কথা দিলাম পর্ব -১৮+১৯

‘ কথা দিলাম ‘ 🌸❤️
||পর্ব ~ ১৮||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

আধভিক সিয়ারার বাড়ি থেকে বের হয়ে যে বড়ো রাস্তা পরে সেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি নিয়ে। সিয়ারা ঠিক যেই সময় বের হয় সেই সময় আধভিক গাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখতে পায় সিয়ারা বড়ো রাস্তায় এসেছে। নিমিষে সে আধভিকের চোখের আড়াল হয়ে যায় কারণ ও স্কুটিতে ছিলো। আধভিক সাথে সাথে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায় সিয়ারার এনজিওর উদ্দেশ্যে। সিয়ারার এনজিওতে থাকাকালীন পুরো সময়টা আধভিক এনজিওর বাইরে দাঁড়িয়ে কাটায়। সিয়ারা বেরানোর সময় তাড়াতাড়ি স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে যায়, আধভিককে দেখতে পায় না।

এক মাস পর,

আধভিকের একমাস এভাবেই কেটে গেছে। রোজ সে সকাল থেকে দুপুর সিয়ারার বাড়ি থেকে এনজিও ও এনজিও থেকে বাড়ি অবধি করেই কাটায়। তবে একদিনও সিয়ারার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি এই কয়দিনে। এমনই একদিন এনজিওতে,

__সিয়া! তুই এতটা পাষাণ কীভাবে হলি বল তো?

সিয়ারা বাচ্চাদের কাজ দিয়ে চুপচাপ জানলার বাইরে তাকিয়ে ছিলো। ঠিক সেই সময়ে দিদি এসে কথাটা বললো। কিন্তু সিয়ারা কোনো ভ্রুক্ষেপ করলো না, সে একমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।

__কি হলো টা কি? কি দেখছিস বাইরে এতো মন দিয়ে একটা কথা…

দিদি সিয়ারার কাছে গিয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে সিয়ারার চাহুনি অনুসরণ করে সেদিকে তাকাতেই চুপ করে যায়। ছলছল চোখে আলতো ভাবে সিয়ারার কাঁধে হাত রাখতেই সিয়ারা ভাঙা কণ্ঠে বলে ওঠে,

সিয়ারা: না খেয়ে, না ঘুমিয়ে কি অবস্থা করেছো দেখেছো শরীরের? চোখ মুখ কেমন শুকিয়ে গেছে দেখো?

সিয়ারা জানলা দিয়ে আধভিককে দেখছিলো। এটা ওর প্রতিদিনের কাজ। প্রথম দিন থেকেই ও লক্ষ্য করেছে আধভিক ওকে ফলো করে। তবে টের পেতে দেয়নি আধভিককে যে ও’ও তাঁকে দেখে।

__এভাবে আর কদিন কষ্ট পাবি বল তো তোরা? শুধু কি আধভিকের চোখ মুখ শুকিয়েছে, শরীরের অবস্থা খারাপ হয়েছে? তোর হয়নি?

সিয়ারা উত্তরে চুপ করে থাকে। চোখটা জলে ভরে উঠেছে ওর। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে ওর।

__তোর মনে হচ্ছে না এইভাবে আধভিককে কষ্ট দিয়ে তুই ভুল করছিস? তুই এটা ভালো ভাবেই জানিস তাই অপরাধ বোধে শেষ হয়ে যাচ্ছিস ভিতরে ভিতরে। তুই কি বুঝতে পারছিস না সিয়া তুইও আধভিককে ভালোবেসে ফেলেছিস?

সিয়ারা এইবার দিদির দিকে তাকালে দিদি বলে,

__এখনও সময় আছে সিয়া।

সিয়ারা আবারও আধভিকের দিকে তাকালো। আধভিক চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে একমনে নীচের দিকে তাকিয়ে, গাড়িতে হেলান দিয়ে। অতিরিক্ত সুন্দর দেখতে ছেলেটা কেমন জানো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সিয়ারার চোখের সামনে আধভিকের সাথে প্রথম দেখার দৃশ্য ভেসে উঠলো। স্মার্ট, হ্যান্ডসাম, ড্যাশিং একটা ছেলে ক্যামেরার পিছনে বসে ছিলো। তারপর যখন বৃষ্টির দিনে বাস স্ট্যান্ডে বসে কথা বলছিলো? একটা আলাদাই উজ্জ্বলতা মেখে ছিলো পুরো মুখটায়। আর আজ? সেই মুখেই বিষন্নতার ছাঁপ।

__এইভাবেই যদি চলতে থাকে তাহলে ছেলেটার একটা বড়সড় ক্ষতি হয়ে যাবে সি…

দিদির কথা শেষ হওয়ার আগেই সিয়ারা বেরিয়ে গেলো ওখান থেকে। দিদির মনে কেমন জানো একটা আশার আলো সঞ্চার হলো। সিয়ারা এনজিওতে থেকে বেরোতেই জানলার বাইরে চোখ রাখলো দিদি।

আধভিক: হ্যাঁ ড্যাড, বলো!

আভাস বাবু: তুমি কি আজও…

আধভিক: (নীচের দিকে তাকিয়ে) হ্যাঁ।

আভাস বাবু: আজ একটা প্রশ্ন করবো উত্তর দেবে?

আধভিক: হম, বলো।

আভাস বাবু: গত একমাসে আমি তোমার যেই ব্যবহার, আচরণ দেখেছি তাতে আমার মাথায় একটা জিনিসই এসেছে যা তুমি কখনও স্বীকার করনি আগে আমার কাছে। আজ কি তুমি স্বীকার করবে? (কিছুক্ষণ থেমে) ভিকি, আর ইউ ইন লাভ?

আধভিক চোখ বন্ধ করে নেয় আভাস বাবুর প্রশ্নে। তার চোখটা জলে ভরে গিয়ে লাল হয়ে উঠেছে। সে নিজেকে একটু সময় নিয়ে স্বাভাবিক করে বললো,

আধভিক: আই রিয়েলি, রিয়েলি লাভ হার ড্যাড! আমার মনে হয় না আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারবো বলে, থাকার মতো থাকতে পারবো বলে।

আভাস বাবু: আমাকে তাহলে কেন কথা বলতে দি…

আধভিক: আমি তোমাকে পরে কল ব্যাক করছি ড্যাড।

আধভিক আকস্মিক ব্যবহারে অবাক হয়ে যান আভাস বাবু। এভাবে কথার মাঝে হুট করে ফোন কেটে দিলো কেন সে? চিন্তিত হয়ে পরেন আভাস বাবু। এদিকে আধভিকের চোখের সামনে সিয়ারা দাঁড়িয়ে আছে। সিয়ারাকে দেখে সোজা ভাবে দাঁড়িয়ে ফোনটা পকেটে রাখতে রাখতে আধভিক নিজের যুক্তি রাখে।

আধভিক: তুমি যোগাযোগ করতে বারণ করেছিলে। তোমাকে দেখতে তো বারণ করনি তাই…

আধভিক আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না তার আগেই সিয়ারা ওর শরীরের সাথে মিশে গেলো। আধভিক শুধু টের পাচ্ছে তাঁর প্রেয়সী তাঁর গলা জড়িয়ে ধরেছে। নীচের দিকে তাকিয়ে থাকার কারণে সে দেখতে পাচ্ছে পায়ের আঙুলের উপর ভর করে সে নাগাল পেয়েছে তাঁর। সেটা দেখে ধীরে ধীরে আধভিক দু হাতে সিয়ারার কোমর জড়িয়ে নিজের সাথে চেপে ধরে। এই দৃশ্য দেখে সিয়ারার দিদি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জানলা থেকে সরে যায়।

সিয়ারা: আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ আধভিক!

