ? মিস তাকওয়াতুল দোয়া!

সুমনের কাছে বারবার নিজের পুরোনাম শুনে দোয়া নুইয়ে গেলো। দোয়ার উপস্থিতি যে সুমনের মোটেও ভালো লাগে নি,আর ওর খারাপ লাগার বিষয়গুলো সরিয়ে দিতে এতোটুকোও‌ ভাববে না ও,ওর কথায় তা স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে তা। একটা শুকনো ঢোক গিলে বললো,

-আ্ আমি এসবে অভ্যস্ত নই। আপনারা যেটা খাবেন,অর্ডার করতে পারেন।

সুমন চেয়ারে হেলান দিয়ে আরো আরাম করে বসলো। দোয়া অন্যদিক ফিরে আছে। তাজীন বললো,

-ওকে,আমিই অর্ডার করছি।

খাবার অর্ডার করলো তাজীন। দোয়া একপলকও আর তাকায়নি সুমনের দিকে।
এদিক ওদিক তাকিয়ে সামলেছে নিজেকে। ওর মাথায় নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। সুমন জেনে গেছে,দোয়া বেচে আছে। জেনে গেছে ওর সত্যিটা জানে,এমন কেউ বেচে আছে। যদিও কোনো প্রমান নেই ওর কাছে। কিন্তু তবুও কি ও চুপ থাকবে? এই নতুন নাম কেনো সুমনের? তাজকে ঠকাবে বলে? ও যতোদুর জানে সুমনের আসল রুপটা এখনো সবার অজানা। তবে কি তাজকে ঠকাবে বলেই এই অন্যনামে গা ঢাকা কেনো দিচ্ছে ও? সুমন খুব স্বাভাবিক ব্যবহার বজায় রাখলো পুরোটা সময়। কোনোমতে খাওয়া শেষ করে দোয়া উঠে দাড়িয়ে বললো,

-আমি এখন আসি।

তাজীন বললো,

-আরেকটু বসবি না?

-ন্ না তাজ। আজকে আসি। ভালো থেকো।

-কেনো? তা কেনো? সবে আড্ডা দেবো ভাবছি! পরিচিত হবো ভাবছি! আর আপনি পালিয়ে যাচ্ছেন?

সুমনের কথায় ঘর্মাক্ত হাত ওড়নায় আটকালো দোয়া। বললো,

-আজকে নয়। অ্ অন্যদিন।

-আমারো তীব্র ইচ্ছা রইলো,দ্বিতীয়বার দেখা করার।

দোয়া উঠে দাড়ালো। ভয় বাড়ছে ওর। ওর চোখমুখে দুশ্চিন্তা দেখে ওকে আর আটকালো না তাজীন। বিকেলে দোয়ার টিউশনি আছে,সেটা জানে ও। ওউ উঠে দাড়ালো। ওয়েটারকে ডেকে প্যাক করা খাবারটা ওর হাতে গুজে দিয়ে বললো,

-এগুলো আন্টি আর দিয়ানের।

দোয়া সুমনের দিকে তাকালো। পরিবারের কথা মনে পরায় ভয় আরো বেড়েছে ওর। হাটা লাগালো ও। তাজীন ইশারায় সুমনকে বুঝালো একটু আসছি। নিশ্চিন্তে স্বায় দিলো সুমন। ও জানে,দোয়ার মুখ দিয়ে ওর বিষয়ে আর কোনো কথা বেরোবে না। গেইটের কাছে এসে তাজীন ফিসফিসিয়ে বললো,

-কেমন লাগলো হবু জীজুকে?

উত্তর না দিয়েই বেরিয়ে এলো দোয়া। কাঠফাটা রোদে বড়রাস্তার ফুটপাত দিয়ে বিদ্ধস্তভাবে ধুকতে ধুকতে হাটা লাগালো ও। জলভরা চোখে আশেপাশে তাকালো একবার। সবাই যে যার মতো ব্যস্ত। অসহায় লাগছে ওর নিজেকে। চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছে না। হাতে প্যাক করা খাবারটা দেখে চোখ ফেটে জল গরিয়েই পরলো ওর এবার। সহ্য হলো না আর! মা,ভাইয়ের পর যে মানুষকে ও সবচেয়ে ভালোবেসেছে,এক মুখোশধারী বহুরুপীর জন্য সে যে ঠকে যেতে চলেছে। খুব বাজেভাবে ঠকানো হচ্ছে ওকে। দিশেহারার মতো এদিক ওদিক তাকালো দোয়া। তাজীনের ফিয়ন্সেই যে ওর জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ ভাবতেই বারবার আকাশ ভেঙে পরছে ওর মাথায়। কি করবে ও? যাই‌ করুক না কেনো,তার পরিনতি যে হবে হয় তাজীনের নষ্ট জীবন,নয় ওর পুরো পরিবারের জীবনশঙ্কা! কোনদিকে যাবে ও? কি করা উচিত ওর এখন?

