এক বেরঙ চিলেকোঠায় পর্ব -২৮+২৯+৩০

#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-২৭

নিরব চুপচাপ ড্রাইভ করছে। তাজীনও কোনো কথা বলেনি গাড়িতে উঠে। একধ্যানে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে শুধু। চারপাশটা তিক্ত লাগছে ওর। কোনোমতে কান্না আটকে রেখেছে বলাই যায়। গাড়ির সামনে রাখা তাজীনের সাইলেন্ট ফোনটা জ্বলছে দেখে নিরব একপলক ওর দিকে তাকালো। সে খেয়াল একদমই নেই তাজীনের। নিরব বললো,

-আপনার ফোন বাজছে তাজীন।

পলক ফেলে নিজেকে সামলালো তাজীন। ফোন হাতে নিয়ে বাবা নামটা দেখে আরো কান্না পাচ্ছিলো ও। নিজেকে শক্ত করে কল রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে জাফর আহমেদ অস্থিরচিত্তে বললেন,

-কোথায় ছিলি তুই মা? তোকে সবাই কতো খুজছে! নিরব,নিরবের বাবা,আমরা…

-আমি মিস্টার নিরবের সাথে আছি।

-জানি। তোকে ভার্সিটিতে দেখেই নিরব কল করেছিলো আমাকে।

-নিরবদের বাসায় ফিরছিস তো?

-আর কোনো উপায় রেখেছো তুমি বাবা?

-তাজ?

-কথা বলতে ভালো লাগছে না বাবা। নিজের যত্ম নিও। খোদা হাফেজ।

কল কেটে দিলো তাজীন। একপলক নিরবের দিকে তাকালো ও। নিজের মতো ড্রাইভে ব্যস্ত সে। তাজীন ধীর গলায় বললো,

-সরি।

নিরব কিঞ্চিত ভ্রুকুচকে বললো,

-ফর হোয়াট?

-আপনাদেরকে না জানিয়ে ভার্সিটি আসা উচিত হয়নি। আঙ্কেল নিশ্চয়ই…

নিরব হেসে বললো,

-ইটস্ ওকে। আমি বাবাকে কল করে বলেছি আপনি ভার্সিটিতে আর আমি আপনাকে নিতে এখানেই এসেছি। এখন আর সে টেনশনে নেই।

নিরবের হাসি দেখে চোখ সরিয়ে নিলো তাজীন। এতো স্বাভাবিকতা মানায় না নিরবকে। বিয়েটা তো স্বাভাবিক ছিলো না। চোয়াল শক্ত করে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো ও। নিরব ড্রাইভিংয়ের ফাকে তাজীনকে লক্ষ্য করে বললো,

-একটা কথা বলবো?

-বলুন।

-আমি জানি বিয়েটা আপনার অমতে হয়েছে। ইভেন আমিও প্রস্তুত ছিলাম না এটার জন্য। কিন্তু কি বলুনতো? আপনার সাথে তো এর আগেও একবার দেখা হয়েছিলো আমার। আপনার কথা জানিনা। কিন্তু আমাদের সেদিনের কনভার্সেশন আমি বেশ এন্জয় করেছিলাম।

তাজীন নিরবের দিকে ফিরে বললো,

-আপনি ঠিক কি মিন করতে চাইছেন?

-দেখুন তাজীন,সেদিন আমরা অচেনা ছিলাম। তবুও আপনার সাথে কথা বলতে ভালো লাগছিলো। কারন আপনি খুশিমনে কথা বলেছিলেন আমার সাথে। আজ আমরা স্বামী স্ত্রী সম্পর্কে আবদ্ধ দুজন মানুষ। ধর্মমতে আজীবনের চেনা। সেটা আজীবন স্থায়ী হোক বা না হোক। আপাতত যতোক্ষন একসাথে আছি,সব অস্বাভাবিকতার ভিড়ে,আপনার বন্ধুসুলভ আচরন তো এক্সপেক্ট করতেই পারি তাইনা?

বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো তাজীন নিরবের দিকে। গত রাতে ওদের দুজনের কোনো কথাই হয়নি। তাজীন চুপচাপ এককোনে বসে ছিলো সারাটা রাত। সকালে নিরবকে ব্যালকনির বিনব্যাগে ঘুমন্ত পেয়েছে। কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে আসে বাসা থেকে। এরই মাঝে এই লোকটা এতো ফ্র্যাংকলি কথা বলবে,আন্দাজে ছিলো না ওর। তাজীন নিজেও সোজা কথা বলাটাই শ্রেয় মনে করলো। বললো,

-যে মেয়েটা অন্য কাউকে ভালোবাসতো,তাকে নিয়ে এতোদুর ভাবা উচিত মনে হলো আপনার?

-ভালোবাসতেন। এটা আপনার জন্য ফ্যাক্ট। আপনি কতোদিন সে অতীতকে মনে রেখে মুভ অন করবেন না। আমার জন্য কোনো ফ্যাক্ট না এটা!

তাজীন আরো বিস্ময়ে তাকালো নিরবের দিকে। নিরব ওর মতোই ব্যস্ত। তাজীনের এবার অস্থির লাগছে। তার বউ হয়েও ও অন্য কাউকে নিয়ে ভাববে সেটা জেনেও লোকটা এতোটা স্বাভাবিক কি করে? এদিকওদিক তাকিয়ে ইতস্তত করতে লাগলো। কি মনে করে আড়চোখে নিরবের দিকে তাকিয়ে বললো,

-আর আপনার গার্লফ্রেন্ড?

ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে দিলো নিরব। বিস্ফোরিত চোখে তাকালো ও তাজীনের দিকে। বিয়েটা হঠাৎ করে হয়ে গেলেও তাজীনের প্রতি ওর কোনো অভিযোগ নেই। সবকিছুর মুলে যে ডক্টর সুমন,সেটা ওউ জানে। আরাব বারবার করে বলে দিয়েছিলো ওকে,তাজীনের যেনো কোনোভাবেই এটা মনে না হয় নিরব ওকে বিয়ে করে খুশি না। সত্যিই বিয়েটাতে যে ও‌ দুঃখী এমনটাও নয়। তা বাবার ইচ্ছা,বা যে কারনেই হোক। তাই ওউ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করবে বলে। কিন্তু তাজীনের কাছে গার্লফ্রেন্ড শব্দ শুনে হিসাবই উল্টে গেলো ওর। হতভম্বের মতো বললো,

-কিহ্? গার্লফ্রেন্ড মানে?

তাজীন অন্যদিক তাকিয়ে বললো,

-হ্যাঁ। আপনি আমার কাছে বন্ধুসুলভ আচরন এক্সপেক্ট করছেন। আর আপনার প্রেমিকা? তার কি?

-হোয়াট দ্যা হেল আর ইউ টকিং আবাউট?

রাগ উঠলো তাজীনের। নিরবের দিকে ফিরে রাগী আওয়াজেই বললো,

-কেনো? আমাকে বিয়ে করে ভুলে গেছেন নাকি তার কথা?

নিরব‌‌ মাথা চেপে ধরে বললো,

-কার কথা? কার কথা বলছেন আপনি?

-সেদিন আপনার গাড়ি আটকে দিয়েছিলো যে!

বাপ্পারাজের ‌মতো বিরহের একটা লুক দিলো নিরব। স্যারের জীবনের এই জারা নামক ঘুর্নিঝড় ওর উঠতি সম্পর্কেও আঘাত হানতে ভুললো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হতাশার স্বরে বললো,

-উনি আমার গার্লফ্রেন্ড নন তাজীন।

তাজীন কিছুটা হচকিয়ে গেছে। সেদিন নিরব বলেনি মেয়েটা কি হয় তার,এটা নিতান্তই ওর ধারনা ছিলো। সেই ধারনা থেকেই কথাটা বলে ফেলেছে ও। বললো,

-জ্বী মানে…

নিরব গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললো,

-ও জারা। আরাব স্যারকে পছন্দ করে। কিন্তু স্যার ওকে দু চোখে সহ্য করতে পারে না। সেদিন আরাব স্যারের খোজ নেওয়ার জন্যই জারা আমার গাড়ি আটকে দিয়েছিলো। কোনো গার্লফ্রেন্ড টার্লফ্রেন্ড না ও আমার!