আধভিকের একদম কানের কাছেই কথাটা বলায় ওর কানে বাজতে থাকে কথাটা। নিজের হাতের বাঁধন আরেকটু শক্ত করে সিয়ারার ঘাড়ে মুখ গুঁজে দেয় আধভিক।

আধভিক: এই একটা কথা শোনার জন্য আমার জীবন বেরিয়ে যাওয়ার যোগান হবে আমি ভাবতেও পারিনি।

সিয়ারা সরে আসে আধভিকের থেকে। ওর চোখদুটোসহ মুখটা এখনও জলে ভেজা।

সিয়ারা: কি অবস্থা করেছেন এটা নিজের? কে বলেছে আপনাকে এভাবে রোজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে?

আধভিক: কি করবো? ঘরে বসে থাকলে এতদিনে কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলতাম নিজের।

সিয়ারা: চুপ করুন! এটা মোটেও গর্ব করে বলার মতো কথা নয়। পাগল একটা! (আধভিকের বাহুতে ঘুষি মেরে)

আধভিক: কেন? আমি আমার প্রেমিকার জন্য দেবদাস হয়ে গেছি এটা গর্ব করে বলবো না?

সিয়ারা: এই এক মিনিট আপনি তো নেশার জিনিস ছুঁয়েও দেখেননি এই এক মাসে তাহলে দেবদাস কীভাবে হলেন?

আধভিক: (জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে) আর তুমি কীভাবে জানলে সেটা?

সিয়ারা: আব না মানে.. (আমতা আমতা করে)

আধভিক: মানে এটাই যে তুমিও আমাকে দেখতে লুকিয়ে লুকিয়ে তাই তো? আর বাকি সময়ের খোঁজ নিশ্চয় আমার অ্যাসিস্টেন্ট কম তোমার অ্যাসিস্টেন্ট বেশি সোহমের থেকে নিতে? (বাঁকা হেসে)

সিয়ারা মুখটা কাচুমাচু করে নীচের দিকে তাকিয়ে ওড়নায় আঙুল প্যাঁচাতে থাকে। একবারে ঠিক জায়গায় নিশানা লাগিয়েছে আধভিক। বেচারি বাজে ফাঁসান ফেঁসে গেছে। সিয়ারা চুপ করে থাকলে হঠাৎই আধভিক ওর কোমরে হাত রেখে তা নিজের দিকে এক ধাপ টেনে আনে। ফলে সিয়ারা আধভিকের কাঁধে হাত রেখে ওর দিকে তাকালে আধভিক জিজ্ঞেস করে,

আধভিক: এই একটা মাস শুধু আমি না তুমিও কষ্ট পেয়েছো। সেটা তোমার চোখ-মুখ বলে দিচ্ছে। কেন করলে এমন সিয়ু? কি লাভ হল এভাবে কষ্ট পেয়ে? সেই তো আমার ভালোবাসার কাছে হার মানতেই হলো তাই না?

সিয়ারা কোনো উত্তর না দিয়ে আধভিকের বুকে মাথা রেখে গুটিয়ে যায়। আস্তে করে বলে,

সিয়ারা: সবটা বলবো তোমাকে, কেন করেছি আমি এমন। আমি তোমার থেকে কিছু লুকাবো না আভি।

আধভিক: (সিয়ারাকে সোজা করে) কি বললে আরেকবার বলো? (উত্তেজিত হয়ে)

সিয়ারা: কি বললাম?

আধভিক: কি নামে ডাকলে আমায়?

সিয়ারা: উমম..আর সি কোলা! (মজা করে)

আধভিক: সিয়ু প্লিজ? বলো না?

সিয়ারা আস্তে করে আধভিকের চোখে চোখ রেখে ওর দিকে এগিয়ে যায়। কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে গিয়ে বলে,

সিয়ারা: আই..লাভ..ইউ..আভি!

আধভিকের হার্টবিট বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো সিয়ারার ঠোঁটের আলতো ছোঁয়া নিজের কানে অনুভব হতেই। সিয়ারা সরে এসে আধভিকের চোখে চোখ রাখতেই দেখে আধভিক এখনও চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। সিয়ারা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলে আধভিক নিজের ঘোর থেকে বেরিয়ে এসে বোকার মতো মাথা চুলকায়।

আধভিক: চলো।

সিয়ারাকে নিয়ে আধভিক গাড়িতে উঠে বসে। সিয়ারা কোনো প্রশ্ন করে না আধভিককে যে সে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। ওরা উপস্থিত হয় আধভিকের ফ্ল্যাটে। আসার পথে অনেক ভয় নিয়েই আধভিককে ধীরে ধীরে সবটা বুঝিয়ে দেয় যে কেন সে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো ওকে। দিয়ারার উপর রাগ হলেও অনেক কষ্টে আধভিক সেটা গিলে নেয় একপ্রকার। সিয়ারা সেটা বুঝতে পেরে সাথ দেয় আরও আধভিকের। নিজের ঘরে নিয়ে যাওয়ার পর আধভিক দরজা বন্ধ করতে গিয়েও যখন থেমে গিয়ে দরজাটা উল্টে খুলে দেয় তখন সিয়ারা জোরে হেসে ফেললো।

আধভিক: না বাবাহ! আর একই ভুল করবো না।

হাসতে হাসতে সিয়ারার হঠাৎই চোখ গেলো একটা ফটো ফ্রেমের উপর। সিয়ারা সেদিকে এগিয়ে গিয়ে ফ্রেমটা হাতে নিতেই আধভিক ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো।

সিয়ারা: আভি, তোমার সাথে এই ছেলেটা কে ছবিতে? সোহমদা বলে তো মনে হচ্ছে না।

আধভিক: মাই ব্রাদার…

সিয়ারা: (অবাক হয়ে) তোমার ভাই আছে?

আধভিক: ব্রাদার ফ্রম অ্যানাদার মাদার!

সিয়ারা কথাটা শুনে চুপ করে গেলো। অপেক্ষা করতে থাকলো আধভিকের আরো কিছু বলার কারণ ও যেটা ভাবছে সেটা নাও হতে পারে। বেস্ট ফ্রেন্ডও তো হতেই পারে, সৎ হতে হবে এমন কোনো কথা আছে?

আধভিক: মাই স্টেপ ব্রাদার।

সিয়ারা চোখ বুজে নেয়। ও আশা করছিলো ওর ধারণা হয়তো মিথ্যে হবে কিন্তু নাহ, সেটাই সত্যি দাঁড়ালো। সিয়ারা চোখ খুলে ফ্রেমটা রেখে দিতেই পাশের যে ফ্রেমে চোখ পরলো সেটাই ওর চোখ আটকে গেলো। ছবিটা, ছোট্টো আধভিক আর ওর মায়ের। আধভিক বুঝতে পারলো সিয়ারা ওই ছবিটার দিকেই তাকিয়ে আছে।

আধভিক: আমার মম! এই মানুষটাকে আমি হারাতে চাইনি কখনও। আমি কল্পনাও করিনি মমের সাথে আমার জার্নিটা এতটা শর্ট হবে। তুমি বলেছিলে না? আমি কীভাবে মাটির ভাঁড়ে চা খেতে পারছিলাম?

সিয়ারা: আণ্টি শিখিয়েছিলেন?

