ওয়েডিং_স্টোরি পর্ব ৩

#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_৩
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

জমকালো গহনার দোকানে ভিতরে দাড়িয়ে আছে আভা, আহনাফ আর মিনহাজ। দোকানের চতুর্দিকে কৃত্রিম আলোয় ঝলমল করছে। মিনহাজ একপাশে দাড়িয়ে মোবাইলে কি একটা টাইপ করছে। কাউকে হয়তো মেসেজ করছে। আভা সাইড ব্যাগ আকড়ে ধরে আহনাফের থেকে দূরত্ব নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আহনাফ দোকানদারের সাথে কথা বলছে। একটু পর আহনাফ আভার দিকে এগিয়ে আসলো।

— ” কোনো আংটির ডিজাইন পছন্দ হয়েছে? ”

আহনাফ আভার দিকে তাকিয়ে বললো। এবার? আভা ত এখনও একটাও আংটি দেখেই নি। আহনাফ আবারও একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে আভা মাথা নাড়িয়ে না বোধক উত্তর করলো।
আহনাফ এতে ব্যতিব্যস্ত হলো। কোনো আংটিই পছন্দ হয়নি? আহনাফ বললো,

— ” তাহলে অন্য দোকান দেখি?চলো? ”

আভা চকিতে বললো,

— ” আরে না,না।আমি এখন পর্যন্ত কোনো আংটি দেখিনি। আপনিই দেখে পছন্দ করে কিনুন। ”

আহনাফ দুনো ভ্রুয়ে ভাজ ফেলে আভার দিকে তাকালো। এই মেয়েটা এত ইন্ট্রোভার্ট কেনো! আহনাফ বললো,

–” মিস বউফ্রেন্ড, এনগেজমেন্ট একা আমার না, তোমারও। তাহলে আমি কেনো একা দুজনের আংটি চুজ করবো? ”

আভা ব্যাগ খামচে ধরে আশপাশটায় চোখ তুলে তাকালো। মিনহাজ একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। এই ভাইয়ের দোকানে এসেও ফোন টিপতে হবে। অদ্ভুত! এখন ও একা একা কিভাবে কি করবে? আভা পড়লো মহা বিপদে। গহনা সম্পর্কে ওর খুব একটা ধারণা নেই। যদি ওর পছন্দ করা আংটি সুন্দর না হয় তবে আহনাফের পরিবার কতকিছু ভেবে নিবে? হায় আল্লাহ! কি বিপদ! আহনাফ আভার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ ছোটছোট করে আভার মতিগতি বুঝার চেষ্টা করছে। মেয়েটা কিছু বলছে না কেনো? আভাকে চুপ থাকতে দেখে আহনাফ ছোট্ট করে এক নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর বললো,

— ” ওকে দেন, চলো আমি চুজ করছি। ”

আহনাফ আভাকে নিয়ে আংটির সেকশনে গেলো। আহনাফ ভ্রু কুঁচকে ডিসপ্লেতে সাজানো সবগুলো একে একে আংটি পরখ করলো। কিন্তু একটাও তার পছন্দ হলো না। আহনাফ এবার সেলসম্যানকে বললো,

— ” আংটির ডিজাইন বুক আছে? ”

— ” জ্বি স্যার,আছে।”

সেলসম্যান একটা লম্বা করে বই বের করে আহনাফের দিকে এগিয়ে দিলো। আহনাফ বইয়ের একটার পর একটা পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে। আভা হতাশ হয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। এই ছেলেটা যে খুব চুজি সেটা ও এখন উপলব্ধি করতে পারছে। আহনাফ সম্পূর্ণ ডিজাইন বুক নিজে একবার দেখলো। সবগুলো পুরনো মডেল। আহনাফ ঠাস করে বই বন্ধ করলো। সেলসম্যানকে প্রশ্ন করলো,

— ” নতুন কোনো ডিজাইন এসেছে? আমরা আসলে এক্সক্লুসিভ কিছু চাচ্ছি। ”

আভা আহনাফের দিকে অবাক হয়ে তাকালো। এতগুলো ডিজাইন দেখেও একটাও পছন্দ হয়নি? কি চোখ!
আহনাফের প্রশ্নে সেলসম্যান খুব বিনয় নিয়ে বললো,

— ” স্যার,আছে। তবে এগুলো একটু দামী। দেখাবো? ”