তাজীন আর কিছু বললো না। চুপ করে মাথা‌ নিচু করে রইলো। নিরব বলতে লাগলো,

-কলেজে এক মেয়েকে ভাল্লাগতো। কিন্তু তা বলার আগেই বিদায় অনুষ্ঠান হয়ে গেলো। ভার্সিটিতে একজনকে দেখে ভাবলাম এবার বুঝি টুরু লাব। সে মেয়ে লাভ ইউ বলার সাথে সাথেই ফেসবুকে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস দিলো। অতঃপর তার শো অফের চক্করে আমার তিনদিনের প্রেমের ব্রেকাপ হয়ে গেলো। তারপর আর গার্লফ্রেন্ড শব্দটা স্বপ্নেও ভাবিনি। যদি কিছু থেকে থাকে,তা ছিলো রিয়জেন্টের সাথে কেমেস্ট্রি আর ল্যাবের যন্ত্রপাতির সাথে ফিজিক্স। নাথিং এলস্!

তাজীন বুঝলো ওকে হাসানোর জন্যই কথাগুলো বলছে নিরব। হয়তো কথাগুলো ছিলোও হাসার মতো। তবুও চুপই রইলো ও।‌জানালায় মাথা ঠেকিয়ে স্থির‌দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো শুধু। বলতে বলতে তাজীনকে‌ আরো নিশ্চুপ হয়ে যেতে দেখে‌ নিরবও বলা বন্ধ করে দিলো। ওর একতরফা চেষ্টায় এ সম্পর্কটা কি আদৌও স্বাভাবিক হবে কোনোদিন?

বাসস্ট্যান্ডের ফাকা ছাউনিটার নিচে দাড়িয়ে প্রায় ফাকা রাস্তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দোয়া। কাধে ঝোলানো পাঠের ব্যাগটা আকড়ে ধরে রেখেছে শক্ত করে। ভার্সিটির বাস পায়নি ও আজ। লোকাল বাস রায়নগর কমই যায় এ সময়। কে জানে বাস পাবে কি‌না আদৌও? আকাশটা বেশ মেঘলা। শীতের এ অসময়ী বৃষ্টি একসময় কতো সুখময় ছিলো ওর কাছে। মায়ের বকা শুনে বাবার সাথে হয় বাগান,নয় ছাদে চলে যেতো প্রতিবার বৃষ্টিতে। ভিজতো বাবা মেয়ে মিলে। আর আজ? এ মেঘলা আকাশ শুধু প্রতিবার ওকে সে অতীত মনে করিয়ে দিয়ে কষ্ট দেয়। আর কিছুই না!

দোয়ার একদম পেছনেই প্যান্টের পকেটে দুহাত গুজে আরাব দাড়িয়ে। মনেমনে বলে চলেছে,আজ বৃষ্টি হোক,তুমুল বর্ষন হোক। আজকের বৃষ্টি ওর সামনে ওর প্রেয়সীর জন্য হোক,আজকের মেঘলা আকাশ ওর প্রেয়সীর ঘন কালো চুলের রঙকে হার মানাক। আজকে নাইবা হলো দোয়ার সে কাঙ্ক্ষিত বাসের আগমন। সুন্দর সে কল্পনাগুলোর মতো আজ দোয়া ওর হাত ধরে সিক্ত পিচঢালা পথ খালিপায়ে পাড়ি দিক। কখনো হিমশীতল বাতাস ছুইয়ে দিয়ে শিহরনে ভাসাক দোয়াকে। আর ও? ও‌ না হয় আলতোভাবে দোয়াকে জড়িয়ে ধরে বলুক,উপেক্ষা করো ও হাওয়া। তারচেয়ে একটাবার আমায় অনুভব করো? আরাবের বাসার সামনের রাস্তাটায় যেমন কাঠগোলাপের চাদোয়া বিছানো থাকে,ওমনি অজস্র ফুলে ভরে যাক দোয়া আর ওর একসাথে চলা সে পথ!

মেঘের গুরুম গুরুম ডাকে হুশ ফিরলো আরাবের। ও সবটা যে এখনো শুধুও ওর কল্পনা। তাজীন ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর একটা কথাও আর বলেনি দোয়া। আরাব একপা সামনে এগিয়ে একদম দোয়ার বরাবর দাড়িয়ে ‌গিয়ে বললো,

-নিরব আর তাজীনের বিয়েতে তুমি খুশি নও দোয়া?

-যতোদিন না তাজীন সম্পর্কটা মানতে পারছে,ও‌ খুশি না মিস্টার আরাব।

-হ্যাঁ। কিন্তু নিরব অনেক ভালো ছেলে। আমি পার্সোনালি চিনি ওকে।

-হবে হয়তো। কিন্তু তাজীনের জন্য বিষয়টা সহজ হবে না। ডক্টর সুমনকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলো ও।

ঝুমঝুম করে বৃষ্টি পরতে লাগলো। আরাব পিছিয়ে দাড়ালো খানিকটা। ছাউনিতে ছিটেফোটা লাগছে বৃষ্টির। কিন্তু দোয়া অনড়। ভিজে যাচ্ছে মেয়েটা। তবুও পেছোচ্ছে না। দোয়ার হাতের দিকে হাত বারিয়েও থেমে গেলো আরাব। বললো,

-বৃষ্টি গায়ে লাগছে তোমার দোয়া।

দোয়া পেছন ফিরলো। ওর চোখ লাল হয়ে আছে। কপালের সামনে থাকা কিছু ছোট চুল কানে গুজে দিয়ে আবারো রাস্তার দিকেই তাকিয়ে রইলো ও। আরাব বললো,

-ডোন্ট ওয়ারি। তাজীন অনেক হ্যাপি থাকবে নিরবের সাথে। ওকে ভালো রাখবে নিরব।

ডোন্ট ওয়ারি! আরাবের এই কথাটা শুনলে চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে হয় দোয়ার। কারো বুকে মাথা রেখে চেচিয়ে বলতে‌ ইচ্ছে হয়,আই ওন্ট ওয়ারি। ইউ আর দেয়ার ফর মি! আই উইল নেভার বি ওয়ারিড্! নেভার এভার! চোখ বন্ধ করে রেখে দোয়া বললো,

-তাই যেনো হয়।

আরাব আবারো এগুলো সামনে। এবার ওর গায়েও বৃষ্টি লাগছে। দোয়া ওর দিকে না তাকিয়ে বললো,

-যাচ্ছেন না কেনো আপনি?

-বৃষ্টিতে কিভাবে যাবো?

-ডক্টর সুমন কোথায়?

-বাস্টার্ডটা এবারো পালিয়ে গেছে!

দাতে দাত চেপে বলে উঠলো আরাব। দোয়া বড়বড় চোখ করে ওর দিকে তাকালো। কি বলেছে সেটা বুঝ আসতেই চোখ বন্ধ করে দুবার শ্বাস ফেললো আরাব। দোয়া বিস্ময় নিয়েই বললো,

-এ্ এবারো মানে?

পুরোপুরিভাবে দোয়ার দিকে ঘুরলো আরাব। একদম ওর চোখে চোখ রেখে বললো,

-আগেও এভাবেই পালিয়েছে ও। অনেককে ঠকিয়ে!

