এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব -২০

#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২০
সকাল সকাল ক্লাস শেষ হওয়ার পর যখন তিতিররা লাইব্রেরিতে পড়ছিল তার আধাঘণ্টা খানিক সময় পর সাইফের কল আসলো। তিতির ফোন রিসিভ করে জানতে পারল, আর আধাঘণ্টার মধ্যে ট্রাক মালামাল নিয়ে পৌঁছে যাবে। তিতির যেনো সেখানে থাকে। কিন্তু সমস্যা হলো যে, ট্রাক আসার কিছুসময় পর তিতিরের ক্লাস শুরু হবে তাই সে কিভাবে থাকবে বুঝে পাচ্ছে না। এখন সে তো বাড়িওয়ালাকেও চিনে না। তিতির চিন্তিত স্বরে বলল,

“ট্রাক কি আমার জন্য দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করবে? নাকি আমি ক্লাসটাই করব না। বাড়িওয়ালার সাথেও তো আমার কথা হয়নি।”

বন্ধুরা ভাবতে থাকলে ইমরান বলে ওঠে,
“তুই চিন্তা করছিস কেনো? এক কাজ করি, যারা বাসা ভাড়া ঠিক করেছে তাদেরকে বল।”

“তারা কী করবে?”

“আরে বাড়িওয়ালাকে বলে রাখবে তারপর ট্রাক থেকে মালামাল রাখবে।”

তিতির লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
“উনাদের সাথে কথা বলতে গেলে আবার যদি ইনায়া আপু কিছু করে?”

“কাল তো ভাইয়া সব ক্লিয়ার করে দিয়েছে। কিছু হবে না। এই ইমরান, রণক ভাইদের কল লাগা। তারা মেবি এখন রাউন্ডে আছে।”

জারিনের কথায় রণক কল লাগায় অর্ককে। অর্ক রিসিভ করলে রণক সালাম দিয়ে বলল,

“ভাই, একটা হেল্প লাগত।”

“হ্যাঁ বল।”

“তিতিররে যে বাসা ভাড়া খুঁজে দিছেন, সেখানে ট্রাকে মালামাল আসবে। তিতিররের তখন ক্লাস আছে। ইম্পরট্যান্ট ক্লাস। আপনারা যদি বাড়িওয়ালাকে একটু বলে দিতেন?”

“আচ্ছা সমস্যা নাই। তিতিরকে বল প্যারা না নিতে। আমরা আছি। সব ম্যানেজ হয়ে যাবে।”

রণকের মুখে হাসি ফুটে ওঠল।
“ধন্যবাদ ভাই। আসসালামু আলাইকুম।”

অর্কও হেসে সালামের জবাব দিয়ে কল কে*টে দেয়। রণক তিতিরকে বলল,
“দোস্ত, চিন্তা করিস না। ভাইরা সামলে নিবে। তুই ক্লাসটার পরে লাঞ্চ ব্রেকে দুই ঘণ্টার মতো পাবি। তখন সবাই মিলে গিয়ে যা করার করে আসব।”

তিতির যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সবাই তাকে এতো সাহায্য করছে যা তার কাছে স্বপ্নের মতো। সে বলল,
“এখানকার সবাই এতো ফ্রেন্ডলি যে বারবার আমি নিজেই অবাক হই! আমার জীবনেও ভালো কিছু আছে ভাবতেই নিজেকে সুখী মনে হয়।”

নাদিয়া কিছুটা রম্যস্বরেই বলে ফেলে,
“কেনো রে? তোর জীবনে আর কিসের দুঃখ?”

ফাইজা নাদিয়কে সাবধানী চি*ম*টি কা*টে। চোখ দিয়ে ইশারা করে। নাদিয়া চোখ-মুখ খিঁচে নিয়ে দ্রুত বলে,
“সরি সরি। আমি হুট করে মজার ছলে বলে ফেলেছিলাম। আঙ্কেল ও তোর ভাইয়ার কথাটা মা*থা থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিল। আমি বড়ো বোকামি করে ফেলেছি। সরি দোস্ত। মাঝেমধ্যে এমন হয়ে যায় আমার। আমি সবসময় চি*ল মুডে থাকি তো। প্লিজ রাগ করিস না।”

তিতির মলিন হাসলো। এখানকার কেউ জানেনা তিতির বিধবা! তিতিরই জানায়নি অবশ্য। চায় না জানাতে। তিতির বলল,
“বাদ দে। পড় এখন।”

তিতির আর কথা না বলে বইয়ের পাতায় মনোযোগ দিল। লিরা পাশ থেকে তিতিরকে এক উষ্ণ আলিঙ্গন দিয়ে নিজেও পড়তে শুরু করল।

