কাঁচের গায়ে বৃষ্টি ফোঁটা পর্ব -০৫

#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (প্রথম পরিচ্ছদ)
–(পর্ব-৫)

————
ইহান টিস্যু বক্সটি এগিয়ে দেয় নিঝুমের নিকট। নিঝুম হেঁচকি তুলতে তুলতে ইহানের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। ইহান নিঝুমের কৌতুহল বুঝতে পেরে বলে,

“চোখের পানি-টানি মুছে এখনই ক্লিন করবে। এসব কান্না-কাটি এখানে চলবে না।”

নিঝুমের মনটা একরাশ অভিমানে ছেঁয়ে গেল মুহুর্তেই। কান্না গুলো দ্বিগুণ নাড়াচাড়া দিয়ে উঠল। সে কিছু না বলে টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু বের করে নিয়ে চোখের পানি মোছার বৃথা চেষ্টা চালাতে লাগল। যতগুলো টিস্যু নিচ্ছে ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে তবুও মোছা শেষ হচ্ছে না। অবশেষে ইহান বিরক্ত হয়ে টিস্যু বক্সটা নিয়ে নেয়। তারপর বলে,

“হয়েছে আর মুছতে হবে না। টিস্যু শেষ হয়ে যাবে কিন্তু তোমার মোছা শেষ হবে না। এবার ওড়না দিয়ে মুছো। আমি একটু বাহিরে যাচ্ছি এসে যেন দেখি এই ড্রামা ক্লোজ হয়েছে।”

ইহান কাবার্ড থেকে কিছু একটা বের করে নিয়ে বাহিরে চলে গেল। ইহান চলে যেতেই নিঝুম ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। এতক্ষণের জমানো কান্না যেন বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়ছে তার দুচোখ দিয়ে। মনে মনে ভাবে, ‘এই লোকটার সঙ্গে সারাজীবন কী করে পার করবে। আস্ত ড্রাগন একটা।”

——————-

বারোটা বাজতেই পার্লার থেকে বিউটিশিয়ান এসে হাজির। নিয়ম মাফিক আজ ওদের রিসেপশন। অনিলা খান খুব বড় করে রিসেপশন পার্টি এ্যারেন্জ করেছেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিঝুমকে তৈরি হয়ে পার্টিতে এটেন্ড করতে হয়। সকলেই বউ দেখে ভীষণ প্রশংসা করে। শুরুর দিকে ইহানের কোনো খোঁজ ছিল না হঠাৎ কোথা থেকে এসে দুপুরে হাজির হয়েছে।

সকলে বউ দেখছে আর নানাপ্রকার গিফট দিচ্ছে। তাদের মধ্যে একজন এলো মুখে মাস্ক পড়ে। খুব দ্রুত এসে আবার দ্রুতই চলে গেছে। তেমন কোনো কথা বলেনি। গিফট টা দিয়েই চলে গেছে। নিঝুমের একটু অদ্ভুত লেগেছে বিষয় টা কিন্তু বেশিক্ষণ সেই ভাবনা অব্যাহত থাকেনি। জন কোলাহলে বেমালুম ভুলে গেছে।

——————-

রিসেপশন পার্টি শেষ করে সব মেহমান নিজেদের মতো করে চলে গেছে। এখন বাড়িটা বেশ শান্ত শিষ্ট। নিঝুম ফ্রেশ হয়ে কেবল বিছানায় একটু গা এলিয়ে দিয়ে তখনই ইরা এসে হামলে পড়েছে। ইরা পর্দার আড়াল থেকে উকি দিয়ে বলে,

“বউমনি আসবো?”

নিঝুম শোয়া থেকে উঠে বসে। মৃদু হেসে বলে,

“এসো এসো।”

ইরা এক লাফে ভেতরে ঢুকে যায়। নিঝুমের কাছে গিয়ে বসে বলে,

“নিশ্চয়ই তুমি খুব ক্লান্ত। আর আমাকে দেখো তোমার সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার লোভ টা সামলে উঠতে পারলাম না।”

“নাহ, নাহ ঠিক আছে ভালো করেছ এসে। চলো আমরা গল্প করি।”

ইরা ভীষণ খুশি হয়ে যায়। দু’জনে আড্ডায় মশগুল হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে নিঝুম ইরাকে বলে,

“আচ্ছা ইরা তুমি কীসে পড়ো?”