-আ্ আপনি…

বাস এসে থামলো। অনেকেই নামলো বাসস্ট্যান্ডে। জায়গাটা ভরে উঠলো মানুষের আনাগোনায়। আরাব শান্ত গলায় বললো,

-বাসায় যাও।

মাথা নিচু করে বাসে উঠে গেলো দোয়া। আরাব চরে বসলো ওর বাইকে। দোয়া জানালা দিয়ে দেখলো,বাস ছাড়ার আগেই‌ বৃষ্টির মধ্যেই ভিজতে ভিজতে বাইক নিয়ে চলে গেলো আরাব।
কাকভেজা হয়ে বাসায় ফিরে সোজা নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো আরাব। টুইঙ্কেল দৌড়ে এগিয়ে এসে বললো,

-মামা? একা একাই ভিজলে‌ বৃষ্টিতে? আমাকে‌ নিলে না? আড়ি তোমার সাথে!

আরাব চুপ রইলো। তৌফিকা বললো,

-টুইঙ্কেল? আগে মামা চেন্জ করে নিক,তারপর আড়ি দেখিও? এখন মামা রুমে যাক হুম?

ক্লান্ত লাগছে আরাবের। কোনো কথা না বলে নিজের ঘরে চলে এলো ও। চেন্জ করে মাথা মুছতে মুছতে বেরোলো ওয়াশরুম থেকে। ঘরে বোন,বোনজামাই দুজনই উপস্থিত। কিছুটা অবাক হয়ে বললো,

-তোমরা সবাই? এখন এখানে?

তৌফিকা এর ওর দিকে তাকিয়ে এগোলো ওর দিকে। ইতস্তত করে বললো,

-তোকে দোয়ার বিষয়ে কিছু বলার ছিলো আরাব।

আরাব মুফতাহিরের দিকে তাকালো। তৌফিকা বললো,

-মুফতাহির জানে সবটা।

আরাব মৃদ্যু হেসে বোনকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বললো,

-বল কি বলবি।

-তুই রিয়্যাক্ট করবি না তো আরাব?

আরাব ভ্রু কুচকে তাকালো। হাসিতে শঙ্কা ফেলনা করে বললো,

-এতো ফর্মালিটিজ কেনো দেখাচ্ছিস বলতো আপু? কি হয়েছে ক্লিয়ারলি বল না!

তৌফিকা চরম অস্বস্তি নিয়ে বললো,

-দ্ দেখ আরাব,আমি মাকে আজ দোয়ার ছবি দেখিয়েছি। মা বলছিলো…

-কি? পছন্দ হয়নি মেয়ে এই টাইপ‌ কিছু? এটা বলে মজা নিতে এসেছিস?

বলেই হেসে‌ দিলো আরাব। তৌফিকা ভাইয়ের বিশ্বাসের হাসিটার দিকে তাকিয়ে রইলো খানিক্ষন। তারপর একটা জোরে শ্বাস নিয়ে বলে উঠলো,

-মা নাকি দোয়াকে একদিন অনেক রাতে,রাস্তায় অনেক বাজে অবস্থায় পেয়েছিলো। কোনো এক গাড়ি থেকে নাকি রাস্তায় ওমন দুদ্ধর্স অবস্থায় ফেলে যায় ওকে। ম্ মায়ের ধারনা,ও্ ওর সাথে কোনো না কোনো অঘটন ঘটেছে।

আরাব দম মেরে বসে রইলো বোনের কথা শুনে। তৌফিকা ওর দুগাল ধরে বললো,

-ব্ বিশ্বাস কর আরাব? আমি…আমি মাকে অনেক বুঝিয়েছি,দোয়ার সাথে কিছুই ঘটেনি। তুই নিজে খোজ নিয়েছিস ছেলেটার। ও কিছুই করেনি দোয়ার সাথে। তবুও মায়ের এক কথা! দোয়া নিজের সম্মান বাচাতে মিথ্যে বলছে। ওই ছেলেটাও তোর ভয়ে মিথ্যে বলেছে। দ্ দোয়ার…দোয়ার সে রাতে…

-স্টপ ইট আপু! জাস্ট স্টপ ইট!

চিৎকার করে উঠে দাড়ালো আরাব। লাথি মেরে কাচের ছোট সেন্টার টেবিলটাও ভেঙে ফেলেছে ও। ওর চিৎকারে কেপে উঠেছে তৌফিকা,মুফতাহির। হাত মুঠো করে চোয়াল শক্ত করে দাড়িয়ে রইলো আরাব। রাগে কাপছে ও সমানে। মুফতাহির উঠে দাড়িয়ে ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,

-তোমার বা কারো কোনো কথাতেই সত্যিটা মিথ্যে বা মিথ্যেটা সত্যি হয়ে যাবে না আরাব। আর মা যখন নিজচোখে দোয়াকে ওই অবস্থায় দেখেছে,ওর সুস্থতার ক্লিনিক্যলি প্রুভ দরকার। মেডিক্যাল টেস্ট ছাড়া ও এ বাসায় বউ হয়ে আসবে না মানে আসবে না!
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-২৮

-আমি দোয়াকে ভালোবাসি। ও যেমন,ওর সবটা নিয়েই ওকে ভালোবাসি। যদি দোয়ার সাথে সত্যিই বাজে‌ কিছু ঘটে যেতো,তবুও আমি ওকেই,ঠিক এভাবেই ভালোবাসতাম। এতোটুকো তফাৎ আসতো না আমার ভালোবাসায়। সেদিন যে রনোক কোনো বাজে কিছু করেনি দোয়ার সাথে তা আমি নিশ্চিত। তাই এসব কথার কোনো মানেই হয়না আর! কান খুলে শুনে রাখ আপু! দোয়ার কোনো মেডিকেল টেস্ট হবে না! তাতে দোয়া এই রংধনুতে‌ বউ হয়ে‌ না আসলেও তাহসানুল আরাবের বউ ঠিকই‌ হবে! আমি বিয়ে‌ করলে সর্বাবস্থাতে দোয়াকেই বিয়ে করবো!

তৌফিকা আর মুফতাহির স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো আরাবের এতো কড়া কথা শুনে। এ অবদি কোনোদিনও আরাব এতো শক্ত গলায় কথা বলেনি ওদের সাথে। আর আজ…আরাব তৌফিকার দিকে তাকিয়ে বললো,

-তোকে নিয়ে আমার বরাবর গর্ব হতো আপু। আর যাই হোক,তুই কোনোদিন বাবার মতো কথা বলবি না। কিন্তু আজ তোর কথার মাঝে আমি বাবার কথার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি।

-আরাব আমি…

-তুই দোয়াকে অপমান করেছিস।

-না আরাব। আমি তো…

-যাকে নিয়ে এতোবড় কথাটা বললি,তাকে তুই চিনিস না আপু? সে তো এখনও অবদি জানেই না তাকে নিয়ে আমি কতো স্বপ্ন বুনেছি। এখনো অবদি জানেই না,তাকে ঘিড়ে আমি আমার পৃথিবী সাজাচ্ছি। তার জন্য একটা মানুষ পাগলপ্রায়,সে বিষয়ে যে সে এখনো অবগত না এটাও তো জানিস তুই আপু। তবে সে কেনো প্রমান দেবে? সে কেনো পরীক্ষা দেবে? তাছাড়া…তাছাড়া তোকে তো আমি আগেই রনোকের বিষয়ে বলেছিলাম আপু। তবুও তুই?

কান্নারত অবস্থায় মুফতাহিরের দিকে তাকালো তৌফিকা। মায়ের কথায় কোনোদিনও আরাবকে এতোবড় কথাটা বলতো না ও। কিন্তু মুফতাহিরকে কোনোভাবেই বুঝিয়ে উঠতে পারছিলো না। এ নিয়ে একদফা ঝগড়াও হয়েছে ওদের মাঝে। ও জানতো এই একটা কথার জন্য ওর আর আরাবের সম্পর্কে ঝড় আসবে। কিন্তু মুফতাহিরের কথার ভীড়ে,যুক্তির ভীড়ে বলতে বাধ্য হয়েছে আরাবকে। মুফতাহির স্বাভাবিক গলায় বললো,

-ওই ছেলেটা যে তোমাকে মিথ্যে বলে নি তার কি সত্যতা আছে আরাব? দোয়া যে মাকে সত্যি বলেছে,তারই বা কি সত্যতা?

