এক সায়াহ্নে প্রেমছন্দ পর্ব -৩১+৩২

#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩১
সন্ধ্যার চা-নাস্তা ও আড্ডা শেষে মহিমা বেগম বিশ্রামের জন্য নিজের ঘরে গিয়ে সবে বিছানায় কাত হয়েছেন তখনি রিতিকা হাজির। রিতিকা এসে মহিমা বেগমের পাশে বসে। মহিমা বেগম জিজ্ঞেসা করেন,
“কিছু বলবি?”

রিতিকা কিভাবে শুরু করবে তাই ভাবছে। মেয়ের থেকে কোন জবাব না পেয়ে মহিমা বেগম বলেন,
“হাঁটুতে খুব ব্যথা করছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রান্না করতে হয়েছে যে। সাথে কোমর ব্যথাতো আছেই!”

রিতিকা এবার বলে,
“মা আমি তোমাকে মুভ লাগিয়ে দেই? ”

“দিবি? দে তাহলে।”

রিতিকার ওয়ার্ড্রপের ড্রয়ার থেকে মুভ মলম বের করে মায়ের হাঁটুতে ও কোমরে লাগিয়ে দিতে দিতে বলে,
“মা, ভাইয়ের বিয়ের জন্য কিছু ভাবলে?”

মহিমা বেগম একটু আরাম পেয়ে চোখ বুজেই জবাব দেন,
“এখনো ভাবিনি। ওর যখন বিয়ে করার হবে তখন তো বলবেই। ”

“তা বললে কি হয় মা! ও তো এখন ভালো চাকরি করে। সেখানে পদোন্নতিও হয়েছে। এখন তো তার বিয়ে করার দরকার। তাছাড়া তোমার বয়স হয়েছে, আমিও দূরে থাকি। তুমি কোয়াটারে একা একাই থাকো। সাথে যদি ছেলের বউ থাকে তাহলে তো আর সমস্যা হয় না। ওদিকে মাশরিফেরও তো টেনশন হয়। বিয়ে করে বউ এখানে রেখে গেল, তারপর ওরও ওইখানে টেনশন কমলো আর তুমিও একজন সঙ্গী পেলে।”

“কথাটা মন্দ বলিসনি। কিন্তু ওরও তো একটা প্রিপারেশন আছে। যখন মনে হবে বলবে। আমার চাকুরি যতোদিন আছে ততোদিন আমি একাই সামলে নিব।”

রিতিকা তার মায়ের কথা শুনতে নারাজ। সে নাছোড়বান্দার মতো বলে,
“আমারও তো চিন্তা হয়। তোমার জামাইয়ের চাকুরির জন্য এসে থাকতেও পারিনা, আবার তোমার চাকুরির জন্য তোমাকেও নিতে পারিনা। মাশরিফের বিয়েটা এবার এলে দিয়ে দিলে ভালো হয়। আর মেয়ে তো আমাদের কাছেই আছে! চেনা জানার মধ্যে!”

রিতিকার প্রস্তাব শুনে মহিমা বেগম ভ্রুঁ কুঁচকালেন। অতঃপর চোখ খুলে মেয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
“বুঝলাম না! তুই কি তিতিরের কথা বললি?”

মায়ের হঠাৎ করে তিতিরের প্রসঙ্গ তোলাতে রিতিকা অবাক হয়। সে উত্তরে বলে,
“তিতিরের কথা কেন বলতে যাব? আমি তো কাশফার কথা বলছিলাম।”

“কাশফা!”

মহিমা বেগমের হতচকিত পতিক্রিয়াতে রিতিকা সন্দিহান কণ্ঠে শুধায়,
“তুমি হঠাৎ তিতিরের কথা কেন বলছ? ও তো বিবাহিতা। আবার বিধবাও! একজন বিধবার সাথে আমার ভাইয়ের বিয়ের কথা কেন বলব?”

মেয়ের প্রত্যুত্তরে মহিমা বেগম মোটেও সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বললেন,
“কেন? বিধবা হয়েছে তো কি হয়েছে?”