আহনাফ ভ্রু বাঁকিয়ে বললো,

— ” আপনাকে আমি দাম নিয়ে চিন্তা করতে বলিনি। প্লিজ দেখান। ”

সেলসম্যান এবার উপর থেকে একটা বক্স বের করলো। বক্স ওপেন করে একটা আংটি বের করলো। আংটিটা অনেক মারাত্মক সুন্দর। আভা উজ্জ্বল চোখে আংটির দিকে তাকালো। আহনাফ আংটিটা নেড়েচেড়ে আভার দিকে এগিয়ে দিলো। জিজ্ঞেস করলো,

— ” এটা ঠিক আছে? ”
— ” আপনার ভালো লাগলে নিয়ে নিন। ”
— ” আমি তোমার ভালো লাগার কথা জিজ্ঞেস করেছি। আমার কথা বলতে বলিনি। ”

আহনাফের ভ্রু কুচকানো শীতল গলা শুনে আভা মাথা নেড়ে বললো,

— ” সুন্দর। ”
–” সিওর?অর্ডার দেই? ”
–“হুম। ”

আহনাফ আভার আঙ্গুলের মাপ দিয়ে আংটিটা অর্ডার দিয়ে দিলো।
গহনার দোকানের বাকি কাজ শেষ করে বেরিয়ে গেলো ওরা। আভা আহনাফ সামনে হাঁটছে। মিনহাজ পিছন পিছন ফোনে কথা বলতে বলতে হাটছে। আহনাফ হাঁটতে হাঁটতে আভার দিকে তাকালো। আভা মাথা নিচু করে নিচে তাকিয়ে হাঁটছে। অদ্ভুত! আহনাফ ভাবলো, এভাবে সামনে না দেখে হাঁটছে কেনো? যেকোনো সময় ব্যথা পেতে পারে এই মেয়ে। এতটা কেয়ারলেস! আহনাফ তাই বললো,

— ” নিচে তাকিয়ে হাঁটলে কোনো কিছুর সাথে ধাক্কা খেতে পারো। সোজা তাকিয়ে হাটো। ”

আভা মাথা তুলে তাকালো আহনাফের দিকে। আহনাফ সামনের দিকে তাঁকিয়ে পা ফেলছে। আভা বললো,

–” ফুটপাথে অনেক সময় পাথর, কাদা আরো কতকি থাকে। যদি ব্যাথা পাই? তাই নিচে তাকিয়ে হাটি। ”

— ” হাঁটার সময় সামনে পিলার, মানুষ আর কতকি থাকে। যদি ব্যথা পান? তাই সামনে তাকিয়ে হাঁটতে হয়। বুঝেছেন?”

আহনাফ অবিকল আভার কথা নকল করে বললো। আভা ফিক করে হেসে ফেললো ওমন কথা শুনে। আহনাফ একবার আভার দিকে তাকিয়েই নজর সরিয়ে ফেললো। এই মেয়ের হাসি মারাত্মক।এক হাসিতেই দিলে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। আহনাফ চোখ বুজে বুকে হাত দিয়ে কয়েকবার বিড়বিড় করলো,

— “অল’জ ওয়েল। অল’জ ওয়েল। ”

আভা আহনাফের দিকে খানিক অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। এমন করলো কেনো এই ছেলে? আহনাফ শান্ত হয়ে হাঁটতে শুরু করলে আভা প্রশ্ন করে,

— ” আপনার আবার কি হলো? ”

আহনাফ অসহায় কণ্ঠে শুধালো,

— ” একটু জন্যে হার্ট ব্লক হচ্ছিল। এখন ঠিক আছি। ”

আভা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকালো আহনাফের দিকে। বোকা কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,

— ” আপনি হার্টের রোগী? ”
–” মানে? ”
— ” একটু আগেই তো আপনি বললেন আপনার হার্টে ব্লক হচ্ছে।তাই জিজ্ঞেস করলাম। ”

আহনাফ আভার কথা শুনে বিস্ফোরিত চোখে খানিক চেয়ে রইলো ওর দিকে। চোখে তার নিদারুণ বিস্ময়। তার সমস্ত বিস্ময় সামনে থাকা এই মেয়েকে ঘিরে।অতঃপর আহনাফ আকাশের দিকে তাকিয়ে কি একটা বিড়বিড় করে আভাকে বললো,

— ” নাহ্! কিছু না। হাটো।”

