কথা দিলাম পর্ব -২০+২১

‘ কথা দিলাম ‘ 🌸❤️
||পর্ব ~ ২০||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

__ভিকি দা, ক্লাইন্ট এসে গেছে মিটিংয়ের জন্য। তুমি যাব…

মেয়েলি গলার স্বর পেয়ে সিয়ারা আর আধভিক দুজনেই হুঁশে ফিরলো এবং তৎক্ষণাৎ সরে দাঁড়ালো। হঠাৎই সিয়ারার মনে হলো, এই গলার স্বর ওর পূর্ব পরিচিত। গলার স্বরটা চিনতে পেরে ধীরে ধীরে সেদিকে তাকালে সিয়ারা অবাক হয় না। কারণ ওর ধারণা সঠিক, ও যাকে ভেবেছিলো সেই ওর চোখের সামনে উপস্থিত।

সিয়ারা: দিয়া!

সিয়ারা অবাক না হলেও দিয়ারা তাজ্জব হয়ে গেছে। ওর মনে হচ্ছে এটা স্বপ্ন নাকি সত্যি? সে সত্যি তাঁর দিদিকে নিজের চোখের সামনে দেখছে? দিয়ারা ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে আসতে একসময় পায়ের গতি বাড়িয়ে সিয়ারাকে জড়িয়ে ধরলো। সেই মূহুর্তেই আধভিক ওখান থেকে বেরিয়ে যায়। সিয়ারা সেটা দেখেও চুপ করে থাকে। ধীরে ধীরে বোনকে জড়িয়ে ধরে।

দিয়ারা: কোথায় ছিলি দি তুই? কোথায় ছিলি এতদিন? (কেঁদে কেঁদে)

সিয়ারা: তোদের থেকে অনেক দূরে।

দিয়ারা: কিন্তু কেন? কেন এভাবে আমাদেরকে ছেড়ে গেলি তুই?

সিয়ারা: (তাচ্ছিল্য হেসে) বাহ রে! আমি না গেলে তোর যে তোর ভালোবাসার মানুষকে পাওয়া হতো না। আমি চলে গেছি বলেই তো তুই তাঁকে নিজের করে…

দিয়ারা: (সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে) একদম না জেনে কথা বলিস না দি। তুই নিজের ইচ্ছায় তোর ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে গেছিলি। খুব তো প্রথমে আমাকে বড়ো মুখ করে বলেছিলি ফিলিংসটা খেলার জিনিস নয়। তাহলে শেষ মুহুর্তে গিয়ে ওই কাজটা কি করে করতে পারলি?

সিয়ারা: এমন ভাবে বলছিস জানো কিছুই জানিস না তুই?

দিয়ারা: মানে? কি জানি আমি? কি বলছিস?

সিয়ারা: (তাচ্ছিল্য হেসে) তুই চাসনি আধভিককে বিয়ে করতে?

দিয়ারা: (অবাক হয়ে) একদমই না! আমি কেন ওকে বিয়ে করতে চাইবো? মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি তোর? তাই যদি হতো তাহলে আমি অনেক আগেই জানতে পেরেছিলাম তোদের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছে। তোরা রিলেশনশিপে ছিলি, তো তখনই আমি তোকে বলতাম। যেমন প্রথমে বলেছিলাম যে আমার ওকে চাই।

সিয়ারা: দিয়া এখন এসব কি বলছিস তুই? তুই যদি আধভিককে বিয়ে করতে না চাইতি তাহলে মা আমাকে এসে কেন বললো যাতে আমি চলে যাই? সরে যায় তোদের মাঝখান থেকে সারাজীবনের মতো।

দিয়ারা: হোয়াট? মা এটা তোকে কীভাবে বলতে পারে? আমি তো কখনওই মা কে বলিনি যে আমি ভিকিদাকে বিয়ে করতে চাই। ইভেন মা তো এটাই জানে না আমি ভিকিদাকে পছন্দ করতাম। আমি কখনোই বলিনি।

সিয়ারা মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে পরে। সেইদিনের কথা সিয়ারা প্রথমে বলে যে ওর মা ওকে এসে কি বলেছে।

ফ্ল্যাশব্যাক…………………….…………

সিয়ারা নিজের ঘরে তৈরী হওয়ার পর নিজেকে একটু আয়নায় দেখছিলো হাসজ্জ্বল মুখে। ঠিক সেই সময় ওর মা ওর ঘরে আসে। মাকে দেখে সিয়ারা হাসিমুখে সেদিকে ফিরে বলে,

সিয়ারা: মা তুমি এখানে? তুমি থাকবে তো তাহলে আমার বিয়েতে?

মা: না। আমি তোর বিয়েতে থাকবো না।(গম্ভীর গলায়)

সিয়ারা: মা তোমাকে বললাম তো এসব পুরনো নিয়ম তোমাকে মানতে হবে না। তারপরেও তুমি…

মা: তুই বিয়েটা করলে তো তোর বিয়েতে থাকার প্রশ্ন আসবে।

সিয়ারা: মা? তুমি এসব কি বলছো? আমি তো কিছুই বুঝতে…

মা: তুই এই বিয়েটা করবি না সিয়া।

সিয়ারা জানো আকাশ থেকে পরে মায়ের কথা শুনে। এক পা পিছিয়ে যায় ও কিন্তু ওর মা স্থির ভাবে নীচের দিকে তাকিয়ে আছেন। ও চুপ করে থাকলে ওর না ওর দিকে মাথা তুলে বলতে শুরু করেন,

মা: আমি চাই না তুই এই বিয়েটা করিস। তোর জায়গায় বিয়ের কনে আমার মেয়ে দিয়া হবে।

সিয়ারা: আর আমি? আমি তোমার মেয়ে না মা?