রিতিকার যেন কৌতুক পেল! সে হাস্যরসে বলল,
“বিধবা হয়েছে তাতে তো কোন সমস্যা নেই। কিন্তু আমার ভাইয়ের জন্য বিধবা মেয়ের কথা আমি কেনই বা বলব? আমার ভাই কি কোনো দিক দিয়ে কম? রাজপুত্রের মতো ভাই আমার। ওর জন্য তো রাজকন্যাই খুঁজব।”

“রাজকন্যা বলতে কাশফা?”
“হ্যাঁ।”

মেয়ের কথায় মহিমা বেগম তাচ্ছিল্য হাসলেন। অতঃপর বললেন,
“তোমার ভাই মেজর, তাই নাহয় রাজপুত্র বলছ। তবে কাশফা কী করে? সে কী এমন করেছে যার কারণে তাকে রাজকন্যা বলছ? প্রতিটা মেয়ে তার বাবা-মায়ের কাছে রাজকন্যা কিন্তু অন্য কারও কাছে রাজকন্যা মানে সে বিশেষ কিছু তো অবশ্যই! বলো? সে কী কোনো মহৎ কার্যসাধন করে ফেলেছে? যার দরুণ তুমি তাকে রাজকন্যা বলছ!”

রিতিকা থতমত খেয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে,
“আমি সেটা বোঝাইনি তো মা! আসলে…”

“আসলে কী? তোমার কথার ধরণ আমি বুঝতে পারছি না। যা বলবে স্পষ্ট করে বলবে। ঘোরপ্যাঁচ লাগানো কথা আমি বুঝি না।”

রিতিকা অবাক হচ্ছে। তার মায়ের কথার ধাঁচ হঠাৎ বদলে গেল কেন? তা সে বুঝতে পারছে না।
“মা, তুমি এভাবে বলছ কেন? কী হয়েছে তোমার? তুমি কি কোনো কারণে আমার উপর রেগে আছ? আমি কি ভুল কিছু বলেছি? ”

“তোমার কী মনে হয়?”

রিতিকা কিয়ৎক্ষণ হতভম্ব দৃষ্টিতে মায়ের দিকে চেয়ে থাকে। তারপর বলে,
“আমি যদি ভুল কিছু বলি তাহলে বলো।”

“সে নাহয় পরে বলব। আগে তুমি তোমার কথা শেষ করো। যা বলতে এসেছ শুধু সেটুকুই বলো।”

রিতিকা লম্বাশ্বাস ফেলে বলে,
“তুমি তো জানো মা, কাশফা ভাইকে পছন্দ করে। তাছাড়া ও চেনা-জানার মধ্যে ভালো মেয়ে। আর পরিবারও ভালো। তাই বলছিলাম কি, ভাই ও কাশফার বিয়ের কথা যদি আগানো যায়!”

এবার মহিমা বেগম বললেন,
“এইতো, সরাসরি বলেছ।”

মায়ের প্রত্যুত্তরে রিতিকা কিঞ্চিত খুশিও হয় কিন্তু পরক্ষণেই তার হাসি মিলিয়ে যায়। মহিমা বেগম বলেন,

“আমার জবাব হচ্ছে, না! কাশফা তোমার কাছে ভালো মেয়ে মনে হয় কিন্তু আমার ও মাশরিফের কাছে ভালো মেয়ে কিনা তা তো তুমি জানো না। তাছাড়া তোমার পছন্দ হলেই তো হবে না! যে বিয়ে করবে তারও তো পছন্দ হতে হবে। তার পছন্দই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। মাশরিফ সাফ সাফ মানা করে দিয়েছে সে কাশফাকে বিয়ে করতে চায় না। কাশফাকে ওর পছন্দ না। ওর অন্য কোথাও পছন্দ আছে। তাই তুমি কাশফার কথা কখোনো না তুললেই আমি খুশি হব।”

রিতিকা হতবাক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে চেয়ে আছে। তার মা এই মুহূর্তে কী বলল তা সে বুঝতে পারলেও মেনে নিতে পারছে না। সে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না।

“তুমি সত্যি বলছ মা? মাশরিফের সত্যিই কি অন্য কোথাও পছন্দ আছে?”