অফিসের হিসাবগুলো দেখে চুল উল্টে ধরে বিছানায় বসে আছে আরাব। হিসাবে বেশ অনেকটাই গরমিল। বিশেষ করে ফার্মাকেমিক্যালস্ ব্রাঞ্চে। যেখানে সেটার সর্বাঙ্গীন দায়িত্বে ছিলো মুফতাহির নিজে। এতোগুলো এলোমেলো হিসাবের কোনো কারনই খুজে পাচ্ছে না ও। মুফতাহিরকে প্রশ্নতাক করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ওর নেই। তাই ঠিক করলো,কষ্ট করে হলেও সবটা নিজেই কিছুটা খুতিয়ে দেখবে না হয়! ল্যাপটপ কোলে নিয়ে সবে বসেছে এসবের উপরই কিছু কাজ করবে বলে,ফোনটা বেজে উঠলো ওর। বিরক্তি নিয়ে ফোনে তাকালো ঠিকই,কিন্তু নাম্বার দেখে খুশি হয়ে গেলো আরাব। ওটা অরুনাভ মুখার্জীর নাম্বার। ল্যাপটপ ছেড়ে হেসে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো ও। কল রিসিভ করে বললো,

-আদাব কাকাবাবু। কেমন আছেন? এতোদিন পর মনে পরলো আপনার চিলেকোঠার এই অতিথির কথা?

-আপনার সাথে আমার জরুরি কিছু কথা আছে মিস্টার আরাব। দেখা করতে চাই আপনার সাথে।

দোয়ার কন্ঠ শুনে থ‌মকে গেছে আরাব। ফোনটা কান থেকে না‌মিয়ে অবিশ্বাসের চোখে দু দন্ড সেটার দিকে তাকিয়ে রইলো ও। ওপাশ থেকে দোয়া আবারো বললো,

-হ্ হ্যালো? মিস্টার আরাব? শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো?

আরাব ফোনটা কানে তুলে মৃদ্যুস্বরে বললো,

-দোয়া?

-জ্বী। আমি দোয়া। আপনার সাথে আমার অনেক জরুরি কথা আছে ‌মিস্টার আরাব। প্লিজ কালকে একবার দেখা করতে পারবেন?

একহাতে বুকের বা পাশটা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে নিলো আরাব। আমি দোয়া,কথাটা ওর সারাদিনের ক্লান্তি গায়েব করে দিয়েছে। ঠাস করে বিছানায় শুয়ে পরলো ও। চোখ বন্ধ রেখেই বললো,

-কোথায় দেখা করবে?

-আ্ আপনি যেখানে বলবেন,সেখানেই। কিন্তু সেটা কালকেই। প্লিজ।

-জায়গার নাম টেক্সট করছি তোমাকে।

তৎক্ষনাৎ ফোন কেটে দিলো দোয়া। ডক্টর সজল মুফতাহির নামটায় আরাব জড়িত। সুমনের আসল পরিচয়ের ঘৃন্য রুপটার প্রমান নেই ওর কাছে। কিন্তু এই ভুল পরিচয়টা প্রমান তো ও দিতেই পারে। আর সেটার জন্য মুফতাহির নামের লোকটাকে তাজীনের সামনে আনতে হবে ওকে। বাড়ি ফিরে খুব কষ্টে মনে করেছে ও এই নাম কোথায় শুনেছিলো। হ্যাঁ,এটা আরাবের কাছে শুনেছিলো ও। আরাবের দেওয়া কাগজটা দেখে আরো নিশ্চিত হয়ে যায় ও। পরে ওর সাথে যা হয়,দেখা যাবে। আগে তাজীনের জীবন থেকে সুমনকে সরিয়ে দেবে ও। যেকোনো উপায়ে। আর তাতে যদি আরাবের মুখাপেক্ষী হতে হয় ওকে,তাই হবে ও! দ্বিতীয়বার ভাবার দরকার নেই কোনো!

কল কেটে গেলে ফোন বুকে নিয়ে দুহাতে জরিয়ে রাখা ভানে শুয়ে রইলো আরাব। ভাবতেই খুশিখুশি লাগছে ওর। পরপরই মনে পরলো,কি এমন জরুরি কথা? যার জন্য দোয়া ওকে ফোন করলো? ওকে ফোন করার মতো কি ঘটেছে দোয়ার জীবনে? উঠে বসলো আরাব। ব্যালকনিতে গিয়ে বাইরের রাস্তার নানা আলোতে চোখ আটকালো ও। এবার চিন্তা হচ্ছে,বড্ড চিন্তা হচ্ছে ওর দোয়ার জন্য!
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-২৩

-বায়োমেডির বিশিষ্ট সাইন্টিস্ট ডক্টর সাফাত রওশনের মেয়ে তাকওয়াতুল দোয়ার আজ এ কি দশা? ভাগ্য কতোটাই না নির্মম! রাজকীয় রওশন প্লাজার রাজকন্যা আজ মা-ভাইকে নিয়ে কিনা তার ঠাই হয়েছে এই বেরঙ চিলেকোঠায়?