__________

ক্লাস শেষে লাঞ্চ ব্রেকে তিতির ও তার বন্ধুরা ভাড়া বাসার কাছে যায়। ট্রাক থেকে মালামাল নামিয়ে রেখে কিছুটা জায়গা মতো রেখেও গেছে মানে খাট দুটো দুই রুমে ঢুকিয়ে পায়া লাগিয়ে গেছে। তিতির এবার ইমরান ও রণকের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে কিউট হাসি দিয়ে বলল,

“ভাই! একটু জায়গা মতো সরিয়ে দে প্লিজ। বেশি কিছু না, দুটো খাট, দুটো আলমারি, সোফাটা, ডাইনিং টেবিলটা আমি যেখানে বলব নিয়ে দিবি। বাকি কাজ আমরা বাকিরা করে ফেলব।”

ইমরান সেন্টি খেয়ে বলে,
“ওহ এইজন্য তুই আমাদের নিয়ে আসছিস? তখন তো মা*থায় আসেনি।”

ফাইজা হাই তুলে বলল,
“তোদের এনেছিই এই কারণে। যা জলদি জায়গা মতো টেনে দে। তাও তো খাটগুলো সেট করে দিয়ে গেছে। আবার রুম অনুযায়ী বসিয়ে দিয়ে গেছে। নাহলে এই আ*কা*ইম্মা গুলাতে গো*লমা*ল করে ফেলত।”

রণক ও ইমরান বাঁকা নজরে মুখ গোমড়া করে তাকায়। যখন দেখল বান্ধবী গুলো পাত্তা দিলো না তখন কাজে লেগে পরলো। এদিকে ঘর মুছতে হবে আর কষ্ট হবে এটা নিয়ে কথা বলতে বলতে জুলিয়া ওয়াশরুমে একটা ছোটো বালতি দেখে, বালতি ভরে পানি ঘরে ঢেলে দেয়!

সবাই অবাক হয়ে যায়। জারিন চেঁচিয়ে বলল,
“কী করলে জুলি! এখন তো পুরো ঘর কাঁদা কাঁদা হয়ে যাবে।”

জুলিয়া নিজের কাজের কারণে লজ্জিত হয়। মাথা নিচু করে বলল,
“সরি। অ্যাই ওয়ান্ট টু হেল্প বাট…”

তিতির কিছু বলতে যাবে তখনি ফাইজা বলল,
“ইটস অকে জুলি। এতো ময়লাযুক্ত ঘর হাতে মোছাও সহজ না। খাটগুলো ঠিক করে সেট হওয়ার পর তোশকগুলো বিছিয়ে তারপর ঘরটাতে পানি ঢেলে দিব।”

তিতিরও বলে,
“হ্যাঁ এটাই ভালো হবে। চল তাহলে আমরাও সোফাটাকে জায়গা মতো নিতে চেষ্টা করি। আর কেউ একজন বাড়িওয়ালার কাছে গিয়ে দুইটা শ*লার ঝা*ড়ু নিয়ে আয় তো। লাগবে ওগুলো।”

নাদিয়া কাজে ফাঁকি দিতে বলল,
“আমি যাই। ততক্ষণে তোরা সব ঠিক করে ফেল।”

জারিন বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“যা কা’ম চো*র!”

নাদিয়াও মুখ ভে*ঙিয়ে চলে যায়। ওরা সবাই মিলে খুব কম সময়ে জিনিসপত্র গুলো সেট করে নেয়। তারপর দুইটা ফ্যান লাগিয়ে, বাকিসব গুঁছিয়ে ঘরে পানি ঢেলে পরিষ্কারও করে নেয়। এক ঘণ্টা হওয়াে আগেই কাজ শেষ। একেকজনের কোমড় ধরে গেছে তাই বিছানা, সোফাতে রেস্ট করছে। লিরা বলল,

“তিটির শুনো, রেফ্রিজারেটর তো নেই। খাবার রাখবে কই?”