“হ্যাঁ। আমি তোমাকে মিথ্যে বলতে যাব কেন? তোমাকে মিথ্যে বলে আমার কি লাভ ! ”

রিতিকা চুপ হয়ে কিছুটা সময় বসে রইল। মহিমা বেগম মেয়ের মুখচ্ছবির প্রতিক্রিয়া দেখে আর কিছু বললেন না। ক্লান্তিতে তার ঘুমে ধরে যাচ্ছিল। কিন্তু এখন মেয়ের কথাতেই ঘুম উড়ে গেছে। আজানের ধ্বনি ধরণীতে প্রতিফলিত হচ্ছে। মহিমা বেগম শোয়া থেকে উঠে অর্ধশোয়া হয়ে বসলেন।

আজান শেষ হলে রিতিকা হুট করে জিজ্ঞেসা করে,
“যদি ভাইয়ের অন্য কোথাও পছন্দ থেকেই থাকে, তাহলে তুমি একটু আগে তিতিরের কথা কেন বললে?”

মহিমা বেগম আর কথার ঘোরপ্যাঁচ চাইলেন না। তিনি এবার সরাসরি জবাব দিলেন,
“তিতিরকেই মাশরিফ পছন্দ করে। আমাকে সেটা ও জানিয়েছেও।”

রিতিকা যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মহিমা বেগম আবার বললেন,
“তিতির বিধবা এটা জেনেই আমার ছেলে ওকে ভালোবেসেছে। তাই তিতিরকে কোনো রাজকন্যা না হলেও চলবে। তিতির যেমন, ওকে আমার ছেলে তেমনি ভালোবেসেছে। তোমার এতে আপত্তি থাকলেও কিছু করার নাই। আমারও তিতিরকে বেশ পছন্দ হয়েছে। তোমার যদি আর কিছু বলার থাকে তবে বলতে পারো তবে কাশফার ব্যাপারে না এবং তিতিরকে কেনো পছন্দ করল সেটার ব্যাপারেও না। সারাদিনে আমি অনেক ক্লান্ত।”

মায়ের কথার ধাঁচ বুঝে রিতিকা চুপচাপ উঠে আসল। নিজের ঘরে এসে বিছানায় মাথা নিচু করে বসল। সায়ান চোখের উপর হাত দিয়ে শুয়েছিল আর রিয়ান ড্রয়িংরুমে কার্টুন দেখছে।
রিতিকার উপস্থিতি টের পেয়ে সায়ান ওই অবস্থাতেই জিজ্ঞেসা করে,

“কী বলল মা?”

রিতিকা শুনেও কোনো জবাব দেয় না। প্রায় মিনিট খানেক সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সায়ান জবাব না পেয়ে উঠে বসে। তারপর স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে মৃদু কণ্ঠে শুধায়,

“কী হলো? এমন থম মে*রে বসে আছ কেনো? মা কী বললেন? রাজী না?”

রিতিকা সায়ানের দিকে ঘুরে তাকালো। রিতিকার চোখের ভাষাতে সায়ান হতাশা দেখতে পেল। সায়ান উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেসা করে,

“বলো না? কী বলেছে মা?”

“কাশফাকে মায়ের ও ভাইয়ের পছন্দ না। তাদের ওই বিধবা তিতিরকে পছন্দ!”

সায়ান কিঞ্চিত অবাক হয় কিন্তু রিতিকার কণ্ঠে হতাশার সম্পূরক তাচ্ছিল্যতাও প্রতিয়মান।
“আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম। কাশফার কথা বলো না। কিন্তু তিতিরকে পছন্দ শুনে অবাক হলেও ভালো লাগছে। মেয়েটাকে দেখে ও জীবনে ঘটে যাওয়া সব শুনে মনে হলো, মেয়েটার সহ্যশক্তি মাশাআল্লাহ। ওর সাথে ভালো কিছু হোক তা আমি মন থেকে চাই। মাশরিফও যে ওকে পছন্দ করে তাতে গর্ববোধ হচ্ছে যে আমার শ্যালকের চিন্তাধারা গতানুগতিক ধারার থেকে ভিন্ন।”