সুমনের গলার আওয়াজ শুনে ধরফরিয়ে পাশ ফিরলো দোয়া। সত্যিই সুমন এসেছে। রেলিং ধরে ওর পাশেই দাড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে। তাজীনের কাছ থেকে ওর ঠিকানাটা নেওয়া,সুমনের জন্য কঠিন কিছু ছিলো না এটা দোয়া জানতো। কিন্তু তাকে ভেতরে আসতে দিলো কে? ওর চোখ পরলো পেছনেই কেচিগেট লাগাতে থাকা সালমা বেগমের উপর। বেশ বুঝলো,ওর মা ই নিয়ে এসেছে সুমনকে। সুমন ওর দিক ফিরে বললো,

-সারপ্রাইজ!

দাতে দাত চেপে জলভরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো দোয়া। সালমা বেগম এগিয়ে এসে বললেন,

-দোয়া? সুমনের জন্য কিছু….

-হ্যাঁ,চা বানিয়ে আনো তুমি।

সালমা বেগম কিছু বললেন না। নিরবে সরে আসলেন ওখান থেকে। অন্যকেউ হলে দোয়া নিজেই আতিথেয়তা দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পরতো। কিন্তু আজ এতোদিন পর সুমনের সাথে দেখা,বলুকনা কিছুক্ষন একান্তে কথা। সবজিবাজারে ওনাকে দেখার পর সুমন যে চিনতে পেরেছে ওনাকে,এটাই অনেক। যখন এই ছেলেটা ওদের পরিস্থিতি মেনে নিয়েছে,বাড়িতে এনে এটুকো আতিথেয়তা না দেখালে ওকে অপমান করা হতো। তাই সুমনকে নিয়ে এসেছেন উনি। সালমা বেগম চলে যেতেই সুমন দোয়াকে বললো,

-কেমন আছো দোয়া?

-আপনি এখানে কেনো?

-ওমা। দেখবো না,আমার গুরুর আকস্মিক মৃত্যুর পর তার পরিবার ঠিক কেমন আছে? কোন হালে আছে?

-তাছাড়া আমার কাছে তোমার পরিচয়টা তো শুধুমাত্র রওশন স্যারের মেয়ে হিসেবে নয় তাইনা দোয়া? স্যার বেচে থাকলে এতোদিনে আমাদের…

-স্টপ ইট ডক্টর সুমন!

-কেনো? কেনো থামবো দোয়া? মিথ্যে বললাম? ভুল বললাম কিছু?

দোয়ার চোখ থেকে টুপটাপ দু ফোটা জল বেরিয়ে এলো। কড়া গলায় বললো,

-আপনি জানেন আমি কোনোদিনও সে চোখে দেখিনি আপনাকে!

সুমন তাচ্ছিল্যে হাসলো। বললো,

-হ্যাঁ হ্যাঁ জানি! তুমি ভালোবাসতে না আমাকে! তবুও তোমার বাবা তোমার জীবনসঙ্গী হিসেবে আমাকেই চুজ করতো। অস্বীকার করতে পারো এটা?

দোয়া কিছুই বললো না। রাগে গা জ্বলছে ওর। কিছু বলতেও পারছে না শুধু এ কারনে,সুমনের আসল রুপটা যে ও জানে,সেটা সুমনকে বুঝতে দেবে না বলে। কোনো প্রমান নেই ওর কাছে এখন। তবে যদি একবার সুমন বুঝে যায়,দোয়া ওর সত্যিটা জানে,কতোটা হিংস্র হতে পারে,তার ধারনা আছে ওর। এই জঘন্য মানুষটাকে ওর বাবা এতোটা বিশ্বাস কেনো,কিভাবে করেছিলো,ভাবতেই আরো কান্না পাচ্ছে ওর। একটা শুকনো ঢোক গিলে বললো,

-তাজীনকে ঠকাচ্ছেন কেনো?

ভ্রুকুচকে তাকালো সুমন। পরপরই বুঝলো কি বুঝাতে চেয়েছে দোয়া। দোয়া আবারো বললো,

-নিজের পরিচয় কেনো লুকাচ্ছেন ডক্টর সুমন? কি এমন কারন,যার জন্য আপনার আসল নাম তাজীনকে বলেননি? আর বেছে বেছে ডক্টর সজল মুফতাহিরের নামই কেনো ব্যবহার করছেন ওর সামনে? কেনো?

….