চোয়াল শক্ত করে এগিয়ে গেলো আরাব। তীক্ষ্ম চোখে মুফতাহিরের দিকে তাকিয়ে বললো,

-বললে বলেছে মিথ্যা দোয়া! ইন দ্যাট কেস,আমি ওই মিথ্যেবাদী,সম্মানহারানো মেয়েটাকেই বিয়ে করবো! কোনো সত্যতার প্রয়োজন আমার নেই। লাইফটা আমার! আমি ডিসাইড করবো আমি কি করবো বা না করবো! কোনো কিছু আগে থেকে ডিসাইড করে রাখার তোমরা কেউ নও মুফতাহির ভাইয়া!

মুফতাহির দমে গেলো। আমার লাইফ কথাটা যখন আরাব বলে দিয়েছে,সেখানে মুফতাহিরের কেনো,স্বয়ং তৌফিক ওয়াহিদেরও কোনো কথাই পোষাবে না। রংধনুতে থেকে হোক বা রংধনুর বাইরে,আরাবের বউ দোয়া ছাড়া আর কেউ হবে না তা বেশ ভালোমতোই বুঝে গেছে ও। আরাব বললো,

-আরো একটা কথা! দোয়ার এই মেডিকেল টেস্টের কথা আজ এ পর্যন্তই শেষ! এরপর এ নিয়ে না রংধনুতে আলোচনা হবে,না রায়নগর,নাইবা এই মহাবিশ্বের কোথাও! আগুন লাগিয়ে‌ দেবো আমি দ্বিতীয়বার এ কথা শুনলে! শেষ করে দেবো সব!

কথাগুলো শেষ করে দরজায় দাড়িয়ে থাকা টুইঙ্কেলকে নিয়ে হাটা লাগালো আরাব। কোনো কথা না বলে মামার সাথে লাফাতে লাফাতে চললো টুইঙ্কেল। আরাব বৃষ্টিতে ভিজে এসেছিলো,ওকে নিয়েও ভিজবে একসময় এটা ভেবে বেশ ভালো মুডে খেলছিলো ও। কিন্তু মামার ঘর থেকে হঠাৎই চিৎকার শুনে ছুটে এসেছিলো কি হয়েছে দেখবে বলে। এতোজোরে কে‌ চেচালো‌ সেটা দেখবে বলে। কোনোদিন আরাবের গলা এতোজোরে শোনে‌নি ও। তাই ভেবেছিলো এটা ওর বাবারই গলা। দরজায় দাড়িয়ে বোঝার‌ চেষ্টা করছিলো ওর বাবা কেনো এতো জোরে চেচালো। কিন্তু কিছু শোনার আগেই‌ কথা শেষ করে ওকে নিয়ে সরে আসলো আরাব।

ঘরের এককোনে দাড়িয়ে বিছানার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছে তাজীন। নিরব চশমা চোখে দিয়ে টেবিলে কিছু লেখালেখি করছে। চারপাশে তিনচারটে বই খুলে রেখে একবার এটার পাতা উল্টাচ্ছে,তো একবার ওটার। তাজীন ব্যালকনিতে গিয়েছিলো একবার। যেটুকো ঠান্ডা হাওয়া,গায়ে কাটা দিয়েছে তাতেই ওর। ঘুমোবে কোথায় বুঝে উঠতে পারছে না ঠিক। আগেররাতে নিরব নিজে থেকে ব্যালকনিতে ছিলো। ওউ এতোটাই শকে ছিলো,পুরোরাত মেঝেতে বসে কাটিয়ে দিয়েছে,সেটা খেয়ালই হয়নি ওর। কিন্তু আজ মেঝেতে বসতেও ইতস্তত লাগছে,বিছানার দিকেও এগোতে পারছে না। কাজ খানিকটা শেষ করে চশমাটা খুলে নিরব চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। নড়েচরে উঠলো তাজীনও। কিছু একটা মনে পরতেই নিরব ফট করে চোখ মেলে পাশে তাকালো। ঘরের এককোনে গোলাপী শাড়ি পরিহিত ওর সদ্য বিয়ে করা বউ দাড়িয়ে। মনেমনে বউ কথাটা বলেই হতাশায় পরে গেলো নিরব। উঠে দাড়িয়ে বললো,

-ঘুমোবেন না?

-কোথায় ঘুমোবো?

উত্তরের বদলে তাজীনের সোজা প্রশ্নে একটু হচকিয়ে গেলো নিরব। মাথা ঝেড়ে নিজেও স্বাভাবিক গলায় বললো,

-কেনো? বিছানায় ঘুমোতে সমস্যা কোনো?

-তাহলে আপনি কোথায় ঘুমোবেন?

-আমার তো বিছানায় ঘুমোতে সমস্যা নেই।

-আমিও বিছানাতেই ঘুমোবো?

-হ্যাঁ ঘুমোবেন। আমার আপনার সাথে বেড শেয়ার করতে কোনো সমস্যা নেই তো!

কথাটা বলেই আটকে গেলো নিরব। তাজীন তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। নিরব আমতা আমতা করে বললো,

-আব্…ঠিকাছে আপনার সমস্যা হলে আমি…আমি ব্যালকনিতে…

তাজীন ওকে পাশ কাটিয়ে চলে আসলো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিরব। একটুপর পেছন থেকে আওয়াজ এলো,

-ল্যাম্পশেড আপনার ওপাশে। ওটা অফ করার দরকার নেই। একেবারে অন্ধকার ঘর ভালো লাগে না আমার।

পেছন ফিরলো নিরব। কোলবালিশ মাঝে দিয়ে বিছানার একপাশে শুয়ে পরেছে তাজীন। কোলবালিশের এপারের জায়গাটা ওর জন্য রাখা দেখে মুচকি হাসলো ও। ঘরের চারপাশে চোখ বুলালো খানিকক্ষন। কেমন যেনো বউ বউ গন্ধে ভরপুর লাগছে ঘরটা। কিছু তো আলাদা লাগছে আজ। মাথাটা লাজুকভাবে চুলকে নিজের জায়গায় এসে কপালে হাত রেখে শুয়ে পরলো ও।

আজ মাহিমের আম্মু বেতন দিয়েছে দোয়াকে। হিসাব করলো,কিছু টাকায় সবজি,কিছু টাকায় চালডাল কিনবে আজই। দুপয়সা হাতখরচ নামে রেখে বাকি টাকায় দিয়ানের জন্য কিছু বই কিনবে। ভাইটা ওর বই পড়তে খুব ভালোবাসে। ক্রিকেট খেলা ওর সবচেয়ে পছন্দের। বাবা চেয়েছিলো দিয়ান বিকেএসপিতে পড়বে। যতই অনটন থাকুক,দোয়া ওকে সেখানেই ভর্তি করাতো। কিন্তু ওর অসুস্থ্যতার জন্যই হয়ে ওঠেনি। কিন্তু দোয়া মনেমনে ভেবে রেখেছে,একবার অপারেশনের পর দিয়ান ভালো হয়ে গেলেই ওকে বিকেএসপিতে ভর্তি করিয়ে দেবে। ভাইয়ের জীবনের কোনো শখ আহ্লাদ অপুর্ন রাখবে না ও। খুশিমনে ও টুইঙ্কেলদের বাসায় এসে পৌছালো। আগেরদিন তৌফিকা অরুনাভ বাবুকে ফোন করে দোয়াকে যেতে বারন করেছিলো। ওরা নাকি বাসায় ছিলো না এজন্য। একদিন পর আবারো টুইঙ্কেলদের বাসার কলিংবেলে চাপ দিলো দোয়া। প্রতিদিনের মতো টুইঙ্কেল ছিলো না দরজায়। ওর পরিবর্তে দরজা দরজা খুলে দিলো তৌফিকা। দোয়া হাসিমুখে সালাম দিয়ে বললো,

-কেমন আছেন আপু?