মায়ের কথা শুনে চোখে জল ভরে উঠেছে সিয়ারার। কিন্তু ওর মা সেসবের পরোয়া না করে বললো,

মা: সৎ মেয়ে। তুই আমার সৎ মেয়ে সিয়া। যেখানে আমার মেয়ের জন্য এত ভালো সম্বন্ধ আসেনি সেখানে তুই কীভাবে এতো ভালো সম্বন্ধে, ভালো ঘরে বিয়ে করে যেতে পারিস? ভালো ছেলে, বড়ো বাড়ি, গাড়ি কোনো কিছুর অভাব হবে না এই ছেলের ঘরে যে মেয়ে যাবে তাঁর। আমি এইসব সুখ আমার মেয়ের জন্য চাই।

সিয়ারা: মা আভি আমাকে ভালোবাসে, দিয়াকে নয়। এইসব টাকা পয়সা দিয়ে সুখে থাকা যায় না মা, আসল সুখ তো ভালোবাসাই দিতে পারবে।

মা: আমাকে জ্ঞান দিতে আসিস না সিয়া। আমি যখন বলেছি তুই এই বিয়ে করবি না তখন তুই করবি না।

সিয়ারা: এমন হয় না মা। তোমার যখন আপত্তি ছিল তাহলে প্রথমেই কেন বলোনি? এইভাবে শেষ মুহুর্তে এসে তুমি বলছো আমার জায়গায় দিয়াকে বিয়ে করতে বসাবে? মা আভি আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। আমি দিয়াকেও বলেছি, তোমাকেও বলছি! আমি ওর ভালোবাসা নিয়ে খেলতে পারবো না, অসন্মান করতে পারবো না ওকে। এমন করল ওর অপমান হবে, ওর ভালোবাসার অপমান হবে যেটা আমি করতে পারবো না কারণ আমিও ওকে ভালোবাসি। ওকে আর কোনো কষ্ট পেতে দেবো না আমি।

সিয়ারা কথাটুকু বলে চোখের জল মুছে মাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায়। দরজার কাছে পৌঁছতেই সিয়ারা আটকে যায় ওর মায়ের কথা শুনে,

মা: আমার দিব্যি আজ এই বিয়ে তুই করবি না। যদি করিস তাহলে তুই আমার মরা মুখ দেখবি। তোর মা মরে যাওয়ার পর থেকে তোকে কখনও মায়ের অভাব বুঝতে দিইনি। কষ্ট করে তোকে মানুষ করেছি, দিয়ার আর তোর মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করিনি। কখনও কোনো কিছুর দাবিও করিনি তোর কাছে তাহলে আজ আমি যেটা চাইছি সেটা আমাকে দিতে পারবি না তুই?

সিয়ারা: (মায়ের দিকে ফিরে) আজ কেন ভেদাভেদ করছো মা? যেই সুখটা দিয়ার জন্য চাইছো, সেই সুখটা আমার জন্য কেন চাইতে পারছো না? আমিও তো তোমাদের জন্য কম কিছু করিনি বলো? হঠাৎ করেই বাবা চলে যাওয়ার পর তুমি যখন হিমশিম খাচ্ছিলে দুজনের পড়াশোনা চালাতে তখন আমি নিজের পড়া ছেড়ে কাজে নেমেছি। দিন রাত পার্ট টাইম জব, টিউশন করে সংসার আর বোনের পড়াশোনার দায়িত্ব পালন করেছি। তোমার উপর কোনো চাপ আসতে দিইনি। নিজের অধিকারের সব কিছু প্রথম থেকে দিয়াকে দিয়ে দিয়েছি তারপরেও আজ তুমি ভেদাভেদ করছো? বলছো নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে ওর হাতে তুলে দিতে?

মা: হ্যাঁ বলছি। কারণ তুই আমার নিজের নয়। আমি আমার নিজের মেয়ের ভবিষ্যতের কথাই দেখবো আগে কারণ এটা সারাজীবনের বিষয়।

সিয়ারা: (মায়ের পা জড়িয়ে) মা তুমি এমন করো না মা। আমি তোমার পায়ে পরছি তুমি এমন করো না। তোমার ধারণা নেই এমনটা করলে কতোটা ক্ষতি হয়ে যাবে আভির। ওর জীবনে ও নিজের কাছের মানুষকে অনেক আগেই হারিয়েছে। অনেক সাহস করে আমাকে ভালোবেসেছে নিজের ভয় কাটিয়ে। ও খুব ভয় পায় কাছের মানুষ হারানোর, আমাকে হারানোর। ও সহ্য করতে পারবে না এসব। প্লিজ? প্লিজ আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি? আমার আভির থেকে আমাকে আলাদা করো না।

সিয়ারার মা পিছন দিকে সরে গেলে সিয়ারা মেঝেতে দু হাত ভর দিয়ে বসে পরে। মায়ের দিকে তাকালে কোনরকম মায়া বা মমতা সে দেখতে পায় না। উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

সিয়ারা: আভি আমাকে ভালোবাসে মা, পাগলের মতো ভালোবাসে। আমি ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে ও কখনওই গ্রহণ করবে না। আমি চলে গেলে এই বিয়ে ও করবে না, দেখে নিও। বরং নিজের ক্ষতি করে ফেলবে। তাই তোমার কাছে আমি হাত জোড় করছি, নিজের মেয়ের জেদের খাতিরে এসব করো না।

মা: আধভিক কি করবে না করবে সেটা আমি বুঝে নেবো। তুই এই বিয়ে করবি না এটাই আমার শেষ কথা। যদি করিস তাহলে এই মুহুর্তে আমি নিজেকে শেষ করে দেবো। আমার মেয়ে যদি না আধভিককে না পায়, আমি তোকেও আধভিককে পেতে দেবো না।

সিয়ারা জানো স্তব্ধ হয়ে গেলো। চোখের জলটা মুছে একভাবে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে ও। এ কোন মারুপী মানুষকে দেখছে ও? যেই মা কে ও চিনত সেই মা তো কখনও এমন ছিলো না। বরং সে তো ওকে বকাবকি করতো যখন দিয়ার জেদের সঙ্গ দিতো ও। আর আজ সেই’ই দিয়ার অন্যায় জেদের প্রশ্রয় দিচ্ছে? সিয়ারার বড্ড অসহায় মনে হয় নিজেকে। কর্তব্য নাকি ভালোবাসা, বেছে নেওয়ার এই জাতাকলে পিষে যাচ্ছে ও। সিয়ারা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে ওর মা সেন্টার টেবিলে থাকা ছুরিটা নিজের গলায় ধরে।

মা: তুই যদি মনে করিস আমি মিথ্যে বলছি তাহলে এক্ষুনি প্রমাণ করে দিচ্ছি আমি আমার কথা।

সিয়ারা দেখে তাঁর মায়ের গলা থেকে রক্ত গড়িয়ে পরছে ইতিমধ্যে। তড়িঘড়ি সে উত্তর দেয়,