-শুধু ভুল নামে থেমে থাকেননি আপনি। নিজেকে লুকোতে তাজীনের কাছে এমন ছবি দিয়েছিলেন,যাতে আপনাকে চিনতে যে কারো সময় লেগে যায়। আফটার অল,সাড়ে চার বছর পেরিয়ে গেছে। তাইনা ডক্টর সুমন?

সুমন শক্তচোখে তাকালো দোয়ার দিকে। ঠান্ডা গলায় বললো,

-আমার যা খুশি,আমি তাই করবো! দ্যাটস্ নান অফ ইউর বিজনেস।

দোয়া এবার চেচিয়ে বলে উঠলো,

-ইটস্ টোটালি অফ মাই বিজনেস! শি ইজ মাই বেস্টফ্রেন্ড! আই ক্যান ডু ইচ এন্ড এভ্রিথিং ফর হার! এন্ড ডোন্ট ইউ‌ ডেয়ার টু মেক হার ক্রাই ডক্টর সুমন! ডোন্ট ইউ ডেয়ার!

দোয়ার উচু গলা শুনে কিছুক্ষন বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো সুমন। মেয়েটা তাজীনের জন্য বেশ অনেকটাই সেন্সিটিভ। কিন্তু ওর উপর রাগের কারনগুলো শুধুই তাজীন কি না তা দেখতেই‌ এখানে এসেছে ও। সুমন বললো,

-তা আমার পরিচয় নিয়ে এতোটা চিন্তিত? নিজের পুরো পরিচয়টা দাওনি কেনো তাজীনকে?

-টেল মি ওয়ান থিং দোয়া? এখানে কেউই কি জানে তোমার পুরো পরিচয়?

….

-চুপ করে গেলে যে? একচুয়ালি চুপ করে থাকা,লুকোনোটাই উচিত তোমার। কাউকে বলার মতো পরিচয়টা কি আদৌও আছে তোমার? আই ডোন্ট থিংক সো!

দোয়া গুটিয়ে গেলো। চুপচাপ মাথা নিচু করে রইলো। সুমন তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে থেকে দুপা এগোলো ওর দিকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,

-কিভাবে বলবে দোয়া? কিভাবে বলবে সবাইকে তোমার পুরো পরিচয়? কিভাবে বলবে তুমিই সেই সাফাত রওশনের মেয়ে,যার ফর্মুলায় বানানো এন্টিডোড আট আটটে তরতরে জীবন কেড়ে নিয়েছিলো। তার একটা ভুল এক্সপেরিমেন্টের ফল হিসেবে জীবন দিতে হয়েছিলো আটটে নিস্পাপ শিশুকে। যার ফর্মুলা বায়োমেডির মতো রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নামে কালি লেপে লেপে দিয়েছিলো। যার রিসার্চ ওই আটটে বাচ্চা…

-থামুন ডক্টর সুমন! প্লিজ থামুন! আর বলবেন না প্লিজ! দয়া করুন আমাকে! দয়া করুন!

ফুপিয়ে কেদে দিলো দোয়া। সহ্য হচ্ছিলো না ওর বাবার বিরুদ্ধে এতোবড় তিক্ত অপবাদগুলো! এতোগুলো দিন পালিয়ে বেরিয়েছে এ সবকিছু থেকে। আবার গুমড়ে গুমড়ে মরেছে বাবার উপর দেওয়া এই অপবাদ মেটাতে পারিনি বলে। তার নাম আসলে আজও লোকে ঘৃনায় ছি ছি করে,অবজ্ঞা করে। সেটা যে সহ্য হয় না দোয়ার। সুমন সরে দাড়িয়ে বললো,

-ভুল কিছু বললাম দোয়া?

-চলে যান এখান থেকে।

-সুমন সবেই তো এলো। এখনই চলে কেনো যাবে ও দোয়া?

মায়ের গলা শুনে চোখের জল মুছে দাতে দাত চেপে দাড়ালো দোয়া। ওড়না মুঠো করে রেখেছে দু হাতে। সালমা বেগম এসে আগে দোয়ার চোখমুখ পর্যবেক্ষন করলেন। পুরোনো হারিয়ে যাওয়া কিছু হঠাৎই পেয়ে গেলে খুশির কান্না তো বইবেই,অভিমানে ফিরিয়ে তো দেবেই,এমনটা ভেবে মেয়েকে আর কিছু বললেন না উনি। সুমন বললো,