রিতিকা তার স্বামীর থেকে এরূপ জবাব আশা করেনি। আজ সবাই তাকে হতাশ করছে। রিতিকা এবার রূঢ় স্বরে বলল,
“ওই মেয়েটার বিয়ের পরপরই স্বামী নিঃখোঁজ হয়ে মা*রা গেছে। তারপর বাবা, ভাই, শ্বশুর সবাই একে একে অল্প সময়ের ব্যাবধানে পরলোকগমন করেছে। তাহলে বুঝতে পারছ?”

সায়ান ভ্রুঁকুটি করে বলে,
“কী বুঝব?”
“ওই তিতির নামক মেয়েটা একটা অল*ক্ষী! আমার ভাইয়ের জীবনে আসলে ওর জীবনটাও ধ্বং*স করে দিবে!”

রিতিকার এমন আকস্মিক উদ্ভট কথায় সায়ান কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে! এতো আধুনিক চিন্তাধারার রিতিকাও এসব বলছে! তার বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে।
#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩২
রাতের খাবারের শেষে তিতির গেস্টরুমে যাওয়ার সময় দেখল পাশের ঘরটা মানে মাশরিফের ঘরটা খোলা। উত্তেজিক সমীরণে রূপালি রঙের পর্দাগুলো উড়ছে। আজ অনিল যেনো একটু বেশিই আন্দোলিত! ঘরের ভেতর থেকে খুটখুট শব্দ আসছে। তা শুনে তিতিরের মনে কৌতুহল জন্ম নিলো। কৌতুহল বশত সে সেদিকেই অগ্রসর হলো। ঘরের ভেতরে গিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে যেখান থেকে শব্দের উৎস সেদিকে গিয়ে দেখে রিতিকার ছেলে রিয়ান আলমারির পেছনে উুঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। তিতির সামান্য ভ্রুঁকুটি করে বাচ্চাটাকে জিজ্ঞাসা করে,

“কি করছো তুমি বাবু? ”

কারো কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে রিয়ান হকচকিয়ে পেছনে ঘুরে তাকায়।
“আমার রিমোট কন্ট্রোল আর্মি ট্র্যাকটা মামার আলমারির নিচে চলে গেছে। ওটার এন্টেনার সাথে কিছু একটা বেজে গেছে। আসছে না।”

“আচ্ছা আমি এনে দিচ্ছি। ”

এই বলে তিতির রিয়ানকে সাইড করে নিজেই মেঝেতে বসে আলমারির নিচে হাত দিয়ে উঁকিঝুুঁকি দিয়ে অনেক কষ্ট করে রিয়ানের আর্মি ট্রাকটা আনতে সমর্থ হয়। ট্রাকটা হাতে পেয়ে রিয়ান তো বেজায় খুশি। সে উৎফুল্ল চিত্তে লাফিয়ে বলে উঠল,

“থ্যাংকিউ আন্টি। তুমি খুব খুব ভালো আন্টি। ”

তিতির মুচকি হাসি দিয়ে রিয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“যাও এখন গিয়ে ঘুমিয়ে পরো। অনেক রাত হয়েছে। এখন আর খেলতে হবে না। ”

রিয়ান অবাক হয়ে বলল,
“মাত্রই তো সাড়ে নয়টা বাজে। এত তাড়াতাড়ি কে ঘুমায়? আম্মু এখন সিরিয়াল দেখছে তাই ঘুমাতে ঘুমাতে এগারোটা তো বাজবেই।”

“তোমার আম্মু সিরিয়াল দেখছে, তুমি তো আর দেখছো না। তুমি গিয়ে ঘুমাও।”

“না বাবা আম্মু যখন সিরিয়াল দেখে তখন আমি আর বাবা আম্মুর সামনে থাকি না আম্মু এক এক সময় এক এক রিয়েক্ট করে। ”

রিয়ানের অভিযোগের স্বর শুনে তিতির হেসে ফেলল। অতঃপর বলল,
“বাচ্চাদের বেশি রাত জাগতে হয় না। জলদি ঘুমিও পরো কেমন?”