আধভিক: হম। অনেক ছোটো বয়সে। আসলে, ড্যাড কখনও মমকে নিয়ে কোথাও যেতো না। তাই মম আমাকে নিয়ে এদিকে সেদিকে বেরিয়ে পড়তো। আমার ঠাম্মি মমকে পছন্দ করে এনেছিল ড্যাডের পছন্দ ছিলো না। তাই কখনও আমার মমের সাথে ঠিক ভাবে কথা বলেনি, কখনও না। আর আমার মম? সবসময় ভালো ভাবে কথা বলেছে, ভালোবেসে গেছে। বদলে পেয়েছে শুধু কষ্ট। আমি নিজে দেখেছি প্রতি রাতে আমার মমকে চোখের জল ফেলতে কিন্তু আমার কিচ্ছু করার ছিলো না। কিচ্ছু করতে পারিনি আমি।

সিয়ারা নিজের কাঁধে আধভিকের কাঁপা নিশ্বাস অনুভব করতেই ও পিছন ফিরে আধভিকের দু হাতের মাঝে চলে যায়। আস্তে করে জিজ্ঞেস করে,

সিয়ারা: আণ্টি কীভাবে…

আধভিক: সুইসাইড। শি ওয়াজ কমিটেড সুইসাইড।

সিয়ারা দমে গেল। ও ভেবে উঠতে পারছে না ওর ঠিক কি বলা উচিত। আধভিক নীচের দিকেই তাকিয়ে আছে এখনও। সে আবার বলতে শুরু করে,

আধভিক: মম জানতো যে ড্যাড মমকে পছন্দ করে না। তাই কষ্ট পেতো, চোখের জল ফেলত। কিন্তু একটা সময় যাওয়ার পর মম জানতে পারে…ড্যাডের জীবনে অন্য কেউ আছে। সেইদিন…সেইদিনটার কথা আমার মনে আছে। মমের সাথে অনেক কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু মম কোনো উত্তর দেয়নি। চুপ করে পাথরের মতো বসে ছিলো। কাঁদছিলো পর্যন্ত না। বিয়ের পর থেকে মম আপ্রাণ চেষ্টা করে চলে ছিলো ড্যাডের পছন্দের হয়ে ওঠার কিন্তু সেদিন গিয়ে জেনেছিল যে সেটা আর কখনও সম্ভব নয়। ইউ নো সিয়ু, আমি খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম বিষয়টা। মমের পরিস্থিতি আমাকে ফীল করিয়েছিল, যে ঠিক কতটা কষ্ট হয় নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্যকাওর সাথে দেখলে। এইজন্যেই হয়তো তোমাকে সেদিন অন্য একজনের সাথে দেখে এতটা রিয়্যাক্ট করেছিলাম। ঠিক এই কারণেই আমি এতটা ওভার পজেসিভ। আমার ওই সিচুয়েশনটা ফেস করার মত সহ্য ক্ষমতা নেই। আ’ম, আ’ম রিয়েলি স্যরি ফর দ্যাট।

সিয়ারা: আমি বুঝতে পেরেছি আভি। প্লিজ ডোন্ট ফীল স্যরি ফর দ্যাট। আমি মনে করি তোমার ওখানে কোনো দোষ ছিলো না। (ছলছল চোখে)

আধভিক: আমি, আমি ড্যাডের একটা কথা এখনও ভুলতে পারি না জানো? তখন কথাটার মানে বুঝিনি। কিন্তু পরে যখন বুঝতে পেরেছি তখন নিজেকে ভীষণ হেল্পলেস মনে হতো।

সিয়ারা: এমন কি কথা বলেছিল আঙ্কেল তোমাকে?

আধভিক: আমাকে না, মমকে। ড্যাডের অ্যাফেয়ার সম্পর্কে জানার আগে প্রথমবার মম ড্যাডের মুখের উপর কথা বলেছিলো। আমি চুপ করে বিছানায় বসে ছিলাম। মম বলেছিল যে কেন ড্যাড এমন করছে। আমার কথাটা একবার ভেবে, নতুন ভাবে সবটা শুরু করা যায় না?

সিয়ারা: আর আঙ্কেল কি বলেছিল?

আধভিক: (তাচ্ছিল্য হেসে) অ্যাট দ্যা টাইম হি ওয়াজ ড্রাংক। সো মমকে একটি চড় মেরে বলেছিলো, “আধভিক আমার জীবনে একটা মিসটেক। সেদিন তুমি আমার ড্রাঙ্কড অবস্থার সুযোগ নিয়েছিলে। যাতে এই বাড়িতে থাকতে পারো। আজ যদি আধভিক না থাকতো কবে তোমাকে তাড়িয়ে দিতাম। শুধুমাত্র আধভিকের কথা ভেবেই তোমাকে এখানে রেখেছি।” মম পরিবর্তে বলেছিলো, “আধভিকের কথা ভেবেই আমি রয়েছি। নাহলে অনেকদিন আগেই চলে যেতাম।”

সিয়ারার চোখ থেকে জল গড়াচ্ছে। সে আন্দাজ করেছিলো আধভিকের ভিতরে অনেক কষ্ট লুকিয়ে আছে কিন্তু এতটা কষ্ট? ধারণার বাইরে ছিলো সিয়ারার। এতো কিছু সহ্য করেছে ছেলেটা ওইটুকু বয়সে? ওর মনে হয় হয়তো এখানেই শেষ নয়।

আধভিক: বড়ো হয়ে কথাটা যখন মনে করতাম তখন এটাই মনে হতো আমি এমন একজন মানুষ যাকে কেউ চায় না, যার কেউ নেই। ছোটবেলায় বুঝিনি দেখেই তো যেই মানুষটার কাছে আমি একটা মিসটেক ছিলাম তাঁকেই আকড়ে ধরতে চাইছিলাম। (তাচ্ছিল্য হেসে)

সিয়ারা: তোমার সৎ ম…

আধভিক: উনি আমার মা নন! আমি মনে করি না ওনাকে নিজের মা। উনি আমার মাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন। উনি জানতেন ড্যাড বিবাহিত তারপরেও সরে যাননি। যেদিন মম জানতে পারলো সত্যিটা তারপর থেকেই আর কথা বলেনি ড্যাডের সাথে ইভেন কাওর সাথে। জানি না কেন, প্রথম হয়তো ড্যাডের চোখে অনুতাপ দেখেছিলাম। ড্যাড এসেছিলো মমের সাথে কথা বলতে। মম শুধু শুনেছে, কোনো উত্তর দেয়নি। ড্যাড ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর সেই যে দরজা দিলো আ..আর বেরিয়ে এলো না, যেভাবে গেছিলো সেভাবে। অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কা দেওয়ার পরেও যখন দরজা খুলছিল না তখন জানলায় গিয়ে দেখলাম মম…

সিয়ারা আরেকটু শক্ত করে ধরে আধভিককে। আধভিক ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হয় তাঁর এই কথাগুলো মনে পরলে।

আধভিক: দেখলাম মম, একটা চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে। অনেক বার বলেছিলাম মমকে, অনেক চিল্লিয়ে ছিলাম যে “মম! এমনটা করো না। দরজা খোলো। আমি তোমার কাছে যাবো।” মম তাকায় পর্যন্তনি আমার দিকে। যখন তাকালো তখন শেষবারের মতো চোখে জল নিয়ে একগাল হেসেছিল আর তারপর…

আধভিক ঘুরে গেলো অন্যদিকে। সিয়ারা নিজের হাত দিয়ে মুখ চেপে অবিরাম কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে আধভিকের কাঁধে হাত রাখলে আধভিক ফটো ফ্রেমটা দিকে তাকিয়ে অভিযোগ আর অভিমান মিশ্রিত সুরে বললো,

আধভিক: মম নিজের কথা রাখেনি। মম ভাবেনি আমার কথা। শুধু ওই লোকটার কথা ভেবেছে যে কি না প্রথম থেকে মমকে কষ্ট দিয়েছে। ওই লোকটার দেওয়া কষ্ট মনে করেই মম আমায় একা করে দিয়ে চলে গেলো। আমার কথা ভাবলে এমনটা করতে পারতো না। সারাজীবন কষ্ট ছাড়া কিচ্ছু পায়নি মম। প্রথমে নিজের মামাবাড়িতে মামা মামীর দেওয়া কষ্ট আর বিয়ের পর স্বামীর।

সিয়ারা: তোমার ঠাম্মি? উনি নিশ্চয় ভালোবাসতেন আণ্টিকে?

