কাঁটায় লেখা ভাগ্য পর্ব -০৫

#কাঁটায়_লেখা_ভাগ্য
পর্ব—০৫
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।

মেয়েটার কথা আমাকে পুরোপুরি স্তব্ধ করে দিলো।এতো সে আমার কাহিনীই আমাকে শোনাচ্ছে।মেয়েটা এরপর মাথার ওপর থেকে ঘোমটাটা সরিয়ে ফেললো।এরপর যে দৃশ্য দেখতে পাই নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না আমি।

আমি আমার সামনে আমাকেই দেখতে পাচ্ছি!মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে আমায় বলতে লাগলো।

—ওরা নিশ্চিত আমায় আমার স্বামীর সাথে জ্যান্ত কবর দিয়ে দেবে,জানিনা কেমনে বাঁচবো আমি এদের হাত থেকে!
আর জানো তুমি এই সবকিছুর পেছনে আমার আম্মা।ও আমার ভালো চায়না!

মেয়েটার দিকে হতবাক হয়ে আমি তাকিয়ে আছি।আমার মুখ বলার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না!কাঁপা কাঁপা গলায় তাকে জিজ্ঞেস করি।

—কে তুমি….?সত্যি করে বলো কে তুমি?

—আমি মান্নাত বললাম তো!দেখো তোমার আমার নাম আর চেহারায় কি অদ্ভুত মিল।

—এটা হতে পারে না,কিছুতেই হতে পারে না এটা।সত্যি করে বলো কে তুমি,তোমার পরিচয় কি?

—আরে বাবা বললাম তো!আমি মান্নাত।আর এই যে বাড়িটা দেখছো এটা আমার বাড়ি।যার লাশটা দেখতে পাচ্ছো ওটা আমার স্বামী।আসিফ শেখ।আর যে পাশে বসে কান্না করছে…

—তোমার আম্মা তাই তো?তোমার আম্মাই আসিফ শেখরে জোর করে তোমার সাথে বিয়ে দিয়েছে।কিন্তু আসিফ শেখ শেষ পর্যন্ত নিজের বুকে ছুরি মেরে নিজেরে শেষ করে দিয়েছে তাই না?

—হ্যাঁ…তাই তো?কিন্তু তুমি এতোকিছু কিকরে জানলে?বাসরঘরে তো গতকাল রাতে আমি ছাড়া কেউ ছিলো না।

—আমি জানতে পারলাম কারণ তুমি আর আমি একই মানুষ।এ পর্যন্ত তোমার সাথে যা যা হয়েছে এ সবকিছু আমার সাথেও ঘটেছে।আমরা দুজন আলাদা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলেও আমরা আলাদা নই।শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এটাই সত্যি – তুমিও যা আমিও তাই!

আমার কথা শুনে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মান্নাত হা করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।এরপর বলতে লাগলো।

—তোমার কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে,কি বলছো তুমি এগুলো?আমরা দুজন এক মানুষ কিকরে হতে পারি?না এটা অসম্ভব…
তুমি আমার বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছো।

—আমি যদি মিথ্যেই বলবো তাহলে তোমার বাসর রাতের ঘটনা কিকরে জানলাম।আর আমি তোমায় দরকার হলে আরোও প্রমাণ দিচ্ছি।

—কি প্রমাণ দেখাবে দেখাও।

—আমার বাম পায়ে একটা দাগ আছে,ছোটোবেলায় তাকদীর ভাইয়ের ধাওয়া খেয়ে কেটে গিয়েছিলো।এখনো সেই দাগ শুকোয়নি।

—হ্যাঁ।আমার পায়েও তো কাঁটা দাগ আছে,তুমিও তাকদীর ভাইয়কে চিনো?