রিয়ান মাথা দুলিয়ে হাসে। তিতিরও মুচকি হেসে চলে যেতে ধরলে ওয়ারড্রবের উপরে একটা মিডিয়াম সাইজের ডুয়েল ছবির ফ্রেম দেখে। ফ্রেমটাতে দুইজনকে আর্মি পোশাকে দেখা যাচ্ছে। তিতির হাত বাড়িয়ে ছবির ফ্রেমটা নিলো। একটাতে মাশরিফ আরেকটা ছবি একটু পুরোনো, কিন্তু ছবির লোকটাতে তিতির চিনতে পারছে না। দুইটা ছবির স্টাইল একই। দুইজনেই স্যালুটের ভঙ্গীতে দাঁড়ানো। ছবি দুটো দেখেই হঠাৎ কেনো জানি তার হৃদমাঝারে সূক্ষ্ম কম্পনের সৃষ্টি হয়। এক ধ্যানে ছবি দুটোর দিকে কিছুসময় নেত্র স্থির রাখে। এতো মুগ্ধতা ও শ্রদ্ধাবোধ যেনো শিরায় শিরায় অনুভূত হচ্ছে।

রিয়ান রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় পাশে তাকিয়ে তিতিরকে ছবির ফ্রেম হাতে দেখে বলে ওঠে,
“আন্টি, ওটা নানাভাই ও মামার ছবি। মামা খুব শখ করে ফ্রেম করে রেখেছে।”

রিয়ান বলাতে তিতির মুচকি হেসে ফ্রেমটা রেখে রিয়ানের কাছে এসে ঘরটা থেকে বের হতে নিবে তখনি রিতিকা আসে। রিতিকা গম্ভীর স্বরে রিয়ানকে বলে,

“তুমি এখানে কেন এসেছ? মানা করেছি না? যাও ড্রয়িংরুমে খেল গিয়ে।”

“আম্মু আমার গাড়িটা..”
“যাই হোক। যাও বলছি।”

শেষোক্ত কথায় ধ*মকে উঠলে তিতিরের কাছে খারাপ লাগে। রিয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে বের হয়ে গেস্টরুমে চলে যায়।

_______

সকালবেলা খুব তাড়াতাড়ি নাস্তা শেষে ওরা বেরোনোর জন্য প্রস্তুতি নেয়। মহিমা বেগম, রিতিকারাও ফিরে যাবে। ওদের বেরোনোর আগে সেখানে কাশফা এসে হাজির। কাশফা সবাইকে বের হওয়ার প্রস্তুতিতে দেখে অবাক হয়ে বলে,
“তোমরা চলে যাচ্ছ?”

কাশফাকে দেখে রিতিকা মাথা নিচু করে রাখে। মহিমা বেগম জবাব দেন,
“হ্যাঁ। এখনি চলে যাব।”

কাশফা মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বলে,
“আমি ভাবলাম তোমরা আজও থাকবে।”

এরপর মহিমা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আন্টি, তোমার তো আজকে ছুটি। তবে আজ চলে যাচ্ছ কেন?”

“রিয়ানের স্কুল আছে তাছাড়া আমরা এখানে একটা কারণেই এসেছিলাম।”

তারপর ওরা বেরিয়ে পরে। সারা পথ রিতিকা চুপ করে ছিল এবং তিতিরদের বিদায় দেওয়ার সময়ও কেমন গম্ভীর ও মৌন ছিল।

_______

সুজন, পলাশরা আজ টে*রো*রি*স্টদের ক্যাম্পে গিয়েছে আজ। টে*রো*রি*স্টদের একজন বলে ওঠে,
“কোনো খবর পেলে? আমাদের গু*প্তচ*র তো কিছু বলছে!”