আধভিক: ভীষণ ভালোবাসতো। মেয়ের সখ ছিলো তো খুব তাই আমার মমকে নিজের মেয়ে মনে করতো। নিজের মেয়ের মৃত্যুটা মেনে নিতে পারেনি। আমাকেও ভীষণ ভালোবাসতো, সব সময় খালি দাদান আর দাদান।

আধভিক চোখে জল নিয়েই একটু হাসলো। তারপর ঠোঁট চেপে ফেললো। সিয়ারা চোখ বুজে নিলো কারণ সে আন্দাজ করতে পারছে এইবার আধভিক কি বলবে।

আধভিক: আমার চিৎকার শুনে যতক্ষণে ঠাম্মি উপরে এসেছে ততক্ষণে সব শেষ। চোখের সামনে মমকে ছটফট করতে দেখলাম কিন্তু কিছু করতে পারলাম না। একটা আট বছরের ছেলে কি বা করবে চিৎকার করা ছাড়া? ড্যাড বাড়ি এসে সবটা জানার পর ঠাম্মিকে যখন জানালো সে মমকে বিয়ে করার এক দুবছর পরেই আরেকটা বিয়ে করেছে এবং তাঁর একটা সন্তানও আছে সেঘরে। সেটা শোনার পর …. ঠাম্মি হার্ট অ্যাটাক করে। মেয়েকে একা ছাড়েনি, কিন্তু নিজের দাদানকে একা ছেড়ে গেছে।

সিয়ারা নিজের ওড়না দিয়ে আধভিকের চোখের জল মুছিয়ে দিলে আধভিক সিয়ারাকে জড়িয়ে ধরে। আধভিকের কাঁধে মাথা রেখে সিয়ারা মনে মনে সেদিকে বলা আভাস বাবুর কথা মনে করে। উনি বলেছিলেন “সব শেষে এই বুড়ো মানুষটাকে জানো ভুলে যেও না।” উনি অপরাধ করেছেন দেখেই কথাটা বলেছিলেন।

সিয়ারা: আভি, একটা কথা বলবো?

আধভিক: (আর একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে) হম।

সিয়ারা: আঙ্কেলকে এখন দেখলে বোঝাই যায় না উনি তোমাকে অপছন্দ করতেন। ওনার তোমার প্রতি কেয়ার, ভালোবাসা দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না এমন একটা ইতিহাস আছে। এমন কেন? উনি কি তোমার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন?

আধভিক: এইসবই হয়তো ওনার পাপের প্রায়শ্চিত্ত। আমি জানি না হঠাৎ করেই উনি কেন আমাকে নিয়ে এতটা ভাবতে শুরু করেছেন। আমার তো এটাই মনে হয়, মম আর ঠাম্মির সাথে সেদিন আমারও কিছু একটা হয়ে গেলে ভালো হতো।

সিয়ারা: (সোজা হয়ে) আভি! কি আজে বাজে কথা বলছো?

আধভিক: ঠিকই বলছি। তুমি আসার আগে আমার জীবনটা জীবন ছিলোই না। ভালোবাসা জিনিসটাকেই বিশ্বাস করতাম না আমি। তখন যদি উনি আমাকে মেরে ফেলতেন ভালো হতো। সব ল্যাটা চুকে যেতো একবারে। এতো কষ্ট পেতে হতো না প্রতিনিয়ত আমাকে।

সিয়ারা: (দু গালে হাত রেখে) চুপ, একদম চুপ! আমি এখন এসে গেছি তো তোমার জীবনে? তাহলে একদম এসব কথা ভাববে না আর।

আধভিক: না সিয়ু। যখন তুমি আমাকে আমাদের স্ট্যাটাস নিয়ে বলেছিলে তখনও আমার এটাই মনে হচ্ছিলো ড্যাড কেন আমাকে নিজের পরিচয় দিল। আমি যখন একটা মিসটেক তখন কোনো অনাথ আশ্রমে দিয়ে দিতে পারতো। নিজের পরিচয় নিজে তৈরী করে নিতাম আমি। আই সোয়্যার তুমি যদি আমার কাছে ফিরে না আসতে তাহলে এই পরিচয় রাখতাম না আমি। নিজের অস্তিত্বই রাখতাম না তো সেখানে পরিচয়।

সিয়ারা: এতোটা ভালোবাসলে কবে আমাকে আভি? (চোখে চোখ রেখে)

আধভিক: যখন প্রথম তোমাকে দেখেছিলাম বা তুমি যখন সময় চেয়ে ছিলে একে অপরকে চেনার কিংবা গত এক মাসে। জানি না আমি। আমি শুধু জানি তুমি আমার জীবন থেকে চলে গেলে আমি আবার একা হয়ে যাবো। আর সেই একাকীত্ব টা সহ্য করার ক্ষমতা হয়তো আমার মধ্যে নেই। বাঁচার মতো বাঁচতে পারব না আমি।

সিয়ারা আধভিককে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। বেশ কিছুক্ষণ ওভাবে থাকার পর আধভিক সরে এসে বলে,

আধভিক: তোমাকে একটা জিনিস দেখাবো চলো। আধভিক আর সিয়ারা ওদের ঘরের মধ্যে থাকাই এক কোণে থাকা ঘরের মধ্যে গেলো। জানলার পর্দাগুলো সরিয়ে দিতেই সিয়ারা অবাক হয়ে গেলো। কি দারুন দারুন সব স্কেচ।

সিয়ারা: এগুলো কি তোমার করা স্কেচ আভি? (অবাক হয়ে)

আধভিক: হম। ভালো লাগছে এগুলো?

সিয়ারা: খুব সুন্দর এগুলো। তুমি স্কেচ, অয়েল পেন্টিং এগুলো আলাদা করে রেখেছ?

আধভিক: আরেকটা জিনিস আলাদা করে রেখেছি।

আধভিকের দিকে সিয়ারা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে আধভিক ওকে টেনে নিয়ে নিজের স্টাডি টেবিল থেকে একটা ড্রয়িং কপি হাতে দেয়। সিয়ারা সেটা খুলে দেখতেই একপ্রকার টাস্কি খায়।

সিয়ারা: তুমি তো পুরো প্রফেশনাল ডিজাইনার আভি?

আধভিক: হম, এটাই আমার প্যাশন। আমি কখনওই একজন প্রোডিউসার হতে চাই না। ড্যাডের উত্তরাধিকারী হিসেবে তাঁর ছোটো ছেলে আছে তো? আমি না হয় আমার মমের স্মৃতিটাই আকড়ে ধরে বাঁচলাম।

সিয়ারা: আণ্টি কি তোমাকে..??

আধভিক: মম খুব ভালো আঁকতো। আমি তো মনে হয় অ-আ লেখার আগে সূর্য এঁকে ছিলাম। (হেসে উঠে)

সিয়ারাও হেসে ফেলে আধভিকের হাসি দেখে। সিয়ারা টোন কেটে আধভিককে বলে,

সিয়ারা: আন্টিকে দেখলেই বোঝা যায় আন্টি খুব মিষ্টি, শান্তপ্রিয় মানুষ ছিলেন। তাহলে তুমি এত করলার মতো তেঁতো আর বদমেজাজি হলে কীভাবে ওনার সাথে থেকে?

আধভিক বেচারা বাচ্চাদের মতো মাথা নীচু করে মাথা চুলকে বলে

আধভিক: আই হেইট করলা! আমি কেন করলার মতো হতে যাবো? হ্যাঁ শর্ট টেম্পার তবে…

সিয়ারা: (ধমক দিয়ে) চুপ! এই শর্ট টেম্পারের চক্করে কোন দিন দেখবে তোমার মাথার শর্ট সার্কিট হয়ে যাবে।

আধভিক: কথায় কথায় খালি ধমক দেয়। (খুব ধীরে)

সিয়ারা মনে মনে হাসে আধভিকের মুখের অবস্থা দেখে। আরও কিছুক্ষণ ওখানে থাকার পর আধভিক সিয়ারাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। গাড়িতে,

আধভিক: সিয়ু, আমি ঠিক করেছি আমি নিজের একটা ফ্যাশন হাউজ করবো।

সিয়ারা: এটা তো খুব ভালো বিষয় আভি। (খুশি হয়ে)

আধভিক: এর থেকেও একটা ভালো বিষয় আছে।

সিয়ারা: কি?

