কাঁচের গায়ে বৃষ্টি ফোঁটা পর্ব -১০

#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (প্রথম পরিচ্ছদ)
–(পর্ব সংখ্যা – ১০)

————————
গাড়ি এসে গেছে। ইরা আর নিঝুম গাড়িতে উঠে বসে। ইরার থমথমে মুখ দেখে নিঝুম চুপসে আছে। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে অনেক কিছু কিন্তু কোথাও একটা বাঁধা কাজ করছে। নিঝুমকে উশখুশ করতে দেখে ইরা নিজেই মুখ খুলল,
-‘ কিছু বলবে?’

ইরা’র অগ্রীম কমেন্টে যেন নিঝুম সাহস পেল।
-‘হুম, বলব। আসলে ওই ছেলেটা কে? তোমার সঙ্গে কীসের ঝামেলা ওর?’

ইরা’র মুখটা দ্বিগুণ থমথমে হয়ে গেল। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে মুখ খুলল,
-‘তেমন কিছু নয়।’

ইরা ফের নিশ্চুপ। নিঝুম বুঝতে পারল ইরা হয়তো বলতে চাইছে না। সেও আর কথা বাড়ায় না। কারো পারসোনাল ম্যাটারে ইন্টারফেয়ার করাটা ভালো দেখায় না।

বেশখানিক সময় নিয়ে চলল নিস্তব্ধতা। গাড়ি কিছুদূর যেতেই নিঝুমের চিৎকারে চমকে ওঠে ইরা। সে এতক্ষন গভীর ধ্যানমগ্ন ছিল। নিঝুম সে রাতের মতো থরথরিয়ে কাঁপছে। তার দৃষ্টি বাহিরে। এক হাত দিয়ে ড্রাইভারকে কিছু একটা বলতে ইশারা করছে। ইরা নিঝুমের হাতের ইশারা অনুসরণ করে ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে। গাড়ি থেকে যায়। ইরা উদ্বীগ্ন কন্ঠে নিঝুমকে জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে। নিঝুম গাড়ির জানালা হতে হাত বের করে দুরে কিছু দেখায়। এখনো শরীর অসম্ভব কাঁপছে তার। দৃঢ় দৃষ্টি বাহিরে নিবদ্ধ রেখে কম্পিত কন্ঠে বলে,
-‘ ব..ব.. বলেছি..লাম না তোমার ভা..ভাই একটা মা’স্তা’ন।’

ইরা নিঝুমের দেখানো পথে চোখ বুলায়। দীর্ঘ শ্বাস টেনে বলতে নেয়, ‘আরে ভাইয়া তো…. ‘

ইরা কথা শেষ করতে পারে না। নিঝুমের দিকে তাকিয়ে দেখে সে সে’ন্স’লে’স হয়ে পড়ছে। দিশেহারা ইরা এক হাতে নিঝুমকে জড়িয়ে নেয়। অন্য হাতে ইশানকে কল করে। এদিকে ড্রাইভারকে বলে সিটি হসপিটাল গাড়ি টানতে।

——————-
ইরা আর ইশান চিন্তিত ভঙ্গিতে হসপিটালের করিডোরে বসে আছে। ইরা এসেই ইশানকে কল করেছে ইশানও সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছে। ইহানকেও জানানো হয়েছে। সেও আসছে।

-‘কী হয়েছে ছোট ভাইয়া কী ভাবছিস?’
-‘ভাবছি এই মেয়েটাকে আর না জানি কত কী সহ্য করতে হয়।’
-‘হুম, বউমনি’র তো কোনো দোষ নেই। অযথাই কষ্ট পেতে হচ্ছে ওকে। আচ্ছা ভাইয়া কী কখনো ওকে মেনে নেবে?’
-‘কী জানি। হয়তো নেবে নয়তো না।’

ওদের কথার মধ্যেই ইহানকে দেখা যায় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে। ইহানকে দেখে দুজনেই এগিয়ে আসে।

-‘ কী হয়েছে? কী অবস্থা এখন?’
-‘ডক্টর দেখছে’
-‘ কী হয়েছিল?’
-‘ কলেজ থেকে ফেরার পথে তোমাকে ফাইট করতে দেখে নিয়েছে। আর যাকে মা’র’ছি’লে তার শরীরের রক্ত দেখেই সে’ন্স’লে’স।’
-‘ওহ শীট! ইডিয়েট একটা।’

তখনই ডক্টরের উপস্থিতি। তিনজনই এগিয়ে যায় ডক্টরের কাছে। ডক্টর ইহানকে বলেন,

-‘পেসেন্ট কী হয়?’