“কী কইতাছে স্যার? আমরা ঢাকা থিকা কাইলই আইলাম তারপর আপনাগো খবর পাইয়া এহানে আইলাম। ওই আমার ময়নাপাখিডা যে কই গেছে খুঁইজাই পাইলাম না। তারপরে আবার পু*লিশের দৌঁ*ড়ানিও খাইছি।”

সুজনের কথা শুনে একজন বিরক্তি নিয়ে বলে ওঠে,
“তোমার ওই ময়নাপাখি না কোকিল পাখি যাই থাকুক ওইসব ভুলে যাও। কাজের কথায় আসো। একবার যখন আমাদের সাথে ইনভলভ হয়েছ, তখন আর নিস্তার নাই। মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের সাথে কাজ করতে হবে। সামনে মৃত্যু দেখলেও গা*দ্দা*রি করা যাবে না। কিন্তু তোমাদের স্বভাবে এখনও লয়ালিটি দেখা যায় না। নিজেদের নিজস্ব স্বার্থ নিয়ে পরে আছ! কাজের কথা ভাব! মোটা অঙ্কের টাকা তো ঠিকই নিচ্ছই। কাজের কাজ তো কিছু করো! তোমাদের বলা হয়েছিল, মেজর মাশরিফের পরিবারের খোঁজ খবর নিতে। কিন্তু তোমরা নিবে নিবে বলে আর নিলে না। তাই বাধ্য হয়ে আমরাই খোঁজ নিয়েছি। অনেক কিছুই জানলাম, এখন বোঝার বাকি।”

সুজন ও পলাশ আমতা আমতা করে মাথা নিচু করে নিল। ওরা নিজেদের গাফিলতির ব্যাপারে তো জানেই। তখন আরেকজন বলে,

“আরেকটা কাজ দিব। করতে পারবে?”

“জি স্যার পারুম। কন খালি।”

“টাঙাইলে দুইজন মেজরের বাড়ি। মেজর মাশরিফ ও মেজর অভী। শুনেছি ওরা বন্ধু। মেজর মাশরিফের পরিবার গতকালকে টাঙাইলে এসেছিল। তারপর আবার চলে গেছে। শুনেছি মেজর মাশরিফের মা মির্জাপুর থাকে আর বোন ঢাকায় থাকে। শুনেছি বনানীতে। এখন তোমাদের মির্জাপুর যেতে হবে।”

“স্যার মির্জাপুরের কোথায়?”

“ক্যাডেট কলেজের ভেতর।”

“কলেজের ভিতর কি ঢুকতে দিব?”

“ওখানে ঢোকা কষ্টকর তবে পেছনের দিকে একটা গেইট আছে যা দিয়ে লোকাল মানুষজন মাঝেমধ্যে যাওয়া আসা করে। পেছনের দিকেও দারোয়ান থাকে। জিজ্ঞেসা করে যেতে দেয়।”

“আচ্ছা স্যার। আপনেরা চিন্তা কইরেন না। আমরা এবার ঠিক মতো কাম করমু। এহন করতে হইব কি? মা*ই*রা লামু না-কি?”

টে*রো*রি*স্ট লোকটা দ্রুত বলে ওঠে,
“না না। একদম না। নজর রাখবে। মিনিটে মিনিটে খবর দিয়ে মেজর মাশরিফকে হাতের মুঠোয় আনতে হবে। আর হ্যাঁ। মেজর মাশরিফদের বাড়িতে কাল কয়েকজন গেস্ট এসেছিল। গুপ্তচর বলল, ওরা নাকি আগে কখোনো আসেনি। বাকি খোঁজ খবর নিতে হবে। দুইদিন আগেও আমাদের এক মেম্বার আর্মিদের গু*লি*তে নিহত হয়েছে। ওরা এখন সাইলেন্টলি অ্যাটাক করছে। তাই আমরা সিলেটের দিকে শিফট হতে চাইছি। চট্টগ্রাম, বান্দারবান, খাগড়াছড়িতে এখন ওদের টহল বেড়ে গেছে। ওখানে অপারেশন বেড়ে গেছে। তিন মাসে আমাদের তিন জন মেম্বার কমে গেছে। এসবের হিসাব তো আমাদেরই দিতে হবে। তাই নেক্সট টার্গেট সাধারণ মানুষদের সাথে মিলেমিশে চলা। সাধারণ ঘরে বিয়ে করা। আমাদের ন*কল জা*তীয় পরিচয়পত্র তো আছেই।”

