এলোমেলো হাওয়া পর্ব -০২

#এলোমেলো_হাওয়া
#পর্ব_২
লেখিকা- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি

কপালে হাত ঠেকিয়ে চুপ করে বসে রয়েছে আদ্র। তার সামনেই বিছানায় ভয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে তীহা। আদ্র’র চোখ দিয়ে অগ্নি বেরোচ্ছে যেন। এ কোন উৎপাত ঘাড়ে এসে পড়ল কে জানে! নাকী মেয়ের মাথায় কোনো গন্ডগোল আছে,তাও তো অজানা! ভীষণ অস্থির চিত্তে উশখুশ করতে থাকলো আদ্র। সেই সাথে বাম হাতে অসহনীয় ব্যথা! কামড়টা বেশ জোরেসোরেই লেগেছে।
তীহা মিনমিন করে বলল,

“স..সরি।”

আদ্র তৎক্ষনাৎ খেঁকিয়ে উঠল,

“এই চুপ, একদম চুপ। প্রথমে চিৎকার,চেঁচামেচি করে আমার সম্মান নষ্ট করা, এরপর আমাকে কামড় দেওয়া! এসব কী! তোমার ভেতর বিড়ালের বৈশিষ্ট্য কেন মেয়ে?”

তীহা অপরাধী কণ্ঠস্বরে বলল,

“আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম। ভাবছিলাম আপনি আমাকে…”

“আমি তোমাকে কী? ছুঁতে আসবো? শোনো,এত যদি ছোঁয়ার তাড়া থাকত তবে এতক্ষণ পর্যন্ত আস্তো থাকতে না। গতকাল রাত থেকে ছোঁয়া তো দূর,তোমার দিকে ভালো করে তাকাইনি পর্যন্ত। তাকাইছি,বলো?”

তীহা ভয়ে ভয়ে ঘাড়টা এদিক ওদিক করল। সাহস করে বলতে পারল না,আপনি মিথ্যে কথা বলছেন। শুধু তাকানইনি, বেশ অনেকক্ষণ ড্যাবড্যাব করে চেয়ে ছিলেন যখন আমি কবুল বলেছিলাম। আমি স্পষ্ট দেখেছি তা… কিন্তু এই কথা বললে নির্ঘাত তাকে মারতে আসবে লোকটা,এই ভেবে চুপ করে গেল তীহা।

আদ্র একটু নিভলো। কর্কশ কণ্ঠে বলল,

“তোমাকে ছোঁয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই, এটা কানের ভেতর ঢুকিয়ে রাখো। আমার জায়গায় অন্য যে কেউ থাকুক, সে তোমাকে অতি অবশ্যই ছুঁতে চাইতো। আর এতে দোষের কিছুই নাই। তুমি বিবাহিতা এখন,তোমার স্বামীর অধিকার আছে তোমাকে স্পর্শ করার।”

“আপনি ভালো মানুষ, তাই বেঁচে গেলেন। অন্য কেউ আমাকে যদি জোর করতো,আমি তার মাথা ফাটিয়ে দিতাম, শিউর।”

আনমনে বিড়বিড় করলো তীহা,কিন্তু আদ্র সবটা স্পষ্ট শুনতে পেল। শুনতে পেয়ে তার চক্ষু চড়কগাছ। বলে কী এই মেয়ে! সে বলল,

“এই,এই তুমি কী বললে? আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে তার মাথা ফাটাতে?”

তীহা দাঁত দিয়ে জিভ কাটলো। আস্তে করে কথাটাও বলতে পারে না! যা বলে সব শুনে ফেলে এই লোক! কী যন্ত্রণা! তীহাকে নির্বাক দেখে আদ্র বিড়বিড়িয়ে স্বগতোক্তি করল,

“ভারী ডেঞ্জারাস চিজ তো তুমি!”

____
ট্রেডমিলের উপর মৃদু গতিতে দৌঁড়াচ্ছে অনিন্য। প্রায় আধঘন্টা যাবত এক নাগাড়ে দৌঁড়ানোর ফলে তার শরীর বেয়ে ঘাম ফোঁটা টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে। মালোতি কফি মগ হাতে বেডরুমে প্রবেশ করে এইধরনের দৃশ্য দেখামাত্রই বলে উঠল,

“তুমি কী এখনো ওকে ভুলতে পারো নাই?”