আধভিক: আমার ফ্যাশন হাউজের মেইন ডিজাইনার হবে…তুমি!

সিয়ারা: (চমকে উঠে) আমি? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে আভি? আমি ডিজাইনার..কি বলছো এসব?

আধভিক: ঠিকই বলছি।

সিয়ারা: না ঠিক বলছো না। আমার কোনো ডিগ্রি নেই। আমি তো সখের বশেই…

আধভিক: নেশাকে পেশা বানাতে কতক্ষণ? আর আমার ফ্যাশন হাউজে কাকে ডিজাইনার হিসেবে রাখবো আর কাকে নয় সেটা আমার ব্যাপার। তুমি চিন্তা করো না, তোমাকে আমি কোর্সে ভর্তি করে দেবো কাজ করার পাশাপাশি। আর তুমি সকালে যেমন এনজিওতে আসো তেমনই আসবে। এরপর আর আমি কিছু শুনতে চাই না, তোমার বাড়ি এসে গেছে।

সিয়ারা মুখটা কাঁচুমাচু করে নীচের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর সময় নষ্ট না করে গাড়ি থেকে নেমে যেতে নিলে আধভিক পিছন থেকে ওকে ওর নাম ধরে ডাকে। ও মাথা আধভিকের দিকে কিছুটা ঘোরাতেই, আধভিক সিয়ারার মাথার নীচটা বাম হাতের মাঝে নিয়ে সিয়ারাকে আচমকাই নিজের একদম কাছে টেনে আনলো। সবটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটে যাওয়ার সিয়ারা কিছুই ঠাওর করে উঠতে পারলো না। বুঝতে পারলো তখন যখন নিজের কপালে আধভিকের ঠোঁটের ছোঁয়া পেলো। আবেশে নিজের চোখ বুজে নিলো ও। কিছুটা সময় ওভাবে থাকার পর আধভিক নিজের ঠোঁট সরিয়ে কপালে কপাল ঠেকালো।

আধভিক: আমি বাড়ি পৌঁছে, ফ্রেশ হয়ে কল করবো। ওকে? আর আগামীকাল থেকে যেমন আমি নিতে আসতাম তেমনই আসবো। তোমাকে এনজিওতে ড্রপ করে আমি চলে যাবো দ্যান ফেরার সময় নিয়ে আসবো। মনে থাকবে?

সিয়ারা কোনো কিছু না বলে আধভিকের গালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে ঝটপট গাড়ি থেকে নেমে চলে যায়। আধভিক কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে বসে সিয়ারার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। সিয়ারা বাড়িতে ঢুকে গেলে স্টিয়ারিং এ মাথা ঠেকিয়ে বসে হাসে তারপর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
‘ কথা দিলাম ‘ 🌸❤️
||পর্ব ~ ১৯||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

ছয় মাস পর,

সিয়ারা আর আধভিক বেশ ভালো ভাবেই নিজেদের সময়টা কাটাচ্ছে। দিয়ারা কোনরকম কোনো কথা সিয়ারাকে নিয়ে বলেনি এই বিষয়ে তাই সিয়ারাও কথা বাড়ায়নি। সে আধভিকের কথা মতো সকালে এনজিও, তারপরে কোর্স করা এবং এরপর যে সময়টা বেঁচে থাকে সেটা আধভিকের ফ্যাশন হাউজে দেয়। ফ্যাশন হাউজ জয়েন করেছে যদিও এক মাস হয়েছে। কারণ ফ্যাশন হাউজের জন্য বিল্ডিং আধভিক আগে থেকেই কিনে রেখেছিলো ঠিকই কিন্তু সিয়ারার মন পছন্দ মতো সাজিয়ে নেওয়ার পরেই সেখানে ধীরে ধীরে কর্মচারী নিয়োগ করতে শুরু করে। এমনই একদিন সিয়ারা সকাল সকাল এনজিওতে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নীচে নামতেই স্থির হয়ে দাঁড়ালো একজায়গায়। ওর সামনে আভাস বাবু আর আধভিক বসে আছে, পাশে সিয়ারার মা। সিয়ারা আধভিকের দিকে তাকাতেই দেখলো আধভিক চায়ের কাপে একটা চুমুক দিতে দিতে ওকে চোখ মারলো।

আভাস বাবু: সিয়া মা, এদিকে আসো একবার।

সিয়ারার মা: আয় এদিকে এসে বস। ওনারা অনেকক্ষণ ধরে তোর অপেক্ষা করছে। সিয়ারা ধীরে ধীরে ওর মায়ের দিকে এগিয়ে যেতেই ওর মা জিজ্ঞেস করলো ওকে,

সিয়ারার মা: আভাস বাবু চান, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আধভিক আর তোর বিয়েটা দিয়ে দিতে। তোর কি মত আছে?

সিয়ারা: আমি, আমি তো..আসলে আঙ্কেল আমি বিয়ে করে চলে গেলে আমার মায়ের উপর চাপ পড়ে যাবে অনেক। এমনিতেই আমি এখন শুধু এনজিও তে পড়াই, বিকেলে যে টিউশনি করতাম সেগুলো ছেড়ে দিয়েছি। মার একার রোজগারে তো সংসার চলবে না। আর বোন যা রোজগার করে সেটা আমরা নিইনা। ওটা ওর হাতখরচ। তাই…

দিয়ারা: তুই চলে গেলে না হয় আমি আমার হাতখরচটা কমই করবো। তাছাড়া আমার রোজগারটা পুরোপুরি ভাবে ব্যবহার করিনা আমি। তুই অন্তত এমন কিছুই শিখাসনি আমাকে। তাই তুই চিন্তা করিস না, আমার আর মায়ের খুব ভালো ভাবে চলে যাবে।

আধভিক: আমার শালী দেখছি বড়ো হয়ে গেছে অনেক। তা শালী সাহেবা পড়াশোনাটা ঠিকঠাক হচ্ছে তো? রেজাল্ট খারাপ হলে কিন্তু…

দিয়ারা: দিই খবর করে দেবে, তোমাকে কিছু করতে হবে না।

দিয়ারার কথায় সিয়ারা চোখ রাঙালে সবাই হেসে ফেলে। সিয়ারা আর কোনো বাঁধা দেয় না যখন ওর মাও বলে বিয়েতে সম্মতি দিতে। সেদিনই পাকা দেখা সেরে বিয়ের ডেটটা জানিয়ে দিয়ে যায় আভাস বাবু যা আগের থেকে ঠিক করেই এসেছিলেন উনি।

রাতে,

সিয়ারা বসে বসে ড্র করছে এমন সময় আধভিকের কল এসে। কলটা রিসিভ করতেই সিয়ারাকে সে বেরিয়ে আসতে বলে রেখে দেয়।

সিয়ারা: বড়ো লাট সাহেব হুকুম যখন করেছেন তখন যেতে তো হবেই। উফ, রাত বিরেতে এই ছেলেটা না ঘুমিয়ে প্রেম করতে এসেছে। বড়ো পাগলের পাল্লায় পরেছি আমি।

সিয়ারা ধীরে ধীরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আধভিকের দিকে এগিয়ে গেলে আধভিক একটা কিউট স্মাইল দেয়। কিন্তু সেটাকে পাত্তা না দিয়ে সিয়ারা কোমরে হাত দিয়ে, মেজাজ দেখিয়ে বলে,

সিয়ারা: রাত বিরেতে না ঘুমিয়ে এখানে কি করতে এসে…

সিয়ারা আর কিছু বলার আগেই আধভিক এক ঝটকায় সিয়ারার কোমরে হাত রেখে, নিজের দিকে টেনে আনে সিয়ারাকে। সে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকায় দুজনের নিশ্বাস দুজনের মুখে আছড়ে পরছে। নাহলে বেচারি সিয়ারা অনেকটাই নাটা আধভিকের থেকে।

আধভিক: প্রেম করতে এসেছি “বউ!”