“ওটা অনেক পুরোনো বলে বে’চে দিয়েছি। নতুন করে কমের মধ্যে কিনব।”

লিরা মাথা দুলায়। পাঁচ-দশ মিনিট রেস্ট করে মেডিকেলে ফিরে যায়। মেডিকেলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে লাঞ্চ ব্রেক প্রায় শেষের দিকে। ক্লাস শুরু হতে পনেরো মিনিটের মতো আছে। ওরা ক্যান্টিন থেকে খাবার কিনে দ্রুত খেয়ে দৌঁড়ে ক্লাসে যায়। সবার মুখে প্রাণোচ্ছল হাসি। বন্ধুরা একসাথে কোনো মা*র খাওয়ার মতো কাজ করলেও তাতে আনন্দ আছে।

________

মহিমা বেগম কলেজ থেকে সাড়ে এগারোটার দিকে ফিরার পর থেকে মাশরিফ মায়ের সাথে রান্নাঘরে কাজে সাহায্য করেছে। মহিমা বেগম বারবার ছেলের দিকে চেয়ে হেসেছেন। এখন গোসল, নামাজ শেষে মা-ছেলে একসাথে খেতে বসেছে। খেতে খেতে মাশরিফ বলল,

“মা, আমি ময়মনসিংহ যাচ্ছি। আসতে রাত নয়টার বেশি বাজবে।”

“তোর কোনদিন এমন বাজে না তা বল!”

মাশরিফ হেসে বলল,
“তাও তুমি চিন্তা করব। তাই জানিয়ে গেলাম। সাথে কিন্তু অভী, রাতুল, রণিতকেও নিয়ে আসব।”

“আয় সমস্যা নাই। সব রান্নাই আছে।”

খাওয়া শেষে একটু রেস্ট করে মাকে একবার আলিঙ্গন করে নিজের জিপ গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পরে। সাথে তিতিরের জন্য গিফট গুলোও নিয়ে নেয়।

প্রায় চারটার দিকে সাত বন্ধু ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে একত্রে হয়। বহুদিন পর দেখা। নিজেদের মধ্যে ফা*জ*লামি শেষ করে ক্যাম্পাসে হাঁটতে থাকে। মাশরিফ চারদিকে নজর ঘুরাচ্ছে বলে রাতুল রম্যস্বরে বলে,

“মেজর মাশরিফ দ্যা প্রেমিক মাশরিফ! আপনার প্রেয়সী কোথায়? মুখদর্শন করাবেন না?”

মাশরিফ আনমনে জবাব দেয়,
“তারেই তো খুঁজতেছি রে! আমার নিজের হাতের বানানো কেক সে না খেলে তো তোরাও পাবি না।”

রণিত দুঃখী দুঃখী ভাব করে বলল,
“দেখলি তোরা! আমরা কতোদিন পর একসাথে হলাম, আর মেজর সাহেবের কোনো উচ্ছাস নাই! সে আমাদের গুনায় ধরল না!”

“হইছে থাম। নাহলে সবসময়ের মতে তোর কপালা চা*টা’ই জুটবে।”

কথাটা বলা শেষ করে সামনে কিছুটা দূরে তিতিরদের দেখল মাশরিফ।
“ওই তো। চল চল।”

মাশরিফই আগে এগিয়ে গেল। শুভ বলল,
“ওইযে পাইছে। এখন গিয়ে কথা তো আমি, অর্ক ও রাফিরে শুরু করতে হবে তা ভুলে গেছে বান্দা।”

“এই দাঁড়া। গিয়ে কী বলবি! ‘আজ আমার জন্মদিস তিতিরপাখি!’ এটা বলবি?”

রাফির ডাকে মাশরিফ থেমে যায় তারপর ওদের কাছে ফিরে এসে হাসার চেষ্টা করে বলল,
“তাইতো! তোরা চল আগে।”

“এইতো তুমি লাইনে আসছ। চল এবার।”

ওরা সাতজন একসাথে তিতিরদের সামনে গিয়ে একটু ভাব নিয়ে দাঁড়ায়। শুভ একটু ভাব নিয়ে বলে,
“কেমন আছো তোমরা?”

নাদিয়ার থেকে জবাব আসে, “আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো। আপনারা কেমন আছেন সিনিয়র ভাইয়ারা?”

“এইতো সবসময় আলহামদুলিল্লাহ্‌। আচ্ছা তোমাদের বাসায় মালামাল রাখার ঝামেলা মিটেছে?”

অর্কর প্রশ্নে তিতির কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে,
“জি ভাইয়া। সব মিটে গেছে। ধন্যবাদ আপনাদের।”

“যাক ভালো। আজ আমাদের আরও তিন ফ্রেন্ড আমাদের ক্যাম্পাসে এসেছে কারণ আজ মাশরিফের জন্মদিন।”

সবাই এটা শুনে মাশরিফকে উইশ করছে কিন্তু তিতির কপাল কুঁচকে মাশরিফকে দেখছে। এর চলনবলন, বেশভূষা তার কাছে সাধারণ লাগে না। তিতির হঠাৎ প্রশ্ন করে বসে,
“ভাইয়া, আপনি কি আর্মিতে আছেন?”

চলবে ইনশাআল্লাহ,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here