ইহান কোনো রকম ভনিতা ছাড়াই বলে,
-‘ মাই ওয়াইফ।’

ডক্টর কিছু একটা ভেবে ইহানকে তার চেম্বারে ডাকেন। ইহান ইরা আর ইশানকে নিঝুমের দিকে খেয়াল রাখতে বলে ডক্টরের সঙ্গে যায়।

-‘ ওনার রক্তে ফোবিয়া জনিত সমস্যা আছে। হার্ট ভীষণ দুর্বল। এ ধরনের রোগীরা রক্ত দেখলেই সেন্স হারায় এটাই স্বাভাবিক। তবে এই সেন্স হারানো বিষয়টি কিন্তু মা’রা’ত্ম’ক ক্ষতিগ্রস্ত বিষয়। রোগীর মন, মস্তিষ্কে সমান ভাবে চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম এই বিষয়টি। এ থেকে যেকোনো সময় বড় কোনো ক্ষতিও হতে পারে। সো বি কেয়ারফুল। আপনাদের অনেক বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। রোগী যাতে এমন পরিস্থিতির স্বীকার খুব একটা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’

-‘এ থেকে মুক্তি লাভের কী কোনো উপায় নেই?’

ডক্টর একটু ভেবে বললেন,
-‘ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন প্রচুর। সময় সাপেক্ষ। মনে হচ্ছে এ সমস্যা অনেক আগে থেকে। ট্রিটমেন্ট চলতে থাকলে ধীরে ধীরে হয়তো ঠিক হতে পারেন। আশা করা যায়। আচ্ছা ঠিক বলতে পারবেন রোগীর এমনটা কতবার হয়েছে বা হতে পারে? আই মিন মেডিকেল হিস্ট্রি চাইছি আরকি।’

-‘ মেডিকেল হিস্ট্রি তো জানা নেই। তবে বিয়ের পর এই নিয়ে তিনবার হলো। কিন্তু বিয়ের আগেরটা জানা নেই।’

-‘ওকে দেখছি কী করা যায়। এখন মেডিসিন দিচ্ছি বাড়িতে নিয়ে যান। আমি আপনাকে এ বিষয়ে পড়ে জানাচ্ছি।’

-‘ ডক্টর এখন কী রিস্ক মুক্ত?’
-‘এখনকার মতো।’
-‘ওকে! থ্যাংকিউ ডক্টর।’
-‘আপনাকেও।’
-‘ আসি তবে।’
-‘প্রয়োজনে আবার আসবেন।’
-‘সিওর।’

নিঝুম বেডে শুয়ে আছে। শরীর প্রচন্ড উইক। ইরা, ইশান টুকটাক কথা বলে ওকে স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করছে। তখনই ইহান চিন্তিত মুখে প্রবেশ করে। ইশান এগিয়ে যায়।

-‘ কী বলল ডক্টর?’
-‘ আপাতত ডে’ঞ্জা’র মুক্ত কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে।’
-‘হুম’

নিঝুম ইহানকে দেখে কেমন জানি করে ওঠে। তার ফের তখনকার ঘটনা মনে পড়ে যায়। উত্তেজিত হয়ে ইরাকে বলতে থাকে,
– ‘তুমি দেখেছ তো ইরা তোমার ভাই একটা মা’স্তা’ন। আমি বলেছিলাম না। ওই লোকগুলোকে কীভাবে ইশ….’

নিঝুম চোখ বন্ধ করে নেয়। কিঞ্চিৎ কাঁপছে তার শরীর। ইরা শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে বলে,।
-‘প্লিজ বউমনি আমার কথা শোনো। ভাইয়া কোনো মা’স্তা’ন নয়। ভাইয়া তো….. ‘

ইরা কথা শেষ করতে পারে না। তার আগেই ইহানের ইশারার চুপ হয়ে যায়। ইহান ইরা আর ইশানকে বাহিরে ওয়েট করতে বলে। ওরা তাই করে। কিন্তু নিঝুম ভয়ে সিটিয়ে থাকে। ইহান ধীর গতিতে এগিয়ে নিঝুমের সামনে গিয়ে বসে। নিঝুম কিছুটা সরে যায়। তার হাবভাব অস্বাভাবিক। ইহান নিঝুমের এক হাত টেনে নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। নিঝুম দিতে নারাজ কিন্তু ইহান নাছোড়বান্দা। ইহান নিঝুমের অনেকটা কাছে এগিয়ে যায়। চোখে চোখ রেখে বলে,
– ‘তাকাও আমার দিকে।’