সিয়ারা: আমি রাজি তোমার কথায়।

সিয়ারার মা ছুরিটা নামিয়ে ফেলেন। পরিস্থিতির শিকার হয়ে সিয়ারা বাধ্য হয় কর্তব্য বেছে নিতে। ছোটো থেকে যে মায়ের স্নেহে মানুষ করেছে তাঁর মৃত্যু এভাবে চোখের সামনে দেখতে পারবে না সে। তবে ভালোবাসা? সময়টা কম হলেও সিয়ারা মানুষটার নামে নিজের গোটা জীবনটা লিখে দিয়েছিল যে? তাঁকে এভাবে শেষ হয়ে যেতে দিতে পারলো সে? সিয়ারার মনে কথাটা আসতেই ও চোখ বুজে ফেললো।

মা: চিন্তা করিস না। এই বিয়ে আধভিক করবে। আমি কথা দিচ্ছি তোকে আধভিকের কোনো ক্ষতি আমি হতে দেবো না। চালাকি করিস না জানো? নিজের ক্ষতি করার ভয় দেখিয়ে তুই যদি ভাবিস এই বিয়ে আটকাবি তাহলেও কিন্তু এক পরিণাম হবে। আর যদি মরেই যাস তাহলেও সেই আধভিকই কষ্ট পাবে। তখন আরও সুবিধা হবে দিয়ার সাথে ওর বিয়ে দেওয়ার, চান্স বেশি থাকবে আধভিকের রাজী হওয়ার। কিন্তু আমি তো মা, তাই তোকে মরতে বলতেও পারিনা আর দিতেও পারিনা। আমি দিয়াকে পাঠাচ্ছি, তুই সাজিয়ে দে ওকে তারপর চুপচাপ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবি। এতো দূর চলে যাবি যাতে তোর নাগাল না পায় কেউ কখনও।

মা চলে যেতেই সিয়ারা ধপ করে মেঝেতে বসে পরে। চিৎকার করে কেঁদে ওঠে ও। হাতের থেকে সোনার চুরি গুলো খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয় তবে শাখা পলাটা খুলতে গিয়ে থেমে যায়।

সিয়ারা: আমি অনেক চেষ্টা করলাম তোমাকে কষ্ট না দেওয়ার কিন্তু পারলাম না আভি। আমি পারলাম না তোমার সাথে থাকতে। পারলাম না নিজের কথা রাখতে। পারলাম না! (ডুকরে কেঁদে উঠলো)

কিছুক্ষণ পর সিয়ারা উঠে দাঁড়িয়ে নিজের চোখের জল মুছে নেয়। চারিদিকে তাকিয়ে একটা কিছু খুঁজতে থাকে। খুঁজে পেতেই সেদিকে চলে যায় এবং সেটা হতে নিয়ে বলে,

সিয়ারা: আমার আভিকে আমি চিনি মা। ওকে জোর করা এতটা সহজ নয়। জোর করে বিয়ে দিয়ে দিলেও ও নিজের ক্ষতি করতে দুবার ভাববে না। এতো কষ্ট পাওয়ার পর এই কষ্টটা সহ্য করার ক্ষমতা ওর নেই। তাই আমাকেই কিছু একটা করতে হবে।

সিয়ারা চিঠি লিখতে শুরু করে। সেখানে সে বলে দেয় নিজের মা আর বোনের খেয়াল রাখবে আধভিক যদি ওকে ভালোবেসে থাকে তো। ও জানে এই কথাটা পরলে আধভিক নিজের ক্ষতি করতে পারবে না। চিঠি লেখা শেষ করে নিজের সাজ ছেড়ে সাধারণ পোশাক পরে নেয় সিয়ারা।

অন্যদিকে,

দিয়ারা উপরে সিয়রাকে ডাকতে এসে নিজের মা কে সিয়ারার ঘর থেকে বেরোতে দেখলে মা কে বলে,

দিয়ারা: মা তুমি এখানে কি করছো? দি কি রেডি হয়নি? না মানে আমি তো জানতাম মেয়েরা তৈরী হয়ে গেলে মা’দের দেখতে নেই তাই বললাম।

সিয়ারার মা: তোর দিদি তোকে ডাকছে। (গম্ভীর গলায়)

দিয়ারা: ও আবার এখন কেন ডাকছে আমাকে? আমিই তো ওকে ডাকতে এলাম নীচে যাওয়ার জন্য। আশীর্বাদের আয়োজন…

সিয়ারার মা: বললাম তো তোকে তোর দি ডাকছে? যা! (ধমক দিয়ে)

দিয়ারা ঘাবড়ে গিয়ে আর কোনো কথা না বলে সিয়ারার ঘরে ঢুকে যায়। গিয়ে দেখে সিয়ারা একটা নরমাল শাড়ি পরে বসে আছে চুপ করে।

দিয়ারা: তুই রেডি হোসনি কেন?

সিয়ারা দিয়ারার দিকে ফিরলে দিয়ারা দেখে সিয়ারার মুখের মেক আপ আছে একটু আধটু। কিন্তু ওর মনে হচ্ছে সিয়ারা হয়তো মেক আপটা তুলে দিতে চাইছে।

দিয়ারা: দি তুই কি মেক আপ তুলে দিচ্ছিস নাকি? আরে বিয়ের দিন তো এটুকু…কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমায়? বোঝানোর চেষ্টা করবি না একদম। দে আমি মেক আপ করিয়ে দিচ্ছি।

সিয়ারা দিয়ারার কোনো কথা শোনে না। চুপচাপ দিয়ারাকে ওর জায়গায় বসিয়ে। গয়নাগুলো এক এক করে পড়িয়ে দিতে শুরু করে। দিয়ারা অবাক হয়ে আটকাতে গেলে সিয়ারা চুপ করে বসতে বলে ইশারায়। পরানো শেষে দিয়ারা এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ায়।

দিয়ারা: এই তোর মাথা খারাপ হয়েছে? আমাকে এসব গয়না কেন পরাচ্ছিস?

সিয়ারা দিয়ারাকে প্রথমে আয়নার দিকে ঘুরিয়ে, পাশে থাকা ভেলটা মাথায় দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

সিয়ারা: সাজটা সুন্দর হয়েছে?