সিয়ারার পেটের মধ্যে অদ্ভুত একটা অনুভুতি হয় যখন আধভিক “বউ” শব্দটা উচ্চারণ করে। আমতা আমতা করে বলে,

সিয়ারা: খ..খেয়ে দেয়ে কাজ নেই না ত..তোমার? ক..কি চাই এতো রাতে? যাও বা..

আধভিক: তোমাকে চাই বউ! এখন তাড়িয়ে দিও না।

সিয়ারা চুপ করে যায়। কিছুক্ষণ গল্প করার পর সিয়ারা সরে আসতে চাইলে আধভিক বাঁধা দেয়। সিয়ারার ঘাড়ে এক হাত রেখে মুখটা আর একটু কাছে টেনে আনে। সিয়ারা আধভিক কি করতে চলেছে বুঝতে পেরে ঝট করে সরে যায় আর বলে,

সিয়ারা: এটা আবাসন বলে যে কেউ কিছু দেখে না তা কিন্তু নয় ঠিক আছে? ভাগ্যিস বাবা আবাসনে একটা ফ্ল্যাট রেখে গেছিলো। নাহলে তোমার জ্বালায় অনেক আগেই আমাদের বাড়ি ছাড়া হতে হতো।

আধভিক: ধুর! এর থেকে তো ফরেইন কান্ট্রি ভালো। যখন তখন যেখানে খুশি রোম্যান্স করা যায়। (মুখ বেজার করে)

সিয়ারা: (দু হাত ভাঁজ করে) আচ্ছা? তো তুমি কজনের সাথে রোম্যান্স করেছো? “যখন তখন, যেখানে খুশি?”

আধভিক একটা উত্তর দিতে গিয়েও থেমে যায়। সিয়ারার প্রশ্নটা আরেকবার ভেবে তরাং করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,

আধভিক: এই এই! আমি এসব করিনি কখনও। আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড ছিল নাকি যে করবো? আমি তো শুধু দেখতাম।

সিয়ারা: লজ্জা করে না তোমার এইসব দেখতে তুমি? আবার সেইটা গর্ব করে বলছো?

আধভিক: তো কি করতাম চোখের সামনে আসলে? গিয়ে বলতাম, তওবা তওবা! এমন ভাবে ওপেনলি রোম্যান্স কেউ করে?

আধভিকের কথা শুনে হেসে ফেলে সিয়ারা। আধভিকও হেসে দেয়। তারপর বলে

আধভিক: তোমার কাছে কোনো কিছু বলতেই আমার লজ্জা লাগে না। আর না লাগে ভেবে চিন্তে কোনো কথা বলতে। (সিয়ারার কাছে গিয়ে)

সিয়ারা: ঠিক আছে ঠিক আছে হয়েছে। হুহ! এবার বাড়ি যাও।

আধভিক: বিয়ের আগে মনে হয় না তোর কপালে রোম্যান্স আছে ভিকি। আর বিয়ের পরেও আদর খাওয়ার জন্য যুদ্ধ করতে হবে যা বুঝতে পারছি। না হলে এতদিন কেউ এতো সুন্দর দেখতে একটা বয়ফ্রেন্ডকে, এতো কাছে পেয়েও নিরামিষ করিয়ে রাখে? (আক্ষেপ করে, নীচের দিকে তাকিয়ে)

সিয়ারা: একটা দেবো! যাও ভাগো। খালি আজে বাজে বকে। (আধভিকের বাহুতে থাপ্পড় দিয়ে)

আধভিক: চুমু দিতে বললাম থাপ্পড় দিয়ে দিলে। আবার বলছো “এক দেবে?” চুমু হলে নিতে রাজি আছি থাপ্পড় হলে দরকার নেই থাক। কি কপাল আমার, চাইলাম চুমু পেলাম থাপ্পড়! স্যাড লাইফ।

সিয়ারা: ইশ! তোমার মুখে কিছুই আটকায় না নাকি? (লাজুক ভাবে)

আধভিক সিয়ারার প্রশ্নে সিয়ারার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করেই ওর কাছে গিয়ে ওর কপালে নিজের ঠোঁটজোড়া রাখে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে গভীরভাবে ছুঁয়ে রেখে সরে এসে, সিয়ারার এক গালে হাত রাখে।

আধভিক: না কিছু বলতে আটকায় আর না কিছু করতে। বাইরে সবার কাছে ভদ্র হলেও তোমার কাছে অভদ্রই থাকবো জান। লাভ ইউ! (গালে ঠোঁট ছুঁয়ে)

আধভিক হেসে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। সিয়ারা মনে মনেই ব্লাশ করতে থাকে ওখানে দাঁড়িয়ে। আধভিক গাড়ির দরজা বন্ধ করলে সিয়ারা জানলার সামনে দাঁড়ায়।

সিয়ারা: সাবধানে যাবে।

কথা শেষ করে আধভিকের কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে সরে আসে সিয়ারা। আধভিক হেসে বলে,

আধভিক: যাক কিছু তো পাওয়া গেলো। কষ্ট করে আসাটা বিফল যায়নি একবারে। (দুষ্টু হেসে)

সিয়ারা: উফ! আবার শুরু হলো? ধুর আমি চললাম। তুমি পৌঁছে টেক্সট করবে।

সিয়ারা আর না দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরলো। সিয়ারাকে বাড়িতে ঢুকে যেতে দেখে আধভিক বেরিয়ে গেলো ওখান থেকে। আধভিকের গাড়ির আওয়াজ পেয়ে সিয়ারা বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে। দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল সে, যায়নি নিজের ঘরে। আধভিকের গাড়িটা যতটা দূর দেখা যায় ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সিয়ারা। এদিকে আধভিক লুকিং গ্লাসে সিয়ারাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসে। নিজের ফোনটা নিয়ে সিয়ারাকে কল করে বলে,

আধভিক: ঘরে যান মহারানী। অনেক রাত হয়েছে এভাবে একা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না আর।

সিয়ারা টুক করে ফোন কেটে দেয়। ধরা পড়ে গেছে ভেবে জিভ কেটে দৌঁড় দিয়ে বাড়িতে ঢুকে নিজের ঘরে চলে যায়। দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এগিয়ে আসে। বিয়ের দিনই আশীর্বাদ করার কথা তাই বরযাত্রী একটু আগে এসেছে। দিয়ারাকে উপরে পাঠানো হয় সিয়ারাকে ডাকতে। অনেকক্ষণ যাবৎ দিয়ারা না আসলে আরেকজন যায় ওদের ডাকতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটা হন্তদন্ত হয়ে নেমে এসে বলে,

__সিয়ারা ঘরে নেই। ও চলে গেছে।

আধভিক: চলে গেছে মানে? কোথায় গেছে? এদিক ওদিক কোথাও…

__না! দিয়াকে কনের সাজে সাজিয়ে সিয়ারা পালিয়ে গেছে।

কথাটা শুনে আধভিক চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আভাস বাবু রেগে গিয়ে বললেন,

আভাস বাবু: এরকম মজা করা ঠিক নয়। এসব কি বলছো তুমি?