-না আন্টি। আজ আসি। আজকে আর দেরি করবো না।

-তা কেনো সুমন? এতোদিন পর…

-ডক্টর সুমনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে মা।

স্তব্ধ হয়ে গেলেন সালমা বেগম। সুমন মুচকি হাসলো। মায়ের ভ্রম ভাঙাতে সোজা কথা বলে দিলো দোয়া,বুঝতে বাকি রইলো না সুমনের। ক্ষুদ্রশ্বাস ছাড়লো দোয়া। বাবার মতো ওর মাও যে মানুষটাকে এতো ভালো ভেবে আপন করে নিতে উদ্যত,অঙ্কুরেই সেই পথ আগলে দাড়ানোটা উচিত মনে হয়েছে ওর। তাছাড়াও,সুমনকে নিয়ে ওর মায়ের ভাবনার মতো ভাবনা কোনোদিনই ছিলো না ওর। এখন ওর আসল রুপটা জেনেশুনে তো আরও নয়! এমনকি তাজীনের সাথেও কোনো অন্যায় হতে দেবে না ও! যা কিছু হয়ে যাক না কেনো! সালমা বেগম বললেন,

-ত্ তোমার বিয়ে সুমন?

-জ্বী আন্টি। সামনের মাসেই। শিল্পপতি জাফর আহমেদের একমাত্র মেয়ে,তাজীন আহমেদের সাথে।

তাজীনের নাম দোয়ার কাছে শুনেছিলেন সালমা বেগম। বুঝলেন,তারমানে ওখান থেকেই সুমন দোয়াকে চিনেছে। মলিন হাসলেন উনি। বললেন,

-দোয়া রইলো বাবা। সুখী হও।

-জ্বী ধন্যবাদ।

-দোয়া? সুমনকে সদর দরজায় এগিয়ে দিয়ে আয়?

দোয়া মাথা নাড়লো। সালমা বেগম চলে আসলেন ওখান থেকে। সুমন নিশ্চিন্ত আওয়াজে বললো,

-শোনো দোয়া,যেমন আছো,তেমনই থাকো। তাজীন আর আমার মাঝে এসো না! তোমার বান্ধবী বেশ অনেকটাই জরিয়ে গেছে আমার সাথে। ভালোবাসে আমাকে। তাই আমার পরিচয় ঠিকভুল বোঝাতে গিয়ে ওর মনটা ভেঙে দিও না। তাছাড়া তাতে তোমার পরিচয়টাও যে আর লুকোতে পারবে না সে দিকটা ভেবে রেখো। ঘৃনায় মুখ ফিরিয়ে নেবে সবাই তোমার থেকে। যখন জানবে,তোমার বাবা এতোবড় একজন কুখ্যাত ব্যক্তি। হি ওয়াজ আ মার্ডারার! একজন খুনি!

হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো সুমন। দোয়া পথর হয়ে দাড়িয়ে রইলো। শুধুমাত্র ভুল পরিচয়ে তাজীনকে ঠকাচ্ছে,এমনটা হলেই সুমনকে ছেড়ে দিতো না ও। উপরন্তু সুমনের সব কুকীর্তির হিসেব আছে ওর কাছে। ওর মতো লোকের সাথে তাজীনকে আর জড়াতে দেবে না ও। কিছুতেই না। তাতে যদি নিজের অন্ধকার অতীতের মুখোমুখি হতে হয়,তাতেও রাজি ও। শক্তহাতে চোখ মুছে, নিজেকে বুঝিয়ে পা বাড়ালো দোয়া। উদ্দেশ্য,আরাবের সাথে দেখা করা।
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-২৪

তীব্র গতিতে বাইক চালাচ্ছে আরাব। কাল পুরোটা রাত ঘুম হয়নি ওর। দোয়ার ফোনকলের পর ঠিক কতোটা অস্থিরতায় ওর প্রতিটা মুহুর্ত কেটেছে তা ওই‌ জানে। দেখা করার জায়গাটা আর সময়টা ও দোয়ার সুবিধামতো ভেবেই বলেছিলো। কিন্তু পরপরই প্রচন্ড আফসোস করেছে। দোয়াকেআরো আগে‌‌ আসতে‌ বলা উচিত ছিলো ওর। সকালবেলা বায়োমেডি থেকে কল এসেছিলো। খুব জরুরি বিষয় এমনটাই বলছিলো নিরব। আরাব শোনেনি। রেডি হয়ে সোজা বাইক ছুটিয়েছে,দোয়ার সাথে দেখা করবে বলে। জায়গাটায় পৌছে বাইক পার্ক করে অস্থিরচিত্ত্বে দোয়াকে খুজতে লাগলো আরাব।

রাস্তার পাশেই এক কৃত্রিম লেইক। পুকুরের পাড়বাধানো ঘাটের মতোই সিড়ি। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসলে উপরে বটতলার ছায়া। বটগাছের নিচেও বসার জায়গা বাধানো। ওখানে দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে খেলছে। পাশেই এক কাপল ঝালমুড়ি খাচ্ছে,হাসছে,বাচ্চাগুলোর সাথে কথা বলছে। বোঝাই যাচ্ছে,ওরাই বাচ্চাগুলোর মা বাবা। এপাশে আরো একটা কাপল আছে। দুজনেই মাস্কপরিহিত কলেজড্রেসে। সিড়িতে বসে দুপলক জুটিদুটোকে দেখে নিলো দোয়া। একেবারেই পাশাপাশি,তবুও কতো বিচিত্রতা। একটা শ্বাস নিয়ে মনেমনে কথা গোছাতে লাগলো ও। আজ ওকে বলতে হবে। সবদিক সামলে,গুছিয়ে কথা বলতে হবে। আরাবকে আজ বলার সুযোগ দেওয়া যাবে না! কোনোমতেই না!