দিয়ারা: হ্যাঁ কিন্তু…

সিয়ারা দিয়ারাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে ওর হাতটা নিজের হাতের মাঝে নিয়ে নেয়। তারপর দিয়ারার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,

সিয়ারা: আমার ভালোবাসার মানুষটাকে তোর হাতে তুলে দিলাম। যত্নে রাখিস, খুব ভালোবাসিস। মানুষটা ভালোবাসার বড্ড কাঙাল।

সিয়ারা আর কিছু বলতে পারে না। এতক্ষণ নিজের কান্না চেপে রেখেছিলো কিন্তু এখন চোখ দিয়ে জল গাল গড়িয়ে পরতে শুরু করেছে। ও পিছন ফিরে নিজের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

পুরোটা সময় দিয়ারা সিয়ারাকে দেখে গেলো। সিয়ারার কথাগুলো ওর কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে। সিয়ারা দরজা বন্ধ করলে সেই আওয়াজে দিয়ারা বাস্তবে ফিরে আসে।

দিয়ারা: কি আজে বাজে বলে গেলো দি? আমার হাতে তুলে দিলো মানে? কেন তুলে দিল? আর ওই বা কোথায় গেলো? কি হচ্ছে…ধুর!

দিয়ারা সাথে সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে সিয়ারার পিছু নিতে যায়। কিন্তু সেই সময় ওর পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ওর মা।

দিয়ারা: মা তুমি জানো দির মাথাটা সম্পূর্ণ খারাপ হয়ে গেছে? ও আমাকে বলল, “আমার ভালোবাসার মানুষটাকে তোর হাতে তুলে দিলাম। যত্নে রাখিস, খুব ভালোবাসিস। মানুষটা ভালোবাসার বড্ড কাঙাল।” কোনো মানে আছে এইসব কথার? আমার হাতে কেন তুলে দেবে ও? কই একটা চলে গেলো। দেখি দাঁড়াও।

মা: কোথাও যাবি না তুই। সিয়ারা এই বিয়ে করতে চায় না। তাই ও তোকে নিজের জায়গায় বিয়ে করতে বলেছে।

দিয়ারা: কি? ও বলেছে এটা তোমাকে? (রেগে)

মা: হ্যাঁ। কিছুক্ষণ আগেই বলেছে।

দিয়ারা: ওকে তো আমি…ইয়ার্কি করছে নাকি ও? মানছি আমি প্রথমে বলেছিলাম যে আমার ভিকিদাকে চাই। কিন্তু পরে আমি বুঝতে পেরেছে ভালোবাসার ক্ষেত্রে জেদ করলে হয় না। আর আমি ভিকিদাকে ভালো বাসিও না। তখন ও বললো যে ও এমন করবে না আর এখন শেষ মুহুর্তে এসব বলছে?

দিয়ারা সিয়ারাকে খুঁজতে যেতে নিলে ওর মা ওকে আটকে দেয়।

দিয়ারা: আমাকে কথা বলতে হবে মা ওর সাথে। যেতে দাও আমায়।

মা: তুই কোথাও যাবি না। এই বিয়েটা তোকেই করতে হবে।

দিয়ারা: কি? তোমারও মাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি?

মা: না। আমি যেটা বলছি সেটাই করবি তুই। নীচে গিয়ে বল সিয়ারাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। (একটু ধীরে) আর কিছু বলার দরকার নেই। (আবার স্বাভাবিক ভাবে) যা!

দিয়ারা: কিন্তু মা আমাদের দিকে খোঁজা উচিত। বেশি দূর যায়নি হয়তো ও।

মা: আমি যেটা বললাম সেটা কর চুপচাপ। নাহলে আমার মরা মুখ দেখবি বলে দিলাম। যা!

দিয়ারা ধমক খেয়ে চলে গেলো তবে ও বুঝতে উঠতে পারলো না মা এরকম ব্ল্যাকমেইল করে ওকে পাঠাচ্ছে কেন।

প্রেজেন্ট.……………………………

সিয়ারার কথাগুলো শুনে দিয়ারা কেঁদেই ফেলেছিলো। অনেক কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক করে দিয়ারা সেদিন ওর সাথে যেটা ঘটেছিল সেটা বলে। সবটা শুনে সিয়ারা অবাক হয়ে যায়। কি করবে ভেবে পায় না।

দিয়ারা: তুই ঠিক ছিলি দি, একদম ঠিক ছিলি। ভিকিদা তুই ছাড়া অন্য কাওকে গ্রহণ করেনি।

সিয়ারা: ও নিজের কোনো ক্ষতি করতে যায়নি তো?

প্রতি উত্তরে দিয়ারা চুপ করে যায়। সিয়ারার আর উত্তরের প্রয়োজন পরে না, ও বুঝে যায়।

সিয়ারা: আঙ্কেল সব সময় ছিলো তো ওর সাথে?

দিয়ারা: হ্যাঁ। সেটাই তো বাঁচোয়া। বাড়িতে গেলে আঙ্কেল আর যতক্ষণ বাইরে থাকে ততক্ষণ সোহমদা। একবার তো ভীষণ বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলো। আঙ্কেল ঠিক সময় না পৌঁছালে বাঁচানো যেত না।

সিয়ারা: (ভয়ে ভয়ে) ক..কি করেছিলো?

দিয়ারা: বাড়ি ফিরে রাতের বেলায় নিজের মায়ের ঘরে গেছিলো ভিকিদা। আঙ্কেল ভিকিদাকে নিজের ঘরে খুঁজে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে ওই ঘরে চলে গেলে দেখে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। জানলার কাছে যেতেই উনি দেখেন ভিকিদা শাড়িতে গিঁট দিচ্ছেন। কোনো সাড়া না দিয়ে তৎক্ষণাৎ সেই ঘরের ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ফেলেন। ততক্ষণে ভিকিদা চেয়ারেও উঠে গেছিল। পাগলামী করছিলো দেখে বাধ্য হয়ে গায়ে হাত তোলেন সেদিন প্রথম।

দিয়ারার কথাটা শুনে সিয়ারার সেইদিনের কথা মনে পরে যেদিন ও নিজের মায়ের ঘটনা বলেছিলো। সিয়ারা বুঝতে পারে আধভিক সেদিন নিজের মা কে মিস করছিলো প্রচুর। তাই জন্যেই হয়তো অমন করতে গেছিলো মায়ের ঘরে।