—কেনো চিনবো না মান্নাত!এমন কোনো কিছু হতেই পারে না যা তোমার চেনা অথচ আমার অচেনা।আমরা যে একই।

—আমি এখনও তোমার কথার স্পষ্ট বুঝতে পারছি না।আচ্ছা একটা শেষ প্রশ্ন।বলো তো,তাকদীর ভাইয়ের সাথে আমাদের শেষ দেখা কবে হয়েছিলো।

—তাকদীর ভাই তার মামা বাড়িতে যাবার আগে…

—সেটা তো বুঝলাম কিন্তু কোথায় বসে…?

—আমার মুখ থেকেই সত্যিই সেটা শুনতে চাও তুমি?

—হ্যাঁ শুনতে চাই।

—ওনাদের বাড়ির ঝোপের ধারে,উনি আদর করে দিয়েছিলো আমাকে।আমি একপ্রকার জোর করে ওনার কাছ থেকে ছুটে আসি।

—কোথায় কোথায় আদর করেছিলো তোমায়?

আমি মান্নাতের প্রশ্ন শুনে রীতিমত অবাক হয়ে গেলাম।ও একের পর এক প্রশ্নের গভীর পরতে ঢুকে যাচ্ছে।আমার ভীষণ সংকোচ হচ্ছে ওর প্রশ্নের উত্তর দিতে।কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম মান্নাত আর আমি আলাদা কেউ নেই।নিজের কাছে নিজের আবার কিসের লজ্জা।

—কী হলো চুপ করে আছো কেনো,বলো?

—কপালে একটা,দুগালে দুটো।এরপরে ঠোঁটের ওপরে তার ঠোঁট রাখতেই আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম।

—হ্যাঁ তাই তো।সব মিলে যাচ্ছে।আমাদের দুজনের সবকিছু এভাবে মিলে যাচ্ছে কিকরে?তাহলে তুমি যা বলেছো তাই কি সত্যি।এটা কোনো ভ্রম নয় তো,আমরা কোনো স্বপ্নের ভেতরে নেই তো?

—আমায় স্পর্শ করে দেখো…এই দেখো হাত বাড়িয়ে দিলাম।

আমি হাত বাড়িয়ে দিতেই মান্নাত আমার হাতটা ধরলো।আমরা দুজন দুজনের অস্বস্তি অনুভব করতে পারছি।

—কি দেখলে তো আমরা কোনো স্বপ্নের ভেতরে নেই না কোনো ভ্রম হচ্ছে আমাদের।

—তাহলে এখন কি করা উচিত?আমাদের দুজনেরই যে বিপদ।আমি চাই না তুমি বা আমি ধরা পড়ি,একবার ধরা পড়ে গেলে ওরা জ্যান্ত কবর দিয়ে দেবে আমাদের।

—একদম তাই।
আচ্ছা তুমি কি জানো আম্মা আমাদের সাথে কেনো এমন করছে…উনি তো আমাদের নিজের মা।তাহলে আমাদের মারতে কেনো চাইছে?

—তুমি না জানলে আমি কিকরে জানবো।আমাদের যেরকেই হোক আম্মার এই সত্যিটা খুঁজে বের করতেই হবে।মা হয়ে পেটের মেয়ের সাথে এতো বড়ো বর্বরতা কিকরে করে?

আমরা দুজন গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে বাড়ির ভেতরে দৃশ্য দেখছি।মান্নাত আমার পেছন থেকে কাঁধের ওপরে হাত রেখে আছে।একটু পরে সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাড়ির ভেতরে তাকদীর ভাই এসে ঢুকে পড়লো।সে আসিফ শেখের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো।

—কি হলো এই বুড়োটা মরলো কিকরে?

—নিজেই নিজেরে খু*ন করছে,নিজের বুকে ছুরি চালাইয়া ম*রছে।

—ভালো করছে,খুব ভালো করছে।যে লোক নিজের সৎ মাইয়ারে বিয়া করবার পারে তার এর থেকেও কঠিন সাজা পাওয়া উচিত ছিলো।
তা তোমরা এর লাশ দাফন না করে বইসা আছো কেনো?