দোয়াকে দেখে লাফানোর ভঙিমায় দৌড় লাগালো আরাব। একেবারে ওর সামনের নিচু সিড়িটায় হাটু গেরে বসে গিয়ে বললো,

-কেমন আছো দোয়া?

আরাবের আকস্মিক আগমনে দোয়া চমকে গেছে ভালোমতোই। কিন্তু ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আর চমকে ওঠা চাওনি স্থবির রাখতে পারলো না। ওই‌ চোখজোড়াতে আকুতি,ও কেমন আছে,তা জানার তীব্র ব্যাকুলতা। থেমে রইলো দোয়া বেশ অনেকক্ষন। আরাব বললো,

-কি হলো দোয়া? বললে না? কেমন আছো?

ধ্যান ভাঙলো দোয়ার। নিজেকে সামলে তৎক্ষনাৎ উঠে দাড়ালো ও। একটা শুকনো ঢোক গিলে,জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে ওড়না আঙুলে পেচাতে লাগলো। হুট করে ওর মনে এক অন্য ভয় ঘুকে গেছে। সেটা আরাবকে নিয়ে। যে যে কথা আরাবকে বলবে বলে এখানে এসেছে ও,সেগুলো আরাবকে বলা কি ঠিক হবে? সুমনের মতো একজন মানুষের সাথে আরাবকে কোনোভাবে যুক্ত করা কি ঠিক হবে? এতে যদি আরাবের কোনো ক্ষতি হয়ে যায়?
না না! আরাবের কোনো ক্ষতি হবে কেনো?‌ ও তো আরাবকে কিছু করতে বলবে না! যা করার ও‌ নিজেই করবে! আরাবকে এসবে জড়াবে না ও। মনেমনে হিসাবটা আতো একবার কষে নিলো দোয়া। আরাব একদম ওর সামনে এসে দাড়িয়ে বললো,

-নিঃসংকোচে বলো দোয়া। কি হয়েছে?

-আমি আছি দোয়া। বলো?

দোয়া চোখ বন্ধ করে একটা জোরে শ্বাস ছাড়লো। এই আমি আছি কথাটায় কতো‌‌না স্বস্তি! সে আছে! চোখ মেলে‌ বললো,

-আমার কিছু দরকারী কথা বলার আছে আপনাকে।

-হ্যাঁ,সেটাই‌ তো‌ শুনতে এসেছি! বলো?

-হ্যাঁ বলবো আপনাকে। কিন্তু তার আগে আমার একটা শর্ত আছে।

ভ্রু কুচকে তাকালো আরাব। মেয়েটা এতো অচেনা কেনো? নিজে থেকে ডেকেছে,তবুও এতোটা গুটানো কেনো? এতো সীমাবদ্ধতা কিসের? পরপরই মনে পরলো,ও দোয়া! সেই দোয়া,যার আত্মসম্মানবোধে ওর গর্ব হয়। এমন কাউকে ভালোবাসে ও,যার সামনে ভালোবাসি বলার আগে লুকিয়ে চুরিয়ে একটার পর একটা ভালোবাসার প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছে ও। মুচকি হেসে আরেকপা দোয়ার দিকে এগোলো আরাব। মাথা নিচু করে বললো,

-সবসময়,তোমার সবরকম শর্ত সমর্থিত দোয়া।

দোয়া নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। আরাব মাথা তুলে ওকে চোখ মেরে বললো,

-বেশি ফিল্মি হয়ে গেলো?

নিজের উপর প্রচন্ডরকমের রাগ হলো দোয়ার। কি জন্য এসেছিলো,আর এই লোকটা কি কি অদ্ভুত ব্যবহারে দুর্বল করে দিচ্ছে ওকে। আর ওউ সব ভুলে কেনো গা ভাসাচ্ছে তাতে? আরাব মুচকি হাসছিলো। দোয়া চড়া গলায় বললো

-আমি আপনাকে যা বলবো,তার বিপরীতে আপনি আমাকে কোনো প্রশ্ন করতে পারবেন না!

-ওকে ফাইন। প্রশ্ন করবো না। তুমি বলো।

একদমই স্বাভাবিক গলায় বললো আরাব। দোয়া বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। মানুষটা কিসের তৈরী,মাঝেমধ্যে এই কথাটা বড্ড ভাবায় ওকে। দোয়া ব্যাগ থেকে আরাবের সেই কাগজটা বের করে বললো,

-এ্ এই ডক্টর সজল মুফতাহির আপনার বোনের বর?