দিয়ারা: আঙ্কেলের কাছে সেদিন ভিকিদা প্রথম নাকি মায়ের জন্য কেঁদেছিলো।

সিয়ারা: হম, বুঝতে পেরেছি। মিস করছিলো ওর মা কে। ভাবছিলো যে, কেন ওর মা থেকে গেলো না ওর সাথে। ওর মা থাকলে ও নিজের সব কষ্ট মায়ের সাথে শেয়ার করতে পারতো। এতোটা একা হয়ে থাকতে হতো না।

দিয়ারা: কতটা ভালো ভাবে চিনিস তুই ভিকিদাকে। আঙ্কেলও ঠিক এই কথাগুলোই বলছিলেন। সব শেষে এটাও বলছিলেন যে ভিকি দা বলছিলো…“মমের পর যাঁকে আকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলো সেও যখন ছেড়ে চলে গেলো। তখন আমি বেঁচে থেকে কি করবো? আমার বাঁচার কোনো ইচ্ছাই নেই।” সবটা ঠিক করে নে দি, প্লিজ! মানুষটা বড্ড কষ্টে আছে। প্রতিটা দিন হয়তো তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এইটা বাঁচার মতো করে বাঁচা নয় দি।

দিয়ারার শেষ কথাটা সিয়ারার বুকে গিয়ে বিঁধল। মনে পরে গেলো আধভিক তাঁকে বলেছিল, “তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না সিয়ু। বাঁচার মত করে বাঁচতে পারবো না।” সিয়ারা চোখ বুজে নেয়। তারপর চোখ খুলে বলে,

সিয়ারা: মা কোথায় দিয়া? আমি মায়ের সাথে কথা বলতে চাই।

দিয়ারা: (কিছুক্ষণ চুপ থেকে) সেটা সম্ভব না দি।

সিয়ারা: সম্ভব না মানে? কেন সম্ভব না?

দিয়ারা চুপ করে মাথা নীচু করে থাকলে সিয়ারা দিয়ারার বাহু ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করে,

সিয়ারা: কি হয়েছে মায়ের? (নার্ভাস কণ্ঠে)

দিয়ারা: দু বছর ধরে মা কোমায় দি।

[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে🥀]’ কথা দিলাম ‘ 🌸❤️
||পর্ব ~ ২১||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

সিয়ারা: মা কোথায় দিয়া? আমি মায়ের সাথে কথা বলতে চাই।

দিয়ারা: (কিছুক্ষণ চুপ থেকে) সেটা সম্ভব না দি।

সিয়ারা: সম্ভব না মানে? কেন সম্ভব না?

দিয়ারা চুপ করে মাথা নীচু করে থাকলে সিয়ারা দিয়ারার বাহু ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করে,

সিয়ারা: কি হয়েছে মায়ের? (নার্ভাস কণ্ঠে)

দিয়ারা: দু বছর ধরে মা কোমায় দি।

সিয়ারার মাথায় বাজ পরলো দিয়ারার কথাটা শুনে। অবাক হয়ে দিয়ারার দিকে তাকিয়ে থাকলে দিয়ারা সিয়ারাকে বলে,

দিয়ারা: সেইদিন ভিকিদাসহ পুরো বরযাত্রী বেরিয়ে যাওয়ার পর মা’ও বেরিয়ে যায়। আমি অনেক অপেক্ষা করি যে এই হয়তো ফিরে আসবে কিন্তু অনেক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও যখন মা আসে না। তখন আমি বের হই মা কে খুঁজতে। বাড়ি থেকে সবে রাস্তায় পা দিয়েছি সেই সময়ই খবর আসে যে বড়ো রাস্তায় মায়ের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। সেদিন থেকে আমি অনেক একা হয়ে গেছি দি। না তুই ছিলি আর মা তো থেকেও ছিলো না। ভাগ্যিস ভিকিদা ছিলো, ও না থাকলে মা তো থাকতোই না।

সিয়ারা বোনকে কাঁদতে দেখে ওকে জড়িয়ে ধরে। দিয়ারা কেঁদে ওঠে দিদিকে এতদিন পর কাছে পেয়ে। কিছুক্ষণ পর দিদিকে ছেড়ে ও বলে,

দিয়ারা: দি! আমাকে যেতে হবে। আমার শুটের টাইম হয়ে যাচ্ছে। আমি এইখানে রোজই আসি, কালকে ফ্রি আছি। অনেক গল্প করবো, আজ আসি?

সিয়ারা: আচ্ছা আয়। আমার বোনটা কত্ত বড় হয়ে গেছে। (কপালে চুমু দিয়ে)

দিয়ারা: তুইই তো বড়ো করে দিলি আমায় এক ঝটকায়। আচ্ছা বাদ দে, মায়ের সাথে দেখা করার ইচ্ছা হলে বলিস। আমি নিয়ে যাবো। আজ আসলাম।

দিয়ারা বেরিয়ে গেলে সিয়ারা বোঝে বোনের মনে বেশ অভিমান জমেছে। তবে আধভিকের অভিমানের কাছে সেটা কিছুই না। বোন না হয় সবটা শুনলে, ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে সবটা। কিন্তু আধভিক? সে তো প্রয়োজনের বেশি কথাই বলে না। এতো কিছু বলবে কখন? দুশ্চিন্তায় পরে যায় সিয়ারা।

অন্যদিকে,

আভাস বাবু ঘুম থেকে উঠে ছেলেকে দেখতে পান না স্টাডি রুমে। চিন্তায় পরে যান। সঙ্গে সঙ্গে সোহামকে ফোন করেন। সোহম ফোনটা ধরতে না ধরতেই উনি বলতে শুরু করেন,

আভাস বাবু: সোহম, বাবাই বাড়ি নেই। ও কালকে রাতে যেভাবে ফিরেছিল সেটা দেখে ওর সাথেই ছিলাম সারারাত। কিন্তু ভোরের দিকে চোখটা একটু লেগে গেছিলো। এখন দেখছি ও বাড়ি নেই। তুমি একটু দেখো কোথায় গেছে। কিছু বাঁধিয়ে বসলো…

সোহম: স্যার অফিসে আছেন বড়ো স্যার। আপনি একটু শান্ত হন।

আভাস বাবু জানো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে সোফায় বসে পরলেন। সোহম আবার বললো,

সোহম: এতো চিন্তা করবেন না বড়ো স্যার, এমন করলে তো আপনার শরীরটা আবার খারাপ হয়ে যাবে।