শান্ত দৃষ্টিতে দোয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো তৌফিকা। কতো মিষ্টি একটা হাসি। কতো ভালোবাসায় জড়ানো গলার স্বর। আর এই মেয়েটাকে নিয়ে কিনা ও…সালামের উত্তর নিয়ে বললো,

-আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি?

-জ্বী ভালো।

তৌফিকা দরজা ছেড়ে সরে দাড়ালো। টুইঙ্কেল এগিয়ে এসে বললো,

-গুড আফটারনুন উইশমাম!

দোয়া ঝুকে ওর গাল টিপে দিয়ে বললো,

-ভেরি গুড আফটারনুন লিটল স্টার! কেমন আছো?

-খুউউব ভালো!

-আজ এতো বেশি ভালো কেনো টুইঙ্কেল?

-কারন আজ মামার সাথে অনেক মজা করেছি রংধনুতে। আর আজ উইশমামকেও অনেক খুশি দেখাচ্ছে।

বেশিরভাগ কথায় মামাকে জুড়ে দেওয়া টুইঙ্কেলের অভ্যাস এটা জানে দোয়া। একপলক তৌফিকার দিকে তাকিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালো ও। বললো,

-ও্ ওকে চলো,আমরা পড়তে বসি?

-ওকে উইশমাম!

দোয়ার সাথে সোফায় পড়তে বসে গেলো টুইঙ্কেল। তৌফিকার চোখ ছলছল করছে। এই মেয়েটাকে নিয়ে যা বলেছে ও,ইচ্ছে তো করছে দোয়ার পা জরিয়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নিতে। যদিও দোয়া কিছুই জানেনা,কিন্তু ওর ভাইয়ের সাথে বোধহয় আর সম্পর্কটা আগের মতো রইলো না। আরাব কোনোদিনও ক্ষমা করবে না ওকে। ভাবতেই দুফোটা চোখের জল বেরিয়ে এলো ওর। লুকিয়ে চোখের পানি মুছে নাক টেনে এগিয়ে গেলো ও দোয়ার দিকে। বললো,

-আন্টি,দিয়ান,কাকাবাবু সবাই কেমন আছে দোয়া?

-সবাই ভালো আছে আপু।

তৌফিকা আর কিছু বললো না। বসে রইলো দোয়ার সামনেই। টুইঙ্কেলকে পড়ানোর শেষে দোয়া বললো,

-আপু? টুইঙ্কেলের এক্সাম তো সামনেই। আব্..আমি কি এক্সামের মধ্যেও…

-তোমার যেটা সুবিধা মনে হয়। আমার মতে দুদিন আগে থেকেই ছুটি দিয়ে দাও না হয়?

দোয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। তৌফিকা বললো,

-আমরা কখনোই এক্সাম নিয়ে টুইঙ্কেলকে প্রেশারাইজ করি না। ও রিল্যাক্স থেকেই এক্সাম দেয় সবসময়। আর ভালোও করে। তাই এক্সামের জন্য ওকে আলাদা করে ট্রিট করতে হবে না তোমাকে। এখন যেভাবে মজায় মজায় শিখছে,ওভাবেই পড়ুক। তোমার পড়ানোর ওয়ে আমার খুব পছন্দের দোয়া। আশা করবো তুমিও আমার কথায় একমত?

দোয়া হেসে মাথা নাড়ালো। এরমাঝেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মুফতাহির। আজ ও ইচ্ছে করেই বেরোয় নি। আরাবের পছন্দের মেয়েকে চাক্ষুস দেখা দরকার ওর। মুফতাহিরকে দেখে দাড়িয়ে গেলো দোয়া। ওর দাড়িয়ে যাওয়া দেখে মুফতাহিরের দিকে তাকালো তৌফিকা। তারপর মাথা নিচু করে বললো,

-টুইঙ্কেলের বাবা।

দোয়া হাসিমুখে সালাম দিলো মুফতাহিরকে। সালামের উত্তর নিয়ে ওকে বসতে বললো মুফতাহির। দোয়া বসলো। সামনে মুফতাহিরও বসে গেলো। স্বাভাবিক ভাবেই বললো,

-তোমার কথা শুনেছি। ব্যস্ততায় দেখা করা হয়নি। আই হোপ কিছু মনে করো নি তুমি?

-জ্ জ্বী একদমই না। মনে করার কি আছে এখানে? দেখা তো হয়েই গেলো!

-তুমি বললাম,এটা নিয়ে কিছু মনে করবে না তো আবার?

-এভাবে কেনো বলছেন? আপনি আমার বয়সে বড়। অবশ্যই তুমি করেই বলবেন।

মুফতাহির হাসলো। সত্যিই দোয়ার চেহারায় মায়া ভরা। ওর এই সাদামাটা বেশভুষায় যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য। তৌফিকা বললো,

-কি খাবে দোয়া?

দেরি না করে ব্যাগ নিয়ে উঠে দাড়ালো দোয়া। বললো,

-আজকে না আপু। আজ আসি। ভালো থাকবেন।

তৌফিকা শুধু তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। আজকে দোয়ার খুব ইতস্তত লাগছে তৌফিকার চাওনিতে। এতো অপরাধীর মতো তাকিয়ে ছিলো পুরোটা সময়,ভালোই‌ লাগছে না ওর আর এ বাসায়। মুফতাহিরের দিকে তাকিয়ে বললো,

-আসছি স্যার।

-ভাইয়া ডাকতে পারো।

-জ্ জ্বী ভাইয়া। আসছি।

-এসো।

কথা না বাড়িয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এলো দোয়া। নিচে নেমে জোড়ে শ্বাস নিলো দুবার। এদিক ওদিক উকি দিয়ে সবজিওয়ালাকে খুজলো খানিকক্ষন। হাতে টাকা আছে,মা ভাইকে শুধুশুধু পরশু কেনা শুকনো পুইশাক কেনো খাওয়াবে? সবজিওয়ালাকে দেখতে না পেয়ে হাটা লাগালো ও। তৌফিকাদের বাসার গলিটা পার হতেই এক বাসার সামনে কাঠগোলাপ গাছ। নিচে পরে আছে অনেকগুলো ফুল। বুকের ভেতরটা আচমকাই ধুকপুক করতে লাগলো দোয়ার। কয়েকদিন হলো এমন কোনো সকাল নেই,কাঠগোলাপের দেখা মেলেনি ওর। বারান্দায়,সিড়িতে,মুখার্জীবাড়ির সদর দরজায় এমনকি ভার্সিটির বাসে অবদি কোথাও না কোথাও শুভ্র কাঠগোলাপের বাহার দেখতে হয়েছে ওকে। কে,কেনো,কার জন্য সব প্রশ্নকে উপেক্ষা করে,সে ফুলগুলোকে পাশ কাটিয়ে গেছে ও। অবশ্য সেটা আলাদা কথা,ফুলগুলো দেখলে ওর মনে অদ্ভুত আনন্দ হতো,অদ্ভুত শিহরন হতো,পুরোনো কোনো ভালোলাগা জেগে উঠতো!