—আমরা সবাই মান্নাতের জন্য অপেক্ষা করতেছি।ওরে ছাড়া এই লাশ কবরে নামানো যাইবো না।

—মানে কি কইতেছো তোমরা?এই বুড়ার লাশের সাথে মান্নাতের কি সম্পর্ক এখন?

—তুমি এতো কথা কেন কও মিয়া,কিছুই তো জানো না।আমরা যা করতেছি এই গ্রামের ভালোর জন্য করতেছি।আর গ্রামের ভালো মানে তোমারও ভালো।

—আমি কিছু বুঝবার পারতেছি না।কি করলে কি ভালো হইবে তোমরা বলো আমারে?

—আসিফ শেখ মান্নাতের মায়েরে স্বপ্নে আদেশ দিছে যেনো তার লাশের সাথে মান্নাতেরেও জ্যান্ত মাটি দেওয়া হয়।নয়তো এই গ্রাম ছারখার করে দেবে সে।

—এই কথা এই বুড়া কইছে ম*রার পর?ম*রা মানুষ আবার কথা কয় কেমনে?

—আমরা এতো কিছু জানি না।মান্নাতরে ওর স্বামীর সাথে কবর দেবার সিধান্ত আমাগো কারোর না,ওর মায়ের।তার পেটের মেয়ে সে তো আর এমনে এমনে নিজের মাইয়ার সর্বনাশ করবে না।

গ্রামবাসীর কথা শুনে তাকদীর ভাই আম্মার দিকে এগিয়ে আসলো।এরপর তার দিকে ক্রোধের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলতে লাগলো।

–ঐ মান্নাতের আম্মা,তোমার কি মাথা গেছে।তুমি নিজের মাইয়ারে কবরে পাঠাইতে চাও কেমন মা তুমি?তুমি আদৌ ওর মা তো?

—বাজান আমি যা করতেছি সবার ভালোর জন্যই করতেছি।তুই ভুল বুঝিস না আমারে।আমি জানি তুই আমার মাইয়ারে বড্ড ভালোবাসতি।ওরে বিয়াও করতে চাস।কিন্তু আমি কি করবো,আমার যে হাত পা বাইন্দা দিছে আল্লাহ।

—একদম আল্লাহর নাম নিবা না।আল্লাহ কিছু করে নাই,যা করার তুমি করছো।এহন আবার আল্লার দোষ দিতাছো।আচ্ছা মান্নাত কোথায়,ওরে তো দেখতে পাইতেছি না।

—ও পালাইছে।ওরে পাইলে আইজ আর রক্ষা নাই।দরকার পড়লে যে বাঁধা দিতে আইবো তারে সুদ্ধ মাটি দিমু আজ ঐ মাইয়ারে।

এই বলে গ্রামবাসীরা একজোট হলো।ঠিক তখন আমি অনুভব করি পেছন থেকে মান্নাত আমায় চেপে ধরেছে।এরপর আমায় বলতে লাগলো।

—এই সুযোগ!আমি আমার তাকদীর ভাইরে তোমার হইতে দিবো না কিছুতেই।যাও মরো গিয়ে এবার।নিজের স্বামীর সাথে তার কবরে যাও…

এই বলে মান্নাত আমায় গাছের আড়াল থেকে ঠেলে উঠানোর দিকে ফেলে দিলো।গাছের পেছনে থাকাতে গ্রামবাসীরা ওকে দেখতে না পেলেও আমায় পেয়েছে।অমনি হায়নার মতো দল বেঁধে ছুটে আসে আমার দিকে।আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি মান্নাত আড়াল থেকে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে!

—হায় আল্লাহ,এ কোন পরীক্ষার মুখে ফেললে আমায় তুমি।আমি নিজেই কিনা এখন নিজের শত্রু?!

চলবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here