আভাস বাবু: হোক! তাহলে যদি ছেলেটা নিজের ক্ষতি করার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে। একটু শান্তি পাবো তাহলে। সব সময় আমি যে কি ভয় নিয়ে থাকি আমিই জানি। প্রত্যেক মুহুর্তে মনে হয় এই বুঝি কিছু একটা বাঁধিয়ে বসলো।

সোহম: এখন আর সেই নিয়ে চিন্তা করতে হবে না আপনাকে। খুব শীঘ্রই আপনি আপনার দু বছর আগের ছেলেকে ফিরে পাবেন।

আভাস বাবু: (কিছুক্ষণ চুপ করে) আমি আর সেটা চাই না সোহম। দু বছর আগের বাবাই কে ফিরে পাওয়ার পর যদি আবার দু বছরটা সহ্য করতে হয়? না না। দরকার নেই আমার। বাবাইকে অনেক কষ্টে বের করে আনছি আমি ধীরে ধীরে।

সোহম: পেরেছেন কি? যদি পারতেন তাহলে স্যার কিছু একটা বাঁধিয়ে বসবে এই ভয়টা পেতেন না প্রতি মুহুর্তে। আপনিও জানেন আর আমিও জানি যে, স্যারকে যদি স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কেউ পারে তাহলে সেটা সিয়ারা।

আভাস বাবু: আমি আর কোনরকম কোনো আশা রাখতে চাইনা।

সোহম: সেটাই ভালো। কারণ বিষয়টা বড্ড কঠিন। দু বছর ধরে যেই অভিমানটা পোষণ করেছেন স্যার নিজের মনের মধ্যে সেটা পাহাড় সমান রূপ ধারণ করেছে। এই অভিমান ওদের মধ্যে অনেক উঁচু একটা দেওয়াল তৈরী করে দিয়েছে আর এই দেওয়াল ভাঙতে সক্ষম হওয়া টা মুখের কথা নয়।

আভাস বাবু: জানি না কি হতে চলেছে। আমার কেমন ভয় লাগে। সিয়ারাকে নিজের চোখের সামনে দেখে যদি আবার কিছু করে বসে বাবাই?

সোহম: এমনটা হবে না তা আমি বলতে পারি। সিয়ারা আর যাই পারুক না পারুক স্যারের প্রাণরক্ষা করতে পারবে। আচ্ছা আপনি আর চিন্তা করবেন না। স্যার আসছে আমি রাখলাম।

সোহম ফোন রেখে দিলে আভাস বাবু গতরাতের ঘটনায় ফিরে যান। দু বছর ধরে ছেলেটাকে যেভাবে দেখে এসেছেন গতরাতে তার থেকে খারাপ অবস্থায় দেখেছেন ঠিকই তবে একটা আশার আলোও দেখেছেন। তাই জন্যেই হয়তো সোহমের কথাগুলোর পরিবর্তে কোনো কথা বললেন না তেমন।

ফ্ল্যাশব্যাক……………………………..

সিয়ারা বাড়ি ঢুকে গেছে জেনে আধভিক নিজের বাড়ি ফিরে আসে। আজ কেন জানো বারে যেতে মন টানছে না। বাড়িতে এসে, নিজের কাছে থাকা একস্ট্রা চাবি দিয়ে সদর দরজা খুলে ভিতরে চলে যায় আধভিক। ড্রয়িং রুমে থাকা বিশাল বড়ো বার ওয়াল সেলফের থেকে একটা হুইস্কির বোতল নিয়ে, আধভিক স্টাডি রুমে চলে গেলো।

আভাস বাবু: মনে হলো দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। বাবাই কি তাহলে এসেছে? যাই একবার।

আভাস বাবু আধভিকের অপেক্ষা করছিলেন। একটা আওয়াজ পেয়ে উনি উঠে চশমাটা পরে বেরিয়ে যান ঘর থেকে। ড্রয়িং রুমে এসে কাওকে দেখতে না পেয়ে ভাবেন হয়তো মনের ভুল। পিছন ফিরে ঘরে ফিরে যাচ্ছিলেন সেই সময় হঠাৎ কানে একটা সুর ভেসে আসে।

“তেরি মউজদগি সে
ইক হিফাজত থি মিলি
তু জো ছোড় গ্যায়া মুঝে
তোহ জিন্দেগি বিখরি…

আব তু ফির সামনে হ্যা
তোহ দিল কার রাহা সাওয়াল
কিউন ইস তারাহ বেওয়াফা হো গ্যায়া
তু দে দে জাওয়াব
হোকে যুদা ক্যায়া মিলা
ইয়ে বাতা দে আব ইয়াহান”

[গানটি হলো — O Sathi অরিজিৎ সিং- এর গাওয়া।]

আধভিক বোতলটা টেবিলে রেখে চেয়ারে মাথাসহ শরীরটা এলিয়ে দেয় পুরোপুরি। চোখ বন্ধ করে রয়েছে আধভিক। মাথাটা যন্ত্রণা করছে। যতবার সিয়ারাকে বলা নিজের কথাগুলোর সাথে সাথে সিয়ারার কান্না মাখা মুখটা মনে পরছে। ততবার বুকের ভিতরটা ছ্যাঁত করে উঠছে আধভিকের। ভালো লাগছে না কিছু। বারবার একটা কোথায় মনে হচ্ছে তাঁর, “ছেড়েই যখন যাওয়ার ছিলো তাহলে প্রতারণা করলে কেন সিয়ারা? আর যখন ছেড়ে চলেই গেছিলে তখন আবার সামনে কেন এলে?”

হঠাৎই নিজের কপালে কাওর হাতের স্পর্শ পায় আধভিক। ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসির রেখা টেনে জিজ্ঞেস করে,

আধভিক: ড্যাড! কেন এত রাত অবধি জেগে থাকো তুমি?

আভাস বাবু: ভাগ্যিস জেগে ছিলাম। নাহলে আমার ছেলের যে এই একটা গুন আছে সেটা কখনও জানতেই পারতাম না। তুই নায়ক না হোস গায়ক তো হতেই পারতিস?