ধীর পায়ে রাস্তায় পরে থাকা ফুলগুলোর দিকে এগোলো দোয়া। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে দেখলো কিছুক্ষন। তারপর উপরে গাছের দিকে তাকালো। গোধুলীর আবছা আধার নামতে শুরু করেছে চারপাশে। অন্ধকারে গাছের সবুজ পাতা কালছে দেখাচ্ছে। কিন্তু ফুলগুলো আরো বেশি উজ্জল দেখাচ্ছে। দোয়ার অনুভব হলো,পেছন থেকে ওর বিনুনী ছুয়েছে কেউ। পেছন ফেরার আগেই সে মানুষটা বলতে লাগলো,

-আমার নীল আকাশে শুভ্র মেঘ হয়ে এসো,
আর মেঘে ঢাকা আকাশে হও‌ বৃষ্টি…
আমার হৃদমোহনায় জোয়ার হয়ে এসো,
আর উত্তল হৃদয়ের জন্য হও দুদন্ডের শ্রান্তদৃষ্টি..
দিনের উজ্জলতায় না হয় সুপ্তই থেকো,
রাতের আধারে থেকো অস্পর্শী হয়ে…
কিন্তু আমিতো জানি,তুমি রবে আমাতে
কোনো এক রাঙা গোধুলীর
ভালোবাসি বলার বিপরীতে ভালোবাসি বলাতে…

মুর্তির মতো দাড়িয়ে রইলো দোয়া। কথাগুলোতে শিরা উপশিরায় রক্তসঞ্চালন যেনো থেমে গেছে ওর। শরীরে তীব্র কম্পন নিয়ে পেছন ফিরলো ও। খানিকটা পেছনেই আরাব দাড়িয়ে। দোয়ার হৃদস্পন্দন যেনো ত্বরন পেলো। দু হাতে খামচে ধরলো ওড়না। চোখ ছলছল করছে ওর। খোলা চুলগুলো কপালের সামনে দিয়ে উড়ছে। কথাগুলো বলতে বলতে ওর সম্পুর্ন বিনুনি খুলে দিয়েছে আরাব। দোয়ার অবস্থা দেখে আরাব একপা এগিয়ে এসে ওর চোখে চোখ রেখে বললো,

-এটুকোতেই এমন? তবে কল্পনা করো আমার সাথে কি কি ঘটেছে দোয়া। কল্পনা করো আমি কি কি সহ্য করেছি,কিভাবে করেছি। কল্পনা করো,তোমার উপেক্ষাতে আমার ভেতরটাতে ঠিক কি কি হয়?

দোয়া পিছিয়ে দাড়ালো। ওর চোখে এখনো পানি চিকচিক করছে। কাপাকাপা গলায় বললো,

-ক্ কি বলছেন আপনি এসব মিস্টার আরাব!

আরাব অন্যদিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে সামলালো নিজেকে। তারপর আবারো দোয়ার দিকে ফিরে বললো,

-কিছুদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি। টেক কেয়ার।

একমুহুর্তও আর দেরি করেনি আরাব। লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেলো ওখান থেকে। চোখ দিয়ে টপটপ করে দুফোটা পানি পরলো দোয়ার। বিমুঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলো ও। কিছু কথা গলায় আটকে রইলো শুধু। হয়তো বলতে চেয়েও বলতে পারলো না,
যদি টেক কেয়ার কথাটা বলে আমার দায়িত্বটা আমাকেই দিয়ে যাবেন,তাহলে বাইরে যাচ্ছেন,সেটা কেনো বলতে এসেছিলেন? একদমই অপ্রয়োজনীয় মানুষের কাছে অপ্রয়োজনীয় কথা বলে গেলেন আপনি! কেনো বলে গেলেন? কোনো প্রয়োজন ছিলো না তো এর! কোনো প্রয়োজন ছিলো না!
#এক_বেরঙ_চিলেকোঠায়
#লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
পর্ব-২৯

খুব ভোরেই ঘুম ভেঙে যায় তাজীনের। চোখ মেলে আগে নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করলো ও। মনে পরলো,এটা এর শশুড়বাড়ি। পাশে তাকিয়ে নিরবকে একেবারে বিছানার কিনারায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকতে দেখলো। আলাদা কম্বল জরিয়ে মাথা বালিশ ছেড়ে একদমই কিনারায় শুয়ে আছে নিরব। যেনো পুরো বিছানা তাজীনকে ছেড়ে দিচ্ছে। ক্ষুদ্রশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমের দিকে এগোলো তাজীন। আয়নায় তাকাতেই সুমনের চেহারা ভেসে উঠলো ওর সামনে। রাগে চোখেমুখে বারকয়েক পানির ছিটা দিয়ে বেসিন ধরে চোখ বন্ধ করে নিলো ও। আশ্চর্যজনক ভাবে ওর বন্ধ চোখের সামনে নিরবের অবয়ব দেখতে পেলো যেনো। তৎক্ষনাৎ চোখ মেললো তাজীন। আয়নার নিজের ভেজা মুখশ্রী যেনো বলে উঠলো,একে বলে বিয়ে! এক অনন্য পবিত্র সম্পর্ক!

নিজেকে সামলে ফ্রেশ হয়ে বাইরে বেরোতেই চোখ কপালে তাজীনের। কিছুক্ষন আগে বিছানার যে দশা দেখে গেছে,এখন তার উল্টোটাই। পুরো বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে নিরব শুয়ে আছে। কোলবালিশটা অবদি মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। যেনো ওই বিছানায় কারো দখলদারিত্ব সহ্য হয় না নিরবের। কোলবালিশেরও না। একটা শুকনো ঢোক গিলে আস্তেধীরে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। বাসায় মানুষজন বলতে শুধু নিরব আর ওর বাবা। শুনেছে নিরবের মা মারা গেছে ছোটবেলাতেই। বাকি আত্মীয়স্বজন যার যার মতো। গুটিগুটি পায়ে কিচেনের দিকে এগোলো তাজীন। নিরবের বাবা মিস্টার নাফিজ চৌধুরী অমলেট বানাতে বানাতে বললেন,

-উঠে গেছিস মা? কি খাবি বল!

স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো তাজীন। এ মানুষটার দিকে ঠিকমতো তাকায়ও নি ও এখনো অবদি! আর এ কিনা ওকে এতো আদুরে গলায় ডাকছে? তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে বললো,

-আ্ আপনি এসব কেনো করছেন আঙ্কেল? আমাকে দিন আমি…

-আঙ্কেলকে সহমর্মিতা দেখাতে হবে না!

হঠাৎ করেই‌ পাল্টানো স্বরে কথা শুনে থেমে গেলো তাজীন। নাফিজ চৌধুরী নিজের মতো ব্যস্ত থেকে বললেন,

-নিরবের মা মারা যাওয়ার পর থেকে আমি একাই বিজনেস,বাসা দুটোই সামলেছি। নিরবকে নিয়েই অফিস চালিয়েছি। ওর পড়াশোনা,ওর যত্ম নিয়েছি। তবুও কখনো ওর জন্য কেয়ারটেকার রাখিনি। নিরব বড় হয়ে বায়োমেডিতে জয়েন করার পরও আমি নিজেই রান্নাবান্না করেছি। বাপ ছেলে মিলে একসাথে খেয়েছি। এখনো এসব আমি মজায় মজায়ই করি। ভালোলাগে আমার। সকালে রান্না করে একসাথে বসে খেয়ে দুজনে মিলে অফিস চলে যাই,দুপুরে একসাথে লান্চ বানাই,রাতে কখনো কখনো বাইরে খেতে যাই। নিরবও আমাকে অনেক সময় দেয়। ইনফ্যাক্ট সময় দেবে বলেই বিজনেসে জয়েন না করে বায়োমেডিতে জয়েন করেছে।

তাজীন শুধু তাকিয়ে রইলো। মিস্টার চৌধুরী বললেন,

-এতো কথা তোমাকে কেনো বলছি তাইতো? আসলে এ বাসায় সবই ছিলো। শুধু একটা মেয়ের অভাব ছিলো আমার বরাবরই। তোমার বাবার কাছ থেকে তাইতো ছেলেবউ চাইনি,মেয়ে চেয়েছিলাম। এখন তুমিও যদি আঙ্কেল বলে ডাকো,আমার মুনাফাটা কোথায় বলোতো?

চোখ ভরে উঠলো তাজীনের। আস্তেধীরে ও এগিয়ে গেলো আরো কিছুটা। কম্পিতকন্ঠে বললো,

-ব্ বাবা!

নাফিজ চৌধুরীর হাত থেমে গেছে। হেসে জরিয়ে ধরলো সে তাজীনকে। একটু থেমে থেকে কেদে দিলো তাজীন। নাফিজ চৌধুরী ওকে সামলে হেসে বললেন,

-এই মেয়ে? কাদছিস কেনো? বাবা ডাকতে কষ্ট হচ্ছে?