-হ্যাঁ।

দোয়া থামলো। আরাবের কেনো কথাটায় প্রশ্ন আসা করেছিলো ও। ওকে অবাক করিয়ে দিয়ে আরাব বললো,

-দিয়ানকে নিয়ে যখনতখন যেতেই পারো।

-বিষয়টা দিয়ান না।

মুচকি হাসলো আরাব। কেনো প্রশ্ন না করেও বেশ ভালোমতোই বুঝে গেলো,দিয়ানকে নিয়ে দোয়া মুফতাহিরের খোজ করছে না। দোয়া বললো,

-ওনার নিউ এইড হসপিটাল?

-হ্যাঁ।

খানিকটা সময় চুপ করে রইলো দোয়া। মাথা নিচু রেখে আস্তে করে বললো,

-বায়োমেডির ডক্টর সুমনকে চেনেন?

আরাব বিস্ফোরিত চোখে তাকালো দোয়ার দিকে হাত মুঠো করে পেছন ফিরে দাড়ালো ও এবার। এতোক্ষন দোয়ার জটিলতার মাঝেও ওকে স্বাভাবিক করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছিলো ও। কিন্তু এবার ওর সমস্ত স্বাভাবিকতায় জটিলতা এনে দিয়েছে দোয়া। নিজেকে সামলে জোরপুর্বক হাসি টেনে দোয়ার দিকে ফিরলো ও। দোয়া তখনো মাথা নিচু করেই দাড়িয়ে। আরাব বললো,

-না তো! চিনিনা! বাট ইফ ইউ‌ ওয়ান্ট,এনকুয়েরি করতে আমার কোনো সমস্যা নেই!

দোয়া মাথা তুলে তাকালো আরাবের দিকে। ওর চেহারায় আশ্বাস! হঠাই অনেকটা সাহস সঞ্চার হলো যেনো ওর মাঝে। বলে উঠলো,

-এই ডক্টর সুমন আপনার বোনজামাইয়ের নাম ব্যবহার করে মানুষজনকে ঠকাচ্ছে মিস্টার আরাব!

আরাবের চোখেমুখে বিস্ময়,প্রশ্নের ঢল। কিন্তয়ওু দোয়ার শর্তের জন্য কিছুই বলছে না। বুঝলো সবটাই দোয়া। বললো,

-এই ডক্টর সুমন আমার বান্ধবী তাজীনকে বলেছে,সে নাকি ডক্টর সজল মুফতাহির। সে নাকি নিউ এইড হসপিটালের হার্টসার্জন! এই পরিচয়ে ওদের বিয়ে অবদি ঠিক হয়ে গেছে মিস্টার আরাব!

মুখ যেনো তালাবন্ধ করে রেখেছে আরাব। এই মুহুর্তে শতশত প্রশ্ন ওর ভেতরে তোলপাড় চালাচ্ছে। সুমন এখানে? কবে? কিভাবে? মুফতাহিরকে না দেখেও দোয়া কি করে এতোকিছু ভেবে নিলো? তারমানে স্পষ্ট,সুমনকে আগে থেকেই চেনে ও। কিন্তু কিভাবে? সুমনই বা কেনো তাজীন নামের কারো সাথে জরাচ্ছে? আর তো আর,এসবে মুফতাহিরের নাম কেনো আসছে? হতবিহব্বল চেহারা সামলে দোয়ার দিকে তাকালো ও। ও মেয়েটাও‌ চিন্তায় কপালে ভাজ ফেলে দাড়িয়ে। পুর্বাকাশের সুর্য মাথার উপর আসায় শুধু বটের পাতার ছায়াটা দিয়ে ঢেকে আছে সুর্যকিরনের কিয়দাংশ। বাকি সবটুকো উপচে পরেছে দোয়ার চেহারায়। আরাব শান্ত গলায় বললো,

-তাজীনের সাথে কোনো ফ্রডের বিয়ে হবে না দোয়া। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।

-ম্ মানে? আপনি…আপনি কি করবেন মিস্টার আরাব? ডক্টর সুমন…ডক্টর সুমন কিন্তু খুবই…

-ডেন্জারাস পার্সোন!

-মানে?

-কিছুনা। বাংলা ফিল্মের ডায়লগ ছুড়লাম। এনিওয়েজ,তুমি নিশ্চিন্তে বাড়ি যাও। বিয়েটা হবে না।

-কিন্তু মিস্টার আরাব…

-ভরসা করে ডেকেছো। একটু ভরসা রাখো?

কাদার তীব্র ইচ্ছা ছিলো দোয়ার। কিন্তু তবুও শক্ত রাখলো নিজেকে। কাউকেই ভরসা করতে পারেনা ও। সবাই এক। সবাই!বললো,

-কি করবেন আপনি?