নিঝুম তাকায় না। সেভাবেই কাঁপতে থাকে। ইহানের ফের শান্ত কন্ঠ,

– ‘নিঝুম! তাকাও।’

ইহানের মুখ প্রথম নিজের নামটা শুনে কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হয় নিঝুমের। কিছুটা ভুলতে থাকে সবকিছু। ধীরে ধীরে ফিরে তাকায় ইহানের মুখের দিকে। ইহান নিঝুমের চিবুক তুলে ধরে,

– ‘ তুমি যা দেখেছ তা সম্পূর্ণই ভুল। এসব তোমার হ্যালুসিলেশন। তুমি সর্বক্ষণ এটাই ভাবো তাই তোমার চোখে শুধু এসবই ভাসে। বিশ্বাস না হয় ডক্টরকে জিজ্ঞেস করো। তিনিও এটাই বলবেন। আমি কোনো মা’স্তা’ন নই৷ আমি তোমার হাসবেন্ড।’

নিঝুম হয়তো কিছুটা গললো। ইহানের মুখের দিকে বোকাসোকা ভঙ্গিতে চেয়ে রইল। ইহান পর হাতটা ধরে বেড থেকে নামাল। নিঝুম এখনো ইহানকে দেখতেই ব্যস্ত। অতঃপর দু’জনে সেভাবেই বেড়িয়ে গেল। ইহান মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। আপাতত ব্রেইনওয়াশ সার্থক।

——————
কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন। নিঝুম এখন এই পরিবারে নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছে। এটা এখন তার নিজের বাড়ি বলেই মনে হয়। মাঝে মধ্যে বাবার বাড়ির জন্য মন কেমন করে তবে সেটাও আলগোছে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ইহানের সঙ্গে তার সম্পর্কটা কেমন নোনতা নোনতা। ইহান সর্বদাই রেগে থাকে আর সে ইহানকে ইমপ্রেস করার টুকটাক চেষ্টা করে আরকি। মূলত সে কিছুটা ইহানের প্রেমে ভাসছে তবে মুখ ফুটে কাউকেই বলেনি। ইরা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ইনিয়ে বিনিয়ে বেশ মজা নেয়। নিঝুম তখন লজ্জায় মিয়িয়ে যায়। সবকিছুর মধ্যে ইহান রাতে কোথায় থাকে এটা এখনো নিঝুমের অজানা। সে এটা নিয়ে গভীর তদন্তে আছে। ইহানকে ফলো করার বা কাউকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে চায় না সে।

এমনই এক সকালে, নিঝুম তার শ্বাশুড়ি অনিলা খানের ঘরে পা রাখে। অনিলা খান তখন বুকশেলফের বইগুলো সোজা করে গুছাও নিচ্ছে। নিঝুম গিয়ে পেছন থেকে তাকে জাপটে ধরে। আচমকা তিনি ভয় পেয়ে যান। পরক্ষণে বুঝতে পেরে হাত উল্টিয়ে নিঝুমকে আগলে নিয়ে বলে,

– ‘সকাল সকাল কী হয়েছে আমার মেয়েটার?’
– ‘কিছু না এমনিতেই।’
– ‘কিছু তো অবশ্য হয়েছে। বল তো তাড়াতাড়ি।’

নিঝুম আমতা আমতা করে বলে,’ একটা কথা বলি?’

-‘শুনতেই তো চাইছি।’
-‘সত্যি বলবে কিন্তু’
– ‘ হুম বল।’
– ‘ তোমার পায়ের এ অবস্থা কী করে হলো। মানে আমি ছবিতে দেখেছি তুমি আগে দাড়াতে পারতে তবে এখন এ অবস্থা কেন?’

অনিলা খান থমকে যান। মুহূর্তেই তার হাসোজ্জল মুখশ্রী ছেয়ে যায় ঘন কালো আধারে। নিঝুম জোরাজুরি করেই চলেছে কিন্তু সে শুনছে কী না কে জানে?

——————-

চলবে,
®সাদিয়া আফরিন নিশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here