মাথা তুলে গাল ফুলিয়ে তাকালো তাজীন। নাফিজ চৌধুরী ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন,

-আমার ছেলে বলে বলছি না। নিরব সত্যিই অনেক ভালো ছেলে। যে ছেলে মা হারা হয়ে বাবার সব দায়িত্বপালনে সক্ষম,সে ছেলে যাকে ভালোবাসবে,তাকেও সবকরমভাবে আগলে রাখতে সক্ষম। ওকে একটু বুঝতে শেখ,দেখবি সবটা ঠিক হয়ে গেছে।

তাজীন মাথা নিচু করে রইলো। নাফিজ চৌধুরী বললেন,

-কি খাবি বললি না!

চুলগুলো খোপা করতে করতে নাফিজ চৌধুরীকে ঠেলে সরিয়ে দিলো তাজীন। বললো,

-বাবা ডেকেছি,তবে ট্রিট করবো ছেলের মতো। আমি খাবার বানাচ্ছি! তুমি এবার যাও পড়তে বসো!

কথাটা বলেই চোখ বন্ধ করে জিভ কামড়ালো তাজীন। নাফিজ চৌধুরীর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো,

-ন্ না মানে…ত্ তুমি গিয়ে রেস্ট নাও বাবা!

হেসে দিলেন নাফিজ চৌধুরী। খানিকটা দুরে বুকে হাত গুজে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে সবটাই দেখলো নিরব। বাবার সকালের ব্রেকফাস্ট বানানোর আরো একজন হেল্পিং হ্যান্ড এসে গেছে,তাকে রেস্ট নিতে বলার আরো এক কঠোর শাষক এসে গেছে ভেবে হাসি ফুটলো ওর চেহারাতেও।

মাঝে দু দিন কেটে গেছে। দোয়ার দিনগুলো কেটেছে সেই বাইক এক্সিডেন্টের আগের আর সব সাধারন দিনগুলোর মতোই। ওর জীবনে আরাব আসার আগের দিনগুলোর মতোই। কোনো উত্তেজনা ছিলো না,কোনো শিহরন ছিলো না,কোনো অদ্ভুত অনুভূতি ছিলো না। শুধু ভার্সিটি,চিলেকোঠা,টিউশনি। কয়েকবার মনে হয়েছে,কেউ তো চোখে চোখে রাখছে ওকে। কিন্তু খুজে পাইনি কাউকে। ক্যাম্পাসের এককোনে বসে খোলা বইয়ের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে ছিলো দোয়া। দুর থেকে ওকে দেখে এগিয়ে আসলো তাজীন। পাশে সে বললো,

-কি পরছিলি?

-হুম? কিছুনা। কখন আসলে?

-সবেই।

দোয়া চুপ করে গেলো আবারো। বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে বাদিকের পাতা বাদ রেখে ডানদিকের পাতায় চোখ আটকালো দোয়া। তাজীন বুঝলো,পড়ায় এতোটুকো মনোযোগ নেই ওর। ক্লাসটাইমেও কলম ব্যাগে রেখে উঠে চলে আসতে যাওয়া,বইয়ের একটার পর একটা পৃষ্ঠা ভাজ দেওয়া,ক্লাস থেকে বেরিয়ে একধ্যানে বাইরের কাঠগোলাপ গাছের দিকে তাকিয়ে থাকা,বাইকের শব্দ শুনলেই চোখ বন্ধ করে নেওয়া,বারবার বিনুনির রাবারব্যান্ড খোলা,আবারো বিনুনী করে ব্যান্ড লাগিয়ে নেওয়া,ওড়না মুঠো করে নিয়ে মুঠো খোলা বন্ধ করা,পুরোটা সময়ই ওকে লক্ষ্য করছে তাজীন। মা ভাইয়ের ভরনপোষন নিয়ে দোয়া চিন্তায় থাকে ঠিকই। কিন্তু এতো অগোছালো থাকে না। আজকে ওর এলোমেলো ভাব দেখে মোটেও ভালো লাগছে না তাজীনের। ভার্সিটি থেকে বেরোনোর সময় বলেই উঠলো,

-তোর কি হয়েছে দোয়া?

দোয়া এক অন্য দুনিয়াতেই ছিলো। চমকে উঠে বললো,

-ম্ মানে?

-কিছু তো একটা হয়েছে তোর। এতো এলোমেলো লাগছে কেনো তোকে আজ?

-এলোমেলো লাগছে? তাহলে কি আর হবে? কাউকে নির্ঘাত মিস করছে আপনার বান্ধবী!

নিরবের কথা শুনে সামনে তাকালো দোয়া তাজীন দুজনই। দোয়া তাজীনের দিকে তাকাতেই মাথা নামিয়ে নিলো ও। শান্ত গলায় বললো,

-আপনি এখানে কেনো?

-আসলে বাবা বলছিলো আপনাকে পিক করে নিয়ে যেতে। আপনার নাকি বাসে যাতায়াত করে অভ্যেস নেই।

-আপনার অফিস থেকে এদিক দিয়ে উল্টো হয় না?

-হলেও কি করার? একইবাসায় তো ফিরবো,একইসাথে ফিরি না হয়!

দোয়া মনেমনে খুশি হলো নিরবের স্বাভাবিক ব্যবহার দেখে। বুঝতে পারলো সম্পর্কে আড়ষ্টতার কারন তাজীনই। তাজীন বললো,

-ও দ্…

-তাকওয়াতুল দোয়া! রায়নগর বাসা! আমি জানি!

নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো দোয়া। নিরব আবারো বললো,

-আগেরদিন ভালো করে কথাই হলো না আপনার সাথে। আরাব স্যারের নিজগলায় আপনাকে আমাদের বিবাহকথন শোনানোর ছিলো কি না! যাইহোক! কেমন আছেন?

তাজীনও কিঞ্চিত হা করে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। এভাবে তো ওর সাথেও কথা বলে না নিরব। আর দোয়ার সাথে এমনভাবে কথা বলছে যেনো কতো জন্ম ধরে দোয়ার পরিচয়পর্ব শুনে এসেছে। দোয়া আমতা আমতা করে বললো,

-জ্বী আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। আপনি?

-এইতো,সদ্য বিবাহিত…

তাজীন কপাল কুচকে তাকালো নিরবের দিকে। চোখাচোখি হওয়ায় নিরবের বাকা হাসিটা দেখে তৎক্ষনাৎ চোখ সরিয়ে নিলো ও। বললো,

-আমি চলে যেতে পারবো বাসে।

নিরব দোয়ার দিকে এগিয়ে বললো,

-এবার আপনিই প্লিজ কিছু বলুন! ইনি আমার গাড়িতে না গেলে বাসায় ফিরলে বাবার সবগুলো মার আমার পিঠে তালপরার মতো পরবে।

দোয়া হাসলো মুচকি। তাজীনের কাধে হাত রেখে বললো,

-চলে যাও। তোমাদের ওদিকের ভার্সিটির বাস ছাড়া এখনো অনেক দেরি।

তাজীন আর কথা বাড়ালো না। গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো চুপচাপ। নিরব সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে বললো,

-থ্যাংকস্ ম্যাম।

-ম্যাম ডাকছেন কেনো? আমি আপনার বয়সে ছোটই হবো। নাম ধরেই ডাকুন।

-বলছেন?

-হ্যাঁ অবশ্যই।

-না থাক! স্যারকে আজ অবদি ভাইয়া বলে ডাকিনি। ম্যামকে আজই সরাসরি নাম ধরে ডাকা উচিত হবে না। অন্য কোনোদিন। আসছি। ভালো থাকবেন। ম্যাম!