সিয়ারার মা: ঠিকই বলছে ও বেয়াই মশাই। সিয়া ঘরে নেই। এই চিঠিটায় ও বলে গেছে সব কথা। (ভাঙা কণ্ঠে)

সিয়ারার মা চিঠিটা এগোতেই আধভিক কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটা নেয়। ধীরে ধীরে ভাঁজ খুলতেই দেখেই সিয়ারার হাতের লেখা।

“আধভিক! আমি তোমাকে অনেক বার বলতে চেয়েও বলে উঠতে পারিনি। আমি এই বিয়েটা কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছি না। চেষ্টা করেছিলাম বিয়েটা আটকানোর কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। আমার বোন যে তোমায় ভালোবাসে তোমাকে সেটা আগেই জানিয়েছিলাম আমি তাই ঠিক করলাম বিয়ের দিন ওর সাথেই না হয় তোমার গাঁটছড়া বেঁধে দেবো। সামনে দাঁড়িয়ে থেকে তো এটা সম্ভব নয় তাই আমি সরে এলাম। তোমার হাতে নিজের বোনকে তুলে দিলাম আধভিক, সামলে রেখো ওকে এবং আমার মাকে।

ইতি তোমার সিয়ু”

চিঠিটা হাতে মুড়িয়ে নিয়ে হুড়মুড় করে সিয়ারার ঘরে চলে গেল আধভিক। ঘরে গিয়ে দেখলো দিয়ারা কনের সাজে বসে আছে। দিয়ার আধভিককে দেখতেই উঠে দাঁড়ায়।

আধভিক: তুমি জানতে এ বিষয়ে?

দিয়ার নীচের দিকে তাকিয়ে না বোধক মাথা নাড়ে। আধভিক রাগে, ক্ষোভে, কষ্টে চোখ বুজে নেয়।

আধভিক: তুমি নীচে যাও।

দিয়ার সাথে সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। দিয়ারা বেরিয়ে গেলে আধভিক ঘুরে ঘুরে ঘরটা দেখতে থাকে। চোখটা জলে ভরে উঠেছে ওর। সিয়ারার একটা ফটোফ্রেম হাতে নিয়ে বলে,

আধভিক: এইভাবে আমাকে ঠকালে সিয়ারা? বার বার অনুরোধ করার পরেও ছেড়ে চলে গেলে?

আধভিক চিৎকার করে কেঁদে ওঠে সিয়ারার নাম ধরে। নীচ থেকে সবাই সেটা শুনে কেঁপে ওঠে। আভাস বাবু চোখ বন্ধ করে নেন ছেলের আর্তনাদ শুনে। কিছুক্ষণ পর আধভিক নীচে নেমে এসে না দাঁড়িয়ে সোজা আভাস বাবুর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। আভাস বাবু ছেলের মুখ দেখে বুঝতে পারেন ঠিক কি ঝড়টা বয়ে যাচ্ছে ওর উপর।

আধভিক: চলো ড্যাড!

সিয়ারার মা: তুমি বিয়েটা করবেনা বাবা?

আধভিক: যাকে বিয়ে করার কথা ছিল সেই তো বিয়েটা করতে চায়নি আন্টি। আপনি চিন্তা করবেন না, আপনার এবং আপনার মেয়ের কোনো রকম কোনো অসুবিধা আমি বেঁচে থাকতে হতে দেবো না। আসি!

আধভিক বেরিয়ে গেলে আভাস বাবুও বেরিয়ে যান। ধীরে ধীরে সব আত্মীয় স্বজন এক এক করে বেরিয়ে যেতে থাকেন।
________________________________________________________

হঠাৎ অন্ধকার হয়ে যায় পুরো হল। সামনে চলতে থাকা বিগ স্ক্রিনটা অফ হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে ছোটো ছোটো আলো জ্বলে উঠছে। কিন্তু সিয়ারার সেই হুঁশ নেই সে নিজমনে চোখের জল ফেলছে। ওর চোখের সামনে এখনও শেষের ঘটনটা প্রতিফলিত হচ্ছে। নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে ও পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো আধভিক নেই। সিনেমাটা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই সিয়ারা বুঝে যায় এটা ওর আর আধভিকের অতীত নিয়ে তৈরী। তখনই ও পুরোপুরি মগ্ন হয়ে যায় পুরনো স্মৃতির মাঝে। আধভিক যে কখন চলে গেছে খেয়ালই নেই।

সিয়ারা চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। এদিক ওদিক তাকায় কিন্তু আধভিককে দেখতে পায় না। ঠিক সেই সময় হলে একটা গান বেজে ওঠে। সিয়ারা স্ক্রিনের দিকে ফেরে। নাম দেখানো শেষ করে এখন একটা “এন্ডিং সং” বেজে উঠেছে। সিয়ারা মাথা নীচু করে নিলে ওর চোখের সামনে কেউ একটা ওর পরিচিত বস্তু তুলে ধরে।

সিয়ারা: এটা তো আমার ডায়েরি!

সিয়ারা ডায়েরিটা হাতে নিয়ে পিছন ফিরতেই দেখে আধভিক দাঁড়িয়ে আছে। সে পিছন থেকে ওর চোখের সামনে ডায়েরিটা ধরে ছিলো। সিয়ারা সেটা নিয়ে নিতেই পকেটে হাত গুঁজলো।

আধভিক: হ্যাঁ আপনারই ডায়েরি। আপনার ডায়েরিটা ছাড়া এই সিনেমাটি তৈরীই হতো না মিসেস সান্যাল। থ্যাংক ইউ সো মাচ আমাকে এতটা হেল্প করার জন্য। (তাচ্ছিল্য হেসে)

সিয়ারা: আমি…

আধভিক: উহুঁ! আমার কিছু শোনার নেই আমার থেকে। আপনি যা করে দেখিয়েছেন সেটাই যথেষ্ট। আপনাকে তো পুরস্কৃত করা উচিত কোনো মানুষের জীবন সুন্দর ভেবে নরক বানিয়ে দেওয়ার জন্য। আপনাকে ঠিক কতবার থ্যাংক ইউ বলবো আমি বুঝে উঠতে পারছি না।

সিয়ারা কিছু বলে না, চুপচাপ সহ্য করে নেয় আধভিকের কড়া কড়া কথা গুলো।

আধভিক: প্রথমত, বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য যে, আমিই ঠিক ছিলাম। ভালোবাসা বলে কোনো কিছু হয়ই না। হলেও সেটা একতরফা থাকে। দ্বিতীয়ত, কখনও কোনো মানুষকে তাঁর যোগ্যতার বাইরে কিছু দেওয়া উচিত নয়। কারণ না চাইতেই মানুষ কিছু পেয়ে গেলে তাঁর মূল্য, মর্যাদা দিতে পারে না। তৃতীয়ত, আমার জীবনে না আসার জন্য। আমাকে বিয়ে না করার জন্য।

সিয়ারা মাথা উঠিয়ে আধভিকের চোখের দিকে তাকায়। শেষের কথাটা মেনে নিতে পারছে না সে।

আধভিক: আপনি আমার জীবনের সব থেকে বড়ো ভুল ছিলেন, বোঝানোর জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।

সিয়ারা: তুমি একবার আমার কথাটা তো শোনো..??

সিয়ারা আধভিকের দিকে এগোলে আধভিক পিছিয়ে যায়।

আধভিক: আমি তোমাকে ঠিক যতটা ভালোবাসতাম তার চাইতেও অনেক বেশি পরিমাণে ঘৃণা করি এখন। আমার জীবনে তোমার কোনো জায়গা নেই মিসেস সিয়ারা সান্যাল! আর আধভিক রায় চৌধুরী যাকে ঘৃণা করে তাঁর দিকে ফিরেও তাকায় না। তাঁর কথা শোনা তো দূরের বিষয়।

সিয়ারা: আমি মানছি আমি ভুল করেছি। কিন্তু আমি এমন কিছু করতে চাইনি।

আধভিক: করে তো দেখিয়েছো তাই না? আমার জীবনটাকে নাটক বানিয়ে রেখে দিয়েছো!! (চিৎকার করে) আমার ফিলিংস টা তোমার হাতের খেলনা ভেবেছিলে তাই তো নিজের বোনের হাতে তুলে দিয়ে চলে গেলে। ওয়াও! সিয়ারা ওয়াও! (হাত তালি দিয়ে) শেষমেশ যখন এটাই করবে তাহলে প্রথমেই কেন তুলে দিলে না? তখন কেন এসে আমার ভালোবাসা স্বীকার করে মিথ্যে নাটক করেছিলে?