মালোতির কথা শুনে অনিন্য দৌঁড়ানো থামালো। মেশিন বন্ধ করে বাম হাতে তোয়ালে উঠালো। মুখ মুছতে মুছতে মুচকি হাসি ছুঁড়ে দিলো মালোতির প্রশ্নের উত্তরে। মালোতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে কম চেষ্টা করছে না,তবুও কেন যেন মনে হয়,তীহা-ই অনিন্যর ভেতরটা জুড়ে বসবাস করছে। আবার যখন কিছুদিন আগের ঘটনাটা মনে পড়ে যায়,তখন মনে হয়,না…অনিন্যর মধ্যে তীহার জন্য সামান্য পরিমাণেও ভালোবাসা নেই। ভালোবাসার মানুষকে আর যাইহোক,কেউ ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারে না! মালোতি নিজেকে বোঝায়,অনিন্য তারই,শুধুই তার। তীহা অতীত,মালোতিই বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ!

অপরদিকে অনিন্য কফি খেতে খেতে সোফায় গিয়ে বসেছে। রিমোট দিয়ে টিভি অন করতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল এক জোড়া সিংহ’র কামড়াকামড়ি দৃশ্য। দূর থেকে মালোতি দেখল,অনিন্য বেশ মনোযোগী দিয়ে সেই দৃশ্য দেখছে। কিন্তু অনিন্য’র বিন্দুমাত্র মন নেই এতে। তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে তীহা.. সে ইনফরমেশন নিয়েছে,তীহার গতকাল বিয়ে হয়ে গেছে। বুকের ভেতরটা জমাট বাঁধা কষ্টে বরফ হয়ে আছে। কাউকে সে দেখাতে পারছে না, শক্তিশালী অনিন্য আজ কতটা অসহায়,নিরুপায়! এমনকি তীহাকেও বোঝাতে পারেনি! অনিন্য কী ভুল করল? নাকী তীহাকে নিয়ে সুখের সংসার বাধার স্বপ্ন টা পূরণ করা যেতো আরেকটু সাহসী হলে?

____
“বেলা কয়টা বাজে?”

রুম থেকে বের হতেই নিরুপমা বেগমের এহেন প্রশ্ন শুনে হতবাক হয়ে পড়ে তীহা। সে জবাব দেওয়ার আগেই আদ্র পেছন থেকে বলে উঠে,

“সেটা তুমি ঘড়িতে দেখলেই তো পারো আম্মা। ও কী ঘড়ি? দাও,মেয়েটাকে খেতে দাও।”

নিরুপমা বেগম দুটো বকা দিতে যেয়েও দিলেন না। আশেপাশে আত্মীয় স্বজনরা টইটই করছে। সবার দৃষ্টি এবং মনোযোগ এদের দিকে। তাদের সামনে একটা হাঙ্গামা না করলেই হবে। সবাই চলে যাক,দুইদিনের বউয়ের উপরে এত মায়া কীভাবে জন্মে,তা তিনিও দেখে নিবেন পইপই করে। উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে নিরুপমা বেগম এগিয়ে চলে গেলেন। তীহা ফিসফিস করে বলল,

“আপনি বোধহয় আপনার আম্মাকে রাগিয়ে দিয়েছেন। এভাবে উনার সাথে তর্ক করেন কেন?”

আদ্র বোকা বনে গেল। এইটুকুন মেয়ে তাকে শেখায় কী করা উচিত আর কী করা উচিত না!

আদ্র উচ্চস্বরেই দায়সারাভাবে বলল,

“যার জন্য চুরি করি,সেই বলে চোর। আজব দুনিয়া!”

বলতে বলতে আদ্র ভবঘুরের ন্যায় ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তীহা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই বাড়িতে একেক জন একেক কিসিমের। তাকে যে কীভাবে মানিয়ে চলতে হবে,খোদাই জানেন! তীহার দু’চোখ মুহূর্তেই ভরে এলো। আজ যদি অনিন্য এমনটা না করতো,তবে হয়তো এসবের কিছুরই ফেস করতে হতো না তীহা কে।

____
তীহার বাবা মোজাম্মেল হক বাড়ির আঙিনায় বসে রয়েছেন। তার ঘরটা আজ ভীষণ শুন্য লাগছে। মেয়েটাকে যতই বকুক, ভীষণ ভালোও তো বাসেন! আফসোস, সেটা তীহা কক্ষনো বুঝবে না। কেন যেন তীহা বড্ড বদমেজাজি স্বভাবের হয়ে গিয়েছিল। বাবা-মায়ের প্রতিটি সিদ্ধান্ত কে পায়ে ঠেলে দিতো। তাদের প্রতি বিশ্বাস,আস্থা কিছুই করতে পারেনি সে। এমনকি বিয়ে দেওয়ার পর তীহা বলেছে,সে নাকী এই বাড়ি কখনো আসবে না। কখনো না…
কথাটায় কতখানি আঘাত পেয়েছে বাবা-মা,তা পরিমাপের আগেই তীহা চলে গেছে। মোজাম্মেল হক জানেন,আদ্র’র বয়সটা একটু বেশি হলেও পুরুষ হিসেবে সে যথেষ্ট ভদ্র এবং ভালো। তীহার পাগলামি, বাচ্চামিকে সামলাতে পারলে একটু বয়স্ক কারোরই প্রয়োজন। তীহাকে শুধু আগলেই রাখবে না,শাসনও করতে পারবে। এবার তীহা ওখানে মিলেমিশে যাক,এটাই কাম্য তার।

দারোয়ান একটা বড় বক্স হাতে করে আঙিনায় প্রবেশ করতেই মোজাম্মেল হকের চিন্তার গতি শ্লথ হলো। তিনি দূর থেকেই হাঁক ছেড়ে ডাকলেন,

“কাসেম,কীসের বাক্স?”