নিরব গাড়ি স্টার্ট দিয়ে তাজীনকে নিয়ে চলে গেলো। অপ্রস্তুত হয়ে দাড়িয়ে রইলো দোয়া। নিরবের স্যারের সাথে ম্যামের হিসেবটা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো ওর। কিন্তু বাসের হর্ন শুনে সেটাকে ধামাচাপা দিয়ে বাসে উঠে বসলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। রায়নগরের বাসস্টপে নামতেই বাইকের হর্ন কানে আসলো দোয়ার। পুলকিত হয়ে পিছন ফিরলো ও। খুশি নিমিষেই গায়েব ওর। এক ছেলে বাইক নিয়ে দাড়িয়ে। হর্ন শুনে ওর ব্যাকসিটে এক মেয়ে এসে বসলো। চোখ ছলছল করছে,চুলকাচ্ছে দোয়ার। এই বুঝি টুপ করে অশ্রু বেরিয়ে আসে! এই বুঝি ওর কষ্টটা ধরা পরে যায় সবার কাছে। কিন্তু কেনো কষ্ট হচ্ছে ওর? ওর তো কষ্ট হওয়ার কথা না! আরাবের জন্য তো নয়ই! একটা জোরে শ্বাস ফেলে,দাতে দাত চেপে শক্ত হয়ে হাটা লাগালো মুখার্জীবাড়ির উদ্দেশ্যে।

-আরাব কোথায় গেছে মুফতাহির?

তৌফিকার কথা শুনে টাই বাধতে গিয়ে থেমে গেলো মুফতাহির। শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো ও তৌফিকার দিকে। ছলছল চোখে মুফতাহিরের এলোমেলো টাইটার দিকে তাকিয়ে রইলো তৌফিকা। দোয়ার মেডিকেল টেস্টের বিষয়ে আরাবকে বলা ঘটনায় ওদের দুজনের সম্পর্কে দুরুত্ব এসে গেছে অনেকটাই। এই টাই বাধার কাজেও বাধা পরে ওর। দুদিন হলো ভাইয়ের কোনো খোজ মিলছে না বলে আরো অস্থির হয়ে আছে তৌফিকা। কেদে কেদে চোখের নিচে কালি পরে গেছে ওর। সতেজ চেহারা বিষন্নতায় ছেয়ে গেছে। মুফতাহির বললো,

-তোমার ভাই কোথায় যাচ্ছে সেটা কি ওর আমাকে বলে যাওয়ার কথা তৌফিকা?

-গেলে তো তোমাকেই বলে যেতো মুফতাহির!

-এবার বলে যায়নি!

কথা শেষ করে টাই বাধায় মনোযোগ দিলো মুফতাহির। অন্যান্য দিন এই টাই কোনোরকমে প্যাঁচ দিয়ে বাসা ছেড়েছে। কিন্তু আজ তৌফিকা সামনে দাড়িয়েছে। ওকে দেখানো দরকার,ও টাই‌ বাধতে পারে। তৌফিকা সব ভুলে হাত লাগালো মুফতাহিরের টাইয়ে। দু দন্ড স্থির দৃষ্টি বিনিময় হলো দুজনের। টাই বাধতে বাধতে তৌফিকা বললো,

-দোয়াকে তো দেখলে। তোমার মনে হয়না আমরা ভুল মুফতাহির?

-মানুষের বাইরেরটা দেখে ভেতরেরটা চেনা যায় না তৌফিকা।

তৌফিকা অসহায়ের মতো একটা জোরে শ্বাস ফেললো। মুফতাহিরের বুকে দুহাত রেখে বললো,

-ইদানিং তোমাকে দেখে আমার এই কথাটা কেনো মনে হয় বলতে পারো?

বড়বড় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো মুফতাহির। তৌফিকা ওর এক গালে হাত রেখে করুনভাবে বললো,

-এতো অচেনা কেনো হয়ে যাচ্ছো মুফতাহির? তুমি তো এমন ছিলে না। তোমার মাঝে এক অন্য মানুষকে কেনো খুজে পাই আমি মুফতাহির? এমন কেনো হচ্ছে?

গাল থেকে তৌফিকার হাত সরিয়ে দিলো মুফতাহির। অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,

-কারন তুমি তোমার ভাইকে ভালোবেসে অন্ধ হয়ে গেছো। বাস্তবতা চোখে পরছে না তোমার।

-মানে?

-মানে এটাই,তুমি ভুলে যাচ্ছো আরাবের সাথে বিয়ের পর দোয়া রংধনুতে আসবে! ওকে সবাই তৌফিক ওয়াহিদের ছেলেরবউ‌ হিসেবে জানবে! বিয়ের পর যদি কোনোভাবে প্রমান হয়,দোয়া..দোয়া এটাক্টড্,তোমার বাবার মান সম্মানটা ঠিক কোথায় গিয়ে দাড়াবে সেটা বুঝতে পারছো তুমি? বোঝার চেষ্টা করেছো?

-কিন্তু মুফতাহির,দোয়া এটাক্টড্ না!

-সেটা তুমি মানো,আর কেউ মানবে না!

-আর কারো মানাতে কি যায় আসে?

-আমার যায় আসে! তোমার বাবার যাবে আসবে! এখনো অবদি আমি বাবাকে কিছু বলিনি এটা ভেবে,আরাব নিজের ভুল বুঝতে পারবে। একটা মেডিকেল টেস্ট করানোরই তো ব্যাপার! তারপরই…

তৌফিকা পিছিয়ে গেলো। শক্ত গলায় বললো,

-তুমি যদি এই বিষয় নিয়েই পরে থাকো,আমার আর কিছু বলার নেই। আরাব দোয়াকে ভালোবাসে,দোয়াকেই বিয়ে করবে! আমি ওর বিপরীতে আর কোনো কথাই চাইনা!

-কিন্তু তোমার বাবার দিকটাও ভাবা উচিত!

-কেনো ভাববো? শুধুই সন্দেহের জেরে? আর যদি দোয়া এটাক্টড্ হয়ও,আমি গর্ব করবো আরাবকে নিয়ে!

মুফতাহির রাগে অন্যদিক তাকিয়ে সামলালো নিজেকে। তারপরও চেচিয়ে বলে উঠলো,

-ওকে ফাইন! থাকো তোমরা দু ভাইবোন নিজেদের চিন্তাভাবনা নিয়ে! আই ডোন্ট থিংক আমি তোমাদের এ বিষয়ে সাপোর্ট করতে পারবো! আর হ্যাঁ,আমি খুব তাড়াতাড়িই দোয়াকে নিয়ে বাবার সাথে কথা বলবো। আমাদের মাঝে কোনোরকম মিস আন্ডার্স্ট্যান্ডিং চাইনা আমি ওকে নিয়ে! তুমি ভেবে নাও ঠিক কার সঙ্গ দেবে। ভাইয়ের? নাকি রংধনুর বাকি সবার?

টাইটা খুলে মেঝেতে ফেলে দিয়ে মুফতাহির বেরিয়ে গেলো। পাথর হয়ে দাড়িয়ে কাদতে লাগলো তৌফিকা। ভাগ্যিস টুইঙ্কেলটা স্কুলে ছিলো। বাবার এই রুপটা একদমই মানতে পারতো না ও। আজ প্রথমবার মুফতাহির এই গলায় কথা বলেছে ওর সাথে। যে মুফতাহির কিনা প্রতিবার মনোমালিন্যের পর নিজে থেকে সরি বলতো,সে আজ এভাবে কথা বলে গেলো ওর সাথে। কাদতে কাদতে একসময় মেঝেতে বসে পরলো তৌফিকা। বলতে লাগলো,

-কোথায় চলে গেলি তুই আরাব? তোর অনুপস্থিতিতে যে সবটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে! আমার উপর অভিমান করেছিস বলে নিজেকে কেনো গুটিয়ে নিলি তুই? এই পরিস্থিতিতে তো তোকেই দরকার। বাবা একবার সবটা জানলে যে কোনোদিনও দোয়া রংধনুতে আসতে পারবে না। স্বয়ং মুফতাহির বুঝাবে তাকে। আমার সংসারটা যাই হোক,আমি তোর ভালোবাসায় আচ দেখতে চাইনা আরাব। প্লিজ ফিরে আয় ভাই! প্লিজ ফিরে আয়!!!

#চলবে…
#চলবে…
#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here