আধভিক: (তাচ্ছিল্য হেসে) গানটা শুধুমাত্র আমার একাকীত্ব আর মন খারাপের সঙ্গী হিসেবে রয়ে গেছে ড্যাড। মমের যাওয়ার পর আজ হয়তো আবার গাইলাম।

আভাস বাবু: (এক গাল হেসে) হ্যাঁ। তোর মা খুব ভালো গান গাইতো। আমার খুব ভালো লাগছে তুই আবার নিজের গানে ফিরেছিস বলে।

আধভিক: কিন্তু আমি তো এইভাবে ফিরতে চাইনি? অনেক যন্ত্রণার পরেই আমার ভিতর থেকে সুর আসে, বিষাদের সুর!

আভাস বাবু চুপ করে গেলেন আধভিকের কথায়। ছেলেটার চোখটা লাল হয়ে যাচ্ছে। হয়তো মাথার যন্ত্রণাটা ধীরে ধীরে বাড়ছে। কথা না বাড়িয়ে ছেলের জন্য বাম নিয়ে আসেন আভাস বাবু। বাম লাগানোর পর একটু ম্যাসেজ করে দিতে থাকেন।

আধভিক: ড্যাড আমি ঠিক হয়ে যাবো। রোজ এভাবে রাত জাগাটা ঠিক না তোমার জন্য। তুমি শুয়ে পরো।

আভাস বাবু: ভালো লাগছে কি না সেটা বল?

আধভিক: হম।

আভাস বাবু: তাহলে চুপটি করে থাক।

আধভিক কথা বাড়ায় না। আভাস বাবু লক্ষ্য করেন আধভিক চোখ বুজে নেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই চোখের কোণ বেয়ে জল গাল গড়িয়ে পরে। আভাস বাবু সেটা দেখে একটা হতাশার নিশ্বাস ফেলেন।

প্রেজেন্ট……………………………………

আধভিক: এখানে কি করছো সোহম? মিটিংটা অ্যাটেন্ড করনি?

সোহম: স্যার মিটিংয়ের টাইমটা একটু পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। আপনার শরীরটা ঠিক ছিলো না তাই আমিই…

আধভিক: দরকার ছিলো না। কখন শুরু হবে মিটিং?

সোহম: এক ঘন্টা পর। আপনি একটু কিছু খেয়ে নিন। রাত থেকে তো…

আধভিক: ড্যাড খবর দিয়ে দিয়েছে তাহলে। আমার ক্ষিদে পেলে খেয়ে নেব আমি। দিয়া শুটে গেছে, ওর জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিয়ো ফেরার সময়।

আধভিক হিপ ফ্ল্যাস্কটা বার করে সেটা চুমুক দিতে দিতে চলে গেলো কথাটা বলে। সোহম বারণ করতে গিয়েও করলো না। আধভিক চলে যাওয়ার পর হঠাৎই সোহম সব ডিজাইনারদের উঠে দাঁড়াতে দেখলে সেইদিকে তাকায়। দেখে সিয়ারা দাঁড়িয়ে আছে। সিয়ারা ওর কাছে আসলে ও বলে,

সোহম: সবাই তোকে দেখে অবাক হয়ে গেছে।

সিয়ারা: হম। এতদিন পর যে দেখছে। একটা সময় কাজ করেছি ওদের সাথে, চিনবে না এমনটা হয় নাকি?

সোহম: (হাসিমুখে) হম সেটাই। কিন্তু তুই এত সকালে এখানে কি করছিস? মনে হয় আরো আগে এসেছিস?

সিয়ারা: ভাগ্যিস এসেছিলাম। নাহলে অনেক কিছু অজানা থেকে যেত। আচ্ছা এসব ছাড়ো, তোমার স্যার কোথায়? অন্য কোনো কেবিনে গেছে?

সোহম: কনফারেন্স রুমে গেছে মনে হয়।

সিয়ারা: আচ্ছা। তুমি হালকা কিছু খাবার মানে ওই স্যান্ডউইচ পাঠিয়ে দাও কনফারেন্স রুমে। আসছি আমি।

সিয়ারা সবার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে কনফারেন্স রুমেr উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলো। কনফারেন্স রুমে ঢুকবে ঠিক তার আগের মুহূর্তে একটা মেয়ে ওর পথ আটকে দেয়।

সিয়ারা: কিছু বলবেন?

__অনেক কিছুই বলবো। প্রথমত, আমি আপনাকে চিনি না। আপনি কে, কোথা থেকে এসেছেন কিছুই জানি না। দ্বিতীয়ত, এসেই এইভাবে পুরো অফিসে কি উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সেটাও জানি না। তাই সেইসব না জেনে আমি আপনাকে কনফারেন্স রুমে ঢুকতে দিতে পারি না।

সিয়ারা: (হাসিমুখে) প্রথমত, আমার যতদূর মনে হয় আপনি একটু নতুন। মানে এখানে কাজ করছেন এক বছরের বেশি হবে না। দ্বিতীয়ত, আমি আমার উদ্দেশ্যের দিকেই এগোচ্ছি। আর মোটামুটি কম বেশি সবাই আমাকে চেনে তাই তাঁদের কোনো অসুবিধা হয়নি আমার ঘুরে বেড়ানোতে। সো, প্লিজ আপনি একটু সাইড দিন আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।

সিয়ারা মেয়েটিকে আর কিছু বলতে না দিয়ে পাশ কাটিয়ে ঢুকতে গেলে মেয়েটা বাঁধা দেয়।

__আমি তো আপনাকে চিনি না। সো আমার প্রবলেম আছে। তাই আপনি আমাকে বলতে বাধ্য আপনি কে? আর কেন এই অফিসে এসেই স্যারকে খুঁজছেন।

সিয়ারা: আগে আপনার স্যারকে একটু ঠিক করেনি। তারপর না হয় আপনি আপনার স্যারের থেকে উত্তর গুলো নিয়ে নেবেন। উনি ভালো বলতে পারবেন “আমি কে?”

সিয়ারা ঢুকেই দরজা লক করে দেয় কনফারেন্স রুমের। সামনে তাকিয়ে দেখে আধভিক চুপ করে যেভাবে সকালে বসে ছিলো সেভাবেই বসে আছে। মাঝে মধ্যে হিপ ফ্ল্যাস্কে চুমুক দিচ্ছে। সিয়ারা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলে আধভিকের মুখটা দেখে মায়া হয়। আস্তে করে টেবিলে বসে আধভিকের বুকে, ঠিক যেই জায়গায় ওর নামটা লেখা আছে সেখানে হাত রেখে ডেকে ওঠে,

সিয়ারা: আভি!