আরাব তাচ্ছিল্যে হেসে বললো,

-নিজের বেলায় বলে দিলে প্রশ্ন করো না। আর আমাকে একের পর এক প্রশ্ন বিদ্ধ করছো। যাইহোক,আমি কিছুই করবো না। আমি জানি আমি কিছু করতে চাইলেও তা গ্রহন করবে না তুমি। তাই তোমার ফেভারটাই আমি গ্রহন করলাম। আমার বোনজামাইয়ের নাম কেউ‌ বাজেভাবে ব্যবহার করছে,তা জানানোর জন্য থ্যাংকস্! আপাতত আমি মুফতাহির ভাইয়াকে দিয়ে ওই ফ্রডের বিরুদ্ধে থানায় জিডি করাই,তুমি না হয় কপিটা তোমার বান্ধবী আর তার ফ্যামিলিকে দেখিয়ে দিয়ো। ব্যস্! শাদি ক্যান্সেল!

দোয়া‌ শ্বাস ফেললো। খুব সরল তবে কার্যকরি কিছু ভেবেছে আরাব। এমনটা হলে,খুব ভালোভাবেই সবটা মিটে যাবে। আরাবের দিকে দু দন্ড তাকিয়ে রইলো ও। আরাব ঠোট টিপে হেসে বললো,

-এমনটাই করতে যাচ্ছি। বেশি কিছু না! পাক্কা!

-ধন্যবাদ।

-ধন্যবাদ তো তোমার প্রাপ্য দোয়া। আমার বোনের বরের মানসম্মানটা তো তোমার জন্যেই বাচবে বলো?

-জ্ জ্বী। আপনি তবে…

-হ্যাঁ হ্যাঁ,জিডির কপি পৌছে যাবে তোমার কাছে। ডোন্ট ওয়ারি।

-জ্বী। আ্ আসছি।

-আবার আসবে?

দোয়ার বড়বড় চাওনি দেখে আরাব আরো বড়সর হাসি দিয়ে বললো,

-এসো।

দোয়া পা বাড়ালো। কেমন যেনো ভয় হচ্ছে ওর। যতোটা সহজ সবটা দেখাচ্ছে,আদৌও কি ততটা সহজ সবটা? আরাব পেছন থেকে আবারো বললো,

-আমার জ্যাকেটটা ফেরত দিলে না দোয়া?

একপলক পেছন ফিরে তাকলো দোয়া আরাবের দিকে। পকেটে হাত গুজে হাসছে ও। ওকে যে সবেমাত্র প্রায় অচেনাই বলা চলে এমন একটা মেয়ে এতোসব কথা বললো,এতোগুলো ধোয়াশা ছড়িয়ে রেখে গেলো,তা যেনো একদমই গায়ে লাগেনি ওর। আরাব বললো,

-পরেরবার মনে করে জ্যাকেটটা নিয়ে আসবে কেমন? আমার জিনিস কাছে রাখার অনেক বাজে সাইড ইফেক্ট হতে পারে তোমার!

ওখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসলো দোয়া। কেনো যেনো সব অস্থিরতার মাঝে এই লোকটার উপস্থিতি,অনুপস্থিতি ওর আলাদা এক অস্থিরতার কারন। তবে এক বিষয়ে নিশ্চিন্ত হলো ও। আসল ডক্টর মুফতাহিরের করা জিডি দেখালে কোনোমতেই তাজীন আর অবিশ্বাস করবে না ওকে। ছেড়ে দেবে ডক্টর সুমনের মতো ধোকাবাজকে। আর রইলো বাকি ওর নিজের সুমনের সম্মুখিন হওয়া, এবারতো কোনো আড়াল নেই। ও জানে,কতোটা হিংস্র হতে পারে সুমন। তাই নিজেকে সেভাবেই না হয় প্রস্তুত করে নেবে ও।

দোয়া আড়াল হতেই পাশের ছোট্ট টঙের দোকানের দিকে এগোলো আরাব। এককাপ চা নিয়ে হাসিমুখে লেকের দিকে তাকিয়ে চুমুক দিলো চায়ের কাপে। দোয়া নিজেও জানে না,ও ঠিক কতো গুরুত্বপুর্ন ইনফর্মেশনস্ দিয়ে গেলো ওকে। কাপে চুমুক দিয়ে আরাব বাকা হেসে বললো,

-ডক্টর সুমন,ক্লোজেস্ট এসিসটেন্ট অফ ডক্টর রওশন! ওয়েলকাম ব্যাক ডিয়ার ! ওয়েলকাম ব্যাক! অনেক তো হলো লুকোচুরি! এন্ড নাও…দ্যা ফাইনাল রাউন্ড বিগেনস্!

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here