দারোয়ান কাসেম কাছে এসে বক্স নামিয়ে রাখলো। হাপাতে হাপাতে বলল,

“বড় আপার নামে আইছে।”

“তীহার নামে!”

দারোয়ানকে দিয়ে বাক্সটা ঘরের ভেতর নেওয়ালো মোজাম্মেল হক। একবার ভাবলো, খুলবে না। তীহার জিনিস,তীহা-ই সর্বপ্রথম দেখুক। হয়তো কেউ বিয়ের উপহার পাঠিয়েছে! পরক্ষণেই বাক্সের উপরের লেখাটা তার আগ্রহ কাড়লো। পরিষ্কার গুটিগুটি অক্ষরে লেখা,

“যেখানে সম্পর্কের সুতো নেই,সেখানে মুহূর্ত ও স্মৃতি গুলো গুছিয়ে রাখাটা বোকামি নয় কী? তাই সব পাঠিয়ে দিলাম অপ্রিয়!”

মোজাম্মেল হক তর সইতে পারলেন না। তিনি বাক্স খুলতেই এক গাদা চিঠি ছড়িয়ে পড়লে বিছানা জুড়ে। চিঠি গুলো তীহার লেখা,তা তিনি হাতের লেখা দেখেই বুঝতে পারলেন।

____
আহম্মেদ বাড়িতে আজ বৌভাত হওয়ার কথা থাকলেও তা একদিন পিছিয়ে আগামীকাল করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কমবেশি সকলেই বিয়ের ধকলে ক্লান্ত। তাই একটা দিন বিশ্রাম নিয়ে মন মতো বৌভাত করতে চাইছে। নিরুপমা বেগম ও মানা করলেন না,রাজী হয়ে গেলেন।

বারান্দায় উদাসী চোখে দাঁড়িয়ে রয়েছে তীহা। একটু আগে তার বাবা ফোন করে ভীষণ চিল্লাচিল্লি করেছেন। কোন ছেলের সাথে তার সম্পর্ক ছিল! সে চিঠিপত্র সহ নানা জিনিস পাঠিয়েছে- এসব নিয়ে কয়েক দফা কথা শুনিয়েছেন তীহাকে। তীহা জানে,এটা অনিন্য’র কাজ। অনিন্যকে সে প্রতিদিন একটি করে চিঠি লিখতো। এছাড়াও বিভিন্ন অকেশানে এটা ওটা উপহার দিতো। সেসব জমিয়ে বিয়ের পরদিন এভাবে তীহার বাড়ির ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া- এ কেমন কাজ অনিন্য’র। তবে কী তীহা শান্তিতে সংসার করুক,তা সে চায় না? না চাইলে কেন ছেড়ে দিলো? তীহা তো ইচ্ছাকৃতভাবে বিয়ে করেনি। অনিন্যই তাকে বাধ্য করেছে। তাকে ফেলে চলে গিয়েছে। ভাসমান তীহা এক পর্যায়ে হাপিয়ে উঠেছিল ভাসতে ভাসতে। তাই শিকড় হিসেবে আঁকড়ে ধরেছে আদ্র’র হাত। তাতেও কেন অনিন্য শান্তি দিচ্ছে না। কী চাচ্ছে অনিন্য!

“ভূতে ধরছে?”

পেছন থেকে আচমকা আদ্র কথা বলে উঠায় তীহা চমকে উঠল। পেছন ঘুরতে ঘুরতে আত্মরক্ষার্থে আদ্র’র গায়ে ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে পরক্ষণে নিজেই হতভম্ব হয়ে গেল। সে আসলে ভয় পেয়ে কাজটি করেছে। ইচ্ছাকৃতভাবে না, কিন্তু আদ্র কী আর তা বুঝবে? আদ্র’র বাহুতে চাপড় মারার জন্যে একদম স্থির হয়ে গেল সে। বোঝার চেষ্টা করল, এই মেয়ে আসলে কী! বিড়ালের ছদ্মবেশে মানুষ, নাকী সত্যিকারের ভূত!

(চলবে)
[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here