পলাশ জবাব দেয়,
“চিন্তা কইরেন না স্যার। মনে করেন আপনাগো কাজ হইয়া গেছে।”

__________

সপ্তাহ খানেক পর। কাশফা এতোদিন রিতিকার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। ফোন বন্ধ পায় বারবার। আজ কল ঢুকেছে। সে অপেক্ষা করছে কখন রিতিকা ফোন রিসিভ করবে।
এদিকে রিতিকা এতোদিন পর নিজের সিমকার্ড লাগিয়ে কাশফাকেই ফোন করতে দেখে হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। অতঃপর বাধ্য হয়ে ফোন রিসিভ করল।

“এই রিতি আপু! কী হয়েছে তোমার? সেইদিনের পর থেকে ফোন বন্ধ কেন? কতোবার কল করেছি জানো? তোমাকে মেসেঞ্জারেও পাচ্ছি না।

রিতিকা আমতা আমতা করে মিথ্যে বলে,
“ফোন নষ্ট হয়েছিল। তাই আরকি!”

“ওহ আচ্ছা। শোনো, আন্টিকে বলেছিলে? কী বলল? কবে প্রস্তাব পাঠাবে? কয়েকদিন পর সেকেন্ড ইয়ারে উঠব, বাড়িতে বিয়ের কথা বলছে। আমি তোমার ভাইয়ের কথা বলে রেখেছি। এখন তোমরা প্রস্তাব পাঠালেই হলো।”

রিতিকা এবার গভীর শ্বাস ফেলে বলল,
“সরি কাশফা, মা রাজি না আর ভাইও না। মায়ের ও ভাইয়ের দুজনেরই তিতির মেয়েটাকে পছন্দ। ভাই মেয়েটাকে ভালোবাসে।”

কাশফা হতভম্ব হয়ে বলে,
“তিতির! মানে ওই দিন আসলো ওই মেয়েটা?”
“হ্যাঁ। বিধবা মেয়েটা। অবশ্য যেই দুটো মেয়ে এসেছিল মানে ননদ-ভাবী, দুটোই বিধবা। ননদটাই তিতির। ওকেই ভাইয়ের পছন্দ।”

“এজন্য বিধবা! তোমার ভাইয়ের পছন্দ এতো নিচে কেন? বিধবা মেয়েকে ভালোবেসে বসেছে! এই মেয়ের সাথে পরিচয় হলো কিভাবে? আর এতো বছর পর আন্টির বোনকে খুঁজে পাওয়া! তোমার ভাইকে সামলাও আপু!”

“কী করব বোন! শুনেছি তিতিরকে মাশরিফ চিনে মাশরিফের সিনিয়র মেজর রায়ান না রিহান যেন! সে নিঃখোঁজ হওয়ার পর তার বাসায় গিয়েছিল তখন থেকে।”

“নিঃখোঁজ মেজর! খবরের কাগজে পড়েছিলাম মনে হয়। যাই হোক, তোমার ভাইকে ওই মেয়ের থেকে দূরে করো। নয়তো আমিই করব। মাশরিফের জীবনটা নষ্ট করে দিবে মেয়েটা।”

কাশফার সাথে রিতিকাও একমত পোষণ করে। তারপর কথা বলা শেষে ফোন কে*টে দিলে কাশফা রেগে ব্যালকনির রেলিংয়ে থাকা কফির মগটা ফেলে দেয়। মেঝেতে পরে মগটা কয়েক টুকরোকে বিভক্ত হয়ে গেছে। একটা টুকরো হাতের মুঠোয় চেপে রেগে হিসহিসিয়ে সর বলে ওঠে,

“মাশরিফ আমার, নয়তো কারও না!”

চলবে ইনশাআল্লাহ,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here