সিয়ারা: তুমি, তুমি বিয়েটা করনি? (কান্না ভেজা কণ্ঠে)

আধভিক: (তাচ্ছিল্য হেসে) কোনো উত্তর নেই তাই কথাটা ঘুরিয়ে দিলে। যাই হোক কোনো উত্তরের আশা আমি তোমার থেকে রাখিনা ইনফ্যাক্ট কোনো কিছুর আশাই রাখি না কারণ তোমার সাথে আশা রাখার মত সম্পর্ক আমার নেই। সম্পর্ক যদি থেকে থাকে তাহলে সেটা ঘৃণার।

আধভিক পিছন ফিরে চলে যায়। যাওয়ার পথে দাঁড়ায় কিন্তু সিয়ারার দিকে ফেরে না। মাথা টা সিয়ারার দিকে কিছুটা ঘুরিয়ে আড় চোখে চেয়ে বলে,

আধভিক: একজনকে ভালোবেসে অন্যজনকে বিয়ে করাটা আধভিক রায় চৌধুরীর ইমেজ, পার্সান্যালিটির সাথে যায় না। সে বিশ্বাসঘাতক নয়, কথা দিয়ে কথার মূল্য দিতে জানে সে। তাই তাঁর জীবনেও বিশ্বাসঘাতক, প্রতারকের কোনো জায়গা নেই। তুমি আমার জীবনে একটা দুঃস্বপ্ন ছিলে সিয়ারা, যা ভোরের আলো ফুটতেই কেটে গেছে। তোমাকে ছাড়া বাঁচতে শিখে গেছি আমি। তুমি এখন না আমার প্রিয়জন আর না প্রয়োজন।

আধভিক চলে যায় আর সিয়ারা কাঁদতে কাঁদতে সেখানেই বসে পরে। গানের লাইনগুলো কানে পৌঁছালে রিলেট করতে পারে সিয়ারা।

“সোচ লিয়া তু খাব হেইন মেরা,
টুট গায়া জো আয়া সাওয়েরা
সোচ লিয়া হেইন বিন তেরে জিনা
সোচ লিয়া তোহ সোচ লিয়া।”

অনেকক্ষণ পরে সিয়ারা হল থেকে বেড়ালে সোহম এসে ওর সামনে দাঁড়ায়।

সোহম: চল। তোকে বাড়ি পৌঁছে দিই।

সিয়ারা: আমি চলে যেতে পারবো সোহম দা।

সোহম: এমন করিস না বোন। অনেক রাত হয়ে গেছে। এইভাবে তোকে একা ছেড়ে দেওয়া যায় নাকি?

সিয়ারা: (তাচ্ছিল্য হেসে) আমার একটা কথা শোনার সময় যখন তাঁর হয়নি তাহলে কেন তোমাকে দাঁড় করিয়ে রাখার পরেও নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করছে? যার জীবনে আমার কোনো জায়গাই নেই তাঁকে আমাকে নিয়ে ভাবতে না করো। আসলাম।

সিয়ারা বেরিয়ে যায় মাল্টিপ্লেক্স থেকে। রাত হয়ে গেছে। কিন্তু কেমন জানো এটাই ভালো লাগছে সিয়ারার। সে চেনে এখানকার রাস্তা তাই কোনো ক্যাব বুক করলো না। হাঁটা শুরু করলো। নিজের ডায়েরিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে, চলে আসার সময় ফেলে রেখে এসেছিলো এটা। হঠাৎই ওর মনে হয় ওর পিছনে কেউ একটা আসছে। ও দাঁড়িয়ে পরে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে একভাবে নিজের জায়গায়। কোনো সাড়াশব্দ না এলে সিয়ারা তাচ্ছিল্য হেসে এগিয়ে যেতে শুরু করে। মনে মনে ভাবে,

সিয়ারা: রাগ দেখানোর বেলায় যেমন আছে তেমন চিন্তা করার বেলায়ও আছে। মুখেই খালি বড়ো বড়ো কথা, ঘৃণা করে। তা এতই যখন ঘৃণা তখন গাড়ি ছেড়ে হেঁটে হেঁটে পিছু নেওয়ার কি দরকার? না ভাবলেই তো চলে?

মনে মনে হাসে সিয়ারা। একসময় নিজের বাড়ি পৌঁছে যায়। বাড়ি গিয়ে দরজা দিয়ে, কায়দা করে দরজার ফাঁকে চোখ রাখে। আধভিক একটু ভালো ভাবে দেখে নিয়ে, সিকিউরিটির সাথে কথা বলে চলে যায়। সিয়ারা বেরিয়ে সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করে আধভিক কি বললো তাঁকে। সিকিউরিটি বলে, “স্যার আপনার খোঁজই নিচ্ছিলেন ম্যাডাম। আপনি বাড়িতে ঠিক ভাবে ঢুকে গেছেন কি না।”

সিয়ারা: (মনে মনে– হম! তার মানে মিস্টার আধভিক রায় চৌধুরীর পাহাড় সমান অভিমান হয়েছে। সেটাই এখন ধীরে ধীরে ভাঙতে হবে। যতই হোক, ভুল তো আমার। এখন আমিই যদি রাগ দেখাই তাহলে কীভাবে হবে? আমাকে যে করেই হোক ওকে মানাতে হবে। আমার নিজেরও অনেক প্রশ্নের উত্তর নেওয়া বাকি।)

পরেরদিন সকালে,

আধভিক বিধ্বস্ত অবস্থায় নিজের কেবিনে, চেয়ারে বসে আছে উপরের দিকে তাকিয়ে। চোখের কোণে থাকা জল গাল গড়িয়ে পরার প্রমাণ রেখেছে শুকিয়ে গিয়ে। এমন সময় কেউ ওর দরজার লকটা খুললে আধভিক বিরক্ত হয়ে উঠে বসে। উঠে বসতেই দেখে সিয়ারা দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে।

সিয়ারা আধভিকের কেবিনে আসতেই আধভিককে এহেন অবস্থায় দেখে স্থির হয়ে যায়। শার্টের উপরের বোতামগুলো খোলা। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে আর দুই আঙুলের ফাঁকে একটা সিগারেট। সেটা দেখেই সিয়ারা নীচে তাকালো। যা ভেবেছিলো, অনেকগুলি সিগারেটের প্যাকেট পরে আছে। আশে পাশে তাকাতেই দেখলো সেন্টার টেবিলে ব্র্যান্ডেড হুইস্কির বোতল, সেখানেও সিগারেটের ফিলটার পরে আছে।

সব দেখে সিয়ারা একটু একটু করে আধভিকের দিকে এগিয়ে যায়। আধভিক নিজের অজান্তেই উঠে দাঁড়ায়, ততক্ষণে সিয়ারা আধভিকের সামনে এসে উপস্থিত। আধভিকের চোখ দুটো লাল হয়ে আছে, বুজে আসছে রীতিমতো। হঠাৎই সিয়ারার চোখ যায় আধভিকের বুকের বাম দিকে। শার্টের ফাঁক দিয়ে নিজের নামটা উঁকি দিচ্ছে। সিয়ারা চোখে জল নিয়ে নিজের নামটার উপর হাত রাখলে আধভিকও চোখ বুজে নেয় আর সিয়ারা নিজেও চোখ বুজে নেয়। সাথে সাথে সিয়ারার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরে। ধীরে ধীরে অনেকটা কাছে চলে যায় ও আধভিকের। আধভিক চোখ খুলে সিয়ারাকে নিজের এতো কাছে দেখতে পেয়ে ওকে কাছে টেনে নেওয়ার জন্য ধীরে ধীরে নিজের হাতটা তুলতে থাকে কিন্তু সে সময়ই….

__ভিকি দা?? ক্লাইন্ট এসে গেছে মিটিংয়ের জন্য। তুমি যাব….

[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে 🥀]

চেষ্টা করবো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here