যাক বাবা! এর আবার কি হলো?আহনাফের ওমন প্রতিক্রিয়া আভার ছোট্ট মাথায় ঢুকলো না। ও আনমনে এলোমেলো পা ফেলতে লাগলো ফুটপাথের রাস্তা ধরে।

____________________
রেস্টুরেন্টে এসে বসলো ওরা। আহনাফ আভাকে চেয়ার টেনে দিলে আভা খানিক অস্বস্তিতে পড়ে যায়। আহনাফ সেসব লক্ষ করে টিপ্পনী কেটে বললো,

— ” সামান্য চেয়ার টেনে বসতে বলেছি। এতেই এত! ”

আভা টিটকারী শুনে লজ্জায় নিজের নিচ ঠোঁট চেপে ধরে চুপচাপ চেয়ারে বসে গেলো। আহনাফ মৃদ হেসে আভার মুখোমুখি চেয়ারে বসলো। একটু পর মিনহাজ এসে আভার পাশের চেয়ারটায় বসে পড়লো।
অর্ডার দেওয়া শেষ। ইতিমধ্যে খাবার চলে এসেছে টেবিলে। এত খাবার দেখে আভার চোখ ছানাবড়া। এত খাবার কে খাবে? আহনাফ আর মিনহাজ পরস্পর কথাবার্তা বলে খাবার খাচ্ছে। আভা মাথা নিচু করে নিজের প্লেটের কাবাব বারবার হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখেছে। একটুও খেতে মন চাচ্ছে না। খাবার দেখেই বমি বমি লাগছে ওর। আহনাফ আর মিনহাজের এত জোড়ে জোড়ে কথা বলছে। তাদের কথাবার্তাই সম্পূর্ণ কেবিনটা মাতিয়ে রেখেছে। এত কথা ওরা পায় কোথায়?
” একের অধিক পুরুষ মানুষের একত্র আলোচনা ,পৃথিবীর সব বড়বড় পত্রিকাকেও হার মানায়।”
আপাতত ওদের দেখে আভার এই কথাই মনে হচ্ছে। আহনাফ কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে আভার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। আভা এতক্ষণে নামেমাত্র খাবার মুখে দিয়েছে। আহনাফ আভার দিকে কড়া চোখে তাকালো। এরকম খায় দেখেই এই মেয়ের আজ এই অবস্থা। একটু পর মিনহাজের ফোনে কল এলো। মিনহাজ কল অ্যাটেন্ড করতে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো।
মিনহাজ চলে যেতেই আহনাফ আচমকা টেবিলের উপর থাকা আভার বাম হাত আকড়ে ধরে। আভা রীতিমত চমকে যায়। চোখের আকৃতি দ্বিগুণ করে তাকায় নিজের হাতের দিকে। তার হাতটা আহনাফের দখলে দেখে চোখ ঘুরিরে আহনাফের দিকে তাকায়। আহনাফ ডান হাতে চামচ নিয়ে আরামসে বসে বসে খাবার খাচ্ছে।যেনো আভার উপস্থিতি এখানে নগণ্য। আর আভার হাত!ওর হাত তো এই জায়গায় নেই বললেই চলে। আভা এক ঢোক গিলে মিহি সুরে শুধায়,

— ” এইযে, আমার হাত। ”

আহনাফ মুখে খাবার চিবুতে চিবুতে আভার দিকে তাকালো। মুখখানা অবুঝ করে বললো,

— ” কি বললে? ”

আভা বিরক্ত হলো। সে কি খুব আস্তে বললো কথাটা? নাকি এই লোকটা শুনেও না শুনার ভান করলো? আভা এক দম নিয়ে তার হাতের দিকে ইশারা করে আবারও বললো,

— ” আমার হাত!”

আহনাফ আভার মুখের শক্তি ক্ষয় করে বলা বাক্যকে একনিমিশেই হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে এক চামচ বিরিয়ানি আভার মুখের সামনে ধরলো। আভা অবাক হয়ে চামচের দিকে তাকালে আহনাফ বললো,

— ” ও হাত কেটে পড়ে যাক। ওদিকে তাকানোর দরকার নেই। এখন তোমার নজর শুধুমাত্র আমার উপর আর এই বিরিয়ানির চামচের উপর থাকবে। নাও, বড় করে একটা হা করো তো, কুইক। ”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here