“অনার্স প্রথম বর্ষে।”

“ওহ আচ্ছা খুব ভালো।”

এভাবেই দুজন কথা বলছে। এবার ইরা বলে,

“জানো বউমনি তোমাকে পেয়ে আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। এ বাড়িতে আমার সঙ্গী বলতে কেউ ছিল না। এখন তুমি আর আমি একসঙ্গে থাকব সবসময়। তোমার বিয়েটা অনাকাঙ্খিত হলেও বিয়ে তো বিয়েই বলো। তুমি কখনো আমাদের ছেড়ে যেও না বউমনি। আমার ভাইটাকে ভালবেসে আপন করে নাও। জানো ওর মনে না অনেক কষ্ট কিন্তু কখনো প্রকাশ করতে চায় না। কঠোরতা দিয়ে ঢেকে রাখতে চায়। আমার ভাইটা না আগে এমন ছিল না। এক কালবৈশাখী ঝড় এসে তছনছ করে দিয়ে গেছে আমাদের জীবন। বাবাকে হারিয়েছি আমরা তখন। আচ্ছা বউমনি তুমি পারবে না আমার ভাইটাকে ঠিক আগের মতো প্রাণোচ্ছল করে তুলতে। পারবে না বলো? ভালবাসবে তো ওকে? কী হলো বলো, বলো?”

নিঝুম তেমন কিছুই বুঝতে পারল না ইরার কথার। তবুও একটি কথাই বলল,

“কিন্তু তোমার ভাই যে একটা মাস্তান। একটা মাস্তানকে কীভাবে মেনে নিবো?”

ইরা বিস্মিত হয় নিঝুমের কথায়। তার ভাই মাস্তান। এটা কী করে সম্ভব। ইরা বিষ্ময়কর দৃষ্টি নিয়ে বলে,

“এসব তুমি কী বলছ বউমনি? ভাইয়া কী করে মাস্তান হবে?”

“আরে হ্যাঁ ইরা তোমার ভাই একটা মা’স্তা’ন। আমি দু দু বার তাকে রাস্তায় ফাইটিং করতে দেখেছি। যাদেরকে মে’রে’ছে তাদের প্রায় যায় যায় অবস্থা। আচ্ছা তুমিই বলো মাস্তান না হলে কী এমনটা কেউ করতে পারে?”

ইরা এবার বুঝতে পারে সবটা। সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে এক প্রশান্তিময় হাসি হাসে। নিঝুম বোঝে না এ হাসির অর্থ তাই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে।
হাসি থামিয়ে ইরা বলে,

“এবার বুঝেছি বউমনি। তুমি ভাইয়াকে ফাইট করতে দেখেছ ঠিক আছে কিন্তু ও মা’স্তা’ন নয় ও তো…… ”

ইরার কথা শেষ হওয়ার আগে সেখানে অনিলা খানের আগমন ঘটে। তিনি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,

“কী এতো আলাপ হচ্ছে ননদ-ভাইবৌ তে মিলে?”

নিঝুম মাথা নিচু করে ফেলে। ইরা একগাল হেসে বলে,

“গল্প করছিলাম মা। তুমিও এসো। আমাদের সঙ্গে জয়েন হও।”

অনিলা খান বললেন,

“আমি এসেছি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে।”

“কী কাজ মা। বলো?”

“কাজটা নিঝুমের সঙ্গে।”

নিঝুম এবার মৃদু আওয়াজে বলে,

“জ্বী বলুন কী কাজ আমি এখনই করে দিচ্ছি।”

অনিলা খান হুইলচেয়ার টেনে নিঝুমের কাছে আসলেন। অতঃপর বললেন,

“সকাল থেকে অনেক ধকল গেছে। বাড়ির সকলের জন্য মন পুড়ছে নিশ্চয়ই। পারলে ফোনে কথা বলে ক্ষমা চেয়ে নিও তাদের থেকে। একটা কথা সবসময় মনে রাখবে, ‘বাবা- মা যতই অন্যায় করুক, ভুল করুক না কেন তারা কিন্তু বাবা- মা ই। তাদের মনে কষ্ট দেওয়া উচিত নয়৷’ যেটা বলতে এসেছি। তুমি কতদূর অব্ধি পড়ালেখা করেছ?”

“অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়তাম।”

“হুম। বিয়ের আগে নিশ্চয়ই তোমার কোনো স্বপ্ন ছিল। তুমি নিশ্চয়ই চাইতে পড়াশোনা করে বড় কিছু হবে। তুমি চাইলে তোমার ইচ্ছে পূরণ করতে পারো। এখান থেকেই পড়ালেখা কন্টিনিউ করে যেতে পারো। তোমার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে কেউ বাঁধা হয়ে দাড়াতে আসবে না।”

নিঝুম মায়াভরা নয়নে তাকিয়ে থাকে অনিলা খানের দিকে। এই মানুষটার প্রতি তার শ্রদ্ধা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। নিঝুম চোখ ভর্তি আনন্দ অশ্রু নিয়ে বলল,

“জ্বী আমি অবশ্যই চাই আমার স্বপ্ন পূরণ করতে।”

অনিলা খান হাসিমুখে বললেন,
“গুড গার্ল। তবে ইরার সঙ্গে তুমিও রোজ কলেজ যাবে। প্রয়োজনীয় টিউশন নেবে। কখনো কিছুর প্রয়োজন পরলে নির্দ্বিধায় আমাকে জানাবে। কখনো সংকোচ করবে না। মনে রাখবে আমি যদি ওদের মা হই তবে তোমারও কিন্তু মা।”

“হুম।”

“আচ্ছা তোমরা গল্প করো আমি আসি তাহলে।”

“আচ্ছা।”

অনিলা খান চলে যায়। তিনি চলে যেতেই ইরা উৎফুল্ল হয়ে বলে,

“বউমনি তুমি তো আজকে অনেক গিফট পেয়েছ চলো সেগুলো দেখি।”

নিঝুমও সায় জানিয়ে বলে,

“আচ্ছা ঠিক আছে চলো তবে।”

এত্তো এত্তো গিফট। দু’জনে এক এক করে খুলতে শুরু করে। একটাতে সুন্দর একটা ডিনার সেট। ডিজাইন টা বেশ আকর্ষণীয়। একটাতে বেশ সুন্দর কয়েকটি শাড়ি। নিঝুমের কালো রঙের একটি শাড়ি বেশ পছন্দ হয়। এভাবেই একে একে তারা গিফটগুলো খুলে খুলে দেখতে থাকে। বেশিরভাগই ঘর সাজানোর সরঞ্জাম এক পর্যায়ে ইরার হাতে বেশ ভারী এবং বড় একটি গিফট বাধে। ইরা কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে গিফট টি নিঝুমের হাতে তুলে দিয়ে বলে,

“বউমনি দেখো তো এতে কী আছে। এটা সবগুলো গিফট থেকে আলাদা। ভীষণ ভারী আর বড়।”

নিঝুম প্যাকেট টি হাতে নেয়। কৌতুহলী মনে খুলতে শুরু করে। র‍্যাপিং পেপার খোলার পর ভেতর থেকে বড় একটি বাক্স বের হয়ে আসে৷ নিঝুম বাক্সটি ধীরে ধীরে খুলতে থাকে। ইরা অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছে ওর মধ্যে কী আছে জানার জন্য। অবশেষে খোলা সম্পন্ন হলো। কিন্তু বাক্সের ভেতরের গিফট চক্ষু সম্মুখে স্পষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিঝুম গগনবিহারী চিৎকারের সঙ্গে ছিটকে কয়েক কদম দুরে চলে গেল। ইরাও বেশ ঘাবড়ে গেল। নিঝুম চোখ বন্ধ করে থরথর করে কাঁপছে। এটুকু সময়েই ঘেমে-নেমে একাকার অবস্থা। অনিলা খান ততক্ষণাৎ সেখানে উপস্থিত হন। নিঝুম ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে কাঁপতে কাঁপতে মেঝেতে ঢলে পড়তে নেয় ঠিক তখনই কেউ তাকে বক্ষপিঞ্জরে আবদ্ধ করে নেয়। নিঝুম পুরোপুরি চোখ বন্ধ করার আগে এক পলক তাকায়। অনেক চেষ্টা করে নিজেকে শক্ত রাখার কিন্তু পারে না।

——————–

চলবে,
®সাদিয়া আফরিন নিশি

(গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here