আধভিক চোখটা খুলতেই সিয়ারার চোখে চোখ পরে। দুজন একে অপরের দিকে চেয়ে থাকে। সেভাবেই ধীরে ধীরে আধভিক উঠে সোজা হয়ে বসে আর সিয়ারা ঝুঁকে পরে আধভিকের দিকে।

আধভিক উঠে দাঁড়ায়। মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

আধভিক: কেন এসেছেন?

সিয়ারা মনে মনে হাসে আধভিকের গলার আওয়াজ শুনে। বেচারা নেশায় থাকলে অন্য সবার সাথে চিৎকার করে কথা বলবে কিন্তু সিয়ারা সামনে থাকলেই আওয়াজ নীচে। আর সিয়ারা যদি রাগ দেখায় তাহলে তো হয়ে গেলো, সব কথা জড়িয়ে গিয়ে তুতলে যাবেন মশাই। সিয়ারা নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয় আধভিকের বাহু ধরে,

সিয়ারা: আপনার জন্যেই তো আসতে হলো। চলেই তো গেছিলাম, কিন্তু শান্তি আর কোথায় পেলাম? এক মুহুর্তের জন্য শান্তি পাইনি। তবে ফিরে আসলে যে এমন কথা শুনতে হবে ভাবিনি।

আধভিকের চোখ ছল করে ওঠে, কিছু বলে না সে। সিয়ারা ধীরে ধীরে আধভিকের বুকে মাথা রেখে বাম হাত দিয়ে হিপ ফ্ল্যাস্কটা নিয়ে নেয় আধভিকের হাত থেকে। অন্যদিকে আধভিক সিয়ারা বুকে মাথা রাখতেই চোখ বুজে নেয়।

সিয়ারা: সকাল সকাল এসব খাওয়ার জিনিস? (মাথা তুলে)

আধভিক: দাও ওটা।

সিয়ারা: চুপচাপ বসো।

আধভিক: দিয়ে দাও ওটা।

সিয়ারা: মাথা ফাটিয়ে দেবো এটা দিয়ে মেরে একবারে। বসতে বলেছি না ওখানে? আবার এটা চাইছো কোন সাহসে?

আধভিক: এ..এসব ঠিক না।

কথাটুকু বলে চুপ করে বসে পরে আধভিক চেয়ারে। সিয়ারা যা ভেবেছিলো তাই, একটুও বদলায়নি। সিয়ারা উঠে দাঁড়িয়ে সোফায় হিপ ফ্ল্যাস্কটা ছুঁড়ে ফেলে আধভিকের কপালের দু পাশে ম্যাসাজ করতে শুরু করে ওর পিছনে দাঁড়িয়ে। আধভিক সব সময়ের মতো সিয়ারা সামনে থাকায় নেতিয়ে পরেছে। গতরাতে যেই তেজ দেখিয়েছিল তার এক শতাংশও এখন ওর মধ্যে অবশিষ্ট নেই।

সিয়ারা আধভিকের মাথা টিপে দিতে দিতে খেয়াল করে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা ওদের দেখছে। ও তাকাতেই মেয়েটা দরজা দিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর সোহম দরজা খুললে সিয়ারা চোখ দিয়ে ইশারা করে খাবারটা রেখে যায়।

সিয়ারা: আভি, এই! উঠে খাওয়ারটা খেয়ে নাও আগে।

আধভিক: (উঠে বসে) আমি খাবো না। ভালো লাগ…

সিয়ারা: (দাঁতে দাঁত চেপে) কি বললে?

আধভিক: (ঢোঁক গিলে) আমি, আমি…আমি সকালে এসব খাই না। স..সেটাই বলছিলাম।

সিয়ারা: খেতে না কিন্তু এখন খাবে। বুঝেছো?

আধভিককে খাইয়ে দিতে শুরু করে সিয়ারা। খাওয়া যখন শেষের দিকে তখন সিয়ারাকে আধভিক জিজ্ঞেস করে,

আধভিক: এতো অধিকার খাটাচ্ছো যে?

সিয়ারা: হম, আমার মানুষের উপরেই তো খাটাচ্ছি।

আধভিক: তাহলে ছেড়ে গিয়েছিলে কেন?

সিয়ারা: বলবো। বলার জন্যেই তো এসেছিলাম। কিন্তু যা অবস্থা বানিয়ে রেখেছ বলবো কীভাবে আর? এখন সোজা বাড়ি যাবে আর গিয়ে রেস্ট নেবে।

আধভিক: আমি এখনই জানতে চাই। (সিয়ারার হাত ধরে)

সিয়ারা: বললে কিছু মনে থাকবে? কিছুই মনে থাকবে না। বলাটাই বেকার এখন। এজন্যেই বলি দিন রাত এইসব গোলা অবধি গিলে বসে থাকবে না। চলো, ওঠো এখন।

আধভিককে দাঁড় করিয়ে সিয়ারা বাইরে নিয়ে যায় আর সোহমকে বলে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে জানো একদম ঘর অবধি দিয়ে আসে। সোহম সেটা শুনে মাথা নেরে আধভিকের দিকে তাকিয়ে দেখে আধভিক চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে কোনো প্রতিবাদ করছে না। মনে মনে হাসে সোহম, কারণ সে যা ভেবেছিলো তাইই হচ্ছে।

সিয়ারা: (মনে মনে — তোমাকে এখনই সবটা জানিয়ে দিতে পারলে আমার থেকে বেশি খুশি কেউ হতো না। কিন্তু যা অবস্থা করে রেখেছো তাতে বলেও লাভ হতো না। সকালে তাও ঠিক ছিলে এখন তো একদমই মনে রাখার মতো অবস্থায় নেই। আমি জানি নেশা কেটে গেলেই তুমি আবার আমাকে দূরে ঠেলে দেবে। তখন তোমার উপর কোনরকম অধিকার খাটাতে দেবে না। দেখতেই চাইবেনা হয়তো আমাকে, কথা শোনা তো দূরের কথা।]

[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে🥀]

বিঃ দ্রঃ এমনটা করে সিয়ারা কি ঠিক করলো? এরপর সত্যি ও বলার সুযোগ পাবে তো? নাকি আবার পরিস্থিতি সব কিছু বদলে দেবে? কি মনে হচ্ছে আপনাদের?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here